Monday, July 15, 2019

বেলাশেষের ফরিয়াদ (ছোটগল্প)

 বেলাশেষের ফরিয়াদ

-নাজমুল চৌধুরী

শেরেগুল খার তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা মুহূর্তে কেটে যায় ভারি বুটের পদশব্দে। তারই অন্ধকার সেল-প্রকোষ্ঠ বরাবর ক্রমশ শব্দগুলো এগিয়ে আসছে। এত ভোরে কারা আসছে? জেদ্দার বৃমান কারাগারে দীর্ঘ তিনমাসের বন্দী জীবনে কাক ডাকা ভোরে কোন নিরাপত্তা প্রহরীর আনাগোনা সে কখনো লক্ষ করেনি ইতোপূর্বে। নাকি বিপদ মুক্তির কোন শুভ সংকেত? আশার আলোয় লাল হয়ে যাওয়া তার চোখ দুটি দপ করে জ্বলে উঠে মুহূর্তে। অনিবার্য বিপদ থেকে দলের লোকজনদেরকে উদ্ধারের জন্য জেদ্দায় তাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত কমান্ডোবাহিনী প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন প্রফেশনে কর্মরত রয়েছে। তিনবছর পূর্বে কলম্বিয়ার পুলিশ কাস্টডি হতে আকস্মিক হামলা চালিয়ে দলের কমান্ডোরা তাকে মুক্ত করেছিল এমনি এক ভোরে।

ফজরের আজান প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দিকে দিকে। অন্ধকার সেল-প্রকোষ্ঠে অনিদ্রায় শেরেগুলের ত্রিশ বছরের টনটনা যৌবনের ভাঁজে ভাঁজে পড়েছে কালির ছাপ। অপদার্থ কমান্ডোদের অহেতুক উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী। ওরা এত দেরি করছে কেন? কি সংঘবদ্ধ দল তাদের! সপ্ত মহাদেশের অগণিত রাজধানীতে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের হিট স্কোয়ার্ড। স্পেশাল ট্রেনিং রয়েছে এদের। পথের কাঁটা চিরদিনের মত সরিয়ে দিতে এদের জুড়ি নেই। এ জগতের বাসিন্দাদের এক ভিন্নতর জীবন। একবার এর সদস্য হয়ে গেলে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত দলে থাকতে হবে, নতুবা অবধারিত মৃত্যু।

মুক্তির চিন্তার পাশাপাশি অতীতের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা একে একে মনে পড়ে শেরেগুলের। কাবুলের এক সাধারণ হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে চাকরির জন্য কত ধর্ণাই না দিতে হয়েছিল তাকে। ছোটবেলা পিতাকে হারিয়ে মায়ের চেষ্টায় সে মেট্রিক পর্যন্ত কোনরকম এগিয়েছিল। অভাবী সংসার। যুদ্ধকালীন অবস্থায় পৈর্তৃক সম্পত্তি এক রকম নিঃশেষ। স্ব-সম্মানে বেঁচে থাকার জন্য একটা চাকরি তার একান্ত প্রয়োজন। দীর্ঘ ত্রিশটি বছর ধরে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট খুব একটা সুখকর নয়।

চাকরি খুঁজে খুঁজে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে একদিন বাড়ি ফেরার পথে মার্সিডিস গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়েছিল রাস্তার একপাশে। গাড়ি চালক নিজে ভিড় ঠেলে তাকে কোলে তুলে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। জ্ঞান ফিরে দেখে তার এক হাতে ব্যান্ডেজ। পাশে গগলস ও স্যুট পরিহিত সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। স্নেহপ্রবণ কণ্ঠে বললেন,খুব বেশি ব্যথা পেয়েছ?

এক্সরে রিপোর্ট দেখে বললেন না,ঘাবড়ানোর কারণ নেই। ডান হাতে একটু ফ্রাকচার হয়েছে এই যা। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে কিছুই ভাবতে হবে না। চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমিই বহন করব। বাড়িতে কে কে আছে তোমার, তাদেরকে কি খবর দিতে হবে?

ভদ্রলোকের মমতা মাখানো কথায় সব ব্যথা ভুলে যায় শেরেগুল। পিতার চেহারা ঠিক তার মনে নেই। ফটোতে দেখেছিল পিতাও তার এমনি সুন্দর চেহারার সুপুরুষ ছিলেন।প্রতিবেশীরা বলত,ছেলেটি হয়েছে ঠিক তার বাপের মত। চেহারা নিয়ে শেরেগুল কখনও মাথা ঘামায়নি। মা-কে খুশি রেখে চলতে শিখেছে সে। এমন মা কারোর হয় না। এ নিয়ে তার গর্বও অনেক।একমাত্র ছেলের মুখের পানে চেয়ে মা আর বিয়ে বসেননি। অথচ তার শৈশবের বন্ধু হেকমতের পিতৃবিয়োগ হওয়ার পর মা অন্যের গলে মালা পরিয়েছিলেন ছমাসের মাথায়। যাকে নিয়ে তার এত গর্ব সে মা-কে মনে পড়াতে অসংকোচে ভদ্রলোককে নিজের বাড়ির ঠিকানা বলে দেয়।

ঠিক আছে, এ নিয়ে তুমি কিচ্ছু ভেবোনা। তোমার মা-কে তোমার হাতে ব্যথা পাওয়ার ক্ষতিপূরণসহ যথাসময়ে খবর দেয়া হবে, কেমন? এমন করে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলে কেন? চাকরির ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়েও শেরেগুল থেমে যায়। ছিঃ ভদ্রলোক এতকিছু করছেন, এরপরও নিজের দৈন্যদশার কথা বলা কি ঠিক হবে? কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। ভেতরের কথাগুলো আস্তে আস্তে টেনে বের করলেন এক মোহনীয় শক্তি প্রয়োগ করে।

তিনদিন পর হাসপাতালে এসে ভদ্রলোক হাজির। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,চলো আর দেরি নয়। তোমার মায়ের সাথে দেখা করে আমার ঠিকানায় কালই চলে আসবে। চাকরিতো তোমার দরকার, তাই না? সে হয়ে যাবে। ড্রাইভার তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে এবং পরদিন আবার নিয়ে আসতেও যাবে,প্রস্তুত হয়ে এসো, কেমন?

