ডিজিটাল প্রেম
-নাজমুল চৌধুরী
মনের অলিন্দে ভাসছে ফেসবুকে দেখা এক অনিন্দসুন্দর মুখ। মাথাভর্তি কুঁকড়ানো ঘন চৃল, চওড়া কপাল ও মায়াভরা মুখে মৃদু হাসির ঝলক। কালো গগলস্ চশমাতে ছেলেটিকে সিনেমার হিরোর মত লাগছে। জন্ম সিলেটে। বাল্যকাল কেটেছে সিলেটের চা বাগানে। টি-টেকনোলজির উপর বর্তমানে
ডক্টরেট করছে লন্ডনে। ঢাকার ধানমন্ডিতে স্থায়ী নিবাস। মা একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। ছোটবোন চীনে ডাক্তারী পড়ে। ব্যাস, এতটুকুই পরিচিতি। ফেসবুকের টাইমলাইন ঘেটে এসব তথ্য পেয়েছে লিলিয়ানা।
ময়মনসিংহের মেয়ে হলেও সিলেটের প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ লিলিয়ানার। কারণ ওখানেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশোরের উদ্দাম দিনগুলো। বাংলাদেশ বিমানের সিলেট শাখার ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়ে তার পিতা ওখানে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘ বিশটি বছর। দশবছর পর একবার বদলি হয়েছিলেন চট্টগ্রামে কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার অজুহাত এবং নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেখিয়ে বাংলাদেশ বিমানের এমডি-কে বুঝিয়ে বদলী ঠেকাতে পেরেছিলেন। বিমানের সিলেট শাখার সেলস্ টার্গেটের প্রায় ত্রিশগুণ বেশী অতিক্রম করেছিল তার এই দীর্ঘ বিশবছরে। সিলেট ও ঢাকায় একটানা ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত করে অবসর নিয়ে মাসুহুদ সাহেব ঢাকার তেজগাঁওয়ে চাকুরীজীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনে স্ত্রী রেবেকা ও সন্তানদেরকে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ছেলে দু’জনের মধ্যে বড় ছেলে ডেভিড সলমান সাংবাদিকতায় মাষ্টারস্ সম্পন্ন করে একটি বে-সরকারী টিভি চ্যানেলে খবর পাঠকের চাকুরী নিয়েছে, ছোট ছেলে ইমানুয়েল গোমর বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আর লিলিয়ানা হোম-ইকনোমিক্সে মাষ্টারস্ পড়ছে।
স্ত্রী রেবেকা, ছেলে ডেভিড, ইমানুয়েল আর মেয়ে লিলিয়ানাকে নিয়ে পাঁচজনের সাজানো সংসার মাসুহুদ সাহেবের। ঢাকায় ছেলে দু’টোকে ভার্সিটিতে ভর্তি করতে গিয়ে বেশ বে-কায়দায় পড়তে হয়েছিল তাকে। তাছাড়া ন্যাশনাল আইডি কার্ড বানাতে গিয়েও একই দুরাবস্থা। ধর্ম খ্রিস্টান। কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন ছেলেদের নাম খ্রিস্টান তরিকায় হবে কেন? মুসলিম নামের কি এতই আকাল? ডেভিড সলমানের এর স্থলে মুহাম্মদ সুলাইমান কেন নয় আর ইমানুয়েল গোমর এর স্থলে মুহাম্মদ ঈসা রাখলে কি ভুল উঠত?
ক্ষেপে যান মাসুহুদ সাহেব ভার্সিটির রেজিষ্ট্রারের কথায়। নাম পছন্দের ব্যাপার। ফর্মে কি মুসলিম ধর্মের অনুসারী লিখে দেওয়া হয়নি? আপনি বদলাতে যাবেন কেন? দয়া করে বলবেন, এ অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে ?
ভাবলাম আপনি হয়তো ধর্মের কলামে খ্রিস্টানের স্থলে ভুলে মুসলিম লিখে ফেলেছেন কারণ এধরণের নামতো খ্রিস্টানের পরিচয় বহন করে - জোরালো যুক্তি রেজিষ্ট্রারের।
দেখুন, পিতামাতা তাদের ছেলেমেয়ের নাম কি রাখবে বা না রাখবে এটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। জানেন ডেভিড বা দাউদ নবীর ছেলে সুলাইমান, দু’জনই বাদশাহ এবং নবী ছিলেন। আর আমার দ্বিতীয় ছেলের নাম ইমানুয়েল গোমর। জানেন ঈসা নবীর অন্য নাম ইমানুয়েল আর গোমর হল নূহ নবীর ঈমানদার ছেলে ইয়াফসের ছেলের নাম। এই চারজনের মধ্যে প্রথম তিনজনই ইসলামের প্রভাবশালী নবী। পবিত্র কুরআনে অসংখ্যবার এদের নাম এসেছে। এ সমস্ত নবীদের নাম রাখতে আপত্তির কি দেখলেন ? অভিভাবককে না জানিয়ে আপনারা ইচ্ছামত বদলিয়ে নেবেন এ কেমন কথা? তাই বলি, আপনারা ভুল করেছেন তাই ঠিক করার দায়িত্ব আপনাদের উপরই বর্তায়। মাসহুদ সাহেবের যুক্তিতর্কের কাছে হেরে গিয়ে ভার্সিটির রেজিষ্ট্রার সংশোধন করে নিবেন বলে সম্মতি জানান।
অবশ্য এ নামের কারণে বড় ছেলে ঢাকার একটি আমেরিকান কোম্পানীতে ভাল চাকুরী পেয়েছিল। কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার আমেরিকান যোসেফ রবিনসন কোম্পানীর সিনিওর এক্সিকিউটিভ পদের জন্য ডেভিড সলমানের নামই পছন্দ করে চাকুরীর দরখাস্ত আলাদা করে রেখেছিলেন। কোন ইন্টারভিউ ছাড়াই ডেভিড সলমানকে ফোনে জানতে চেয়েছিলেন কবে কাজে যোগ দিতে পারবেন? একইভাবে প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের কনভারটেড খ্রিস্টান সিইও রথিশ বথুয়েল ডেভিড সলমানকে নিজেদের টিভি চ্যানেলে খবরপাঠক হিসাবে ভাল বেতনে নিয়োগ দেন এবং খবরপাঠক হিসাবে বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার খবর পাঠকদের খবর পড়ার ষ্টাইল রপ্ত করার জন্য একমাসের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থাও করেন।
ভার্সিটি ফেরত লিলিয়ানা নিজের রুমে ফেসবুক খুলে পুনরায় ঐ ছেলের ফেসবুক একাউন্টে প্রবেশ করে। সেই হাসি হাসি নায়কোচিত সিলেটের ছেলে। ফটোতে যার মায়াবী মুখ হৃদয়ে অস্থিরতা জাগায়। এক অজানা অনুভুতির স্পর্শে উত্তাপ ছড়ায় দেহের কোষে কোষে। একবার মেসেজ বারে গিয়ে নক করবে নাকি ছেলেটাকে? না, না, কি ভাববে ছেলেটি? সে ভার্সিটির অন্য পাঁচটি মেয়ের মত নয়, একটু স্পেশাল। সিলেটে তার শৈশব কৈশোর কেটেছে। পীর আউলিয়াদের দেশ। ওখানের স্থানীয় ছেলেমেয়েরা তাই একটু ভিন্ন ধাঁচে গড়া। অন্যান্য জেলা হতে আসা ছেলেমেয়েদের মত বেলাল্লাপনা ওরা কিংবা ওদের অভিভাবকরাও পছন্দ করেনা। অভিভাবকদের সম্মতিতেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়। গোপন অভিসার আর প্রেমের রাজ্যে হাবুডুবু খেয়ে বিয়ে করা ঐ সমাজ সহজে মেনে নেয়না।
