Wednesday, July 17, 2019

আমার স্বর্গের প্রতিপক্ষ (ছোটগল্প)



 
আমার স্বর্গের প্রতিপক্ষ
- গুলশান চৌধুরী


জায়গাটির নাম কে কবে নিমতলী বাজার রেখেছিল কে জানে? বাজারটা মক্কা রোডের নাজলা এলাকার পুরোনো অংশে। ১৯৭৬ সালে জেদ্দায় বাংলাদেশ দূতাবাস হবার পর খুব দ্রুত বাঙালী জনপদ গড়ে ওঠে এখানে। প্রবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য গড়ে ওঠেছিল বাংলাদেশ দূতাবাস হাইস্কুল। যার কারণে মক্কা, মদীনা, তায়েফ, আভা, বাহা এসব শহরের তুলনায় এখানে বাঙালীদের বসতি ঘনতম। জেদ্দার মরুতপ্ত রাজপথের দু‘পাশে যদিও কিশোর বয়েসী নিমগাছের চোখজুড়ানো পত্রপল্লব এখন আর নূতন কিছু নয় তবু এ বাজারে নিমগাছের ঘনছায়া একটু বেশিই চোখে পড়ে। প্রাণে হয়ত মাতৃভূমির কিছুটা ছোঁয়া লাগে। তাই স্বদেশের গাবতলী, কদমতলী, হিজলতলী, শিমুলতলী ইত্যাদি নামের সাথে মিল রেখে প্রবাসী বাঙালীদের মুখে মুখে সহজেই এ বাজারের নাম হয়ে গেল নিমতলী বাজার। বেশিরভাগ দোকানীও বাংলাদেশী। অসংখ্য বাংলা সাইন বোর্ড  প্রাণের ভেতর সুর তুলে - আ-মরি বাংলাভাষা।  
নিমতলীতে এলে সাইনবোর্ডের গর্বিত বাংলা অক্ষর দেখতে দেখতে প্রথমেই সজীব সুপার মার্কেটে ঢুকে পড়ি। পারভীনের জন্য বাংলা পত্রিকা আর ম্যাগাজিন কিনি। আমার নাইট ডিউটি থাকলে রাত জেগে অপেক্ষা করে। কত নিষেধ করি, শরীরের এ রকম অবস্থায় রাত জাগা ঠিক নয়। কে শোনে কার কথা ? হাল ছেড়ে দিয়ে এখন পত্র-পত্রিকার ব্যবস্থা করেছি। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে। 
ডিউটি শেষে গাড়িতে ওঠার আগে মনে পড়ল বেশ কিছুদিন ধরে আইসক্রীম কেনা হয়নি। জিনিসটা ওর বড্ড প্রিয়। হাতে দিলেই যেন খুকী হয়ে যায়। আমার খুব মজা লাগে। বিনিময়ে যা চাই, টুক করে দিয়ে দেয়। হাসিমাখা ঠোঁটজোড়া চোখে ভাসতেই মনে পড়ল সারাওয়াত সুপার মার্কেটে যেতে হবে। পার্পল কালারের লিপস্টিকের কথা কবে যেন বলেছিল। তাছাড়া ওর পছন্দের কিছু কাবাবও কিনতে হবে। আসলে ঘরে ফেরার সময় ওই অপেক্ষমান হাসিমুখটির জন্য রোজ কিছু না কিছু না নিলে দিনান্তে আমার সার্থকতাই যেন অপূর্ণ রয়ে যায়। তাই নিদেন পক্ষে এক প্যাকেট বাদাম হলেও কিনে নিয়ে তবে ওর মুখোমুখি হই। 
লিপস্টিক কিনতে গিয়ে হঠাৎ পা আটকে যায়। সেই ভদ্রমহিলা। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক। মুখের উগ্র  প্রসাধনী বয়সটাকে এক যুগ কমিয়ে এনেছে। কপালে কাটছাট করা কোঁকড়া চুলের ঝালর। ট্রলি বোঝাই করে তুলে নিচ্ছেন নানা ধরণের খাবার সামগ্রী, ঘর সাজানোর সরঞ্জাম, খেলনা, পোশাক আরো কত কি। ইন্দোনেশীয়ান বুয়ার কোলে ঘুমন্ত শিশু। সাধারণতঃ এ দেশীয় ধনাঢ্য মহিলারা ইন্দোনেশীয়ান বা ফিলিপিনো কাজের মেয়ে সাথে নিয়ে এ রকম ট্রলি বোঝাই করে দামী দামী জিনিস নেয়। ভালই পাল্টা দিচ্ছে তাদের সাথে। মহিলা এবার আমার খুব কাছাকাছি এসেছেন কসমেটিক নিতে। মুখোমুখি হতে চাচ্ছি না। চিনে ফেললেই হাই-হ্যালো শুরু করে দেবেন। বাসায় এমনভাবে ইনভাইট করবেন যেন আমি তার খুব নিকট-আত্মীয়। অবশ্য নিকট-আত্মীয় কথাটা অস্বীকার করি কিভাবে ? আর, না করেই বা উপায় কী ?
লিপস্টিক কিনে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে আসি। ছয়মাস আগে সিদ্দিকা হাসপাতালেই ওই শিশুটির জন্ম হয়। জটিল পজিশন। উর্দু, আরবী বা ইংরেজী জানেন না বলে ভাষাগত সমস্যা সমাধানের জন্য ড. সিদ্দিকা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সেই থেকে ভদ্রমহিলা বা তার স্বামী আমার প্রতি বেশ কৃতজ্ঞ। স্বামীটাকে অবশ্য এখনো দেখিনি। দেখার দরকারও মনে করি না। পারভীনের কাছে এসব কথা সযতেœ গোপন রেখেছি। কী কাজ হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর ?
