Wednesday, July 24, 2019

ভারত সরকার কর্তৃক ঘোষিত “তালাক ফৌজদারী অপরাধ” প্রসঙ্গে

নারী-পুরুষের অধিকার
(প্রসঙ্গ: ভারতে ”তালাক-ফৌজদারী অপরাধ”) 
- নাজমুল চৌধুরী


সাম্প্রতিককালে পত্র-পত্রিকায়, ইউ টিউবে, মানবাধিকার সংস্থা এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে ভারতীয় মুসলিম সমাজে ”তালাক - ফৌজদারী অপরাধ” শীর্ষক আলোচনা সমগ্র ভারত সরগরম হয়ে উঠেছে। ভারত সরকার অর্ডিন্যান্স জারীর মাধ্যমে ভারতীয় মুসলিম সমাজে তালাকের মাধ্যমে বিবাহ-বিচ্ছেদকে ”ফৌজদারী অপরাধ” হিসাবে গণ্য করে আইন পাশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। 

মুসলিম ধর্মগ্রন্থে এবং বিধিবিধানে ভুল ধরা কিংবা ভারতের পঁচিশ কোটি মুসলিম জনসাধারণকে হেয় প্রতিপন্ন করা ভারতীয় সরকারের সাংবিধানিক দায়িতে¦র অংশ কিনা তা আলোচনার প্রতিপাদ্য। এক বিশাল মুসলিম জনগোষ্টির ধর্মীয় সত্ত¡ায় কিংবা আচারঅনুষ্ঠানে তাদের জন্য হালাল আমিষ খাদ্য (গো-মাংস) ভক্ষণে কিংবা হিন্দু ধর্মের ”জয় শ্রীরাম” মন্ত্র কিংবা ”বন্দেমাতরম (মাতৃভূমির বন্দনা)” জোরপূর্বক পড়িয়ে নেয়া কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনে বাধাপ্রদান ইত্যাদি বিষয় একধরণের হিংসার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হয়। মুসলিমরা একমাত্র আল্লাহর বন্দনা করে, আল্লাহ সৃষ্ট মাটিকে নয় তাই ”বন্দেমাতরম” উচ্চারণে তাদের আপত্তি। ”বন্দেমাতরম” শব্দটি শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার লেখালেখিতে প্রথমে উচ্চারণ করেন। এ শব্দটি যে হিন্দু ধর্মের কোন প্রবর্তক কিংবা ধর্মীয় গ্রন্থ বেদের নির্দেশ তা কিন্তু নয়। তাই ”বন্দেমাতরম” না বলায় যে ভারতীয় মুসলিমরা দেশপ্রেমিক নন এটা প্রমাণিত হয়না। 

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল সম্প্রদায়ের লোকজনের অবদান অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পাকভারত উপমহাদেশের সকল শ্রেণীর লোকই অংশগ্রহণ করেছিল এবং এ আন্দোলনের ফসল হিসাবে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তবে ব্রিটিশরা ”ডিভাইড এন্ড রোল” মন্ত্রটি ভারতবর্ষের নের্তৃবৃন্দের মগজে এমনভাবে পাকাপোক্ত করে গেছে যে, যার প্রতিক্রিয়া এ উপমহাদেশের অধিবাসীদের রক্তে স্থায়ীভাবে মিশে আছে। এ উপমহাদেশে হাজার হাজার বছর ধরে প্রত্যেক ধর্মের লোকই নিজেদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে আসছে। মুঘল শাসনে ধর্মপালনে পরম সহিষ্ণুতা ছিল এবং কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা ছিলনা।      

পৃথিবীর সর্বত্রই অর্থাৎ ৯৭ টি ধর্মেই এবং শতকরা ৯৯.৯ টি দেশেই গো-মাংস ভক্ষণে বা কে কি খাবে বা না খাবে তার উপর কোন বিধিনিষেধ নেই। এমনকি সাম্প্রতিককালে জাপানের বিশেষায়িত কিছু রেষ্টুরেন্টে সদ্য মৃত মানুষের মাংসসহ নানাধরণের কীট-পতঙ্গ ভক্ষণ করারও সরকারী লাইসেন্স রয়েছে। কোরিয়া, ভিয়েতনাম, চীন কিংবা আফ্রিকার অনেক দেশেই কীট-পতঙ্গ, সরীসৃপ, কুকুর, বিড়াল, শুকর ইত্যাদির মাংসও মানুষ ভক্ষণ করে থাকে এবং এজন্য রেষ্টুরেন্টগুলো সরকারী অনুমোদন পেয়ে থাকে। এমনকি সনাতন হিন্দুধর্মের প্রবর্তক ও পুরোহিত পর্যায়ে গো-মাংস ভক্ষণের রেওয়াজও প্রচলিত ছিল। বর্তমান ভারতে ও বাংলাদেশে অনেক হিন্দুরা গো-মাংস পছন্দ করে থাকেন। ভারতে গো-মাংস নিষিদ্ধ করে যখন আইন পাশ হয় তখনও অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের নের্তৃবৃন্দ এবং আমজনতার কিছু অংশ প্রতিবাদ করেছিলেন এবং তারা নিজেও গো-মাংসে ভুরিভোজন পছন্দ করেন বলে প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন। তারা এও বলেছিলেন হিন্দুধর্মে গো-মাংস ভক্ষণ অপরাধযোগ্য নয়। হিন্দুধর্মের ঋগবেদের ১০ নং গ্রন্থের ৮৬ অনুচ্ছেদের ১৩ পরিচ্ছেদে, মনুশ্রুতির ৫ নং অধ্যায়ের  ৩০-৩১-৩৫ ও ৪২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে তোমরা মাংস খাবে, মাংস উপকারী। প্রাচীনকালে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা গরু বলি দিত এবং গরুর মাংস ভক্ষণও করত। গান্ধী রচিত “হিন্দু ধর্ম” গ্রন্থে বর্ণীত হয়েছে প্রাচীন ব্রাক্ষণরা গরুর মাংস ভক্ষণ করিত। মহাভারতের ৮৮ অনুশাসন পর্বে এবং মনুশ্রুতির ৩ নং অধ্যায়ের ২৬৬-২৭২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে ঈশ্বর বিষ্ণু যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিচ্ছেন তোমাদের পূর্বপুরুষদের প্রয়াত আত্মাকে সন্তুষ্ঠ করতে যদি শাকসব্জি খাদ্য হিসাবে বিতরণ কর তাহলে আত্মা ১ মাস, মাছ দিলে ২ মাস, হরিণের মাংস দিলে ৩ মাস, ভেড়ার মাংস দিলে ৪ মাস, পাঠার মাংস দিলে ৫ মাস, ছাগলের মাংস দিলে ৬ মাস, চিত্রা হরিণের মাংস দিলে ৭ মাস, কালো হরিণের মাংস দিলে ৮ মাস, গরুর মাংস দিলে ১২ মাস, ষাড়ের মাংস দিলে ১২ বছর এবং গন্ডারের লাল মাংস খাওয়ালে তাদের আত্মা অনন্তকাল সন্তুষ্ট থাকবে।

পৃথিবীর খাদ্যসম্ভার মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। প্রত্যেকটি জীবেরই তার পছন্দনীয় খাবার ভোগ করার অধিকার মহান সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন। শুধুমাত্র ভারতেই এর ব্যতিক্রম। সাম্প্রতিককালে গো-মাংস ভক্ষণের বা বহনের অপরাধে কিংবা প্রতিহিংসার কারণে মিথ্যে অপবাদে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অনেক মুসলিম নাগরিককে প্রাণ দিতে হয় অথবা শারিরীকভাবে লাঞ্চনার শিকার হতে হয়। ভারতে অসংখ্য ধর্মবলম্বীদের বসবাস, তাদের খাদ্যদ্রব্যের মেনু নিয়ে সরকার বা হিন্দু জনতা কখনো মাথা ঘামায়নি বা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার প্রমাণ নেই অথচ শুধুমাত্র মুসলিম নাগরিকদের অধিকারের উপর সরকার কিংবা মৌলবাদী হিন্দুদের খর্গহস্ত কেন তা বোধগম্য নয়।     

”তালাক ফৌজদারী অপরাধ” - ভারত সরকার কর্তৃক এ অর্ডিন্যান্স জারী প্রসঙ্গে কিছু কথা ঃ

এ অর্ডিন্যান্স জারির প্রাক্কালে ভারত সরকার কি কোন মুসলিম ধর্ম বিশেষজ্ঞ কিংবা মুসলিম ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কু’রআনে বিশদভাবে বর্ণিত বিধিবিধানের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন নাকি চোখ-কান বন্ধ করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে একটি শৃঙ্খলিত ধর্মের অনুশাসনকে অবজ্ঞা করে এ ধরণের অনধিকার চর্চার প্রয়াস চালিয়ে আসছেন তা ভারতীয় এবং পৃথিবীব্যাপী মুসলিম সমাজে আজ প্রশ্নবিদ্ধ। 

একথা অনস্বীকার্য যে, ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলা সকল ধর্মের মানুষের মৌলিক অধিকার, এটাকে পরিবর্তন করার অধিকার কোন সরকার বা ব্যক্তিবিশেষের নেই। কারণ ধর্ম মানুষ পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে পালন করে আসছে এবং যুগে যুগে মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রেরিত ধর্মপ্রবর্তকদের মাধ্যমে সেই সময়ের মানুষকে ধর্মপালনের বিধিবদ্ধ নিয়মে বিধাতার গুণগান, সমাজের মধ্যে বৈষম্য, হিংসাবিদ্বেষ, লোভ, পরশ্রীকাতরতা, সামাজিক অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ রাখার প্রয়োজনে সে সমস্ত জনগোষ্টির জন্য ধর্মপ্রচার করে গেছেন। পবিত্র কু’রআনে মহান আল্লাহ বলেছেন : আমি প্রত্যেক দেশে, প্রত্যেক জাতি ও সমাজের কাছে বার্তাবাহক পাঠিয়েছি যাতে তারা বলতে না পারে আমাদেরকে পূর্বে হুশিয়ার করা হয়নি।  

মানুষের জন্যই ধর্ম এবং ধর্ম যুগে যুগে প্রবর্তিত হয়েছে। যেমন হিন্দু ধর্ম প্রায় পাঁচহাজার বছরের পুরানো, বৌদ্ধ, মসীহি (ইয়াহুদ) ও ঈসায়ী (খ্রিষ্ট) ধর্ম প্রচারের সময়কাল দু’হাজার পাঁচশত থেকে তিনহাজার পাঁচশত বছরের মধ্যে এবং সর্বশেষ ইসলাম প্রায় পনরো বছরের পুরানো।

তাই সকল ধর্মেই সমাজে নর-নারীর অধিকার সজ্ঞায়িত করা হয়েছে যা শুধু সেই সমাজের বা সেই ধর্মের জন্যই প্রযোজ্য। সকল ধর্মেই নর-নারীর অধিকারের সীমা নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, যদি কোন ধর্মে নর-নারীর সামাজিক অধিকারের প্রশ্নে কোনরূপ বৈষম্য থাকে কিংবা কোন ব্যাপারে ধর্ম কোন সমাধান দিতে পারেনা সেক্ষেত্রে ধর্মীয় পুরোহিতগণ ধর্মগ্রন্থ মোতাবেক বিচার বিবেচনা করে একটি সমাধানের পথ বের করেন যা সেই সমাজ মেনে নেয় এবং সেভাবেই ধর্মপালনে ব্রতী হয়। কিন্তু কোন রাজনৈতিক নেতা, গোষ্ঠী বা সরকার তাদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে হাজার হাজার বছরের নিয়মপ্রথা কিংবা ধর্মের চিরাচরিত বিধান পরিবর্তন করে তাদের নিজস্ব মতামতের প্রেক্ষিতে আইন প্রণয়ন করার অধিকার রাখেনা। 


মুসলিম ধর্মে তালাকের বিধান এবং নারী অধিকার প্রশ্নে ধর্মগ্রন্থ আল-কু’রআনে বিশদভাবে বর্ণনা ব্যক্ত করা হয়েছে যা অন্যান্য ধর্মের সাথে ত‚লনা করলে দেখা যায় ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যে ধর্মে নারীদের অধিকার সুষ্টভাবে বন্টন করা হয়েছে। 

আসুন মুসলিম ধর্মে নারী-পুরুষের অধিকার নিয়ে যে সমস্ত বিধিবিধান রয়েছে সে সমস্ত বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যাক।

পবিত্র কু’রআনে বলা হয়েছে ঃ  ”তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের সাথে শান্তিতে বসবাস করতে পার এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাদি রয়েছে। (সুরা রুম ঃ ২০)”

”তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ (সুরা বাকারা ঃ ১৮৭)”

রাসুল (সঃ) বলেছেন  তোমাদের মধ্যে বেশী উত্তম সে, যে নিজের স্ত্রীর কাছে উত্তম আর আমি আমার স্ত্রীদের কাছে উত্তম (বুখারী ও মুসলিম)।

পারিবারিক জীবনগঠনের কয়েকটি উদ্দেশ্য রয়েছে।

এক ঃ নৈতিক চরিত্রের এবং সতীত্বের হেফাজত।

দুই ঃ পারস্পরিক ভালবাসা ও আন্তরিকতা।

তিন ঃ আদর্শ পরিবার গঠন এবং এ পরিবারের মাধ্যমে জন্ম নেয়া বংশধরগণ দেশ, জাতি ও সমাজগঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করবে এবং একটি আদর্শ সমাজ ও সরকার গঠন করবে।

পবিত্র কু’রআনের বিভিন্ন সুরায় মানবজাতির জীবনবিধানের কথা উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে বেশীরভাগ সুরাতেই পারিবারিক জীবনের বিষয়, যেমন : বিবাহের মাধ্যমে সম্পর্ক, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তান পালন, স্ত্রীর ভরণপোষণ, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও কর্তব্যের কথা রয়েছে। 

রাসুল (সঃ) এর হাদীসে উল্লেখ আছে ”তালাকপ্রথা আল্লাহর কাছে হালাল বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত বস্তু। কোন মহিলাকে তার স্বামী অন্যায়ভাবে তালাক দিলে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠে।” 

তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিয়মের ভেতর সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসাবে তালাক প্রযোজ্য। তবে এ ক্ষেত্রগুলোর ব্যাপারে কমসংখ্যক লোকই অবহিত। ধর্মের বিধিবিধান না জানার কারণে বা অজ্ঞতাপ্রসূত তালাকের কারণে অনেকর সাজানো সংসার নষ্ট হয়ে যায়।

ইসলাম যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিধান দিয়েছে সেখানে নিজেদের মধ্যে ভুলবুঝাবুঝি, ঝগড়াবিবাদ নিষ্পত্তির পথও বাৎলে দিয়েছে। পবিত্র কু’রআন ও হাদিসের বিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে সমস্যা সমাধানে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকেনা।
 
রাগের মাথায় অনেকে অতি তুচ্ছ কারণে ঝগড়াবিবাদকে কেন্দ্র করে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেয়। তিনতালাক দিয়েই বিবাহবিচ্ছেদের পরিসমাপ্তি ঘটায়। অথচ ইসলাম এ ধরণের তাৎক্ষণিক তিন তালাক সমর্থন করেনা।
 
আমি ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পবিত্র কা’বা শরীফের ঈমাম ডঃ সালেহ বিন হুমাইদ কর্তৃক প্রদত্ত জু’মার খুতবায় তালাকের বিধান সম্পর্কিত বয়ানের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি। তিনি তার খুতবার ভাষণে বলেছেন ঃ      

ক) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতভেদের কারণে তালাক শব্দ প্রয়োগ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। মানসিক উত্তেজনা ত্যাগ করে বিভেদের মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের কোন কাজ বা আচরণ পছন্দ নাও হতে পারে কিন্তু তাই বলে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। স্ত্রীর কোন কাজ পছন্দ না হলে তার সাথে দুর্ব্যবহার করা যাবেনা। 

পবিত্র কু’রআনে সুরা নিসার ১৯নং আয়াতে বলা হয়েছে ঃ ”স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। যদি তোমরা তাদের কোন কাজ অপছন্দ কর তাহলে মনে রাখবে যে, তাদের অনকে বিষয় তোমাদের পছন্দ হয়না কিন্তু আল্লাহ এর মধ্যে তোমাদের জন্য মঙ্গল রেখেছেন।” 

খ) যদি স্ত্রীর বাস্তবিক কোন গর্হিত ত্রুটি ধরা পড়ে বা তিনি যদি স্বামীর সাথে অবাধ্যমূলক বা পছন্দের পরিপন্থী আচরণ করেন, এমতাবস্থায় তাকে তালাক দেওয়ার কথা এমনকি আকারে ইঙ্গিতেও তালাক শব্দ ব্যবহার করা অন্যায়। সুরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে পবিত্র আল্লাহ বলেছেন ঃ ”তোমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে তাদের আচরণে যদি আশংকা জাগে তাহলে তাদেরকে উপদেশ দাও। উপদেশ দেওয়ার নিয়ম হচ্ছে ন¤্রভাবে বুঝানো। স্নেহমমতার ভাষায় তার ত্রæটিগুলো ধরিয়ে দিতে হবে এবং এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতে হবে।” 

গ) আয়াতের দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছে নম্রভাবে ভুল সংশোধনের ব্যাপারে যদি স্ত্রী সংশোধিত না হয় তাহলে তার বিছানা আলাদা করে দাও। এ পর্যায়েও যদি কাজ না হয় তাহলে তাকে ভিন্ন রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে। এ পদ্বতিতে একাকীত্বের কারণে স্ত্রীর মনে শুভ চিন্তার উদয় হতে পারে এবং অনুশোচনা জাগতে পারে। বিছানা আলাদা করে দেওয়া মানে ঘর থেকে বের করে দেওয়া নয়। স্ত্রীর প্রতি অরোপিত শাস্তির কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করাটাও জায়েজ নয় যেহেতু এটি স্বামী-স্ত্রীর আভ্যন্তরিণ ব্যাপার। 

