Thursday, September 24, 2020

সম্ভাষণে আশীর্বাদের ছোঁয়া (প্রতিবেদন) MUST READ


MUST READ

সম্ভাষণে আশীর্বাদের ছোঁয়া

- নাজমুল চৌধুরী

ভোরের আবছা আলোতে প্রার্থনার পালা শেষ করে কমপক্ষে এককিলোমিটার প্রাতঃভ্রমন আমার অভ্যাস। যৌবনের উদ্দাম দিনগুলোতে মধ্যে মধ্যে যাওয়া হত কোন বন্ধুবান্ধবের আমন্ত্রনে অর্থাৎ বিশেষ উপলক্ষে। তখন ভোরের আবেশজড়ানো ঘুম পরিত্যাগ করা কষ্টকর ছিল বটে কিন্তু ভোরে বাড়ি এসে বন্ধুদের ডাকাডাকি উপেক্ষা করাটাও ছিল কঠিন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে জটিল রোগ উঁকিঝুকি দিতে শুরু করে এবং ক্রমেই তা ডালপালা বিস্তার করে। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পেতে শুরু করে যার জন্য ডায়াবেটিক, উচ্চ-রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, কিডনীজনিত সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদির যেকোন দু’টো বা তিনটি একই সাথে অস্থিত্বের জানান দেয়। এ ধরণের রোগ থেকে মুক্তির প্রাথমিক শর্ত ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসে একনাগাড়ে আধঘন্টা হাঁটা, মৃদু ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়া যাতে রক্তসঞ্চালনের মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সজীব থাকে। কথায় আছে ভোরের বাতাসে একশো একটি রোগের উপশম নিহীত আছে। তাই যুগে যুগে জ্ঞানীজনেরা ভোরের বিশুদ্ধ বাতাস সেবনের জন্য প্রাতঃভ্রমণের তাগিদ দিয়েছেন।
বাসার সামনের রাস্তাটি প্রতিদিন ঝাড়ু দেয় মধ্যবর্ষী এক মহিলা। রাত তিনটেয় ঝাড়ু দেয়া শুরু করে, কাজ শেষ হয় সকাল ছ’টায়। প্রতিদিন একটানা তিনঘন্টা পরিচ্ছন্নতার কাজ করে আসছে এই মহিলাটি, গত ২০ বছরে একটি দিনের জন্যও সে কাজ ফাঁকি দিতে দেখিনি। ঝড়ো হাওয়ায়, বৃষ্টিতে ভিজে তার কর্তব্য পালন করে আসছে। কোনদিন সে অসুস্থ হয়নি? জ্বর, সর্দি, কাশি, কোমরে ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা এধরণের রোগ গত বিশ বছরে তাকে কাবু করতে পারেনি। এর পেছনে রহস্য কোথায়? একটিই কারণ আমার চোখে ধরা পড়ে। বেচারী রাত তিনটেয় ঝাড়ুর কাজ শুরু করে, কি শীত কি গ্রীষ্ম। প্রভাতের বিশুদ্ধ বাতাস সেবনের কারণে সে অসুখমুক্ত। মধ্যে মধ্যে তাকে দেখলে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করি, কখনো কিছু টাকা বখশিস দেই আমার নিজস্ব স্বার্থে। খুশী মনে সে আমার গেটের সিংহদুয়ারের সামনে বাতাসে উড়ে আসা কাগজপত্র, পলিথিন অপসারণে নিজ থেকেই সচেষ্ঠ থাকে।
পূ্বআকাশে সূর্যের রক্তিম আলোর রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তড়িগড়ি করে গেট খুলে পাকা রাস্তায় নেমে পড়লাম। পাড়ার মধ্যবয়সী মহিলা ও পুরুষরা ২০ ফিট পাকা রাস্তায় কেউ একাকী নেমে পড়েছে আবার কেউবা যুগলবন্দী হয়ে একনাগাড়ে হাঁটছে। সামনে পড়ল শ’খানেক মাদ্রাসার ছাত্র সারিবদ্ধভাবে হাঁটার দৃশ্য। প্রত্যেক ছাত্র আমাকে সামনে পেয়ে হাত তুলে একে একে সবাই বলল – আসসালামু আলাইকুম (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। হাতটা নামাতে পারছিলামনা, একে একে প্রত্যেকের সালামের প্রত্যুত্তর দিলাম – ওয়া আলাইকুম ওয়াসসালাম ওয়া রাহমাতুলিল্লাহি (তোমাদের উপর আল্লাহর শান্তি ও করুণা বর্ষিত হোক)। এটা তাদের প্রাপ্য, সালামের পরিবর্তে শান্তি কামনা ও দোয়া। কচি কচি বাচ্চারা কি ভদ্রভাবে হেঁটে যাচ্ছে, ঝগড়া নেই, মারামারি কিংবা ধ্বস্থাধস্থি নেই, গালিগালাজ নেই – শৃঙ্খলিতভাবে ওরা হাঁটছে, আগে পিছে দু’জন শিক্ষক তাদের পাহারায়। কি সুন্দর দৃশ্য। মাথায় ওদের প্রত্যেকের কিস্তি বা গোল টুপি। ভদ্রমার্জিত আচরণ, নৈতিক মূল্যবোধে বিকশিত কিশোররা। অথচ আধূনিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের কাউকে রাস্তায় চোখে পড়েনা। আদুরে ছেলেমেয়েরা তখনো গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত, সাথে সাথে তাদের পিতামাতারা ও সুখনিদ্রায় হয়তো বিছানায় লেপটে আছে।
পথে পাড়ার কয়েকজন হিন্দু ধর্মের অনুসারী প্রতিবেশীদের সাথে দেখা হল, ওরা সাক্ষাতে বলল, আদাব আবার কেউবা নমস্কার। একই কায়দায় তাদেরকে তাদের নিয়মে অভিবাদন জানালাম। আমার বাসার গেটের সামনের দু’টো বৃহদাকার টবে লাল ও বেগুনী রংয়ের অজস্র সন্ধ্যামালতী তখনো কয়েকটি গাছে ফুটে আছে, সূর্যের আলো গায়ে লাগলে লজ্জ্বায় সংকুচিত হবে, পুনরায় বিকালের দিকে গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠবে। গেটের উপরিভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাধবীলতার সারি সারি লতাগুচ্ছ। লালবেগুনী গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের সমারোহ। প্রভাতের মৃদুমন্দ বাতাসে নাসিকার রন্দ্রপথে অবাধে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে নিরন্তর। হিন্দু মহিলাদের দু’জন সাজি হাতে ফুলগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। পূজোর জন্য কিছু ফুল নিতে চাই, দেবেন? হেসে বললাম, অবশ্যই নেবেন, ওদেরকে ডালিতে সাজিয়ে পূজোঅর্চনা করবেন একারণে ওদের ফুটে থাকাটা স্বার্থক হবে তবে গাছগুলো অক্ষত রাখবেন। এভাবেই শেষ হল অদ্যকার এক কিলোমিটার হাঁটা।
আজ আমি কয়েকটি ধর্মীয় সম্ভাষণের কথা লিখব বলে ভাবছি। আজকের প্রাতঃভ্রমণের শুরুতে মাদ্রাসার শ’খানেক ছাত্রদের সালাম বিনিময় বা অভিবাদন আমাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। তাদের অন্তরনিংড়ানো অভিবাদনের মাধ্যমে আশীর্বাদের ছোঁয়া আমি পেয়েছি যা হৃদয়কে আপ্লুত করেছে। বিভিন্ন ধর্মের অভিবাদনের রীতিনীতির রকমফের পরিমাপের ভারটা পাঠকের উপরই ছেড়ে দিতে চাই। উৎকৃষ্ট অভিবাদনের সারসংক্ষেপ বিচার্যে প্রধান চারটি ধর্মের রীতিনীতির মধ্যে কোনটি অধিকতর মার্জিত ও আশীর্বাদসরূপ গ্রহণযোগ্য তা নিরূপণের ভার পাঠকদের উপর।
খ্রিষ্ট ধর্মে সম্ভাষণের বিধানঃ
সকাল হতে শুরু করে দুপুরের পূর্বে সমগোত্রের/ভিন্নগোত্রের পরিচিত কারোর সাথে দেখা হলে প্রাথমিক সম্ভাষণঃ গুড মনিং (শুভ সকাল), দুপুরের পর দেখা হলেঃ গুড আফটারনুন (শুভ অপরাহ্ন), বিকেলে দেখা হলেঃ গুড ইভিনিং (শুভ বিকাল), রাতে দেখা হলে বা ঘুমুতে যাওয়ার প্রাক্কালে কারোর সাথে দেখা বা শেষ বাক্য হিসাবেঃ গুড নাইট (শুভ রাত্রি)।
