দারুচিনি দ্বীপে
-নাজমুল চৌধুরী
ঠিক দুবছরের মাথায় জেদ্দা হতে ঢাকাগামী
বাংলাদেশ বিমানের ডিসি ১০-এ চড়ে বসেছে আসিফ। বেআইনীভাবে বসবাসের অপরাধে একসপ্তাহ
জেলবন্দী থেকে দেশে ফিরে যাওয়ার মধ্যে তার কোন অনুতাপ নেই। দেখতে দেখতে দু'বছর
অতিক্রান্ত হয়ে গেল। প্রবাসে এসেছিল বিশেষ এক উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্য তার সফল
হয়েছে। অনেক আগেই ফিরে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু নিজেকে গোছাতে গিয়ে সময়টা
কিভাবে যে গড়িয়ে গেল তা সে টেরই পায়নি।
আজ
নিজেকে বড় হালকা মনে হচ্ছে মুক্ত স্বাধীন পাখির ন্যায়। যেন তর সইছে না আসিফের।
আর এক মুহূর্ত এখানে নয়। জীবনের শুরুতে যে আলোবাতাসে সে চোখ মেলেছিল, যে মাটির
ঘাসফুলের সবুজ নরম গালিচায় তার দেহ মন গড়াগড়ি খেয়ে বড় হয়েছে, সে মাটির
আলিঙ্গনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাকুল আহবান তার হৃদয়তন্ত্রীতে ঝড় তুলেছে। এ ঝড়
মহামিলনের, আনন্দের, মহাসমারোহের।
ধৈর্যের
বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পূর্বেই বিমানটি তার বিশাল বপু নিয়ে আকাশে উডডয়ন করল। রোমাঞ্চিত
হল আসিফের দেহমন এক অজানা পুলকে। জানালাপথে দৃষ্টি মেলে দেখে মুহূর্তে মর্তের
মানুষ, চলন্ত যানবাহন, আর বিশাল বিশাল অট্রালিকাগুলো ক্ষুদ্র হতে হতে একসময়
বিন্দুতে মিলিয়ে গেল। আকাশের নীল সামিয়ানায় সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে
বিমানখানা ঠিক পূর্বদিকে আসিফের স্বপ্নরাজ্যে। জানালা দিয়ে বিস্তৃত মহাশূন্যে চোখ
রাখে সে। থোকা থোকা তূলোর মত সাজানো মেঘের ভেলার তুলতুলে বিছানায় আসিফের দেহমন
অজান্তে গড়াগড়ি খায়। সাদা কালো ধূসর মেঘের আবরণ ভেদ করে বিমানখানা এগিয়ে চলছে
নির্দিষ্ট গন্তব্যে। পুঞ্জীভূত মেঘমালায় ভর করে মনও ওড়ে চলে নীল নীল নিঃসীমে।
মনের অলিন্দে ভাসছে একটি মুখ। সে ফরিদার। জমে থাকা পাহাড়সম সাদাকালো মেঘের চড়াই উৎরাই
পেরিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে সে ফরিদার পেছনে অথচ তার সাথে সে পেরে উঠছে না
কোনমতেই। হাসতে হাসতে ফরিদা নাগালের বাইরে পালিয়ে যাচ্ছে। কখনো কালো মেঘের ফাঁকে
ফাঁকে তার দীঘল কালো চুলরাশিকে ইচ্ছা করেই ঢেকে রাখছে যাতে আসিফ খুঁজে না পায়।
ক্লান্তিবিহীন এ লুকোচুরি খেলার অন্ত নেই। একসময় ফরিদা পিছন হতে কালো মেঘগুলোকে দু'হাতে
ফাঁক করে পিছন হতে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলে, এবার ক্ষান্ত দাও সাহেব। সারাদিন
চেষ্টা করলেও খুঁজে পাবে না। আমি যদি ধরা না দেই তাহলে সাধ্যি আছে তোমার?
হাসি
পায় আসিফের। পাশের সিটের বাঙালি ভদ্রলোক বলে ওঠেন, কি সাহেব, বড় হাসছেন যে ?
সম্বিত
ফিরে পায় আসিফ। মুখ ঘুরিয়ে বলে, না, এমনিতেই..।
এক
জেদের মাথায় এসেছিল সে সৌদিতে। ফরিদার বাবা অর্থাৎ আব্দুস সাত্তার চাচা তাকে যদি
তুচ্ছ জ্ঞান না করতেন, তাহলে হয়তো তার জীবনের ধারা আজ অন্যরকম হত। আই,এ পাশ ছেলের
কাছে বি,এ পাশ মেয়ের বিয়ে কেমন করে হয়? তবু যদি প্রবাসে ভাল চাকুরী বাকরী করত, সেক্ষেত্রে
না হয় একটু ছাড় দেওয়া যেত। দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে গম্ভীরভাবে কথাটাকে যুক্তির
পাল্লায় খাড়া করতে চেয়েছিলেন তিনি।
এককালের
পরম বন্ধু আজীজ মাস্টার এ কথায় আহত হয়ে বলেছিলেন, আসিফের লেখাপড়া তেমন কম কিসে
? আই, এ পাশ করে বছরখানেক প্রাইমারী ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ট্রেনিং দিল। এ ট্রেনিং
না দিলে সেও তো বি,এ পাশ করে বেরুতো। আর মেয়েটাকেতো অনেক আগেই আমাকে দিয়ে দিয়েছ
দোস্ত, এখন আবার ওকথা কেন?