ঘ) এরপরও যদি স্ত্রী অবাধ্যতার ব্যাপারে জেদ ধরে তাহলে তাকে মৃদৃ প্রহার করবে তবে এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে এ প্রহারে সীমালঙ্গিত না হয় অর্থাৎ স্ত্রীর কোন অঙ্গহানি বা মারাত্মক শারিরীক ক্ষতি না হয়।

ঙ) এতদসত্তে¡ও যদি স্বামীর আনুগত্যে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে পরবর্তী পর্যায় সমঝোতা বা মধ্যস্থতার পথ খোলা রাখা। এ পদ্ধতি সম্মন্ধে কু’রআনে বর্ণিত সুরা নিসার ৩৫নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে ঃ ”যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভাঙ্গনের আশংকা দেখা দেয় তাহলে এ পর্যায়ে স্বামীর পক্ষ থেকে একজন এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন সালিশ উপস্থিত কর। যদি তারা মধ্যস্থতায় উপনীত হয় তাহলে আল্লাহ তাদের মধ্যস্থতাকারীদের এবং তাদেরকে সাহায্য করবেন।” 

চ) সব ধরণের উপদেশ ও যাবতীয় পদ্বতি অবলম্বন করা সত্ত্বেও যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা সম্ভব না হয় এবং স্বামী-স্ত্রীর পরিবারের লোকজনের সকল চেষ্ঠা ব্যর্থ হয় তখনই তালাকের আশ্রয় নিতে হবে। 

এ হচ্ছে পবিত্র কা’বা শরীফের ঈমামের জুমার নামাজে প্রদত্ত তালাক সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ভাষণের অংশবিশেষ। 

এখন আসা যাক্ ইসলামে তালাকের বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য যা মুসলিম ধর্মে এবং মুসলিম সমাজে প্রযোজ্য।

একান্তই বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে যদি তালাক দিতে হয় তাহলে অবশ্যই নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে নতুবা ইসলামের দৃষ্টিতে তা বৈধ বলে গণ্য হবেনা।

১)প্রথমে স্ত্রীকে এক তালাক দিতে হবে এবং একমাস পর্যন্ত এক তালাক অবস্থায় ছেড়ে দিতে হয়। এ অবস্থায় তাকে ঘর থেকে বহিষ্কার করা যাবেনা বরং স্ত্রী তার স্বামীর বাড়িতেই অবস্থান করবে। উভয়ের সম্পর্ক পূর্বের মতই বহাল থাকবে বটে তবে ক্ষণিক সময়ের জন্য তাদেরকে আলাদা থাকতে হবে যাতে স্ত্রী বা স্বামী নিজেদের মনোভাব পরিবর্তন করার সুযোগ পান। একমাসের মধ্যে স্ত্রী সংশোধিত হলে স্বামী পুনরায় নিজের কাছে গ্রহণ করে নিতে পারবেন।

২)যদি একমাস পেরিয়ে যায় এবং স্ত্রী সংশোধিত না হন বা অনুশোচনা না জাগে তাহলে মাসপুর্তির পরপরই তাকে দ্বিতীয় তালাক দেওয়া যাবে এবং এভাবে আরও একমাস এ অবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় মাসের শেষ অবধি পর্যন্ত যদি স্ত্রী সংশোধিত হয়ে স্বামীর ঘর করতে রাজী হন তাহলে স্বামী স্ত্রীকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করাতে কোন আপত্তি নেই। 

৩)এরপরও যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হয় তাহলে পারিবারিকভাবে উভয়পক্ষের মনোনিত ব্যক্তিদ্বয়ের মধ্যস্থতায় সমঝোতার চেষ্টা করতে হবে যাতে বিচ্ছেদের ভয়াবহ পরিণতি এবং ভবিষ্যতের কথা মনে রেখে পুনরায় সংসারে ফিরে আসতে পারে।

৪)মহিলাদের মাসিক রক্তস্রাব অবস্থায় তালাক দেওয়া ইসলামে জায়েজ নহে। 

৫)উপরোক্ত নিয়ম পালন করে যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সংসার করা সম্ভব না হয় তখন স্বামী চূড়ান্ত তালাক বা আরবী পরিভাষায় ”তালাকে মুগাল্লাজা” দিতে পারেন। তবে স্বামী স্ত্রীকে সম্মানের সাথে বিদায় দিতে হবে। স্ত্রীর প্রাপ্য মোহরানা সময়ের ব্যবধানে সমপরিমাণ, অলংকারাদি, পরনের বস্ত্র এবং বাড়তি কিছু সাহায্য দিয়ে বিদায় দিতে হবে। সেজন্য আল্লাহতায়ালা স্ত্রীকে উত্তম পদ্ধতিতে বিদায় দেওয়ার কথা বলেছেন (সুরা বাকারা ঃ ২৩১ এবং সুরা তালাক ঃ ১-২)। 

তালাকের ব্যাপারে ইসলামে স্ত্রীর অধিকারসমূহ ঃ

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্ধ বা বাড়াবড়ি যেমন স্ত্রীর পক্ষ থেকে হতে পারে তেমনি স্বামীর পক্ষ থেকেও হতে পারে। সমাজে বহু বদ-মেজাজী, দুশ্চরিত্র, লম্পট, কপট, যৌতুকলোভী স্বার্থপর স্বামী আছে যারা স্ত্রীর উপর অত্যাচার নিপীড়ন চালায়। অনেক সময় মারধর, খুন এবং এসিড নিক্ষেপ করে অথবা নিঃসম্বল অবস্থায় ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়। এধরণের লোকেরা মুসলিম নামধারী হলেও ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার সম্মন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে সমাজে স্ত্রীদেরকে ক্রীতদাসী মনে করে। স্ত্রী মানেই ঘরের কাজকর্ম করবে, স্বামীর পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের সেবা করবে এরূপ মনমানসিকতা আমাদের সমাজে চালু রয়েছে। বাড়ির মুরব্বীদের খেদমত কিংবা দেবর-ননদের সাথে মতপার্থক্য হলে তার উপর সম্মিলিতভাবে চালানো হয় অত্যাচারের ষ্টীমরোলার। অনেক সময় শশুর-শাশুড়ী, দেবর-ননদরা ছেলের বউয়ের উপর অন্যায়ভাবে অকথ্য নির্যাতন চালায় এবং স্ত্রীকে তালাক দিতে স্বামীকে উস্কানী দেয়। স্বামী স্ত্রীকে মনেপ্রাণে ভালবাসলেও পরিবারের লোকজনের উস্কানিতে স্ত্রীকে অনেকসময় তালাক দিতে বাধ্য হয়। স্বামী স্ত্রী উভয়েই এ কারণে নির্মম পরিণতির শিকার হয়। 

আমাদের মনে রাখতে হবে ইসলামে স্ত্রীদেরকে শুধুমাত্র স্বামীর ভালমন্দ দেখা, সেবা করা এবং সন্তানদের লালনপালন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এর বাইরে উপরোক্ত দায়িত্ব স্ত্রীর দায়িত্বের অংশ নয়। তবে স্বামীর পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, ভাইবোনদের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের ভালমন্দের সাথে একাত্মতা পোষণ করা, স্বামীর পরিবারের উন্নতিতে অবদান রাখা স্ত্রীর মহানুভবতা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে এবং এ কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসা প্রগাঢ় হয়, সুখের সংসার রচিত হয়।

স্বামীর আয়ের উপর স্ত্রীর পূর্ণ অধিকার থাকে। মহান আল্লাহ তাকে এ অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সে অধিকার দেওয়া হয়না। স্ত্রীর হাতখরচের জন্য স্বামীর আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ তুলে দিক এটা মুরব্বীদের পছন্দ নয়। মুরব্বীরা চান ছেলের উপার্জিত সমুদয় অর্থ তাদের হাতে আসুক, তারপর ইচ্ছে হলে ছেলের বউকে হাতখরচের জন্য কিছু দেবেন নতুবা দেবেননা এটা নির্ভর করে তাদের ইচ্ছার উপর। এটাও স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীকে উস্কানী দেবার অন্যতম কারণ। 

ইসলামে যৌতুকপ্রথার কোন বিধান নেই। ক’নেপক্ষ ছেলেপক্ষকে যৌতুক দিতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই, অপরদিকে স্বামী স্ত্রীকে সম্পূর্ণ দেনমোহর প্রধান করার পর তার অধিকার প্রয়োগ করবে। স্বামীর আর্থিক স্বচ্ছলতার উপর দেনমোহর নির্ধারিত হওয়ার কথা থাকলেও ক’নেপক্ষের মুরব্বীরা জোরপূর্বক স্বামীর আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূত অর্থ মোহরানা হিসাবে নির্ধারণ করার প্রয়াস চালিয়ে যান, এতে স্বামী সম্পূর্ণ দেনমোহর প্রদান না করে আংশিক পরিশোধ করে স্ত্রীকে স্পর্শ করে যা ইসলামে বৈধ নয়। অনেক সময় স্বামী অপারগ হয়ে বাসর ঘরে স্ত্রীর কাছে দেনমোহর প্রদানে অপারগতার কারণে স্ত্রীর কাছে  মাফ চেয়ে নেন, পারিপার্শিক কারণে অগত্যা স্ত্রী একরকম বাধ্য হয়ে স্বামীর দেনমোহরের  বোঝা মাফ করে দেয়। তাই ইসলামিক বিধান মতে ছেলেমেয়ের পরিবার বিয়েতে সম্মত হলে উভয়পক্ষ ছেলের আর্থিক সংগতির উপর নির্ভর করে এবং ছেলের মতামত নিয়ে মোহরানা ধার্য করাকে ইসলাম উৎসাহিত করে। 

রাসুল (সঃ) এর আমলে অনেক গরীব সাহাবারা শুধুমাত্র ছোটখাটো খেজুর বাগান কিংবা দা, কুড়াল ইত্যাদি দেনমোহর স্বাব্যস্থ করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অসংখ্য নজীর রয়েছে। এমনকি বর্তমান যুগেও আরবের যুবকেরা কিছু খেজুর এবং মাত্র পাঁচ/দশ রিয়াল মোহরানা দিয়ে বিয়ে করার কথা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে দেখা যায়। তারা ক’নেকে দেনমোহর হিসাবে প্রচুর অর্থপ্রদানে যে অপারগ সে কারণে নয়, শুধুমাত্র মুসলিম সমাজে দু’পক্ষকে মোহরানা সংক্রান্ত দেন-দরবারের অবসানের উদ্দেশ্যে এ মহৎ উদ্যোগ নিতে দেখা যায়।             

ইসলামে বিয়ের পূর্বে ছেলে মেয়ে একে অপরকে স্বচক্ষে দেখার এবং প্রয়োজনীয় খোঁজখবর নেবার অধিকার দেয়া হয়েছে অথচ আমাদের সমাজে দু’পক্ষের মুরব্বীরা ছেলে-মেয়েকে দেখে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করেন যে কারণে অনেকসময় বিয়ের কিছুদিন পরেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অপছন্দের কারণে মনমালিন্যের সৃষ্টি হয়।  

লম্পট, লোভী, দুশ্চরিত্র স্বামীর কারণে নারীরা যেমন নির্যাতিত হয় তেমনি অনেক স্ত্রীও আছে যারা পরকীয়া প্রেমে আসক্তির বশবর্তী হয়ে কিংবা শারিরীকভাবে দুর্বল, মানসিক বিকারগ্রস্থ ও আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল স্বামীর উপর নির্যাতন চালায়। পরকীয়ার কারণে স্বামীকে স্ত্রী খুন করতেও দেখা যায়। এরূপ ঘটনা আমাদের সমাজে বিদ্যমান। এক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ জরুরী হয়ে পড়ে। 

স্বামী স্ত্রীকে বিশ্বাসভঙ্গের কারণে বা অবাধ্য হওয়ার কারণে তালাক দিতে বাধ্য হয় তেমনি নারীরাও স্বামীর অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে কোর্টের মাধ্যমে, গ্রামীন সালিশের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। একজন মহিলা আল্লাহর রাসুল (সঃ) এর কাছে স্বামীর অত্যাচারের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোর আবেদন জানালে তিনি তাকে বিচ্ছেদের অনুমতি দিলেন এবং সেই সাথে স্বামীর কাছ থেকে ঐ স্ত্রী মোহর হিসাবে যে খেজুরবাগানটি পেয়েছিলেন তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ইসলামী পরিভাষায় স্ত্রী স্বামীকে তালাক দেওয়ার এ বিধানকে বাংলাভাষায় ”খোলা” বলে। সকল ঈমাম ও ফিকাহবিদদের মতে ”খোলা”র মাধ্যমে স্ত্রী লম্পট স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিতে পারে। এক্ষেত্রে স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ সুন্দরভাবে ফেরত দিতে হবে।

সুখী দাম্পত্যজীবনের জন্য আমাদের প্রিয় নবীর একটি হাদিস রয়েছে। তিনি বলেন ” মানুষ সাধারণত যে কোন চারটি গুণের ভিত্তিতে বিয়ে করে থাকে যেমন, এক সৌন্দর্য্য, দুই সম্পদ, তিন বংশ এবং চার ধর্মীয় আদর্শ। তবে ধর্মীয় আদর্শবান নারীকে যে বিবাহ করবে সে-ই দাম্পত্যজীবনে সফল হবে”।   
  
উপরোক্ত নিয়মসমূহ উপেক্ষা করে তালাক দেওয়ার কোন বিধান ইসলামে নেই। পারিবারিক প্রশান্তি এবং স্থায়িত্বের জন্য ইসলাম যে বিধান দিয়েছে এর চেয়ে শ্রেষ্ট, যুক্তিসঙ্গত, উন্নত এবং সঠিক বিধান আজ পর্যন্ত অন্য কোন ধর্ম দিতে পারেনি। 

তাই পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্ধ, অবিশ্বাস, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, কলহ, নির্যাতন, পরকীয়া, ডিভোর্স, বিয়ে না করে লিভ-টুগেদার ইত্যাদি লেগেই আছে। ইসলাম নারী-পুরুষের সামাজিক অধিকার পূর্ণমাত্রায় দিয়েছে, পৈর্তৃক সম্পত্তি কিংবা স্বামীর মরনোত্তর সম্পত্তিতে নারীর নিশ্চিত অধিকার সংরক্ষণ করেছে যা অন্যধর্মে নেই। 

তাই আজ একথা প্রমাণিত, যারা ইসলামের বিধান মেনে চলবে তারাই সুখী দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করবে। এ সত্যটি আজ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নারীসমাজের অনেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছে তাই অন্যান্য ধর্মের নারীরা ইসলামে নারী অধিকার সংরক্ষণের বিধানসমূহে আকৃষ্ট হয়ে প্রতিদিন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। 

ভারত সরকার ইসলামকে অবমাননার জন্য ”তালাক-ফৌজদারী অপরাধ” আইনটি পাশ করার কারণে  পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৩৩% মুসলিমদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? ভারত সরকার যদি ভারতীয় মুসলিমদেরকে ইসলামে তালাকের বিধান না মানলে ”ফৈৗজদারী অপরাধ” বলে গণ্য হবে এ ধরণের একটি আইন পাশ করত তাহলে সমগ্র মুসলিম জাহানে ভারত সরকার নিঃসন্দেহে প্রশংসিত হত।  হিন্দু সমাজের চিরাচরিত একস্ত্রীবাদী রীতি বর্তমান  সমাজ আর তেমনভাবে গ্রহণ করছেনা এবং এটা কোন যৌক্তিক সমাধান নয়। একজন স্ত্রী কিংবা একজন স্বামী উম্মাদ, মাদকাসক্ত, অত্যাচারী, পরকিয়ার আসক্ত একজনকে নিয়ে চিরদিন সংসার করতে পারেনা। তাছাড়া যৌতুক দেয়নেয়ার ভয়কে হিন্দুসমাজ কোনক্রমেই এড়াতে পারেনা। তাই হিন্দু সমাজে অসংখ্য কন্যসন্তানকে প্রসবের পূর্বেই হত্যা করা হয়।তাই ভারত সরকার যদি সামাজিক এ সমস্ত ব্যাধি এড়াতে তালাক আইনের পরিবর্তে নিজেদের ধর্মের বিধিবিধানের উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ নিত তাহলে হিন্দু সমাজের ভিত আরও মজবুত হত। 
 
বিভিন্ন ধর্মের উপদেশবাণী ঃ  

মানুষের যে সমস্ত জিনিষ বা ব্যবহার তোমার পছন্দ হয় সে সমস্ত জিনিষ বা ব্যবহার তোমার পক্ষ হতে মানুষকে ফিরিয়ে দিও : Christianity/Islamism

মহান আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করনা, প্রতিবেশীকে ভুখা রেখে খেয়োনা, অনাথ এতিমকে দয়া কর, নিজের মঙ্গলের জন্য যা যা কর, প্রতিবেশীর জন্যও তাই করবে এবং ভিন্ন ধর্মের লোককে গালমন্দ করনা  বরং তার সত্য উপলব্ধি ও হেদায়তপ্রাপ্তির জন্য দোয়া কর : Islamism

তুমি অন্যকে মনোকষ্ট দিওনা, যে অনুরূপ কষ্ট তোমাকে দেয়। কোন জীবকে অহেতুক কষ্ট দিওনা, প্রত্যেক জীবকে ভালবাসার মধ্যে ধর্ম :  Buddhism

অন্যের প্রতি এমন ব্যবহার করিওনা, অন্য হতে প্রাপ্ত যে অনুরূপ ব্যবহার তোমাকে পীড়া দেয় : Brahmanism/Hinduism 

তোমার প্রতিবেশীর খুশীতে খুশী হও এবং তাদের বিপদকে তোমার বিপদ মনে কর : Taoism,Confucius preached, চীন)

তোমার কাছে যা খারাপ বলে মনে হয়, তোমার প্রতিবেশীর জন্যও তা খারাপ বলে মনে করবে ঃ Judaism//Islamism

একজন মানুষ পৃথিবীর প্রত্যেক সৃষ্টিকূলের প্রতি সতর্ক থাকবে যেমন সতর্কতা নিজের প্রতি অবলম্বন করে :Jainism 

তোমার চোখে যে বিচারটি সঠিক বলে মনে হয়, প্রতিবেশীর প্রতিও সে সুবিচার কর : Baha'i /Islamism

তাই আসুন, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে উপরোক্ত উপদেশসমূহের আলোকে আমরা মানবতার জয়গান গাই, নিজের ধর্মে অটল থাকি এবং অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করি কারণ প্রত্যেক ধর্মের মূলমন্ত্রই মানবজাতির মঙ্গলসাধন।

সকল ধর্মের মূলমন্ত্রই মানবতা রক্ষা, ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পরিহার করতে উপদেশ দেয়া হয়েছে। আশা করা যায় ভারত সরকার এবং জনগণ তাদের সনাতন ধর্মের অনুশাসন মেনে চলবেন এবং সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের লোকদের সামাজিক ও ধর্মীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন এবং মনগড়া আইন প্রণয়ন করে তাদের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন করবেননা। 

=========================

Saturday, July 20, 2019

কয়েকটি চিঠি এবং একটি ত্রিশ তারিখ (ছোটগল্প)


কয়েকটি চিঠি এবং একটি  ত্রিশ  তারিখ

গুলশান চৌধুরী

১.