বাসায় ফিরে মহিলার ছবিটা মন থেকে ঝেড়েমুছে হাজির হই আমার সুরভিত বেডরুমে। রুম তো নয়, আমার ছোট্ট স্বর্গ। স্বর্গের ভেতর অভিসারিনী পরী। আমি তাকে পরী বলেই ডাকি। প্রথম দিন ওর নামকে ছোট্ট করে পারু বলেছিলাম। তাজা মেহেদীর সুবাসে মৌ মৌ করা নরম আঙুল আমার ঠোঁটে রেখে বলেছিল, ‘প্লিজ। আর যাই ডাকুন, এ নামে ডাকবেন না। 
কেন ?
এ নামে আমার বাবা আরেকজনকে ডাকতেন। আমি ভুলে থাকতে চাই।
এরপর আর এ নামে ডাকিনি। ভুলে থাকুক ঐ আরেকজন অর্থাৎ ওর মায়ের কথা। তাছাড়া ডাকার জন্য নামের অভাব আছে নাকি পৃথিবীতে ? হুরপরী, ফুলপরী, জলপরী, লালপরী ইত্যাদি কতকিছু ডাকতেই পারি। আমি বাসায় ঢোকার আগে প্রতিদিন আমার পরী এসি অন করে। ডাইনিং টেবিল সাজায়। বেডরুমে রিফ্রেশেনার ছড়িয়ে জেসমিনের মৌ মৌ সুবাস নিয়ে আসে। তারপর ম্যাক্সি ছেড়ে আমার প্রিয় যে কোনও কালারের শাড়ি। ম্যাচ করা চুড়ি, টিপ। খোঁপায় একই রঙের ফুল। অথবা সামনে এনে রাখবে লতার মত ঝুলে থাকবে সুদীর্ঘ রেশমী বেণী। প্রথম প্রথম মনে করতাম আশেপাশের বাঙালী পরিবারে হয়ত বেড়িয়ে সময় কাটিয়ে এসেছে। পরে আবিষ্কার করি প্রবাসের নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য প্রথম প্রথম নূতন নূতন বাঙালী পরিবার পেলে যেভাবে খুশি হয়ে বেড়াত, এখন তেমন আগ্রহ নেই। সামাজিকতা কমিয়ে এনেছে। ইদানিং শুরু করেছে নেকাব পরা। প্রশ্ন করলে গ্রামীন সংস্কারের কথা বলে। এ সময়টাতে নাকি অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। কি জানি - হয়ত তাই। 
সিঁড়ির শেষ মাথায় আসার সাথে সাথে রোজকার মত চাবি খোলার শব্দ। নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। কলিং বেল টিপতে হয়না। আমার পায়ের আওয়াজেই খুলে যায় দরজা। অভিসারিণী হাসিমুখে হাতের ব্যাগ নেয়। কখনো লুকোচুরি খেলে। খুঁজে বের করতে হয়। আজও দেখি দরজায় সে নেই। আড়চোখে পর্দার নিচের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘ঘরে কেউ নেই দেখছি। পরীরাণী নিশ্চয় আকাশপারে। এইতো মহাসুযোগ। আইসক্রীম একাই সাবাড় করব’। অমনি পেছন থেকে এক রেশমী বেণী আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে। কানের কাছ নরম শব্দগুচ্ছ, ‘এবার দেখি তো গলা দিয়ে কি করে আইসক্রীম যায়?’ আমি তাড়াতাড়ি আইসক্রিমবক্স সঁপে দিয়ে বলি, ‘নাও নাও। কোন দুঃখে আমি বাইরের আইসক্রীম খাব ?’ শেষ কথাটার ইঙ্গিতের ওপর ভেংচি কেটে বক্স নিয়ে দে ছুট। ফ্রীজে রেখে রোজকার মত কোট টাই খুলে দেয়। ভেজা টাওয়েলে ঘাম মুছে। চোখ বুঁজে প্রশান্তির মহাসাগরে ডুবে ভাবি, বনানীর ছায়ঘেরা রাস্তায় মুখ নীচু করে হাঁটা সেই বিমর্ষ মেয়েটার ভেতর এত যে ফাল্গুন ছিল কে জানত?
অনেক হেঁটে সেদিন মিলুর কাছে এসেছিল নোট নিতে। দু’তিন ঘন্টা ছিল আমাদের বাসায়। কয়েকটা অংকও টুকে নিচ্ছিল। বারান্দায় সকালের রোদ মেখে মজা করে মার আদরমাখা পিঠা খাচ্ছি, এসময় মিলু বলে, দাওনা ভাইয়া অংকটা করে। নিজের মাথাই ঢুকছেনা, ওকে বুঝাব কি ?
ও কে?