উত্তরে ২য় ব্যক্তি একই সম্ভাষণ ব্যবহার করবে অর্থাৎ শুভ সকাল, শুভ অপরাহ্ন, শুভ বিকেল এবং শুভ রাত্রি কিংবা হাত নেড়ে হাই, হ্যালো কেমন আছেন।
এদের প্রত্যেকটি অভিবাদনে শুভ, হাই, হ্যালো ইত্যাদি শব্দের ছড়াছড়ি আছে কিন্তু আশীর্বাদের বা ‍দোয়ার কোন বহিঃপ্রকাশ নেই।
মুসলিম ধর্মের সম্ভাষণঃ
সামনাসামনি দেখা হওয়া মাত্র একজন মুসলিম পরিচিত/অপরিচিত অন্য মুসলিম ব্যক্তিকে কিংবা কারো গৃহে প্রবেশকালে যাকে সামনে পাবে কিংবা গৃহ হতে বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে, বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রথম সম্ভাষণ হিসাবে মুসলিমরা অন্য মুসলিমকে যে অভিবাদন জানায় তা হলঃ
১ম ব্যক্তিঃ আসসালামু আলাইকুম (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)।
২য় ব্যক্তি উত্তরেঃ ওয়া আলাইকুম ওয়া্স্ সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি (আপনার উপর আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক)। এখানে ১ম জনের উত্তরে ২য় ব্যক্তি “ওয়া আলাইকুম ওয়াস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি” বলে সম্ভাষণ করেছে অর্থাৎ ২য় ব্যক্তি একটি বাক্য অতিরিক্ত বাক্য সংযোজন করেছে। ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহি” অর্থাৎ ১ম ব্যক্তির উত্তরে ২য় ব্যক্তি শান্তির সাথে সাথে ‘রহমত বর্ষিত হোক’ যুক্ত করেছে।
হাদিসে আছে তোমরা ১ম জনের সালামের উত্তরে উত্তম সালাম দিবে। ২য় ব্যক্তিটি এখানে উত্তম সালাম প্রয়োগ করেছে।
১ম ব্যক্তি যদি ২য় ব্যক্তির ন্যায় প্রথম সাক্ষাৎে একটু লম্ভিত সম্ভাষণ করেঃ আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুললাহি ওয়া বারাকাতুহ (আপনার উপর শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক)।
এক্ষেত্রে ২য় ব্যক্তি প্রতিউত্তরে বলবেঃ ওয়া আলাইকুম ওয়াস্ সালাম ওয়া রাহমাতুললাহি ওয়া বারাকাতুহ ওয়া মাগফেরাতু (আপনার উপরও শান্তি, রহমত, বরকত ও পরকালে ক্ষমা বর্ষিত হোক)। এখানে ২য় ব্যক্তিটি প্রত্যুত্তরে শান্তি, রহমত, বরকত ও “পরকালে ক্ষমার কথা” উল্লেখ করেছে। ১ম ব্যক্তিকে ২য় ব্যক্তি গুণবাচক অতিরিক্ত ”পরকালে ক্ষমা“ কামনার মতঅতিরিক্ত শব্দ প্রয়োগ করেছে।
উপরোক্ত অভিবাদনের প্রত্যেকের উক্তিতে সম্মান, শ্রদ্ধা ও আশীর্বাদ বা দোয়া পরিস্ফুটিত হয়েছে।
হাদিসে ও কু’রআনে বর্ণিত আছে, তোমরা একে অপরকে উৎকৃষ্ট সম্ভাষণ করো অর্থাৎ ১ম ব্যক্তি হতে ২য় ব্যক্তির সম্ভাষণ উৎকৃষ্ট হতে হবে। আমাদের দেশে বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে বড়রা ছোটদের কাছে প্রথম সালাম আশা করে কিন্তু ইসলাম ধর্মে ছোটবড় ভেদাভেদ করা যাবেনা। ছোটদেরকেও বড়রা দেখা হলে প্রথমে সালাম করবে। যেহেতু সালাম একটি আশীর্বাদ বা দোয়া। ছোটবড় প্রকারভেদে এ দোয়া করা আবশ্যকীয়। ছোটরা বড়দের কাছে শিখবে তাই ছোটদেরকে ছোট বলে অবহেলা বা উপেক্ষা করা যাবেনা। ছোটবড় নির্বিশেষে সালাম বিনিময় ইসলামের বিধান হিসাবে স্বীকৃত।