তবু
ডিগ্রির একটা মূল্য আছে না? মেয়েরও তো একটা মুখ আছে। শিক্ষিত মেয়ে বলে কথা।
তোমার আমার যুগতো কবে বাসী হয়ে গেছে দোস্ত,এটা বুঝতে চাও না কেন? ছেলেটাকে বলো
ডিগ্রিটা নিয়ে নিতে। মেয়েতো তোমারই রইল।
আহত
পাখির ন্যায় ছটফট করে ওঠে আজিজ মাস্টারের হৃদয়। কোন কথা না বলে হন হন করে বাড়ির
পথে পা বাড়ান তিনি। আত্মসম্মানে ঘা লাগে দারুণভাবে।
এ
ঘটনাকে কেন্দ্র করেই প্রবাসে পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নেয় আসিফ। বিদেশে যেতে পারাটা
যদি ফরিদাকে পাওয়ার সার্টিফিকেট হয় তাহলে যাবে না কেন? পিটিআই ট্রেনিং-এ
থাকাকালীন সময়ে শহরে ফরিদার সাথে কতবার দেখা হয়েছে। দু'পিতার অভিলাষের কথা তাদের
দু’জনেরই জানা।
এজন্য পরস্পরের মনের গোপন কন্দরে অনুরাগের বীজও রোপিত হয়েছিল।
কলেজ
হোষ্টেলে থেকে পড়ত ফরিদা। আসিফের সাথে দেখা হত প্রায়ই। কলেজ বন্ধ হলে ফরিদাকে
গ্রামের বাড়িতে মাঝেমধ্যে নিয়ে আসার দায়িত্বও ছিল তার ওপর। শহর থেকে একদিন
ফেরার পথে ফরিদা বলেছিল, আচ্ছা আসিফ ভাই, ট্রেনিং শেষে কি করবেন বলে ভাবছেন?
ভাববো
আবার কি? বাবার ইচ্ছা ট্রেনিংটা নিয়ে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারি করি। বাড়ির
ছেলে বাড়িতেই থাকি। তাছাড়া আমাদেরতো আর খাওয়াপরার জন্য ভাবতে হচ্ছে না। আল্লাহ
যা দিয়েছেন চাকরি না করলেও সংসার চলবে। তবু সম্মানের খাতিরে একটা কিছুতো করতে
হবে। তাই বাবার ইচ্ছাতে রাজী হয়ে গেলাম।
চাচীতো
আপনাকে সংসারী দেখতে খুব ইচ্ছে। আপনার কি মত? কথাটা বলতে গিয়ে ফরিদা লজ্জায় লাল
হয়ে উঠে। এ ধরনের প্রশ্ন না করলে কি হতনা? কথা পাল্টানোর ছলে অন্য কথা পাড়ে -
বাড়ি পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে ? |
ট্রেন
সময়মত ছাড়লে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাব। একটু থেমে আসিফ পুনরায় কথার খেই ধরে বলে,
আর বাবার ইচ্ছার কথা যে বললে তা পূরণ করার ব্যাপারে তুমি আমাকে কি করতে বল ? তোমারওতো
একটা মতামত আছে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে আসিফ।
এ
প্রশ্নের উত্তর ফরিদার জানা থাকলেও প্রকাশের ভাষা জানা নেই। এক অস্বস্তিকর শূন্যতা
দু’জনকে স্তব্ধ
করে দেয় পরমুহুর্তে।
এরপরের
ঘটনা সাদামাটা। ফরিদা বি,এ পাশ করেছে দ্বিতীয় বিভাগে, আর আসিফ পিটিআই থেকে
ট্রেনিং শেষ করেছে সফলতার সাথে।
চাকরির
ব্যাপারে একটা কিছু হলেই আজিজ মাস্টার বন্ধু আব্দুস সাত্তারের কাছে কথাটা পাড়বেন বলে
মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু চাকরি হতে দেরি হবে জেনে ভাবলেন, শুভ কাজটা সেরে নিলে কি
এমন ক্ষতি? বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছে শরীর,কখন কি ঘটে যায় বলাতো যায় না? কিন্তু
কথাটা বন্ধু আব্দুস সাত্তারের কাছে পাড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হল দারুণভাবে।
এ
কথা মায়ের কাছে শুনার পর সোজা ঢাকায় গিয়ে ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে
ওমরাহ ভিসা নিয়ে আকস্মিক পাড়ি জমায় আসিফ সৌদিতে। এখানে আসার মাসখানেক পরেই বে-আইনী
লোক ফেরত পাঠাবার পুলিশী তৎপরতার চাপে পড়ে পরিচিত এক বন্ধুর সহায়তায় সে জেদ্দা
হতে দুইশত কিলোমিটার দুরে মদীনা হাইওয়ের পাশাপাশি পেট্রোল পাম্পের পাশেই একটি
রেস্টুরেন্টে চাকরির অফারটা লুফে নেয়। ওখানে পুলিশের সন্ধানী চোখ নেই।
