Friday, November 12, 2021

হিসেব-নিকেশ

হিসেব-নিকেশ

গুলশান চৌধুরী

 

নোরার বেতনের টাকা তিনভাগে ভাগ করা। প্রথমভাগ ব্যাঙ্কের জন্য। দ্বিতীয়ভাগ বাবার চিকিৎসা আর ছোটভাই ছোটনের কোচিংএর জন্য। শেষভাগ সংসারের টুকটাক খরচপাতির জন্য। ব্যাগে থেকে যায় ওভারটাইমের টাকা। ওটা নিজের যাতায়াত বা হাতখরচের জন্য। তারও একাংশ আবার চলে যায় বিভিন্ন দোকানের পাওনা পরিশোধে। রাজার রেখে যাওয়া রাজকীয় ঋণ এভাবেই একটু একটু করে কমিয়ে আনতে হচ্ছে।

ওদের ফ্যাক্টরির সাপ্তাহিক ছুটি সোমবার। তাই মাসের প্রথম সোমবার বেতনের ঐ প্রথমভাগ নিয়ে ব্যাঙ্কে যাবার ফুরসত মেলে। মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য দু’হাজার করে জমা দেয়।মনোরার দু’চোখের পাতা জুড়ে শুধু অঙ্ক আর অঙ্ক। সামনে নাকি ধেয়ে আসছে করোনার ভয়াল ঢেউয়ের আরেক ধাক্কা। এ চিন্তায় যথাসম্ভব খরচপাতি কমিয়ে এমাসে একহাজার টাকা বাঁচাতে পেরেছে। আজ তাহলে জমা দিতে পারবে তিনহাজার। ভাবতে ভাবতে ব্যাঙ্কের সিঁড়িতে পা রাখতেই বেজে ওঠে মোবাইল। রাজার মিসড কল। মানুষটা এ রকমই। স্বার্থ ছাড়া কল দেয়না। দিলেও মিসড কল। তার মানে মনোরা কল ব্যাক করুক।

কল ব্যাক করে মনোরা। বিরক্ত হয়ে বলে, আইজ আবার কি মনে কইরা?

-মায় মারা গেছে। বাড়িত যাইতাছি। খবরটা দেওনের দরকার, দিলাম।

-ইন্না লিল্লা---- কবে?

-কাইল রাইত। সকাল দশটায় জানাজা। মার ঋণ শোধ করছস তো?

মা তোমার, না আমার? কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারেনা মনোরা।প্রশ্নটা হজম করে বলে, মার অষুধের ঋণ শেষ। বাকি রইছে তোমারটা। আর পারুম না। আইয়া কিন্তু শোধ কইরো।

‘কথা হুনা যায়না। বাসের মইধ্যে আছি’ বলে লাইন কেটে দেয় রাজা।

মনোরার ভেতরের চাপা দেওয়া রাগ দুঃখ লাফিয়ে লাফিয়ে চোখমুখ দখল করে। তোর মার ঋণ, তোর ঋণ, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর ঋণ শোধ করতে হবে এই মনোরাকে? কেন, তোদের খেয়েপরে আমি বড় হয়েছি নাকি? আমার তিনভাই তো ঠিকই বলে, এই অমানুষটা জীবনেও শোধরাইব না। দে ডিভোর্স।

মাঝেমাঝে তারও ইচ্ছে হয়, দেয় ডিভোর্স। কিন্তু পারেনা। জীবনের হিসেব করা গন্তব্য কখন বেহিসেবে কোন দিকে মোড় নেয়,কে জানে?

পাত্রী হিসেবে মনোরা ছিল দেখতে শুনতে ভাল। রোজগার ভাল। বাবা রাজমিস্ত্রি। বড় দুইভাই গার্মেন্টস্ ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। এসব গুণ বিচারে মনোরাকে পছন্দ করেছিলেন রাজার মা। ঐ দুইভাইর চেষ্টায় যদি রাজার একটা চাকরি জুটে যায় তাহলে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসবেন। গ্রামের বাড়িতে ধানতোলা, ধানভানা, ছাগল চরানো, পাহাড়ে গিয়ে লাকড়ি জোগাড় করা - এতসব কঠিন কাজ কাঁহাতক সহ্য হয়?।

পাত্র হিসেবে রাজা ছিল দেখতে শুনতে ভাল। যৌতুকের দাবী নেই। গৃহস্থালী কাজের জন্য মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে রাখবেনা। শহরেই রাখবে। এ গুণ বিচারে রাজাকেও পছন্দ করেছিলেন মনোরার মা।

