Monday, July 29, 2019
Wednesday, July 24, 2019
ভারত সরকার কর্তৃক ঘোষিত “তালাক ফৌজদারী অপরাধ” প্রসঙ্গে
Saturday, July 20, 2019
কয়েকটি চিঠি এবং একটি ত্রিশ তারিখ (ছোটগল্প)
কয়েকটি চিঠি এবং একটি ত্রিশ তারিখ
গুলশান চৌধুরী
১.
দোয়া পর সমাচার এই বাবা মিন্টু, তুমি চলিত
মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসিতেছ জানিয়া যার পর নাই খুশি হইলাম। দোয়া করি সহি সালামতে
পৌঁছাও।
লিখিয়াছ, বিদেশের এত বছরের ঘানিটানা খাটুনি
আর শরীরে কুলায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়াছ যে, একেবারে চলিয়া আসিবা। আর দীর্ঘ ষোল বছরে
যাহা সঞ্চয় করিয়াছ তাহা দিয়া দেশে আসিয়া ব্যবসা করিবা। কিন্তু আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত
যথাযথ নহে। আরো দুই তিন বছর থাকিয়া হাতে অন্তত এক কোটি টাকা লইয়া দেশে আসাই বুদ্ধিমানের
কাজ। নতুবা ব্যবসা করিবা কী দিয়া? আজকাল গাঁওগেরামে একটা পানের দোকান দিয়ে ব্যবসা করিতেও
পঞ্চাশ হাজার লাগে। তুমি অবশ্য পানের ব্যবসা করিবে না। ইহা একটি কথার কথা। তোমার বুঝার
সুবিধার্থে লিখিলাম আর কি।
এদিকে আমার আর তোমার মায়ের হজ্ব বাকি। এতদিন
তুমি যুক্তি দেখাইয়াছ যে, হাসনা ও হেনার বিবাহ দেওয়া আমার পয়লা নম্বর ফরয কাজ। এখন
তো এই পয়লা নম্বর ফরয কাজ আদায় হইয়া গিয়াছে। মামলা-মোকাদ্দমার ঝামেলাও শেষ। এই বৎসর
হজ্ব না করিলে সমাজে মুখ তো রক্ষা হয় না। পিন্টুর শ্বশুর ম্যানপাওয়ারের ব্যবসা করেন।
তিনি তো সপরিবারে তিনবার হজ্ব করিয়া ফেলিলেন। তিনি এবং পাড়াপড়শী সকলেই বলে, ‘আপনার
ছেলে সৌদীতে থাকে অথচ আজ পর্যন্ত হজ্ব করিলেন না?’ কথা তো ঠিকই। সুতরাং আমি ইরাদা করিয়াছি
এই বৎসর হজ্বে যাইব। তাই তোমার উক্ত সিদ্ধান্ত পরিহার কর। তবে অবশ্যই অন্যবারের মত
ছুটিতে আসিবা। দেশের আবহাওয়া এখন খুব গরম। ফ্যানের বাতাসে কুলায় না। আসার সময় অন্তত
একটা এসি নিয়া আসিবা। পিন্টুর শ্বশুরের বাসায় তিনটি আছে। তিনি তাহার কন্যা নাতাশার
কামরার জন্য একটি দান করিয়াছেন। একই ফ্ল্যাটে থাকি, অথচ আমার নিজের কামরায় এসি নাই।
বড়ই সংকোচ লাগে। মুগদাপাড়ার কুদ্দুসভাইর ছেলে তাহার বৃদ্ধ মাতাপিতার জন্য দুইটা এসি
পাঠাইয়াছে। ড্রয়িংরুমের জন্য একটা ইরানী কার্পেটও পাঠাইয়াছে। দেখিলে চক্ষু জুড়ায়। মাতাপিতার
সেবায় তাহার জুড়ি নাই দেখিয়া আমার মনও জুড়ায় বৈকি।
বিদেশে যাহারাই গেল তাহারাই শহরে একটি বাসা
বানাইয়া ফেলিল। কেবল তোমারই বাসা হয় নাই। এইবারে আসিয়া বড় একটি বাসা বানাইবার ব্যবস্থা
করিবা। বাসাভাড়া দিতে দিতে আমার পিন্টুর সর্বস্বান্ত অবস্থা। শহরে একটা বাসা হইলে তোমরা
সকল ভাইবোন মিলিয়া মিশিয়া নিশ্চিন্তে থাকিবার ব্যবস্থা হইবে। টাকাও বাঁচিবে। বাবা,
একটি কথা। তোমার পাঠানো টাকায় পিন্টু আইসক্রীম ফ্যাক্টরীটা তাহার নিজের নামে খরিদ করিয়াছে
বলিয়া অনেক রাগ করিয়াছ। তাহাকে অনেক গালাগালি করিয়াছ। চিঠিপত্র লিখা বন্ধ করিয়াছ। পরের
ঘর হইতে আসা মেয়েলোকের কথায় কেন তুমি স্ত্রৈন হইয়া গেলে? ইহা সমীচীন নহে। সে তোমারই তো ভাই। তোমার টাকা,
তাহার টাকা সমান নহে কি? আল্লাহ্ তোমাকে পিন্টুর চাইতে বেশি ভাগ্যবান করিয়া দুনিয়ায়
পাঠাইয়াছেন। তুমি জীবনে যে কাজে হাত দিয়াছ সেই কাজেই সফল হইয়াছ। ইচ্ছা করিলেই তুমি
ভবিষ্যতে এর চেয়ে বড় ফ্যাক্টরীর মালিক হইতে পারিবা। কিন্তু পিন্টু পারিবেনা। তাহার
সেই তকদিরও নাই, ঘিলুও নাই। এইসব বিবেচনা করিয়া তোমাকে নির্দেশ দিতেছি, দেশে আসিয়া
তাহার সাথে মন কষাকষি করিও না। আমার নূতন বৌমা নাতাশা কিংবা বেয়াই সাহেব শুনিলে কী
বলিবেন? আমার মানসম্মানের কথা বিবেচনা করিও। এই ফ্যাক্টরী দেখিয়াই তো বেয়াই সাহেব তাহার
মেয়েকে পিন্টুর কাছে বিবাহ দিলেন। নচেৎ পিন্টুর
মত বেকার ছেলেকে কে পাত্তা দিত? শহরে এত বড়লোকের সাথে কি আজ কুটুম্বিতা করিতে পারিতাম
?
শহরে আসার পর হইতে আমার শরীর-মন ভাল যাইতেছে
না। হয়ত জানিয়াছ যে, গ্রামে আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়া তোমার অতি সোহাগের ছোটভাই
সোহাগ সাহেব আমার মান সম্মানের মাথা খাইয়া চেয়ারম্যানের কালো কুৎসিত মেয়ে শোভাকে বিবাহ
করিয়াছে। তাও কিনা কোর্টম্যারেজ। আমাদের সাথে যাহাদের ত্রিশ বছর পর্যন্ত মামলা চলিতেছিল
তাহাদের মেয়েকে সোহাগ কোন আক্কেলে ঘরে তুলিল? অতীতে মামলায় জিতিয়া ব্যাটা আমাদের বাপ-দাদার
সবচেয়ে দামী জমিটা দখল লইয়াছে। আমার সন্দেহ, ঐ পাজীটা সোহাগকে হাত করিয়া ধীরে ধীরে
আরো দখল করিবে। মেয়েটির বয়স যদি আঠারোর নীচে হইত, খোদার কসম আমি ওর বাপের নামে মামলা
ঠুকিতাম। বেকুব সোহাগ ইহা কী করিল? খাল কাটিয়া কুমির আনিল? আমি স্থির করিয়াছি, তাহাকে
পৃথক করিয়া দিব। দরকার হইলে ত্যাজ্যপুত্র বলিয়া ঘোষণা দিব। সে তাহার চেয়ারম্যান শ্বশুরের
লেজুড়বৃত্তি নিয়া দিনপাত করুক।
কিছু জিনিসপত্র আর ওষুধের লিস্ট দিলাম।
আসার আগে মনে করিয়া সবগুলি কিনিয়া সুটকেসে ঢুকাইও।
ইতি
তোমার আব্বা
তারিখ ১০. ৬. ১৯৮৬ ইং
পুনশ্চঃ আবারও বলিতেছি, বাৎসরিক ছুটিতে
আসিবা। চাকুরি ছাড়িয়া চিরতরে আসিবা না।
২.