হিন্দু/বৌদ্ধ/জৈন ধর্মের অনুসারীদের সাথে দেখা হলে মুসলিমরা তাদেরকে সম্ভাষণ করেঃ (আদাব বা নমস্কার নিবেদন), ঠিক যেমনটি উক্ত ধর্মের অনুসারীরা মুসলিমদেরকে করে থাকে।
”আদাব” শ্রদ্ধা নিবেদন হিসাবে ব্যবহৃত হয় তবে এ শব্দে আশীর্বাদ বা দোয়ার কোন ইঙ্গিত নেই।
খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীদেরকে তাদের সম্ভাষনের অনুরূপ (শুভ সকাল, শুভ অপরাহ্ন, শুভ বিকেল এবং শুভ রাত্রি কিংবা হা্ই, হ্যালো, কেমন আছেন বলে সম্ভাষণ জানায়। এখানেও কোন আশীর্বাদজনিত কোন শব্দ নেই।
ইহুদি ধর্মের অনুসারীদেরকেঃ শুধু স্যালুম (শান্তি) শব্দ দিয়ে অভিবাদন জানানো হয় ঠিক যেমনটি ইহুদিরা অভিবাদন হিসাবে ব্যবহার করে। এখানে আশীর্বাদ হিসাবে ’শান্তি’ উচ্চারিত হয় বটে তবে তা শুধু শ্রদ্ধা বিনিময় হিসাবে, আশীর্বাদ অর্থে নয়।
হিন্দু ধর্মে সম্ভাষণের বিধানঃ
শুধুমাত্র সমগোত্রীয় গুরুজন বা শ্রদ্ধেয় (ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রীয়) ব্যক্তির সাথে দেখা হলেঃ করজোড়ে নমস্কার বা নমস্থে (গভীর শ্রদ্ধা, প্রণাম, নমস্য, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির প্রতি মাথা নত করি)। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কিংবা পূজোঅর্চনায় পন্ডিত ব্যক্তিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম (শুয়ে কপাল ঠেকিয়ে করজোড়ে প্রণাম করার বিধান রয়েছে)।
বৈশ্য এবং শুদ্র নিম্নবর্ণের দলিত হিন্দু হলে ব্রাক্ষণ বা ক্ষত্রিয় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ওদেরকে মুখে, করজোড়ে বা সাষ্ঠাঙ্গে সম্ভাষণ জানানোর বিধান নেই। এক্ষেত্রে পরিচিত হলে কেমন আছ, কি করছ ইত্যাদি বাক্য বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
বৌদ্ধ ধর্মে সম্ভাষণের বিধানঃ
কোন নির্দিষ্ট বিধান নেই। জাপানী ও চায়নীজ বৌদ্ধরা কুঁজো হয়ে মাথা নুয়ে সম্ভাষণ জানায়। ভারতীয়, কোরিয়ান কিংবা অন্যান্য দেশের বৌদ্ধরা তাদের দেশীয় রীতিতে সম্ভাষণ জানায়। তাই সম্ভাষণের প্রকারভেদ সর্বত্র। বৌদ্ধ বা জৈন (বিভক্ত বৌদ্ধ ধর্মের একটি শাখা জৈন)। তাদের কাছে গৌতম বৌদ্ধ এবং তাঁর বাণী সবকিছুর উর্ধে, আলাদা ঈশ্বর বা খোদা বলে কিছু নেই।
আজকের প্রাতঃভ্রমণ আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে কারণ আমাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে ফুল সংগ্রহ উপলক্ষে পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন পূজারী, মাদ্রাসার শ’খানেক ছাত্র এবং মসজিদ ফেরত কিছু মুসল্লি। আমি মাদ্রাসার কচি ছাত্রদের দোয়া বা আশীর্বাদ নিয়ে ঘরে ঢুকেছি। একে একে প্রত্যেকটি ছাত্র সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে বলেছে “আপনার উপর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক”। এই নিষ্পাপ শিশুগুলোর নিঃস্বার্থ দোয়া আমাকে প্রভাতের এই মৃদৃমন্দ বাতাসে এক স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দিল।
