Tuesday, June 11, 2019

নূহের নৌকা অবতরণ করেছিল আরারাত না জুদিতে - কোনটি প্রমাণিত সত্য ?


নূহের (আঃ) নৌকা অবতরণ করেছিল - আরারাত না জুদিতে 
(কোনটি প্রমাণিত সত্য ?)

- নাজমুল চৌধুরী 


খিস্টানদের পবিত্র বাইবেল ধর্মগ্রন্থের  জেনেসিস, চাপ্টার-৮, ভার্স-৪ - এ লিপিবদ্ধ আছে যে, নূহের আমলে যে প্রলয়ঙ্করী তুফান ও বন্যা সংগঠিত হয়, সে মাসের ১৭ তারিখে সেই সু-বিশাল নৌকাটি (লম্বায় ১৫২.৪ মিটার, চওড়া ২৫.৪ মিটার এবং উচ্চতায় ১৫.২৪ মিটার) আরারাত পর্বতে অবতরণ করেছিল। 
 
                                 ( জুদি পর্বতশৃঙ্গের ৭.০০০ ফিট উঁচুতে আবিষ্কৃত নূহের নৌকার প্রামান্য চিত্র )





এ ব্যাপারে অনাদিকাল থেকে বৈজ্ঞানিক, গবেষক, ঐতিহাসিক, ভূ-তত্ত্ববিদ এবং ধর্মযাজকগণ বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে আসছিলেন। পর্বতারোহিদের অনেকেই আরারাত পর্বতশৃঙ্গে আরোহন করে নৌকাসদৃশ কিছু ফসিলের নমুনা দেখে ধারণা করেন এটিই সম্ভবতঃ নূহের নৌকা। 

বেবিলনের (ইরাকের অন্তর্গত) একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক বলেছেন এ নৌকাটির ধবংসাবশেষ অক্ষত আছে যা তিনি দিব্যজ্ঞানে দেখতে পাচ্ছেন।

প্রখ্যাত ইহুদী ঐতিহাসিক জোসেফাস তার লিখিত গ্রন্থে (ইহুদিদের এ্যনটিক গ্রন্থ) বর্ণনা করেছেন যে, তুরস্কের অন্তর্গত আর্মেনিয়ার একটি পর্বতশৃঙ্গে উক্ত নৌকাটির ফসিল রয়েছে যা ভালভাবে পরীক্ষা করলে এর সত্যতা প্রমাণিত হবে। বিখ্যাত পর্যটক মার্কোপলো বর্ণনা করেছেন, আর্মেনিয়ার পর্বতশৃঙ্গের উপর নৌকাটির নিদর্শন অবশ্যই খুঁজলে পাওয়া যাবে।

ইলমিজ গানার নামে একজন ভূ-তত্ত্ববিদ ও গবেষক তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, তুরস্ক ও ইরাকের সীমান্ত বরাবর ”কুদি” নামে যে পর্বতশৃঙ্গটি রয়েছে তার উপরিভাগের ফসিল ও বন্যার সময়কালের ব্যবধান পরীক্ষা করে তিনি নিশ্চিত হন যে, ভয়ংকর তুফান ও প্লাবন শেষে নৌকাটি এ পর্বতটির উপর এসে ঠেকে। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে, প্রলয়ংকারী বন্যা সৃষ্টি হয়েছিল ভয়ংকর ভুমিকম্পের মাধ্যমে। সাগরের জল যখন উথলে উঠেছিল ভূমিকম্পের কারণে তখন সাগরবক্ষ হতে প্রবল ঢেউয়ে  বিরাট আকারের শিলাপাথর আরারাত পর্বতের ১৬,০০০ ফুট উঁচুতে এসে লুটিয়ে পড়ে। কালের বিবর্তনে এ সমস্ত পাথরগুলোর আকৃতি নৌকার মত মনে হলেও এটা আসলে নৌকার কোন ধ্বংসাবশেষ নয়। এতে পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক ও ভূ-তত্ত্ববিদগণের কথার সত্যতাকে অস্বীকার করা হয়। 

আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী যিনি পবিত্র কু’রআনের একজন উচ্চমার্গের গবেষক তিনি এই মর্মে বর্ণনা করেন যে, কিছুসংখ্যক ঐতিহাসিক ও ভূ-তত্ত্ববিদগণ উক্ত পর্বতকে তাদের গ্রন্থে ’জুদি’ ’কুদি’ কিংবা ’গুদি’ বলে বর্ণনা করেছেন। ভাষাগত এবং উচ্চারণের তারতম্যহেতু এ ধরণের উচ্চারণ হতে পারে, তবে প্রত্যেকটি উচ্চারণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। 