দোয়া পর সমাচার এই বাবা মিন্টু, তুমি চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসিতেছ জানিয়া যার পর নাই খুশি হইলাম। দোয়া করি সহি সালামতে পৌঁছাও।

লিখিয়াছ, বিদেশের এত বছরের ঘানিটানা খাটুনি আর শরীরে কুলায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়াছ যে, একেবারে চলিয়া আসিবা। আর দীর্ঘ ষোল বছরে যাহা সঞ্চয় করিয়াছ তাহা দিয়া দেশে আসিয়া ব্যবসা করিবা। কিন্তু আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত যথাযথ নহে। আরো দুই তিন বছর থাকিয়া হাতে অন্তত এক কোটি টাকা লইয়া দেশে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। নতুবা ব্যবসা করিবা কী দিয়া? আজকাল গাঁওগেরামে একটা পানের দোকান দিয়ে ব্যবসা করিতেও পঞ্চাশ হাজার লাগে। তুমি অবশ্য পানের ব্যবসা করিবে না। ইহা একটি কথার কথা। তোমার বুঝার সুবিধার্থে লিখিলাম আর কি।

এদিকে আমার আর তোমার মায়ের হজ্ব বাকি। এতদিন তুমি যুক্তি দেখাইয়াছ যে, হাসনা ও হেনার বিবাহ দেওয়া আমার পয়লা নম্বর ফরয কাজ। এখন তো এই পয়লা নম্বর ফরয কাজ আদায় হইয়া গিয়াছে। মামলা-মোকাদ্দমার ঝামেলাও শেষ। এই বৎসর হজ্ব না করিলে সমাজে মুখ তো রক্ষা হয় না। পিন্টুর শ্বশুর ম্যানপাওয়ারের ব্যবসা করেন। তিনি তো সপরিবারে তিনবার হজ্ব করিয়া ফেলিলেন। তিনি এবং পাড়াপড়শী সকলেই বলে, ‘আপনার ছেলে সৌদীতে থাকে অথচ আজ পর্যন্ত হজ্ব করিলেন না?’ কথা তো ঠিকই। সুতরাং আমি ইরাদা করিয়াছি এই বৎসর হজ্বে যাইব। তাই তোমার উক্ত সিদ্ধান্ত পরিহার কর। তবে অবশ্যই অন্যবারের মত ছুটিতে আসিবা। দেশের আবহাওয়া এখন খুব গরম। ফ্যানের বাতাসে কুলায় না। আসার সময় অন্তত একটা এসি নিয়া আসিবা। পিন্টুর শ্বশুরের বাসায় তিনটি আছে। তিনি তাহার কন্যা নাতাশার কামরার জন্য একটি দান করিয়াছেন। একই ফ্ল্যাটে থাকি, অথচ আমার নিজের কামরায় এসি নাই। বড়ই সংকোচ লাগে। মুগদাপাড়ার কুদ্দুসভাইর ছেলে তাহার বৃদ্ধ মাতাপিতার জন্য দুইটা এসি পাঠাইয়াছে। ড্রয়িংরুমের জন্য একটা ইরানী কার্পেটও পাঠাইয়াছে। দেখিলে চক্ষু জুড়ায়। মাতাপিতার সেবায় তাহার জুড়ি নাই দেখিয়া আমার মনও জুড়ায় বৈকি।

বিদেশে যাহারাই গেল তাহারাই শহরে একটি বাসা বানাইয়া ফেলিল। কেবল তোমারই বাসা হয় নাই। এইবারে আসিয়া বড় একটি বাসা বানাইবার ব্যবস্থা করিবা। বাসাভাড়া দিতে দিতে আমার পিন্টুর সর্বস্বান্ত অবস্থা। শহরে একটা বাসা হইলে তোমরা সকল ভাইবোন মিলিয়া মিশিয়া নিশ্চিন্তে থাকিবার ব্যবস্থা হইবে। টাকাও বাঁচিবে। বাবা, একটি কথা। তোমার পাঠানো টাকায় পিন্টু আইসক্রীম ফ্যাক্টরীটা তাহার নিজের নামে খরিদ করিয়াছে বলিয়া অনেক রাগ করিয়াছ। তাহাকে অনেক গালাগালি করিয়াছ। চিঠিপত্র লিখা বন্ধ করিয়াছ। পরের ঘর হইতে আসা মেয়েলোকের কথায় কেন তুমি স্ত্রৈন হইয়া গেলে?  ইহা সমীচীন নহে। সে তোমারই তো ভাই। তোমার টাকা, তাহার টাকা সমান নহে কি? আল্লাহ্ তোমাকে পিন্টুর চাইতে বেশি ভাগ্যবান করিয়া দুনিয়ায় পাঠাইয়াছেন। তুমি জীবনে যে কাজে হাত দিয়াছ সেই কাজেই সফল হইয়াছ। ইচ্ছা করিলেই তুমি ভবিষ্যতে এর চেয়ে বড় ফ্যাক্টরীর মালিক হইতে পারিবা। কিন্তু পিন্টু পারিবেনা। তাহার সেই তকদিরও নাই, ঘিলুও নাই। এইসব বিবেচনা করিয়া তোমাকে নির্দেশ দিতেছি, দেশে আসিয়া তাহার সাথে মন কষাকষি করিও না। আমার নূতন বৌমা নাতাশা কিংবা বেয়াই সাহেব শুনিলে কী বলিবেন? আমার মানসম্মানের কথা বিবেচনা করিও। এই ফ্যাক্টরী দেখিয়াই তো বেয়াই সাহেব তাহার মেয়েকে পিন্টুর কাছে বিবাহ দিলেন।  নচেৎ পিন্টুর মত বেকার ছেলেকে কে পাত্তা দিত? শহরে এত বড়লোকের সাথে কি আজ কুটুম্বিতা করিতে পারিতাম ?

শহরে আসার পর হইতে আমার শরীর-মন ভাল যাইতেছে না। হয়ত জানিয়াছ যে, গ্রামে আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়া তোমার অতি সোহাগের ছোটভাই সোহাগ সাহেব আমার মান সম্মানের মাথা খাইয়া চেয়ারম্যানের কালো কুৎসিত মেয়ে শোভাকে বিবাহ করিয়াছে। তাও কিনা কোর্টম্যারেজ। আমাদের সাথে যাহাদের ত্রিশ বছর পর্যন্ত মামলা চলিতেছিল তাহাদের মেয়েকে সোহাগ কোন আক্কেলে ঘরে তুলিল? অতীতে মামলায় জিতিয়া ব্যাটা আমাদের বাপ-দাদার সবচেয়ে দামী জমিটা দখল লইয়াছে। আমার সন্দেহ, ঐ পাজীটা সোহাগকে হাত করিয়া ধীরে ধীরে আরো দখল করিবে। মেয়েটির বয়স যদি আঠারোর নীচে হইত, খোদার কসম আমি ওর বাপের নামে মামলা ঠুকিতাম। বেকুব সোহাগ ইহা কী করিল? খাল কাটিয়া কুমির আনিল? আমি স্থির করিয়াছি, তাহাকে পৃথক করিয়া দিব। দরকার হইলে ত্যাজ্যপুত্র বলিয়া ঘোষণা দিব। সে তাহার চেয়ারম্যান শ্বশুরের লেজুড়বৃত্তি নিয়া দিনপাত করুক।    

কিছু জিনিসপত্র আর ওষুধের লিস্ট দিলাম। আসার আগে মনে করিয়া সবগুলি কিনিয়া সুটকেসে ঢুকাইও।

ইতি

তোমার আব্বা

তারিখ ১০. ৬. ১৯৮৬ ইং

পুনশ্চঃ আবারও বলিতেছি, বাৎসরিক ছুটিতে আসিবা। চাকুরি ছাড়িয়া চিরতরে আসিবা না।

২.

দোয়া পর সমাচার এই যে বাবা মিন্টু, চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ তুমি দেশে আসিতেছ জানিয়া খুশি হইলাম। এতদিন যাবৎ এই খবরেরই অপেক্ষা করিতেছিলাম। কারণ পরিবারের অনেক কাজ তোমার জন্য আটকা পড়িয়া রহিয়াছে। তুমি আসার পর সব কাজ এক এক করিয়া সমাধা করা হইবে। তোমার আব্বা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছেন। মনও ভাল না। সোহাগের বিবাহের খবর শোনা মাত্রই অসুখ বাড়িয়া গিয়াছে। এই কথা বিবেচনা করিয়া বসুন্ধরায় পিন্টুর শ্বশুর বাসাতে আসিয়াছি। ভাবিতেছি, জীবনের শেষ কয়টা দিন শহরেই কাটাইব। এইখানে ভাল চিকিৎসা হইবে। গ্রামে থাকিলে কোন প্রকার লাভ হইবে না।

দেশে আসিবার পর  তোমার প্রথম কাজ হইল, বসুন্ধরায় একটি জমি কিনা। মিরপুরে বাসা বানাইবে বলিয়া তোমার সম্বন্ধীর বাসার নিকটে জমি কিনিয়াছ। ইহা কেমন কথা। তাছাড়া বড় বউমা কেনইবা তোমার সম্বন্ধীর বাসায় ভাড়া দিয়া থাকিতেছে ? পিন্টু তোমার আপন ভাই। সে এখানে থাকিতে তুমি মিরপুরে বড়বৌমাকে রাখিতে গেলে কেন? দেশে আসিয়া ঐ জমি বেচিয়া তোমার ভাইদের লইয়া একত্রে থাকিবার নিমিত্তে বসুন্ধরায় বড় বাসা বানাইবা। মিরপুরের তুলনায় বসুন্ধরা অনেক সুন্দর ও উন্নত এলাকা। রাস্তা অনেক বড়। মিরপুরে চিপা গলির মত রাস্তা। সেদিন তো একটু হইলেই একটি গাড়ি আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়া ফেলিয়াছিল। সুতরাং তুমি আসিয়া বসুন্ধরায় তিনভাইর জন্য তিনতলা বাসা তেরি করিবা। পিন্টুর শশুর রড-সিমেন্টের ব্যবসা করেন। তিনি সুযোগ সুবিধা দিতে পারিবেন।

দ্বিতীয় কাজ হইল, বড়বৌমাকে আনিয়া আমাদের কাছেই রাখিবা। আগে আমরা গ্রামে থাকিতাম। তাই মেয়েদের পড়ালেখার অসুবিধার দোহাই দিয়া বড়বৌমা মিরপুরে তাহার ভাইয়ের বাসায় চলিয়া আসিলেন। এখন তো আমরাও শহরে থাকি। অসুবিধা হইবে কেন? মিরপুরে তুমি তাহাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, আবার এখানেও আমাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, ইহাতে ডাবল টাকা খরচ হইতেছে না? একত্রে থাকিলে তো খরচ বাঁচে। এইসব বিবেচনা করিয়া আমি ও তোমার বাবা গত সপ্তাহে গিয়াছিলাম বৌমাকে আনিতে। সে তোমার অনুমতির কথা বলিল। আমরা বাঁচিয়া থাকিতে তোমার আবার কিসের অনুমতি, বুঝিলাম না। মেয়েটি বড়ই চালাক। চিঠিতে আর কিছু লিখিলাম না। তুমি দেশে আসিলে সব বলিব। তুমি আশা মাত্রই তাহাকে এখানে আনিবা। পিন্টুর শশুর বাড়িতে বাবুর্চি আছে। আর বৃদ্ধ বয়সে আমরা বুয়ার হাতের বাজে রান্না খাই। আমাদের এইসব অসুবিধার কথা কি বড়বউমার বুঝা উচিত না? বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ির খেদমত করা তাহার উচিত না? মেজবৌমা নাতাশা ছেলেমানুষ। লেখাপড়া নিয়া সারাদিন বাহিরে থাকে। সে কিভাবে রান্না করিয়া খাওয়াইবে ? ইহাও বড়বৌমার বিবেচনা করা উচিত। ভাইয়ের বাসায় আরামে বসিয়া থাকিলেই চলিবে? সে নাহয় থাকিল। কিন্তু সাফা-মারোয়া? তাহারা তো আমার নাতিন। তাহারা কেন পরের বাসায় থাকিবে? 

এইবার পিন্টুর কথায় আসি। তুমি দেশে আসিয়া তাহার সাথে রাগারাগি করিও না। হাজার দোষ করুক, সে তোমারই মায়ের পেটের ভাই। আমার কড়া হুকুম, মায়ামমতা বজায় রাখিবা। আরেক কথা। যদিও তাহার বিবাহের গহনাসহ যাবতীয় খরচ দিয়াছ তবুও নাতাশাকে এই প্রথমবারের মত দেখিবে। সালামী হিসাবে তাহার জন্য একপদ স্বর্ণালঙ্কার আনিও। শাড়ি আনিও না। আজকালকার মেয়ে শাড়ি টাড়ি পরে না। বিবাহের সময় সোহাগ একটি শাড়ি দিয়াছিল। দামী হইলেও তাহা সে পরে নাই। কাউকে দিয়া দিয়াছে। তাহারা উচু বংশের মানীলোক। নাতাশার মা-বাবার জন্যও কিছু গিফ্ট আনিও। ইহাতে আমাদের কদর বাড়িবে। আর কার কার জন্য কি কি আনিতে হইবে তাহার একটি তালিকা দিলাম। প্রতিটি জিনিস মনে করিয়া আনিও। ভুলিওনা।

ইতি

তোমার আম্মা

পুনশ্চঃ হাসনা আর হেনার চিঠির উত্তর দাও নাই কেন ? তাহারা মনে কষ্ট পাইয়াছে। আসিবার সময় জামাইদের জন্য সু্ট কোট আনিবে। বেয়াইনদের জন্য শাড়ি। পুত্রা-ঝিয়ারিদের জন্য টুকিটাকি যা পার।

তারিখঃ ১০. ৬. ১৯৮৬ ইং

 

৩. 

লিখেছ, আমাদের জন্য কী কী আনতে হবে? ওগো, আমি কী চাই, তুমি কি জান না? দু’বছর ধরে দেশে আসছ না পারিবারিক কলহ এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার চাপে। ত্রিশ তারিখ তুমি আসবে - এটাই পরম পাওয়া। সহিসালামতে চলে এস। ব্যাস, আর কিছু চাই না। তোমার মেয়েরা রোজ দশবার ক্যালেন্ডারের পাতায় ‘ত্রিশ তারিখ’ দেখে। তাদের দিনও যেন ফুরোতে চায়না। তুমি এলে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে সারাক্ষণ তারই পরিকল্পনা। দাম্মামে থাকতে সী-বিচে কত আনন্দ করে বেড়িয়েছে তোমার হাত ধরে। সেই সোনালী দিনগুলো তো আর ফিরে পাবে না। তাই তুমি আসার অপেক্ষা করেই যাচ্ছে। ওদের দাম্মামের বন্ধুদের কয়েকটা ছবি আনতে বলেছে। এলবামে রাখবে। সেই পিচ্ছিরা এতদিনে নিশ্চয় বেশ বড় হয়ে গেছে। আমারও খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ওখানকার ভাবীদের কথাও খুব মনে পড়ে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল দিনগুলো কাটিয়েছি ওখানে। সবাইকে আমার সালাম বলো। 

চিঠির এক কোনায় হাসপাতালে যাবার কথা লিখেছ। সিরিয়াস কোন অসুখ নয়তো? এবারের পাঠানো ছবিতে এত রোগা রোগা লাগছে কেন? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। বছরের পর বছর ওভারটাইমসহ ছুটিহীন খাটুনি দিচ্ছ। আমি পাশে নেই। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে নিশ্চয়। দেশে এসে যদি দু’তিন মাস থাকতে পারতে তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত। জানি তো, প্রবাসজীবনের বিরামহীন কষ্ট মানুষকে সুস্থ্য থাকতে দেয়না। দেখনা, অন্তত দুমাসের ছুটি নিতে পার কিনা।

 গতকাল গ্রামের বাড়ি থেকে সোহাগ এসেছিল নূতন বউ নিয়ে। শোভা খুব লক্ষী মেয়ে। গায়ের রং শ্যামলা। কিন্ত পয়মন্ত চেহারার মধ্যে প্রখর বুদ্ধির ছাপ। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছে। ভাল রেজাল্ট। ওকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বলেছি। তুমি যদি ভাল মনে কর তাহলে মিরপুরে আমার কাছে রেখে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। আমাদের মত করে ওকে গড়ে তুলব। কি বল ? এতে করে বাবা-মার মন থেকে ওদের কোর্টম্যারেজ সংক্রান্ত মনোকষ্ট ধীরে ধীরে ঘুচবে। আমার প্রস্তাবে সোহাগ খুশি হয়েছে। এখন তোমার মতামতের অপেক্ষা।

সেদিন মা এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে। বললেন, আমাকে ওনাদের কাছেই থাকতে হবে। সাফা-মারওয়া  নাকি বসুন্ধরার স্কুলেই পড়বে। ঐ স্কুলে পিন্টুভাইর শালাশালীরা পড়ে। এটা নাকি শহরের সবচেয়ে ভাল স্কুল, ইত্যাদি অনেক যুক্তি। মার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজী হতে আমার বিবেক সায় দেয়নি। প্রথমতঃ বাসার মালিক পিন্টুভাইর শশুর। আমার শশুর নন। তাছাড়া বাসাটা ভাড়া হয়েছে পিন্টুভাইর নামে, তোমার নামে নয়। দ্বিতীয়তঃ যে ভাইকে তুমি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছ, তার কাছ থেকে পেয়েছ অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসঘাতকতা। ওর বাসায় তোমার অনুমতি ছাড়া যাব কেন ? গেলে তুমি কষ্ট পাবে। তাছাড়া সে কি শুধু তোমার মনেই কষ্ট দিয়েছে ? আমার নামেও তো নানারকম অপবাদ দিতে ছাড়েনি। আমিই নাকি ভাইয়ে ভাইয়ে শ্ত্রুতা তৈরি করেছি। সে তো এটুকুও ভাবল না যে, দাম্মামের সুখের সংসার ছেড়ে, সাফা-মারওয়াকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে আমি চলে দেশে এসেছিলাম শুধুমাত্র পয়সা বাঁচাব বলে। আর ঐ বাঁচানো টাকা সঞ্চয় করে তিনভাইর যৌথ ব্যবসার জন্য আইসক্রীম ফ্যাক্টরী আর তিনভাই একসাথে থাকার জন্য বড় একটা বাসা কিনব বলে। ফ্যাক্টরী তো হল। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের উন্নতির জন্য তোমার যে সুদূরপ্রসারী ধ্যানধারণা ছিল তার কী হল? সাফা-মারওয়া, তুমি-আমি এ চারজনের আত্মত্যাগের মূল্য কী এই? 