হয়ে গেল বিয়ে। ওদের থাকার জন্য আপাতত ঘরের একটা কামরা ছেড়ে দিলেন বাবা। দুদিন না যেতেই স্থায়ীভাবে থাকার ইচ্ছা নিয়ে এসে পড়লেন অসুস্থ্য বেয়াইন। কথা ছিল রাজার চাকরি হয়ে গেলে ধারেকাছে বাসা নিয়ে আলাদা থাকবে ওরা। কিন্তু কোনো চাকরিই তার তিনচার মাসের বেশিদিন টিকে না। শ্বশুরবাড়ির আরামআয়েশ ছেড়ে কেবা এত পরিশ্রম করতে যায়? পাড়ার দোকানীরা জামাই বলে সমীহ করে। সুতরাং বাকিতে মার জন্য ঔষধ, পানসুপারি, দুধ, ডিম ইত্যাদি যখনতখন কিনতে অসুবিধা হয়না। নিজের মান সমুন্নত রাখতে মাঝে মাঝে চাল-ডাল কিনে দেখিয়ে দেওয়াও যায়। মনোরা তো শোধ করে দিচ্ছেই।

এসব দেখে মনোরার বাবা-ভাইরা মাঝেমাঝে রেগে ফোঁস ফোঁস করলেও শেষপর্যন্ত মেনে নেয় ফুটফুটে দুই ভাগ্নির মুখের দিকে তাকিয়ে। মন্দভালো সবমিলিয়ে চলছিল মোটামুটি। কিন্তু যেদিন টাকার জন্য নেমকহারামটা মনোরার গায়ে হাত তুলল, সেদিন তার বড় দুইভাইও হাত গুটিয়ে থাকতে পারেনি।

প্রতিশোধটা ভালমতন দেখিয়ে দেয় রাজা। ‘দ্যাশে তোর মতন রোজগারী মাইয়ালোকের অভাব আছে নাহি?’ মুখের ওপর প্রশ্নটা ছুঁড়ে মেরে মাকে নিয়ে কোথায় যেন চলে যায়। মনোরা দুই মেয়ের কান্নাকাটির কথা জানিয়ে ফোন করলে সাফ সাফ বলে দেয়, দু দুটো লস প্রজেক্ট নিয়ে তার কি লাভ?

 

ভাবতে ভাবতে ব্যাঙ্কের সিঁড়িতে বসে পড়ে মনোরা।স্নেহময়ী শাশুড়ির মুখটা ভেসে উঠতেই সমস্ত রাগ পানি হয়ে যায়। ব্যাঙ্কে না ঢুকে বাসায় ফিরে যায় সে। সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে ছোটনকে নিয়ে শেরপুরগামী বাসে ওঠে।

ততক্ষণে জানাজা শেষ। লেগুনা বাড়ির সামনে থামতেই ‘বড়ভাবী আইছে’ বলে খুশিতে চিৎকার করতে করতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভীড় জমায়। হৈচৈ শুনে রাজা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মুখ দেখে বোঝা গেল মহাবিরক্ত। কিছু বলতে হয়, তাই শুকনো মুখে বলে, আমার মাইয়ারা কির’ম আছে?

-  তোমার আবার মাইয়া আছে নাহি? যা আছে, তাতো লস প্রজেক্ট।

-  তর আল্লাহর দোয়াই, ভালা মুখে থাহিস। বাড়িত আরেকজন আইছে। হের সামনে অন্তত এমুন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কইস না।    

মনোরা জানে এই আরেকজনটা কে। তবু না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করে, আরেকজন আবার কেডা? কেডা আইছে?

আমতা আমতা করে কি একটা জবাব দিতে চাচ্ছিল, তার আগেই চাচীশাশুড়ি এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না জুড়ে দেয়। বলে, আইছস রে মা? একটা দিন আগে আইতি। মরার আগ পর্যন্ত তর হউড়িয়ে তরে ডাকছিল। তর হাতে এট্টু পানি খাইতে চাইছিল। রাজারে খবর দিছিলাম। হে তরে কয় নাই?

-নাতো!

চাচী রাজার দিকে কটমকট করে তাকিয়ে মনোরার হাত ধরে পা চালায় ঘরের দিকে। গোলপাতায় ছাওয়া দুই কামরার মাটির ঘর।আতর লোবানের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। শাশুড়ির কামরায় তেলাওয়াত করছে মেয়েরা। অন্য কামরার দরজা লাগানো। সব বুঝতে পারে মনোরা। কিছু বলেনা। ননদ আর চাচী-ফুফুদের নিয়ে রান্নাঘরে যায়। মসজিদে যোহরের নামাযের পর দোয়া মাহফিল হবে। তারপর ইমাম-মুয়াজ্জিন আর ফকির-মিসকিনকে খাওয়াবে মনোরা। সদাইপাতির একটা লিস্ট তৈরি করে ছোট দেবরের সাথে ছোটনকে বাজারে পাঠায়।  

পাঁচকেজি জিলাপি মসজিদে পাঠিয়ে রান্নার কাজে লেগে যায়। হাতে হাতে সবাই সবকিছু কুটেবেছে এগিয়ে দিয়েছে বলে খুব কম সময়ে রান্নার কাজ সেরে ফেলে। এক ফাঁকে রাজা এসে থালায় খাবার বেড়ে তার কামরায় সেই আরেকজনকে দিয়ে এসেছে। প্রথম খাবারটা যেন তারই পাওনা। এতে কে কি বাজে মন্তব্য করল, তা গায়েই মাখলো না ।

খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ করতে করতে বিকেলের সোনারোদ ফিকে হতে শুরু করে। এবার মনোরার ফেরার পালা। ফুফু চোখ কপালে তুলে বলে, ভর সৈন্ধ্যায় ক্যামনে যাবা বউ? আইজ থাহো।

সে তার নিজের কামরার দিকে ইশারা করে। তারই বাবার দেওয়া খাটে রাণীর মত শুয়ে আছে সেই আরেকজন। অর্থাৎ রাজার দ্বিতীয় বউ। সেও নাকি আরেক ফ্যাক্টরির গার্মেন্টসকর্মী। রাজার হাতখরচের টাকা দেয়। রাজা তাই তোয়াজ করে তাকে এবং তার ছয় সদস্যে ভরা পরিবারকে।

মনোরা কঠিনস্বরে সবাইকে বলে, কই থাকুম, আপনারাই কন? আমার কি ঘর আছে?

বড়চাচী বলেন, কি কস বউ? আমি আছি না? আমার ঘরে থাকবি।    

ননদেরা সাথে সাথে চেঁচিয়ে বলে, ক্যান ক্যান? নিজের ঘর থাকতে আমগো বড়ভাবী আপনের ঘরে থাকবো ক্যান? খাড়াও, নবাবজাদীরে চুলের মুঠি ধইরা বাইর করতাছি।

মনোরা বলে, বাদ দ্যাও তো।

বড় ননদ বলে,ক্যান বাদ দিমু? টাউইন্যা মেমসাব মাথা বেদনার ভান ধইরা হুইয়া আছে তো আছেই। কুনু কামের মইধ্যে নাই।

ছোট ননদ বলে, আওনের পর থাইক্যা অডারের পর অডার, চা দেও, গোসলের গরম পানি দেও, টাট্টি কেনে নোংরা, ডেটল দিয়া সাফ কইরা দেও ----- ইস! জমিদারনী একখান। আমরা যেমুন হের দাসীবান্দী। 

ফুফু এবার কামরার দিকে তাকিয়ে ততোধিক চেঁচিয়ে বলে, হের বাসাত তোগো মারে নিয়া দুনিয়ার কাম করাইছে না? বাসন মাজাইছে না? ঘরের একপাল মাইনষের ত্যাড়া কথা হুনাইছে না? কম দুক্ষে তোগো মায় মরতে মরতে বাড়িত ফিরা আইছিল?

পাশের বাড়ির দাদীশাশুড়ি এতক্ষণ চুপচাপ বসে বসে সুপারিকুটনি দিয়ে পানসুপারি কুটছিলেন। তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, দরকার অইলে হেরা বারাইয়া যাউক। ও বইন, এইডা তোর ঘর। একটা রাইত থাক।

একটা রাত কেন? একটা মিনিটও থাকার ইচ্ছা নেই মনোরার। প্রতিটি সেকেন্ড+প্রতিটি কথা+প্রতিটি পদক্ষেপ = তার নির্মাণাধীন তেজী ভবিষ্যত। হিসেবের খাতায় যা যোগ করতে এসেছিল,তা সফলভাবে শেষ। নিজেকে এখন নিরঙ্কুশ বিজয়ী মনে হচ্ছে। তাই ছোটনের পরীক্ষা আর নিজের ডিউটির দোহাই দিয়ে হনহনকরে বাইরে পা চালায়।

বাসের হেডলাইটে অন্ধকার ভেদ করে সর্পিল পথ ধরে এগিয়ে চলছে বাস। ছোটন ওবাড়ির সবার সামনে কিছু বলেনি। এবার সব রাগ ঝাড়তে শুরু করে।

- আল্লায় তোমারে কি দিয়া বানাইছে আফা? শয়তান বেডায় তোমার লগে কি র’ম ব্যভার করল দেখলা? একটু আগাইয়া পর্যন্ত দিলনা। আমার লগে তো হারাদিনে এট্টু রাও করল না! তোমারে বুড়িআঙুল দেহাইয়া তোমার খাটে হে আরেক বউ লইয়া ঘুমাইল! অত বেইজ্জতির পরেও তুমি তারে ডিভোর্স দিতে পার না?

-ক্যান পারি না, এইডা তুই বুঝবি নারে ভাই। জীবনটা গণিতের সরল অঙ্কের মত কঠিন। সমাজভরা তিনরকম বন্ধনীর নিয়মকানুন আর যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের কত হিসাব। ধৈর্য ধইরা আমারে কলম চালাইতে অয়। কারণ, ডিভোর্সী বাপ-মার মাইয়াগোরে ভালা ঘরের কেউ বিয়া করতে চায়না। উল্টাসিধা নানান কথা কয়। আমার মাইয়া দুইটা তরতর কইরা বড় অইতাছে। তাগো ভবিষ্যত কেমুন অইতে পারে, ক ?

ছোটন কিছু বলতে পারে না। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে সীটে হেলান দিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। মনোরা ঘুমায় না। সামনে এগোচ্ছে সে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি সারা দেহমনে খেলা করছে। রাজার সুখের ভেলা আর কতদূর যাবে? ভেলা তো বেশিদূর যেতেও পারেনা। বেশি দিন টিকেও না।

 

No comments:

Post a Comment

What do you think?