সামেরিয়ান সভ্যতার পুরানো তথ্য হতে জানা যায়, ইরাকের টাইগ্রিস নদীর অববাহিকায় দু’হাজার বছর পূর্বে যে মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছিল তারা ’কুটি’ ও ’গুটু’ নামে পরিচিত। তাদের উত্তরসূরীরাই বর্তমানে ’কুর্দি’ (কুর্দ্)  নামে পরিচিত যারা ইরাক ও তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে বর্তমানে লিপ্ত রয়েছে। বর্তমান তুরস্কের ’বহ্টান’ (Bohtan) জেলার অন্তর্গত যে ’জুদি’ পর্বত তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের সীমান্ত বরাবর দাঁড়িয়ে আছে তারই একটি উপত্যকায় ’জাজিরাহ ইব্‌নে ওমর’ শহরটি অবস্থিত (তুরস্ক ও ইরাকের সীমান্ত শহর)। এই ’জুদি’ পর্বতটি আরও এগিয়ে গেছে ইরাক ও ইরানের সীমান্ত বরাবর। ওখানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গটির নাম ’আরারাত’। 

এ পর্বতটির নিচে বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে ’ভেন’ ও ’উরুমিয়া’ (Van & Urumia) নামক দু’টো লবণাক্ত হ্রদ। সাগরের সাথে সংযোগবিহীন হ্রদ দু’টোর জলের উৎস সরাসরি বৃষ্টি ও পর্বতশৃঙ্গ হতে নেমে আসা একমাত্র ঝর্ণার মিষ্টি জলরাশি। তাহলে হ্রদের জলরাশি নোনা হয় কি করে ? 

এ নিয়ে এলাকাবাসীর মুখে মুখে অনেক গল্পকাহিনী শোনা যায়। নূহের নৌকাটি নিয়েও এলাকাবাসী বলে থাকে নূহের সময়ের প্লাবন যখন এসব অঞ্চল ভাসিয়ে নিয়ে যায় তখনই সাগর হতে উপচে পড়া জলরাশি এখানে আটকা পড়ে, সেই হতেই এ দু’টো হ্রদের জল লবণাক্ত। 

বাইবেলের বর্ণনা মতে নূহের সু-বিশাল নৌকা প্রবল বন্যা শেষে আরারাত পর্বতশৃঙ্গের ১৬,০০০ ফুট উঁচুতে অবতরণ করে কিন্তু মুসলিম ধর্মগ্রন্থ আল-কু’রআনের বর্ণনা মতে নূহ নবীর নৌকা অপেক্ষাকৃত নিচু পর্বতশৃঙ্গ ’জুদি’-তে (৭,০০০ ফুট উঁচুতে) এসে ঠেকে। এ বর্ণনার সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন পূর্বঞ্চলের কিছু খিস্টান ও ইহুদী পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ। 

১৯৯৪ সালে আমেরিকার ভূ-তত্ত্ববিদ ভেনড্যাল জোনস্ (Vandal Jones) আকস্মিক একটি খবর পরিবেশন করে সমগ্র পৃথিবীকে চমকে দেন যে, ’জুদি’ পর্বতশৃঙ্গের উপরেই তিনি নূহের সু-বিশাল নৌকাটির সন্ধান পান। পরবর্তী পর্যায়ে ডেভিড ফসোল্ড (David Fausold) যিনি পুরানো গ্রীক দর্শনশাস্ত্রের উপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনিও ভেনড্যালের সাথে একমত পোষণ করেন যে, তার আবিষ্কারই সঠিক। 

এ ব্যাপারে পবিত্র কু’রআনে নৌকাটির অবস্থানের পূর্ণ বিবরণ দেয়া হয়েছে যা  নিম্নরূপঃ

সুরা হুদ ঃ 

আয়াত-৪০ ঃ (পবিত্র আল্লাহ পাক বলছেন) আমি নূহকে হুকুম দিলাম যে, প্রত্যেক জীব হইতে স্ত্রী ও পুরুষ দুই জোড়া যাহার সম্মন্ধে প্রথমে কথা হইয়া গিয়াছে, যে ধ্বংস হইবে তাহাকে ছাড়িয়া নিজের সমস্ত গৃহবাসী এবং অন্য যে ব্যক্তি আমার উপর ঈমান আনিয়ছে, উহাদের সকলকে নৌকায় উঠাইয়া লও, তাঁহার (নূহের) সহিত ঈমান অতি অল্পসংখ্যকই আনিয়াছিল। 