ভদ্রলোকের কথাগুলো পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করার পূর্বেই ড্রাইভারের ডাকে অগ্রসর হতে হয় শেরেগুলকে। নিশ্চয়ই দুর্ঘটনা নিয়ে পুলিশ কেইস হয়েছে। ভদ্রলোকের কোন দোষ নেই। সব তারই কর্মফল। কেন অন্যমনস্ক হয়ে সে রাস্তা ক্রস করছিল? হ্যা,কাল এসে পুলিশকে বলবে তারই দোষ ছিল। অমন অমায়িক ভদ্রলোকটির গায়ে দোষের আঁচড় লাগতে দেবে না সে ।

বাড়িতে ঢুকে মায়ের কাছে যা শুনল তাতে শেরেগুলের চোখ ছানাবড়া। মা বললেন, জোর করে ভদ্রলোক দশহাজার রুপীয়া হাতে দিয়ে গেলেন, কোনরূপ ওজর আপত্তি শুনতে চাইলেন না। তাছাড়া তোর চাকরিও নাকি কান্দাহারে ঠিক করে রেখেছেন। কালই নাকি জয়েন করতে হবে।একেই বলে তকদির। তোর বাবা বেঁচে থাকলে আজ কত খুশী হতেন!

পরদিন কাবুল হতে সোজা কান্দাহার ইয়ং এন্টারপ্রাইজ-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় শেরেগুল। জয়েন করার পরদিনই তাকে এক বছরের ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয় কান্দাহারের পার্বত্য এক আস্তানায়। পুরোপুরি একবছর ট্রেনিং। অফিসে মায়ের ঠিকানা লিখে দিয়ে যায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। মায়ের কাছে নাকি ট্রেনিং প্রিয়ডে প্রতিমাসে এক হাজার রুপীয়া করে পাঠাবে কোম্পানি। শেরেগুলের মনে হয়, তকদিরের ফের যতটুকু গড়াতে পারে বুদ্ধি কিংবা চিন্তা ততটুকু পারে না।

বছরান্তে শেরেগুল নিজেকে আবিষ্কার করে কঠিন এক আবেষ্টনীর মধ্যে সে এক রবোট বিশেষ। যা বলা হবে তার বাইরে কিছু করা যাবে না। সহজ সরল মনের গোপন কোণটি যেন এই এক বছরে এক কঠিন আবরণে ঢাকা পড়েছে। সব ট্রেনিংই সে শেষ করেছে। চারপাঁচটি ভাষায় অনর্গল কথা বলা থেকে শুরু করে সুটিং, জুডো, কারাতে, এক্রোবেট সবকিছু। ট্রেনিংয়ের শেষ দিনটি ছিল বড়ই ভয়ঙ্কর। চিড়িয়াখানার বাঘের খাঁচার মত একটি খাঁচাতে প্রবেশ করতে তাকে বলা হল। সাথে সাথে নির্দেশ পালন এখানকার নিয়ম। খাঁচায় ঢোকামাত্রই সামনে ভয়ঙ্কর চেহারার হিংস্র একটি জার্মান সেফার্ড হানটিং ডগ দেখতে পেয়ে শেরেগুলের গায়ের লোম প্রবল ঝাকুনি দিয়ে খাড়া হয়ে যায়। হৃৎপিণ্ড কাঁপতে থাকে নিরুপায় হয়ে। এক্ষুণি যেন ঝাপিয়ে পড়বে শেরেগুলের ঘাড়ে হিংস্র কুকুরটি। মটকে দেবে মুহূর্তে নাজুক ঘাড়টি। নাদুস নুদুস শরীরটি নিয়ে রক্তের হুলিখেলায় মত্ত হবে কিছুক্ষণের মধ্যে।

কটমট করে তাকাচ্ছে হিংস্র কুকুরটি। যেন বলছে, কোথায় যাবে যাদু? দেখি কতবড় বাহাদুর? পিঞ্জুরার বাইরে নিরবে দাঁড়িয়ে আছেন ওস্তাদ। তাহলে কি শেরেগুলকে অজানা কোন অপরাধের শাস্তি পেতে হচ্ছে? কি তার অপরাধ? আর এক পা দুপা করে এগিয়ে আসছে কুকুরটি। চোখ দুটোতে অসম্ভব হিংস্রতার ছাপ।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শেরেগুল,কি করত পারে সে এখন? সিংহের মত হা করে কুকুরটি এক লাফে এগিয়ে আসে তার দিকে বিকট ঘেউ ঘেউ শব্দে।এ্যক্রোবেটিক কায়দায় সরে পড়ে সে পলকে। কুকুরটি বিশাল বপু নিয়ে লোহার রডে ছিটকে পড়ে। জিহবা বের করে হাঁফাতে থাকে। এবার আরও যেন হিংস্র হয়ে উঠে। আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায়ে এবার শেরেগুল বাঁচার তাগিদে কুকুরটির চোয়াল লক্ষ্য করে বিরাশী শিক্কার ল্যাপ্ট জ্যাক মারে জুডো কায়দায়।

কুকুরটি কাউ কাউ করে উঠে ব্যথায়। যেন ক্ষিপ্র হয়ে উঠে মুহূর্তে। বাইরে থেকে অদ্ভুত এক শব্দ ভেসে আসতেই কুকুরটি রণে ভঙ্গ দেয়। খোঁড়াতে খোঁড়াতে পিঞ্জুরার এক পাশে শুয়ে লোহার রড কামড়ে ধরে ব্যর্থতার গ্লানিতে।

শেরেগুলের পিছনে ওস্তাদ দাঁড়িয়ে। সা-বা-স শেরেগুল, সা-বা-স। তোমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। পিঠ চাপড়াতে থাকে ওস্তাদ খুশি হয়ে। কিছু মনে করনা।এটা ছিল তোমার জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। তোমাকে মেরে ফেলার আদেশ কুকুরটিকে দেয়া হয়নি। শুধু তোমার সার্ট আর প্যান্ট ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলার নির্দেশ ছিল। অবশ্য তাকে সে সুযোগ দেয়া হয়নি। চেয়ে দ্যাখো, লোহার রড কামড়ে কিভাবে তার রাগ প্রশমিত করছে! জান, আমাদের বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়ায় তাদের অনেকের রক্তের স্বাদ এ কুকুরটি নিয়েছে। তার সত্যিকার হিংস্র রূপ তুমি দেখনি। নির্দেশ পেলে কি ভয়ঙ্করভাবে সে মানুষ নিয়ে খেলতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। এ ধরনের বাহাদুর আমাদের কাছে রয়েছে অনেক। পৃথিবীর প্রতিটি বড় বড় শহরে এদেরকে ট্রেনিং দিয়ে পাঠানো হয়। অন্ধকার কক্ষে রাখা হয়। শুধু একটি নির্দেশ, ব্যাস, যারা আমাদের পথের কাঁটা.তাদেরকে ধরে এনে দলের লোক এদের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পরের দিন কয়েকটি মাংসবিহীন হাঁড় ফেলে আসতে হয় ডাস্টবিনে।

