পিপিলিকার পাখা গজে মরিবার তরে (Must read)
-নাজমুল চৌধুরী
ভারত ও পাকিস্তান – পাশাপাশি প্রতিবেশী দু’টো দেশ। একে অপরের চোখের বালি। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টের পূর্বে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভূক্ত একটি দেশ। প্রায় দু'শ বছর একটানা শাসন করেছে ব্রিটিশ। ব্রিটিশদের পূর্বে শাসন করেছে মুঘলরা। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাণিজ্যের নামে এসে ক্রমশঃ সমগ্র দেশটি দখল করে ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটায়। তারও পূর্বে খন্ড খন্ডভাবে হিন্দু, মুসলমান, রাজপুত শাসকেরা শাসন করেছে এ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। অনেক উত্থান,পতন,শাসন,শোষণ যুগে যুগে দেখে এসেছে এ উপমহাদেশের মানুষ। এ অঞ্চলের মাটি কলুষিত হয়েছে বার বার বহিরাগতদের আক্রমনে। ইতিহাস রচিত হয়েছে অসংখ্যবার এবং সে ইতিহাস যোগ বিয়োগের মাধ্যমে বার বার নুতন করে ঢেলে সাজাতে হয়েছে।
ব্রিটিশরাজ এদেশ হতে বিতাড়িত হয়েছে স্বদেশী আন্দোলনের ঝাপ্টা সহ্য করতে না পেরে। উপমহাদেশে এ আন্দোলনের পুরোধায় ছিলেন বেশীরভাগ বাংলাভাষী বিপ্লবীরা যাদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। ইংরেজরা এদেশ ছাড়ল বটে তবে যাবার সময় উপমহাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ রোপন করে যায় তা একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দাঁড়িয়েও বলতে পারা যাচ্ছেনা এর শেষ কোথায়? কবে উপমহাদেশীয় রাজনীতিবিদদের সুবুদ্ধির উদয় হবে? অথবা আদৌ হবে কিনা এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন?
আশ্চর্য হলেও সত্য যে, এ উপমহাদেশে যুগের পর যুগ বিভিন্ন ধর্মের লোক পাশাপাশি অবস্থান করেছে এমনকি মুঘলদের সাতশ বছরের শাসনকালীন সময়ে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। দাঙ্গা করে মানুষ খুন করার কথা কেউ ভাবতেও পারেনি। ইংরেজদের দু’শ বছর ব্যাপী শাসনামলের মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার রোষানলে কেউ পতিত হয়নি।
ইংরেজ বিতাড়নের পর হতেই হঠাৎ করে কেন সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ প্রতিষ্ঠিত হল? সহজ এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা আজও খুঁজে পাননি। পাননি এর সমাধান। সমাধান খুঁজে বের করাতো দুরের কথা পরন্তু বিজ্ঞ নেতারা দিনের পর দিন খুঁজে হয়রান হচ্ছেন কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সমাজের গভীর হতে গভীরে প্রবেশ করিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটা যায়। এর ফলে সৃষ্ট হয়েছে মৌলবাদী দলগুলো।
ব্রিটিশরা স্বদেশী আন্দোলনের তেজ সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে বাঁচেলো বটে কিন্তু রেখে যাওয়া আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িকতার বীজ আজ শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে সমাজে বিষৰাষ্প ছড়াচেছ নিরন্তর। রাজনৈতিক মেরুকরণে সৃষ্ট উপমহাদেশের ধর্মপ্রাণ, সরলপ্রাণ মানুষগুলোর প্রতিহিংসা রক্তারক্তিতে পরিণত হয়েছে অনেকবারই - ১৯৪৭, ৫৪, ৬৪, ৯২ এবং আরো অনেকবার।
স্বাধীনতার পর হতে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ জুড়ে অসংখ্যবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। রক্ত নিয়ে রক্ত গঙ্গা বইয়ে দাও, রক্ত দিয়ে স্নান কর, ওদের কষ্টার্জিত ধনসম্পদ যা পার লুটে নাও, যুবতী পেলে শ্লীলতাহানি কর, পুড়িয়ে দাও জনপদ, ভেঙ্গে ফেল মসজিদ মন্দির। কিন্তু এতসব কারা করছে ? এমন ভাঙ্গাচোরা, ধ্বংসযজ্ঞের হোতা কারা? কাদের প্ররোচনায় এমনটি হয়? এ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামায়নি কেউ। মাখা ঘামাতে যাবেনা কোনদিন এ উপমহাদেশের রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দ।
