(১৯৮৯ সালে সৌদিআরবের দৈনিক একটি পত্রিকায় একটি বাঙ্গালী পরিবারের ছোট্ট একটি মেয়ের
হৃদয়বিদারক নিখোঁজ কাহিনী প্রকাশ পায় – তারই
আলোকে এ গল্পের অবতারণা)
ফেরারী
- নাজমুল চৌধুরী
আল রাওয়া পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বিস্তীর্ণ মরুর বালুভূমি চিকচিক করছে খোলা আকাশের নিচে। মদীনা-ইয়ানবু মহাসড়ক হতে ঠিক পূর্বদিকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পেরোলেই নজরে পড়বে আল নাখল বেদুঈন পল্লী। বেদুঈন কিছু পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে এ পল্লী। ওখান হতে হেঁটে পিচঢালা পথে দশ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে পাথুরে পাহাড়বেষ্টিত আল-রাওয়ার বিস্তীর্ণ মরুভূমি। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য খেজুর বাগান। গাছে গাছে ঝুলে আছে থোকা থোকা হলুদ রঙের খেজুরগুচছ। প্রকৃতির এ এক ভিন্ন রূপ। দেলোয়ার পরিবার প্রকৃতির এ রূপ দেখতে এসেই ঘটেছিল ব্যাপারটি।
পঁচিশে সেপ্টেম্বর '৮৯ এর একটি বিকেল। ইয়ানবু শহরের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার সাহেব জোৎস্নামাখা রাতে মরুর সৌন্দর্য্য ভোগের জন্য একমাত্র ছেলে মামুনের আবদার উপেক্ষা করতে পারেননি সেদিন।
মামুন ও মুন্নীকে নিয়েই দেলোয়ার সাহেব ও স্ত্রী রত্নার সাজানো সংসার। সপ্তাহে ছুটির দুটো দিন দেলোয়ার সাহেব ইয়ানবু শহর ঘেষে লোহিত সাগরের তীরে, পার্কে কিংবা বন্ধুবান্ধবের বাসায় স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে নিয়ে সময় কাটাতে ভালবাসেন। বিগত পনেরো বছর ধরে দেলোয়ার সাহেবের একই রুটিন। মামুন ও মুন্নী যখন ছিলনা তখন স্ত্রী রত্নাকে নিয়ে এখানে সেখানে ইচ্ছামত বেড়াতে যেতেন। আজকাল ছেলেমেয়েদের বায়নাকে প্রাধান্য দিতে হয়।
মামুনের খুব ভাল লাগে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র সে। ছোট বোন মুন্নী একই স্কুলে নার্সারীতে পড়ে।
মরুভূমিতে জোৎস্নামাখা রাতে বেড়ানোর স্বপ্ন মামুনের অনেক দিনের। সহপাঠিদের অনেকের কাছে গল্প শুনে আসছে আকাশে ভাসমান পূর্ণিমার চাঁদ আর তারকারাজির কোলাকুলি মরুভূমিতে যে না প্রত্যক্ষ করেছে তাদের জন্মই বৃথা। এ ধরণের গল্প শুনে শুনে এমনি একটি দিনের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছিল মামুন। আজ স্বপ্নের সে দিনটি এসেছে।
পর্যাপ্ত খাবার ও পানীয় বোঝাই করা তাদের লিফট ব্যাক টয়েটা ক্রেসিডা গাড়িখানি সন্ধ্যার পরপরই আল--রাওয়ার বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তরে এসে থামে
আশেপাশে কোন লোকালয় নেই। পূর্ণিমার চাঁদ পূব আকাশের গায়ে উঁকি দিচ্ছে। মামুন চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। মনে তার আনন্দ ধরেনা। এক অজানা আবেগে শিহরিত হয় তার দেহ মন। আকাশের গায়ে পূর্ণিমার চাঁদটি যেন লেপটে আছে ঝলসানো এক রুটির মত। পৃথিবীর আমন্ত্রনে চাঁদটি যেন নির্ভয়ে নেমে এসেছে কয়েকশো মাইল নিচে। আর তাকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে সাথে নেমে এসেছে নীলাকাশ জুড়ে অযুত নক্ষত্রের দীপালী। সূতা দিয়ে গাঁথা মালার মতই সপ্তর্ষিমন্ডল চাঁদটিকে যেন পেঁচিয়ে আছে। নক্ষত্রের মেলা বসেছে চাঁদের হাটে। মিট মিট