মাদারীপীরের জটা
স্বদেশে ছুটি কাটাতে এসে এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করে শাওন। অসংখ্য
মানুষের পদভারে যেন নুয়ে পড়েছে সমগ্র দেশ।বিশেষ করে ঢাকা শহরকে
মনে হয় মানুষের চিড়িয়াখানা। বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজনে গিজগিজ করছে
এ শহরের প্রতিটি অলিগলি। জীবিকার সন্ধানে মানুষ এখানে চরকার মত ঘুরছে। একই সাথে তাল মিলিয়ে ছুটছে সাইকেল, রিক্সা,
ঠেলাগাড়ি, স্কুটার, বাস, ট্রাক, লরি, ট্যাক্সি
আরো কত বিচিত্র যানবাহন।
সমগ্র শহরের রাজপথ থেকে
শুরু করে গিঞ্জি বস্তি পর্যন্ত কাল ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়ে কার্বন ছড়াচ্ছে বাতাসে নিরন্তর। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির এ শহরের ব্যস্ত
নরনারীর সাথে যোগ হয়েছে একপাল কুকুর-বিড়াল। লাঠি পেটা, ঝাটা পেটা, আর রোদ ও ঝড়ের ঝাপটা সামলাতে না পেরে তাদের কেউ কেউ হারিয়েছে নিজের
অঙ্গ সৌষ্ঠবের মূল্যবান পশম সম্পদ।তবু বাঁচতে হবে
বাঁচার তাগিদে। ”মরিতে
চাহি না আমি এ সুন্দর ভূবনে” -
এ সত্যটুকু মানুষ কিংবা পশুর ক্ষেত্রে সমতার দাবীদার। এ শহরের আকাশে ছড়ানো কাল ধোঁয়া ভেদ করে চাঁদ-তারার স্নিগ্ধ আলো কোনদিন মানুষগুলোকে স্পর্শ
করার চেষ্টা করেছে কিনা সে তথ্য নেয়ার জন্যে রাজধানী
উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হয়তো একটা আলাদা গবেষণামূলক
সেল থাকার প্রয়োজন ছিল।
বিয়ের ফুল এবারও হয়তো ফুটবে না। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে
হচ্ছে, জীবনের আরও
একটি বসন্তের নিঃশব্দ পতন ঘটবে। পূর্বেও এমনি খোঁজাখুঁজির
পালা শেষে ব্যর্থতা নিয়ে কানাডায় ফিরে যেতে হয়েছিল।
এবারে পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনরা একযোগে হন্যে হয়ে ক’নে
খুঁজছেন। মার একটাই কথা, যদি এবারও আমার শাওন ব্যর্থ হয়ে
ফিরে যায় তাহলে সবাই আমার মরা মুখ দেখবে।
কি কঠিন সমস্যা মাকে নিয়ে। শাওন
ভেবে পায় না, মা এমন করে প্রতিজ্ঞা করে সবাইকে
চিন্তাযুক্ত রেখেছেন কেন? গত দু’সপ্তাহে
কমপক্ষে দু’ডজন
কনে দেখা হয়েছে। এদের কাউকে মায়ের cQ›` হয়নি।
কলেজে পড়ুয়া ছোটবোন নীলার অভিমত, কÕনে যখন মায়ের পছন্দ মতই হবে, তখন তিনি নিজে দেখলেই
পারেন। আমাদেরকে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়া কেন? মা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বলেন,তার মানে
এই নয় যে,যেন তেন একটা প্রস্তাব মেনে নিতে হবে? এটা কি ছেলেখেলা? আমার ছেলে কম কিসে?
ইঞ্জিনিয়ার বানাতে ওর জন্যে কি কম কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে? ওর মত একটি ছেলে দেখাতো
দেখি? শুধু বক বক করতে শিখেছিস, যত্তসব অপদার্থের দল –হুহ্, কবে যে তোরা কাজের হবি?
এদিকে ছুটির ট্রেন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সময়ের সাথে
পাল্লা দিয়ে। ফুরিয়ে আসছে একমাসের ছুটি দেখতে দেখতে। শাওন ভাবছে এবারেও কি মায়ের আশা অপূর্ণ থেকে যাবে? কোথায় লুকিয়ে
আছে তার মানসকন্যা? কপালের লিখা অখন্ডনীয়, তাই
যদি সত্য হয় তাহলে ওকে খুঁজে পেতে এত দেরী হচ্ছে
কেন?