ব্রিটিশরা যখন দেশ ভাগ করে যায় তখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে সীমান্ত নিয়ে অসংখ্য ক্রটি-বিচ্যুতি জিইয়ে রেখে যায়। যেগুলো সমাধানের পথ ধরে এগুতে গেলে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়।ওরা কলাকৌশল প্রয়োগ করে এ নিশ্চয়তা বুকে ধারণ করে দেশ ছেড়েছে তার অর্থ এই দাঁড়ায়, আমাদেরকে যখন শান্তিতে থাকতে দিলেনা তখন তোমাদেরকেও আজীবন পুড়িয়ে মারবো। হিংসা চরিতার্থের অভিপ্রায়ে ওরা কিছুনেতা,পাতিনেতা সৃষ্টি করে শিখিয়ে পড়িয়ে যায় সাম্প্রদায়িকতার সূত্র। সেইসব নেতারা পরবর্তী পর্যায়ে তাদের অনুচরদেরকে সমশিক্ষায় শিক্ষিত করে রাখতে চায় যার ফলশ্রুতিতে এ উপমহাদেশে শুরু থেকে সাম্প্রদায়িক পার্টির সৃষ্টি হয়। একের পর এক দাঙ্গা লেগেই আছে। এ যেন শেষ হওয়ার নয়।
কাশ্মীর মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট এক ভূ-খন্ড। এ ভূ-খভের সিংহভাগই ভারতের দখলে। জবরদখল করার প্রশ্ন নিয়ে পাকিস্তান এবং ভারতের ঘুম হারাম। কার দখলে যাবে কাশ্মীর নামক ভূ-স্বর্গটি। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভালমন্দ, উন্নতি নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই। মানুষ নয় ভূমির প্রয়োজন। উক্ত জায়গায় মালিকানা নিয়ে ১৯৪৭ সাল হতে শুরু করে আজও যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এ নিয়ে তিন তিনটি গুরুতর যুদ্ধ হয়ে গেল।
কাশ্মীরের মজলুম জনতা ছাড়াও এ দু'দেশের সাধারণ মানুষ যুদ্ধের তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করল। গরীব বলে পরিচিত হল বিশ্বে যদিও এখানের মাটিতে সোনা ফলে। সোনা ফলে বলেই এ উপমহাদেশ যুগে যুগে আক্রান্ত হয়েছে ভিনদেশীদের হিংস্র থাবায়। এ বিরাট বিস্তৃীত ভূ-খন্ডের অধিবাসীরা বিভিন্ন সময়ে নিজেদের দেশে নিজেরাই বন্দীত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। কথা হল কাশ্মীরকে নিয়ে। জবরদখলের ইচ্ছা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান মনোনিবেশ করল প্রচন্ড শক্তি সঞ্চয়ে। সাধারণ মানুষের ভাগ্য তেমন পরিবর্তন না হলেও এ দু’দেশের সামরিক শক্তিতে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে নাটকীয়ভাবে।
১৯৯৮ এর মে মাসে প্রকাশ্যে দু’দেশের শক্তি প্রদর্শিত হল। ভারত ১১ এবং ১৩ই মে’ ৯৮ ইং-তে পরপর পাঁচটি আণবিক বোমার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। ইতিপুর্বে ১৯৭৪ ইং-তে ছোটআকারের একটি আণবিক বোমা পরীক্ষা করেছিল। সেই সূত্র ধরে পাকিস্তান বসে থাকার পাত্র নয়।
২৮ এবং ৩০ শে মে’ ১৯৯৮ তে পাকিস্তানও পাঁচটি আণবিক বোমার বিষ্ফোরণ ঘটালো। সারা বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল গরীব এ দু’টো দেশের দিকে। এর পূর্বে বৃহৎ শক্তিবর্গ পাকিস্তান ও ভারতকে CTBT (Comprehensive test ban treaty) তে সই করার জম্য বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল। ভারতের প্রশ্ন আমাদেরকে যদি এ ট্রিটিতে সই করতে হয় তাহলে পরমাণুধর সকল দেশকে তা করতে হবে। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এবং অঘোষিত ইসরাইল ও উত্তর কোরিয়া যদি সই করে তাহলে আমরাও করবো।
পাকিস্তানের উত্তর হল ভারত যদি সই করে তাহলে আমরাও করব। উভয় দেশের যুক্তিকে অগ্রাহ্য করা যায়না। যুক্তির অবতারণা না করে বৃহৎ শক্তিবর্গ পাকিস্তান ও ভারতকে অর্থনৈতিক অবরোধ করার অভিপ্রায় জানালো। আজ বিশ্বচিত্রকে যদি সঠিকভাবে চোখের সামনে মেলে ধরা যায় তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে ফিলিস্তিন, চেচনীয়া, বসনিয়া, কসবো, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, কুর্দিস্তান, লিবিয়া, লেবানন, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, কঙ্গো, ফিলিপাইন, সোমালিয়া ইত্যাদি দেশগুলোতে কি হচ্ছে ?