আমার বান্ধবী। অবশ্য অন্য কলেজে পড়ে। এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট না হওয়ায় আমাদের কলেজে চান্স পায়নি।
ডেকে আন। দুজনকেই বুঝিয়ে দিচ্ছি।  
আসবে না। খুব লাজুক। 
মাঝে মাঝে এভাবে মিলুর কাছে আসত। মা খুব আদর করতেন। না খাইয়ে ছাড়তেন না। বলতেন, খুব লক্ষী মেয়ে। একদিন শুনি সেদিনের পর থেকে আর আসেনা। ওর মামী নাকি খোঁচা মেরে বলেছে, ‘মিলুর বাসায় এত ঘন ঘন আসা যাওয়া কিসের? ও, মিলুর একটা ডাক্তার ভাই আছে। ভালই তো। মায়ের পথ ধর। মা ভেগেছে প্রাইভেট টিউটরের সাথে, তুইও পারলে ভাগ ওই ডাক্তারের সাথে। বিয়ের খরচা থেকে বেঁচে যাই।’ 
হরদম মামীর তিক্ত মুখের অগ্নিবাণে পুড়তে থাকে তার অশ্রæভেজা নোট আর বইয়ের পাতা। যখনই পাতায় পাতায় ভেসে ওঠে বাবার ছবি তখনই দুহাতে আগুন ঠেকানোর ভঙ্গিতে বুকে চেপে ধরে বই খাতা। স্পষ্ট শুনতে পায়, ‘আয় খুকু আয়’। শহরের নামকরা শিল্পী ছিলেন তার বাবা। কী সুন্দর করে গাইতেন এ গানটা। বিষাক্ত ছুরি দিয়ে বাবার কন্ঠের সব গান জবাই করে মা পালিয়ে গেলেন। উচ্ছ¡ল প্রাণবন্ত মানুষটি কোর্টে যেতেন অপরাধী আসামীর মত মুখ নীচু করে। কানে আসত প্রতিপক্ষ উকিলদের ফিস ফিস করা তীর - ‘যার নিজের ঘরই বেআইনী  কুকীর্তিতে ভেসে যায় সে আবার আইনের কি বুঝে ?’
সেদিন সমস্ত অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে মেয়েকে বুকে চেপে বলেন, মা রে, তুই আমার বুকের একমাত্র ধন। আমার একমাত্র স্বপ্ন। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না তোর জন্য। ভালমত পড়াশুনা করিস। দেখবি আল্লাহই তোর জীবনের পথ দেখাবেন। 
পরদিন কোর্টের মানুষ কোর্টেই স্ট্রোক করেন। পারভীনের এসএসসি পরীক্ষার আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। বই খাতা যেমন এলোমেলো ছিল তেমনি পড়ে থাকে। পরীক্ষা দেবার শক্তি বা সাহস কোনটাই নেই। স্বয়ং হেড মিস্ট্রেস এসে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজ দায়িত্বে হোস্টেলে নিয়ে যান। বাবার জীবনের শেষ কথা মাথায় নিয়ে পিঠ সোজা করে ওঠে দাঁড়াতে বলেন। টিচারদের অপার মমতায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেও কাক্সিক্ষত লক্ষে যেতে পারেনা। যে মেয়ের সে বছর বোর্ডে স্ট্যান্ড করার কথা তার কপালে জুটল সেকেন্ড ডিভিশন। কাছের আপনজনেরা বলল, হবে না ?  বিদেশে যেদিন ছিল মায়ের হানিমুন, স্বদেশে সেদিন ছিল মেয়ের অগ্নিপরীক্ষা।  
কলেজে ভর্তি হবার পর বাসায় টিউটর রেখে দেবার তো প্রশ্নই আসে না। সারা সকাল মামীর ফুটফরমাইশ খেটে ঠিক সময়ে ক্লাশে পৌঁছতে না পারায় প্রতিদিন লাস্ট বেঞ্চে বসে পার করে লজ্জাজনক মূহুর্ত।
মিলুর কাছে শোনা এসব ঘটনাচক্রের চার বছর পার হয়ে গেছে। তেমন মনে রাখার কথা না। ইতোমধ্যে জেদ্দায় এসে শিশু-বিশেষজ্ঞ হিসেবে সিদ্দিকা হাসপাতালে জয়েন করেছি। দু‘বছরের মাথায় মা ফোনে তাগিদ দিচ্ছেন আর ই-মেইলে পাঠাচ্ছেন বাজারের সেরা গয়না আর কসমেটিকের লম্বা লিস্ট। জিনিসপত্র কোন ক্রমেই যেন কম বা কমদামী না হয়। কারণ যাদের সাথে আত্মীয়তা করতে যাচ্ছি তারা কোটিপতি। আমার মা মহাকঠিন সংগ্রামী মহিলা। বাবার সংসারে এসে অকাল বৈধব্য মেনে নিয়ে ভেঙে পড়েন নি। আত্মীয় স্বজনের করুণার সাহায্যও নেননি। সামান্য বেতনে চাকুরী করে শক্ত হাতে তিন ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন। এখন একটাই উচ্চাভিলাষ - ছেলেমেয়ের বিয়ে দেবেন এমন বাড়িতে যার গেটে দারোয়ান থাকবে, বাগানে ফোয়ারা থাক্েব, গ্যারেজে গাড়ি থাকবে। তবে বিয়েটা হবে শতভাগ যৌতুকবিহিন। এমনকি এক রতি স্বর্ণও যেন পুত্রবধু সাথে করে না আনে। স্ট্যাটাস অর্জন করতে গিয়ে নিজের নীতির কাছে হার মানার কোন সুযোগই কাউকে দেবেন না। 
মেয়ের ছবি এসেছে ই-মেইলে । মিলু বলেছে ফটোর চেয়েও সুন্দরী। আমি সুন্দর অসুন্দরের ধার ধারি না। মন পবিত্র থাকলেই হল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহপাঠিনী ইরার কাছ থেকে ছ্যাকা খেয়ে জীবনসঙ্গিনী বাছাইয়ের ব্যাপারে আমি এখন নির্বিকার সুবোধ ছেলে। মা বোনদের পছন্দ হলেই হল। 
বিয়ের দিন উঠোনে রাখা বাবার স্মৃতিমাখা নামাযের চৌকিতে দাঁড়িয়ে জরিদার শেরোয়ানী পরেছি। আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের হাসি ঠাট্টা ভরা বিশেষ মূহুর্তটা ভিডিওতে ধারণ করা হচ্ছে। মার ফুঁ দেওয়া পাগড়িটা কেবল মাথায় পরানো হবে এ সময় হন্তদন্ত হয়ে বিয়ের প্রধান গাইড আমার দুলাভাইর দুলাভাই এসে উপস্থিত। রোজকার মত আমাকে শালার শালা বলে রসিকতা করলেন না। গম্ভীর মুখে বললেন, পাগড়ি রাখো। বলে ধুম করে চৌকিতে বসে হাঁপাতে লাগলেন। 
কি ব্যাপার ?