সাংবাদিকতায় মাষ্টারস্ থাকায় ডেভিড টিভি চ্যানেলের চাকুরী বেছে নেয়, আমেরিকান কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজারকে বিনয়ের সাথে রিগ্রেট জানায়। মাসুহুদ সাহেব গর্ব করে ছেলেকে বলেন - দেখলিতো নামের কত গুণ? দেখে নিস আমাদের ইমানুয়েল কিংবা লিলিয়ানা তাদের পড়া শেষ করে ভাল চাকুরীই পাবে।
স্ত্রী রেবেকাকে মটর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে মাসুহুদ সাহেব বেড়িয়ে পড়েন শপিংয়ে। সংসার এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার চাপে রেবেকার সাথে যৌবনের সেই স্মৃতিময় মধুর দিনগুলোর কথা প্রায় ভুলতে বসেছেন। বিয়ের পরপর নূতন কর্মস্থলে যোগদানের পর একটু গুছিয়ে রেবেকাকে নিয়ে যাবার শর্তে তার পিত্রালয়ে রেখে এসেছিলেন। নূতন কর্মস্থলে অফিস ষ্টাফদের সাথে একটি মেসে উঠেছিলেন। কাজকর্ম বুঝে নিতে দেরী হচ্ছিল বিধায় বাসা ভাড়া নিয়ে রেবেকাকে নিয়ে সংসার সাজাতে ছ’মাস দেরী হয়েছিল।
তখনকার দিনে চিঠিই ছিল একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। অফিসে কাজের ফাঁকে রেবেকাকে লিখা প্রথম চিঠি ছিল এভাবে -
”জানি, তোমার মনে কত স্বপ্ন প্রিয়তমা। আমারও কি কম? নির্ঘুম রাতের নিরবতা কত যে কষ্টের তা তোমাকে কি করে বুঝাবো! আমার ঘুম আসেনা, সময় যে কাটেনা, লক্ষীসোনা। তুমিই একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী হয়ে বিরাজ করছ আমার এ বিরহী মনের গোপন কন্দরে। একটু গুছিয়ে নিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব কথা দিলাম। ময়মনসিংহ অনেক দুরের পথ। নূতন চাকুরী তাই হঠাৎ করে যে ছুটি নিয়ে যে তোমার কাছে চলে যাব তারও উপায় নেই। এ মূহুর্তে তুমি কি করছ জানিনা। বারান্দায় বসে দুরের আকাশে ঘনকালো মেঘমালার দিকে উদাস দৃষ্টিতে হয়ত চেয়ে আছ কিংবা রাতের নিস্তব্ধ প্রহরে মহাকাশের অযুত নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছ। আমারও একই অবস্থা। অফিসে ফাইলের গভীরে প্রতিটি পাতায় শুধু তোমারই মূর্তিমান প্রতিচ্ছবি। ভাবি, আলাদিনের চেরাগ যদি হাতে পেতাম তাহলে যখন তখন উপস্থিত হয়ে তোমার উষ্ণ ভালবাসার এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে নিজেকে ভিজিয়ে মনের জ্বালা জুড়াতে পারতাম। উত্তর দিয়ে আমার বুকের ছাই চাপা আগুনকে শান্ত করবে এ আশায় পথ চেয়ে রইলাম। ইতি : তোমারই বিরতকাতর স্বামী।”
উত্তরের প্রতীক্ষায় যুবক মাসহুদের সময় কাটেনা। প্রতিদিন অফিসে মেইল আসলেই একরাশ আশা জাগে মনের গভীরে। আজ নিশ্চয়ই আসবে প্রিয়তমার চিঠি। কিন্তু প্রতীক্ষার শেষ প্রহরে একসাগর রক্তক্ষরণ নিয়ে একসময় ফিরে আসতে হয় নিজের টেবিলে।
অবশেষে প্রতীক্ষিত নীল খামে মোড়া প্রথম চিঠি আসে পনরোদিনের মাথায়। ধৈর্য্য যেন বাঁধ মানেনা মাসহুদের। নববধুর ভালবাসা মাখানো প্রথম পত্র। হৃদয়ের কোষে কোষে এক অজানা শিহরণ জাগায়। প্রাপ্তির আনন্দে দ্বিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের রুমে এসে চিঠিটি মেলে ধরে চোখের সামনে ঃ
”প্রিয়তম, আর পারছিনা, তোমার চিঠি আমার বুকের গভীরে আগুনের লেলিহান শিখা হয়ে সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এ দাবদাহে আমি জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাব। হে প্রাণপ্রিয় স্বামী, আমার হৃদয়ের রাজা, এক বিরহিনী নারীর ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কান্না তুমি কি শুনতে পাওনা? কথা দিয়েছিলে কাজকর্ম একটু গুছিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে কিন্তু দেখতে দেখতে ছ’মাস কেটে গেল আর কতদিন অপেক্ষার প্রহর গুণব বল? অভিশপ্ত সময়গুলোর চাপ আমি আর বয়ে বেড়াতে পারছিনা। তোমার সৃষ্ট এক প্রবল বৈশাখী ঝড় আমার হৃদয়ের সমস্ত শাখা-প্রশাখা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছে। বিধ্বস্থ বলাকার মত মনটি আশ্রয় খুঁজছে শান্তির নীড়ে। তোমার ভালবাসায় সিক্ত এ উন্মাদিনী সত্যি সত্যিই একদিন বেড়িয়ে পড়বে তোমার খুঁজে। মনে রেখ, কোন প্রতিবন্ধকতা তাকে আটকাতে পারবেনা। ইতি - তোমার ভালবাসার কাঙ্গালিনী রেবেকা”
বড় ছেলে ভাল চাকুরী পেয়েছে। সে খুশীতে মাসহুদ-রেবেকা দম্পতির মনে আনন্দের জোয়ার বইছে। কিন্তু মাসহুদ সাহেব রেবেকাকে আজ দিতে চান বাড়তি কিছু আনন্দ। জীবনের ধাপে ধাপে সংসার ধর্ম পালন করেছে সে নিষ্ঠার সাথে। তিন তিনটি ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছে। ওদের পড়াশুনার খরচের যোগান দিতে গিয়ে নিজের চাওয়াপাওয়া বিসর্জন দিয়েছে। ডিজিটাল যুগের সর্বনিম্ন চাহিদা একটি মোবাইল ফোনও দিব দিচ্ছি করে কিনে দিতে পারেননি। ছেলেমেয়েরা নিজেদের রিক্সাভাড়া বাঁচিয়ে ছোট্ট কমদামী একটি সেট কিনে দিয়েছিল। মটর সাইকেলের পাহারায় রেবেকাকে রেখে সুপার শপে ঢুকেই প্রথমে একটি দামী মোবাইল সেট কিনেন, পাশের গয়নার দোকান থেকে দেড়ভরি ওজনের সোনার একটি চেইনও কিনতে ভুলেননা। প্যাকেটে মোড়া উপহার দু’টো পাঞ্জাবীর পকেটে লুকিয়ে রাখেন স্বযতনে।নিজেকে রেবেকার কাছে প্রমাণ করতে চান তিনি কৃপণ নন। এককালের যুবতী বধুকে পৌঢ়ত্বে এসে নূতন করে পুরানো ভালবাসা দিয়ে মন ভরিয়ে দিতে চান।
ঝটপট কেনাকেটা সেরে মটর সাইকেলের পাশে এসে রেবেকার দিকে প্রেমিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন, উঠে এসে আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে বস।
সাহেবের কি হল? যুবক যুবতীর মত নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে বসার অর্থ কি বুঝতে পারলাম না। লোক হাসাতে চাও ?