কাদের প্ররোচনায় এ দেশগুলোতে যুদ্ধ এবং সংঘাত লেগেই আছে। অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর একটিই। শক্তিধর বড়রা ছোটদেরকে শান্তিতে থাকতে দেবেনা। তাদের স্বার্থের পরিপন্থী কিছু করে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবেনা। তাদের স্বার্থে আঘাত এলে পাশাপাশি দেশকে মদদ যুগিয়ে যুদ্ধে উৎসাহিত করে। চীন পাকিস্তানকে মদদ যোগাচ্ছে কারণ প্রতিবেশী ভারতকে সামরিকভাবে দুর্বল করে রাখতে হলে চীনের প্রয়োজন পাকিস্তানের শক্তি বর্ধন করা। কারণ সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিবাদ রয়েছে।
১৯৬২ সালে চীন ভারতীয় কিছু ভূ-খন্ড জোর করে দখল করে নিয়েছিল। তখন ভারতকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল রাশিয়া ও ইসরাইল। বর্তমানে ইসরাইলের চাপে আমেরিকাও ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করে সাহায্য করছে। ভারতকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করার পেছনে ইসরাইলের একমাত্র ইচ্ছা হল কোন মুসলিম দেশ যাতে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী না হয়। তাই আধুনিক অস্ত্র দিয়ে, প্রযুক্তি দিয়ে ভারতকে শক্তিশালী করছে।
পাকিস্তানকে দমাতে হলে ভারতকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রের যোগান দিতে হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আধূনিক সামরিক শিক্ষাসহ আণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশ হিসাবে তৈরী করে নিতে হবে। আমেরিকা ও ব্রিটিশ সাহায্যপুষ্ট ইসরাইল জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে আমেরিকার সাহায্যে নিজেদের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করে আসছে সাম্প্রতিক কালে। মনে রাখতে হবে ইহুদিরা কারোর বন্ধু নয়। ইহুদি নয় এমন ধর্ম বিশ্বাসীদেরকে তারা জ্যান্টাইল বা এন্টি সেমিটিক হিসাবে ডাকে। ইহুদিদের একমাত্র উদ্দেশ্য যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে পৃথিবীর সমগ্র ধর্মকে পরাভূত করে তারাই হবে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক, যেহেতু তারা মনে করে তারাই ঈশ্বরের মনোনীত জাতি আর অন্যরা তাদের তাবেদার।
আমেরিকার পরম বন্ধু ইসরাইল শত কুকর্ম করলেও তাদের উপর জাতিসংঘের কোন খবরদারী চলেনা। অবরোধের প্রশ্ন আসেনা। ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য অধিকারকে সমূলে উৎখাত করে দিব্যি আছে ইসরাইল। সারা দুনিয়া এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও আমেরিকা ও ব্রিটেন নির্বিকার। ইহুদি নেতাদের ইচ্ছায় আমেরিকা এবং অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। আইপেক-এর সদস্য ধনাধ্য ইহুদিরা তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে অর্থের যোগান দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে।ইহুদিদের সমর্থন
ছাড়া নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যায়না। তাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কখনো ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের বিপক্ষে যেতে পারেনা।
সিটিবিটি-তে সই করার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গ ইসরাইলকে কোন চাপ দেয়না। চাপ প্রয়োগ করছে পাকিস্তান, ভারত ও উত্তর কোরিয়াকে। এখন কথা হল -সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তান ও ভারত যে পারমাণবিক মরণাস্ত্র হাতে পেয়েছে তার প্রয়োগ ঘটালে কি হতে পারে উপমহাদেশের সাধারণ জনগনের ভাগ্যে?