রেস্টুরেন্টের মালিক বে-আইনী লোকদেরকে দিয়েই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালাচ্ছে।
মাসান্তে সাতশ রিয়াল পারিশ্রমিক পেয়েই সন্তুষ্ট ছিল আসিফ। খাওয়া থাকার খরচ নেই।
বদাভ্যাসও নেই। তাই সব রিয়ালই বেঁচে যায়। মাঝে মধ্যে বাবাকে কিছু কিছু টাকা
পাঠায়। এ পর্যন্ত যা জমেছে তা দিয়ে দেশে গিয়ে কিছু একটা করতে পারবে।
দু’বছরে
ফরিদা নিশ্চয়ই সাংসারিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে অনেক। ভাল রান্নাবান্না থেকে শুরু
করে ঘর সাজানোর অনেক কলাকৌশল। প্রবাসে পাড়ি দেয়ার প্রাক্কালে ছোট্ট একটি চিরকুট
ফরিদাকে লিখে পাঠাতে ভুলেনি সে।
“চাচার
অনুমোদন পেতে হলে আমাকে প্রবাসের সার্টিফিকেট নিতে হবে যে কোন মূল্যে। বাবা তোমাকে
মনেপ্রাণে ছেলের বউ হিসাবে বরণ করে নিয়েছেন। বাবার স্বপ্ন ব্যর্থ হোক আমি তা চাই
না। চাচাকে খুশি করেই তোমাকে ঘরে তুলব। শীঘ্রই ফিরে আসব - সেদিনটির প্রতীক্ষায়
থেকো"
ঢাকা
বিমানবন্দরে অবতরণের মধ্য দিয়ে আসিফের ভাবনার রেশ কেটে যায়। তাড়াতাড়ি
ইমিগ্রেশন শেষ করে হাতের স্যুটকেসটি নিয়ে গ্রীন চ্যানেল দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে
পড়ে। এক অজানা শিহরণে মনটি তার দোল খেতে থাকে। গ্রামের বাড়ি পদ্মাপারের আলমপুর।
ঢাকা হতে মাত্র তিনঘন্টার পথ।
দেড়হাজার
টাকা ভাড়া সাব্যস্ত করে একটি ট্যাক্সিতে চেপে বসে আসিফ।
এক
মিনিট বিলম্ব মোটেই তার সহ্য হচ্ছে না। পাখির মত যদি তার দুটো ডানা থাকত তাহলে এতক্ষণ
অপেক্ষার প্রহর গুণতে হতনা। এয়ারপোর্টের রূপালী ব্যাঙ্কের শাখায় ডলারগুলো ভাঙ্গিয়ে
নিয়েছে আগেভাগেই। হাতে শুধু স্যুটকেস, যাতে রয়েছে ফরিদাসহ সবার জন্য উপহারসামগ্রী।
ফরিদাদের
বাড়ি পেরিয়ে তাদের বাড়ি যেতে হয়। পাঁচমিনিট ওদের বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে গেলে
কেমন হয়? ফরিদার স্বহস্তে তৈরি একগ্লাস লেবুর শরবত পানের মধ্য দিয়ে ওকে দেখা উপরন্তু
চাচার প্রতিক্রিয়াও যাচাই করা যাবে। হয়তো ফরিদা লেবুর শরবত দিতে এসে অভিমানে বলবে,
দু’বছরে একটি
চিঠিতো দিতে পারতেন? আপনার মত এমন শক্ত মানুষ জীবনে দেখিনি।
ট্যাক্সি
আলমপুর বাজারে পৌঁছতেই ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় আসিফ। পথে পরিচিতদের
অনেকেরই কুশল জেনে নেয়। একটি জিনিষ লক্ষ্য করে আসছে সে। সবাই যেন তাকে কিছু
লুকোচ্ছে। শৈশবের খেলার সাথী মাশুকের সাথে দেখা হলে মাশুক বলল, বড় দেরি করে ফিরলে
দোস্ত। ছ’টি মাস আগে
ফিরলে কতনা ভাল হত।
এ
কথার মানে ?
তুই
কি কিছুই জানিস না? মাশুক প্রশ্নবান ছুঁড়ে?
নাতো
? কি ব্যাপার?
আগে
বাড়ি যা,তারপরই জানতে পারবি।
পাশের
মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে দেখা হতেই,তিনি বললেন, বাবা আসিফ। কবে বিদেশ হতে ফিরলে?
এইমাত্র
চাচা।
কারোর
চিঠি পেয়ে আসছো? খবর সময়মত পেয়েছিলে?
কিসের
খবর? কার কথা বলছেন চাচা?
কেন,তোমাদের
পরিবারের কথা ?
কিছু
বুঝতে পারছিনা চাচা? কি হয়েছে পরিবারের লোকদের? স্পষ্ট করে বলুনতো?
ওহ্,তুমি
দেখি কিছুই জান না। ইমাম সাহবে বিস্ময়াবিভূত হয়ে বললেন, ঠিক আছে,আগে বাড়ি যাও।
গেলেই সব জানতে পারবে। কথাটি বলে হন হন করে পা বাড়ান মসজিদ পানে।
এক
অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে আসিফের হৃৎপিণ্ড। অকল্যাণজনিত কিছু যে একটা ঘটেছে তা আঁচ
করে নেয়। নিশ্চয়ই বাবা অথবা মায়ের একটা কিছু !