হাসুক লোকে, তাতে আমাদের কিচ্ছু যায় আসেনা। নিজেদেরকে যুবক-যুবতী ভাবতে দোষের কি? আমরা কি এতই বুড়ো হয়ে গেলাম? তুমি যদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বস হলফ করে বলতে পারি মটর বাইকটিও আমাদের সাথে তার হারানো যৌবন ফিরে পাবে।
ঠিক আছে তোমার কাঁধের দুপাশে জড়িয়ে ধরে বসব আর লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে মৃদু টিপে দেব - হলতো আপতত তাই চলুক, কিছুটাতো পেলাম। কিন্তু মনের ব্যথাতো রয়েই গেল। ছেলে চাকুরী পেয়েছে। আজ উৎসবের আনন্দে যৌবনের রঙ্গিন দিনগুলোর মত ভালবাসার রাজ্যে আমাকে ভাসিয়ে দিতে তোমার মন চায়না?
চায় গো চায় কিন্তু সংসারের ঘানি টেনে টেনে সেই অনুভূতি কোথায় যেন একসময় হারিয়ে যায়। তুমিতো সবসময়ই আমার পাশে আছ, বিরহের যাতনা নেই। তাছাড়া ছেলেমেয়েরা তোমার আমার মাঝখানে এসে ভালবাসায় ভাগ বসিয়েছে। তাই হয়ত ভালবাসার প্রকাশ যেমনটি চাও তেমনটি পারিনা। এজন্য তোমার রাগ হয়?
আজ হতে সে অনুভূতি আর হারিয়ে যেতে দেবনা, দেখে নিও। ভালবাসার কাঙ্গালীনি যেভাবে এক উন্মাদের কাছে প্রাণের আকুতি মিশিয়ে চিঠি লিখত আজ ছেলের চাকুরী পাওয়ার দিন হতে তা নূতন করে শুরু হবে।
কি আবোলতাবুল বলছ? বিয়ের উপযুক্ত ছেলেমেয়ে ঘরে রেখে খাতাকলম নিয়ে তোমার কাছে চিঠি লিখব! তুমি কি দুরে কোথাও চাকুরী করছ যে চিঠি লিখতে হবে। বয়স বাড়ছে না কমছে - পাগল হয়েছ ?
মটর সাইকেল বাসার গেটে আসতেই নেমে পড়েন রেবেকা। ঘরে ঢুকেই ফ্রিজ হতে বোতল বের করে একগ্লাস ঠান্ডা জল ঢেলে দেন শুকনো গলার গভীরে। মাসহুদ সাহেব কাজের বুয়াকে ডেকে জানতে চাইলেন কাজ শেষ হয়েছে কিনা? শেষ হলে যেতে বললেন।
লিলিয়ানা ও ইমানুয়েল ভার্সিটিতে। ডেভিড অফিসে। রেবেকাকে কাছে ডেকে বললেন এবার চোখ বুজ?
কেন, কি অঘটন ঘটাতে চাও দিন দুপুরে? পাগল নাকি ?
না, এতটা বেওকুফ আমি নই। তোমার ধারণা ভুল, সময়তো আর চলে যাচ্ছেনা। চোখদু’টো বুজেই দেখনা। আমার অনেক দিনের স্বপ্নটা ভেঙ্গে দিওনা রেবেকা আজকের এই খুশীর দিনে।
ঠিক আছে, বুজলাম এবং দু’হাত বাড়ালাম। তবে দুষ্টামী করনা।
মাসহুদ সাহেব রেবেকার গলায় সদ্য কেনা সোনার চেইনটি প্রথমে গলায় পরিয়ে দিলেন এবং পরে হাতে গুজে দিলেন মোবাইল ফোনের প্যাকেট। বললেন এবার চোখ খুল।
রেবেকা হাসি মুখে বললেন, পার বটে। আজ মনে হচ্ছে তুমি সেই আগের মানুষটি। কোথায় এতদিন এ মনটি লুকিয়ে রেখেছিলে ? আজ সারপ্রাইজ দিয়ে দেখিয়ে দিলে তুমি আমার সেই দুষ্ট প্রাণপ্রিয় স্বামী।
বলেছিলাম না, আজ হতে শুরু হবে চিঠি লেখালেখি। মোবাইলে চিঠি লিখার সব কলাকৌশল শিখিয়ে দেব। আর আমার কাছে ওয়াটস্-এ্যপে প্রতিদিন দু’চারলাইন চিঠি লিখবে। সেই প্রথম চিঠির মত।
তাহলে প্রত্যেত্তর পাবতো ?