দোয়া পর সমাচার এই যে বাবা মিন্টু, চলিত
মাসের ত্রিশ তারিখ তুমি দেশে আসিতেছ জানিয়া খুশি হইলাম। এতদিন যাবৎ এই খবরেরই অপেক্ষা
করিতেছিলাম। কারণ পরিবারের অনেক কাজ তোমার জন্য আটকা পড়িয়া রহিয়াছে। তুমি আসার পর সব
কাজ এক এক করিয়া সমাধা করা হইবে। তোমার আব্বা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছেন। মনও ভাল না। সোহাগের
বিবাহের খবর শোনা মাত্রই অসুখ বাড়িয়া গিয়াছে। এই কথা বিবেচনা করিয়া বসুন্ধরায় পিন্টুর শ্বশুর বাসাতে আসিয়াছি। ভাবিতেছি, জীবনের শেষ কয়টা দিন শহরেই কাটাইব। এইখানে ভাল চিকিৎসা
হইবে। গ্রামে থাকিলে কোন প্রকার লাভ হইবে না।
দেশে আসিবার পর তোমার প্রথম কাজ হইল, বসুন্ধরায় একটি জমি কিনা।
মিরপুরে বাসা বানাইবে বলিয়া তোমার সম্বন্ধীর বাসার নিকটে জমি কিনিয়াছ। ইহা কেমন কথা।
তাছাড়া বড় বউমা কেনইবা তোমার সম্বন্ধীর বাসায় ভাড়া দিয়া থাকিতেছে ? পিন্টু তোমার আপন
ভাই। সে এখানে থাকিতে তুমি মিরপুরে বড়বৌমাকে রাখিতে গেলে কেন? দেশে আসিয়া ঐ জমি বেচিয়া
তোমার ভাইদের লইয়া একত্রে থাকিবার নিমিত্তে বসুন্ধরায় বড় বাসা বানাইবা। মিরপুরের তুলনায়
বসুন্ধরা অনেক সুন্দর ও উন্নত এলাকা। রাস্তা অনেক বড়। মিরপুরে চিপা গলির মত রাস্তা।
সেদিন তো একটু হইলেই একটি গাড়ি আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়া ফেলিয়াছিল। সুতরাং তুমি আসিয়া
বসুন্ধরায় তিনভাইর জন্য তিনতলা বাসা তেরি করিবা। পিন্টুর শশুর রড-সিমেন্টের ব্যবসা
করেন। তিনি সুযোগ সুবিধা দিতে পারিবেন।
দ্বিতীয় কাজ হইল, বড়বৌমাকে আনিয়া আমাদের
কাছেই রাখিবা। আগে আমরা গ্রামে থাকিতাম। তাই মেয়েদের পড়ালেখার অসুবিধার দোহাই দিয়া
বড়বৌমা মিরপুরে তাহার ভাইয়ের বাসায় চলিয়া আসিলেন। এখন তো আমরাও শহরে থাকি। অসুবিধা
হইবে কেন? মিরপুরে তুমি তাহাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, আবার এখানেও আমাদের জন্য টাকা
পাঠাইতেছ, ইহাতে ডাবল টাকা খরচ হইতেছে না? একত্রে থাকিলে তো খরচ বাঁচে। এইসব বিবেচনা
করিয়া আমি ও তোমার বাবা গত সপ্তাহে গিয়াছিলাম বৌমাকে আনিতে। সে তোমার অনুমতির কথা বলিল।
আমরা বাঁচিয়া থাকিতে তোমার আবার কিসের অনুমতি, বুঝিলাম না। মেয়েটি বড়ই চালাক। চিঠিতে
আর কিছু লিখিলাম না। তুমি দেশে আসিলে সব বলিব। তুমি আশা মাত্রই তাহাকে এখানে আনিবা।
পিন্টুর শশুর বাড়িতে বাবুর্চি আছে। আর বৃদ্ধ বয়সে আমরা বুয়ার হাতের বাজে রান্না খাই।
আমাদের এইসব অসুবিধার কথা কি বড়বউমার বুঝা উচিত না? বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ির খেদমত করা তাহার
উচিত না? মেজবৌমা নাতাশা ছেলেমানুষ। লেখাপড়া নিয়া সারাদিন বাহিরে থাকে। সে কিভাবে রান্না
করিয়া খাওয়াইবে ? ইহাও বড়বৌমার বিবেচনা করা উচিত। ভাইয়ের বাসায় আরামে বসিয়া থাকিলেই
চলিবে? সে নাহয় থাকিল। কিন্তু সাফা-মারোয়া? তাহারা তো আমার নাতিন। তাহারা কেন পরের
বাসায় থাকিবে?
এইবার পিন্টুর কথায় আসি। তুমি দেশে আসিয়া
তাহার সাথে রাগারাগি করিও না। হাজার দোষ করুক, সে তোমারই মায়ের পেটের ভাই। আমার কড়া
হুকুম, মায়ামমতা বজায় রাখিবা। আরেক কথা। যদিও তাহার বিবাহের গহনাসহ যাবতীয় খরচ দিয়াছ
তবুও নাতাশাকে এই প্রথমবারের মত দেখিবে। সালামী হিসাবে তাহার জন্য একপদ স্বর্ণালঙ্কার
আনিও। শাড়ি আনিও না। আজকালকার মেয়ে শাড়ি টাড়ি পরে না। বিবাহের সময় সোহাগ একটি শাড়ি
দিয়াছিল। দামী হইলেও তাহা সে পরে নাই। কাউকে দিয়া দিয়াছে। তাহারা উচু বংশের মানীলোক।
নাতাশার মা-বাবার জন্যও কিছু গিফ্ট আনিও। ইহাতে আমাদের কদর বাড়িবে। আর কার কার জন্য
কি কি আনিতে হইবে তাহার একটি তালিকা দিলাম। প্রতিটি জিনিস মনে করিয়া আনিও। ভুলিওনা।
ইতি
তোমার আম্মা
পুনশ্চঃ হাসনা আর হেনার চিঠির উত্তর দাও
নাই কেন ? তাহারা মনে কষ্ট পাইয়াছে। আসিবার সময় জামাইদের জন্য সু্ট কোট আনিবে। বেয়াইনদের
জন্য শাড়ি। পুত্রা-ঝিয়ারিদের জন্য টুকিটাকি যা পার।
তারিখঃ ১০. ৬. ১৯৮৬ ইং
৩.