আনমনে হেটে যাচ্ছিল শাওন মগবাজারের মোড়ের দিকে। মায়ের
জন্যে কিছু ফলমূল
ও দু-একটি বাংলা ম্যাগাজিন কিনে নেয় রাস্তার হকারদের
কাছ থেকে।
নাছোড়বান্দা সব হকাররা।
কেমন করে যেন চিনে নিতে পারে তাদের আসল খরিদ্দার। মনোবিদ্যায় এই হকাররা একেকজন পন্ডিত বটে! একজনতো বলেই ফেলল, স্যার, বিদেশেতো
প্রচুর ফলমূল খান কিন্তু দেশের টাটকা ফলমূলের স্বাদটা
একবার যাচাই করেই দেখুন না।
শাওন চমকে ওঠে। কেমন করে একজন সাধারণ হকারের কাছে
সে ধরা পড়ে গেল। তবে কি তার বাবহারে বা আচরণে প্রবাসী ভাবটা ফুটে
উঠেছিল? পেট্রোল ও মবিল পোড়া কাল ধোঁয়া চোখের
ভেতর জ্বালা ধরিয়ে পানি ঝরাচ্ছে অবিরাম। নরম টিসুপেপার
পকেট হতে বের করে শিশিরসদৃশ নোনাজল আলতোভাবে ঘসে নিয়ে রাস্তার পাশের পাকা বেঞ্চটিতে
বসে পড়ে শাওন।
সদ্য কেনা বাংলা ম্যাগাজিনটি এবারে মেলে ধরে চোখের
সামনে। রাজনৈতিক যত
অস্থিরতা। সরকারী এবং বিরোধীদলের মধ্যে ক্ষমতার তীব্র
লড়াই। ইসরাইলী সৈন্যের সাথে ফিলিস্তিনী যুবকদের
সংঘাত, কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ান সাবমেরিন ও তার সকল ক্রুদের সলিল সমাধি, ঢাকার রাজপথে সন্ত্রাসী কর্তৃক যুবক গুলিবিদ্ধ,
প্রেমিকের আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় যুবতী এসিডদগ্ধ
-এ সবকিছুই বিরক্তিকর।
ভাল কোন কাজ যেন এ জগতে নেই। পৃথিবী নামক নিষ্পাপ গ্রহটি পাপের
রাহুগ্রাসে নিপতিত। এ গ্রহের আকাশে শান্তিকপোত ডানা
মেলে উড়তে গিয়ে বিদ্ধ হয় নিষ্ঠুর শিকারীর বিষাক্ত তীরের ফলকে। সমাধিকারের
ভিত্তিতে বেঁচে থাকার অঙ্গীকারে আবদ্ধ মানবজাতি নিজেকে
নিয়ে এত বেসামাল কেন? শুধুই কোন্দল আর সংঘাত।
শাওন ভেবে পায় না, মানুষের জন্যে সৃষ্ট একটি মাত্র
পৃথিবী এত কলুষিত কেন? সংঘাতময় পৃথিবীর মানুষগুলোর অপকর্ম মানুষই আবার প্রকাশ করে কাগজের পাতায়।
এবার চোখের দৃষ্টি এসে থামে একজন সর্পবিশারদের বিজ্ঞাপনে।
সাপ মারবেন
না, সাপ দেশ ও প্রকৃতির সম্পদ, সর্পবিদ মানুষের বিভিন্ন
সমস্যার সমাধান দিতে পারেন গ্যারান্টি সহকারে।কি
আশ্চর্যের ব্যাপার?
পাশাপাশি আরেকজন মহিলার বিজ্ঞাপন। তিনিও একশ এক জাতের
সমস্যার সমাধান দিতে
পারেন।ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে তিনি নাকি মনের মানুষটির সন্ধান কিংবা বান
মেরে শত্রুকেও ধ্বংস করে দিতে পারেন। কি আশ্চর্য! ঈশ্বরের কি দায় পড়েছে, শত্রুকে
বান মেরে ধ্বংস করার জন্যে তিনি এক মহিলাকে প্রতিনিধি বানিয়ে এ ধরায় পাঠাবেন? শাওনের
আগ্রহ বাড়তেই থাকে। সে দেখতে চায়, ঈশ্বর মনোনিত নারী প্রতিনিধিকে,যিনি ক্ষমতাবলে
ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করছেন এ ধরায় তারই সমগোত্রীয় মানুষের। উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হলে রোগীকে ক্ষতিপূরণসহ টাকা ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি
দিয়ে বিশ্বাস অর্জনের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন
এই মহিলা।
নেহায়েত কৌতুহলবশতঃ শাওন ঠিকানানুযায়ী এগিয়ে যায়
সরু একটি গলিপথ
ধরে। বিধাতার মহিলা প্রতিনিধির কাছে গিয়ে বলবে, আপনিতো
অঘটনঘটনপটিয়সী। আমার মায়ের প্রতীক্ষার অবসান
ঘটিয়ে দেন মনের মানুষটির সন্ধান দিয়ে। মন্দ কি! অভিজ্ঞতার ভান্ডারে সঞ্চিত হবে নূতন
অভিজ্ঞতা।
পত্রিকার পাতায় এ ধরণের বিজ্ঞাপন জীবনে
সে বহুবার দেখেছে, কিন্তু তলিয়ে দেখেনি কোনদিন। এ ধরণের নিছক মিথ্যা আশ্বাস
তার বিশ্বাসের শক্ত শিকড়কে কোনদিন নাড়াতে পারেনি। পরিবর্তে
পত্রিকাওয়ালাদের ওপর ভীষণ রাগ ধরেছে তার। বিজ্ঞাপনের
কয়েকটি টাকার লোভে ওরা সমাজের কিছু সংখ্যক সহজ
সরল মানুষগুলোকে একপাল ভন্ডের কাছে লেলিয়ে দিচ্ছে অবলীলায়।
প্রায় আধমাইল হাঁটার পর ডানদিকের বাঁকা রাস্তার
মোড়ে লাল সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা, সামনে মাদারীপীরের আস্তানা,
এগিয়ে যান।
শাওনের আগে ও পিছে আরও কয়েকজন
উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষে সাইনবোর্ডের
নির্দেশ মেনে এগিয়ে যাচ্ছে। শাওন লক্ষ করে তার সামনেই এক