আফজল খানের নের্তৃত্বে শেরেগুল প্রথম অ্যাসাইনম্যান্ট নিয়ে আফগানিস্তানের চমন বর্ডার দিয়ে পাকিস্তানের কোয়েটাতে প্রবেশ করে। পুরিন্দাগুলো মসজিদের দারোয়ান ছদ্মবেশী হেলাল খানের কাছে পৌঁছে দিয়ে আনুগত্যের নিদর্শনসরূপ পঞ্চাশ হাজার রুপাইয়ার কড়কড়ে নোটগুলো প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল তার অগ্রযাত্রা। টাকার ঘ্রাণ তাকে এক স্বপ্নিল নেশায় বিভোর করে রেখেছিল।

গত দশবছরে অনেক কামিয়েছে সে। কোটি কোটি টাকা। চাকরীক্ষেত্রে চারটি পদোন্নতি পেয়ে নিজের অবস্থানকে করেছে আরও সুদৃঢ়। পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে। গ্রুপ লিডার হিসাবে সাতটি মহাদেশের অগণিত রাজধানীতে পৌঁছে দিয়েছে নেশাখোরদের কাছে তাদের নেশার উপাদান। চাওয়ার শেষ নেই বলে ঢাকা ও জেদ্দার বিশলক্ষ রুপেয়ার এবারের অফারটি সে পায়ে ঠেলে দিতে পারেনি। ভেবেছিল এ অফারের সম্পূর্ণ সে গুলবদনের জেওর কিনতে খরচ করবে। মায়ের পছন্দ করা শৈশবের খেলার সাথী গুলবদনকে আপাদমস্তক সোনা দিয়ে সাজিয়ে ঘরে তুলবে। গুলবদনের রূপের সাথে যদি কারোর তুলনা করতে হয় তাহলে বেহেশতের কল্পিত হুরপরীর সাথেই তুলনা করতে হবে। মনে পড়ে স্কুলে তৈমুর লং নাটকে তার পাঠ দেখে গুলবদন বলেছিল,তুমি যদি সত্যিই তৈমুরের মত দুনিয়াটা জয় করে নিতে পারতে? উত্তরে সে বলেছিল, পারবোনা কেন জানিস? যেহেতু তৈমুরের মত আমার এক পা খোঁড়া নয় বলে। স্বপ্নিল সে দিনগুলোর কথা মনে হতেই ঠোঁটের কোণে হাসির লহর খেলে যায় মুহূর্তে।

শেষ অ্যাসাইনমেন্ট দুটো নিয়ে সে বেরিয়েছিল তিনমাস পূর্বে। কাবুল থেকে করাচী হয়ে ঢাকা। সর্বশেষ গন্তব্য জেদ্দা। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে রিসিভ করেছিল দলের সদস্য সলমান। কাস্টমস কাউন্টারের ভি,আই,পি চ্যানেল দিয়ে অতি সহজে পেরিয়ে এসেছিল সে। সলমানের সাথে ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন নামকরা এক ব্যবসায়ী। টাকার কুমীর।

হোটেল সেরাটনের নির্দিষ্ট কক্ষে সাজানো তিনকিলো ওজনের পুরিন্দাগুলো হ্যান্ডওভার করে এক স্বস্থির নিঃশ্বাস নেয় সে। পেমেন্ট যথাসময়ে পৌঁছে যাবে ঢাকাস্থ আমেরিকান একপ্রেস ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের সেন্ট্রাল একাউন্টে।

তার আগমন উপলক্ষে সেরাটনের বিস্তৃত বলরুমে প্রিন্সেস লায়লা নাইটের আয়োজন করেছিল সলমান। বোম্বে হতে এসেছিল লায়লা। বাজনার তালে তালে শরীরের সুন্দর সকল ভাঁজগুলো ফোটানো ফুলের মত মেলে ধরেছিল লায়লা। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চস্থানীয় অনেক নারী-পুরুষের উপস্থিতি ছিল বলরুমে। সবাই তাদের খদ্দের। নেশার রাজ্যে সবাই এক একজন রাজা-রাণী।

হোটেল বলরুমে ঢলে পড়েছিল নেশাগ্রস্ত নারীপুরুষের দল একসময় নিজেদের পছন্দনীয় একে অপরের মুক্ত আলিঙ্গনে। পূব-আকাশে ভোরের সোনালী সূর্যের রক্তিমাভা হোটেল কক্ষে উকিঝুঁকি দিতেই নেশা কাটিয়ে ওঠা অর্ধউলঙ্গ নরনারীর দল হোটেল সংলগ্ন সুইমিং পুলে নেমে পড়ে রাতের আবর্জনা ধুয়ে ফেলার লক্ষে। সকাল দশটার দিকে কেউ কেউ ছুটে চলে রাজনৈতিক মঞ্চের সামনে অপেক্ষমান উল্লাসিত জনতার সামনে। কেউবা সিনেমার মুভী ক্যমেরার সামনে। আবার কেউবা অফিস বস হয়ে শত শত অধঃস্তন কর্মচরীর সামনে। দিনের আলোয় ওদের প্রত্যেকেই নের্তৃত্ব দিচ্ছে এক বিরাট জনগোষ্টীর।

নিজেকে ওদের চেয়ে অনেক উত্তম মনে হয় শেরেগুলের। সাদা সাদা পাউডারের পুরিন্দা সে গত দশ বছরে অনেক পাচার করেছে, কিন্তু শরীরের ওপর এর প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করেনি কখনো। ট্রেনিংয়ের সময় ডাঃ নিজাম-উল-মুলক, ল্যাবরেটরি কক্ষে দেখিয়েছিলেন এর প্রতিক্রিয়া ডিস্টিল ওয়াটারের সাথে হেরোইন পাউডার মিশিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায়।