কত মধুর সে স্মৃতিগুলো তাইনা? যেদিন তোমাকে নিয়ে গেলাম কর্মস্থল সিলেটের ভাড়া বাসায়, ঘরে ঢুকা মাত্র কতক্ষণ আমরা আঁকড়ে ধরেছিলাম একে অপরকে, মনে আছে ? মনে হয়েছিল যেন এক স্বর্গীয় হুর আমার বাহুতে বন্দীনি। প্রাণের উৎসারিত উচ্ছ্বাস ও আবেগ মিশিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরে ব্যতিব্যস্ত করে তুললাম। আর তুমি তাতে সাড়া দিয়ে আমার দেহমন ভরিয়ে দিয়েছিলে পূর্ণতার আনন্দে।
সেসব দিনগুলো আবার নূতন করে ফিরে পেতে চাও তাইতো ? দ্যাখো, মেয়েদেরকে জাগাতে হয় ভালবাসার নিত্যনূতন ডালি দিয়ে। সে ধরণের কিছু পেলে মেয়েরা পড়ন্ত বেলায়ও রামধনুর রঙ্গে সাজতে পারে। সে সত্যটি আমাদের সমাজের বেশীরভাগ পুরুষ জানেনা। তাই পড়ন্ত বেলায় বউয়ের দোষ খুঁজে বেড়ায়, খিট খিটে মেজাজ দেখায় আর সে কারণে বউয়ের যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তাও একসময় নিস্তেজ হয়ে যায়। অবশ্য শুধু পুরুষদেরকেই দোষ দেব কেন? বেশীরভাগ মহিলারা পৌঢ়ত্বে এসে খিট খিটে হয়। এ কারণে সংসারে অশান্তির দাবানল জ্বলে উঠে। দু’পক্ষের সংযত আচরণ আর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ সংসারে এনে দিতে পারে স্বর্গের প্রশান্তি।
তাহলে কথা দিচ্ছ আগামী সপ্তাহ হতে শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের ডিজিটাল প্রেম, কথাটি মনে রেখ।
লিলিয়ানার রেজাল্ট বেরিয়েছে একমাস পর। ইন্টারনেটে ফলাফল দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। দুরু দুরু বক্ষে নিজের অবস্থান খুঁজতে গিয়ে মহানন্দে চিৎকার করে মায়ের কাছে এসে জানায়, মা-দেখতো আমার এই রুল নাম্বার ঠিক আছে কিনা? বিশ্বাস করতে পারছিনা, চোখের ভুলও হতে পারে।
রেবেকা অতি আগ্রহে মোবাইলে আসা নাম্বারগুলোতে চোখ বুলিয়ে বললেন হ্যাঁ, ঠিকইতো দেখছি। তুই তাহলে গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছিস। লিলিয়ানা সাফল্যের হাসিতে সারা ঘর মাতিয়ে তুলে। বাবা কোথায় মা?
বিল্লালের দোকান হতে কিছু সওদা আনতে গেছেন।
একলাফে লিলিয়ানা বারান্দায় এসে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা কখন ফিরবেন? অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয়না।
দোকান হতে মাসহুদ সাহেব ঘরে ফিরলে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কৃত্রিম দুঃখের ছাপ মুখে ফুটিয়ে বলে ঃ বাবা রেজাল্ট এত খারাপ হল কেন বুঝতে পারলাম না। আজই আউট হল। এত পড়াশুনা করলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ভাগ্যে ছিল?
গম্ভীর দৃষ্টিতে লিলিয়ানার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন মাসহুদ সাহেব, মেয়ের চেহারায় মৃদু হাসি ও প্রশান্তির ভাব লক্ষ্য করে বললেন ঃ আমার মেয়ের রেজাল্ট খারাপ হলে ধরে নিতে হবে মেয়েকে আরও একটি বছর বেশী কাছে পাব সুতরাং আমার মন খারাপের কিছু নেই।
বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, তুমিতো গোল্ডেন-এ পেলে খুশী হতে তাইনা বাবা।
আর তুই যে তা পেয়েছিস তা তোর চেহারায় ফুটে উঠেছে। বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে তাইনা? ধরা পড়ে গেলিতো ?
কোন কথা না বলে বাবার ঘাড়ে মুখ ঘষতে থাকে লিলিয়ানা। রেবেকা স্বামীর দিকে চেয়ে বলেন, কই কিনা মিষ্টি আনবে, পাড়া-পড়শীকে বিলাতে হবে মেয়ের সাফল্যে, তা না করে বাবা মেয়ে নিরবে একে অপরকে শুকনো মুখে আদর বিলাচ্ছে।
এ্যাই, তোমার সাথে কথা হবে মোবাইলে, মুখে নয়, শর্তের কথা ভুলে গেছ? কিছুক্ষণের মধ্যে মোবাইলের ম্যাসেজে গিয়ে দেখতে পাবে আমার মনের প্রতিক্রিয়া। কথার খই ফুটিয়ে আমার মেয়ে ও আমাকে বিব্রত করনা বলে দিলাম।
রেবেকা মৃদু হেসে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান। ইমানুয়েলের ফেরার সময় হল। ছেলেটা একটু ভাল খেতে পছন্দ করে। বিশেষ করে মুরগীর রোষ্ট। এই ভেবে ফ্রিজ হতে একটি আস্ত মুরগী এনে পানিতে ভিজিয়ে রাখলেন। লিলিয়ানার সাফল্যে আজকের এই আনন্দের দিনে কমপক্ষে পাঁচপদের সুস্বাদু রান্না করতে হবে। মুরগীর রোষ্ট, খাসির মাংস দিয়ে বিরানী, পাবদা মাছের দু’পেয়াজী, গলদা চিংড়ির মালাইকারী, কাবাব, ডিমের পুডিং আর সাথে সালাদ ও কোকাকোলা হলে মন্দ হয়না।
স্বামী বলেছিলেন কথা হবে মোবাইলে লিখা ছোট্ট চিঠিতে, মুখে নয়। গত দু’দিন মোবাইল খোলা হয়নি। ওয়াটস-এ্যাপ ম্যসেজে যেতেই খন্ডিত চিঠি স্ক্রীনে ভেসে উঠে।
”এ্যাই, তুমি না বলেছিলে ভালবাসার ডালি সাজিয়ে মেয়েদের ভালবাসা জাগাতে হয় কিন্তু শর্তানুযায়ী বিনিময় পাচ্ছি কোথায়? লিলিয়ানার সাফল্যে আজ মনে হচ্ছে মহাসমুদ্রের অথৈ জলের গভীরে ডুব দিয়ে তিনটি মণিকাঞ্চন কুঁড়িয়ে এনে পেটে লুকিয়ে রেখেছিলে, সময়ের ব্যবধানে উদগীরণ করেছ একে একে, আর তাইতো চমক দেখিয়ে যাচ্ছে ওরা একের পর এক।”
”ভুল বলেছ, মণিকাঞ্চন তুমিই কুঁড়িয়ে এনে আমার পেটে লুকিয়ে রেখেছিলে যক্ষের ধনের মত, আমি শুধু তোমার ভালবাসার রত্নগুলো সময় সময় ফিরিয়ে দিয়েছি, ফিরিয়ে দেওয়ার আনন্দ আর সুখময় মার্তৃত্বের অফুরান আনন্দ আমার নারী জনমকে করেছে ধন্য। আনন্দের এ শুভক্ষণে কথা দিচ্ছি ইদানিং তোমার নবজাগরণে আমিও খানিকটা জেগে উঠেছি, সুতরাং যা চাইবে সাধ্যমত তা পূরণে সচেষ্ট হব”। শুধু অনুরোধ এ কথাগুলো পড়ার পরক্ষণে মোবাইল হতে ডিলিট করে দিতে হবে।”
লিলিয়ানা বিডি জবস্-এর চাকুরীর বিজ্ঞাপনের পেজ খুলতেই নজর থেমে যায় একটি বিজ্ঞাপনে। ঢাকাস্থ একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান হোম-ইকেনোমিক্সে মাষ্টারস্ পাশ করা একজন মহিলা ট্রেইনার চাচ্ছে। এ পদে চাকুরী হলে মন্দ হয়না। বলা হয়েছে - প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মিসেস সায়রা খাতুনের সাথে দরখাস্ত নিয়ে সরাসরি দেখা করতে।
সে অনুযায়ী বাবাকে সাথে নিয়ে পরদিন সে হাজির হয় প্রতিষ্ঠানটির বনানী অফিসে। তাদের তেজগাঁর বাসা হতে খুব একটা দুরে নয়। মহাখালীর রাস্তা ধরে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ঠিক মাঝামাঝি ৩৯/২ অফিসে সকাল দশটায় হাজির হয়।
অফিসে অপেক্ষমান আরও পাঁচজন তরুণী। বাবাকে ওয়েটিংরুমে বসিয়ে ইন্টারভিউয়ের জন্য নির্ধারিত চেয়ারের পাঁচজনের পরের সিরিয়েলে বসে পড়ে লিলিয়ানা। রিসিপশনিষ্ট মহিলার কাছে জমা পড়া দরখাস্তনুযায়ী একে একে ডাক পড়ে পরিচালক কক্ষে। জানানো হয় ইন্টারভিউ পরে আপনারা চলে যেতে পারেন, সিলেকটেড প্রার্থীকে পরে কোন একদিন ডাকা হবে।
প্রায় একঘন্টা পর লিলিয়ানার ডাক পড়ে। ত্রস্থ পদে পরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করে দুরু দুরু বক্ষে। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। সামনে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সেক্রেটারীয়েট টেবিলের ওপাশের সুন্দরী পৌঢ়া মহিলা হতে নির্দেশ আসে, বসুন। ইতোমধ্যে ভদ্রমহিলা দরখাস্তগুলোতে কি যেন লিখে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
এবার লিলিয়ানার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে একটু হেসে বলেন, নামটা যেমন মিষ্টি দেখতেও তেমনি। ট্রেইনার হিসাবে তোমার কোন অভিজ্ঞতা আছে?