বৃদ্ধ বোরকা পরিহিতা
এক যুবতীর কানের কাছে ফিস ফিস করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে বলতে
এগিয়ে যাচ্ছে।
যুবতীর ভীত সন্ত্রস্থ পদক্ষেপ। কেউ যেন
দেখে না ফেলে তার জন্যে নেকাবে ঢাকা মুখায়োবব। গলিপথ ধরে আনুমানিক পোয়ামাইল রাস্তা অতিক্রম করার পর মূল রাস্তাটি তিনভাগে বিভক্ত হয়ে এগিয়ে
গেছে সামনে।
দিক নির্দেশনার সব কটিতেই লেখা, মাদারীপীরের আস্তানা,
সামনে বাড়ুন।
কোনদিকে যাবে টুটুল? সকলের চোখে মুখে একই প্রশ্ন? চাদর
পরিহিত জটাধারী সন্যাসী পাশের একটি খুপরী হতে বেরিয়ে এসে প্রত্যেকের সমস্যা জেনে নিয়ে একেকজনকে একেক রাস্তা ধরে এগিয়ে
যেতে নির্দেশ দেয়।
তারই নির্দেশমত টুটুলও মোহগ্রস্থের মত কোন কথা না
বলে এগিয়ে যায়। পাকা সরু রাস্তার দু’পাশে ছেঁটে
দেওয়া ঘন কাঁটাবনের সারি। নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। শহরের
উপকণ্ঠে এ এলাকাটি মহানগরীর কোন ব্যস্ততাকে স্পর্শ করে না।
কিছুদর এগিয়ে যেতেই শাওন
লক্ষ্য করে তার সামনে রাস্তার দু’পাশে
কাঁটাবনের উপরে একরাশ পিঙ্গল জটাচুলধারী মূর্তির মাথাকে বাঁশের
খুঁটির সাথে এঁটে দেয়া হয়েছে,দেখতে অনেকটা সবজী
বাগানে কাকতাড়ুয়ার অনুরূপ।
এরপর থেকেই শুরু হয়েছে রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ
মাদার গাছ। গাছগুলোতে ফুটে আছে অজস্র লাল ফুল। ডালে ডালে লটকে আছে কাল বর্ণের
লতা। মনে হয় দীঘলকেশী যৌবনাবতী কোন তরুণীর এলোকেশ দিয়ে সাজানো হয়েছে মাদার গাছের
অঙ্গ সৌষ্ঠব।
শাওনের
মনে পড়ে শৈশবের কথা। পিতার কর্মস্থল মফস্বল শহরে তখন সে প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র।
তাদের বাসার ঠিক সামনে ছিল অসংখ্য মাদার গাছ। কাঁটাযুক্ত এ গাছগুলোতে বছরের কয়েকটি মাস জুড়ে এমনি লাল ফুলে ছেয়ে থাকতো। সকালের
মিষ্টি রোদে ডালে ডালে বুলবুলি আর ধানশালিকেরা কিচির মিচির
করতো। বাসার পাশেই বাঁশের বেড়ার ছোট্ট খুপরির
মধ্যে থাকতো রাবী নামের এক মধ্যবয়সী রমণী। ছোটবেলায় সে নাকি নিখোঁজ হয়েছিল। আর কোনদিন
ফেরেনি। কেমন করে ওর সংসার চলে কেউ তা জানে না।
খুপরীর বাশের দরজায় তালা লাগিয়ে রাবী মধ্যে মধ্যে
কোথাও উধাও হয়ে যেত, পনেরো বিশদিন পর আকস্মিকভাবে ফিরেও
আসতো। শাওনদের বাসার সামনের মাদার গাছগুলোর ফুল ঝরে এক সময় যখন ডালে ডালে কাল চুলের
মত শুকনো লতাগুলো ঝুলে থাকত তখন রাবী পাড়ার ছেলেদেরকে
সাবধান করে বলতো, দ্যাখো ছেলেরা - ভুলেও যেন মাদার
গাছ হতে লতাগুলো ছিঁড়তে যেয়োনা। মাদারীপীর কিছুদিনের মধ্যে তার পছন্দের এ লতাগুলো নিতে আসবেন কিন্তু সাবধান এ পীরের কাছাকাছি যেয়েনা
গেলেই তোমাদের মাথার চূলে জট লেগে যাবে যা কোনদিনই খুলবেনা এবং সন্যাসী সেজে সংসারের
মায়া ত্যাগ করতে হবে।
সত্যিই একদিন ঘুম হতে সকালে উঠে শাওন দেখে, তাদের
বাসার সামনের মাদার গাছগুলোতে ঝুলে থাকা চুলসদৃশ লতাগুলো কে যেন ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
রাবী মাদারীপীরের ভীষণ ভক্ত। মাদারীপীর কখন দেখা দেবেন
একমাত্র রাবী-ই জানে।
লক্ষীপূর্ণিমার এক রাতে শাওনের সহপাঠিরা রাবীর খুপরীর
পেছনের নারিকেল গাছ হতে কচি ডাব চুরি করতে গিয়ে ওর ঘরের
বেড়ার ফাঁক দিয়ে লম্বা দাড়িওয়ালা জটাধারী এক লোককে চোখ মুদা অবস্থায় নিজেদের
চোখে দেখেছে। পাড়ার ছেলেরা যখন এ কথাটা ফাঁস করে দিল,সে
হতে রাবীর সাথে একটু সমীহ করে কথা বলতে শুরু করলেন
পাড়ার মহিলারা।
কারোর কাছে হাত পাততে রাবীকে কখনো দেখা যায়নি। অথচ
জীবিকার সন্ধানে
কোন কাজকর্ম করতেও তাকে কেউ কখনো দেখেনি।
কেমন করে তার সংসার চলে এ কথাটি জানার
কৌতূহল অনেকের থাকলেও কেউ তাকে জিজ্ঞেস করতে কোনদিন সাহস করেনি। রাবীর মুখের মধ্যে যে ঝগড়াটে ভাব পরিস্ফুটিত হয়ে উঠতো হয়তো
জিজ্ঞাসা না করার পেছনে এও একটা কারণ ছিল।
মাদারীপীরের কথা শুনে শুনে শাওন একদিন মাকে জিজ্ঞেস
করেছিল, মা, মাদারী পীর দেখতে কেমন? মা হেসে বললেন, কেন, রাবী তোকে বলেনি?
ঐ একমাত্র রাবী ছাড়া মাদারী পীরকে কেউ কোনদিন
দেখেনি। ওর কথা বিশ্বাস করিস কেন?