ফরিদাদের
বাড়ি পেরিয়ে তাদের বাড়ি যেতে হয়। আরো একমাইল পথ বাকি।
পূর্বপরিকল্পনানুযায়ী
ফরিদাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে আসিফ।
চাচা
আছেন? আমি আসিফ। সৌদি হতে ফিরেছি।
কে?
কে তুমি? লাটিতে ভর করে আব্দুস সাত্তার চাচা গেইটের বাইরে আসেন।
ওহ,বাবা
আসিফ!কখন ফিরলে? তা বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আস ?
এ্যা...ই,
কে কোথায় আছ ? দেখে যাও কে এসেছে?
চাচী
কাছে এসে দাঁড়াতেই আসিফ কদমবুচি করে দাঁড়ায়।
থাক,
থাক হয়েছে বাবা। তারপর কেমন আছ ? পথে কোন অসুবিধা হয়নিতো?
না, চাচী
কোনই অসুবিধা হয় নি। শুধু বিমানটি ছাড়তে ঘন্টাখানেক দেরি হয়েছে এই যা।
এই
কুলসুমের মা! তাড়াতাড়ি একগ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে আয় তো,বাবা আমার গরমে নেয়ে
এসেছে।
অস্থির
হবেন না চাচী। আমি বেশ আছি। আপনাদেরকে পেয়ে জার্নির সব কষ্ট ভুলে গেছি। তা, ওরা
সব কোথায় ?
কার
কথা বলছ,বাবা? আশিকতো কাশিপুরে। আজই ফেরার কথা। তুমি কাপড় ছাড়ো বাবা। হাতমুখ ধোও।
সবেমাত্র এলে,একটু বিশ্রাম নেও, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আব্দুস
সাত্তার স্ত্রীর দিকে চেয়ে ইশারায় কিছু একটা জানালেন।
খাওয়া
দাওয়া শেষে সাত্তার চাচা আস্তে আস্তে মুখ খুললেন। বাবা, প্রায় দু'বছর হয়ে গেল
তুমি বিদেশ গিয়েছ। একটি চিঠিতো দিতে পারতে?
আসিফ
এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল। মোটামোটি একটি উত্তরও ঠিক করে রেখেছে এধরণের কোন
প্রশ্নের।
বলল,চাচা,আমি
যেখানে কাজ করতাম সে জায়গাটা শহর হতে তিনমাইল দুরে। চিঠি লিখে পোষ্ট করতে হলে হেঁটে
যেতে হয় তিনমাইল। সে কারণে আর চিঠি লিখা হয়নি।
গত
দু'বছরে বাবার কাছেও একটি চিঠি দিতে পারিনি। অনেক বলে কয়ে পরিচিত একজনকে দিয়ে
দু'বার কয়েকটি টাকা পাঠিয়েছি মাত্র। চলে আসব করে করে কেমন করে দু’বছর পার করে দিলাম, বুঝতেই পারিনি।
আমার এ অপারগতা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
এই
টাকা পাঠানোই তোমার বাবার জন্য কাল্ হল।
কেন
চাচা? কাল্ হতে যাবে কেন?
দ্যাখো
বাবা, তোমাকে সবকিছু বলতেই হবে। আমরা ছাড়া তোমার আপনজন আর কে আছে? তোমার পাঠানো চেকটি ব্যাংকে জমা দিয়ে
টাকা তুলতে তেমার বাবা শহরে গেলেন। টাকাগুলা উঠালেন।
বাড়ি
ফেরার পথে কোথা থেকে নিয়ে এলেন কলেরার বীজ। আশেপাশের গ্রামের সব ডাক্তার কবিরাজ
ডাকলাম, কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা। কলেরার সাথে যুদ্ধ করে মাত্র তিনদিন বেঁচে ছিলেন।
তারপর এই আত্মঘাতী রোগে পরপর তোমার ভাই ও মা’কে
মাত্র একসপ্তাহ সময় দিয়েছিল। কি আর বলব বাবা ? সবই তকদিরের ফের।
আসিফ
ভেঙ্গে পড়ে কান্নায়। চাচা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, মাথা ঠাণ্ডা রাখ বাবা,
ভেঙ্গে পড়লে কি চলবে? আরো কথা আছে। এ ঘটনা ঘটে প্রায় ছ'মাস পূর্বে।
ইতমধ্যে
ফরিদার বিয়ের জন্য ভাল ভাল প্রস্তাব আসছিল। কিন্তু সে কিছুতেই বিয়েতে রাজী
নয়।এদিকে তোমার কোন খবর নেই। তার মনের কথা বুঝেও কিছু করতে পারছিলাম না।
পাশের
গ্রাম কাশীপুর থেকে তোমার বাবাই একটি ভাল প্রস্তাব নিয়ে এলেন। ফরিদাকে তোমার বাবা
অনেক বুঝিয়ে রাজী করালেন। বললেন - মা, আমি তোমার মনের কথা জানি, কিন্তু যেখানে
আমার ছেলের কোন হদিস নেই! কবে দেশে ফিরবে তাও ঠিক নেই ...তাছাড়া ভাল সম্মন্ধ