জ্বিনা। সদ্য পাশ করে বেরিয়েছি। তবে মনে হয় ট্রেইনার হিসাবে কাজ চালিয়ে নিতে অসুবিধা হবেনা।
দ্যাখো, এ প্রতিষ্ঠানটি সিলেটের চা বাগানের কুলি-মজুরদের নিয়ে কাজ করে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। বলতে পার চা-বাগানের পিছিয়ে পড়া এক বিশাল জনগোষ্ঠির নূতন প্রজন্মকে প্রাথমিক শিক্ষার আলো এবং প্র্রগতির বিকাশ ঘটাতে এর সমস্ত আয়োজন। এদেরকে বশে আনা খুবই কঠিন। মায়া-মমতা আর ধৈর্য্য দিয়ে ওদেরকে বশে আনতে হয়। বনে জঙ্গলে বেড়ে ওঠা এ সমস্ত প্রজন্মরা জন্ম থেকেই দেখে এসেছে তাদের সমাজের অন্ধকার দিকগুলো। লেখাপড়ার জগতে ওদের বিচরণ সীমাবদ্ধ। বেশীরভাগ প্রজন্ম প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরোনোর আগেই ঝরে পড়ে। আমাদের প্রতিষ্ঠান সরকারী সহায়তায় এদেরকে বের করে আনতে চায় আলোর জগতে।
ম্যাডাম, আমার জন্ম থেকে শুরু করে শৈশব ও কৈশোর কেটেছে সিলেটের মাটিতে। স্কুলের ছুটিতে পিকনিকে গিয়েছি বিভিন্ন চা-বাগানে। চা-শ্রমিকদের জীবনধারা খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার পিতা বিশ বছর সিলেটে বাংলাদেশ বিমানের ম্যানেজার ছিলেন।
তাই নাকি? খুব ভাল কথা। তাহলেতো আশা করি ট্রেইনিদের সহজে সামাল দিতে পারবে। প্রতি মাসে চা-শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে পঞ্চাশজনের মত ছেলেমেয়ে পাঠায়। এখানে আমাদের একটি হোস্টেল রয়েছে, ওখানে ছেলেমেয়েরা থাকে। পাশেই ট্রেনিং সেন্টার। ছেলেমেয়েরা অনভ্যস্থতার কারণে একটু বেয়াদব টাইপের হয়। আদর সোহাগ দিয়ে ওদেরকে হ্যান্ডেল করলে কোন সমস্যা হয়না। একটি আদর্শ পরিবার গঠনে যা যা প্রয়োজন তার সবক’টিই এদের সিলেবাসে রয়েছে। পারবেতো ?
ইনশাআল্লাহ, পারবো মোম। যদি সুযোগ দেন তাহলে আনন্দের সাথে গ্রহণ করব।
খুব খুশী হলাম মা। তোমার নাম, কথার মাধুর্য্য, মিষ্টি চেহারা, বাকপটুতা ও সর্বোপরি ভদ্রতা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তাহলে আগামী সপ্তায় কাজে যোগ দিতে পারবেতো? একমাস আমরা তোমার দক্ষতা দেখব এবং উত্তীর্ণ হলে প্রথম ছয়মাস তোমার বেতন হবে মাসিক পনেরোহাজার, পরবর্তী পর্যায়ে বেতন এর দ্বিগুণ হবে। রাজীতো ?
মনের খুশী চেপে রেখে বলে বয়সে আপনি আমার মায়ের মত তাইতো প্রথমেই মোম বলে সম্মোধন করেছি। আমি কাজে যোগ দিতে চাই। বেতন নিয়ে ভাবছিনা। আমার বিশ্বাস আপনি কোনদিন আমাকে ঠকাবেননা। লিলিয়ানা এগিয়ে এসে ম্যাডামের পায়ের কাছে বসে, শ্রদ্ধা বিগলিত চিত্তে সালাম করে উঠে দাঁড়ায়।
সায়রা খাতুন লিলিয়ানাকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খান। প্রথম ইন্টারভিউয়ে তুমি একশোতে একশো পেয়েছো, বাদবাকী চাকুরীর স্থায়িত্ব নির্ভর করছে তোমার কাজের উপর। নামাজ কু’রআন পড় ?
জ্বি, নিয়মিত আলহামদুলিল্লাহ। সিলেটের আলোবাতাসে জন্ম নিয়েছি, বড় হয়েছি পীর-আউলিয়াদের সান্যিধ্যে থেকে। তাছাড়া পারিবারিকভাবে আমরা ভাইবোনদেরকে পরমসহিষ্ণু ও সকল ক্ষেত্রেই যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় পিতামাতা।
ঠিক আছে, খুব খুশী হলাম মা। আগামী সোমবার অন্যান্য ট্রেইনারদেরকে যখন সেন্টারের মাইক্রোবাস আনতে যাবে তখন তোমাকেও সাথে নিয়ে আসবে, ঠিক ন’টায় রেডী থেকো কেমন?