ভয়ানক ব্যাপার। 
একশ জনের দুইশ চোখ তার দিকে। কী সেটা ? কিছু বলছেন না কেন ? তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অনেক পর বললেন, আজ ফযরের সময় বিয়ের কনে বিষ খেয়েছে। এখন ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। 
জামাই কুটুমদের সাথে যে একটু আদর-সমাদরের সাথে কথা বলতে হয় সেকথা বেমালুম ভুলে গিয়ে মেজরকাকু গর্জে ওঠেন।
তো ? ডাক্তার পারভেজকে এখন কি করতে হবে শুনি ? শেরোয়ানী খুলে এ্যাপ্রন পরতে হবে? ঢাকা মেডিকেলে ছুটতে হবে ট্রিটমেন্টের জন্য ? মেয়ে প্রেগন্যান্ট ছিল এ খবর ওরা জানত না? খেলা পেয়েছে আমাদের সাথে, হেঁ?
সব দোষ যেন বেচারা দুলাভাইয়ের দুলাভাইর।
সারা উঠোন জুড়ে বিরতিহীন গুঞ্জন। ভেতরে মা-বোনরা পাথর হয়ে আছেন। কি বেইজ্জতী কান্ড! সব জায়গায় কার্ড বিলি হয়ে গিয়েছে। আজ শুক্রবার বিয়ে, পরশু রোববার কমিউনিটি সেন্টারে বৌভাত। নিমন্ত্রিত সবাই তো যথাসময়ে উপস্থিত হবেই। ক’জনকে কিভাবে এবং কোনমুখে জানানো হবে বিয়ে ক্যানসেলের কথা? মেজরকাকু মিলিটারী কায়দায় হুংকার ছেড়ে বললেন, কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই। এক পাত্রী গেছে তো কি হয়েছে? দেশে কি ভাল পাত্রীর এতই অভাব? আজ বিকেলের মধ্যে যে যেখান থেকে পার ভাল পরিবারের ভাল পাত্রীর লিস্ট দাও। আজ সন্ধ্যায় ইনশাআল্লাহ্ একজনকে সিলেক্ট করব। আজ রাতেই আমার পারভেজের বিয়ে হবে এবং বৌভাতও  হবে ঐ রোববারেই।
সারাবাড়িতে এবার অন্যরকম গুঞ্জন। উপস্থিত সবাই যার যার হাতের কাছের পাত্রী হাজির করার সুযোগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। হার্টের রোগী মা বিছানায় পড়ে কাঁদছেন। জরিদার শেরোয়নীর ভেতর এই শীতেও আমি ঘামছি। আমার ভেতরকার সুবোধ ছেলে এবার অন্য রূপ ধারণ করে। মিলুকে সাথে নিয়ে মার শিয়রের কাছে বসে বলি, মা, মেজর কাকু আজ সন্ধ্যায় যাকে সিলেক্ট করবেন তার দেহ-মনও যে আরেকজনের অকুপাইড নয় তার গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারবে? পারবে না। সুতরাং সবাইকে পাত্রী খোঁজা বন্ধ করতে বল। এখন আমি যার কথা বলব তাকে তুমি ভাল করে চেনো। তুমি যেমনটি চাও তেমন কোটিপতি অবশ্য নয়, তবে -----
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিলু বলে, তার বাবা নামকরা লেখক ছিলেন। শিল্পী ছিলেন। বাপের এই গুণ তার ভেতরেও আছে। অনেক প্রতিভা তার। ওদের আলীশান বাড়ি গাড়ি নেই বটে, কিন্তু খানদানী পরিবার। গ্রামে এখনো তাদের পুরোনো আমলের জমিদার বাড়ি, মসজিদ, শান বাঁধনো ঘাট এসব অনেকাকছু সেকালের সাক্ষী। তুমি ঠকবে না, মা।
মা বললেন, রাখ ফিরিস্তি। কে সে মেয়ে? 