আকস্মিকভাবে একদিন দেখা গেল রাবীর মাথার দীঘল কাল
চূল পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করে জটাযুক্ত হয়ে গেছে। চূলগুলো শক্ত পাথরের
মত দু’ভাগ
হয়ে পেছনে এলিয়ে পড়েছে। ফুলা ফুলা চোখ,আর জটা চুল
ওকে যেন এক রহস্যময়ী নারীতে রূপান্তরিত করেছে।
রাত বারটার পর পাড়ার রাস্তায়
রাস্তায় রাবী আনমনে গান গেয়ে বেড়াতো, হায়রে মাদারী, তুমি হও আমার কান্ডারী,
তোমার রূপে হলেম আমি বৈরাগী, রে মাদারী, অভাগীর হও কান্ডারী।
রাবী
বোধহয় উন্মাদ হয়ে গেছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে হয়তো কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে,
সে কারণে রাবীকে কেউ কিছু বলেনা অথবা বলার সাহস করেনা ।
একদিন
রাবী নিরুদ্দেশ হল। কোথায় কেউ জানেনা।পাড়ার ছেলেরা ওকে অনেকদিন না দেখে একদিন ওর আঙ্গিনার
পেয়ারা গাছ হতে পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে যেই না গাছে উঠতে যাচ্ছিল অমনি চারপাঁচ হাত লম্বা বিরাট এক অজগর রাবীর খুপরী হতে বেরিয়ে হিস
হিস করতে করতে তাদেরই সম্মুখ দিয়ে জঙ্গলে মিলিয়ে
গেল, সে হতে ওদিকে পা মাড়াবার সাহস কেউ করেনি।
বৈশাখী এক ঝড়ের ছোবল সহ্য করতে না পেরে রাবীর বাঁশ
বেতের তৈরী
খুপরীটি একদিন মাটির সাথে মিশে গেল। বৃষ্টিতে পঁচে যাওয়া
বাঁশের চালা ভেদ করে কিছুদিনের মধ্যে গজে উঠা মাদার
গাছটি বেশ শাখা প্রশাখা মেলে দিয়েছে দেখতে দেখতে।
পাড়ার বৌ-ঝিরা পাশের পুকুর
পাড়ে বাসন ধুতে গিয়ে পূর্ণিমার স্বচ্ছ চাঁদের আলোয় কেউ কেউ অজগরটিকে গাছের ডালে ঝুলতে দেখেছে। বৃদ্ধরা পাড়ার দুষ্ট ছেলেদেরকে সাবধান
করে দিয়েছেন, কেউ যেন অজগরটিকে লক্ষ করে ঢিল না
ছোঁড়ে। কারণ সাপটি নাকি পাড়ার রাখাল। রাখালেরা নাকি মানুষকে অমঙ্গল হতে রক্ষা করে।
কথিত আছে এ উপদেশ না মেনে দশ বছরের পাড়ার ছেলে
পিন্টু একদিন সাপটিকে ঢিল মেরেছিল। বাসায় ফেরা মাত্রই তার অস্বাভাবিক জ্বর উঠে। জ্বরের প্রকোপ সহ্য করতে না
পেরে পরদিন সকালে পিন্টুকে এ ধরা হতে চিরবিদায়
নিতে হয়েছিল। তাছাড়া একদিন এক সাপুড়ে সাপটিকে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে তাড়া খেয়ে যেইনা পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিল
অমনি সে পানির নিচে তলিয়ে গেল। পরদিন তার ভেসে
উঠা লাশটি পুলিশ ময়না তদন্তের জন্যে মর্গে পাঠিয়েছিল।
সে হতে সাপটিকে আর অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি বরং
পাড়ার হিন্দু ঘরের
বউ-ঝিরা পূর্ণিমার রাতে লক্ষীন্দরের নাম স্মরণ করতে করতে
পরম ভক্তিভরে বাটি বাটি দুধ রেখে আসতো রাবীর পরিত্যাক্ত
ঘরের আঙ্গিনায়। সকালে উঠে খালি বাটি নিয়ে আসতো অদৃশ্য দেবতাকে প্রণাম জানাতে জানাতে।
ছোটবেলার সে টুকরো টুকরো
স্মৃতির পর্দা টুটে যায় শাওনের কারোর বিনম্রª আহ্বানে। অনুগ্রহপূর্বক
এ দরজা দিয়ে উপরে উঠুন। মাথায় দু’ভাগ
হয়ে যাওয়া ঝাকড়া জটাধারী এক সন্যাসী ঈশারায় ওপরে উঠার
সিড়ি দেখিয়ে দেয়।
দোতালার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে
শাওন দ্রুতপদে। আট দশটি সিড়ি পেরোনের পর সেলোয়ার
কামিজ পরিহিত জটাধারী এক
যুবতী হাসিমুখে আহ্বান জানায়, আ-সু-ন, মাদারীপীর আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
তার আগে টিকেট সংগ্রহ করে নিতে হবে সামনের ঐ কাউন্টার
হতে। আমি আপনার জন্যে এখানেই অপেক্ষা করছি।
টিকেট এগিয়ে দিয়ে কাউন্টারের লোকটি শাওনকে লক্ষ
করে বলে, আপনার
মনের মানুষটির খোঁজ মাদারীপীরের কাছে পেয়ে যাবেন। আশা
আপনার অপূর্ণ থাকবে না| এই বলে উদাস দৃষ্টি দূরে
নিক্ষেপ করে সন্যাসী। যেন সে দিব্যচোখে দেখছে শাওনের হবু বধুকে। চমকে উঠে সে
সন্যাসীর কথা শুনে! কে ওকে বলে দিল তার মনের মানুষটির খুঁজে সে মাদারীপীরের আস্তানায়
এসেছে। একসময় এ প্রশ্নের উত্তর সে নিজ থেকেই খুঁজে পায়।
পূর্বেই
তার সন্দেহ হয়েছিল, একে হয়তো কেউ তার সমস্যার কথা ফোনে বলে দিয়েছে, অথবা এও হতে পারে
তিনরাস্তার মোড় হতে যে রাস্তা ধরে আসতে হয়
সে রাস্তাটি এ ধরণের সমস্যার জন্যে নির্ধারিত। নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করে শাওন। মনে
মনে বলে, হায়রে জটাধারীরা, তোমরা হয়তো জান না,একজন মনস্তত্ববিদ