বাবাকে নিয়ে ফিরে আসে লিলিয়ানা। পথে তেমন কোন কথা হয়না। বাবার উৎসুখ চোখের দিকে চেয়ে ঈশারায় জানালো বাসায় গিয়ে বিস্তারিত বলবে।
মেয়ের চাকুরী হয়ে গেছে জেনে মা বাবার খুশীর অন্ত নেই। উল্লাসে ডেভিড, ইমানুয়েল আর লিলিয়ানা আনন্দের সাগরে ভাসছে। নানাধরণের পরিকল্পনা নিয়ে ওরা ভাইবোন ব্যস্ত। মাসহুদ সাহেব ওয়াটস্-এ্যাপ খুলে স্ত্রী রেবেকাকে মেসেজে লিখেন - ”তোমার পেটে যে তিনটি সোনার টুকরো ধারণ করেছিলে তারা তোমার অহংকার। একের পর এক তোমাকে উপহার দিয়ে যাচ্ছে তাদের সাফল্যগাঁথা। আর তোমার মত জীবনসঙ্গিনী পেয়ে আমি ধন্য। এমন সোনার বউ যাদের ঘরে আছে তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।”
উত্তরে রেবেকা লিখেন ”তুমি আমাকে শর্তে আবদ্ধ করেছ লিখতে নতুবা মুখ ফোটে বলতাম এমন স্বামী সন্তান যে নারীর ভাগ্যে জুটেছে সেতো সুখের সাগরে ভাসবেই। বয়স সন্ধিক্ষণের মধ্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যে নারীর প্রেমিক স্বামী নিত্যই ডিজিটাল প্রেমের পসরা সাজিয়ে মনের পরতে পরতে হিল্লুল জাগায় সে নারীর এত সুখ সইবেতো ?”
লিলিয়ানা নিজের রুমে ফেসবুক খুলে সেই ছেলেটির ছবি মেলে ধরে চোখের সামনে। কি করবে সে ভেবে পায়না। বিশেষ করে ছেলেটি সিলেটের হয়ত এ কারণে অনুরাগের এক তীব্র যাতনা অনুভব করে মনের গভীরে। ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পাঠায়, কি জানি কি ভাববে ছেলেটি? হয়ত ভাববে বেহায়া মেয়ে কোন কূ-মতলব নিয়ে রিকোয়েষ্ট পাঠিয়েছে। তারচেয়ে এই ভাল ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্টের পাশাপাশি ম্যাসেজে কিছু লিখে জানানো তাহলে হয়ত ব্যাপারটি স্বাভাবিক ঠেকবে। অগত্যা লিখেই ফেলে ” আমি লিলিয়ানা, জন্ম নিয়েছি এবং বড় হয়েছি সিলেটের আলোবাতাসে। ফেসবুকের টাইমলাইনে আপনার পরিচয় পেলাম। মাষ্টারস্ নিয়েছি, ইউ.কে-তে পিএইচডি করার ইচ্ছে। এ ব্যাপারে যদি কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন তাহলে উপকৃত হব।
ঘন্টাখানেক পর উত্তর আসে, খুশী হলাম জেনে যে আপনার পড়াশুনা ও বড় হওয়া সিলেটের পবিত্র মাটিতে। যে বিষয়ে ডক্টরেট নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন সে ব্যাপারে জানাবেন। সাথে একটি বায়োডাটাও পাঠাবেন। এখানের একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে আপনার কাগজপত্র দাখিল করব এবং কর্তৃপক্ষের পছন্দ হলে নিয়মকানুন ইত্যাদি জানিয়ে সরাসরি আপনার সাথে যোগাযোগ করবে। স্বীকার করছি নামটা কিন্তু আপনার বেশ রোমান্টিক আর নামের সাথে ছবিটিরও যথেষ্ট মিল রয়েছে। উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম ... প্রিন্স।
সাথে সাথে উত্তর লিখতে বসে লিলিয়ানা ” ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্টে তড়িৎ সাড়া দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। মা বাবার সাথে আলাপ করে পড়াশুনার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে বিস্তারিত জানাব। নূতন চাকুরীতে ঢুকেছি, কিছুদিন দেরী হবে পাঠাতে। আপনার নামের সাথে ফটোর কিন্তু অদ্ভূত মিল রয়েছে। দেখতে কিন্তু আপনি সত্যিই প্রিন্সের মত ..... লিলিয়ানা।
সাথে সাথে উত্তর। ফটো দেখে আর নামটি জেনে গুণগানে মত্ত হবেননা। আসলে আমি হতভাগ্য। প্রবাসে একা পড়ে আছি মা বাবার কঠিন শর্তারোপের প্রেক্ষিতে। যে কোন মূল্যে পিএইচডি নিতে হবে। মা বাবার স্বপ্ন পূরণের লক্ষে এখানে এসে আটকা পড়েছি। রাতদিন পড়াশনা আর গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। মা বাবার ইচ্ছে ছিল ”টি টেকনোলজিতে” পিএইচডি নেই। তাই দিনরাত শুধু চা গাছগুলোর জীবনের নূতন রহস্য উদ্ভাবনে ব্যস্ত থাকতে হয়। বলছিলেন চাকুরীতে ঢুকেছেন। কোথায় সে চাকুরী তাতো জানাননি? নিঃসংকোচে আমাকে একজন ভাল বন্ধু হিসাবে ভাবতে পারেন... প্রিন্স।
”আপনার গবেষণার সাথে আমার চাকুরীর সম্পর্ক আশ্চর্য্যজনকভাবে মিলে গেছে। ঢাকাস্থ ”চা-শ্রমিক কল্যাণ ট্রাষ্ট” পরিচালিত একটি এনজিও-তে ট্রেইনার হিসাবে কর্মরত। চা-শ্রমিকদের সন্তানদেরকে অন্ধকার জগত থেকে আলোর রাজ্যে প্রবেশ করানোর কাজ হাতে নিয়েছি। মাত্র কিছুদিন হল চাকুরীর। আমাদের পরিচালকও একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা। আমাকে মায়ার জালে আবদ্ধ করে রেখেছেন। আর হ্যাঁ, আপনাকে বন্ধু ভাবতে আপত্তি নেই তবে মনে রাখবেন আমি যে মা বাবার ঔরসে জন্ম নিয়েছি তারা আমাকে আদর্শ ও বিশ্বাসের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন। আদর্শের গন্ডি যদি অতিক্রম করেন তাহলে বন্ধু হিসাবে পাবেননা ...... লিলিয়ানা।
বেশ কিছুদিন দেরী হয়ে গেল আপনার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিনি বলে দুঃখিত। আমার গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম। এর উপর আলোকপাত করতে আমাদের টিম ম্যানেজমেন্ট একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল তাই ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। এদিকে মায়ের আবদার আগামী গরমের ছুটিতে দেশে যেতে হবে। আমার ছোট বোন সা’রাও এসময়ে চীনের সাংহাই হতে ছুটিতে দেশে ফিরছে। তাই ভাবছি ছুটিতে দেশে যাব। আর হ্যাঁ- বিশ্বাস করি আদর্শে এবং মেনেও চলি। আদর্শের গন্ডি অতিক্রম করার সুযোগ নেই। আমার পিতামাতা আমাদের দু’ভাইবোনকে এ মন্ত্র শিখিয়েছেন বলেই হয়ত পদস্খলনের পথ খুঁজে পাইনি। হৃদয়ের ভালবাসা, কর্তব্যবোধ, শ্রদ্ধা, ভক্তির অপচয় না করার নামইতো আদর্শ। আর হ্যাঁ, খুব ভাল লাগল আপনার পরিচালক মহিলাটি আপনাকে ভালবাসেন বলে, নামটা জানতে পারি কি? কারণ আমি সিলেটের ছেলে। চা-শ্রমিক কল্যাণ ট্রাষ্ট্রের পরিচালক একজন মহিলা। আমার গবেষণায় একজন মহিলা উদ্যোক্তার বিষয়ও কাজে লাগতে পারে।..... প্রিন্স।
”অনেক প্রতীক্ষিত চিঠি পেলাম। আপনার আদর্শের সাথে আমার আদর্শের বহুলাংশে মিল রয়েছে জেনে আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ক্রমেই বেড়ে চলছে। দেশে আসলে দেখা হবে সে প্রতীক্ষায় থাকব। আর আমার পরিচালকের নাম সায়রা খাতুন। একজন নীতিবান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা যাকে দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়। যার সহচর্য্য কাজে প্রেরণা যোগায়, শক্তি যোগায়। আপনার গবেষণায় এ ধরণের একজন মহিলা উদ্যোক্তাকে নিয়ে ভাবলে নিশ্চয়ই গবেষণা ফলপ্রসু হবে ..... লিলিয়ানা।
প্রায় দু’মাস গত হয়ে গেল প্রিন্সের কাছ হতে কোন উত্তর আসেনি যদিও এরই মধ্যে কয়েকবার লিলিয়ানা ফেসবুকে প্রিন্সকে লিখেছে, জানতে চেয়েছে নিরবতার কারণ কি ? না তার কোন কথায় অসন্তুষ্ট হয়েছে। একধরণের শূন্যতা মনকে অচ্ছন্ন করে। কি যেন হারিয়ে ফেলেছে লিলিয়ানা। ওকে এত বেশী বেশী মনে পড়ছে কেন ? এটা কি অনুরাগ নাকি নিছক আগ্রহের অভিব্যক্তি ?