ট্রেনিং প্রিয়ডে হিরোইনমাখানো ইনজেকশনটি পুশ করেছিলেন প্রথমে একটি ইদুঁরকে। নেশায় বুদ হয়ে পড়েছিল ইদুঁরটি। দ্বিতীয়দিন সকাল আটটায় তার খাঁচায় চিক চিক শব্দ করছিল। ইনজেকশন পুনরায় পুশ করলে শান্ত হয়ে পড়ে আবারো নেশার রাজ্যে। তৃতীয়দিন সকালে এক অভিনব কাণ্ড দেখতে হল শেরেগুলকে। ঠিক সকাল আটটায় ইদুঁরটি খাঁচায় লাফাচ্ছিল আর ভীষণ শব্দ করে যেন কাঁদছিল। ডাঃ মুলক সকল ট্রেইনিদেরকে এক ঘন্টা দেরিতে নিয়ে গেলেন খাঁচার সামনে। বললেন, ইনজেকশন পুশের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বলে ইদুঁরটি এখন পাগলপ্রায়। তাকে তার প্রাপ্য দিতেই হবে বলে এগিয়ে গেলেন খাচার সামনে। বুঝতে পেরে ইদুঁরটি তারের ফাঁক দিয়ে দু-পা বাড়িয়ে দিল স্বেচ্ছায়। ইনজেকশনটি পুশ করতেই একেবারে চুপচাপ। নির্বোধ বালকের মত পিট পিট করে একবার তাকালো সবার দিকে। পরম তৃপ্তিতে চোখ বুঝলো প্রত্যাশিত ডোজ পেয়ে।

এবার পাউডারের প্রয়োগ দেখালেন ডাঃ মুলক অন্যভাবে। একটি পিতলের কৌটায় সামান্য পাউডার ঢেলে এগিয়ে গেলেন খাঁচায় রক্ষিত শিম্পাঞ্জীর দিকে। পকেট থেকে লাইটার বের করে পাউডারে একটু আগুন ধরিয়ে দিলেন। সিম্পাঞ্জী পাগলের মত ছুটে এসে নাক দিয়ে দু-তিন টান দিয়ে নির্গত ধোঁয়া সেবন করে চোখ বুজে বুদ হয়ে পড়ে রইল পরম স্বপ্ন রাজ্যে। ডাঃ মুলক বললেন, এগুলো এমন জিনিষ যা মাত্র তিনদিন ব্যবহার করলে বাকি জীবন ব্যবহার করতেই হবে। আমাদের খদ্দের এ পৃথিবী জুড়ে রয়েছে অনেক। ব্যর্থ প্রেমিক, বড়লোকের অবাধ্য সন্তান, দাম্পত্যজীবনে অসুখী দম্পতি, প্রতিষ্ঠলোভী রাজনীতিবিদ, আর রয়েছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনেক টাকার কুমীর ব্যবসায়ীমহল।ওদের বিরুদ্ধে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কিছুই করতে পারে না। করতে গেলে ওদেরকে হয় হারাতে হবে চাকুরি নতুবা জীবন। তাছাড়া আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাফিয়ারা তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। বিশ্বজুড়ে আমাদের প্রচণ্ড প্রতাপ।

কথাটি সত্য কিন্তু এ সত্যটি কেন প্রমাণিত হচ্ছে না জেদ্দার এ কারাগারের রঙ্গমঞ্চে? তিনটি মাস ধরে সে অন্ধকার সেল প্রকোষ্ঠে বন্দী। অথচ এখানকার কমান্ডোদের যেন কোন মাথাব্যথা নেই? তাহলে কি তাকে এরূপ বিপদে ফেলা হয়েছিল দলের কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তির ইচ্ছায়? তা-ই বা হয় কেমন করে,তাদের অভিধানে ব্যক্তিগত স্বার্থে দলের লোককে ইচ্ছে করে বিপদে ফেলার কোন রীতি নেই।

মনে পড়ে, ঢাকাস্থ সেরাটন হোটেলের বিশ নম্বর কক্ষে দলের সদস্য সলমানের সাথে এক ভদ্রলোক ঢুকেন। সলমান পরিচয় করিয়ে দেয় ইনি হচ্ছেন আমাদের বিশ্বস্ত ফ্রেন্ড। কাস্টমস্‌ ইনটেলিজেন্সের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ব্রিফকেসটি যথাসময়ে তোমার হাতে পৌছবে ইমিগ্রেশন অতিক্রম করার পর। শুধু cvm‡cvU© তোমার কাছে থাকবে। সলমান একটি খাম এগিয়ে দেয় শেরেগুলের দিকে। স্মিতহাস্যে বলে, বাদবাকি যা করার তা এতেই লিখা আছে। কোড নাম্বারগুলো মিলিয়ে নিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

নীল স্যুট পরিহিত শেরেগুলকে ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছিল। সলমান রসিকতা করে বলে, মেয়েরা তোমাকে এ অবস্থায় দেখলে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে তাই ভাবছি! সাথের ভদ্রলোক সলমানের কথায় খেই ধরে বলেন, সত্যিইতো এমন হ্যন্ডসাম মানুষ সচরাচর দেখা যায় না।আপনাদের সিলেকশনের প্রশংসা করতেই হয়। সকাল এগারটায় জেদ্দাগামী বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ডি,সি,টেন-এ চড়ে বসে শেরেগুল। প্লেনে উঠার পূর্বমুহূর্তে কাস্টমস্ ইনটেলিজেন্সের সে অফিসার একরকম দৌঁড়ে এসে যাত্রীদের সামনে শেরেগুলকে ইংরেজিতে বলেন, আপনার ব্রিফকেসটি ভুলে ফেলে এসেছেন। এই নিন, গুডলাক বলে করমর্দন করলেন। যাত্রীদের অনেকেই অফিসারটির সততার প্রশংসা করল।

আনন্দ-বিষাদে মাখানো অনুভূতির ছন্দপতন ঘটল জেদ্দা বিমানবন্দরে নিরাপদ অবতরণের মধ্য দিয়ে। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে কাস্টমস্ কাউন্টারের ঠিক বিপরীতে একটি চেয়ারে বসে সতর্কতার সাথে স্যামসনেট ব্রিফকেসটি খুলে শেরেগুল। তিনটি নীল প্লাস্টিকের কৌটা ব্যাগের উপরে সাজিয়ে রাখে। একটির উপরে রয়েছে শুকনো রুটি,অন্য দুটির অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের উপর সাজানো রয়েছে পাকা খেজুর।