না হলেও আমি একজন পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। আর তাই
তোমাদের এই
জটার ভেতর লুকিয়ে থাকা রহস্যের জট উন্মোচন করতে চাই -স্বাগোতোক্তি করে শাওন।
ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে লোকটি| ঈশারায় এগিয়ে যেতে বলে। জটাধারী
যুবতীকে অনুসরণ করে এগিয়ে যায় শাওন সামনের পর্দাঘেরা অন্ধকার এক প্রকোষ্ঠের
দিকে। ভারি কালো পর্দার অন্তরালে মোমবাতির মৃদু
আলোয় আলোকিত কক্ষটি রহস্যময়।
ডানদিকের টানা বারান্দার দেয়ালে আঁকা বিরাট আকারের
মাদার গাছটিকে জীবন্ত মনে হয়। লাল লাল ফুলে ছেয়ে আছে গাছটির সমস্ত
শাখা প্রশাখা। গুচ্ছ গুচ্ছ শুকনো কাল চুল জটলা পাকিয়ে যেন লেপটে আছে গাছটির সারা অঙ্গে। ডালে ঝুলছে এক মস্ত বড় অজগর
। আগুন ঝরানো লাল দু’টো
চোখ মেলে যেন তাকিয়ে আছে শাওনের দিকে। যেন এখনই হিস হিস শব্দে তার
মাথা বরাবর ঝাঁপ দেবে,বিষাক্ত ছোবলে জ্বালিয়ে দেবে সারা অঙ্গ।
শিরশির করা এক প্রতিক্রিয়া
বয়ে যায় শাওনের সারা অঙ্গে। জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করুন। যুবতীটির দিকে একবার তাকিয়ে
পর্দা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে শাওন। হৃৎপিন্ডটি
ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত শব্দ করে দুলছে এক অজানা আশঙ্কায় অথবা উত্তেজনায় যা সে নিজেও জানে না। ঘরটির অভ্যন্তরে
লাল চাদোয়ার নিচে কাল পাতলা পর্দার ওপাশে মোমবাতির
মৃদু আলো-আঁধারিতে বসে আছে এক নারীমূর্তি। ফোনে
ফিস ফিস করে কার সাথে কথা বলছে।
দু'পাশে রাখা কোলবালিশের মধ্যখানে নারীমূর্তিটি
এবার একটু নড়ে উঠে। তার অদ্ভুত কণ্ঠ হতে পাক খেতে খেতে kãZi½ বেরিয়ে
আসে পর্দা ভেদ করে, তুমি যার খুঁজে এসেছে, সে তোমারই
দুয়ারে অপেক্ষমান বাবা! দূরে আছ বলে এতদিন ওকে তোমার
চোখে পড়েনি। যাও, ঘরে ফিরে যাও, কাল সকাল পর্যন্ত
কারোর সাথে অযথা কথা বলনা। তোমার মায়ের
এমন একটি কনে পছন্দ হবে যে হবে তোমার জন্য উৎকৃষ্ট। তবে বাপ, মা
হারিয়েছে বলে মেয়েটিকে যদি অবজ্ঞার চোখে দেখো,
তাহলে ফল হবে ভয়াবহ। আর দেরী করনা বাবা। ঘরে ফিরে
যাও।
কথার ফাঁকে পর্দার ওপাশে কাল কাপড়ে আবৃত লম্বা দাড়িওয়ালা
জটাধারী এক ছায়ামূর্তি নতজানু হয়ে নারীমূর্তিটির কানে ফিস ফিস
করে বলে ওঠে, রাবী, আমি বিক্রমপুরে যাচ্ছি,ওখানের মাদার গাছগুলোতে অসংখ্য ফুল ফুটেছে
ও গাছগুলো চূল ছেড়েছে। G g~û‡Z© এ
চূলগুলো আমাদের খুবই দরকার। ফেরার পথে তোর অজগরটিকেও নিয়ে আসব।।
দুধ কলা খেতে খেতে সাপটি অসম্ভব মোটা হয়ে গেছে। ওর এই বুড়ো বয়সে আর কত পাহারা দেবে তোর ভিটেমাটি? ঈশ্বরতো তোকে কম দেননি, ভিটেমাটির
মায়া ছাড়তে পারিস না?
টুকরো
টুকরো কথাগুলো শাওনের
কানের পর্দা ভেদ করে
মগজে গিয়ে তাল পাকাতে থাকে। কাঁপছে তার সারা অঙ্গ। এখনই যেন পড়ে যাবে সে টাল সামলাতে
না পেরে। স্মৃতির বেদীমূলে কে যেন প্রচন্ড আঘাত হেনে তার সমস্ত চেতনাকে অবশ করে দিয়েছে।
পায়ের নিচের মাটি যেন কাঁপছে থর থর করে।
ঠিক
আছে আপনার কথামত মায়ের পছন্দের মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করব।কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথাগুলো বলে ত্রস্ত পদে বেরিয়ে আসে শাওন চারদেয়ালের বাইরে মুক্তাঙ্গনে।
পেছন হতে তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে
যাচ্ছে কোন এক অশুভ শক্তি। তাকাতে চায় না সে পেছন পানে। তাকালেই হয়তো ভয়ংকর বেগে লটকে থাকা অজগরটি কপালে ছোবল মারবে। প্রচন্ড
ভয়ে ঘামছে শাওন। হৃৎপিন্ডটা কাঁপতে কাঁপতে এখনই
যেন বেরিয়ে আসবে। ফেরার পথে দেয়ালে টাঙ্গানো মাদার গাছের ছবিটির দিকে একপলক তাকিয়েছিল
সে।গাছের ডালে ঝুলন্ত সাপটি যেন বৃত্তের আকারে ঘুরপাক খেয়ে আসন পরিবর্তন করেছে এরই মধ্যে। শাওনের মনে হল,
ছবির মধ্যেও অজগরটি জীবন্ত।
ধানমন্ডির পাঁচ নম্বর রোডের ৪২ নং বাসার গেইটের সামনে
এসে রিক্সাটি থামে
শাওনের নির্দেশে। ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকেই সোজা নিজের
রুমে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দেয় সে। ছোটবোন নীলা
এসে দরজার গায়ে ঠক ঠক আওয়াজ তুলে বলে,ভাইয়া,সারাদিন কোথায় ছিলে? একটু দরজা খুলতো?