যাহোক। একদিন সে তার ভুল বুঝবে। ক্ষমা করতে তোমার কষ্ট হবে জানি। তবু পারলে ধীরে ধীরে তাকে ক্ষমা করে দিও। আমি জানি আল্লাহ্ আমাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করবেন। দেশে এসে তার সাথে রাগারাগি করনা। তোমার জন্য দিনরাত দোয়া করছি। ভাল থেকো। সুস্থ্য থেকো। সহিসালামতে পৌঁছাও।

ইতি

একমাত্র তোমারই জান্নাত আরা

তারিখ : ১৫. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চঃ আবার বলছি, কষ্ট করে অযথা এটা সেটা কিনে লাগেজ ভারি করতে যেয়োনা। সব সময়ই তো পাঠাও। কিছুই আনতে হবেনা। তাছাড়া মনে রেখো আমার জন্য আনতে গেলে আরো অনেকের নাম উঠে আসে। দেশে এসে এ নিয়ে অপ্রিয় কথা শুনবে আর কষ্ট পাবে। তোমার এ কষ্ট আমি দেখতে চাই না।    

৪.

বড় ভাইয়া, আমাদের সালাম নিও। গতকাল মিরপুর গিয়েছিলাম আমার মহিয়সী ভাবী আর কলিজার টুকরো দুই ভাতিজীকে দেখতে। শোভার কথা নিশ্চয় শুনেছ। ওকে কীভাবে গ্রহণ করবে এই ভয়ে এতদিন সরাসরি লিখতে সাহস করিনি। বড়ভাবী এই পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি নিজের গহনা পরিয়ে ওকে আশীর্বাদ করে স্বীকৃতি দিলেন। তারপরই না তোমার কাছে চিঠি লিখতে সাহস পেলাম। ভাবীর ¯œহের ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব জানিনা। মাঝে মাঝে তুলনা করে আশ্চর্য হই, আল্লাহ্ কীভাবে যে জোড়া মিলিয়ে দিলেন! বড়ভাবীর মনটা ঠিক তোমার মত। আর ছোটভাবীর মনটা ঠিক ছোটভাইয়ার মত। আব্বা আম্মাতো ধনের জৌলুস দেখে ছোটভাবীকে মাথায় তুলে রেখেছেন। আমার বিশ্বাস, দেরিতে হলেও একদিন খাঁটি সোনা চিনতে পারবেন।

বড়ভাবীর মুখে শুনলাম, এ মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসছ। শুনে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিস্ক নেবার মত ভরসা পাচ্ছি। প্রথমতঃ তোমার উপস্থিতিতে আব্বা আম্মাকে বুঝিয়ে শোভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তোলা।

দ্বিতীয়তঃ আলীগঞ্জ বাজারে লাভজনক একটা একতলা দোকান বিক্রি হচ্ছে। ভবিষ্যতে দোতলা বা তিনতলা করা যাবে। গ্রামে বসেই শহরে ব্যবসা করা যাবে। ওরা সর্বমোট দু’লাখ চায়। অগ্রিম পঞ্চাশ হাজার টাকা আমি আমাদের সমিতি থেকে ধার নিতে পারব। তোমার কাছে বাকি দেড় লাখ টাকা চাইতে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমাকে মাস্টার্স পাশ করাতে তুমি যথেষ্ট অর্থব্যয় করেছ। কিন্তু বৃথা গেল। এসব খোটা দিয়ে আব্বা আম্মা আমাকে হরদম বকাঝকা করেন। তোমার অতি আদরে নাকি আমি বাঁদর হয়েছি। মানুষ হইনি। সব দোষ নাকি তোমার।

কিন্তু ভাইয়া, মানুষ না হলেও অমানুষ তো হইনি। কাদের স্যারের অগ্নিমন্ত্রে আমি দীক্ষিত। গ্রামের সার্বিক কল্যাণের জন্য এখন অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। গ্রামে আমার সুনাম এবং প্রতিপত্তি যথেষ্ট রয়েছে। আমাদের  প্রতিপক্ষ ছিল দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান। শোভার কল্যাণে আজকাল তিনিও পাল্টাতে আরম্ভ করেছেন। শোভাকে বিয়ে করেছি বলে আব্বা তো বলেন, আমি নাকি খালকেটে কুমীর এনেছি। আব্বা আমার পলিটিক্স বুঝবেন কী করে? বুঝেন তো কেবল মামলা-মোকদ্দমা। আমি খাল কেটে কুমীর আনিনি। বরং গ্রাম থেকে কুমীরের রাজত্ব উৎখাত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তদুপরি আমার বাপ-দাদা যা পারেন নি আমি তা পেরেছি। বিগত ত্রিশ বছরের মহাযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে প্রকারান্তরে চেয়ারম্যানকে সারেন্ডার করতে বাধ্য করেছি। জবরদখলকৃত জমি উনি ফিরিয়ে দিতে রাজী। শুধু কি তাই? ইউনিয়নবাসীর উন্নতির দিকেও আজকাল মনোযোগী হয়েছেন। আব্বা আর কী চান? যদি গ্রামের মঙ্গল চান তাহলে আমার প্রতিটি কৌশল বোঝার কথা। পক্ষান্তরে উনি যদি আমাদের পরিবারের বহিরাগত মন্ত্রণাদাতা জনৈক বেয়াইকে (পিন্টুভাইর শ্বশুর) প্রাতঃস্মরণীয় মহাজ্ঞানী মহাজন ভাবেন, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।

যাহোক। যা বলছিলাম, তুমি দেশে এসে দোকানটা দেখবে। পছন্দ হলে তোমার নামেই কিনে ফেলব এবং ব্যবসা আরম্ভ করে বেকারত্ব ঘুচাব। টাকাটা আমি ধার হিসেবেই চাচ্ছি। আমাকে অবিশ্বাস কর না ভাইয়া। আমি তোমার এম. এ পাশ করা পিন্টু নই।

পিন্টুসাহেবের বসুন্ধরার বাসায় গিয়ে আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে এসেছি। শ্বশুরের দেওয়া দামী ফার্নিচারে ঠাসা তার বাসা। এমন কোন জিনিস নেই যা পিন্টুভাইর নিজের টাকায় কেনা। আব্বা আম্মাকে দেখলাম খুব গর্বিত। শোভা মিরপুর আছে জেনেও না জানার ভান করলেন। ওনাদের বকাঝকা তো আমার নিত্যসাথী। এখন আর দুঃখ পাইনা। কিন্তু দুঃখ লাগে, আমাদের যে মাতাপিতা অল্পেতুষ্টি আর সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, সেই মাতাপিতা এখন শহরের জৌলুস আর বিলাসী জীবনের প্রতি ক্রমশ ঝুঁকে পড়েছেন। ওনাদের কামরায় এখন নিজস্ব রঙীন টিভি। বিদেশী চ্যানেলের সিরিয়ালের নেশায় থাকেন বুঁদ। দুনিয়াদারী চাহিদার শেষ নেই। কে তাদেরকে পল্লীবাংলার দিকে ফেরাবে? কে ফেরাবে আখেরাতের চিন্তার দিকে ?

অনেক কিছু লিখলাম। ভুল বুঝো না যেন। আমার ওপর আস্থা রেখো। শোভার সালাম নিও। আমরা ভাল আছি।

ইতি

তোমার ছোটভাই সোহাগ

তারিখ : ২০. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চঃ এয়ারপোর্টে অবশ্যই ভাবী আর সোনামণিদেরকে নিয়ে আমি উপস্থিত থাকব। কোনো চিন্তা কর না।

 

 ৫.

আমি মিন্টু বলছি। আমার কলিগ মাসুদ খান অফিস থেকে ফেরার পথে হাসপাতলে এসে এই চারটা চিঠি দিয়ে গেল। এখনই উত্তর লিখে ফেলা দরকার। কারণ ধূসর সময়টাকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। মহাকাল আমাকে আর বেশি সময় দেবে বলে মনে হচ্ছে না।

চাওয়া মাত্রই নার্স কাগজ-কলম দিয়ে গেল। আলাদা করে সবার চিঠির জবাব দেবার মত সময় বা মন কোনটাই নেই। যতদূর আন্দাজ করছি, আজই আমাকে লাইফ-সাপোর্টে নেওয়া হবে। তাই সময় থাকতে অছিয়ত-নামা লিখে যাচ্ছি। এতেই একত্রে সবার চিঠির জবাব থাকবে।

আমার পুত্রসন্তান নেই বিধায় প্রবাসজীবনের ষোলটি বছরের উপার্জিত স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পদ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক নিম্নলিখিত ওয়ারিশদের নামে বন্টন করে দিচ্ছি। এরপর পৃথিবীতে যেভাবে নিঃস্ব অবস্থায় এসেছিলাম, ঠিক সেভাবেই নিঃস্ব অবস্থায় পরম করূণাময়ের কাছে প্রত্যাবর্তন করব।

ক. মা-বাবা এবং দুই বোন ঃ নদীর পারে যে জমি কিনেছিলাম তা সম্পূর্ণ তাদের নামে যাবে। দেখেশুনে প্রত্যেকে শরীয়ত মোতাবেক বন্টন করে নেবেন। আব্বা-আম্মা তাগিদ দিচ্ছিলেন এ বৎসর ওনাদেরকে হজ্ব করাতে। হজ্ব করানোর মালিক তো আল্লাহ। আমি নই। তাছাড়া হজ্ব করতে হয় নিজস্ব আয় বা সম্পদ থেকেই। সুতরাং উক্ত জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ওনারা এ বৎসর হজ্ব করুন।

খ. দুই ভাইঃ  আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে পিন্টু ফ্যাক্টরীটা নিজের নামে লিখে নিয়েছে। সে তার প্রাপ্য অংশের বেশি পেয়েছে। সুতরাং তার আর পাওনা নেই। আমার স্ত্রীর অনুরোধক্রমে তাকে  আমি ক্ষমা করলাম। কিন্তু কয়েক শর্তে। তার একমাত্র জীবিত ভাই সোহাগকে যেন না ঠকায়। আব্বাআম্মার যেন অযতœ না হয়। তাদের জন্য ভাল একটা বাবুর্চি যেন রেখে দেয়। আমবাগান, লিচুবাগানের ফল আর জমির ফসল বিক্রির সব টাকা যেন ওনাদের হাতেই তুলে দেয়। আর বোনদের হক যেন আদায় করে। অর্থাৎ পৈত্রিক সম্পদের অংশ প্রদান করা, খোঁজখবর নেওয়া, মাঝেমাঝে নাইওর আনা, সামাজিকতা লৌকিকতা বজায় রাখা ইত্যাদি।

দাম্মামে আমার গাড়ি এবং ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা আমার বন্ধু মাসুদ খানের তদারকিতে থাকবে। উক্ত টাকা সোহাগের জন্য রইল। সে তার ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়ে বাকি টাকা দিয়ে শোভার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে এবং ওদের রিসিপশনের অনুষ্ঠানে ব্যয় করবে। খোদার হুকুমেই তো ওদের বিয়ে হয়েছে। এ হুকুম বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে আব্বাআম্মা যেন তাদেরকে সমাদরে গ্রহণ করেন এবং চেয়ারম্যানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। তিনি তো গ্রামসম্পর্কে আব্বারই জ্ঞাতিভাই। সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানেই মঙ্গল। 

গ. আমার স্ত্রী এবং জমজ কন্যাঃ  আমার মৃত্যুর পর কোম্পানী থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে তা এবং সোনালী ব্যাংকে যৎসামান্য যা আছে তা সম্পূর্ণ তাদের। মিরপুরে আমার স্ত্রীর নামে কেনা একটুকরো জমি আছে। এ টাকায় তেতলা বাড়ি হবে। দোতলায় ওরা থাকবে এবং বাকি অংশ ভাড়া দিয়ে দিন গোজরান করবে। তাদের হেফাজতের ভার আল্লাহ তা’লার ওপর রইল। আমার সম্বন্ধীর কাছে অনুরোধ রইল তিনি যেন তাদেরকে তার কাছাকছিই রাখেন। আরেকটা কথা বিশেষভাবে বলছি, আমার মেয়েরা যেন তাদের দাদাবাড়ির অধিকার ও স্নেহমমতা থেকে বঞ্চিত না হয়।

রণক্লান্ত হাতখানি অবশ হয়ে আসছে। আর লিখতে পারছি না। ত্রিশ তারিখ দেশে যাবার জন্য বিমানের টিকিট নেবার পরদিন থেকে হাসপাতালে পড়ে আছি। বন্ধুরা সান্তনা দেয় ভাল হয়ে যাব বলে। ডাক্তারও পেশাসুলভ পজিটিভ অভিব্যক্তি দেখায়। কিন্তু আমি জানি বাংলাদেশ বিমান আমাকে কি অবস্থায় স্বদেশে দেশে নিয়ে যাবে। দাম্মামের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ: আমার চলিত মাসের বেতন থেকে যেন হাসপাতালের পাওনা মেটানো হয়। আমাকে যেন শোয়ানো হয় গ্রামের বাড়ির শ্যামল মাটিতে। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।

ইতি

হতভাগ্য মিন্টু

তারিখ : ২৬. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চ ঃ বন্ধু মাসুদ, প্রতিদিন তুমি এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছ। তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে আরো একটি অনুরোধ করছি। আমার এ চিঠি ফটোকপি করে রেখো। মূলকপি যাবে তোমার ভাবীর কাছে। আর সাত কপি যাবে আমার মা বাবা, দুইভাই আর দুইবোন আর আমার সমন্ধীর কাছে। অপর পৃষ্ঠায় ঠিকানা দেওয়া আছে। বিদায়।

রচনাঃ ১৯৮৯ জেদ্দা

১.