এক টুকরো রুটি মুখে পুরে শেরেগুল চিবুতে থাকে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, নির্দিষ্ট লোকটি আসছে না কেন? কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষের একজন সামনে এগিয়ে এসে শেরেগুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, ইয়াল্লাহ - সুরা ইয়া শেখ .... তাড়াতাড়ি শেষ করে কাস্টমস্ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করে। রুটি চিবুনের মধ্য দিয়ে ঈশারায় একটু সবুরের মিনতি জানায় শেরেগুল। 

শাসরুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান ঘটল যখন হলুদ পোষাক পরিহিত এয়ারপোর্ট ক্লিনার জাওয়েদ এসে সামনে ঝাড়ু দেয়ার ভান করছিল। হ্যাঁ,স্পষ্টই বুক পকেটের উপর জাওয়েদ নামটি লিখা দেখে আশ্বস্ত হয় শেরেগুল। চোখাচোখি হতেই দুজনের ভাবের আদান-প্রদান হয় নিরবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে শেরেগুল আস্তে করে তিনটি প্যাকেটই জাওয়েদের কাল গার্বেজ ব্যাগে ছুড়ে দেয় পলকে। শেরেগুলকে ইশারায় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে কাজে মন দেয় ক্লিনার জাওয়েদ।

নিজেকে হালকা মনে হয় শেরেগুলের। সবকিছুই নির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, কোথাও কোন খুঁত নেই। কাস্টমস্ কাউন্টার পেরিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে গুণ গুণ করে গান ধরতেই সামনে এসে দাঁড়ায় আফগানী এক লোক। উঁচু করা প্লেকার্ডে এস,জি,খান - গেস্ট অব হলিডে ইন লিখা দেখেই ইশারা করে শেরেগুল। লোকটির পিছনে পিছনে সন্তর্পণে এগিয়ে যায় অপেক্ষমান ট্যাক্সির দিকে। ট্যাক্সিতে বসে শেরেগুল তার প্রিয় হাভানা ফিল্টার সিগারেটে আগুন ধরায়।

নীলাকাশ জুড়ে অযুত নক্ষত্র আর রাস্তার দুপাশের উজ্জ্বল আলোর শোভায় ঝলমল করছে পিচঢালা পথ। মরুর বুকে এ ধরনের একটি সুন্দর শহরের সাথে শেরেগুলের পরিচয় এই প্রথমবারের মত। ফ্লাইওভারগুলো আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার অনুরূপ। মদিনা রোড ধরে ডাউন টাউনের দিকে এগিয়ে চলছে ওরা। ডান দিকের ভিউ গ্লাসের দিকে নজর পড়তেই শেরেগুল ড্রাইভারের দিকে চেয়ে বলে, টিকটিকি তোমার পিছনে লেগেছে, দেখতে পাচ্ছ না?

হকচকিয়ে উঠে ড্রাইভার। ব্যাক ভিউ গ্লাসে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখে। ওস্তাদ, তোমার আন্দাজ সত্য হতে পারে আবার ভুলও হতে পারে। দেখা যাক,পানি কোনদিকে গড়ায়!

পেপসি ওভারব্রিজের পাশে এসে ড্রাইভার ইচ্ছা করেই ডানদিকে মোড় নেয়। তাহলিয়া রোড ধরে লোহিতসাগর অভিমুখে ছুটে চলে হাওয়ায় ভর করে। আধাকিলোমিটার দুরত্ব বজায় রেখে পুলিশের ৯৯৯নং গাড়িখানা পিছু ধাওয়া করে। তাহলিয়া রোডের শেষ প্রান্তে এসে আবার তাদের গাড়িটি বায়ে মোড় নেয়। পুলিশ ভ্যানটি ঠিক আধাকিলোমিটার দুরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে আসছে। এবার ড্রাইভার নিশ্চিত হয়ে বলে,ওস্তাদ,তুমি ঠিকই ধরেছ। তবে অসুবিধা নেই, এ যাবত ওরা আমাকে কত দেখিয়েছে আর আমিও ওদেরকে কত দেখিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। এবার দেখবে ঠিক ওদের সম্মুখ দিয়েই পার হব ।

দশবার ডানে বামে ঘুরপাক খেয়ে পুনরায় মদিনা রোডের দিকে এগিয়ে চলে তাদের ক্রেসিডা। রাস্তায় পুলিশ ভ্যানটিকে ক্রস করতেই পুলিশ মাইকে নির্দেশ দেয় গাড়ি থামানোর জন্য। গাড়ি থামালে পুলিশ এগিয়ে এসে আরবিতে শুধায়, কোথায় যাচ্ছ? ড্রাইভার বলে,এয়ারপোর্টে। শেরেগুলের দিকে একনজর দেখে পুলিশ সত্যতা যাচাই করে। বলে তোমরা কি এই কিছুক্ষণ আগে একটি সাদা ক্রেসিডাকে এ রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে দেখেছ?

কত গাড়িইতো দেখেছি তবে ঠিক পাঁচমিনিট পূর্বে এক ক্রেসিডাকে পাশ দিয়েছি যেটি সাগর অভিমুখে যাচ্ছিল। নির্লিপ্ত উত্তর ড্রাইভারের। কোন কথা না বলে পুলিশ এবার সাথীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ইয়াল্লাহ রু সুরাহ, গো কুইকলি .. বলেই এস্তপদে পুলিশটি নিজের গাড়ীর সিটে চেপে বসে।

শেরেগুল ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলে, সত্যি তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। হাসিভরা মুখে ড্রাইভার এবার বলে, ওরা এতক্ষণে হয়তো সাগরপানে ছুটে চলছে। মাত্র এককিলোমিটার দূরে লোহিত সাগর। সাগরের মৃদুমন্দ বাতাস তাদের ক্লান্তি জুড়াবে, ভাল করিনি ওস্তাদ? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ড্রাইভার।

হলিডে ইন-এর পনেরো নম্বর কক্ষে বসে সকাল দশটায় অপেক্ষা করছিল শেরেগুল ড্রাইভারের জন্যে। ম্যাপটি চোখের সামনে মেলে ধরে। ক্যাফেটারিয়া আফগানী,বাবমক্কা ফার্মেসির পাশ দিয়ে সরু গলিতে বিশহাত এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে। ফার্মেসির কাছে গেলেই সে ম্যাপ অনুযায়ী খুঁজে নিতে পারবে।

ওয়াল ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই চিন্তাক্লিষ্ট মনে পায়চারী করতে থাকে সে। দশটার স্থলে এগারোটা। তবে কি ড্রাইভার কোন বিপদের সম্মুখীন হল?