লিলিয়ানাকে অফিসে ডেকে পাঠান মিসেস সায়রা খাতুন। জরুরী তলব। ব্যাপারটি ভাল ঠেকছে না। কি এমন হতে পারে? কারোর নালিশের প্রেক্ষিতে কি জরুরী তলব করেছেন, নাকি ট্রেনিং সেন্টার নিয়ে কোন পরামর্শ করতে চান ? সাতসতেরো চিন্তা নিয়ে বনানীর অফিসে প্রতীক্ষা করে লিলিয়ানা।
মিসেস সায়রা খাতুন অফিসে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ায় সে। ঈশারায় রুমে আসার আহ্বান জানান। রুমে ঢুকতেই কাছে ডেকে বলেন বাসায় মেহমান আসবে তাই এখনই আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। সরকারপক্ষের দু’তিনজন অফিসার আসবেন আমাদের প্রজেক্টের খোঁজখবর নিতে। তুমি আমার চেয়ারে বস এবং ওরা এলে আমাদের ট্রেনিংসেন্টারের বিস্তারিত তথ্য দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করবে, কেমন ? আগামী তিনদিন তোমাকে আমার চেয়ারে বসতে হবে। সামলে নিতে পারবেনা ? আশা করি এতে তোমার কোন আপত্তি নেই, কি বল?
নত মস্তকে লিলিয়ানা সম্মতি জানায়। সায়রা খাতুন কাছে এসে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলেন লক্ষী মা আমার, চিনতে আমি ভুল করিনি।
আমাকে এখনই বেরোতে হবে। ত্রস্তপদে বেরিয়ে পড়েন সায়রা খাতুন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
তিনদিন পর লিলিয়ানার কাছে ফোন আসে। ওপ্রান্তে সায়রা খাতুন। মা আজতো অফিস বন্ধ, বিকেলে তোমার পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে আমার বাসায় তোমাদের দাওয়াত। অবশ্যই আসবে সকলকে নিয়ে। তোমার আম্মুকে দাও, উনাকে আমি বুঝিয়ে বলছি।
লিলিয়ানার বস অনুনয় বিনয় করে দাওয়াত দিয়েছেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতে। ড্রাইভার বিকেল চারটায় নিতে আসবে। কি করবো এখন ? উৎকন্ঠিত রেবেকা।
কি আর করবে। ভদ্রমহিলা মেয়ের বস্। প্রথম ডেকেছেন। ওদেরকে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বল। আমি কয়েকপাতিল মিষ্টি নিয়ে আসি এর মধ্যে।
বিকেল চারটায় ড্রাইভার এসে গেটের কলিংবেল টিপল। পরিবারের সবাই গাড়ীতে উঠতেই গন্তব্যের পানে গাড়ী ছুটে চলল। রাস্তায় যানজট থাকায় পৌঁছাতে আধঘন্টা দেরী হল। সায়রা খাতুন ও স্বামী আক্তার সাহেব মাসহুদ পরিবারকে রিসিভ করে ড্রইংরুমে বসালেন। আবসরপ্রাপ্ত আক্তার ও মাসহুদ সাহেব সিলেটের কর্মবহুল জীবন ও স্মৃতি রোমন্থন নিয়ে ব্যস্ত। অন্যপ্রান্তে রেবেকা ও সায়রা অতীত স্মৃতি নিয়ে খোশগল্পে ব্যস্ত। ড্রাইভার মিষ্টির হাড়িপাতিল নামিয়ে ভেতরে চালান দিচ্ছে। লিলিয়ানা, ডেভিড এবং ইমানুয়েল নিম্নস্বরে একে অপরের সাথে কথা বলছে।
তাদের সকলকে হতভম্ভ করে দিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করে আক্তার তনয়-তনয়া। লিলিয়ানার মুখে কথা জোগায়না। একি দেখছে সে। সেই মুখ সেই চোখ। লিলিয়ানার দিকে একপলক তাকিয়ে ছেলেটি চোখ নামায়। ইমানুয়েল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। ভাইবোন এবং তাদের মা বাবাকে স্রষ্টা যেন নিজ হাতে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সৃষ্টি করেছেন।
আক্তার সাহেব সবাইকে স্তম্ভিত করে হঠাৎ কথার বোমা ফাটালেন - মিষ্টি খাওয়া সুন্নত আর তার আগে ফরজ কাজটা পাকাপোক্ত করতে চাই। আমার ছেলে প্রিন্স লিলিয়ানার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার দায়িত্ব দিয়েছিল তার মাকে তিনমাস পূর্বে যিনি লিলিয়ানা এবং আপনাদের সম্মন্ধে ভালভাবে তথ্য নিয়েছেন। লিলিয়ানা ও প্রিন্স একে অপরের ফেসবুক ফ্রেন্ড। আমি নিজেও প্রিন্সের মামাকে নিয়ে গত পরশু স্ত্রীর বনানী অফিসে লিলিয়ানার সাথে গল্পগুজব করে গিন্নী এবং ছেলের পছন্দের তারিফ করেছি। এখন আপনারা যদি দয়া করে সম্মতি জানান তাহলে আপনাদের আনা মিষ্টি পেট ভরে খেতে রাজী যদিও ডাইবেটিকের প্রভাব আছে আমার শরীরে।
মাসহুদ-রেবেকা বিস্ময়ে বিমুঢ়। সহসা কথা জোগায় না। মাসহুদ সাহেব আক্তার সাহেবের কথার উত্তরে একটু ইতস্তত: ভাব ফুটিয়ে বলেন, দেখুন আমার কথা হল যখন ”মিয়া বিবি রাজী তো কিয়া করেগা কাজী”। সবাই হেসে উঠলো একসাথে মাসহুদ সাহেবের মন্তব্য শুনে।