দোয়া পর সমাচার এই বাবা মিন্টু, তুমি চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসিতেছ জানিয়া যার পর নাই খুশি হইলাম। দোয়া করি সহি সালামতে পৌঁছাও।

লিখিয়াছ, বিদেশের এত বছরের ঘানিটানা খাটুনি আর শরীরে কুলায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়াছ যে, একেবারে চলিয়া আসিবা। আর দীর্ঘ ষোল বছরে যাহা সঞ্চয় করিয়াছ তাহা দিয়া দেশে আসিয়া ব্যবসা করিবা। কিন্তু আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত যথাযথ নহে। আরো দুই তিন বছর থাকিয়া হাতে অন্তত এক কোটি টাকা লইয়া দেশে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। নতুবা ব্যবসা করিবা কি দিয়া? আজকাল গাঁওগেরামে একটা পানের দোকান দিয়ে ব্যবসা করিতেও পঞ্চাশ হাজার লাগে। তুমি অবশ্য পানের ব্যবসা করিবে না। ইহা একটি কথার কথা। তোমার বুঝার সুবিধার্থে লিখিলাম আর কি।

এদিকে আমার আর তোমার মায়ের হজ্ব বাকি। এতদিন তুমি যুক্তি দেখাইয়াছ যে, হাসনা ও হেনার বিবাহ দেওয়া আমার পয়লা নম্বর ফরয কাজ। এখন তো এই পয়লা নম্বর ফরয কাজ আদায় হইয়া গিয়াছে। মামলা-মোকাদ্দমার ঝামেলাও শেষ। এই বৎসর হজ্ব না করিলে সমাজে মুখ তো রক্ষা হয় না। পিন্টুর শ্বশুর ম্যানপাওয়ারের ব্যবসা করেন। তিনি তো সপরিবারে তিনবার হজ্ব করিয়া ফেলিলেন। তিনি এবং পাড়াপড়শী সকলেই বলে, ‘আপনার ছেলে সৌদীতে থাকে অথচ আজ পর্যন্ত হজ্ব করিলেন না?’ কথা তো ঠিকই। সুতরাং আমি ইরাদা করিয়াছি এই বৎসর হজ্বে যাইব। তাই তোমার উক্ত সিদ্ধান্ত পরিহার কর। তবে অবশ্যই অন্যবারের মত ছুটিতে আসিবা। দেশের আবহাওয়া এখন খুব গরম। ফ্যানের বাতাসে কুলায় না। আসার সময় অন্তত একটা এসি নিয়া আসিবা। পিন্টুর শ্বশুরের বাসায় তিনটি আছে। তিনি তাহার কন্যা নাতাশার কামরার জন্য একটি দান করিয়াছেন। একই ফ্ল্যাটে থাকি, অথচ আমার নিজের কামরায় এসি নাই। বড়ই সংকোচ লাগে। মুগদাপাড়ার কুদ্দুসভাইর ছেলে তাহার বৃদ্ধ মাতাপিতার জন্য দুইটা এসি পাঠাইয়াছে। ড্রয়িংরুমের জন্য একটা ইরানী কার্পেটও পাঠাইয়াছে। দেখিলে চক্ষু জুড়ায়। মাতাপিতার সেবায় তাহার জুড়ি নাই দেখিয়া আমার মনও জুড়ায় বৈকি।

বিদেশে যাহারাই গেল তাহারাই শহরে একটি বাসা বানাইয়া ফেলিল। কেবল তোমারই বাসা হয় নাই। এইবারে আসিয়া বড় একটি বাসা বানাইবার ব্যবস্থা করিবা। বাসাভাড়া দিতে দিতে আমার পিন্টুর সর্বস্বান্ত অবস্থা। শহরে একটা বাসা হইলে তোমরা সকল ভাইবোন মিলিয়া মিশিয়া নিশ্চিন্তে থাকিবার ব্যবস্থা হইবে। টাকাও বাঁচিবে। বাবা, একটি কথা। তোমার পাঠানো টাকায় পিন্টু আইসক্রীম ফ্যাক্টরীটা তাহার নিজের নামে খরিদ করিয়াছে বলিয়া অনেক রাগ করিয়াছ। তাহাকে অনেক গালাগালি করিয়াছ। চিঠিপত্র লিখা বন্ধ করিয়াছ। পরের ঘর হইতে আসা মেয়েলোকের কথায় কেন তুমি স্ত্রৈন হইয়া গেলে?  ইহা সমীচীন নহে। সে তোমারই তো ভাই। তোমার টাকা, তাহার টাকা সমান নহে কি? আল্লাহ্ তোমাকে পিন্টুর চাইতে বেশি ভাগ্যবান করিয়া দুনিয়ায় পাঠাইয়াছেন। তুমি জীবনে যে কাজে হাত দিয়াছ সেই কাজেই সফল হইয়াছ। ইচ্ছা করিলেই তুমি ভবিষ্যতে এর চেয়ে বড় ফ্যাক্টরীর মালিক হইতে পারিবা। কিন্তু পিন্টু পারিবেনা। তাহার সেই তকদিরও নাই, ঘিলুও নাই। এইসব বিবেচনা করিয়া তোমাকে নির্দেশ দিতেছি, দেশে আসিয়া তাহার সাথে মন কষাকষি করিও না। আমার নূতন বৌমা নাতাশা কিংবা বেয়াই সাহেব শুনিলে কী বলিবেন? আমার মানসম্মানের কথা বিবেচনা করিও। এই ফ্যাক্টরী দেখিয়াই তো বেয়াই সাহেব তাহার মেয়েকে পিন্টুর কাছে বিবাহ দিলেন,নচেৎ পিন্টুর মত বেকার ছেলেকে কে পাত্তা দিত? শহরে এত বড়লোকের সাথে কি আজ কুটুম্বিতা করিতে পারিতাম ?

শহরে আসার পর হইতে আমার শরীর-মন ভাল যাইতেছে না। হয়ত জানিয়াছ যে, গ্রামে আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়া তোমার অতি সোহাগের ছোটভাই সোহাগ সাহেব আমার মান সম্মানের মাথা খাইয়া চেয়ারম্যানের কালো কুৎসিত মেয়ে শোভাকে বিবাহ করিয়াছে। তাও কিনা কোর্টম্যারেজ। আমাদের সাথে যাহাদের ত্রিশ বছর পর্যন্ত মামলা চলিতেছিল তাহাদের মেয়েকে সোহাগ কোন্‌ আক্কেলে ঘরে তুলিল? অতীতে মামলায় জিতিয়া ব্যাটা আমাদের বাপ-দাদার সবচেয়ে দামী জমিটা দখল লইয়াছে। আমার সন্দেহ, ঐ পাজীটা সোহাগকে হাত করিয়া ধীরে ধীরে আরো দখল করিবে। মেয়েটির বয়স যদি আঠারোর নীচে হইত, খোদার কসম আমি ওর বাপের নামে মামলা ঠুকিতাম। বেকুব সোহাগ ইহা কী করিল? খাল কাটিয়া কুমির আনিল? আমি স্থির করিয়াছি, তাহাকে পৃথক করিয়া দিব। দরকার হইলে ত্যাজ্যপুত্র বলিয়া ঘোষণা দিব। সে তাহার চেয়ারম্যান শ্বশুরের লেজুড়বৃত্তি নিয়া দিনানিপাত করুক।   

কিছু জিনিসপত্র আর ওষুধের লিস্ট দিলাম। আসার আগে মনে করিয়া সবগুলি কিনিয়া সুটকেসে ঢুকাইও।

ইতি

তোমার আব্বা।

২২. ৬. ১৯৮৬ ইং

পুনশ্চ: আবারও বলিতেছি, বাৎসরিক ছুটিতে আসিবা। চাকুরি ছাড়িয়া চিরতরে আসিবা না।

 

২.

দোয়া পর সমাচার এই যে বাবা মিনটু, চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ তুমি দেশে আসিতেছ জানিয়া খুশি হইলাম। এতদিন যাবৎ এই খবরেরই অপেক্ষা করিতেছিলাম। কারণ পরিবারের অনেক কাজ তোমার জন্য আটকা পড়িয়া রহিয়াছে। তুমি আসার পর সব কাজ এক এক করিয়া সমাধা করা হইবে। তোমার আব্বা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছেন। মনও ভাল না। সোহাগের বিবাহের খবর শোনা মাত্রই অসুখ বাড়িয়া গিয়াছে। এই কথা বিবেচনা করিয়া বসুন্ধরায় পিনটুর বাসাতে আসিয়াছি। ভাবিতেছি, জীবনের শেষ কয়টা দিন শহরেই কাটাইব। এইখানে ভাল চিকিৎসা হইবে। গেরামে থাকিয়া কোন প্রকার লাভ হইবে না।

দেশে আসিয়া তোমার প্রথম কাজ হইল, বসুন্ধরায় একটি জমি কেনা। মিরপুরে বাসা বানাইবে বলিয়া তোমার সমন্ধীর বাসার নিকটে জমি কিনিয়াছ। ইহা কেমন কথা ? তাছাড়া বড় বউমা কেনইবা তোমার সমন্ধীর বাসায় ভাড়া দিয়া থাকিতেছে ? পিনটু তোমার আপন ভাই। সে এখানে থাকিতে তুমি মীরপুরেইবা বড়বৌমাকে রাখিতে গেলে কেন? দেশে আসিয়া ঐ জমি বেচিয়া তোমার ভাইদের লইয়া একত্রে থাকিবার নিমিত্তে বসুন্ধরা বড় বাসা বানাইবা। মিরপুরের তুলনায় বসুন্ধরা অনেক উন্নত। রাস্তা অনেক বড়। খোলামেলা জায়গা। মিরপুরে চিপা গলির মত রাস্তা। সেদিন তো একটু হইলেই একটি গাড়ি আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়া ফেলিয়াছিল। সুতরাং তুমি আসিয়া বসুন্দরায় তিনভাইর জন্য তিনতলা বাসা তেরি করিবা। পিন্টুর শশুর রড-সিমেনটের সুবিধা দিতে পারিবেন।

দ্বিতীয় কাজ হইল, বড়বৌমাকে আনিয়া আমাদের কাছেই রাখিবা। আগে আমরা গ্রামে থাকিতাম। তাই মেয়েদের পড়ালেখার অসুবিধার দোহাই দিয়া বড়বৌমা মীরপুরে তাহার ভাইয়ের বাসায় চলিয়া আসিলেন। এখন তো আমরাও শহরে থাকি। অসুবিধা হইবে কেন? মীরপুরে তুমি তাহাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, আবার এখানেও আমাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, ইহাতে ডাবল টাকা খরচ হইতেছে না? একত্রে থাকিলে তো খরচ বাঁচে। এইসব বিবেচনা করিয়া আমি ও তোমার বাবা গত সপ্তাহে গিয়াছিলাম বৌমাকে আনিতে। সে তোমার অনুমতির কথা বলিল। আমরা বাঁচিয়া থাকিতে তোমার আবার কিসের অনুমতি, বুঝিলাম না। মেয়েটি বড়ই চালাক। চিঠিতে আর কিছু লিখিলাম না। তুমি দেশে আসিলে সব বলিব। তুমি আসা মাত্রই তাহাকে এখানে আনিবা। পিনটুর শশুরের বাসায় বাবুরচি আছে। আর আমরা বৃদ্ধ বয়সে বুয়ার রান্না খাই। আমাদের এইসব অসুবিধার কথা কি বড়বউমার বুঝা উচিত না? বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ির খেদমত করা তাহার উচিত না? মেজবৌমা নাতাশা ছেলেমানুষ। লেখাপড়া নিয়া সারাদিন বাহিরে থাকে। রান্না করিয়া খাওয়াইবে কিভাবে ? ইহাও বড়বৌমার বিবেচনা করা উচিত। ভাইয়ের বাসায় আরামে বসিয়া থাকিলেই চলিবে? সে নাহয় থাকিল। কিন্তু সাফা-মারোয়া? তাহারা তো আমার নাতিন। তাহারা কেন পরের বাসায় থাকিবে? 

এইবার পিনটুর কথায় আসি। তুমি দেশে আসিয়া তাহার সাথে রাগারাগি করিও না। হাজার দোষ করুক, সে তোমারই মায়ের পেটের ভাই। আমার কড়া হুকুম, মায়ামমতা বজায় রাখিবা। আরেক কথা। যদিও তাহার বিবাহের গহনাসহ যাবতীয় খরচ দিয়াছ তবুও নাতাশাকে এই প্রথমবারের মত দেখিবে। সালামী হিসাবে তাহার জন্য একপদ স্বর্ণালঙ্কার আনিও। শাড়ি আনিও না। আজকালকার মেয়ে শাড়িটাড়ি পরে না। বিবাহের সময় সোহাগ একটি শাড়ি দিয়াছিল। দামী হইলেও তাহা সে পরে নাই। কাউকে দিয়া দিয়াছে। তাহারা উচু বংশের মানীলোক। নাতাশার মা-বাবার জন্যও কিছু গিফট্‌ আনিও। ইহাতে আমাদের সম্মান বাড়িবে। আর কার কার জন্য কি কি আনিতে হইবে তাহার একটি তালিকা দিলাম। প্রতিটি জিনিস মনে করিয়া আনিও।

ইতি

তোমার আম্মা

তারিখ: ২২. ৬. ১৯৮৬ ইং

পুনশ্চ: হাসনা আর হেনার চিঠির উত্তর দাও নাই কেন ? তাহারা মনে কষ্ট পাইয়াছে। আসিবার সময় জামাইদের জন্য সুট কোট আনিবে। বেয়াইনদের জন্য শাড়ি। পুত্রা-ঝিয়ারিদের জন্য টুকিটাকি যা পার।

 

৩. 

লিখেছ, আমাদের জন্য কী কী আনতে হবে? ওগো, আমি কী চাই, তুমি কি জান না? দু’বছর ধরে দেশে আসছ না পারিবারিক কলহ এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার চাপে। তুমি আসবে - এটাই পরম পাওয়া। সহি সালামতে চলে এস। ব্যাস, আর কিছু চাই না। তোমার মেয়েরা রোজ দশবার ক্যালেন্ডারের পাতায় আগামী মাসের ‘ত্রিশ তারিখ’ দেখে। তাদের দিনও যেন ফুরোতে চায়না। তুমি এলে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে সারাক্ষণ তারই পরিকল্পনা। দাম্মামে থাকতে সী-বিচে কত আনন্দ করে বেড়িয়েছে তোমার হাত ধরে। সেই সোনালী দিনগুলো তো আর ফিরে পাবে না। তাই তুমি আসার অপেক্ষা করেই যাচ্ছে। ওদের দাম্মামের বন্ধুদের কয়েকটা ছবি আনতে বলেছে। এলবামে রাখবে। সেই পিচ্ছিরা এতদিনে নিশ্চয় বেশ বড় হয়ে গেছে। আমারও খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ওখানকার ভাবীদের কথাও খুব মনে পড়ে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল দিনগুলো কাটিয়েছি ওখানে। সবাইকে আমার সালাম বলো। 

চিঠির এক কোনায় হাসপাতালে যাবার কথা লিখেছ। সিরিয়াস কোন অসুখ নয়তো? এবারের পাঠানো ছবিতে এত রোগা রোগা লাগছে কেন? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। বছরের পর বছর ওভারটাইমসহ ছুটিহীন খাটুনি দিচ্ছ। আমি পাশে নেই। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে নিশ্চয়। দেশে এসে যদি দু’তিন মাস থাকতে পারতে তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত। জানি তো, প্রবাসজীবনের বিরামহীন কষ্ট মানুষকে সুস্থ্য থাকতে দেয়না। দেখনা, অন্তত দুমাসের ছুটি নিতে পার কিনা।

 গতকাল গ্রামের বাড়ি থেকে সোহাগ এসেছিল নূতন বউ নিয়ে। শোভা খুব লক্ষী মেয়ে। গায়ের রং শ্যামলা। কিন্ত পয়মন্ত চেহারার মধ্যে প্রখর বুদ্ধির ছাপ। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছে। ভাল রেজাল্ট। ওকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বলেছি। তুমি যদি ভাল মনে কর তাহলে মীরপুরে আমার কাছে রেখে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। আমাদের মত করে ওকে গড়ে তুলব। কি বল ? এতে করে বাবা-মার মন থেকে ওদের কোর্টম্যারেজ সংক্রান্ত মনোকষ্ট ধীরে ধীরে ঘুচবে। আমার প্রস্তাবে সোহাগ খুশি হয়েছে। এখন তোমার মতামতের অপেক্ষা।

সেদিন মা এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে। বললেন, আমাকে ওনাদের কাছেই থাকতে হবে। সাফা-মারওয়া নাকি ওখানকার স্কুলেই ভর্তি হবে। বললেন, ঐ স্কুলে পিন্টুভাইর শালাশালীরা পড়ে। এটা নাকি শহরের সবচেয়ে ভাল স্কুল, ইত্যাদি। মার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজী হতে আমার বিবেক সায় দেয়নি। প্রথমত: বাসাটা ভাড়া হয়েছে পিন্টুভাইর নামে, তোমার নামে নয়। দ্বিতীয়ত: যে ভাইকে তুমি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছ, তার কাছ থেকে পেয়েছ অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসঘাতকতা। ওর বাসায় তোমার অনুমতি ছাড়া যাব কেন ? গেলে তুমি কষ্ট পাবে। তাছাড়া সে কি শুধু তোমার মনেই কষ্ট দিয়েছে ? আমার নামেও তো নানারকম অপবাদ দিতে ছাড়েনি। আমিই নাকি ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা তৈরি করেছি। সে তো এটুকুও ভাবল না যে, দাম্মামের সুখের সংসার ছেড়ে, সাফা-মারওয়াকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে আমি চলে দেশে এসেছিলাম শুধুমাত্র পয়সা বাঁচাব বলে। আর ঐ বাঁচানো টাকা সঞ্চয় করে তিনভাইর যৌথ ব্যবসার জন্য আইসক্রীম ফ্যাক্টরী আর একসাথে থাকার জন্য বড় একটা বাসা কিনব বলে। ফ্যাক্টরী তো হল। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের উন্নতির জন্য তোমার যে সুদূরপ্রসারী ধ্যানধারণা ছিল তার কী হল? সাফা-মারওয়া, তুমি-আমি এ চারজনের আত্মত্যাগের মূল্য কী এই? 

যাহোক। একদিন সে তার ভুল বুঝবে। ক্ষমা করতে তোমার কষ্ট হবে জানি। তবু পারলে ধীরে ধীরে তাকে ক্ষমা করে দিও। আমি জানি অল্লাহ্ আমাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করবেন। দেশে এসে তার সাথে রাগারাগি করনা। তোমার জন্য দিনরাত দোয়া করছি। ভাল থেকো। সুস্থ্য থেকো। সহিসালামতে পৌঁছাও।

ইতি

একমাত্র তোমারই জান্নাত

তারিখ : ২৩.৬. ১৯৮৬

পুনশ্চ: আবার বলছি, কষ্ট করে অযথা এটা সেটা কিনে লাগেজ ভারি করতে যেয়োনা। সব সময়ই তো পাঠাও। কিছুই আনতে হবেনা। তাছাড়া মনে রেখো আমার জন্য আনতে গেলে আরো অনেকের নাম উঠে আসে। দেশে এসে এ নিয়ে অপ্রিয় কথা শুনবে আর কষ্ট পাবে। তোমার এ কষ্ট আমি চাই না।  

 

৪.