লিখেছ, আমাদের জন্য কী কী আনতে হবে? ওগো,
আমি কী চাই, তুমি কি জান না? দু’বছর ধরে দেশে আসছ না পারিবারিক কলহ এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার
চাপে। ত্রিশ তারিখ তুমি আসবে - এটাই পরম পাওয়া। সহিসালামতে চলে এস। ব্যাস, আর কিছু
চাই না। তোমার মেয়েরা রোজ দশবার ক্যালেন্ডারের পাতায় ‘ত্রিশ তারিখ’ দেখে। তাদের দিনও
যেন ফুরোতে চায়না। তুমি এলে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে সারাক্ষণ তারই পরিকল্পনা। দাম্মামে
থাকতে সী-বিচে কত আনন্দ করে বেড়িয়েছে তোমার হাত ধরে। সেই সোনালী দিনগুলো তো আর ফিরে
পাবে না। তাই তুমি আসার অপেক্ষা করেই যাচ্ছে। ওদের দাম্মামের বন্ধুদের কয়েকটা ছবি আনতে
বলেছে। এলবামে রাখবে। সেই পিচ্ছিরা এতদিনে নিশ্চয় বেশ বড় হয়ে গেছে। আমারও খুব দেখতে
ইচ্ছে করে। ওখানকার ভাবীদের কথাও খুব মনে পড়ে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল দিনগুলো কাটিয়েছি
ওখানে। সবাইকে আমার সালাম বলো।
চিঠির এক কোনায় হাসপাতালে যাবার কথা লিখেছ।
সিরিয়াস কোন অসুখ নয়তো? এবারের পাঠানো ছবিতে এত রোগা রোগা লাগছে কেন? আমার খুব চিন্তা
হচ্ছে। বছরের পর বছর ওভারটাইমসহ ছুটিহীন খাটুনি দিচ্ছ। আমি পাশে নেই। খাওয়া দাওয়ার
অনিয়ম হচ্ছে নিশ্চয়। দেশে এসে যদি দু’তিন মাস থাকতে পারতে তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত। জানি
তো, প্রবাসজীবনের বিরামহীন কষ্ট মানুষকে সুস্থ্য থাকতে দেয়না। দেখনা, অন্তত দুমাসের
ছুটি নিতে পার কিনা।
গতকাল গ্রামের বাড়ি থেকে সোহাগ এসেছিল নূতন বউ নিয়ে।
শোভা খুব লক্ষী মেয়ে। গায়ের রং শ্যামলা। কিন্ত পয়মন্ত চেহারার মধ্যে প্রখর বুদ্ধির
ছাপ। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছে। ভাল রেজাল্ট। ওকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বলেছি।
তুমি যদি ভাল মনে কর তাহলে মিরপুরে আমার কাছে রেখে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। আমাদের মত
করে ওকে গড়ে তুলব। কি বল ? এতে করে বাবা-মার মন থেকে ওদের কোর্টম্যারেজ সংক্রান্ত মনোকষ্ট
ধীরে ধীরে ঘুচবে। আমার প্রস্তাবে সোহাগ খুশি হয়েছে। এখন তোমার মতামতের অপেক্ষা।
সেদিন মা এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে। বললেন,
আমাকে ওনাদের কাছেই থাকতে হবে। সাফা-মারওয়া
নাকি বসুন্ধরার স্কুলেই পড়বে। ঐ স্কুলে পিন্টুভাইর শালাশালীরা পড়ে। এটা নাকি
শহরের সবচেয়ে ভাল স্কুল, ইত্যাদি অনেক যুক্তি। মার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজী হতে আমার
বিবেক সায় দেয়নি। প্রথমতঃ বাসার মালিক পিন্টুভাইর শশুর। আমার শশুর নন। তাছাড়া বাসাটা
ভাড়া হয়েছে পিন্টুভাইর নামে, তোমার নামে নয়। দ্বিতীয়তঃ যে ভাইকে তুমি লেখাপড়া শিখিয়ে
মানুষ করেছ, তার কাছ থেকে পেয়েছ অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসঘাতকতা। ওর বাসায় তোমার অনুমতি
ছাড়া যাব কেন ? গেলে তুমি কষ্ট পাবে। তাছাড়া সে কি শুধু তোমার মনেই কষ্ট দিয়েছে ? আমার
নামেও তো নানারকম অপবাদ দিতে ছাড়েনি। আমিই নাকি ভাইয়ে ভাইয়ে শ্ত্রুতা তৈরি করেছি। সে
তো এটুকুও ভাবল না যে, দাম্মামের সুখের সংসার ছেড়ে, সাফা-মারওয়াকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত
করে আমি চলে দেশে এসেছিলাম শুধুমাত্র পয়সা বাঁচাব বলে। আর ঐ বাঁচানো টাকা সঞ্চয় করে
তিনভাইর যৌথ ব্যবসার জন্য আইসক্রীম ফ্যাক্টরী আর তিনভাই একসাথে থাকার জন্য বড় একটা
বাসা কিনব বলে। ফ্যাক্টরী তো হল। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের উন্নতির জন্য তোমার যে
সুদূরপ্রসারী ধ্যানধারণা ছিল তার কী হল? সাফা-মারওয়া, তুমি-আমি এ চারজনের আত্মত্যাগের
মূল্য কী এই?
যাহোক। একদিন সে তার ভুল বুঝবে। ক্ষমা করতে
তোমার কষ্ট হবে জানি। তবু পারলে ধীরে ধীরে তাকে ক্ষমা করে দিও। আমি জানি আল্লাহ্ আমাদেরকে
উত্তম বিনিময় দান করবেন। দেশে এসে তার সাথে রাগারাগি করনা। তোমার জন্য দিনরাত দোয়া
করছি। ভাল থেকো। সুস্থ্য থেকো। সহিসালামতে পৌঁছাও।
ইতি
একমাত্র তোমারই জান্নাত আরা
তারিখ : ১৫. ৬. ১৯৮৬
পুনশ্চঃ আবার বলছি, কষ্ট করে অযথা এটা সেটা কিনে লাগেজ ভারি করতে যেয়োনা। সব সময়ই তো পাঠাও। কিছুই আনতে হবেনা। তাছাড়া মনে রেখো আমার জন্য আনতে গেলে আরো অনেকের নাম উঠে আসে। দেশে এসে এ নিয়ে অপ্রিয় কথা শুনবে আর কষ্ট পাবে। তোমার এ কষ্ট আমি দেখতে চাই না।
৪.
বড় ভাইয়া, আমাদের সালাম নিও। গতকাল মিরপুর
গিয়েছিলাম আমার মহিয়সী ভাবী আর কলিজার টুকরো দুই ভাতিজীকে দেখতে। শোভার কথা নিশ্চয়
শুনেছ। ওকে কীভাবে গ্রহণ করবে এই ভয়ে এতদিন সরাসরি লিখতে সাহস করিনি। বড়ভাবী এই পরিবারের
প্রথম সদস্য যিনি নিজের গহনা পরিয়ে ওকে আশীর্বাদ করে স্বীকৃতি দিলেন। তারপরই না তোমার
কাছে চিঠি লিখতে সাহস পেলাম। ভাবীর ¯েœহের ঋণ আমি কীভাবে
শোধ করব জানিনা। মাঝে মাঝে তুলনা করে আশ্চর্য হই, আল্লাহ্ কীভাবে যে জোড়া মিলিয়ে দিলেন!
বড়ভাবীর মনটা ঠিক তোমার মত। আর ছোটভাবীর মনটা ঠিক ছোটভাইয়ার মত। আব্বা আম্মাতো ধনের
জৌলুস দেখে ছোটভাবীকে মাথায় তুলে রেখেছেন। আমার বিশ্বাস, দেরিতে হলেও একদিন খাঁটি সোনা
চিনতে পারবেন।
বড়ভাবীর মুখে শুনলাম, এ মাসের ত্রিশ তারিখ
দেশে আসছ। শুনে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিস্ক নেবার মত ভরসা পাচ্ছি। প্রথমতঃ তোমার
উপস্থিতিতে আব্বা আম্মাকে বুঝিয়ে শোভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তোলা।
দ্বিতীয়তঃ আলীগঞ্জ বাজারে লাভজনক একটা একতলা
দোকান বিক্রি হচ্ছে। ভবিষ্যতে দোতলা বা তিনতলা করা যাবে। গ্রামে বসেই শহরে ব্যবসা করা
যাবে। ওরা সর্বমোট দু’লাখ চায়। অগ্রিম পঞ্চাশ হাজার টাকা আমি আমাদের সমিতি থেকে ধার
নিতে পারব। তোমার কাছে বাকি দেড় লাখ টাকা চাইতে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমাকে মাস্টার্স
পাশ করাতে তুমি যথেষ্ট অর্থব্যয় করেছ। কিন্তু বৃথা গেল। এসব খোটা দিয়ে আব্বা আম্মা
আমাকে হরদম বকাঝকা করেন। তোমার অতি আদরে নাকি আমি বাঁদর হয়েছি। মানুষ হইনি। সব দোষ
নাকি তোমার।
কিন্তু ভাইয়া, মানুষ না হলেও অমানুষ তো
হইনি। কাদের স্যারের অগ্নিমন্ত্রে আমি দীক্ষিত। গ্রামের সার্বিক কল্যাণের জন্য এখন
অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। গ্রামে আমার সুনাম এবং প্রতিপত্তি যথেষ্ট রয়েছে। আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান। শোভার কল্যাণে
আজকাল তিনিও পাল্টাতে আরম্ভ করেছেন। শোভাকে বিয়ে করেছি বলে আব্বা তো বলেন, আমি নাকি
খালকেটে কুমীর এনেছি। আব্বা আমার পলিটিক্স বুঝবেন
কী করে? বুঝেন তো কেবল মামলা-মোকদ্দমা। আমি খাল কেটে কুমীর আনিনি। বরং গ্রাম থেকে কুমীরের
রাজত্ব উৎখাত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তদুপরি আমার বাপ-দাদা যা পারেন নি আমি তা পেরেছি।
বিগত ত্রিশ বছরের মহাযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে প্রকারান্তরে চেয়ারম্যানকে সারেন্ডার করতে
বাধ্য করেছি। জবরদখলকৃত জমি উনি ফিরিয়ে দিতে রাজী। শুধু কি তাই? ইউনিয়নবাসীর উন্নতির
দিকেও আজকাল মনোযোগী হয়েছেন। আব্বা আর কী চান? যদি গ্রামের মঙ্গল চান তাহলে আমার প্রতিটি
কৌশল বোঝার কথা। পক্ষান্তরে উনি যদি আমাদের পরিবারের বহিরাগত মন্ত্রণাদাতা জনৈক বেয়াইকে
(পিন্টুভাইর শ্বশুর) প্রাতঃস্মরণীয় মহাজ্ঞানী মহাজন ভাবেন, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।
যাহোক। যা বলছিলাম, তুমি দেশে এসে দোকানটা
দেখবে। পছন্দ হলে তোমার নামেই কিনে ফেলব এবং ব্যবসা আরম্ভ করে বেকারত্ব ঘুচাব। টাকাটা
আমি ধার হিসেবেই চাচ্ছি। আমাকে অবিশ্বাস কর না ভাইয়া। আমি তোমার এম. এ পাশ করা পিন্টু
নই।
পিন্টুসাহেবের বসুন্ধরার বাসায় গিয়ে আব্বা
আম্মার সাথে দেখা করে এসেছি। শ্বশুরের দেওয়া দামী ফার্নিচারে ঠাসা তার বাসা। এমন কোন
জিনিস নেই যা পিন্টুভাইর নিজের টাকায় কেনা। আব্বা আম্মাকে দেখলাম খুব গর্বিত। শোভা
মিরপুর আছে জেনেও না জানার ভান করলেন। ওনাদের বকাঝকা তো আমার নিত্যসাথী। এখন আর দুঃখ
পাইনা। কিন্তু দুঃখ লাগে, আমাদের যে মাতাপিতা অল্পেতুষ্টি আর সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত
ছিলেন, সেই মাতাপিতা এখন শহরের জৌলুস আর বিলাসী জীবনের প্রতি ক্রমশ ঝুঁকে পড়েছেন। ওনাদের
কামরায় এখন নিজস্ব রঙীন টিভি। বিদেশী চ্যানেলের সিরিয়ালের নেশায় থাকেন বুঁদ। দুনিয়াদারী
চাহিদার শেষ নেই। কে তাদেরকে পল্লীবাংলার দিকে ফেরাবে? কে ফেরাবে আখেরাতের চিন্তার
দিকে ?