না,এখন দরজা খোলা যাবে না। শুয়ে পড়েছি। পেটে ক্ষুধা
নেই। বন্ধুর বাসায় খেয়ে এসেছি।কাল সকালে দেখা হবে।একটু শান্তিতে
ঘুমাতে দে। মা কোথায় রে?
নিউমার্কেটে গেছেন আংটি কিনতে তোমার হবু বউয়ের জন্যে।
তোমার জন্যে খুশীর
খবর আছে। এবার বোধহয় আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। মা কিন্তু
খুব সিরিয়াস দুপুরে কারোর সাথে আলাপের পর থেকে,বুঝেছ ?
এ পর্যন্ত মোট কতটি আংটি কেনা হল? আর কত? মাকে বলিস,
মাথা ধরেছে, আমাকে
যেন আর ডাকা না হয়,বুঝেছিস? নীলার কাছে স্বাভাবিকতা বজায়
রাখতে কথাগুলো বলে শাওন এক স্বস্থির নিঃশ্বাস নেয়।
নীলার হাসির তরঙ্গ ক্রমেই মিলিয়ে যায়। লাইট নিভিয়ে
শাওন বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। একরাশ ক্লান্তির পাহাড় যেন দেহকে
বিবশ করে দেয়। চোখ মুদে ঘুমের পায়তারা করে। অন্ধকার
কক্ষের বদ্ধ খাঁচায় সে যেন বন্দী পাখী। রাত গভীর হয়। রাতজাগা পাখীদের কিচির মিচির আর হুতুম পেচার কান্নার শব্দ রাতের পরিবেশেকে
ভৌতিক করে তুলে।
শাওনের চেখে ঘুম নেই। ঘন কাল আবরণের খোলসে তন্দ্রাচ্ছন্ন
রাতটি যেন
পৃথিবীকে পেঁচিয়ে রেখেছে নিজের বাহুবন্ধনে। কনকনে ঠান্ডা
বাতাস ভেন্টিলেটার দিয়ে প্রবেশ করে শীতের জানান
দিচ্ছে। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাবার পায়তারা করে সে। মায়ের চিন্তাক্লিষ্ট মুখচ্ছবি
মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। একডজনের উপরে মেয়ে দেখলেও পছন্দ হয়নি মায়ের একটিও।
মা-র
একই কথা, তোদের কাছে আমি টাকা পয়সা চাইনি,চেয়েছি মনের মত একটি ছেলের বউ। এটাও পারবি না ? হয়তো কাল সকালে
শাওনকে ধরে নিয়ে যাবেন কোথাও পাত্রী দেখাতে। ভালভাবে পরখ করবেন বউয়ের মনমেজাজ,চলাফেরা,আদবকায়দা সবকিছু। পছন্দ না
হলে বলবেন, ঠিক আছে আমাদের মতামত পরে জানাব। এর
মানে পছন্দ হয়নি। মাকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা।
পছন্দের সীমারেখা মায়ের কতদুর পর্যন্ত বিস্তৃত মা ছাড়া কেউ তা জানে না। আরে বাবা, একটু ছাড় দিলেইতো হয়, নিজের পছন্দ যে শতভাগ সঠিক
হতেই হবে এমনতো কোন কথা নেই।
আজকের ঘটনা মাকে খুলে বললে কেমন হয়? রাবীর কথা মনে
পড়ে। কালপর্দার
অন্তরালে রাবীকে সে স্পষ্ট দেখতে পায়নি। কৈশোরে দেখা
রাবীর মুখচ্ছবি তার স্পষ্ট মনে আছে। কণ্ঠ ছিল গুরুগম্ভীর, পাড়ার ছেলেদেরকে কারণে অকারণে
শাসাতো কিন্তু আজকের
কণ্ঠস্বর তার সম্পূর্ণ বিপরীত। না মেয়েলী আর না পুরুষালী। মাদারীপীর কি রাবীকে
উভয়লিঙ্গে পরিবর্তন করেছেন, যে কারণে তার সুর পাল্টে গেছে। পর্দার অন্তরালে
মুহুর্তের জন্য আলাপরত জটাধারী সে পুরুষটিকেও স্পষ্ট সে
দেখতে পায়নি। কে সেই পুরুষ? রাবীর সাথে তার কিইবা
m¤úK© ? তবে কি কোনকালে ঝগড়া করে নিখোঁজ
হয়ে যাওয়া রাবীর স্বামী?
পাড়ার ছেলেরা পেয়ারা
চুরি করতে গিয়ে রাবীর বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখে এসেছিল দীর্ঘ এক জটাধারী পুরুষকে।
তাহলে সে-ই কি এ লোকটি? তাইবা কি করে হয়? মাদারীপীরের
আস্তানায় যাদের সাথে দেখা হয়েছে সবইতো জটাধারী
সন্যাসী। টিকেট কাউন্টারে যার কাছে পাঁচশত টাকা ফিস দিয়ে নাম,ঠিকানা,পেশা লেখাতে হয়েছিল তার চেহারাও একই ধরণের।
না,মাকে নির্লজ্জের মত বলতে
সে পারবে না। নীলা শুনে হাসবে, হয়তো ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির ঝিলিক তুলে ব্যঙ্গ করে বলবে, মাকে একা দোষ দেই কি করে?
তুমিও বিয়ের জন্য কম পাগল নও ভাইয়া? ইঞ্জিনিয়ার ছেলে শেষ পর্যন্ত বউ পাগল হয়ে সন্যাসীদের
ভক্ত হলে? ছি,ছি,ভাইয়া,তোমার কাছ
থেকে এরকম আশা করিনি!