বড় ভাইয়া, আমাদের সালাম নিও। গতকাল মীরপুর গিয়েছিলাম আমার মহিয়সী ভাবী আর কলিজার টুকরো দুই ভাতিজীকে দেখতে। শোভার কথা নিশ্চয় শুনেছ। ওকে কীভাবে গ্রহণ করবে এই ভয়ে এতদিন সরাসরি লিখতে সাহস করিনি। বড়ভাবী এই পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি নিজের গহনা পরিয়ে ওকে আশীর্বাদ করে স্বীকৃতি দিলেন। তারপরই না তোমার কাছে চিঠি লিখতে সাহস পেলাম। ভাবীর স্নেহের ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব জানিনা। মাঝে মাঝে তুলনা করে আশ্চর্য হই, কীভাবে যে জোড়া মিলে যায়। বড়ভাবীর মনটা ঠিক তোমার মত। আর ছোটভাবীর মনটা ঠিক ছোটভাইয়ার মত। আব্বা আম্মাতো ধনের জৌলুস দেখে তাকে মাথায় তুলে রেখেছেন। আমার বিশ্বাস, দেরিতে হলেও একদিন খাঁটি সোনা চিনতে পারবেন।

বড়ভাবীর মুখে শুনলাম, এ মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসছ। শুনে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিস্ক নেবার মত ভরসা পাচ্ছি। প্রথমতঃ তোমার উপস্থিতিতে আব্বা আম্মাকে বুঝিয়ে শোভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তোলা।

দ্বিতীয়তঃ আলীগঞ্জ বাজারে লাভজনক একটা একতলা দোকান বিক্রি হচ্ছে। ভবিষ্যতে দোতলা বা তিনতলা করা যাবে। গ্রামে বসেই শহরে ব্যবসা করা যাবে। ওরা সর্বমোট দু’লাখ চায়। অগ্রিম পঞ্চাশ হাজার টাকা আমি আমাদের সমিতি থেকে ধার নিতে পারব। তোমার কাছে বাকি দেড় লাখ টাকা চাইতে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমাকে মাস্টার্স পাশ করাতে তুমি যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করেছ। বৃথা গেল এই খোটা দিয়ে আব্বা আম্মা আমাকে হরদম বকাঝকা করেন। তোমার অতি আদরে নাকি আমি বাঁদর হয়েছি। মানুষ হইনি। সব দোষ নাকি তোমার।

কিন্তু ভাইয়া, মানুষ না হলেও অমানুষ তো হইনি। কাদের স্যারের অগ্নিমন্ত্রে আমি দীক্ষিত। গ্রামের সার্বিক কল্যাণের জন্য এখন অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। গ্রামে আমার সুনাম এবং প্রতিপত্তি যথেষ্ট রয়েছে। আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান। শোভার কল্যাণে আজকাল তিনিও পাল্টাতে আরম্ভ করেছেন। শোভাকে বিয়ে করেছি বলে আব্বা তো বলেন, আমি নাকি খাল কেটে কুমীর এনেছি। আব্বা অত পলিটিক্স বুঝবেন কী করে? বুঝেন তো কেবল মামলা-মোকদ্দমা। আমি খাল কেটে কুমীর আনিনি। বরং গ্রাম থেকে কুমীরের রাজত্ব উৎখাত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তদুপরি আমার বাপ-দাদা যা পারেননি আমি তা পেরেছি। বিগত ত্রিশ বছরের মহাযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে প্রকারান্তরে চেয়ারম্যানকে সারেন্ডার করতে বাধ্য করেছি। জবরদখলকৃত জমি উনি ফিরিয়ে দিতে রাজী। শুধু কি তাই? ইউনিয়নবাসীর উন্নতির দিকেও আজকাল মনোযোগী হয়েছেন। আব্বা আর কী চান? যদি গ্রামের মঙ্গল চান তাহলে আমার প্রতিটি কৌশল বোঝার কথা। পক্ষান্তরে উনি যদি আমাদের পরিবারের বহিরাগত মন্ত্রণাদাতা জনৈক বেয়াইকে (পিন্টুভাইর শ্বশুর) প্রাতঃস্মরণীয় মহাজ্ঞানী মহাজন ভাবেন, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।

যাহোক। যা বলছিলাম, তুমি দেশে এসে দোকানটা দেখবে। পছন্দ হলে তোমার নামেই কিনে ফেলব এবং ব্যবসা আরম্ভ করে বেকারত্ব ঘুচাব। টাকাটা আমি ধার হিসেবেই চাচ্ছি। আমাকে অবিশ্বাস কর না ভাইয়া। আমি তোমার এম. এ পাশ করা পিন্টু নই।

পিন্টুসাহেবের বসুন্ধরার বাসায় গিয়ে আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে এসেছি। শ্বশুরের দেওয়া দামী ফার্নিচারে ঠাসা তার বাসা। এমন কোন জিনিস নেই যা পিন্টুভাইর নিজের কেনা। আব্বা আম্মাকে দেখলাম খুব গর্বিত। শোভা মীরপুর আছে জেনেও না জানার ভান করলেন। ওনাদের বকাঝকা তো আমার নিত্যসাথী। এখন আর দুঃখ পাইনা। কিন্তু দুঃখ লাগে, আমাদের যে মাতাপিতা অল্পেতুষ্টি আর সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, সেই মাতাপিতা এখন শহরের জৌলুস আর বিলাসী জীবনের প্রতি ক্রমশ ঝুঁকে পড়েছেন। ওনাদের কামরায় এখন নিজস্ব রঙীন টিভি। বিদেশী চ্যানেলের সিরিয়ালের নেশায় থাকেন বুঁদ। দুনিয়াদারী চাহিদার শেষ নেই। কে তাদেরকে পল্লীবাংলার দিকে ফেরাবে? কে ফেরাবে আখেরাতের চিন্তার দিকে ?

অনেক কিছু লিখলাম। ভুল বুঝো না যেন। আমার ওপর আস্থা রেখো। শোভার সালাম নিও। আমরা ভাল আছি।

ইতি

তোমার ছোটভাই সোহাগ

তারিখ : ২৪. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চ: এয়ারপোর্টে অবশ্যই ভাবী আর সোনামণিদেরকে নিয়ে আমি উপস্থিত থাকব। কোন চিন্তা কর না।

 

 ৫.

আমার কলিগ মাসুদ খান অফিস থেকে ফেরার পথে হাসপাতলে এসে এই চারটা চিঠি দিয়ে গেল। এখনই উত্তর লিখে ফেলা দরকার। কারণ ধূসর সময়টাকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। মহাকাল আমাকে আর বেশি সময় দেবে বলে মনে হচ্ছে না।

চাওয়া মাত্রই নার্স কাগজ-কলম দিয়ে গেল। আলাদা করে সবার চিঠির জবাব দেবার মত সময় বা মন কোনটাই নেই। যতদূর আন্দাজ করছি, শীঘ্রই আমাকে লাইফ-সাপোর্টে নেওয়া হবে। তাই সময় থাকতে অছিয়ত-নামা লিখে যাচ্ছি। এতেই একত্রে সবার চিঠির জবাব থাকবে।

আমার পুত্র সন্তান নেই বিধায় প্রবাসজীবনের ষোলটি বছরের উপার্জিত স্থাবর অস্থাবর যৎসামান্য সম্পদ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক নিম্নলিখিত ওয়ারিশদের নামে বন্টন করে দিচ্ছি। এরপর পৃথিবীতে যেভাবে নিঃস্ব অবস্থায় এসেছিলাম, ঠিক সেভাবেই নিঃস্ব অবস্থায় পরম করূণাময়ের কাছে প্রত্যাবর্তন করব।

 

ক. মা-বাবা এবং দুই বোন: নদীর পারে যে জমি কিনেছিলাম তা সম্পূর্ণ তাদের নামে যাবে। দেখেশুনে প্রত্যেকে শরীয়ত মোতাবেক বন্টন করে নেবেন। আব্বা-আম্মা তাগিদ দিচ্ছিলেন ওনাদেরকে হজ্ব করাতে। হজ্ব করানোর মালিক তো আল্লাহ। আমি নই। আর হজ্ব করতে হয় নিজস্ব সম্পদ থেকেই। সুতরাং উক্ত জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ওনারা এ বৎসর হজ্ব করবেন।      

খ. দুই ভাইঃ  আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে পিন্টু ফ্যাক্টরীটা নিজের নামে লিখে নিয়েছে। সে তার প্রাপ্য অংশের বেশি পেয়েছে। সুতরাং তার আর পাওনা নেই। আমার স্ত্রীর অনুরোধক্রমে তাকে আমি ক্ষমা করলাম। কিন্তু কয়েক শর্তে। তার একমাত্র জীবিত ভাই সোহাগকে যেন না ঠকায়। আব্বা আম্মার যেন অযত্ন না হয়। তাদের জন্য ভাল একটা বাবুর্চি যেন রেখে দেয়। আমবাগান, লিচুবাগানের ফল আর জমির ফসল বিক্রির সব টাকা যেন ওনাদের হাতেই তুলে দেয়।আর বোনদের হক যেন আদায় করে। অর্থাৎ পৈত্রিক সম্পদের অংশ প্রদান করা, খোঁজখবর নেওয়া, মাঝেমাঝে নাইওর আনা, সামাজিকতা লৌকিকতা বজায় রাখা ইত্যাদি।

দাম্মামে আমার গাড়ি এবং ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা আমার বন্ধু মাসুদ খানের তদারকিতে থাকবে। উক্ত টাকা সোহাগের জন্য রইল। সে তার ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়ে বাকি টাকা দিয়ে শোভার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে এবং ওদের রিসিপশনের অনুষ্ঠানে ব্যয় করবে। খোদার হুকুমেই তো ওদের বিয়ে হয়েছে। এ হুকুম বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে আব্বা আম্মা যেন তাদেরকে সমাদরে গ্রহণ করেন এবং চেয়ারম্যানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। তিনি তো গ্রামসম্পর্কে আব্বারই জ্ঞাতিভাই। সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানেই মঙ্গল।

 

গ. আমার স্ত্রী এবং জমজ কন্যাঃ আমার মৃত্যুর পর কোম্পানী থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে তা এবং সোনালী ব্যাংকে যৎসামান্য যা আছে তা সম্পূর্ণ তাদের। মীরপুরে আমার স্ত্রীর নামে কেনা একটুকরো জমি আছে। এ টাকায় তেতলা বাড়ি হবে। দোতলায় ওরা থাকবে এবং বাকি অংশ ভাড়া দিয়ে দিন গোজরান করবে। তাদের হেফাজতের ভার আল্লাহতা’লার ওপর রইল। আমার সম্বন্ধীর কাছে অনুরোধ রইল তিনি যেন তাদেরকে তার কাছাকাছিই রাখেন। আরেকটা কথা বিশেষভাবে বলছি, আমার মেয়েরা যেন তাদের দাদাবাড়ির অধিকার ও স্নেহমমতা থেকে বঞ্চিত না হয়।

রণক্লান্ত হাতখানি অবশ হয়ে আসছে। আর লিখতে পারছি না। ত্রিশ তারিখ দেশে যাবার জন্য বিমানের টিকিট নেবার পরদিন থেকে হাসপাতালে পড়ে আছি। বন্ধুরা সান্তনা দেয় ভাল হয়ে যাব বলে। ডাক্তারও পেশাসুলভ পজিটিভ অভিব্যক্তি দেখায়। কিন্তু আমি জানি বাংলাদেশ বিমান আমাকে কী অবস্থায় স্বদেশে দেশে নিয়ে যাবে। দাম্মামের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ: আমার চলিত মাসের বেতন থেকে যেন হাসপাতালের পাওনা মেটানো হয়। আমাকে যেন শোয়ানো হয় গ্রামের বাড়ির শ্যামল মাটিতে। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।

ইতি

একজন হতভাগ্য মিন্টু

তারিখ : ২৬. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চঃ বন্ধু মাসুদ, প্রতিদিন তুমি এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছ। তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে আরো একটি অনুরোধ করছি। আমার এ চিঠি ফটোকপি করে রেখো। মূলকপি যাবে তোমার ভাবীর কাছে। আর সাত কপি যাবে আমার মা বাবা, দুইভাই আর দুইবোন আর আমার সমন্ধীর কাছে। অপর পৃষ্ঠায় ঠিকানা দেওয়া আছে। বিদায়।

--------------------------

Wednesday, July 17, 2019

আমার স্বর্গের প্রতিপক্ষ (ছোটগল্প)