অনেক কিছু লিখলাম। ভুল বুঝো না যেন। আমার
ওপর আস্থা রেখো। শোভার সালাম নিও। আমরা ভাল আছি।
ইতি
তোমার ছোটভাই সোহাগ
তারিখ : ২০. ৬. ১৯৮৬
পুনশ্চঃ এয়ারপোর্টে অবশ্যই ভাবী আর সোনামণিদেরকে
নিয়ে আমি উপস্থিত থাকব। কোনো চিন্তা কর না।
৫.
আমি মিন্টু বলছি। আমার কলিগ মাসুদ খান অফিস
থেকে ফেরার পথে হাসপাতলে এসে এই চারটা চিঠি দিয়ে গেল। এখনই উত্তর লিখে ফেলা দরকার।
কারণ ধূসর সময়টাকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। মহাকাল আমাকে আর বেশি সময় দেবে বলে মনে
হচ্ছে না।
চাওয়া মাত্রই নার্স কাগজ-কলম দিয়ে গেল।
আলাদা করে সবার চিঠির জবাব দেবার মত সময় বা মন কোনটাই নেই। যতদূর আন্দাজ করছি, আজই
আমাকে লাইফ-সাপোর্টে নেওয়া হবে। তাই সময় থাকতে অছিয়ত-নামা লিখে যাচ্ছি। এতেই একত্রে
সবার চিঠির জবাব থাকবে।
আমার পুত্রসন্তান নেই বিধায় প্রবাসজীবনের
ষোলটি বছরের উপার্জিত স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পদ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক নিম্নলিখিত ওয়ারিশদের
নামে বন্টন করে দিচ্ছি। এরপর পৃথিবীতে যেভাবে নিঃস্ব অবস্থায় এসেছিলাম, ঠিক সেভাবেই
নিঃস্ব অবস্থায় পরম করূণাময়ের কাছে প্রত্যাবর্তন করব।
ক. মা-বাবা এবং দুই বোন ঃ নদীর পারে যে
জমি কিনেছিলাম তা সম্পূর্ণ তাদের নামে যাবে। দেখেশুনে প্রত্যেকে শরীয়ত মোতাবেক বন্টন
করে নেবেন। আব্বা-আম্মা তাগিদ দিচ্ছিলেন এ বৎসর ওনাদেরকে হজ্ব করাতে। হজ্ব করানোর মালিক
তো আল্লাহ। আমি নই। তাছাড়া হজ্ব করতে হয় নিজস্ব আয় বা সম্পদ থেকেই। সুতরাং উক্ত জমির
কিছু অংশ বিক্রি করে ওনারা এ বৎসর হজ্ব করুন।
খ. দুই ভাইঃ আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে পিন্টু ফ্যাক্টরীটা
নিজের নামে লিখে নিয়েছে। সে তার প্রাপ্য অংশের বেশি পেয়েছে। সুতরাং তার আর পাওনা নেই।
আমার স্ত্রীর অনুরোধক্রমে তাকে আমি ক্ষমা করলাম।
কিন্তু কয়েক শর্তে। তার একমাত্র জীবিত ভাই সোহাগকে যেন না ঠকায়। আব্বাআম্মার যেন অযতœ না হয়। তাদের
জন্য ভাল একটা বাবুর্চি যেন রেখে দেয়। আমবাগান, লিচুবাগানের ফল আর জমির ফসল বিক্রির
সব টাকা যেন ওনাদের হাতেই তুলে দেয়। আর বোনদের হক যেন আদায় করে। অর্থাৎ পৈত্রিক সম্পদের
অংশ প্রদান করা, খোঁজখবর নেওয়া, মাঝেমাঝে নাইওর আনা, সামাজিকতা লৌকিকতা বজায় রাখা
ইত্যাদি।
দাম্মামে আমার গাড়ি এবং ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র
বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা আমার বন্ধু মাসুদ খানের তদারকিতে থাকবে। উক্ত টাকা
সোহাগের জন্য রইল। সে তার ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়ে বাকি টাকা দিয়ে শোভার জন্য প্রয়োজনীয়
জিনিস কিনবে এবং ওদের রিসিপশনের অনুষ্ঠানে ব্যয় করবে। খোদার হুকুমেই তো ওদের বিয়ে হয়েছে।
এ হুকুম বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে আব্বাআম্মা যেন তাদেরকে সমাদরে গ্রহণ করেন এবং চেয়ারম্যানের
সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। তিনি তো গ্রামসম্পর্কে আব্বারই জ্ঞাতিভাই। সবার সাথে সুসম্পর্ক
বজায় রাখলে দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানেই মঙ্গল।
গ. আমার স্ত্রী এবং জমজ কন্যাঃ আমার মৃত্যুর পর কোম্পানী থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে
তা এবং সোনালী ব্যাংকে যৎসামান্য যা আছে তা সম্পূর্ণ তাদের। মিরপুরে আমার স্ত্রীর নামে
কেনা একটুকরো জমি আছে। এ টাকায় তেতলা বাড়ি হবে। দোতলায় ওরা থাকবে এবং বাকি অংশ ভাড়া
দিয়ে দিন গোজরান করবে। তাদের হেফাজতের ভার আল্লাহ তা’লার ওপর রইল। আমার সম্বন্ধীর কাছে
অনুরোধ রইল তিনি যেন তাদেরকে তার কাছাকছিই রাখেন। আরেকটা কথা বিশেষভাবে বলছি, আমার
মেয়েরা যেন তাদের দাদাবাড়ির অধিকার ও স্নেহমমতা থেকে বঞ্চিত না হয়।
রণক্লান্ত হাতখানি অবশ হয়ে আসছে। আর লিখতে
পারছি না। ত্রিশ তারিখ দেশে যাবার জন্য বিমানের টিকিট নেবার পরদিন থেকে হাসপাতালে পড়ে
আছি। বন্ধুরা সান্তনা দেয় ভাল হয়ে যাব বলে। ডাক্তারও পেশাসুলভ
পজিটিভ অভিব্যক্তি দেখায়। কিন্তু আমি জানি বাংলাদেশ বিমান আমাকে কি অবস্থায় স্বদেশে
দেশে নিয়ে যাবে। দাম্মামের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ: আমার চলিত মাসের বেতন থেকে যেন হাসপাতালের
পাওনা মেটানো হয়। আমাকে যেন শোয়ানো হয় গ্রামের বাড়ির শ্যামল মাটিতে। সবাই আমাকে ক্ষমা
করে দেবেন এবং মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।
ইতি
হতভাগ্য মিন্টু
তারিখ : ২৬. ৬. ১৯৮৬
পুনশ্চ ঃ বন্ধু মাসুদ, প্রতিদিন তুমি এসে
খোঁজ নিয়ে যাচ্ছ। তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে আরো একটি অনুরোধ
করছি। আমার এ চিঠি ফটোকপি করে রেখো। মূলকপি যাবে তোমার ভাবীর কাছে। আর সাত কপি যাবে
আমার মা বাবা, দুইভাই আর দুইবোন আর আমার সমন্ধীর কাছে। অপর পৃষ্ঠায় ঠিকানা দেওয়া আছে।
বিদায়।
রচনাঃ ১৯৮৯ জেদ্দা
১.