না, না, কাউকে একথা বলা যাবেনা। মা, নীলা কাউকে।
এ অভিজ্ঞতা তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। জীবনের চোরাগলিতে হাঁটতে গিয়ে
এমন কিছু জিনিসের সাথে পরিচয় ঘটে যা কাউকে কোনদিন
বলা যায় না। মনের গোপন প্রকোষ্ঠে সে স্মৃতিকে সযত্বে লালন করতে হয় আজীবন।
দরজায় করাঘাতের শব্দে শাওনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাইরে
নীলার কণ্ঠস্বর। ভাইয়া, দশটা বাজে। আর কত ঘুমুবে? মা তোমার
প্রতীক্ষায় বসে আছেন। তাড়াতাড়ি ওঠো।
লেপ সরিয়ে শাওন ওঠে দাঁড়ায়। গতরাতে কাপড় ছাড়া
হয়নি। অজগরটি স্বপ্নের ঘোরে দুবার তার লেপের পাশে এসে ওর হাত
পেঁচিয়ে ফনা মেলে হিস হিস করছিল লাল দুটো চোখ মেলে। ঘুমের ঘোরে ওর বিশাল বপুকে সরাতে গিয়ে
খাটের খুঁটির সাথে হাত লেগে জখম হওয়া কনুইটি ব্যথায় টনটন করছে।
বাথরুমে
ঢুকে গোসল সেরে নেয় শাওন। এক রাশ ক্লান্তিকে ধূঁয়ে, মুছে সতেজ হয়ে ফিরে আসে। নূতন
একপ্রস্থ কাপড় গায়ে জড়িয়ে মায়ের বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতেই মা বল্লেন, কি রে,
মাথাব্যথা সেরেছে? তোর জন্যে বসে আছি, চল্ তোকে নিয়ে এখনই এক জায়গায় যেতে হবে। চা, নাস্তা তাড়াতাড়ি সেরে নে।
কোথায় মা?
তেজগাঁয়ের এক ষ্টাফ কলোনীতে।
কথা বাড়ায় না শাওন। মায়ের পরণে দামী শাড়ী। খুব মানিয়েছে।
মা হয়তো কোন ক’নের সন্ধান
পেয়েছেন। বিরক্ত হয় না সে। মায়ের জন্যে দুঃখ হয়। ছেলের জন্যে তিনি ঘুম হারাম
করেছেন।
ঠিকানানুযায়ী তেজগা ষ্টাফ কলোনীর ১২/এ-এর খোঁজ পেতে
অসুবিধা হয়না মা ছেলের। কলিং বেল টিপতেই বেরিয়ে আসেন এক বৃদ্ধা।
সৌজন্য বিনিময়ের পর ড্রইংরুমে নিয়ে বসান। আরাম
করে বসতে বলে ব্যস্ত হয়ে ভেতরে ঢুকেন। ময়লা কোট
গায়ে অন্য এক ভদ্রলোক এবারে মা’কে
উদ্দেশ্য করে বলেন,এই কিছুক্ষণ আগে আমিও এসেছি।
আপনার সাথে গতকাল ফোনে আলাপের পর সিদ্ধান্ত নিলাম আপনার
ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটির জন্যে এ মেয়েটিই উপযুক্ত হবে। পিতৃ-মাতৃহীন। বাপ মা তো আর চিরদিন
কারোর থাকে না। বলতে গেলে সন্তানহীন এই মামার কাছেই মেয়েটি মানুষ হয়েছে। এত ভাল মেয়ে এ তল্লাটে আর দেখিনি, কি
রূপে, কি গুণে। গত বছর খুব ভাল রেজাল্ট করে এম,
এস, সি পাশ করেছে। এখনই আসবে। আমার কথা সত্যি কিনা
একটু পরখ করেই দেখুন! জীবনে কত মেয়েকে পার করেছি,কিন্তু এমন গুণবতী মেয়ে এ যাবত চোখে পড়েনি।
মা,ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,দেখুন আমার ছেলের
জন্যে ধনসম্পদ বা
যৌতুক কিছুই চাই না। তাছাড়া বাপ, মা নেই এটাও আমার কাছে
বড় কথা নয়। আমি শুধু একটি মেয়ের মত মেয়ে চাই।
ঘরের প্রথম ও শেষ বউ। সে হবে ভাল বংশের, শিক্ষিতা এবং সর্বগুণে গুণান্নিতা,ব্যাস আর কিছুই চাইনা।
আলাপের মধ্যেই হাতে চা নাস্তার ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে
এক সুন্দরী যুবতী নত মস্তকে। কাল চাদরে মাথার অর্ধেক ঢাকা।
সবাইকে সালাম করে কার্পেটে হাঁটু গেড়ে বসে।আস্তে আস্তে কাপে চা ঢালতে থাকে আনমনে।
মা এক বিচিত্র ভঙ্গিতে চেয়ে থাকেন মেয়েটির মুখপানে।তার চোখের গভীর দৃষ্টি মেয়েটির আপাদমস্তক অতিক্রম করে কোথায়
গিয়ে ঠেকেছে কে জানে! এবার মুখ খুললেন, ঠিক আছে
মা, তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমরা নিজেরাই এ সামান্য
কাজটুকু সেরে নিতে পারব। তা তোমার নাম
কি মা?
আমাকে সবাই নূপুর বলে ডাকে। আসল নাম জিনাত রেহানা।
ধীর শান্ত কণ্ঠস্বরটি যেন নূপুরের রিনিঝিনি। বাহ! খুব সুন্দর নামতো? এম,এস,সি পাশ করেছ শুনলাম।তা,এখন
কি করবে বলে ভেবেছ?
এখনও
কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।
শুনলাম
তোমার বাপ মা নেই, তাদেরকে মনে পড়ে?
জী,না
-তবে মামা আছেন যিনি আমাকে পিতৃস্নেহ দিয়ে বড় করেছেন। আমার সৃষ্টিকর্তা ও মামা যা করলে খুশি হবেন,আমি তা-ই মেনে নেব। চোখের
কোণ মুছতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে মেয়েটি।
তোমাকে
দুঃখ দেবার জন্য একথা বলিনি মা। বাপ মা কারোর জীবনভর থাকেনা।
তোমার পিতা-মাতা হয়ত এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, আমাদেরকেও
এমনি একদিন চলে যেতে হবে – এটাইতো
স্রষ্টার বিধান। মুরব্বীদের প্রতি তোমার শ্রদ্ধাবোধ দেখে বড় খুশী হলাম মা
। মনে হচ্ছে, এমনি এক পবিত্র মনের মেয়েকে আমি এতদিন ধরে খুঁজছিলাম! এদিকে এসো মা,
দেখি তোমাকে এ আংটিতে কেমন মানায়? কেমন করে তোমাকে আদর করি বলতো? এক জটাধারী সন্যাসীর কাছে ওই যে ওনার মত একজন ঘটকের
সন্ধান না পেলে তোমাকে কি খুঁজে পেতাম মা? তোমার
মামাকে যে দেখছি না, উনি আবার কোথায় গেলেন?