 
আমার স্বর্গের প্রতিপক্ষ
- গুলশান চৌধুরী


জায়গাটির নাম কে কবে নিমতলী বাজার রেখেছিল কে জানে? বাজারটা মক্কা রোডের নাজলা এলাকার পুরোনো অংশে। ১৯৭৬ সালে জেদ্দায় বাংলাদেশ দূতাবাস হবার পর খুব দ্রুত বাঙালী জনপদ গড়ে ওঠে এখানে। প্রবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য গড়ে ওঠেছিল বাংলাদেশ দূতাবাস হাইস্কুল। যার কারণে মক্কা, মদীনা, তায়েফ, আভা, বাহা এসব শহরের তুলনায় এখানে বাঙালীদের বসতি ঘনতম। জেদ্দার মরুতপ্ত রাজপথের দু‘পাশে যদিও কিশোর বয়েসী নিমগাছের চোখজুড়ানো পত্রপল্লব এখন আর নূতন কিছু নয় তবু এ বাজারে নিমগাছের ঘনছায়া একটু বেশিই চোখে পড়ে। প্রাণে হয়ত মাতৃভূমির কিছুটা ছোঁয়া লাগে। তাই স্বদেশের গাবতলী, কদমতলী, হিজলতলী, শিমুলতলী ইত্যাদি নামের সাথে মিল রেখে প্রবাসী বাঙালীদের মুখে মুখে সহজেই এ বাজারের নাম হয়ে গেল নিমতলী বাজার। বেশিরভাগ দোকানীও বাংলাদেশী। অসংখ্য বাংলা সাইন বোর্ড  প্রাণের ভেতর সুর তুলে - আ-মরি বাংলাভাষা।  
নিমতলীতে এলে সাইনবোর্ডের গর্বিত বাংলা অক্ষর দেখতে দেখতে প্রথমেই সজীব সুপার মার্কেটে ঢুকে পড়ি। পারভীনের জন্য বাংলা পত্রিকা আর ম্যাগাজিন কিনি। আমার নাইট ডিউটি থাকলে রাত জেগে অপেক্ষা করে। কত নিষেধ করি, শরীরের এ রকম অবস্থায় রাত জাগা ঠিক নয়। কে শোনে কার কথা ? হাল ছেড়ে দিয়ে এখন পত্র-পত্রিকার ব্যবস্থা করেছি। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে। 
ডিউটি শেষে গাড়িতে ওঠার আগে মনে পড়ল বেশ কিছুদিন ধরে আইসক্রীম কেনা হয়নি। জিনিসটা ওর বড্ড প্রিয়। হাতে দিলেই যেন খুকী হয়ে যায়। আমার খুব মজা লাগে। বিনিময়ে যা চাই, টুক করে দিয়ে দেয়। হাসিমাখা ঠোঁটজোড়া চোখে ভাসতেই মনে পড়ল সারাওয়াত সুপার মার্কেটে যেতে হবে। পার্পল কালারের লিপস্টিকের কথা কবে যেন বলেছিল। তাছাড়া ওর পছন্দের কিছু কাবাবও কিনতে হবে। আসলে ঘরে ফেরার সময় ওই অপেক্ষমান হাসিমুখটির জন্য রোজ কিছু না কিছু না নিলে দিনান্তে আমার সার্থকতাই যেন অপূর্ণ রয়ে যায়। তাই নিদেন পক্ষে এক প্যাকেট বাদাম হলেও কিনে নিয়ে তবে ওর মুখোমুখি হই। 
লিপস্টিক কিনতে গিয়ে হঠাৎ পা আটকে যায়। সেই ভদ্রমহিলা। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক। মুখের উগ্র  প্রসাধনী বয়সটাকে এক যুগ কমিয়ে এনেছে। কপালে কাটছাট করা কোঁকড়া চুলের ঝালর। ট্রলি বোঝাই করে তুলে নিচ্ছেন নানা ধরণের খাবার সামগ্রী, ঘর সাজানোর সরঞ্জাম, খেলনা, পোশাক আরো কত কি। ইন্দোনেশীয়ান বুয়ার কোলে ঘুমন্ত শিশু। সাধারণতঃ এ দেশীয় ধনাঢ্য মহিলারা ইন্দোনেশীয়ান বা ফিলিপিনো কাজের মেয়ে সাথে নিয়ে এ রকম ট্রলি বোঝাই করে দামী দামী জিনিস নেয়। ভালই পাল্টা দিচ্ছে তাদের সাথে। মহিলা এবার আমার খুব কাছাকাছি এসেছেন কসমেটিক নিতে। মুখোমুখি হতে চাচ্ছি না। চিনে ফেললেই হাই-হ্যালো শুরু করে দেবেন। বাসায় এমনভাবে ইনভাইট করবেন যেন আমি তার খুব নিকট-আত্মীয়। অবশ্য নিকট-আত্মীয় কথাটা অস্বীকার করি কিভাবে ? আর, না করেই বা উপায় কী ?
লিপস্টিক কিনে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে আসি। ছয়মাস আগে সিদ্দিকা হাসপাতালেই ওই শিশুটির জন্ম হয়। জটিল পজিশন। উর্দু, আরবী বা ইংরেজী জানেন না বলে ভাষাগত সমস্যা সমাধানের জন্য ড. সিদ্দিকা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সেই থেকে ভদ্রমহিলা বা তার স্বামী আমার প্রতি বেশ কৃতজ্ঞ। স্বামীটাকে অবশ্য এখনো দেখিনি। দেখার দরকারও মনে করি না। পারভীনের কাছে এসব কথা সযতেœ গোপন রেখেছি। কী কাজ হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর ?
বাসায় ফিরে মহিলার ছবিটা মন থেকে ঝেড়েমুছে হাজির হই আমার সুরভিত বেডরুমে। রুম তো নয়, আমার ছোট্ট স্বর্গ। স্বর্গের ভেতর অভিসারিনী পরী। আমি তাকে পরী বলেই ডাকি। প্রথম দিন ওর নামকে ছোট্ট করে পারু বলেছিলাম। তাজা মেহেদীর সুবাসে মৌ মৌ করা নরম আঙুল আমার ঠোঁটে রেখে বলেছিল, ‘প্লিজ। আর যাই ডাকুন, এ নামে ডাকবেন না। 
কেন ?
এ নামে আমার বাবা আরেকজনকে ডাকতেন। আমি ভুলে থাকতে চাই।
এরপর আর এ নামে ডাকিনি। ভুলে থাকুক ঐ আরেকজন অর্থাৎ ওর মায়ের কথা। তাছাড়া ডাকার জন্য নামের অভাব আছে নাকি পৃথিবীতে ? হুরপরী, ফুলপরী, জলপরী, লালপরী ইত্যাদি কতকিছু ডাকতেই পারি। আমি বাসায় ঢোকার আগে প্রতিদিন আমার পরী এসি অন করে। ডাইনিং টেবিল সাজায়। বেডরুমে রিফ্রেশেনার ছড়িয়ে জেসমিনের মৌ মৌ সুবাস নিয়ে আসে। তারপর ম্যাক্সি ছেড়ে আমার প্রিয় যে কোনও কালারের শাড়ি। ম্যাচ করা চুড়ি, টিপ। খোঁপায় একই রঙের ফুল। অথবা সামনে এনে রাখবে লতার মত ঝুলে থাকবে সুদীর্ঘ রেশমী বেণী। প্রথম প্রথম মনে করতাম আশেপাশের বাঙালী পরিবারে হয়ত বেড়িয়ে সময় কাটিয়ে এসেছে। পরে আবিষ্কার করি প্রবাসের নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য প্রথম প্রথম নূতন নূতন বাঙালী পরিবার পেলে যেভাবে খুশি হয়ে বেড়াত, এখন তেমন আগ্রহ নেই। সামাজিকতা কমিয়ে এনেছে। ইদানিং শুরু করেছে নেকাব পরা। প্রশ্ন করলে গ্রামীন সংস্কারের কথা বলে। এ সময়টাতে নাকি অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। কি জানি - হয়ত তাই। 
সিঁড়ির শেষ মাথায় আসার সাথে সাথে রোজকার মত চাবি খোলার শব্দ। নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। কলিং বেল টিপতে হয়না। আমার পায়ের আওয়াজেই খুলে যায় দরজা। অভিসারিণী হাসিমুখে হাতের ব্যাগ নেয়। কখনো লুকোচুরি খেলে। খুঁজে বের করতে হয়। আজও দেখি দরজায় সে নেই। আড়চোখে পর্দার নিচের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘ঘরে কেউ নেই দেখছি। পরীরাণী নিশ্চয় আকাশপারে। এইতো মহাসুযোগ। আইসক্রীম একাই সাবাড় করব’। অমনি পেছন থেকে এক রেশমী বেণী আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে। কানের কাছ নরম শব্দগুচ্ছ, ‘এবার দেখি তো গলা দিয়ে কি করে আইসক্রীম যায়?’ আমি তাড়াতাড়ি আইসক্রিমবক্স সঁপে দিয়ে বলি, ‘নাও নাও। কোন দুঃখে আমি বাইরের আইসক্রীম খাব ?’ শেষ কথাটার ইঙ্গিতের ওপর ভেংচি কেটে বক্স নিয়ে দে ছুট। ফ্রীজে রেখে রোজকার মত কোট টাই খুলে দেয়। ভেজা টাওয়েলে ঘাম মুছে। চোখ বুঁজে প্রশান্তির মহাসাগরে ডুবে ভাবি, বনানীর ছায়ঘেরা রাস্তায় মুখ নীচু করে হাঁটা সেই বিমর্ষ মেয়েটার ভেতর এত যে ফাল্গুন ছিল কে জানত?
অনেক হেঁটে সেদিন মিলুর কাছে এসেছিল নোট নিতে। দু’তিন ঘন্টা ছিল আমাদের বাসায়। কয়েকটা অংকও টুকে নিচ্ছিল। বারান্দায় সকালের রোদ মেখে মজা করে মার আদরমাখা পিঠা খাচ্ছি, এসময় মিলু বলে, দাওনা ভাইয়া অংকটা করে। নিজের মাথাই ঢুকছেনা, ওকে বুঝাব কি ?
ও কে?
আমার বান্ধবী। অবশ্য অন্য কলেজে পড়ে। এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট না হওয়ায় আমাদের কলেজে চান্স পায়নি।
ডেকে আন। দুজনকেই বুঝিয়ে দিচ্ছি।  
আসবে না। খুব লাজুক। 
মাঝে মাঝে এভাবে মিলুর কাছে আসত। মা খুব আদর করতেন। না খাইয়ে ছাড়তেন না। বলতেন, খুব লক্ষী মেয়ে। একদিন শুনি সেদিনের পর থেকে আর আসেনা। ওর মামী নাকি খোঁচা মেরে বলেছে, ‘মিলুর বাসায় এত ঘন ঘন আসা যাওয়া কিসের? ও, মিলুর একটা ডাক্তার ভাই আছে। ভালই তো। মায়ের পথ ধর। মা ভেগেছে প্রাইভেট টিউটরের সাথে, তুইও পারলে ভাগ ওই ডাক্তারের সাথে। বিয়ের খরচা থেকে বেঁচে যাই।’ 
হরদম মামীর তিক্ত মুখের অগ্নিবাণে পুড়তে থাকে তার অশ্রæভেজা নোট আর বইয়ের পাতা। যখনই পাতায় পাতায় ভেসে ওঠে বাবার ছবি তখনই দুহাতে আগুন ঠেকানোর ভঙ্গিতে বুকে চেপে ধরে বই খাতা। স্পষ্ট শুনতে পায়, ‘আয় খুকু আয়’। শহরের নামকরা শিল্পী ছিলেন তার বাবা। কী সুন্দর করে গাইতেন এ গানটা। বিষাক্ত ছুরি দিয়ে বাবার কন্ঠের সব গান জবাই করে মা পালিয়ে গেলেন। উচ্ছ¡ল প্রাণবন্ত মানুষটি কোর্টে যেতেন অপরাধী আসামীর মত মুখ নীচু করে। কানে আসত প্রতিপক্ষ উকিলদের ফিস ফিস করা তীর - ‘যার নিজের ঘরই বেআইনী  কুকীর্তিতে ভেসে যায় সে আবার আইনের কি বুঝে ?’
সেদিন সমস্ত অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে মেয়েকে বুকে চেপে বলেন, মা রে, তুই আমার বুকের একমাত্র ধন। আমার একমাত্র স্বপ্ন। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না তোর জন্য। ভালমত পড়াশুনা করিস। দেখবি আল্লাহই তোর জীবনের পথ দেখাবেন। 
পরদিন কোর্টের মানুষ কোর্টেই স্ট্রোক করেন। পারভীনের এসএসসি পরীক্ষার আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। বই খাতা যেমন এলোমেলো ছিল তেমনি পড়ে থাকে। পরীক্ষা দেবার শক্তি বা সাহস কোনটাই নেই। স্বয়ং হেড মিস্ট্রেস এসে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজ দায়িত্বে হোস্টেলে নিয়ে যান। বাবার জীবনের শেষ কথা মাথায় নিয়ে পিঠ সোজা করে ওঠে দাঁড়াতে বলেন। টিচারদের অপার মমতায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেও কাক্সিক্ষত লক্ষে যেতে পারেনা। যে মেয়ের সে বছর বোর্ডে স্ট্যান্ড করার কথা তার কপালে জুটল সেকেন্ড ডিভিশন। কাছের আপনজনেরা বলল, হবে না ?  বিদেশে যেদিন ছিল মায়ের হানিমুন, স্বদেশে সেদিন ছিল মেয়ের অগ্নিপরীক্ষা।  
কলেজে ভর্তি হবার পর বাসায় টিউটর রেখে দেবার তো প্রশ্নই আসে না। সারা সকাল মামীর ফুটফরমাইশ খেটে ঠিক সময়ে ক্লাশে পৌঁছতে না পারায় প্রতিদিন লাস্ট বেঞ্চে বসে পার করে লজ্জাজনক মূহুর্ত।
মিলুর কাছে শোনা এসব ঘটনাচক্রের চার বছর পার হয়ে গেছে। তেমন মনে রাখার কথা না। ইতোমধ্যে জেদ্দায় এসে শিশু-বিশেষজ্ঞ হিসেবে সিদ্দিকা হাসপাতালে জয়েন করেছি। দু‘বছরের মাথায় মা ফোনে তাগিদ দিচ্ছেন আর ই-মেইলে পাঠাচ্ছেন বাজারের সেরা গয়না আর কসমেটিকের লম্বা লিস্ট। জিনিসপত্র কোন ক্রমেই যেন কম বা কমদামী না হয়। কারণ যাদের সাথে আত্মীয়তা করতে যাচ্ছি তারা কোটিপতি। আমার মা মহাকঠিন সংগ্রামী মহিলা। বাবার সংসারে এসে অকাল বৈধব্য মেনে নিয়ে ভেঙে পড়েন নি। আত্মীয় স্বজনের করুণার সাহায্যও নেননি। সামান্য বেতনে চাকুরী করে শক্ত হাতে তিন ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন। এখন একটাই উচ্চাভিলাষ - ছেলেমেয়ের বিয়ে দেবেন এমন বাড়িতে যার গেটে দারোয়ান থাকবে, বাগানে ফোয়ারা থাক্েব, গ্যারেজে গাড়ি থাকবে। তবে বিয়েটা হবে শতভাগ যৌতুকবিহিন। এমনকি এক রতি স্বর্ণও যেন পুত্রবধু সাথে করে না আনে। স্ট্যাটাস অর্জন করতে গিয়ে নিজের নীতির কাছে হার মানার কোন সুযোগই কাউকে দেবেন না। 
মেয়ের ছবি এসেছে ই-মেইলে । মিলু বলেছে ফটোর চেয়েও সুন্দরী। আমি সুন্দর অসুন্দরের ধার ধারি না। মন পবিত্র থাকলেই হল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহপাঠিনী ইরার কাছ থেকে ছ্যাকা খেয়ে জীবনসঙ্গিনী বাছাইয়ের ব্যাপারে আমি এখন নির্বিকার সুবোধ ছেলে। মা বোনদের পছন্দ হলেই হল। 
বিয়ের দিন উঠোনে রাখা বাবার স্মৃতিমাখা নামাযের চৌকিতে দাঁড়িয়ে জরিদার শেরোয়ানী পরেছি। আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের হাসি ঠাট্টা ভরা বিশেষ মূহুর্তটা ভিডিওতে ধারণ করা হচ্ছে। মার ফুঁ দেওয়া পাগড়িটা কেবল মাথায় পরানো হবে এ সময় হন্তদন্ত হয়ে বিয়ের প্রধান গাইড আমার দুলাভাইর দুলাভাই এসে উপস্থিত। রোজকার মত আমাকে শালার শালা বলে রসিকতা করলেন না। গম্ভীর মুখে বললেন, পাগড়ি রাখো। বলে ধুম করে চৌকিতে বসে হাঁপাতে লাগলেন। 
কি ব্যাপার ?
ভয়ানক ব্যাপার। 
একশ জনের দুইশ চোখ তার দিকে। কী সেটা ? কিছু বলছেন না কেন ? তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অনেক পর বললেন, আজ ফযরের সময় বিয়ের কনে বিষ খেয়েছে। এখন ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। 
জামাই কুটুমদের সাথে যে একটু আদর-সমাদরের সাথে কথা বলতে হয় সেকথা বেমালুম ভুলে গিয়ে মেজরকাকু গর্জে ওঠেন।
তো ? ডাক্তার পারভেজকে এখন কি করতে হবে শুনি ? শেরোয়ানী খুলে এ্যাপ্রন পরতে হবে? ঢাকা মেডিকেলে ছুটতে হবে ট্রিটমেন্টের জন্য ? মেয়ে প্রেগন্যান্ট ছিল এ খবর ওরা জানত না? খেলা পেয়েছে আমাদের সাথে, হেঁ?
সব দোষ যেন বেচারা দুলাভাইয়ের দুলাভাইর।
সারা উঠোন জুড়ে বিরতিহীন গুঞ্জন। ভেতরে মা-বোনরা পাথর হয়ে আছেন। কি বেইজ্জতী কান্ড! সব জায়গায় কার্ড বিলি হয়ে গিয়েছে। আজ শুক্রবার বিয়ে, পরশু রোববার কমিউনিটি সেন্টারে বৌভাত। নিমন্ত্রিত সবাই তো যথাসময়ে উপস্থিত হবেই। ক’জনকে কিভাবে এবং কোনমুখে জানানো হবে বিয়ে ক্যানসেলের কথা? মেজরকাকু মিলিটারী কায়দায় হুংকার ছেড়ে বললেন, কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই। এক পাত্রী গেছে তো কি হয়েছে? দেশে কি ভাল পাত্রীর এতই অভাব? আজ বিকেলের মধ্যে যে যেখান থেকে পার ভাল পরিবারের ভাল পাত্রীর লিস্ট দাও। আজ সন্ধ্যায় ইনশাআল্লাহ্ একজনকে সিলেক্ট করব। আজ রাতেই আমার পারভেজের বিয়ে হবে এবং বৌভাতও  হবে ঐ রোববারেই।
সারাবাড়িতে এবার অন্যরকম গুঞ্জন। উপস্থিত সবাই যার যার হাতের কাছের পাত্রী হাজির করার সুযোগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। হার্টের রোগী মা বিছানায় পড়ে কাঁদছেন। জরিদার শেরোয়নীর ভেতর এই শীতেও আমি ঘামছি। আমার ভেতরকার সুবোধ ছেলে এবার অন্য রূপ ধারণ করে। মিলুকে সাথে নিয়ে মার শিয়রের কাছে বসে বলি, মা, মেজর কাকু আজ সন্ধ্যায় যাকে সিলেক্ট করবেন তার দেহ-মনও যে আরেকজনের অকুপাইড নয় তার গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারবে? পারবে না। সুতরাং সবাইকে পাত্রী খোঁজা বন্ধ করতে বল। এখন আমি যার কথা বলব তাকে তুমি ভাল করে চেনো। তুমি যেমনটি চাও তেমন কোটিপতি অবশ্য নয়, তবে -----
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিলু বলে, তার বাবা নামকরা লেখক ছিলেন। শিল্পী ছিলেন। বাপের এই গুণ তার ভেতরেও আছে। অনেক প্রতিভা তার। ওদের আলীশান বাড়ি গাড়ি নেই বটে, কিন্তু খানদানী পরিবার। গ্রামে এখনো তাদের পুরোনো আমলের জমিদার বাড়ি, মসজিদ, শান বাঁধনো ঘাট এসব অনেকাকছু সেকালের সাক্ষী। তুমি ঠকবে না, মা।
মা বললেন, রাখ ফিরিস্তি। কে সে মেয়ে? 
বলার সাহস না পেয়ে মিলু ঢোক গিলে আমার দিকে তাকায়। আমি নির্দ্বিধায় বলি, পারভীন। তোমার সেই খুব লক্ষী মেয়ে। 
মার অশ্রুভেজা চোখে এবার আগুন জ্বলে ওঠে। পা-র-ভী- ন? ওর মার কীর্তি শুনিসনি? সমাজে ওর কোন্ পরিচয় দেব, বল্? তোর মেজর কাকু শুনলে তো তোকে জবাই করে ফেলবে।
বিয়েটা মেজরকাকুর নয় মা, আমার। তোমাদের পছন্দের ওপর তো সুবোধ ছেলের মতো মত দিয়েছিলাম। এবার যদি আমার পছন্দের মূল্য না দাও তাহলে এই যে শেরোয়ানী  খুলব, আর কিন্তু পরাতে পারবেনা।  