দোয়া
পর সমাচার এই বাবা মিন্টু, তুমি চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসিতেছ জানিয়া যার পর
নাই খুশি হইলাম। দোয়া করি সহি সালামতে পৌঁছাও।
লিখিয়াছ,
বিদেশের এত বছরের ঘানিটানা খাটুনি আর শরীরে কুলায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়াছ যে, একেবারে
চলিয়া আসিবা। আর দীর্ঘ ষোল বছরে যাহা সঞ্চয় করিয়াছ তাহা দিয়া দেশে আসিয়া ব্যবসা করিবা।
কিন্তু আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত যথাযথ নহে। আরো দুই তিন বছর থাকিয়া হাতে অন্তত এক
কোটি টাকা লইয়া দেশে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। নতুবা ব্যবসা করিবা কি দিয়া? আজকাল গাঁওগেরামে
একটা পানের দোকান দিয়ে ব্যবসা করিতেও পঞ্চাশ হাজার লাগে। তুমি অবশ্য পানের ব্যবসা করিবে
না। ইহা একটি কথার কথা। তোমার বুঝার সুবিধার্থে লিখিলাম আর কি।
এদিকে
আমার আর তোমার মায়ের হজ্ব বাকি। এতদিন তুমি যুক্তি দেখাইয়াছ যে, হাসনা ও হেনার বিবাহ
দেওয়া আমার পয়লা নম্বর ফরয কাজ। এখন তো এই পয়লা নম্বর ফরয কাজ আদায় হইয়া গিয়াছে। মামলা-মোকাদ্দমার
ঝামেলাও শেষ। এই বৎসর হজ্ব না করিলে সমাজে মুখ তো রক্ষা হয় না। পিন্টুর শ্বশুর ম্যানপাওয়ারের
ব্যবসা করেন। তিনি তো সপরিবারে তিনবার হজ্ব করিয়া ফেলিলেন। তিনি এবং পাড়াপড়শী সকলেই
বলে, ‘আপনার ছেলে সৌদীতে থাকে অথচ আজ পর্যন্ত হজ্ব করিলেন না?’ কথা তো ঠিকই। সুতরাং
আমি ইরাদা করিয়াছি এই বৎসর হজ্বে যাইব। তাই তোমার উক্ত সিদ্ধান্ত পরিহার কর। তবে অবশ্যই
অন্যবারের মত ছুটিতে আসিবা। দেশের আবহাওয়া এখন খুব গরম। ফ্যানের বাতাসে কুলায় না। আসার
সময় অন্তত একটা এসি নিয়া আসিবা। পিন্টুর শ্বশুরের বাসায় তিনটি আছে। তিনি তাহার কন্যা
নাতাশার কামরার জন্য একটি দান করিয়াছেন। একই ফ্ল্যাটে থাকি, অথচ আমার নিজের কামরায়
এসি নাই। বড়ই সংকোচ লাগে। মুগদাপাড়ার কুদ্দুসভাইর ছেলে তাহার বৃদ্ধ মাতাপিতার জন্য
দুইটা এসি পাঠাইয়াছে। ড্রয়িংরুমের জন্য একটা ইরানী কার্পেটও পাঠাইয়াছে। দেখিলে চক্ষু
জুড়ায়। মাতাপিতার সেবায় তাহার জুড়ি নাই দেখিয়া আমার মনও জুড়ায় বৈকি।
বিদেশে
যাহারাই গেল তাহারাই শহরে একটি বাসা বানাইয়া ফেলিল। কেবল তোমারই বাসা হয় নাই। এইবারে
আসিয়া বড় একটি বাসা বানাইবার ব্যবস্থা করিবা। বাসাভাড়া দিতে দিতে আমার পিন্টুর সর্বস্বান্ত
অবস্থা। শহরে একটা বাসা হইলে তোমরা সকল ভাইবোন মিলিয়া মিশিয়া নিশ্চিন্তে থাকিবার ব্যবস্থা
হইবে। টাকাও বাঁচিবে। বাবা, একটি কথা। তোমার পাঠানো টাকায় পিন্টু আইসক্রীম ফ্যাক্টরীটা
তাহার নিজের নামে খরিদ করিয়াছে বলিয়া অনেক রাগ করিয়াছ। তাহাকে অনেক গালাগালি করিয়াছ।
চিঠিপত্র লিখা বন্ধ করিয়াছ। পরের ঘর হইতে আসা মেয়েলোকের কথায় কেন তুমি স্ত্রৈন হইয়া
গেলে? ইহা সমীচীন নহে। সে তোমারই তো ভাই। তোমার
টাকা, তাহার টাকা সমান নহে কি? আল্লাহ্ তোমাকে পিন্টুর চাইতে বেশি ভাগ্যবান করিয়া দুনিয়ায়
পাঠাইয়াছেন। তুমি জীবনে যে কাজে হাত দিয়াছ সেই কাজেই সফল হইয়াছ। ইচ্ছা করিলেই তুমি
ভবিষ্যতে এর চেয়ে বড় ফ্যাক্টরীর মালিক হইতে পারিবা। কিন্তু পিন্টু পারিবেনা। তাহার
সেই তকদিরও নাই, ঘিলুও নাই। এইসব বিবেচনা করিয়া তোমাকে নির্দেশ দিতেছি, দেশে আসিয়া
তাহার সাথে মন কষাকষি করিও না। আমার নূতন বৌমা নাতাশা কিংবা বেয়াই সাহেব শুনিলে কী
বলিবেন? আমার মানসম্মানের কথা বিবেচনা করিও। এই ফ্যাক্টরী দেখিয়াই তো বেয়াই সাহেব তাহার
মেয়েকে পিন্টুর কাছে বিবাহ দিলেন,নচেৎ পিন্টুর মত বেকার ছেলেকে কে পাত্তা দিত? শহরে
এত বড়লোকের সাথে কি আজ কুটুম্বিতা করিতে পারিতাম ?
শহরে
আসার পর হইতে আমার শরীর-মন ভাল যাইতেছে না। হয়ত জানিয়াছ যে, গ্রামে আমার অনুপস্থিতির
সুযোগ নিয়া তোমার অতি সোহাগের ছোটভাই সোহাগ সাহেব আমার মান সম্মানের মাথা খাইয়া চেয়ারম্যানের
কালো কুৎসিত মেয়ে শোভাকে বিবাহ করিয়াছে। তাও কিনা কোর্টম্যারেজ। আমাদের সাথে যাহাদের
ত্রিশ বছর পর্যন্ত মামলা চলিতেছিল তাহাদের মেয়েকে সোহাগ কোন্ আক্কেলে ঘরে তুলিল? অতীতে
মামলায় জিতিয়া ব্যাটা আমাদের বাপ-দাদার সবচেয়ে দামী জমিটা দখল লইয়াছে। আমার সন্দেহ,
ঐ পাজীটা সোহাগকে হাত করিয়া ধীরে ধীরে আরো দখল করিবে। মেয়েটির বয়স যদি আঠারোর নীচে
হইত, খোদার কসম আমি ওর বাপের নামে মামলা ঠুকিতাম। বেকুব সোহাগ ইহা কী করিল? খাল কাটিয়া
কুমির আনিল? আমি স্থির করিয়াছি, তাহাকে পৃথক করিয়া দিব। দরকার হইলে ত্যাজ্যপুত্র বলিয়া
ঘোষণা দিব। সে তাহার চেয়ারম্যান শ্বশুরের লেজুড়বৃত্তি নিয়া দিনানিপাত করুক।
কিছু
জিনিসপত্র আর ওষুধের লিস্ট দিলাম। আসার আগে মনে করিয়া সবগুলি কিনিয়া সুটকেসে ঢুকাইও।
ইতি
তোমার আব্বা।
২২.