উনি একটু জরুরী কাজে গ্রামের বাড়িতে গেছেন, আজই ফিরে
আসবেন। মামার বাড়ী মাণিকগঞ্জের সিংগাইরের কাজীবাড়ি।
সিংগাইরের কাজিবাড়িতো বনেদি পরিবার বলে জানি। তুমি
তোমার নানাবড়িতে গিয়েছ কখনো?
জ্বী, অনেকবার।
এতক্ষণ শাওন নিরবে নতমস্তকে বসেছিল। মায়ের কথায়
চমকে ওঠে সে। এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর যেন ধ্বসে গেল তার
চোখের সামনে। মনে হল এক জটাধারী সন্যাসী ও ঘটকের রহস্যময় দূর্গে মাকে নিয়ে প্রবেশ করেছে সে নিজের অলক্ষে।এখান
হতে বেরিয়ে আসা যাবেনা তাদের আয়োজনকে অস্বীকার
করে।
সবকিছুই রাবীদের সাজানো। হ্যাঁ, তার ব্যাপারটিও নিখুঁতভাবে
সাজিয়েছে হিউম্যান সাইকোলজিতে ডক্টরেট ঘটক ও জটাধারী
রাবীরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। পেশার খাতিরে ওরা সংঘবদ্ধ একটি চক্র। বিভিন্ন
মুখোশ পরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে।
তাইতো রাবীরা পারে রোগীর মনের কথা জেনে রোগের পথ্য নির্ধারণ করতে।
এবার মায়ের বুকে নেতিয়ে পরা নূপুরের দিকে আড়চোখে
তাকায় সে। ওর অনাবৃত সুন্দর হাতের আঙ্গুল পেঁচিয়ে আকিক পাথরের
আংটির সাথে শোভা পাচ্ছে মার দেয়া সোনার আংটিটি।
মার শুভেচ্ছার স্বীকৃতি।
অকস্মাৎ চমকে ওঠে সে! এমনি একটি অনাবৃত
সুকোমল হাতের অঙ্গুলিতে আকিক পাথর খচিত একটি আংটি মুহুর্তের জন্য হলেও ইতিপূর্বে সে কোথাও দেখেছিল। হ্যাঁ, স্পষ্ট মনে পড়ছে।
গতকাল মাদারীপীরের আস্তানায় যাওয়ার পথে ঠিক তারই
সামনে চার পাচ হাতের ব্যবধানে এক বৃদ্ধের সাথে
ভীতসন্ত্রস্থ এক তরুণীর সুঢৌল হাতের অঙ্গুলিতে এ ধরণের একটি আংটি সে দেখেছিল। শুভ্র সুন্দর অনামিকায় আকিক খচিত আংটিটি দেখে বোরকাবৃত
সেই তরুণীটির
Rb¨ তার হৃদয়ের পুষ্পিত বাগানে মুহূর্তের
জন্য প্রবল এক ভাললাগার ঝড়ও বয়েছিল। তাহলে কি ঐ লোকটিই
এ মেয়েটির মামা ছিলেন?
মা
মেয়েটিকে নিয়ে মহাব্যস্ত। কখনো বুকে চেপে ধরছেন, আবার কখনো হৃদয়ের সমস্ত মমতা মিশিয়ে
ওর দীঘল কাল কেশে বিলি কেটে দিচ্ছেন। মেয়েটি মিশে আছে মায়ের বুকে। আনন্দাশ্রু ঝরছে
ঝর্ণার মত ওর দু’চোখ ভাসিয়ে ।
রাবীর
শেষ কথাটি মনে পড়ে, বাপ মা নেই এমন একটি মেয়েকে তোমার মায়ের পছন্দ হলে তাকে অবজ্ঞা
করনা বাবা,
যদি কর তাহলে এর ফল হবে ভয়াবহ।
কঠিন
হয়ে ওঠে শাওনের চোয়ালের দু'পাশের রগ প্রবল এক উত্তেজনায়।
nu¨v,
তাই আমি দেখতে চাই রাবী। তোমার সাজানো বাসরে প্রবেশ না করে
সেই ভয়াবহ রূপটি একটিবার দেখে মরতে চাই কিন্তু পরক্ষণেই তার পৌরুষ হার মানতে বাধ্য
হয় মায়ের উচ্ছ্বাসের কাছে।
নূপুরকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত মায়ের মুখখানা যেন প্রশান্তিতে
ভরে গেছে। মুখমন্ডল
তৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কিছু
বলতে গিয়েও পারে না শাওন। পিতৃবিয়োগ হওয়ার পর
একযুগ পেরিয়ে গেল, মাকে এমনভাবে প্রসন্ন হতে দেখেনি কতটি বছর।
অস্পষ্ট ভাষায় বলে ওঠে,আমার সাধ্য কোথায় রাবী?
জটার মতই শক্তভাবে
সাজানো তোমার সকল আয়োজন, আর তাই বিষধর অজগরকে পুষে বছরের
পর বছর তোমার ভাঙ্গাঘরের পাহারাদার বানিয়ে রাখতে
পেরেছ| আরও
পেরেছ মাদার গাছের কাল চূলসদৃশ শুকনো লতা দিয়ে এদেশের সকল জটাধারীদেরকে
একই আঙ্গিকে রূপ দিয়ে এক পূর্ণ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে,আর এ রাজত্বে তুমিই একচ্ছত্র
সম্রাজ্ঞী।
==================
No comments:
Post a Comment
What do you think?