আকস্মাৎ কড়া নাড়ার শব্দ হতেই হকচকিয়ে ওঠে শেরেগুল। নিরাপদ জায়গায় প্যাকেটগুলো রেখে দরজার কাছে এসে বলে, কে? উত্তর আসে, ওমরার ড্রেসে মালগুলো নিয়ে সাবধানে নেমে এস ওস্তাদ। হোটেলে রেইড করছে পুলিশ, সাবধান....।

গতরাতে কেনা ওমরাহের ড্রেস পরে নেয় শেরেগুল অতি দ্রুত। তিনটি প্লাস্টিক প্যকেট দুটো উরুর সাথে বেঁধে নেয় সতর্কতার সাথে। দোতালা বেয়ে নামতেই দেখা হয় মিশরীয় এক পরিবারের সাথে। ওদের সাথে বছরদুয়েক ব্যবধানের তিনটি বাচ্চাও রয়েছে। ভদ্রলোকের পরণেও ওমরাহের ড্রেস। নিশ্চয় ওরা ওমরাহ করতে যাচ্ছে। বাচ্চা তিনটি এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে। শেরেগুল সব চেয়ে ছোটটিকে কোলে তুলে নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে বলে - প্লিজ প্রসিড, আই উড লাইক টু হেল্প ইউ। ভদ্রলোক কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে শুধান, আই থিংক ইউ আর গোয়িং ফর ওমরাহ?

ইয়েস, ফর দি ফারস্ট টাইম। শেরেগুলের কোলে ছেলেটি লাফাচ্ছে মুক্তি কামনায়।

রিসিপশনে নেমেই তিনজন পুলিশের মুখোমুখি হতে হয় তাদেরকে। ফিস ফিস করে একজন পুলিশ অপরজনকে বলে,হুম্মা মিশরীন, খাল্লিনা রুহ। মিশরীয় ভদ্রলোক দণ্ডায়মান পুলিশকে সালাম দিতেই একজন পুলিশ বলে ওঠে, ইয়া আহলান ওয়া সাহলান,ইনশাআল্লাহ ওমরাহ মবরুক। শেরেগুল এমন ভাব দেখালো যে, বাচ্চাটিকে নিয়ে সে মস্ত বে-কায়দায় পড়েছে। অন্যদিকে তাকানোর ফুরসৎ তার নেই। পুলিশ ওদেরকে একই ফ্যামিলির বলে ধরে নিয়েছে নিশ্চয়ই।

গেট পেরিয়ে শেরেগুল ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে, ওরা আপনাকে কি বলছিল, ঠিক বুঝতে পারিনি।

আর বলবেন না। এদেশের আইনকানুনের কিছুই বুঝি না। বে-আইনী লোক খুঁজছো, ভাল কথা, তবে হোটেলে কেন? হোটেল কর্তৃপক্ষ রেজিষ্টার মেনটেইন করে। বলুনতো, বে-আইনী লোককে হোটেল কর্তৃপক্ষ কি ভাড়া দেবে? কোনদিন যে ওদের মাথায় ঘিলু হবে তা আল্লাই ভাল জানেন। বলে কি - ওরা মিশরীয়, ওদেরকে যেতে দাও।এমনভাবে বলল যে, আমরা সবাই শুনতে পেলাম- হা, হা করে হেসে উঠেন ভদ্রলোক ।

মিশরীয় ভদ্রলোকের কাছ হতে বিদায় নিয়ে পার্কিংয়ের দিকে এগিয়ে যায় শেরেগুল। একটি কাল রংয়ের পাজারো গাড়িতে গতরাতের ড্রাইভারকে উপবিষ্ট দেখে সেটাতেই ওঠে বসে।

টয়োটার কি হল? পরিবর্তে পাজারো।

এর কারণও কি বুঝিয়ে বলতে হবে ওস্তাদ? টিকটিকিরা কি এত সহজে গতরাতের টয়োটা ক্রেসিডাকে ভুলতে পারবে? আচ্ছা, মালগুলো নিয়ে আসতে কোন অসুবিধা হয়নিতো?

না।

এখন কোথায় যেতে হবে ওস্তাদ? পশতু ভাষায় প্রশ্ন করে ডাইভার।

বাবমক্কা ফার্মেসি।

ফার্মেসির সামনে শেরেগুলকে নামিয়ে দিয়ে একটু দূরে নিরাপদ অবস্থানে অপেক্ষা করতে থাকে ড্রাইভার। তার উপর যতটুকু দায়িত্ব ঠিক ততটুকুই করতে হবে। অহেতুক প্রশ্ন বা কথাবলা তাদের মানা।

ফার্মেসির পাশ দিয়ে সরু রাস্তা ধরে কিছু এগিয়ে যেতেই নজরে পড়ে ক্যাফেটারিয়া আফগানী। লম্বা দাড়িওয়ালা আফগানী লোকটি ঘামে একাকার হয়ে রুটি বানাচ্ছে। পাশে বেশ কিছুসংখ্যক খরিদ্দার। কে আগে রুটি নিবে তা নিয়ে দু-একজনের মধ্যে কথা কাটাকাটিও চলছে।

ভিড় একটু পাতলা হতেই শেরেগুল এগিয়ে এসে পশতু ফার্সির সংমিশ্রণে শুধায়,বেহান জোরমে দাস্তান?

শেরেগুলের আপাদমস্তক দেখে লোকটি মুচকী হেসে নিচের দিকে চেয়ে আস্তে করে উত্তর দেয়,বেহান দাজা দস্তি।

উত্তরে নিশ্চিত হয়ে শেরেগুল নীল প্লাস্টিকের একটি কৌটা সর্তকতার সাথে এগিয়ে দেয় দোকানীকে,পরিবর্তে একটি রুটি হাতে নিয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে যায় অপেক্ষমান গাড়িটির দিকে।

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। পার্শবর্তী হোটেল এশিয়াতে লাঞ্চের জন্য ঢুকে পড়ে শেরেগুল ডাইভারকে নিয়ে। চব্বিশ ঘন্টার জন্য একটি রুম ভাড়া নেয়। আর মাত্র দুটো প্যাকেট বাকি।