৬. ১৯৮৬ ইং
পুনশ্চ:
আবারও বলিতেছি, বাৎসরিক ছুটিতে আসিবা। চাকুরি ছাড়িয়া চিরতরে আসিবা না।
২.
দোয়া
পর সমাচার এই যে বাবা মিনটু, চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ তুমি দেশে আসিতেছ জানিয়া খুশি
হইলাম। এতদিন যাবৎ এই খবরেরই অপেক্ষা করিতেছিলাম। কারণ পরিবারের অনেক কাজ তোমার জন্য
আটকা পড়িয়া রহিয়াছে। তুমি আসার পর সব কাজ এক এক করিয়া সমাধা করা হইবে। তোমার আব্বা
দুর্বল হইয়া পড়িয়াছেন। মনও ভাল না। সোহাগের বিবাহের খবর শোনা মাত্রই অসুখ বাড়িয়া গিয়াছে।
এই কথা বিবেচনা করিয়া বসুন্ধরায় পিনটুর বাসাতে আসিয়াছি। ভাবিতেছি, জীবনের শেষ কয়টা
দিন শহরেই কাটাইব। এইখানে ভাল চিকিৎসা হইবে। গেরামে থাকিয়া কোন প্রকার লাভ হইবে না।
দেশে
আসিয়া তোমার প্রথম কাজ হইল, বসুন্ধরায় একটি জমি কেনা। মিরপুরে বাসা বানাইবে বলিয়া তোমার
সমন্ধীর বাসার নিকটে জমি কিনিয়াছ। ইহা কেমন কথা ? তাছাড়া বড় বউমা কেনইবা তোমার সমন্ধীর
বাসায় ভাড়া দিয়া থাকিতেছে ? পিনটু তোমার আপন ভাই। সে এখানে থাকিতে তুমি মীরপুরেইবা
বড়বৌমাকে রাখিতে গেলে কেন? দেশে আসিয়া ঐ জমি বেচিয়া তোমার ভাইদের লইয়া একত্রে থাকিবার
নিমিত্তে বসুন্ধরা বড় বাসা বানাইবা। মিরপুরের তুলনায় বসুন্ধরা অনেক উন্নত। রাস্তা অনেক
বড়। খোলামেলা জায়গা। মিরপুরে চিপা গলির মত রাস্তা। সেদিন তো একটু হইলেই একটি গাড়ি আমাকে
প্রায় ধাক্কা দিয়া ফেলিয়াছিল। সুতরাং তুমি আসিয়া বসুন্দরায় তিনভাইর জন্য তিনতলা বাসা
তেরি করিবা। পিন্টুর শশুর রড-সিমেনটের সুবিধা দিতে পারিবেন।
দ্বিতীয়
কাজ হইল, বড়বৌমাকে আনিয়া আমাদের কাছেই রাখিবা। আগে আমরা গ্রামে থাকিতাম। তাই মেয়েদের
পড়ালেখার অসুবিধার দোহাই দিয়া বড়বৌমা মীরপুরে তাহার ভাইয়ের বাসায় চলিয়া আসিলেন। এখন
তো আমরাও শহরে থাকি। অসুবিধা হইবে কেন? মীরপুরে তুমি তাহাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, আবার
এখানেও আমাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, ইহাতে ডাবল টাকা খরচ হইতেছে না? একত্রে থাকিলে তো
খরচ বাঁচে। এইসব বিবেচনা করিয়া আমি ও তোমার বাবা গত সপ্তাহে গিয়াছিলাম বৌমাকে আনিতে।
সে তোমার অনুমতির কথা বলিল। আমরা বাঁচিয়া থাকিতে তোমার আবার কিসের অনুমতি, বুঝিলাম
না। মেয়েটি বড়ই চালাক। চিঠিতে আর কিছু লিখিলাম না। তুমি দেশে আসিলে সব বলিব। তুমি আসা
মাত্রই তাহাকে এখানে আনিবা। পিনটুর শশুরের বাসায় বাবুরচি আছে। আর আমরা বৃদ্ধ বয়সে বুয়ার
রান্না খাই। আমাদের এইসব অসুবিধার কথা কি বড়বউমার বুঝা উচিত না? বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ির
খেদমত করা তাহার উচিত না? মেজবৌমা নাতাশা ছেলেমানুষ। লেখাপড়া নিয়া সারাদিন বাহিরে থাকে।
রান্না করিয়া খাওয়াইবে কিভাবে ? ইহাও বড়বৌমার বিবেচনা করা উচিত। ভাইয়ের বাসায় আরামে
বসিয়া থাকিলেই চলিবে? সে নাহয় থাকিল। কিন্তু সাফা-মারোয়া? তাহারা তো আমার নাতিন। তাহারা
কেন পরের বাসায় থাকিবে?
এইবার
পিনটুর কথায় আসি। তুমি দেশে আসিয়া তাহার সাথে রাগারাগি করিও না। হাজার দোষ করুক, সে
তোমারই মায়ের পেটের ভাই। আমার কড়া হুকুম, মায়ামমতা বজায় রাখিবা। আরেক কথা। যদিও তাহার
বিবাহের গহনাসহ যাবতীয় খরচ দিয়াছ তবুও নাতাশাকে এই প্রথমবারের মত দেখিবে। সালামী হিসাবে
তাহার জন্য একপদ স্বর্ণালঙ্কার আনিও। শাড়ি আনিও না। আজকালকার মেয়ে শাড়িটাড়ি পরে না।
বিবাহের সময় সোহাগ একটি শাড়ি দিয়াছিল। দামী হইলেও তাহা সে পরে নাই। কাউকে দিয়া দিয়াছে।
তাহারা উচু বংশের মানীলোক। নাতাশার মা-বাবার জন্যও কিছু গিফট্ আনিও। ইহাতে আমাদের
সম্মান বাড়িবে। আর কার কার জন্য কি কি আনিতে হইবে তাহার একটি তালিকা দিলাম। প্রতিটি
জিনিস মনে করিয়া আনিও।
ইতি
তোমার
আম্মা
তারিখ:
২২. ৬. ১৯৮৬ ইং
পুনশ্চ:
হাসনা আর হেনার চিঠির উত্তর দাও নাই কেন ? তাহারা মনে কষ্ট পাইয়াছে। আসিবার সময় জামাইদের
জন্য সুট কোট আনিবে। বেয়াইনদের জন্য শাড়ি। পুত্রা-ঝিয়ারিদের জন্য টুকিটাকি যা পার।
৩.