এ সুন্দর পৃথিবী নামক গ্রহের কি অবস্থা দাঁড়াৰে যদি আণবিক শক্তিধারীরা এ শক্তির প্রয়োগ ঘটায় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। দেখা যায় মাত্র পাঁচমিনিটের ব্যবধানে সমগ্র পৃথিবীর কোমল শস্যক্ষেত্র ও মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পারমাণবিক শক্তিধরেরা যদি কোন ভুল করে বসে তাহলে এ ভুলের মাসুল দিতে হবে সারা বিশ্বকে।
১৯৪৫ সালের পর হতে এ পর্যন্ত মোট ২,০৫০ টিরও অধিক আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে উন্মোক্ত সাগরে, গিরিগুহায় কিংবা নির্জন মরুভূমিতে। বর্তমান বিশ্বে যত হাইড্রোজেন ও নিউট্রন বোমা বিভিন্ন দেশে মওজুদ রয়েছে এগুলো দিয়ে বর্তমান পৃথিবীর মত ৭টি পৃথিবীকে সমুলে ধ্বংস করে দেয়া যায় কয়েক মিনিটের মধ্যে।
দেখা যাক ১৯৪৫ সালে আজকের আণবিক বোমার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের বোমা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে নিক্ষেপের পর কি প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল? যে দু’টো দিনকে ইতিহাসের পাতায় মানবসভ্যতার কলঙ্কময় দিন হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।
১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট ভোরবেলা। হিরোশিমার কর্মক্লান্ত ঘুমন্ত মানুষগুলো ভোরের সূর্যাদয়ের পরপর জেগে উঠছিল একে একে। ভোরের পাখীরা গান গাচ্ছিল আপন মনে। পত্রপল্লবে শিশির বিন্দু। পূব-আকাশের দিগন্ত রেখায় সোনালী সূর্য দিনের আগমনী বার্তা ঘোষণা করছে। পরম তৃপ্তিতে নবজাতক শিশুরা তাদের খাদ্য চুষে নিচ্ছে মায়ের বুক হতে। স্কুলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে হাজারো শিশু।
এমনি এক মূহুর্তে আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমান ৬ই আগষ্ট রাতে আমেরিকান ঘাটিতে অপেক্ষমান বিশেষ একটি মিশন বাস্তবায়নের জন্য। কর্ণেল পল ডব্লিউ তিব্বত (বিমানের পাইলট) এর নের্তৃত্বে মোট ন’জন ক্রুর সমন্বয়ে গঠিত একটি দল কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে বিমানে আরোহন করে।
নির্দিষ্ট সময় বিশাল বি-২৯ বিমানটি রাতের আঁধার ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে হিরোশিমার উদ্দেশ্যে। হিরোশিমা পৌঁছতে মাত্র দু'ঘন্টা বাকী। পাইলট কর্ণেল পল মুখ খুলল। উপস্থিত সবার কাছে গোপন এ মিশনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল। কি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তারা? টমাস ফ্যারিবি (২৬) পাইলটের নির্দেশের অপেক্ষায়। তার উপর দায়িত্ব ছিল সুইস বটম টিপে বোমাটি যথাস্থানে নিক্ষেপের। ঠিক সময়, ঠিক জায়গায় বোমাটি ফেলতে হবে। পাইলট কথায় কথায় জানালো যে বোমাটি নিক্ষেপ করা হবে তার প্রতিক্রিয়া কারোর জানা নেই, এমনকি এর আবিষ্কারক বৈজ্ঞানিকদের কেউ জানেননা এর সত্যিকার ক্ষমতা কতটুকু? যেহেতু এ ধরণের বোমার প্রয়োগ এই প্রথমবারের মত। এ বোমাটির সাফল্য হয়তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারে। সবাই মনযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলো।