ট্যাক্সি এবার ছুটে চলে বনিমালিকের উদ্দেশ্যে শেরেগুলের নির্দেশে ঠিক পাঁচ ঘন্টা পর। বনিমালিক পৌঁছেই দেখে পাকিস্তানী লোকজনদের অহরহ বিচরণ। কে বলবে এটা সৌদিআরব! যেন পাকিস্তানের তাবত লোকজন চলে এসেছে এখানে। আল রাজি ব্যাংককে পিছনে রেখে সামনের দিকে তাকাতেই ছোট্ট পানবিড়ির দোকান তার নজর এড়ায় না। দোকানের সামনে ঠোঁট ও দাঁত লাল করা খরিদ্দারদের ভীড়। মাগরিবের আজানের সাথে সাথেই ভীড় একটু কমে গেল। সেই সুযোগে শেরেগুল এগিয়ে যায় দোকানির সামনে। লোকটিকে পাঠানী বলে মনে হচ্ছে। বর্ণনানুযায়ী গুটি বসন্তের কাল দাগগুলো গালজুড়ে ঠিকই বিদ্যমান।

তবুও নিশ্চিন্ত হতে হবে। তীক্ষ দৃষ্টিতে পরখ করে দোকানি শেরেগুলকে। খাঁটি উর্দুতে আহ্বান জানায়, আইয়ে আইয়ে ছাহাব, পান চাহিয়ে?

আফগানকা সফেদ জর্দা হায়? শেরেগুলের কৌতুহলী দৃষ্টি।

কিয়া? কিয়া বলা? আফগানকা সফেদ জর্দা? ইয়েতো নেহী হ্যায় লেকিন চমন কা চমনবাহার হ্যায়। উস জর্দাকা লিয়ে বহুত কাষ্টমার ইনতেজারমে হ্যায়।

চমনবাহার! ইনতেজার! সঠিক উত্তর। বিনা বাক্য ব্যয়ে দোকানির সামনে প্যাকেটটি রাখতে রাখতে শেরেগুল বলে,ইয়ে প্যাকেট আপকো পাছ রাখ্ দিজিয়ে। ম্যায় বাদ মে লে যাউঙ্গা। আভি নামাজকা টাইম হ্যায়।

শেরেগুলের হাতে এক খিলি পান গুজে দোকানি সালাম জানায়। খুশিতে চিকচিক করে উঠে তার চোখ দুটো। গালে পান পুরে বিজয়োল্লাস নিয়ে অপেক্ষমান ট্যাক্সিতে ওঠতেই দুজন পুলিশ এসে ট্যাক্সির পথরোধ করে। জানালার পাশে এসে শেরেগুলের দিকে চেয়ে পুলিশের একজন বলে, একামা ফি?

শেরেগুল না বুঝার ভান করতেই পুলিশ বলে,একামা ফি,রেসিডেন্ট কার্ড?

শেরেগুল একথা জেনে এসেছে এদেশের আরবি জানা সাধারণ পুলিশদের ইংরেজিকে বড় ভয়। তাই এদেশে আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইউরোপের সাদা চামড়ার লোকদেরকে ওরা একটু সমীহের চোখে দেখে।

ওমরাহ ভিসা লাগানো পাসপোর্ট পুলিশের সামনে মেলে ধরে খাটি ইংরেজ স্টাইলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে, ডু ইউ ওয়ান্ট এনিথিং মোর স্যার? সাহেবসুলভ শেরেগুলের চেহারার দিকে চেয়ে পুলিশ উত্তরে ও,কে .. ও,কে, ইয়াল্লাহ রুহ - বলে ইশারায় চলে যেতে বলে।

শেষ প্যাকেটটি বাজার সংলগ্ন মসজিদের পাশে মুচী ছদ্মবেশী আফগানী আল্লারাক্ষা খানের কাছে পৌছে দিতে গিয়েই হল যত সমস্যা। পাশের চা স্টল হতে আকস্মিক ঝড়ের বেগে সাদা পোষাক পরিহিত নিরাপত্তা পুলিশ বাহিনীর তিনজন তাদের দুজনকে ঘেরাও করে পিস্তল উঁচিয়ে ধরে যখন বলল,ডোন্ট মুভ, তখন তারা দুজনই থ বনে যায়। আল্লারাক্ষা খানের হাত থেকে পুলিশ প্যাকটটি উদ্ধার করে মসজিদের পাশে অপেক্ষমান ছোট আকৃতির জীপের পিছনে দুজনকেই ওঠার নির্দেশ দেয়।

পুলিশ ভ্যানে উঠতেই শেরেগুলের চোখ ছানাবড়া! এয়ারপোর্টে যে কাস্টমস্ অফিসার রুটি খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি কাউন্টারে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল, সে লোকটি বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল, কি বাছা, ভেবেছিলে ওরা বেদুঈন। মগজে আর কিইবা আছে? কিন্তু বাছা, বিমানের প্রথম শ্রেণীর এত খাবারের পর যখন শুকনো রুটি চিবুচ্ছিলে তখনই ভেবেছিলাম মতলব তোমার অন্যকিছু, তবে একটু দেরি করে ফেলেছি এই যা। আমাদের সিকিউরিটি তোমার পেছনে ধাওয়া করে তোমাকে হারিয়ে ফেলায় দিনরাত আমাদেরকে হন্যে হয়ে খুঁজতে হয়েছে। তোমার সাঙ্গপাঙ্গ টের পেয়ে গা ঢাকা দিয়েছে, তবে যাবে কোথায়? তাদেরকেও একসময় ধরা পড়তেই হবে,ওরা আমাদের নজরে আছে।

নিরাপত্তা প্রহরীর লোকজন আকস্মিক সেলের দরজা খুলতেই তন্ময়তা কেটে যায় শেরেগুলের। ষ্টারধারী পুলিশ অফিসার তার দিকে ঝুঁকে নম্রভাবে প্রশ্ন করে, তোমার পছন্দ অনুযায়ী কিছু খেতে ইচ্ছে হয় বা কাউকে কিছু বলার আছে? সম্ভব হলে আমরা তা রক্ষা করব। উত্তরের অপেক্ষায় একদৃষ্টে পুলিশ অফিসার শেরেগুলের মুখপানে চেয়ে থাকে। শেরেগুল বুঝতে পারে এই সাতসকালে পুলিশ অফিসারের এহেন আচরণ কোন এক মহাপ্রলয়ের ইঙ্গিত ।