আয়াত-৪১ ঃ  আর নূহ নৌকায় আরোহনকারীদেরকে বলিল, তোমরা আরোহণ কর ’বিসমিল্লাহ মাজরিহা ওয়া মুরছাহা পড়িতে পড়িতে, নিঃসন্দেহে আমার পালনকারী ক্ষমাশীল ও দয়ালু। 

আয়াত -৪২ ঃ নৌকা পাহাড়সদৃশ উচ্চ তরঙ্গমালার মধ্যে নূহ ও তাঁহার সঙ্গীদেরকে লইয়া চলিয়া যাইতেছিল এবং নূহের পুত্র উহাদের হইতে পৃথক ছিল, তখন নূহ তাহাকে ডাকিল, হে পুত্র, আমাদের সঙ্গে নৌকায় আরোহণ কর  এবং অবিশ্বাসীদের সঙ্গী হইওনা।
 
আয়াত -৪৩ ঃ  নূহের পুত্র বলিল, আমি এখনই তোমাদেরকে দেখিতে দেখিতে সাঁতরাইয়া কোন পাহাড়ের আশ্রয়ে যাইয়া পৌঁছিতেছি, সেই আমাকে ক্ষমা করিবে তুফান এবং বন্যার পানি হইতে; নূহ বলিল, অদ্যকার দিনে আল্লাহর গজব হইতে কেহই রক্ষাকারী নাই কিন্তু আল্লাহ যাহার প্রতি রহম করেন এবং উভয়ের মাঝখানে এক প্রবল তরঙ্গ আসিয়া পৌঁছিল তখন অন্যান্য লোকের সাথে নূহের পুত্রকে ডুবাইয়া দেওয়া হইল। 
আয়াত -৪৪ ঃ এবং হুকুম করা হইল যে, হে মৃত্তিকা তুমি তোমার পানি টানিয়া লও এবং হে আকাশ থামিয়া যাও এবং পানির প্রবণতা কমিয়া গেল এবং কওমের কাজ শেষ করিয়া দেওয়া হইল এবং নৌকা ’জুদি’-তে যাইয়া দাঁড়াইল এবং বলিয়া দেওয়া হইল, লানৎ হইতে থাকুক; কোন জিনিষ আশ্রয় দিতে পারে নাই এবং ভবিষ্যতেও পারিবেনা। ইহার নজির যুগে যুগে মানুষ অবলোকন করিতে থাকিবে; ইহার অন্যথা হইবেনা। 

ভেনড্যাল জোনস্ ’জুদি’ পর্বতশৃঙ্গের উপরেই নূহের নৌকা আবিষ্কার করেন। এর পূর্বে ১৯৫০ সালে আমেরিকার নাসা উপগ্রহকেন্দ্র আকাশ হতে কয়েকটি অবিশ্বাস্য ছবি প্রেরণ করে যার রিপোর্ট ছিল নিম্নরূপঃ

পূর্ব তুরস্কের একটি পর্বতশৃঙ্গ যার উচ্চতা ৭,০০০ ফুট তার উপর বিরাট চোখাকৃতিবিশিষ্ট একটি বস্তুর ফটো উপগ্রহটি প্রেরণ করে। এ বস্তু নিয়ে নাসা গবেষণাকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিকগণ অনেক গবেষণা করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছিলেন না। ভেনড্যাল জোনস্ তার আবিষ্কার দিয়ে কিছুকাল পূর্বে পৃথিবীকে চমকে দেন। নূহের নৌকার ম্যাপ যা তিনি এঁকেছেন তা নাসা উপগ্রহ হতে প্রেরিত ফটোর সাথে অদ্ভূতভাবে মিলে গেছে। 

আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নূহ নবীর নৌকা জুদি পর্বতেই সমাহিত হয়েছিল। ১৪০০ বছর পূর্বে বর্ণিত আল-কু’রআনের ঐশ্বরিক বাণী পৃথিবীর মানুষের কাছে অবশেষে সত্য বলেই প্রমাণিত হল।  

                                                        ==============

No comments:

Post a Comment

What do you think?