সময় ঘনিয়ে এল। টমাস ফ্যারিবির আঙ্গুল তখন পুশ বটনে। ক্যামেরা রেডী। রেডিয়েশনের প্রতিক্রিয়া ক্যামেরায় বন্দী করে রাখতে হবে। নির্দেশ এলো। তখনকার ফ্যারিবির ২৬ বছরের রক্ত টগবগিয়ে উঠল। মাত্র ৪৩ সেকেন্ডে হিরোশিমার কোমল মাটিতে বোমাটি পড়ে বিষ্ফোরিত হল ভয়ানক শব্দে। মাটি কাঁপিয়ে কালো ধোঁয়া ব্যাঙ্গের ছাতার মত রূপধারণ করল আকাশে। তারপর তেজস্ক্রিয় পদার্থ লাল, নীল, সবুজ, গোলাপী বিভিন্ন রং-য়ে অণু-পরমাণু হয়ে সামনে, পশ্চাতে, ডানে, বামে ছুটলো।
হিরোসিমা শহরের প্রায় দেড়লক্ষ মানুষ এবং পশুপক্ষী তৎক্ষণাৎ চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ল। মোট ৪.৪ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এর ধ্বংসলীলা চলে। ”ইনোলা গে” নামক বি-২৯ বোমারু বিমান হতে ৬৪ কেজি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ “লিটল বয়” আণবিক বোমা কর্ণেল পল ডব্লিউ-এর নের্তৃতে হিরোসিমার সিমা সার্জিকেল ক্লিনিকের উপর নিক্ষেপ করা হয়।
তিনদিনের মাথায় ৯ ই আগষ্ট ১৯৪৫ ইং, একই কায়দায় নাগাসাকিতে ”ফ্যাট ম্যান” নামক অপেক্ষাকৃত ছোট ৬.৪ কেজি ওজনের আণবিক প্লোটনিয়াম বোমা একটি টেনিস কোর্টে মেজর চার্লস ডব্লিউ সুইনি কর্তৃক নিক্ষিপ্ত হয়। এ বোমা শিল্প নগরী নাগাসাকিতে ৭,০৫০ ডিগ্রি উত্তাপ সৃষ্টি করে এবং এর আণবিক কণাগুলো ঘন্টায় ৬২৪ মাইল বেগে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। একলক্ষ চল্লিশ হাজার মানুষ, ঘরবাড়ী ও পশুপক্ষী নিমেষে ধূলায় মিশে গেল।
প্রেতপুরী হিসাবে পড়ে রইল হিরোশিমা ও নাগাসাকি। বিশ বছর ধরে সেখানে ঘাস পর্যন্ত জন্মায়নি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। মনুষ্য বসবাসের উপযোগী রইলনা অনেক বছর পর্যন্ত।
১৯৪৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাপান আত্মসমর্পণ করল তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। হিরোশিমা ও নাগাসাকির নিরীহ মানুষগুলো মরে গেল বটে কিন্তু বেঁচে রইল কর্ণেল পল, সুইনি, ফ্যারিবি ও অন্যান্য ক্রুরা। ওদের কয়েকজন আজও বেঁচে আছে। পল ও ফ্যারিবি মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে জানায় - পরমাণবিক বোমায় এত মানুষ মরে গেলেও আমাদের দুঃখ নেই কারণ এ দুটো বোমা জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে। থামাতে পেরেছে যুদ্ধ। যুদ্ধ থামাবার জন্য এত প্রয়াস যদি হয়ে থাকে তাহলে যুদ্ধ বাঁধানোর প্রয়োজন কেন হয়েছিল?