সবসময় আসে না। সুতরাং প্রস্তাব পায়ে ঠেলে দিও না মা। তোমার বাবা মার ইচ্ছার
দিকেও তোমার খেয়াল রাখা দরকার। কোনরকমে ফরিদাকে বুঝিয়ে তিনিই পার করলেন। কিন্তু
মেয়েটির কপালে কি ছিল কে জানে। কথাটি শেষ হল না,ডুকরে কেঁদে ওঠেন। অসমাপ্ত কথা
মুখের ভিতর পাঁক খেতে খেতে জিহবার নিচে ঢাকা পড়ে।
এক বোবা
কান্না মেঘের রূপ ধরে হৃদয়াকাশে গুমোট মেরে আছে। আকস্মাৎ তা ভারি বর্ষণে ভেঙ্গে
পড়বে। নিজেকে আর সামলাতে পারছে না আসিফ। এক অব্যাক্ত বেদনায় ভেঙ্গে পড়ে তার
হৃদয়ের সমস্ত শাখা প্রশাখা। ভাষার পাখি যেন বোবা হয়ে নিঃসীম নীলিমায় ওড়াল
মেরেছে। চা -চা -, একি শুনলাম চাচা,
শ্রাবণ বরিষণের মত প্রবল ঝাপটা দিয়ে চোখ প্লাবিত করে বেরিয়ে আসে অবাধ্য অশ্রুর
বন্যা।
তার
সাথে সুর মিলিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন চাচা। আসিফকে জড়িয়ে ধরে বলেন -বলতে পার
বাবা, কেন আমি বেঁচে আছি আমার বন্ধুকে হারিয়ে? আসিফ তুমি আমার ছেলে আশিকের মত। তোমার
নামের সাথে মিল রেখে তোমার বাবাই ওর নাম রেখেছিলেন আশিক। আজীবন তুমি ছেলে হিসাবে এ
পরিবারের সাথে মিশে থাকবে এ কথা তোমাকে দিতেই হবে বাবা। তোমার বাবার মৃত্যুর পর উনার সব সম্পত্তি আমি যক্ষের
ধনের মত আলগে রেখেছি।
চোখ
মুছে উঠে দাঁড়ায় আসিফ। শান্তভাবে বলে -চাচা, আমি একটু ঘুরে আসি।
ব্যাগটি
রইল। ফরিদার প্যাকেটটি কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। উত্তরের অপেক্ষা না করেই চোখ
মুছে বেরিয়ে পড়ে আসিফ। পদ্মাপরের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলে অনেকদুর।
মনটা
যেন ঝাঝরা হয়ে গেছে বেদনার নীল ক্ষতে। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ তার কাছে এমুহূর্তে
অর্থহীন! এক বিরাট শূন্যতা তার মনকে গ্রাস করে। কোথায় যাবে সে? কে আছে তার এ
পৃথিবীতে? প্রবাসের দু’বছরের জীবনে
যাকে নিয়ে একটি স্বপ্নের বাগান সাজিয়েছিল সেও আজ নাগালের বাইরে। সবাইকে হারিয়ে
বেঁচে থাকার অর্থ কোথায় ?
স্রোতস্বিনী
পদ্মার বুকে পাল তুলে হাজারো সাম্পান ভেসে যাচ্ছে দূর দূরান্তে। নদীপারে ডিঙ্গি
নিয়ে অপেক্ষমান এক মাঝিকে দেখে কাছে গিয়ে আসিফ জানতে চায় - মাঝিভাই! এ ডিঙ্গি
বানাতে আপনার কত খরচ হয়েছে?
তা
প্রায় তিন-চার হাজার টাকা। কেন,একটা বানাইতে চান?
আমি
যদি আপনাকে এ ডিঙ্গির বিনিময়ে অনেক টাকা দেই তাহলে বিক্রি করবেন?
মাঝি
একটু আশ্চর্য হয়ে বলে, টাকা বেশি পেলে বিক্রির কথা ভাবতে পারি। তবে আমার সাথে
মস্করা করতাছেন, মিয়াভাই?
এয়ারপোর্টে
ভাঙ্গানো টাকার তোড়াটি গুজে দেয় আসিফ মাঝির হাতে। আশ্চর্য হয়ে মাঝি বলে,এত টাকা?
আপনি কি পাগল অইছেন, মিয়াভাই?
না,আমি
পাগল নই। এসব টাকা সবই আপনার মাঝিভাই। টাকা আমাকে কিছুই দেয় নি। এ টাকার জন্যই
আমি হারিয়েছি অনেককিছু। সময় আমার খুব কম। এ ডিঙ্গি নিয়ে আমি যেতে চাই অনেক
দুরে, যেখানে নদী মিশেছে সাগরে আর সাগর মিশেছে মহাসাগরে।
সেই
মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে আমি খুঁজব নির্জন একটি দ্বীপ। যেখানে প্রিয়জন হারানোর বেদনা
নেই। কাউকে হারানোর ব্যথা মনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় না।
মাঝি
ভাবে লোকটি নিশ্চয়ই পাগল? মনের ভাব মনে গোপন করে বলে, মিয়াভাই সমুন্দরে যাইবেন হেডাতো
পরের কথা, ডিঙ্গি নিয়া আপনিতো পদ্মাই পার অইতে পারবেন না। ডিঙ্গি নিয়ে কেউ
সমুন্দরে যায় ?