বলার সাহস না পেয়ে মিলু ঢোক গিলে আমার দিকে তাকায়। আমি নির্দ্বিধায় বলি, পারভীন। তোমার সেই খুব লক্ষী মেয়ে। 
মার অশ্রুভেজা চোখে এবার আগুন জ্বলে ওঠে। পা-র-ভী- ন? ওর মার কীর্তি শুনিসনি? সমাজে ওর কোন্ পরিচয় দেব, বল্? তোর মেজর কাকু শুনলে তো তোকে জবাই করে ফেলবে।
বিয়েটা মেজরকাকুর নয় মা, আমার। তোমাদের পছন্দের ওপর তো সুবোধ ছেলের মতো মত দিয়েছিলাম। এবার যদি আমার পছন্দের মূল্য না দাও তাহলে এই যে শেরোয়ানী  খুলব, আর কিন্তু পরাতে পারবেনা।  
কী শুনছি রে মিলু ? ও মিলু।
মিলুও ঘাবড়ে গিয়েছে। মায়ের কামরা ছেড়ে আমি বাইরে আসি। নিজের ‘জবাইয়ের’ রিস্ক নিয়ে মেজর কাকুর কাছে যাই। উনি তখন একটু আগের রাগারাগির জন্য বেচারা দুলাভাইয়ের দুলাভাইর হাত ধরে সরি বলে তোয়াজ করছেন। আর বিশাল ফাঁড়া থেকে আগে ভাগেই বাঁচালেন বলে মহান ভাগ্য-নিয়ন্তাকে শোকরিয়া জানাচ্ছেন। আমার সব কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান। 
বলেন, ‘আরে, এ মেয়ের বড়চাচাকে আমি তো চিনি। আমার সাথেই মুক্তিযুুদ্ধ করেছেন। আমি এ মেয়ের অন্য কোন পরিচয় খুঁজব না। তোর মাকে বল, মেয়েটা এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ভাতিজী , এটাই ওর বড় পরিচয়। আমি নিজেই যাচ্ছি। কইরে মিলু, ও মিলু, চল আমার সাথে। বাসাটা চিনিয়ে দিবি। বাবাজী, আপনিও চলেন। এই বলে বেচারা দুলাভাইয়ের দুলাভাইর হাতে ধরে হন হন করে বেরিয়ে গেলেন।              
মিলু এ বিয়ের নাম দিয়েছে ঝটিকা-বিয়ে। এক ঝটিকায় আমার ভাগ্যের দৃশ্যপট উল্টেপাল্টে একাকার। কে আসার কথা। কে এসে গেল। অনিশ্চিত মরুপথে হঠাৎ মুষলধারায় বৃষ্টি। আর তারপরই বসন্তের শোভা। বাড়ির সবাই পারভীনের ¯িœগ্ধতায় মন্ত্রমুগ্ধ। মিলু ঠিকই বলেছিল, বহুমুখী প্রতিভা ওর। অনার্সে অপ্রত্যাশিত ফার্স্টক্লাশ। মাস্টার্সে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তৃ মরুর দেশে নিজেই মরুভূমি হয়ে যাচ্ছি আমি। বিরহ নামের চিজটা যে এত দুর্বিসহ ভাইরাস, কে জানত? বিশেষত ওর অপরূপ পত্রকাব্যে ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে হৃৎপিন্ড। বললাম, ‘মাস্টার্স পরে হবে। বাঁচাও এসে রোগী’। কথা দু’টোকে পুঁজি করে হাসতে হাসতে ‘বাঁচাও রোগী’ নামে লিখে পাঠাল আরেক কবিতা। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত চল্লিশটা কবিতা নিয়ে বের হয়েছে ওর প্রথম কাব্য ’পাশে আছ তাই’। উৎসর্গ আমাকেই।
জেদ্দায় ওকে প্রথমবার এনে প্রথমেই ঘর-সংসারের বেড়াজালে ঢুকাতে চাইনি। এয়ার পোর্টে রিসিভ করে সোজা সাগরপারের হোটেলে। টানা সাতদিন হানিমুন। এর ফাঁকে মক্কা মদীনায় গিয়েছি। লোহিত সাগরের নিভৃত শিলাখন্ডে বসে শুনেছি ওর চাপা সুরের গান, ‘সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে, তোমার কপালে ছোঁয়াব গো----’। 
বছর খানেক হয়ে গেল আমার কাছে মনে হয় এখনো যেন হানিমুনের আবেশের মধ্যেই আছি। খাওয়ার সময় ভাত মাখিয়ে প্রতিবেলার প্রথম লোকমা আমি ওর মুখে দেই। ও আমার মুখে দেয়। আমার চুলের ভেতর ওর চাঁপাকলির মত নরম আঙুলের যাদুর ছোঁয়ায় রাতে চলে যাই ঘুমের রাজ্যে। ভোরে  ঘুম ভাঙ্গে ‘মজনু গো আঁখি খোল’ এ রকম কত গানের সুরে। আমাদের দুজনের নামের প্রথম তিনটা অক্ষর একই। সবদিকেই ছন্দে ছন্দে অপরূপ আমার ছোট্ট স্বর্গ। ইরাকে বিয়ে করলে এ স্বর্গ কি কপালে জুটতো? আমাকে বিট্রে করে ইরা বিয়ে করেছিল অস্ট্রেলিয়া-প্রবাসী এক ইঞ্জিনীয়ারকে। শোনা যায় ওখানে গিয়ে তাকেও বিট্রে করেছে। পশ্চিমা কায়দায় কার সাথে যেন লিভ-টুগেদারে আছে। সংসারের বাঁধন তথা পরাধীনতা নাকি তার ধাতে সয়না।
খেতে বসে কাবাবের টুকরো ওর মুখে দিয়ে বলি, পরীজাদার কী অবস্থা? মুভমেন্ট টের পাও?
পাই।
কিক মারে ? 
হুম।
ব্যথা লাগে না?