বুকে সাহস এনে উল্টো প্রশ্ন করে, কখন আমাকে মুক্তি দিচ্ছ তোমাদের এই নরক থেকে? তিনমাসতো রাখলে, আর কত? এই সাতসকালে ভালয় ভালয় ছেড়ে দাও। কেটে পড়ব কথা দিচ্ছি, তোমার কোন ক্ষতি হবে না। নতুবা আমাকে কষ্ট দেয়ার অপরাধে তোমার এবং তোমার সঙ্গীদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। আমাদের ক্ষমতা সম্মন্ধে নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে।

পুলিশ অফিসারের চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে, রাগ দমন করে শান্তভাবে বলে, দ্যাখো, বয়সে কিন্তু আমি তোমার বড় হব। তাছাড়া আজ শুক্রবার। বরকতের দিন। জুমার নামাজান্তে তোমার এবং আমাদের মধ্যে চিরদিনের মত সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। তুমি আর যাই কর না কেন একজন মুসলমানতো বটে। সুতরাং কোন কিছু চাওয়ার থাকেতো বল? তোমার সাথী আল্লারাক্ষা খান কিন্তু আমাদের কাছে ওমরাহ করার অনুরোধ জানিয়েছে এবং তা রক্ষার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের বিবেচনাধীন রয়েছে।

ওমরাহ-র কথা শুনে শেরেগুলের মনে পড়ে যায় মায়ের শেষ উপদেশ। হ্যা-রে শেরেগুল,সৌদিতে যখন যাচ্ছিস তাহলে অবশ্যই ওমরাহ পালন করে আসবি বাবা। এত কম বয়সে আল্লাহ তোকে এতকিছু দিয়েছেন তারজন্য শোকর গোজারী করবিনা ?

হ্যাঁ - তাই করতে হবে। যে মাকে নিয়ে তার গর্বের অন্ত নেই, সে কল্যাণময়ী মায়ের শেষ উপদেশ। তাছাড়া দলের লোকজনেরা নিশ্চয়ই ওৎ পেতে আছে। জেলের বাইরে বেরুতে পারলে নিশ্চয়ই ওরা সুযোগ হাতছাড়া করবে না। উৎসুক ভঙ্গিতে শেরেগুল মিনতি জানায় যদি ওমরাহ করার সুযোগ দাও তাহলে বিশেষ করে তোমার নিকট কৃতজ্ঞ থাকব। যেহেতু এটাই ছিল এখানে আসার সময় আমার মায়ের শেষ উপদেশ। 

ঠিক আছে। সময় যখন আমাদের হাতে পাঁচছয় ঘন্টা আছে তখন তোমাদের দুজনের অনুরোধ রক্ষা করা হবে, তবে এ ধরনের অনুরোধ এই প্রথম এবং শেষ এটা মনে রেখো । 

প্রহরাবেষ্টিত পুলিশের জি,এম,সি গাড়িতে ওমরাহ করে ফিরে আসতে প্রায় চারঘন্টা লেগে যায়। ওমরাহ করার পর শেরেগুল অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে যায়। এক অপূর্ব প্রশান্তিতে মন যেন ভরে উঠেছে কানায় কানায় । ত্রিশ বছরের এ জীবনে ধনদৌলত, আরাম আয়েশ তার পায়ে লুটোপুটি খেয়েছে, কিন্তু এমন স্বর্গসুখ জীবনে কখন সে অনুভব করেনি। ইচ্ছা হয় সারাটি জীবন এমনিভাবে পবিত্র কাবার সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেয়। দুচোখ ভরে জল আসে শেরেগুলের। জেদ্দায় ফেরার পথে ভাগ্যিস রাস্তায় কোন কমান্ডো আক্রমণ হয়নি। তাহলে ওরা কি সবাই ধরা পড়েছে? ওদের যা হয় হোক। শেরেগুল ওদেকে নিয়ে আর ভাবতে চায় না। জীবনের চোরাগলিতে হাঁটতে গিয়ে সে যা হারিয়েছে তা এক অব্যক্ত বেদনায় ডুকরে কেঁদে ওঠে এ মুহূর্তে ।

সূর্য তখন মধ্যাকাশে। জুমার নামাজের আজান প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দিকে দিকে। আট সদস্যের স্পেশাল পুলিশ ইউনিট শেরেগুল ও আল্লারাক্ষা খানকে পুলিশ ভ্যানে উঠায়, দুচোখ বেঁধে দেয় । গাড়ি এগিয়ে চলছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। পথিমধ্যে বিশেষ পোষাক পরিহিত কটিবন্ধে ক্ষুরধার তরবারীতে সুসজ্জিত জল্লাদদ্বয় পুলিশ ভ্যানে উঠে। কোন কথা নেই কারোর মুখে । গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে কোর্ট প্রাঙ্গণে, যার নির্দিষ্ট স্থানে অসংখ্য জনতার সামনে এদেশীয় আইনে সুষ্ঠু বিচার হবে। মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে আজানধ্বনি শেষ হয়ে আসছে......

 

হাইয়া আলাস সা.. লা.. হ...

হাইয়া আলাল ফা.. লা.. হ...

নামাজের জন্য আসো, কল্যাণের জন্য আসো .....।

নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছামাত্র ডাক্তার তাকে একটি ইনজেকশন পুশ করেছে। শেরেগুলের দুচোখ জুড়ে প্রবল ঘুম আসছে। প্রগাঢ় ঘুমের এত  আমেজ জীবনে তার এই প্রথম? মায়ের পবিত্র মুখখানা ভেসে উঠে মনের আয়নায়। মা এবং গুলবদনকে কথা দিয়ে এসেছিল, ফিরে আসা মাত্রই ঘটা করে বিয়ে হবে। গুলবদন হয়ত সে প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে। সেই শৈশব হতে যাকে ঘিরে তার স্বপ্ন, তার মুখচ্ছবি যেন আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। গুলবদনের গোলাপী ওড়না তন্দ্রাচ্ছন্ন শেরেগুলের দুচোখটি যেন পেঁচিয়ে রয়েছে। অস্পষ্ট ভাষায় বলে উঠে, হে আল্লাহ! তুমিই এ বিশ্বের প্রভু, জগতের সমগ্র কল্যাণ তোমারই আয়ত্বে। কল্যাণ প্রতিষ্ঠার লক্ষে আমার মত একজন গুনাহগারকে উঠিয়ে নাও খোদা, তোমার এ পৃথিবী কলুষমুক্ত হোক, মানুষে মানুষে ভালবাসা প্রতিষ্ঠিত হোক্ সমাজের সকল স্তরে নেশার পরিবর্তে।  

.

==========================

No comments:

Post a Comment

What do you think?