মাঝির
কথায় কান না দিয়ে স্রোতের প্রবল টানে ভরাযৌবনা পদ্মার বুকে আসিফ তার সদ্য কেনা ছোট্ট
ডিঙ্গিখানা ভাসিয়ে দিতে দিতে বলে, মাঝিভাই! আমার একটি অনুরোধ রাখবেন?
কি
করতে অইব কন মিয়াভাই?
আলমপুর
বাজারে আব্দুস সাত্তার সাহেবের বড় দোকানে গিয়ে বলবেন,আসিফকে যেন ক্ষমা
করেন,কথাটা রাখতে পারলনা বলে?
ঢেউয়ের
তালে তালে ডিগবাজি খেতে খেতে আসিফের ডিঙ্গিখানা এগিয়ে চলে সাগরপানে। টাকাগুলো
গামছায় পুটলি বাঁধতে গিয়ে মাঝির হাত যেন এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে। কড়কড়ে নোটগুলো
দু’আঙ্গুলের
ফাঁকে যেন কাঁটা হয়ে বিঁধছে। ভেসে যাওয়া ডিঙ্গির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে
মাঝি। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে ততক্ষণে।
ক্রমেই
অন্ধকার গ্রাস করবে পৃথিবীকে। মাঝির মনে পড়ে যায় ৭১'এর ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় উৎসব
করতে গিয়ে তার একমাত্র ছেলে আলী হোসেন দু'বন্ধুকে নিয়ে এমনি ভরা গাঙ্গে ডিঙ্গি
ভাসিয়েছিল, ওরা আর ফিরে আসেনি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয় মাঝির।
কেন সে
বিক্রি করতে গেল ডিঙ্গিটি হুজুগের বশে? নিস্তেজ হয়ে যাওয়া দু'আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে
টাকার বান্ডিলটি গড়িয়ে পড়ে নদীবক্ষে। বুক চিরে দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে এক অব্যক্ত
বেদনায়। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অবাধ্য অশ্রুর অবিরল ধারা। নদীপারের নরম মাটিতে
হাটুগেড়ে বসে আকাশপানে দু'হাত তুলে মাঝি কাতর মিনতি জানায়, হে আল্লাহ, পাগলটারে
তুমি রক্ষা কর,যদিও জানি ভরাগাঙ্গে ওর রক্ষা নেই। বুকফাটা আর্তনাদ খরস্রোতা পদ্মার
ঢেউয়ের সাথে মিশে মিলিয়ে যায় দুরের দিগন্তরেখায়।
আসিফের
ডিঙ্গি দ্রুতবেগে ডিগবাজী খেতে খেতে এগিয়ে চলে তার কল্পিত দারুচিনি দ্বীপের
সন্ধানে। দাঁড় ধরে স্থবির বসে আছে সে। সম্মুখে প্রসারিত উদাস দৃষ্টি। ঢেউ এসে ডিঙ্গিতে
আছড়ে ভেঙ্গে পড়ছে বার বার। ভিজিয়ে দিচ্ছে পরণের কাপড়। অস্তগামী সূর্য বিদায়ের
প্রস্তুতি নিচ্ছে। আলোর রক্তিমাভা পূব আকাশে ভাসমান মেঘকে রাঙ্গিয়ে দিয়েছে। বিমানে
বসে সে এ মেঘের আবরণে ফরিদাকে নিয়ে কল্পনায় লুকোচুরি খেলছিল।
স্বপ্ন
কত মধুর আর বাস্তব কত wbg©g এ সত্য
আসিফের চেয়ে ভাল আর কে বুঝবে এমুহূর্তে।
সামনেই
কাশিপুর গ্রাম। আসিফের মনবনে পোষা এক সাধের ময়না উড়ে এসে এগ্রামেই ঘর বেঁধেছে।
কয়েকঘন্টা আগেও মনে ছিল তার কৃষ্ণচূড়ার লাল রং। কি বিচিত্র অনুভূতি মিশিয়ে
ফরিদার জন্য সে গেঁথেছিল মালিকা, সাজিয়েছিল বাসর। সে ফুলফোটানো মনের বাগিচা প্রবল
বৈশাখী ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে। পিতা, মাতা ও ছোট্টভাইটিকে নিয়ে সাজানো সংসারটিও
অকালে ঝরে গেল। কি রইল আসিফের জন্য মনের এ শূন্য বনে।
স্নেহ
ভালবাসার প্রলেপ দিয়ে যে মনকে শান্তনা দিতে পারত এ মুহূর্তে সেও অন্যজনের
বাহুডোরে। যে মাটির মায়ায় সে ফিরে এসেছে সে মাটি তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে
দিয়েছে। একটি তপ্ত দীর্ঘনিঃশ্বাস বক্ষ ভেদ করে তীরের ফলার মত বেরিয়ে এসে
ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে আসিফের দেহমন।
বাতাসের
তীব্রতা বাড়ছে। ঢেউগুলো ভয়ঙ্কর রূপে এগিয়ে আসছে একে একে। ডিঙ্গিখানি উল্টে যেতে