লাগে। তবে ব্যথার চেয়ে মজা বেশি। আমাকে বলেছে আব্বুকে বল ফুটবল কিনে দিতে।
ওর দেওয়া প্রথম লোকমা গিলে হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে বলি, ‘দেব নিশ্চয় দেব। ওকে বল জন্মের পর প্রথমে যেন আমার কোলেই আসে। ওর মার কোলে নয়’।
নির্ধারিত সময়ের এক সপ্তাহ আগে ফুটে ওঠে আমাদের স্বপ্নের প্রথম কুঁড়িটি। নাম রেখেছি অনাবিল। আসল নাম নাবিল। যার যেটা পছন্দ সেটাই ডাকে। ‘নাবিল, ও নাবিল’ ডাকতে ডাকতে অনাবিল হয়ে যায়। আরবী বাংলা দুই ভাষা মিশে একাকার। ওর কচি মুখের অনাবিল হাসিতে আমার ছোট্ট স্বর্গ এখন কল-কাকলীময়। ডিউটি থেকে ফেরার সময় এতদিন দরজায় অপেক্ষমান থাকত একটি হাসিমুখ, এখন দ’ুটি। পারভীনের মুখমন্ডলের ফটোকপিটি গোলাপী মাড়ি বের করে হাসতে হাসতে পাখির মত প্রায় ওড়ে আসে আমার কোলে। এসেই পকেটের কলম মুখে পুরে। লালা ঝরায় কোটে। লালা তো নয় লালিত্য। বুক ভরে ওঠে গর্বিত পিতৃত্বের সীমাহীন মাধুর্যে, যার সাথে পৃথিবীর কোন কিছুর তুলনা চলেনা। পারভীন এসব চিত্র-বৈচিত্র্য নিয়ে দু‘হাতে লিখে চলছে ছড়ার বই ‘অনাবিল শান্তির ভোর’।
সত্যি, আমাদের ভোর এখন অন্য রকম শান্তির ভোর। অনাবিল আমাদের রুটিন বদলে দিয়েছে। দিনে প্রচুর ঘুমায় বলে রাতে প্রায় দুটো পর্যন্ত জেগে থাকে। ওর রুটিন মেনে আমাকেও  জেগে থাকতে হয়। খেলতে হয়। এ হচ্ছে আরেক নাইট ডিউটি। ভোরে তার ঘুমন্ত মুখে চুমু খেয়ে চেম্বারে আসি।
আজ হাসপাতালে আসতে বিশ মিনিট লেট। ঘুমের রেশ পুরোটা কাটেনি। চেয়ারে বসতেই একগাদা ফাইল জমা দেয় নার্স। আর বাচ্চা কোলে নিয়ে ঢুকেই বাংলাভাষায় কলরব জুড়ে দেন এক ভদ্রলোক। 
আমার ওয়াইফ বলেছিল, ওর ডেলিভারীর সময় ড. সিদ্দিকার সাথে একজন বাঙালী ডাক্তারও ছিলেন। কিন্তু নাম মনে করতে পারছিল না। তাই খুঁজে বের করতে বেশ সময় লাগল। কই গো পারু, এস। 
ও পারুল আহমদ নামের এ ভদ্রমহিলার ডাক নাম তাহলে পারু। এবার আমার মনে পড়ল বাসর রাতে কেন পারভীন আমাকে এ নামে ডাকতে মানা করেছিল। আমি দরজার দিকে তাকাই। 
দরজা ঠেলে সালাম দেন সেই ভদ্রমহিলা। আমার বুকটা চিন চিন করে ওঠে। আবার সেই মুখ। ভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে তিরিশ দাঁত প্রকাশ করে বলেন, এখন আর তোমার ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম হবেনা। তোমার সৌভাগ্য যে, সেই দেশীভাই আজ পেয়ে গেলে।
ভদ্রলোকের মুখে বিরতিহীন খই ফুটছে। ‘বুঝলেন ডাক্তার ভাই, বাচ্চার অসুখ হলে হাসপাতালে যে নিয়ে আসব, সে সময় কই? নিমতলী আর গুলিল এরিয়ায় তিনটা দোকান আমার। এত বিজন্যাস ছাড়াও, এক্সট্রা অনেক কিছুর সাথে আমি জড়িত। পার্টির কাজ তো আছেই। এই যেমন ধরুন গে আপনার, আগামী কাল প্রধানমন্ত্রী আসছেন। এয়ারপোর্টে যেতে হবে। গতকাল এ বিষয়ে এ্যাম্বেসেডর আর কনসাল জেনারেলের সাথে মিটিং ছিল। পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা না দিলে তো নয়ই। কত দায় দায়িত্ব। আর গিন্নির অবস্থা কি আর বলব?  বাচ্চা একটু হাঁচি দিল তো ফোনের পর ফোন, ‘ওগো, শিগগির এস। হসপিটালে যেতে হবে’। ওর কলিজাখানায় -- কী আর বলব, সন্তান বাৎসল্য জিনিসটা টু মাচ। টেনশনে পাগল হয়ে যায়। 
আমি অনেক কষ্টে কাষ্ঠ-হাসি ফুটিয়ে বলি, বাচ্চার সমস্যাটা কি বলেন।
তেমন কিছু না। সর্দিকাশি। ওকে বোঝান তো ডাক্তার ভাই। সর্দিকাশি তো তেল রসুন গরম করে বুকে পিঠে একটু  মালিশ করে দিলেই তো সেরে যায়। এত টেনশনের কি আছে ?
ইচ্ছে করেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করি, এ আপনার প্রথম সন্তান? তাইনা ? 
মহিলার চোখের পাতা কেঁপে ওঠে। ডাক্তার আর উকিলের কাছে নাকি কোন সত্য তথ্য গোপন করতে নেই। সেজন্য হয়ত উনি ড. সিদ্দিকার অনুরূপ প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন,  না, দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান জন্মের পর মারা গিয়েছে। 
এ সত্য তথ্যটা জেনেও না জানার ভান করে উত্তরের অপেক্ষা করে চুপ থাকি। মহিলাও চুপ। সত্যমিথ্যার মাঝখানে থেকে ভদ্রলোক বলেন, জ্বী, এটা আমাদের প্রথম সন্তান। 
আমি মৃদু হেসে বলি, প্রথম সন্তানের বেলায় সব মা একটু বেশি টেনশন করে থাকেন। এটাই তো স্বাভাবিক। তাই না,মা ?