যুদ্ধ থামাতে গেলে নিরীহ লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার নীতি ফ্যারিবি বা তার দেশের তখনকার নের্তৃবৃন্দকে প্রভাবিত করেনি। সাধারণ মানুষ মেরে যুদ্ধ থামানোর অদ্ভুত ফরমূলা মানবতার নীতি হতে পারেনা। মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার রক্ষা করে আপোষ করার নীতিই মানবতার নীতি।
মানুষের জীবন নেবে সে-ই, যে জীবন দিয়েছে। সুতরাং পল, ফ্যারিবি বা তার দেশের যুদ্ধবাজরা যা-ই বলুক সেটা হবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকায় মত কৈফিয়ত, নিজেদের নৃশংসতাকে বিশ্ববাসীর কাছে ঢাকার অপচেষ্টার সামিল।
যুদ্ধ যারা জড়ালো মূল সমস্যা সমাধানে তখনকার সময়ে তাদেরই এগিয়ে আসা উচিত ছিল। যদি সামরিক লোক সামরিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করে তাহলে কারোর বলার কিছুই থাকেনা কারণ উভয়েই হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত।
হিরোশিমায় আণবিক বোমা নিক্ষেপের নের্তৃত্বদানকারী কর্ণেল পল উব্লিউ তিব্বত ৯২ বছর বয়সে শ্বাসকষ্টে মারা যায়। এক সাক্ষাৎকারে সে বলেছিল হিরোসিমায় ১,৬৬,০০০ নিরপরাধ লোকের মৃত্যুতে সে অনুতপ্ত নয়। তার শেষ ই্চ্ছানুযায়ী তার মৃতদেহ জ্বালিয়ে ইংলিশ চ্যানেলে ছাই নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সে চায়নি কবর দিলে তার কবরে গিয়ে মানুষ তার কৃতকর্মের জন্য তাকে অভিসম্পাত করুক।
নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপকারী মেজর জর্জ ডব্লিউ সুইনি এক সাক্ষাৎকারে বলে, হতাহতের জন্য সেও দুঃখিত নয় বরং জাপানীদেরকে নাকি সমূলে বিনাশ করাই উচিত ছিল। ২০০৫ সালে হৃদরোগে সে মারা যায়।
আণবিক বোমার জনক বলে খ্যাত রবার্ট জে ওপেনহিমার, হাইড্রোজেন বোমার জনক এডওয়ার্ড টেলর, নিউট্রন পারমাণবিক বোমার জনক স্যামুয়েল টি কোহেন এদের তিনজনই ইহুদি সম্প্রদায়ভূক্ত।
রবার্ট জে ওপেনহিমার ১৯৬৭ সালে ৬৩ বছর বয়সে ক্যানসারে মারা যায়। স্যামুয়েল টি কোহেন ২০১০ সালের ২৮ শে নভেম্বর ৮৯ বছর বয়সে হৃদরোগে মারা যায়। তার ইচ্ছানুযায়ী তার মৃতদেহকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এডওয়ার্ড টেলর ২০০৩ সালে ৯৫ বছর বয়সে ষ্ট্রোকে মারা যায়।
মরণাস্ত্র আণবিক বোমার আবিষ্কারক, নিক্ষেপণকারীরা মানবসভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কজনক ও নিষ্ঠুরতম স্থান দখল করলেও আমেরিকাতে তাদেরকে বীরের সম্মান দেয়া হয়। আণবিক বোমা আবিষ্কারের জনক তিনজন ইহুদী বিধায় ইহুদিরা তাদেরকে নিয়ে গর্ব করে।
১ম বিশ্বযুদ্ধে ১ কোটি সেনাসদস্য ও ৭০ লক্ষ সাধারণ লোক মৃত্যুবরণ করে। অসংখ্য আহত হয় এবং পঙ্গুত্ববরণ করে।
২য় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২ কোটি সেনাসদস্য ও প্রায় ৫ কোটি সাধারণ মানুষ মারা যায়। তাছাড়া যুদ্ধের কারণে প্রায় ২ কোটি লোক অনাহারে, অর্ধাহারে এবং রেডিয়েশন জনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় কিংবা মারা যায়।
জাপানের যে সমস্তু নিরপরাধ শিশু এবং নরনারী পঙ্গু হয়েছে বিষাক্ত গ্যাসে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘুমের ঘোরে মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করেছে - পল, সুইনি, ফ্যারিবি ও তাদের দেশের যুদ্ধবাজদের তা অনুধাবন করার কথা নয়।
এখানে বোমার তেজোষ্ক্রিয়তা হতে বেঁচে যাওয়া হিরোশিমার একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য বর্ণনা করছি। জাপানে আণবিক বোমা নিক্ষেপকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে এ ধরণের একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য ইয়াহিকো হিরোশিমায় বেঁচে যাওয়া অল্প কয়েকজনের মধ্যে একজন।