আজকাল বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক ধর্মীয় উন্নাসীরা এই কওমী মাদ্রাসা এবং ছাত্রদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন। মাদ্রাসার ছাত্ররা ইংরেজী ভাষা ভাল জানেনা এটা যেন তাদের দোষ। অথচ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আজকাল এই কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদেরকেও ব্যবহারিক ইংরেজী ভাষাও শেখানো হয় যদিও তা পর্যাপ্ত নয়। আর ইংরেজী ভাষা ইংরেজদের ভাষা। এ ভাষায় পন্ডিত হতে হবে তার কোন মানে হয়না। কথাবার্তার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষার চেয়ে মধুর আর কি হতে পারে? এই শিশুগুলো ভোর ৩-০০ ঘটিকা হতে পবিত্র কু,রআন হেফজ্ করতে থাকে এবং তিন বছরের মধ্যেই তারা মহাগ্রন্থ ৬৬৬৬ পৃষ্ঠার কু’রআন মুখস্ত করে ফেলে। এদের চরিত্র হয় নির্মল ,আদব-তমিজ, গুরুজন, শিক্ষক, প্রতিবেশী এবং পিতামাতার প্রতি তাদের চমৎকার ব্যবহার সকলের দৃষ্টি কাড়ে।এরা কখনো খুন, খারাপী, ধর্ষণ, মদ্য পান, জুয়া ইত্যাদি কূকর্মের সাথে যুক্ত নয় যেহেতু ধর্মীয় অনুশাসন তাদের বিবেক বুদ্ধিকে জাগ্রত করে। পরিত্র কু’রআনের অমৃত বাণী পান করে তারা হয়েছে বিশুদ্ধ ও খাঁটি। পক্ষান্তরে দেখা যায় ইহুদিদের চাপিয়ে দেওয়া অনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা বেশীরভাগ ছাত্রদেরকে সমাজে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। কিভাবে ইহুদি রাব্বী/রাবাই সম্প্রদায়ের হাজার বছর আগে জ্যান্টাইল সমাজে (ইহুদি নয় এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি) এমন অনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে তার প্রমাণ নিম্নে প্রদত্ত হল। পাঠক লক্ষ করুন, হাজার বছর আগে ইহুদি প্রটোকলের দিকে যা বর্তমান বিশ্বে ইহুদিদের একটি গোপন সংবিধান বলে বিবেচিত। এ সংবিধানের ৪০-৪৫ টি প্রটোকল বর্তমানে অগোছালোভাবে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
ক) জ্যান্টাইলদের সাথে আমাদের পার্থক্য হচ্ছে, আমরা হলাম সৃষ্টিকর্তার মনোনীত সম্প্রদায় এবং মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ট। জ্যান্টাইলরা হচ্ছে দু’পায়ে ভর করে চলা পশুসদৃশ, তাদের না আছে দূরদৃষ্টি আর না আছে নিত্যনূতন আবিষ্কারের ক্ষমতা, তাই সৃষ্টিকর্তা আমাদের হাতে এ পৃথিবীর শাসনভার তুলে দিয়েছেন। জ্যান্টাইলদের চরিত্রগত দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যে তাদের মধ্যে আমরা বিভাজনের দেয়াল সৃষ্টি করতে পেরেছি।
খ) ওদের যুবসমাজের বুদ্ধিবৃত্তি, চিন্তাশক্তি এবং নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস করার লক্ষে আমরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা ওদেরকে গ্রহণ করাতে সক্ষম হয়েছি যা আমাদের যুবসমাজের শিক্ষাব্যবস্থা ও মূল্যবোধ চর্চার ক্ষেত্রে আমরা তা কখনো গ্রহণ করবনা।