চাচ্ছে টাল সামলাতে না পেরে। আসিফ শক্ত হাতে দাঁড় ধরে রাখে।
দূরে
উজানে ভেসে আসছে একটি বড় পানসি নৌকা স্রোতের প্রতিকূলে। আসিফের বেঁচে থাকার
একমাত্র ভরসা। আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে ডিঙ্গিটাকে কোনরকম পানসি নৌকাটির কাছাকাছি
নিয়ে যেতে পেরেছে। বড় ধরনের আর একটি ঢেউ আসলে ডিঙ্গিটি তলিয়ে যাবে নদীর অতল গহীনে।
পানসির মাঝিকে দুহাত তুলে বিপদ সংকেত জানায়। প্রবল স্রোতে ডুবতে ডুবতে ডিঙ্গিখানা
পানসির কাছে পৌঁছতেই মাঝি ভারি একটি রশি ছুঁড়ে দেয় আসিফের দিকে। রশিটি পেয়ে
দাঁড় ছেড়ে ডিঙ্গির সাথে শক্ত করে বাঁধে সে এবং রশি বেয়ে তড়িৎ গতিতে পানসির
গলুইতে পৌঁছার চেষ্টা করতেই মাঝি দু'হাতে আসিফকে তুলে নেয় শক্ত সুঠাম হাতে।
হাঁপাতে
থাকে আসিফ। মাঝি একটু বিরক্তিভরা স্বরে বলে,মরতে বের অইছেন ডিঙ্গি নিয়ে এই পদ্মার
বুকে? কই যাইবার লাগছেন? দেখতেতো ভালা মানুষ লাগে। মাথায় ছিট আছে নাকি? বাড়ি কই
আপনের ?
সংযতভাবে
উত্তর দেয় আসিফ - আলমপুর। |
আলমপুর?
কার ছেলেগো আপনে?
আজিজ
মাস্টারের। ছ'মাস আগে তিনি গত হয়েছেন।
কি
কইলেন? আমাগো মাষ্টার সাহেবের ছেলে আপনে ? আ-হা-রে, ওমন মানুষ দুইন্যাতে আর
জন্মাবে কিনা সন্দেহ। ওই ধরেন, সাত, আটমাস আগে উনি আমার এই পানসিতে করে দুলহীনরে নিয়া ফিরাযাত্রায় এই কাশীপুরে
আইছিলেন। আমি খুব ভালা কইরা উনারে চিনি। যে দুলহীনকে নিয়া আইছিলাম হেই দুলহীনরে
নিয়া আবার আলমপুর যাইতাছি কিন্তু মাস্টার সাহেব দুইন্যা ছাইরা চইল্যা গেছেন,
আহারে.কি শুনাইলেন মিয়াভাই ? খারাপ মানুষ দুইন্যায় থাইক্যা যাইবো আর ভালা
মানুষরে আল্লায় উঠাইয়া নিব, না অইলেতো কিয়ামত আইবার পারবনা। আমাগোর মরণ নাই, ভাল
মাইনষরে দুইন্যাটা সহ্য করতে পারেনা। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নেয় মাঝি।
পশ্চিমাকাশের
দিগন্তরেখায় সূর্য ডুবু ডুবু। ক্রমেই ধেয়ে আসছে অন্ধকার। সেই অস্পষ্ট আলোয় এক নারীমূর্তি
নিরবে আসিফের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। ভাবলেশহীন, চোখে অশ্রু, দৃষ্টি দূরে ঢেউয়ের
পানে নিবদ্ধ।
ভূত
দেখার মতই চমকে উঠে আসিফ,একি, তুমি এখানে? এটা কি করে সম্ভব ?
এই
দুর্যোগপূর্ণ নদীর বুকে ডিঙ্গি নিয়ে কোথায় চলেছ? মরতে? কার জন্য? কি তোমার অভিপ্রায়
জানতে পারি? দুরে দৃষ্টি নিবদ্ধ এক মানবীর শান্ত অথচ দৃঢ় প্রশ্নের আকস্মিক উত্তর
খুঁজে পেতে দেরি হয় আসিফের। ঢোক গিলে বলে, মরব আবার কার জন্য? কে আছে আমার এ
পৃথিবীতে ? বাঁচতে চাই বলেইতো ভাসিয়েছিলাম ডিঙ্গি।ওখানে আমাকে পৌঁছতেই হবে।সেটা হয়তো
অনেকদুরের পথ,নির্জন একটি দারুচিনি দ্বীপ। যেখানে হারানোর বেদনা নিয়ে কষ্ট পেতে
হয় না। এখানে আর এক দণ্ডও নয়।কিসের মায়ায় আমি এ গ্রামে পড়ে থাকবো বল? নির্মম
এ পৃথিবী আমার জন্য কিছুই রেখে যায়নি। wbR©b এ দ্বীপটি খুঁজতে
খুঁজতে এ পৃথিবী হতে যদিবা হারিয়ে যাই সেটাও হবে আমার পরম পাওয়া। ঢেউয়ের তাণ্ডব
একটু থেমে গেলেই রওয়ানা দেব আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে। এ লক্ষ্য হতে পৃথিবীর কোন মায়া
আমাকে ফেরাতে পারবে না,GUv GKiKg mywbwðZ|
কখন
এলে? সংযত অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর। বাতাসে উড়ছে একরাশ দীঘল কালো চুল।
আজই।।
আমার
শশুরের মৃত্যুসংবাদ সময়মত পেয়েছিলে?