লিখেছ,
আমাদের জন্য কী কী আনতে হবে? ওগো, আমি কী চাই, তুমি কি জান না? দু’বছর ধরে দেশে আসছ
না পারিবারিক কলহ এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার চাপে। তুমি আসবে - এটাই পরম পাওয়া। সহি সালামতে
চলে এস। ব্যাস, আর কিছু চাই না। তোমার মেয়েরা রোজ দশবার ক্যালেন্ডারের পাতায় আগামী
মাসের ‘ত্রিশ তারিখ’ দেখে। তাদের দিনও যেন ফুরোতে চায়না। তুমি এলে কোথায় কোথায় বেড়াতে
যাবে সারাক্ষণ তারই পরিকল্পনা। দাম্মামে থাকতে সী-বিচে কত আনন্দ করে বেড়িয়েছে তোমার
হাত ধরে। সেই সোনালী দিনগুলো তো আর ফিরে পাবে না। তাই তুমি আসার অপেক্ষা করেই যাচ্ছে।
ওদের দাম্মামের বন্ধুদের কয়েকটা ছবি আনতে বলেছে। এলবামে রাখবে। সেই পিচ্ছিরা এতদিনে
নিশ্চয় বেশ বড় হয়ে গেছে। আমারও খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ওখানকার ভাবীদের কথাও খুব মনে
পড়ে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল দিনগুলো কাটিয়েছি ওখানে। সবাইকে আমার সালাম বলো।
চিঠির
এক কোনায় হাসপাতালে যাবার কথা লিখেছ। সিরিয়াস কোন অসুখ নয়তো? এবারের পাঠানো ছবিতে এত
রোগা রোগা লাগছে কেন? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। বছরের পর বছর ওভারটাইমসহ ছুটিহীন খাটুনি
দিচ্ছ। আমি পাশে নেই। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে নিশ্চয়। দেশে এসে যদি দু’তিন মাস থাকতে
পারতে তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত। জানি তো, প্রবাসজীবনের বিরামহীন কষ্ট মানুষকে সুস্থ্য
থাকতে দেয়না। দেখনা, অন্তত দুমাসের ছুটি নিতে পার কিনা।
গতকাল গ্রামের বাড়ি থেকে সোহাগ এসেছিল নূতন বউ নিয়ে।
শোভা খুব লক্ষী মেয়ে। গায়ের রং শ্যামলা। কিন্ত
পয়মন্ত চেহারার মধ্যে প্রখর বুদ্ধির ছাপ। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছে। ভাল
রেজাল্ট। ওকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বলেছি। তুমি যদি ভাল মনে কর তাহলে মীরপুরে আমার কাছে
রেখে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। আমাদের মত করে ওকে গড়ে তুলব। কি বল ? এতে করে বাবা-মার
মন থেকে ওদের কোর্টম্যারেজ সংক্রান্ত মনোকষ্ট ধীরে ধীরে ঘুচবে। আমার প্রস্তাবে সোহাগ
খুশি হয়েছে। এখন তোমার মতামতের অপেক্ষা।
সেদিন
মা এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে। বললেন, আমাকে ওনাদের কাছেই থাকতে হবে। সাফা-মারওয়া নাকি
ওখানকার স্কুলেই ভর্তি হবে। বললেন, ঐ স্কুলে পিন্টুভাইর শালাশালীরা পড়ে। এটা নাকি শহরের
সবচেয়ে ভাল স্কুল, ইত্যাদি। মার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজী হতে আমার বিবেক সায় দেয়নি।
প্রথমত: বাসাটা ভাড়া হয়েছে পিন্টুভাইর নামে, তোমার নামে নয়। দ্বিতীয়ত: যে ভাইকে তুমি
লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছ, তার কাছ থেকে পেয়েছ অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসঘাতকতা। ওর
বাসায় তোমার অনুমতি ছাড়া যাব কেন ? গেলে তুমি কষ্ট পাবে। তাছাড়া সে কি শুধু তোমার মনেই
কষ্ট দিয়েছে ? আমার নামেও তো নানারকম অপবাদ দিতে ছাড়েনি। আমিই নাকি ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা
তৈরি করেছি। সে তো এটুকুও ভাবল না যে, দাম্মামের সুখের সংসার ছেড়ে, সাফা-মারওয়াকে পিতৃস্নেহ
থেকে বঞ্চিত করে আমি চলে দেশে এসেছিলাম শুধুমাত্র পয়সা বাঁচাব বলে। আর ঐ বাঁচানো টাকা
সঞ্চয় করে তিনভাইর যৌথ ব্যবসার জন্য আইসক্রীম ফ্যাক্টরী আর একসাথে থাকার জন্য বড় একটা
বাসা কিনব বলে। ফ্যাক্টরী তো হল। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের উন্নতির জন্য তোমার যে
সুদূরপ্রসারী ধ্যানধারণা ছিল তার কী হল? সাফা-মারওয়া, তুমি-আমি এ চারজনের আত্মত্যাগের
মূল্য কী এই?
যাহোক।
একদিন সে তার ভুল বুঝবে। ক্ষমা করতে তোমার কষ্ট হবে জানি। তবু পারলে ধীরে ধীরে তাকে
ক্ষমা করে দিও। আমি জানি অল্লাহ্ আমাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করবেন। দেশে এসে তার সাথে
রাগারাগি করনা। তোমার জন্য দিনরাত দোয়া করছি। ভাল থেকো। সুস্থ্য থেকো। সহিসালামতে পৌঁছাও।
ইতি
একমাত্র তোমারই জান্নাত
তারিখ
: ২৩.৬. ১৯৮৬
পুনশ্চ:
আবার বলছি, কষ্ট করে অযথা এটা সেটা কিনে লাগেজ ভারি করতে যেয়োনা। সব সময়ই তো পাঠাও।
কিছুই আনতে হবেনা। তাছাড়া মনে রেখো আমার জন্য আনতে গেলে আরো অনেকের নাম উঠে আসে। দেশে
এসে এ নিয়ে অপ্রিয় কথা শুনবে আর কষ্ট পাবে। তোমার এ কষ্ট আমি চাই না।
৪.
বড়
ভাইয়া, আমাদের সালাম নিও। গতকাল মীরপুর গিয়েছিলাম আমার মহিয়সী ভাবী আর কলিজার টুকরো
দুই ভাতিজীকে দেখতে। শোভার কথা নিশ্চয় শুনেছ। ওকে কীভাবে গ্রহণ করবে এই ভয়ে এতদিন সরাসরি
লিখতে সাহস করিনি। বড়ভাবী এই পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি নিজের গহনা পরিয়ে ওকে আশীর্বাদ
করে স্বীকৃতি দিলেন। তারপরই না তোমার কাছে চিঠি লিখতে সাহস পেলাম। ভাবীর স্নেহের ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব জানিনা।
মাঝে মাঝে তুলনা করে আশ্চর্য হই, কীভাবে যে জোড়া মিলে যায়। বড়ভাবীর মনটা ঠিক তোমার
মত। আর ছোটভাবীর মনটা ঠিক ছোটভাইয়ার মত। আব্বা আম্মাতো ধনের জৌলুস দেখে তাকে মাথায়
তুলে রেখেছেন। আমার বিশ্বাস, দেরিতে হলেও একদিন খাঁটি সোনা চিনতে পারবেন।
বড়ভাবীর
মুখে শুনলাম, এ মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসছ। শুনে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিস্ক
নেবার মত ভরসা পাচ্ছি। প্রথমতঃ তোমার উপস্থিতিতে আব্বা আম্মাকে বুঝিয়ে শোভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে
ঘরে তোলা।
দ্বিতীয়তঃ
আলীগঞ্জ বাজারে লাভজনক একটা একতলা দোকান বিক্রি হচ্ছে। ভবিষ্যতে দোতলা বা তিনতলা করা
যাবে। গ্রামে বসেই শহরে ব্যবসা করা যাবে। ওরা সর্বমোট দু’লাখ চায়। অগ্রিম পঞ্চাশ হাজার
টাকা আমি আমাদের সমিতি থেকে ধার নিতে পারব। তোমার কাছে বাকি দেড় লাখ টাকা চাইতে নিজেকে
অপরাধী মনে হয়। আমাকে মাস্টার্স পাশ করাতে তুমি যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করেছ। বৃথা গেল এই
খোটা দিয়ে আব্বা আম্মা আমাকে হরদম বকাঝকা করেন। তোমার অতি আদরে নাকি আমি বাঁদর হয়েছি।
মানুষ হইনি। সব দোষ নাকি তোমার।
কিন্তু
ভাইয়া, মানুষ না হলেও অমানুষ তো হইনি। কাদের স্যারের অগ্নিমন্ত্রে আমি দীক্ষিত। গ্রামের
সার্বিক কল্যাণের জন্য এখন অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। গ্রামে আমার সুনাম এবং প্রতিপত্তি
যথেষ্ট রয়েছে। আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান। শোভার কল্যাণে আজকাল তিনিও
পাল্টাতে আরম্ভ করেছেন। শোভাকে বিয়ে করেছি বলে আব্বা তো বলেন, আমি নাকি খাল কেটে কুমীর
এনেছি। আব্বা অত পলিটিক্স বুঝবেন কী করে? বুঝেন তো কেবল মামলা-মোকদ্দমা। আমি খাল কেটে
কুমীর আনিনি। বরং গ্রাম থেকে কুমীরের রাজত্ব উৎখাত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তদুপরি
আমার বাপ-দাদা যা পারেননি আমি তা পেরেছি। বিগত ত্রিশ বছরের মহাযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে
প্রকারান্তরে চেয়ারম্যানকে সারেন্ডার করতে বাধ্য করেছি। জবরদখলকৃত জমি উনি ফিরিয়ে দিতে
রাজী। শুধু কি তাই? ইউনিয়নবাসীর উন্নতির দিকেও আজকাল মনোযোগী হয়েছেন। আব্বা আর কী চান?