গ) জ্যান্টাইল দেশসমূহের শিক্ষাব্যবস্থাকে জ্যান্টাইলদের যোগ্যতা যাচাইয়ের মাফকাঠিতে পরিগণিত করব। কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্বে নিম্নমানের এই শিক্ষাব্যবস্থা তাদের মধ্যে অহংকার এবং যোগ্যতার মানদন্ডে বিভক্তির সৃষ্টি করবে যা একসময় পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্ক চিহ্ন করতে উৎসাহিত করবে। জ্যান্টাইল যুবসমাজের নৈতিকবোধ, বুদ্ধিবৃত্তি, স্বাধীন চিন্তাশক্তি ধ্বংস করতে আমরা ইতোমধ্যে তাদের ওপর এক অবাস্তব, অযৌক্তিক ধমীর্য় অনুশাসন বিবর্জিত এক শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছি। ফলে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট একেবারেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
ঘ) আমরা অতি প্রাচীনকাল থেকেই স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব এ ধরণের মতবাদকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে আসছি কিন্তু জ্যান্টাইলদের বোকা গর্দভরা এ মতবাদগুলোকে অধিকার আদায়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে আসছে।
ঙ) আমরা তাদের কাছে প্রগতির সিড়ি হিসাবে যা উপস্থাপন করেছি যা তারা সাদরে গ্রহণ করেছে এবং এসমস্ত বিভিন্ন মতাদর্শের মাধমে তাদের মধ্যে বিভক্তি ও নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস করেছি এবং সামনের দিনগুলোতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
চ) উদারপন্থী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মুক্তমনা ইত্যাদি নীতিবাক্য ব্যবহার করে জ্যান্টাইলদেরকে বিভিন্ন মারপ্যাঁচের মধ্যে আমরা ডুবিয়ে রাখব। তারা উদারপন্থী নীতিবাক্য প্রগতির জন্য প্রয়োজন বলে মনে করবে কিন্তু এরা এতই নির্বোধ যে প্রগতির আসল সত্য তাদের কাছে অধরাই থেকে যাবে।
ছ) পৃথিবীর সকল শক্তিশালী রাষ্ট্রকে টার্গেট করে তাদেরকে অবনত করে আমরা রাজা ডেভিডের (দাউদ নবী) সিংহাসন পুনরুদ্ধার করব। পৃথিবীর বুকে এই রাজবংশের ধারা হিসাবে আমরা আজও বিদ্যমান। বিজ্ঞ, বিচক্ষণ ও শিক্ষিত প্রত্যেক ইহুদি ব্যক্তিই এই রাজবংশের উত্তরাধিকারী, যাদের উপর পুরো বিশ্বের শাসনভার অর্পণ করা হয়েছে।
(সূত্রঃ বিখ্যাত ফোর্ড কোম্পানীর মালিক হেনরী ফোর্ড কর্তৃক লিখিত “ সিক্রেটস্ অব জায়োনিজম” বইটি দ্রষ্টব্য। এ মহামূল্যবান বইটি ইহুদিরা পাশ্চাত্য সকল পাবলিক লাইব্রেরী ও দোকান হতে সরিয়ে নিয়েছে)
উপরোক্ত প্র্টোকলসমূহের আলোকে একথা বলা যায় পৃথিবীর সকল ধর্মের লোকদেরকে ইহুদিরা অস্বীকার করে এবং তাদেরকে তারা জন্মশত্রু বলে ভাবে। স্বার্থপর, কূট-বুদ্ধির অধিকারী ইহুদিরাই পৃথিবীর ১১৪ টি স্থান হতে বিতাড়িত হয়েছে এবং প্রায় দু’ই হাজার বছর তারা যাযাবর জীবন অতিবাহিত করেছে। এই ইহুদিরা কারোর বন্ধু নয়। শুধুমাত্র স্বার্থের কারণে তারা বন্ধু সাজে কিন্তু পিঠে প্রয়োজনে ছুরি বসাতে তাদের জুড়ি নেই। পৃথিবীর যেখানে ইহুদিরা বসতি স্থাপন করেছে সেখানেই তারা তাদের সন্তানদের জন্য আলাদা স্কুলের ব্যবস্থা করেছে।ভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