তোমার
শশুর? কি বলছ? তোমার শশুর আবার কবে মারা গেলেন?
চাচাতো একথা বলেননি আমাকে।
এ
মৃত্যুসংবাদ আমাকেও জানানো হয়নি। গতকাল আশিক এসে বলার পর জানতে পেরেছি। আশিক আমার
সাথেই আছে, ভিতরে ঘুমুচ্ছে। ওনার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল এই পানসিতেই। আমাকে দুলহীন
বেশে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। উনিই আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন।
শত বাধা বিপত্তির চাপে আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলেছিলেন,মা,ছোটবেলা থেকেই তোমাকে
পুত্রবধূ হিসাবে বরণ করে নিয়েছিলাম কিন্তু আশা অপূর্ণ রয়ে গেল। কার জন্য অপেক্ষা
করবে বল, যেখানে ছেলের কোন হদিস নেই ?
ওনার
কথা শুনে কেঁদেছিলাম প্রচুর, কিন্তু লাভ হয়নি। শুধু একটি কথা আদায় করতে পেরেছিলাম।
শশুরের মর্যাদা নিয়ে আজীবন তিনি আমার মনে বিরাজ করবেন। আমার গলা জড়িয়ে ধরে
বলেছিলেন এটাতো আমার মনের কথা,তুমি কেমন করে জানলে মা?
নারীহৃদয়ের
এক ব্যাকুল মমতা কেঁদে বুক ভাসিয়ে গলাটাকে আড়ষ্ট করে দেয় ফরিদার।
আসিফের
মুখে কথা জোগায় না। ভাষা যেন বোবা কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে অশান্ত ঢেউয়ের মত
তার হৃদয় সমুদ্র তোলপাড় করে দিচ্ছে। পৃথিবীর প্রতি শেষ মমতাটুকু যেন নিঃশ্বেষ হয়ে
গেছে। মাথাটা ভন ভন করে ঘুরছে। অন্ধকার হয়ে ওঠে চোখের দৃষ্টি। টাল সামলাতে পেরে
গলুই হতে ছিটকে পড়ে নদীবক্ষে।
চীৎকার
করে উঠে ফরিদা। নৌকার পাটাতনে হাটু গেড়ে নিচের দিকে চেয়ে পাগলের মত বলে উঠে,আমার
কথা শেষ হয়নি আসিফ। বিয়ের দু'দিনের মাথায় বিধবা হয়েছি। সে হয়তো তোমারই জন্য। মরতে তোমাকে আমি দেব না। কষ্টের মহাসাগর
পাড়ি দিয়ে তোমারই প্রতীক্ষায় দিন গুণে গুণে শুধু ধড় নিয়ে এখনো বেঁচে আছি। আর
এই সামান্য নদী হতে তোমাকে উদ্ধার করতে পারবনা ? শক্ত করে ধরে রাখো আসিফ।
তোমার
ডিঙ্গিতে করে আমিও যাব সেই দারুচিনি দ্বীপে, যেখানে আছে দারুচিনির খুশবু ভরা
মিষ্টি ভালবাসা, সে ভালবাসার খুশবু নিয়ে আমি নতুন করে তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই
আসিফ। তুমি না বলেছ, ওখানে হারানোর বেদনা
নেই। এত কাছে এসে দুরে চলে যাবে আমাকে না নিয়েই? আমার জীবন থাকতে সে হতে দেব
না....!
একটি
আর্তচীকারের মধ্যে দিয়ে ঝাপ দেয় ফরিদা নদীবক্ষে আসিফকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ধরতে
গিয়েও পারে না। প্রচণ্ড ঢেউ এসে আলাদা করে দেয় তাদের দুজনকে মুহূর্তে। ঢেউয়ের
সাথে যুদ্ধ করে আবারো এগিয়ে যায় দুজনে কিন্তু ধরাছোঁয়ার এই খেলায় শেষরক্ষা
হয়নি। ঢেউয়ের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়
তাদেরকে।
মাঝির
চিৎকারে আশিকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ রগরাতে রগরাতে নৌকার ছই হতে দৌড়ে বেরিয়ে
আসে। মাঝির মুখে বিস্তারিত শুনে খুঁজতে থাকে ফরিদাকে নদীবক্ষে।
আবছা
আলোতে দেখতে পায় প্রবল ঢেউয়ের তালে তালে ভাটির টানে ভেসে যাওয়া দুটো দেহের উপর
মাঝি সেজে বসে আছে দুটো গাংচিল পরম নির্ভয়ে।
বুবু
- উ-উ-উ। এ তুমি কি করলে বুবু-উ-উ ? আশিকের বিলাপ উত্তাল ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে
প্রতিধ্বনিত হয়ে তারই কানে ফিরে আসে বুমেরাং হয়ে।
********************