কী শুনছি রে মিলু ? ও মিলু।
মিলুও ঘাবড়ে গিয়েছে। মায়ের কামরা ছেড়ে আমি বাইরে আসি। নিজের ‘জবাইয়ের’ রিস্ক নিয়ে মেজর কাকুর কাছে যাই। উনি তখন একটু আগের রাগারাগির জন্য বেচারা দুলাভাইয়ের দুলাভাইর হাত ধরে সরি বলে তোয়াজ করছেন। আর বিশাল ফাঁড়া থেকে আগে ভাগেই বাঁচালেন বলে মহান ভাগ্য-নিয়ন্তাকে শোকরিয়া জানাচ্ছেন। আমার সব কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান। 
বলেন, ‘আরে, এ মেয়ের বড়চাচাকে আমি তো চিনি। আমার সাথেই মুক্তিযুুদ্ধ করেছেন। আমি এ মেয়ের অন্য কোন পরিচয় খুঁজব না। তোর মাকে বল, মেয়েটা এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ভাতিজী , এটাই ওর বড় পরিচয়। আমি নিজেই যাচ্ছি। কইরে মিলু, ও মিলু, চল আমার সাথে। বাসাটা চিনিয়ে দিবি। বাবাজী, আপনিও চলেন। এই বলে বেচারা দুলাভাইয়ের দুলাভাইর হাতে ধরে হন হন করে বেরিয়ে গেলেন।              
মিলু এ বিয়ের নাম দিয়েছে ঝটিকা-বিয়ে। এক ঝটিকায় আমার ভাগ্যের দৃশ্যপট উল্টেপাল্টে একাকার। কে আসার কথা। কে এসে গেল। অনিশ্চিত মরুপথে হঠাৎ মুষলধারায় বৃষ্টি। আর তারপরই বসন্তের শোভা। বাড়ির সবাই পারভীনের ¯িœগ্ধতায় মন্ত্রমুগ্ধ। মিলু ঠিকই বলেছিল, বহুমুখী প্রতিভা ওর। অনার্সে অপ্রত্যাশিত ফার্স্টক্লাশ। মাস্টার্সে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তৃ মরুর দেশে নিজেই মরুভূমি হয়ে যাচ্ছি আমি। বিরহ নামের চিজটা যে এত দুর্বিসহ ভাইরাস, কে জানত? বিশেষত ওর অপরূপ পত্রকাব্যে ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে হৃৎপিন্ড। বললাম, ‘মাস্টার্স পরে হবে। বাঁচাও এসে রোগী’। কথা দু’টোকে পুঁজি করে হাসতে হাসতে ‘বাঁচাও রোগী’ নামে লিখে পাঠাল আরেক কবিতা। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত চল্লিশটা কবিতা নিয়ে বের হয়েছে ওর প্রথম কাব্য ’পাশে আছ তাই’। উৎসর্গ আমাকেই।
জেদ্দায় ওকে প্রথমবার এনে প্রথমেই ঘর-সংসারের বেড়াজালে ঢুকাতে চাইনি। এয়ার পোর্টে রিসিভ করে সোজা সাগরপারের হোটেলে। টানা সাতদিন হানিমুন। এর ফাঁকে মক্কা মদীনায় গিয়েছি। লোহিত সাগরের নিভৃত শিলাখন্ডে বসে শুনেছি ওর চাপা সুরের গান, ‘সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে, তোমার কপালে ছোঁয়াব গো----’। 
বছর খানেক হয়ে গেল আমার কাছে মনে হয় এখনো যেন হানিমুনের আবেশের মধ্যেই আছি। খাওয়ার সময় ভাত মাখিয়ে প্রতিবেলার প্রথম লোকমা আমি ওর মুখে দেই। ও আমার মুখে দেয়। আমার চুলের ভেতর ওর চাঁপাকলির মত নরম আঙুলের যাদুর ছোঁয়ায় রাতে চলে যাই ঘুমের রাজ্যে। ভোরে  ঘুম ভাঙ্গে ‘মজনু গো আঁখি খোল’ এ রকম কত গানের সুরে। আমাদের দুজনের নামের প্রথম তিনটা অক্ষর একই। সবদিকেই ছন্দে ছন্দে অপরূপ আমার ছোট্ট স্বর্গ। ইরাকে বিয়ে করলে এ স্বর্গ কি কপালে জুটতো? আমাকে বিট্রে করে ইরা বিয়ে করেছিল অস্ট্রেলিয়া-প্রবাসী এক ইঞ্জিনীয়ারকে। শোনা যায় ওখানে গিয়ে তাকেও বিট্রে করেছে। পশ্চিমা কায়দায় কার সাথে যেন লিভ-টুগেদারে আছে। সংসারের বাঁধন তথা পরাধীনতা নাকি তার ধাতে সয়না।
খেতে বসে কাবাবের টুকরো ওর মুখে দিয়ে বলি, পরীজাদার কী অবস্থা? মুভমেন্ট টের পাও?
পাই।
কিক মারে ? 
হুম।
ব্যথা লাগে না?
লাগে। তবে ব্যথার চেয়ে মজা বেশি। আমাকে বলেছে আব্বুকে বল ফুটবল কিনে দিতে।
ওর দেওয়া প্রথম লোকমা গিলে হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে বলি, ‘দেব নিশ্চয় দেব। ওকে বল জন্মের পর প্রথমে যেন আমার কোলেই আসে। ওর মার কোলে নয়’।
নির্ধারিত সময়ের এক সপ্তাহ আগে ফুটে ওঠে আমাদের স্বপ্নের প্রথম কুঁড়িটি। নাম রেখেছি অনাবিল। আসল নাম নাবিল। যার যেটা পছন্দ সেটাই ডাকে। ‘নাবিল, ও নাবিল’ ডাকতে ডাকতে অনাবিল হয়ে যায়। আরবী বাংলা দুই ভাষা মিশে একাকার। ওর কচি মুখের অনাবিল হাসিতে আমার ছোট্ট স্বর্গ এখন কল-কাকলীময়। ডিউটি থেকে ফেরার সময় এতদিন দরজায় অপেক্ষমান থাকত একটি হাসিমুখ, এখন দ’ুটি। পারভীনের মুখমন্ডলের ফটোকপিটি গোলাপী মাড়ি বের করে হাসতে হাসতে পাখির মত প্রায় ওড়ে আসে আমার কোলে। এসেই পকেটের কলম মুখে পুরে। লালা ঝরায় কোটে। লালা তো নয় লালিত্য। বুক ভরে ওঠে গর্বিত পিতৃত্বের সীমাহীন মাধুর্যে, যার সাথে পৃথিবীর কোন কিছুর তুলনা চলেনা। পারভীন এসব চিত্র-বৈচিত্র্য নিয়ে দু‘হাতে লিখে চলছে ছড়ার বই ‘অনাবিল শান্তির ভোর’।
সত্যি, আমাদের ভোর এখন অন্য রকম শান্তির ভোর। অনাবিল আমাদের রুটিন বদলে দিয়েছে। দিনে প্রচুর ঘুমায় বলে রাতে প্রায় দুটো পর্যন্ত জেগে থাকে। ওর রুটিন মেনে আমাকেও  জেগে থাকতে হয়। খেলতে হয়। এ হচ্ছে আরেক নাইট ডিউটি। ভোরে তার ঘুমন্ত মুখে চুমু খেয়ে চেম্বারে আসি।
আজ হাসপাতালে আসতে বিশ মিনিট লেট। ঘুমের রেশ পুরোটা কাটেনি। চেয়ারে বসতেই একগাদা ফাইল জমা দেয় নার্স। আর বাচ্চা কোলে নিয়ে ঢুকেই বাংলাভাষায় কলরব জুড়ে দেন এক ভদ্রলোক। 
আমার ওয়াইফ বলেছিল, ওর ডেলিভারীর সময় ড. সিদ্দিকার সাথে একজন বাঙালী ডাক্তারও ছিলেন। কিন্তু নাম মনে করতে পারছিল না। তাই খুঁজে বের করতে বেশ সময় লাগল। কই গো পারু, এস। 
ও পারুল আহমদ নামের এ ভদ্রমহিলার ডাক নাম তাহলে পারু। এবার আমার মনে পড়ল বাসর রাতে কেন পারভীন আমাকে এ নামে ডাকতে মানা করেছিল। আমি দরজার দিকে তাকাই। 
দরজা ঠেলে সালাম দেন সেই ভদ্রমহিলা। আমার বুকটা চিন চিন করে ওঠে। আবার সেই মুখ। ভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে তিরিশ দাঁত প্রকাশ করে বলেন, এখন আর তোমার ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম হবেনা। তোমার সৌভাগ্য যে, সেই দেশীভাই আজ পেয়ে গেলে।
ভদ্রলোকের মুখে বিরতিহীন খই ফুটছে। ‘বুঝলেন ডাক্তার ভাই, বাচ্চার অসুখ হলে হাসপাতালে যে নিয়ে আসব, সে সময় কই? নিমতলী আর গুলিল এরিয়ায় তিনটা দোকান আমার। এত বিজন্যাস ছাড়াও, এক্সট্রা অনেক কিছুর সাথে আমি জড়িত। পার্টির কাজ তো আছেই। এই যেমন ধরুন গে আপনার, আগামী কাল প্রধানমন্ত্রী আসছেন। এয়ারপোর্টে যেতে হবে। গতকাল এ বিষয়ে এ্যাম্বেসেডর আর কনসাল জেনারেলের সাথে মিটিং ছিল। পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা না দিলে তো নয়ই। কত দায় দায়িত্ব। আর গিন্নির অবস্থা কি আর বলব?  বাচ্চা একটু হাঁচি দিল তো ফোনের পর ফোন, ‘ওগো, শিগগির এস। হসপিটালে যেতে হবে’। ওর কলিজাখানায় -- কী আর বলব, সন্তান বাৎসল্য জিনিসটা টু মাচ। টেনশনে পাগল হয়ে যায়। 
আমি অনেক কষ্টে কাষ্ঠ-হাসি ফুটিয়ে বলি, বাচ্চার সমস্যাটা কি বলেন।
তেমন কিছু না। সর্দিকাশি। ওকে বোঝান তো ডাক্তার ভাই। সর্দিকাশি তো তেল রসুন গরম করে বুকে পিঠে একটু  মালিশ করে দিলেই তো সেরে যায়। এত টেনশনের কি আছে ?
ইচ্ছে করেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করি, এ আপনার প্রথম সন্তান? তাইনা ? 
মহিলার চোখের পাতা কেঁপে ওঠে। ডাক্তার আর উকিলের কাছে নাকি কোন সত্য তথ্য গোপন করতে নেই। সেজন্য হয়ত উনি ড. সিদ্দিকার অনুরূপ প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন,  না, দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান জন্মের পর মারা গিয়েছে। 
এ সত্য তথ্যটা জেনেও না জানার ভান করে উত্তরের অপেক্ষা করে চুপ থাকি। মহিলাও চুপ। সত্যমিথ্যার মাঝখানে থেকে ভদ্রলোক বলেন, জ্বী, এটা আমাদের প্রথম সন্তান। 
আমি মৃদু হেসে বলি, প্রথম সন্তানের বেলায় সব মা একটু বেশি টেনশন করে থাকেন। এটাই তো স্বাভাবিক। তাই না,মা ?
ভদমহিলা আমার কথার খোঁচাটা বুঝতে পারলেন কি না কে জানে।  
নার্স বাচ্চাটাকে বেডে শুইয়ে দেয়। বাচ্চাটারও সেই চোখ সেই মুখ। চেহারায় এত মিল? পারভীন আর অনাবিলের অবিকল চেহারাটা আমাকে যেন বিকল করে দিচ্ছে। বাচ্চাটা আমার এত কাছের তবু যেন কাছের নয়। ভদ্রমহিলা চিন্তিত মুখে আমার মুখোমুখি দাঁড়ান। উনি আমার এত কাছের মানুষ তবু যেন যোজন যোজন দূর। বাচ্চাটাকে ভালভাবে চেক আপ করে বলি , সিরিয়াস কিচ্ছু হয়নি। টেম্পারেচারও তেমন নেই। সিজন চেঞ্জ হলে এরকম একটু আধটু হয়ই। টেনশনের কিছু নেই। খোদা না করুক, তেমন সিরিয়াস হলে আমার কাছে অবশ্যই আসবেন। ওর জন্য স্পেশাল কেয়ার নেব। 
ভদ্রলোকের ডাকসাইটে স্বরযন্ত্র আবার চালু হয়। ‘পারু, দেখলে তো? তোমাকে কত করে বলেছি সামান্যতেই বাচ্চাদের এত ঘন ঘন ঔষধ খাওয়াতে নেই। তুমি তো কথাই শোন না। বাচ্চার অবস্থা উনিশ থেকে বিশ হলেই দে ছুট হসপিটালে। এখন থেকে এই ভাইর কাছে আসবে। তার কথা মানবে। দেশীভাই বলে কথা। কত অমায়িক, দেখেছ ? আর হ্যাঁ, ড্রাইভার নিয়ে একাই চলে এস। আমার সময় কোথা? এইতো এখনই ছুটতে হবে মির্টিংয়ে। প্রধানমন্ত্রীর রিসিপশন বলে কথা। বাণিজ্য মন্ত্রীও আসবেন। বাংলাদেশে নূতন একটা ব্যাংক হচ্ছে। শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে আমিও একজন। বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে এ নিয়ে আলাদা মিটিং।
অ আচ্ছা।
আমার নেক্সট্্ টার্গেট, নিজের শহরে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে শেয়ার হওয়া। আপনাদের দোয়ায় আমার এতসব উন্নতির মূলে কিন্তু আমার স্ত্রী-ভাগ্য এবং সন্তান-ভাগ্য। এদের ভাগ্যেই নিমতলী বাজারে আমার দুটো দোকান। একটা ওর নামে, পারুল স্টোর। আরেকটা হচ্ছে ছেলের নামে, পুলক এন্টারপ্রাইজ। আর গুলিলের সবজি মার্কেটটা দেশের নামে, শ্যামল বাংলাদেশ। বুঝলেন না, দেশপ্রেম হচ্ছে ঈমানের অংশ। হেঃ হেঃ হেঃ !
ভদ্রমহিলা গর্বিত ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকান। বাচ্চাকে চুমু দিয়ে ভদ্রলোক মুখে আবার খই ফোটান,  ‘আমার স্পন্সর আমাকে খুব ভালবাসে। সে তো তাগিদ দিচ্ছে রিয়াদে গিয়ে তার ব্যবসার হাল ধরতে। রিয়াদ খুব হাইফাই এরিয়া। ক্যাপিটাল সিটি তো। সবকিছুতেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। ওখানকার বিল্ডিংয়ের তুলনায় নিমতলী নেহাত জরাজীর্ণ। ভাবছি নিমতলীর দোকান ভাতিজার হাতে দিয়ে রিয়াদ চলে যাব। সময়ের সাথে সাথে আভিজাত্য, আই মীন, ব্যক্তিগত স্ট্যান্ডার্ডও বাড়াতে হয়। হেঃ হেঃ কি বলেন, ভাইয়া ?
আমি বিনীত ভাবে বলি, স্যরি, আমার অন্য রোগীরা অপেক্ষা করছে। অন্যদিন না হয় গল্প করা যাবে।
ও, তাইতো তাইতো। উঠি তাহলে। ভাল কথা, আপনার বাসা কোথায় ?
নাজলায়। 
আরে, আমার বাসাও তো নাজলায়। দেখা হয়ে ভালই হল। এ সপ্তাহে আমার পুলকের মুখেভাত অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীর রিসিপশনের ব্যাপারটা সেরে নেই। তারপর ‘দরবার হোটেলে’ গিয়ে ডেট ঠিক করব। আপনাকে কিন্তু যেতেই হবে। ‘না’ বলতে পারবেন না।
ভদ্রলোকের কথার তোড়ে এতক্ষণ ভদ্রমহিলা কোন কথাই বলতে পারছিলেন না। এবার আদুরে গলায় বলেন, ভাইয়া, আমি নিজে গিয়ে ভাবীকে দাওয়াত করে আসব। বাসার লোকেশন বলেন। 
বলে কি? বাসা পর্যন্ত যাবে? সর্বনাশ। আমার এতক্ষণের উদারতা আর গোপনীয়তা মন থেকে উধাও। ভেতরকার অস্বস্থি চাপা দিয়ে বলি, আমার স্ত্রী আপনার ভাবী হতে যাবেন কেন ? বড়জোর আপনার মেয়ের মত একটা নগন্য হতভাগ্য মেয়ে। 
ড্রয়ার খুলে পারভীনের কবিতার বই বের করি। মহিলার মুখের সামনে আয়নার মত ধরি। সামনের মলাটে ‘পারভীন মুস্তফা’ নাম এবং পেছনের মলাটে ওর ছবি দেখিয়ে বলি, ‘তাকে হয়ত চেনেন। বইটা ইতোমধ্যে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষ করে ‘মা দিবসের অমানিশা’ নামক কবিতাটা। স্যরি টু সে, আমি চাইনা আমার বাসায় এ জাতীয় কোন একটা সিন ক্রিয়েট হোক।
আর কিছু বলতে হয় না। বিধ্বস্ত স্বরযন্ত্র নিয়ে ভদ্রলোক তার সন্তান-বৎসল স্ত্রীর হাত ধরে দ্রুত বেরিয়ে যান। 
ঘটনা পারভীনকে বলতে পারিনি। মরুর বালু দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছি বুকের গভীরে। সে রাতে পারভীনকে নিয়ে ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। আধভাঙ্গা ঘুমের মধ্যে টের পাই জোরে জোরে শ্বাস ফেলছি। হাত বাড়িয়ে দেখি বিছানায় পারভীন নেই। টয়লেটেও না। কিচেনেও না। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি আবছা অন্ধকারে পায়চারী করছে। লাইট জ্বেলে দেখি চোখ ফোলা। সোফায় বসিয়ে বলি, কি ব্যাপার?  কাঁদছ কেন?
কাঁদছি না, আল্লাহকে জিজ্ঞেস করছি। কী অপরাধ করেছিলাম যে---। কথা অসমাপ্ত রেখে আমার বুক ভিজিয়ে জোরে কাঁদতে থাকে। 
টিসু দিয়ে চোখ মুছে বলি, আহ্্হা, বলবে তো কী হয়েছে?
থেমে থেমে ভাঙ্গা গলায় বলে, বিদেশে এসে ভেবেছিলাম দেশের সমাজের হাত থেকে বাঁচলাম। কিন্তু ওরা বাঁচতে দিল কই? জেদ্দায় এসেছে আমাকে ডুবাতে। রাগে দুঃখে রোজ লুকিয়ে কাঁদি। আমার চোখের পানি দেখে পাছে তুমি অস্থির হয়ে পড় তাই বলতে গিয়েও এতদিন বলিনি।
বিষয়টা আমিও জানি পরী। পাছে তুমি কষ্ট পাও তাই আমিও তোমাকে বলিনি। 
তুমি জানলে কি করে ?
আমি তখন পারুল আহমদ নামের ভদ্রমহিলার সাথে কখন, কোথায়, কতবার দেখা হয়েছে, কী কী কথা হয়েছে সব খুলে বলি। তারপর জিজ্ঞেস করি, কিন্তু  তুমি জানলে কি করে? 
পাশের ফ্ল্যাটের এক ভাবীর এলবামে দেখেছিলাম ওই শয়তানীর বাচ্চার আকীকার ছবি। বিশাল পার্টি দিয়েছে হোটেলে। বাসা নিমতলীতে। ঘন ঘন পার্টি, পিকনিক এসব নিয়ে নাকি সারাবছর ফুর্তি করে বেড়ায়। ভাবী বললেন আমার মতই চেহারা। কথাটা শোনার পর থেকে বাঙালীদের পার্টিতে যাওয়া বাদ দিয়েছি। পাছে ওর মুখোমুখি হলে কেউ যদি দু’জনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে কোনো প্রশ্ন করে বসে। 
ও, এজন্যই বুঝি নেকাব ধরেছ? এত ভয় ?
কি করব বল? নাজলার একেকটা বাঙালী পাড়া তো একেকটা রেডিও সেন্টার। একদিন এখানকার সবাই জেনে যাবে। সেই ভয়ে আমার ইচ্ছে হয় জেদ্দা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে কোন বাঙালী  থাকবেনা। দেখনা চেষ্টা করে ?
কেন ? তুমি কেন জেদ্দা ছাড়বে ?  বরং ওদেরকেই জেদ্দাছাড়া করব। আমার ওপর ভরসা রাখ, পরী। আমি থাকতে তোমার ভয় কেন ?  
তুমি আছ বলেই তো বেঁচে আছি। দুর্ভাগ্যের পৃথিবীতে তুমিই আমার সৌভাগ্যের বেহেশত। তুমিই আমার---’। এর চেয়ে ভাল উপমা হয়ত আর খুঁজে পেলনা। সশব্দে অবাধ্য স্রোত ছড়িয়ে দেয় আমার বুকে। ওর চুলের অরণ্যে হাত বুলিয়ে বলি, তোমার সব যন্ত্রণা, সব দুর্ভাবনা আমার বুকে ঢেলে দাও পরী। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। 
কান্নার মৃদু শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। এক সময় শান্তিতে এলিয়ে পড়ে। আমি অনড় হয়ে ওকে ধরে থাকি, পাছে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। দূর থেকে তখন ভোরের আজান ভেসে আসছে।     
==========================