এবার আসুন ধর্ম এবং ধর্মশিক্ষা নিয়ে একটি সমীক্ষা রিপোর্টঃ
আমেরিকাতে ধর্মপালনের উপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। এ জরিপে শতকরা ৫৬ জন লোক দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের গুরুত্ব অপরিসীম বলে মনে করে এবং প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জন (৮২%) লোক ধর্মের প্রয়োজন আছে বলে মনে করে। প্রতি ছয়জনের প্রাপ্ত বষস্কদের মধ্যে (১৬%) মনে করে ধর্ম ব্যবহারিক জীবনে কোন তাৎপর্য বহন করেনা।
খ্রিস্টান ধর্মে কিছু কিছু অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা ঈসা নবীর (যিশু) ন্যায় দেখা হলে “ আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক” (Peace unto you) বলে সম্ভাষণ করে। ইহুদি জাতির জন্য প্রেরিত মূসা নবীও দেখা হলে “আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক” বলে সম্মোধন করতেন। পবিত্র কু’রআনে বর্ণিত হয়েছে দাউদ (ডেভিদ), ইব্রাহীম/আব্রাহাম, মূসা (মোসেস) কিংবা ঈসা নবী (যিশু) তাদের সকলেই প্রকৃত মুসলিম ছিলেন এবং তাঁরা সকলই আল্লাহর মনোনীত নবী ও বান্দা। মুসলিম কথাটির অর্থ “যে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে”। হয়রত দাউদ নবীর মাধ্যমে প্রেরিত যবুর ধর্মগ্রন্থ, মূসা নবীর মাধ্যমে ইহুদিদের জন্য প্রেরিত গ্রন্থের নাম “তোরাহ/তৌরাত এবং ঈসা (যিশু) নবীর মাধ্যমে প্রেরিত “ইঞ্জিল” বা বাইবেল“ গ্রন্থগুলোর বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের সুবিধামত ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা অসংখ্যবার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাই বিভিন্ন দেশে ইহুদিদের ”তোরাহ” এবং খ্রিস্টানদের “বাইবেল“ গ্রন্থের বিভিন্ন শ্লোকে রকমফের রয়েছে। এ পৃথিবীতে পবিত্র কু’রআনই একমাত্র গ্রন্থ যার একটি শব্দও পরিবর্তিত হয়নি। প্রতিটি দেশের মুসলমানের কাছে পবিত্র কু’রআন এক এবং অভিন্ন।
সর্বশেষে একথা প্রমাণিত যে, ধর্মীয় অনুশাসন এবং প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে বলিয়ান করে এবং তা যে কোন ধর্মের লোক হোকনা কেন। কারণ সকল ধর্মই নৈতিকতা্বোধকে উৎসাহিত করে।
================================
(পাঠক, একটি ভাল সমাজ গঠনে নিম্নলিখিত শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প নেই, আপনি কি এ ব্যাপারে একমত?)
ক) আপনি যে কোন ধর্মের অনুসারী হোননা কেন, উত্তরসূরীদের প্রাথমিক শিক্ষা দিতে হবে ধর্মভিত্তিক, যাতে তারা পরিণত বয়সে ধর্মের নিয়মকানুন মেনে চলে সৎ গুণাবলীসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে পারে।
খ) ধর্মের অনুশাসন মানুষকে চারিত্রিক, বিচারিক, দয়াদাক্ষিণ্য এবং ন্যায়পরায়ণতা শিক্ষা দেয় এবং শিশুকাল হতে এর প্রভাব চিরস্থায়ী থাকে যে কারণে সে পরিণত বয়সে ন্যায়অন্যায় বিচারে পরিপক্ষতা অর্জন করে এবং সুস্থ সমাজ গঠনে বলিষ্ট ভূমিকা রাখে।

Comments