তাহলে বেয়াই আরেকটি ফরজ কাজ একসাথে সেরে নিতে চাই। ভাবছি এবার হজ্জ্বে যাব আমরা দু’জন একত্রে। এর আগে দায়িত্ব সেরে নিতে হবেনা? লিলিয়ানার কাছে সেদিন অফিসে জানতে পারলাম ইমানুয়েল বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছে। স্কলারশিপে নাকি পিএইচডি করতে শীঘ্রই আমেরিকা যাচ্ছে। এদিকে আমার সা’রাও সাংহাই হতে আকুপাংচারের উপর সর্বশেষ ডাক্তারী ডিগ্রি নিতে গেলে আরও তিনবছর সময় লাগবে। এখন ছেলেপক্ষের মতামত পেলে সবকাজ ভালয় ভালয় সম্পন্ন হয়।
রেবেকা তুমিই বল ? তুমিতো ছেলের মা। ছেলের উপর তোমার দাবী বেশী। আমিতো আমার মেয়েকে দিয়েই দিয়েছি। এবার তোমার ইচ্ছে হলে বাকী কাজটা সম্পন্ন কর।
দেখুন বড় ছেলে ডেভিডের জন্য তার সহকর্মী খবরপাঠিকা শামিমা চৌধুরীর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ইমানুয়েল বিদেশ যাওয়ার পূর্বে মা সা’রার সাথে বিয়ে দিতে আমাদের আপত্তি নেই যদি সা’রার আপত্তি না থাকে। মা সা’রাতো আমাদের আদিমাতা ইব্রাহীম (আঃ) এর স্ত্রী ছিলেন। তাই জীবন্ত সা’রা মাকে যদি আমরা পুনরায় মা হিসাবে কাছে পাই তাহলে আমাদের ছেলের গৌরব বাড়বে বই কমবেনা। সবিনয় যুক্তি রেবেকার।
তাহলেতো সব হয়েই গেল। ঘরের ছেলেমেয়ে ঘরেই রইল। ঠিক আছে বেয়াই-বেয়াইনের মধ্যে ছেলেমেয়েরা বসে থেকে সময় নষ্ট করবে কেন? তাদেরও একে অপরেকে জানার কৌতুহল আছে। বাবা মারা তোমরা তোমাদের রুমে গিয়ে গল্পগুজব কর, একে অপরকে ভালভাবে জান - স্নেহমেশানো কন্ঠে বললেন মাসহুদ সাহেব। কথাটি সাপোর্ট করেন আক্তার সাহেব, সায়রা খাতুন ও রেবেকা।
নতমস্তকে সবাইকে সালাম জানিয়ে অন্দরে প্রবেশ করে প্রিন্স-লিলিয়ানা, ইমানুয়েল-সা’রা আর ডেভিড আধঘন্টার সময় নিয়ে বাইরে যাওয়ার অনুমতি চায়।
মাসহুদ সাহেব বলে উঠেন বেয়াই-বেয়াইন কি ভয়ানক চালাক। এ তূলনায় আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই পিছিয়ে। গুপ্তচরের মুখোশ পরে বেয়াই অফিসে গিয়ে আমার মেয়েকে চূলচেরা বিশ্লেষণ করে এলেন আর বেয়াইন সে সুযোগ করে দিলেন। কিন্তু বেয়াই মনে রাখবেন আমরা দু’জন কিন্তু এখন ডিজিটাল প্রেমিক-প্রেমিকা। সামনে কিছু বলিনা কিন্তু মোবাইলে প্রেমের চিঠি আদান-প্রদান হয়।
ওহ্, এই কথা? আমরা দু’জনতো গত পাঁচবছর যাবত প্রেমের কথা বিনিময় করি মোবাইলে। আপনার বেয়াইন অফিস করেন, আমি বাসায় একা প্রহরীর কাজে নিয়োজিত। বলতে পারেন অসহায় কর্মক্লান্ত এক সৈনিক। এ সমস্যা সমাধানে আপনার বেয়াইনই আবিষ্কার করলেন মোবাইলে প্রেমের চিঠি লিখে আমাকে জিইয়ে রাখবেন। এখন আর নিঃসঙ্গ অনুভব করিনা। প্রতিদিন চিঠি পাই, মনের মাধুরী মিশিয়ে উত্তর লিখে সময় কাটাই। তবে একটা কথা বেয়াই, ছেলেমেয়েদের সুন্দর সুন্দর নাম রাখার ব্যাপারে আপনারা কিন্তু এগিয়ে এটা অকপটে স্বীকার করছি।
আবারো হেরে গেলাম, বেয়াই ক্ষিপ্ত হয়ে চিঠির চড় কষিয়ে বসালেন আমার গালে নির্দয়ের মত। ঠিক আছে, এবার আরেকটি প্রস্তাব আপনাদের কাছে রাখছি। আগামী কিছুদিনের মধ্যে ওরা ছুটি কাটানো অবস্থায় আমরা চার বেয়াই-বেয়াইন সিঙ্গাপুরে হ্যানিমুন করে আসি। বিমানের প্রাক্তন ম্যানেজার হিসাবে টিকেট ও হোটেলের দায়িত্ব আমার। আপনার বেয়াইন কতবার খোঁটা দিয়েছেন বিয়ের পর কোথাও নিয়ে যাইনি বলে।
আমি রাজী, আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন আক্তার সাহেব। বেয়াইনরাও হাত তুলে সম্মতি জানান।
তাহলে আর দেরী কেন ? বিয়ের পরপর চিঠির প্রতীক্ষায় কেটেছে ক্ষণ, কল্পনায় সাজিয়েছি বাসর, গেঁথেছি মালিকা, নববধূকে কাছে না পাওয়ার বিরহে উদাস মনের গভীরে বয়ে চলা রক্তক্ষরণ নিয়ে কাজে ডুবে থাকতে হয়েছিল। এখনতো আমাদের দু’পক্ষের কর্তব্য শেষ। তাই জীবনের মধ্যখানে এসে পুরানো ক্ষতের দাগ শুকাতে শুরু করতে চাই নূতন করে ডিজিটাল প্রেম - ঠিক বলিনি বেয়াই।
ঠিক বলেছেন, বেয়াই। ঐ যে ভদ্রমহিলাকে দেখছেন, লিলিয়ানার গম্ভীর বস্, আমাকে কি কম জ্বালিয়েছেন ? আমাকে জ্বালিয়ে উনি খুব আনন্দ পেতেন। ইচ্ছে করে কৃত্রিম অভিমানে মুখ গোমরা করে বসে থাকতেন আর আমি ঐ গোমরা মুখে হাসি ফুটানোর জন্য কি না করেছি তা বলাই বাহুল্য। আসলে বেয়াই, আমি ছিলাম বোকা, না হলে কেনই বা ভাবতাম অভিমান শুধু উনারই প্রাপ্য।
উল্লাসিত হাসির তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরময়.....।