পাকিস্তান ও ভারতের আণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিষ্ফোরণের কথা শুনে তিনি পাকিস্তান ও ভারত সফরে গিয়েছিলেন। প্রথমে পাকিস্তানে পরে ভারতে। করাচী বিমানবন্দরে অবতরণের পর সাংবাদিকদের বলেন - আমি এসেছি পাকিস্তানী আপামর জনগণকে এ বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করতে যে, পারমাণবিক যুদ্ধে কেউ জয়ী হতে পারেনা। এ বোমা সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে কারণ এটি ধ্বংসের জন্যই তৈরী করা হয়।
এ বোমার ধ্বংসাত্মক দিকটা উপমহাদেশের অধিবাসীদের ভাবা উচিত। তিনি হিরোশিমার ৯ই আগষ্ট’ ১৯৪৫ এ দিনটির কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আমি তখন জুনিওর স্কুলের ছাত্র। হাজার হাজার লোক সেদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল, কেমন করে আমি বেঁচে গেলাম তা আজও আমায় কাছে একটি বিস্ময়। আমার পরিবারের সবাইকে হারিয়েছি। আমার ছোট বোনদের এবং একশত ঊননব্বই জন সহপাঠিদের সবাইকে। তিনি বলেন যুক্তরাষ্ট্রকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি এবং সম্ভব হলে এর প্রতিশোধ একদিন নেব। বর্তমানে আমার নাতনীরা রয়েছে। আমি চাই তারা শান্তিতে থাকুক।
আমি আজীবন সংগ্রাম করে যাব যতদিন এ পৃথিবী হতে আণবিক বোমা অপসারিত না হবে। আমি আশা করি ভারত ও পাকিস্তানের নের্তৃবৃন্দ যে ধ্বংসাত্মক খেলায় মেতে উঠেছেন সে খেলা থেকে অবিলম্বে তারা বিরত হবেন। উভয় দেশের সমস্যাকে সমঝোতার মাধ্যমে নিস্পত্তির জন্য তিনি আকুল আবেদন জানান। আজ পাকিস্তান ও ভারতের শান্তিপ্রিয় জনগণের মনে অসংখ্য প্রশ্ন। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষেপিত আণবিক বোমার চেয়ে অধিক শক্তিসম্পন্ন পারমাণবিক বোমা আমাদের ও উত্তরসূরীদের জীবনকে কতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারে? মূল সমস্যা সমাধানে না গিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের নের্তৃবর্গ একে অপরকে প্রয়োজনে আণবিক বোমা ব্যবহারের হুমকি দিচ্ছেন। এ সমস্ত নের্তৃবৃন্দ কি নিশ্চিত এর প্রয়োগ ঘটালে তারা নিজেরা বেঁচে যাবেন?
আমরা কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব এ পৃথিবীর আলোবাতাস হতে? আমাদের উত্তরসূরী যাদের জন্য আমরা শহর, বন্দর গড়ছি, নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছি - তাদের কি হবে?
পাকিস্তান ও ভারত এ খেলায় মেতে উঠলে প্রতিবেশী দেশগুলো কি বাঁচবে? মনে রাখা দরকার - পারমাণবিক বোমা সীমান্ত মানেনা, নিরীহ জনগোষ্ঠি বুঝেনা, তার তেজস্ক্রিয়তা সীমান্ত অতিক্রম করতেও দ্বিধা করেনা। ভারত, পাকিস্তানের কাছাকাছি দেশসমূহের আপামর জনসাধারণের মধ্যে কেউই নিরাপদ নয়। পাগলা হাতী যখন ছুটে তখন সামনে যা পায় তার সবকিছুই লন্ডভন্ড করে দেয়।
ভাবার সময় এসেছে আজ পাকিস্তান ও ভারতের। একঘেয়েমী ও হিংসাত্মক মনোভাব পরিত্যাগ করে পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে দু’পক্ষের বিদ্যমান সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দু’পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। সমস্যার গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে নের্তৃবৃন্দকে, উপমহাদেশের সভ্য সমাজের সবাইকে - নিজের জন্য, অপরের জন্য ও ভবিষ্যৎ উত্তরসূরীদের জন্য। নতুবা ”পিপীলিকার পাখা গজে মরিবার তরে” - এ সত্যই উপমহাদেশের মানুষের জীবনে প্রতিফলিত হবে।
==============================
No comments:
Post a Comment
What do you think?