যদি গ্রামের মঙ্গল চান তাহলে আমার প্রতিটি কৌশল বোঝার কথা। পক্ষান্তরে উনি যদি আমাদের
পরিবারের বহিরাগত মন্ত্রণাদাতা জনৈক বেয়াইকে (পিন্টুভাইর শ্বশুর) প্রাতঃস্মরণীয় মহাজ্ঞানী
মহাজন ভাবেন, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।
যাহোক।
যা বলছিলাম, তুমি দেশে এসে দোকানটা দেখবে। পছন্দ হলে তোমার নামেই কিনে ফেলব এবং ব্যবসা
আরম্ভ করে বেকারত্ব ঘুচাব। টাকাটা আমি ধার হিসেবেই চাচ্ছি। আমাকে অবিশ্বাস কর না ভাইয়া।
আমি তোমার এম. এ পাশ করা পিন্টু নই।
পিন্টুসাহেবের
বসুন্ধরার বাসায় গিয়ে আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে এসেছি। শ্বশুরের দেওয়া দামী ফার্নিচারে
ঠাসা তার বাসা। এমন কোন জিনিস নেই যা পিন্টুভাইর নিজের কেনা। আব্বা আম্মাকে দেখলাম
খুব গর্বিত। শোভা মীরপুর আছে জেনেও না জানার ভান করলেন। ওনাদের বকাঝকা তো আমার নিত্যসাথী।
এখন আর দুঃখ পাইনা। কিন্তু দুঃখ লাগে, আমাদের যে মাতাপিতা অল্পেতুষ্টি আর সহজসরল জীবনযাপনে
অভ্যস্ত ছিলেন, সেই মাতাপিতা এখন শহরের জৌলুস আর বিলাসী জীবনের প্রতি ক্রমশ ঝুঁকে পড়েছেন।
ওনাদের কামরায় এখন নিজস্ব রঙীন টিভি। বিদেশী চ্যানেলের সিরিয়ালের নেশায় থাকেন বুঁদ।
দুনিয়াদারী চাহিদার শেষ নেই। কে তাদেরকে পল্লীবাংলার দিকে ফেরাবে? কে ফেরাবে আখেরাতের
চিন্তার দিকে ?
অনেক
কিছু লিখলাম। ভুল বুঝো না যেন। আমার ওপর আস্থা রেখো। শোভার সালাম নিও। আমরা ভাল আছি।
ইতি
তোমার
ছোটভাই সোহাগ
তারিখ
: ২৪. ৬. ১৯৮৬
পুনশ্চ:
এয়ারপোর্টে অবশ্যই ভাবী আর সোনামণিদেরকে নিয়ে আমি উপস্থিত থাকব। কোন চিন্তা কর না।
৫.
আমার
কলিগ মাসুদ খান অফিস থেকে ফেরার পথে হাসপাতলে এসে এই চারটা চিঠি দিয়ে গেল। এখনই উত্তর
লিখে ফেলা দরকার। কারণ ধূসর সময়টাকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। মহাকাল আমাকে আর বেশি
সময় দেবে বলে মনে হচ্ছে না।
চাওয়া
মাত্রই নার্স কাগজ-কলম দিয়ে গেল। আলাদা করে সবার চিঠির জবাব দেবার মত সময় বা মন কোনটাই
নেই। যতদূর আন্দাজ করছি, শীঘ্রই আমাকে লাইফ-সাপোর্টে নেওয়া হবে। তাই সময় থাকতে অছিয়ত-নামা
লিখে যাচ্ছি। এতেই একত্রে সবার চিঠির জবাব থাকবে।
আমার
পুত্র সন্তান নেই বিধায় প্রবাসজীবনের ষোলটি বছরের উপার্জিত স্থাবর অস্থাবর যৎসামান্য
সম্পদ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক নিম্নলিখিত ওয়ারিশদের নামে বন্টন করে দিচ্ছি। এরপর পৃথিবীতে
যেভাবে নিঃস্ব অবস্থায় এসেছিলাম, ঠিক সেভাবেই নিঃস্ব অবস্থায় পরম করূণাময়ের কাছে প্রত্যাবর্তন
করব।
ক.
মা-বাবা এবং দুই বোন: নদীর পারে যে জমি কিনেছিলাম তা সম্পূর্ণ তাদের নামে যাবে। দেখেশুনে
প্রত্যেকে শরীয়ত মোতাবেক বন্টন করে নেবেন। আব্বা-আম্মা তাগিদ দিচ্ছিলেন ওনাদেরকে হজ্ব
করাতে। হজ্ব করানোর মালিক তো আল্লাহ। আমি নই। আর হজ্ব করতে হয় নিজস্ব সম্পদ থেকেই।
সুতরাং উক্ত জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ওনারা এ বৎসর হজ্ব করবেন।
খ.
দুই ভাইঃ আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে পিন্টু
ফ্যাক্টরীটা নিজের নামে লিখে নিয়েছে। সে তার প্রাপ্য অংশের বেশি পেয়েছে। সুতরাং তার
আর পাওনা নেই। আমার স্ত্রীর অনুরোধক্রমে তাকে আমি ক্ষমা করলাম। কিন্তু কয়েক শর্তে।
তার একমাত্র জীবিত ভাই সোহাগকে যেন না ঠকায়। আব্বা আম্মার যেন অযত্ন না হয়। তাদের জন্য
ভাল একটা বাবুর্চি যেন রেখে দেয়। আমবাগান, লিচুবাগানের ফল আর জমির ফসল বিক্রির সব টাকা
যেন ওনাদের হাতেই তুলে দেয়।আর বোনদের হক যেন আদায় করে। অর্থাৎ পৈত্রিক সম্পদের অংশ
প্রদান করা, খোঁজখবর নেওয়া, মাঝেমাঝে নাইওর আনা, সামাজিকতা লৌকিকতা বজায় রাখা ইত্যাদি।
দাম্মামে
আমার গাড়ি এবং ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা আমার বন্ধু
মাসুদ খানের তদারকিতে থাকবে। উক্ত টাকা সোহাগের জন্য রইল। সে তার ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়ে
বাকি টাকা দিয়ে শোভার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে এবং ওদের রিসিপশনের অনুষ্ঠানে ব্যয়
করবে। খোদার হুকুমেই তো ওদের বিয়ে হয়েছে। এ হুকুম বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে আব্বা আম্মা
যেন তাদেরকে সমাদরে গ্রহণ করেন এবং চেয়ারম্যানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। তিনি তো
গ্রামসম্পর্কে আব্বারই জ্ঞাতিভাই। সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে দুনিয়া-আখেরাত উভয়
জাহানেই মঙ্গল।
গ.
আমার স্ত্রী এবং জমজ কন্যাঃ আমার মৃত্যুর পর কোম্পানী থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে তা এবং
সোনালী ব্যাংকে যৎসামান্য যা আছে তা সম্পূর্ণ তাদের। মীরপুরে আমার স্ত্রীর নামে কেনা
একটুকরো জমি আছে। এ টাকায় তেতলা বাড়ি হবে। দোতলায় ওরা থাকবে এবং বাকি অংশ ভাড়া দিয়ে
দিন গোজরান করবে। তাদের হেফাজতের ভার আল্লাহতা’লার ওপর রইল। আমার সম্বন্ধীর কাছে অনুরোধ
রইল তিনি যেন তাদেরকে তার কাছাকাছিই রাখেন। আরেকটা কথা বিশেষভাবে বলছি, আমার মেয়েরা
যেন তাদের দাদাবাড়ির অধিকার ও স্নেহমমতা থেকে বঞ্চিত না হয়।
রণক্লান্ত হাতখানি অবশ হয়ে আসছে। আর লিখতে পারছি না। ত্রিশ তারিখ দেশে যাবার জন্য বিমানের টিকিট নেবার পরদিন থেকে হাসপাতালে পড়ে আছি। বন্ধুরা সান্তনা দেয় ভাল হয়ে যাব বলে। ডাক্তারও পেশাসুলভ পজিটিভ অভিব্যক্তি দেখায়। কিন্তু আমি জানি বাংলাদেশ বিমান আমাকে কী অবস্থায় স্বদেশে দেশে নিয়ে যাবে। দাম্মামের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ: আমার চলিত মাসের বেতন থেকে যেন হাসপাতালের পাওনা মেটানো হয়। আমাকে যেন শোয়ানো হয় গ্রামের বাড়ির শ্যামল মাটিতে। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।
ইতি
একজন
হতভাগ্য মিন্টু
তারিখ
: ২৬. ৬. ১৯৮৬
পুনশ্চঃ বন্ধু মাসুদ, প্রতিদিন তুমি এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছ। তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে আরো একটি অনুরোধ করছি। আমার এ চিঠি ফটোকপি করে রেখো। মূলকপি যাবে তোমার ভাবীর কাছে। আর সাত কপি যাবে আমার মা বাবা, দুইভাই আর দুইবোন আর আমার সমন্ধীর কাছে। অপর পৃষ্ঠায় ঠিকানা দেওয়া আছে। বিদায়।
--------------------------