ভদমহিলা আমার কথার খোঁচাটা বুঝতে পারলেন কি না কে জানে।  
নার্স বাচ্চাটাকে বেডে শুইয়ে দেয়। বাচ্চাটারও সেই চোখ সেই মুখ। চেহারায় এত মিল? পারভীন আর অনাবিলের অবিকল চেহারাটা আমাকে যেন বিকল করে দিচ্ছে। বাচ্চাটা আমার এত কাছের তবু যেন কাছের নয়। ভদ্রমহিলা চিন্তিত মুখে আমার মুখোমুখি দাঁড়ান। উনি আমার এত কাছের মানুষ তবু যেন যোজন যোজন দূর। বাচ্চাটাকে ভালভাবে চেক আপ করে বলি , সিরিয়াস কিচ্ছু হয়নি। টেম্পারেচারও তেমন নেই। সিজন চেঞ্জ হলে এরকম একটু আধটু হয়ই। টেনশনের কিছু নেই। খোদা না করুক, তেমন সিরিয়াস হলে আমার কাছে অবশ্যই আসবেন। ওর জন্য স্পেশাল কেয়ার নেব। 
ভদ্রলোকের ডাকসাইটে স্বরযন্ত্র আবার চালু হয়। ‘পারু, দেখলে তো? তোমাকে কত করে বলেছি সামান্যতেই বাচ্চাদের এত ঘন ঘন ঔষধ খাওয়াতে নেই। তুমি তো কথাই শোন না। বাচ্চার অবস্থা উনিশ থেকে বিশ হলেই দে ছুট হসপিটালে। এখন থেকে এই ভাইর কাছে আসবে। তার কথা মানবে। দেশীভাই বলে কথা। কত অমায়িক, দেখেছ ? আর হ্যাঁ, ড্রাইভার নিয়ে একাই চলে এস। আমার সময় কোথা? এইতো এখনই ছুটতে হবে মির্টিংয়ে। প্রধানমন্ত্রীর রিসিপশন বলে কথা। বাণিজ্য মন্ত্রীও আসবেন। বাংলাদেশে নূতন একটা ব্যাংক হচ্ছে। শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে আমিও একজন। বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে এ নিয়ে আলাদা মিটিং।
অ আচ্ছা।
আমার নেক্সট্্ টার্গেট, নিজের শহরে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে শেয়ার হওয়া। আপনাদের দোয়ায় আমার এতসব উন্নতির মূলে কিন্তু আমার স্ত্রী-ভাগ্য এবং সন্তান-ভাগ্য। এদের ভাগ্যেই নিমতলী বাজারে আমার দুটো দোকান। একটা ওর নামে, পারুল স্টোর। আরেকটা হচ্ছে ছেলের নামে, পুলক এন্টারপ্রাইজ। আর গুলিলের সবজি মার্কেটটা দেশের নামে, শ্যামল বাংলাদেশ। বুঝলেন না, দেশপ্রেম হচ্ছে ঈমানের অংশ। হেঃ হেঃ হেঃ !
ভদ্রমহিলা গর্বিত ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকান। বাচ্চাকে চুমু দিয়ে ভদ্রলোক মুখে আবার খই ফোটান,  ‘আমার স্পন্সর আমাকে খুব ভালবাসে। সে তো তাগিদ দিচ্ছে রিয়াদে গিয়ে তার ব্যবসার হাল ধরতে। রিয়াদ খুব হাইফাই এরিয়া। ক্যাপিটাল সিটি তো। সবকিছুতেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। ওখানকার বিল্ডিংয়ের তুলনায় নিমতলী নেহাত জরাজীর্ণ। ভাবছি নিমতলীর দোকান ভাতিজার হাতে দিয়ে রিয়াদ চলে যাব। সময়ের সাথে সাথে আভিজাত্য, আই মীন, ব্যক্তিগত স্ট্যান্ডার্ডও বাড়াতে হয়। হেঃ হেঃ কি বলেন, ভাইয়া ?
আমি বিনীত ভাবে বলি, স্যরি, আমার অন্য রোগীরা অপেক্ষা করছে। অন্যদিন না হয় গল্প করা যাবে।
ও, তাইতো তাইতো। উঠি তাহলে। ভাল কথা, আপনার বাসা কোথায় ?
নাজলায়। 
আরে, আমার বাসাও তো নাজলায়। দেখা হয়ে ভালই হল। এ সপ্তাহে আমার পুলকের মুখেভাত অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীর রিসিপশনের ব্যাপারটা সেরে নেই। তারপর ‘দরবার হোটেলে’ গিয়ে ডেট ঠিক করব। আপনাকে কিন্তু যেতেই হবে। ‘না’ বলতে পারবেন না।
ভদ্রলোকের কথার তোড়ে এতক্ষণ ভদ্রমহিলা কোন কথাই বলতে পারছিলেন না। এবার আদুরে গলায় বলেন, ভাইয়া, আমি নিজে গিয়ে ভাবীকে দাওয়াত করে আসব। বাসার লোকেশন বলেন। 
বলে কি? বাসা পর্যন্ত যাবে? সর্বনাশ। আমার এতক্ষণের উদারতা আর গোপনীয়তা মন থেকে উধাও। ভেতরকার অস্বস্থি চাপা দিয়ে বলি, আমার স্ত্রী আপনার ভাবী হতে যাবেন কেন ? বড়জোর আপনার মেয়ের মত একটা নগন্য হতভাগ্য মেয়ে। 
ড্রয়ার খুলে পারভীনের কবিতার বই বের করি। মহিলার মুখের সামনে আয়নার মত ধরি। সামনের মলাটে ‘পারভীন মুস্তফা’ নাম এবং পেছনের মলাটে ওর ছবি দেখিয়ে বলি, ‘তাকে হয়ত চেনেন। বইটা ইতোমধ্যে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষ করে ‘মা দিবসের অমানিশা’ নামক কবিতাটা। স্যরি টু সে, আমি চাইনা আমার বাসায় এ জাতীয় কোন একটা সিন ক্রিয়েট হোক।
আর কিছু বলতে হয় না। বিধ্বস্ত স্বরযন্ত্র নিয়ে ভদ্রলোক তার সন্তান-বৎসল স্ত্রীর হাত ধরে দ্রুত বেরিয়ে যান। 
ঘটনা পারভীনকে বলতে পারিনি। মরুর বালু দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছি বুকের গভীরে। সে রাতে পারভীনকে নিয়ে ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। আধভাঙ্গা ঘুমের মধ্যে টের পাই জোরে জোরে শ্বাস ফেলছি। হাত বাড়িয়ে দেখি বিছানায় পারভীন নেই। টয়লেটেও না। কিচেনেও না। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি আবছা অন্ধকারে পায়চারী করছে। লাইট জ্বেলে দেখি চোখ ফোলা। সোফায় বসিয়ে বলি, কি ব্যাপার?  কাঁদছ কেন?
কাঁদছি না, আল্লাহকে জিজ্ঞেস করছি। কী অপরাধ করেছিলাম যে---। কথা অসমাপ্ত রেখে আমার বুক ভিজিয়ে জোরে কাঁদতে থাকে। 
টিসু দিয়ে চোখ মুছে বলি, আহ্্হা, বলবে তো কী হয়েছে?
থেমে থেমে ভাঙ্গা গলায় বলে, বিদেশে এসে ভেবেছিলাম দেশের সমাজের হাত থেকে বাঁচলাম। কিন্তু ওরা বাঁচতে দিল কই? জেদ্দায় এসেছে আমাকে ডুবাতে। রাগে দুঃখে রোজ লুকিয়ে কাঁদি। আমার চোখের পানি দেখে পাছে তুমি অস্থির হয়ে পড় তাই বলতে গিয়েও এতদিন বলিনি।
বিষয়টা আমিও জানি পরী। পাছে তুমি কষ্ট পাও তাই আমিও তোমাকে বলিনি। 
তুমি জানলে কি করে ?
আমি তখন পারুল আহমদ নামের ভদ্রমহিলার সাথে কখন, কোথায়, কতবার দেখা হয়েছে, কী কী কথা হয়েছে সব খুলে বলি। তারপর জিজ্ঞেস করি, কিন্তু  তুমি জানলে কি করে? 
পাশের ফ্ল্যাটের এক ভাবীর এলবামে দেখেছিলাম ওই শয়তানীর বাচ্চার আকীকার ছবি। বিশাল পার্টি দিয়েছে হোটেলে। বাসা নিমতলীতে। ঘন ঘন পার্টি, পিকনিক এসব নিয়ে নাকি সারাবছর ফুর্তি করে বেড়ায়। ভাবী বললেন আমার মতই চেহারা। কথাটা শোনার পর থেকে বাঙালীদের পার্টিতে যাওয়া বাদ দিয়েছি। পাছে ওর মুখোমুখি হলে কেউ যদি দু’জনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে কোনো প্রশ্ন করে বসে। 
ও, এজন্যই বুঝি নেকাব ধরেছ? এত ভয় ?
কি করব বল? নাজলার একেকটা বাঙালী পাড়া তো একেকটা রেডিও সেন্টার। একদিন এখানকার সবাই জেনে যাবে। সেই ভয়ে আমার ইচ্ছে হয় জেদ্দা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে কোন বাঙালী  থাকবেনা। দেখনা চেষ্টা করে ?
কেন ? তুমি কেন জেদ্দা ছাড়বে ?  বরং ওদেরকেই জেদ্দাছাড়া করব। আমার ওপর ভরসা রাখ, পরী। আমি থাকতে তোমার ভয় কেন ?  
তুমি আছ বলেই তো বেঁচে আছি। দুর্ভাগ্যের পৃথিবীতে তুমিই আমার সৌভাগ্যের বেহেশত। তুমিই আমার---’। এর চেয়ে ভাল উপমা হয়ত আর খুঁজে পেলনা। সশব্দে অবাধ্য স্রোত ছড়িয়ে দেয় আমার বুকে। ওর চুলের অরণ্যে হাত বুলিয়ে বলি, তোমার সব যন্ত্রণা, সব দুর্ভাবনা আমার বুকে ঢেলে দাও পরী। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। 
কান্নার মৃদু শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। এক সময় শান্তিতে এলিয়ে পড়ে। আমি অনড় হয়ে ওকে ধরে থাকি, পাছে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। দূর থেকে তখন ভোরের আজান ভেসে আসছে।     
==========================






   
 



   
 

1 comment:

  1. অপূর্ব ভালো লাগা গল্প নয় যেন এক জীবনকথা

    ReplyDelete

What do you think?