করে সমস্ত আকাশ জুড়ে জ্বলছে নক্ষত্ররাজি। এমনি করে কখনো চাঁদতারার এ অপরূপ সৌন্দর্য ভোগ করেনি মামুন। পিতামাতাকে বায়না ধরে অনেক রাত অবধি এখানে থাকার। নিস্তব্ধ রাতের অতন্দ্র প্রহরে আরও ভালকরে জোৎস্নার সান্যিধ্য চায় সে। সম্মতিসূচক সাড়া পেয়ে হৃদয়ে এক রোমাঞ্চ অনুভব করে সে। কি যে ভালো লাগছে তার! ইচ্ছে হচ্ছে দিগন্তব্যাপী সাদা বালুর সমুদ্রে বিচরণ করে প্রাণ জুড়ায়। একহাতে মুন্নীকে এবং অপরহাতে মুন্নীর প্লাষ্টিকের বলটি ধরে এগিয়ে যায় মামুন অনেকদুরে পিতামাতার অনুমতি নিয়ে। যতই দুরে যায়না কেন সবকিছুই যেন আয়নার মত স্বচ্ছ। দুরে চারপাঁচটি উট এদিক সেদিক বিচরণ করছে। চাঁদের নরম আলো লেপটে আছে মরুর আঙিনায়।
দুর থেকে বাবা মাকে দেখতে পাচ্ছে মামুন। গাড়ীর পাশে মেট বিছিয়ে বসে গল্প করছেন ওরা দুজনে। চারবছরের মুন্নী মেতে আছে আপন ভূবন নিয়ে। কারোর দিকে তাকাবার ফুরসৎ তার নেই। বা হাতে মুটিভরে বালুরাশি উড়িয়ে দিচ্ছে মরুর ঝিরঝির বাতাসে আর সৃষ্টির উল্লাসে হাসছে বার বার।
খেলুক মুন্নী, যত ইচ্ছে তার মন চায় - তার আনন্দে বাঁধা দিয়ে আজ তাকে বিড়ম্বিত করবে না মামুন। দুরে, অনেক দুরে একপাল মেষ দেখা যাচ্ছে। মামুন আপন মনে গেয়ে উঠে - মেরী হ্যাজ এ লিটল ল্যাম্ব, লিটল ল্যাম্ব...। মুন্নীও সুর ধরে মামুনের সাথে। প্রিয় এ ছড়াগানটি শুনতে পেলে মুন্নী চুপ থাকতে পারেনা। ফিলিপিনো টিচার মিসেস হেলেনা কি সুন্দর করেই না ক্লাসে এ গানটি শিখান।
রাত যত গভীর হচ্ছে বাতাসের গতি তত বাড়ছে।
আকস্মিক কুন্ডলী পাকিয়ে কালো মেঘের মত একপাহাড় ধূলো আকাশে উড়ে গেল প্রবল বেগে।
কোনরূপ নোটিশ না দিয়ে শান্ত প্রকৃতির আকস্মিক এ পরিবর্তনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান দেলোয়ার
সাহেব। মূহুর্তে প্রকৃতির বুকে নেমে আসে ভয়ঙ্কর রূপ। তপ্ত বালুমাখা ঘূর্ণিঝড়।
মামুন ও মুন্নীকে ডাকতে গিয়ে প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে গাড়ীতে ফিরে আসেন তিনি।
গাড়ীর হ্যাজার্ড লাইট চারটি জ্বালিয়ে দেন যাতে মামুন ও মুন্নী দেখতে পেয়ে
গাড়ীতে ফিরে আসে।
চিৎকার করে মামুন ও মুন্নীকে ডাকতে থাকেন গাড়ীর জানালা ফাঁক করে। দমকা ঝড়ে খই ফোটা বালির আঁচড় সারা শরীরে যেন হুল ফোটাচ্ছে মৌঁমাছির মত। অসহায়ের মত চেয়ে থাকেন ছেলেমেয়ের ফেরার পানে। হর্ণ বাজান পাগলের মত। কিছুক্ষণ পর ঝড়ের বেগে মামুন মুখ ঢেকে গাড়ীতে ঢুকে। হাউমাউ করে কেঁদে বলে - বাবা, মুন্নীকে খুঁজে পাইনি। চিৎকার করে ডাকলাম, অনেক খুঁজলাম বালুঝড়ের অন্ধকারে কিন্তু মুন্নীর সাড়া মেলেনি। এতই অন্ধকার যে কিছুই দেখতে পাইনি। গাড়ীর হ্যাজার্ড লাইট দেখে দুহাতে চোখমুখ ঢেকে ফিরে এলাম। এখন কি হবে মুন্নীর? কাঁদো কাঁদো স্বরে মামুনের চোখেমুখে একরাশ প্রশ্ন।
মিসেস রত্না ভেঙে পড়েন কান্নায়। চীৎকার করে ডাকতে থাকেন মুন্নীকে। দমকা বাতাস আর বিস্তীর্ণ মরুভূমির বালুঝড়ের শব্দে সে ডাক আর্তচীৎকারে প্রতিধ্বনিত হয় বাতাসের ইথারে। দেলোয়ার সাহেব ঢোক গিলে বলেন ভেঙ্গে পড়না, চীৎকার করে কোন লাভ হবেনা। বরং দোয়া কর আল্লাহ যাতে ওকে সহিসালামতে রাখেন। ঝড় থামলে ওকে খুঁজে নিয়ে আসব – চিন্তা করোনা। বললেন বটে কিন্তু ছোট্ট একটি শিশু কিভাবে এ ঝড়ের ঝাপটা সামলাচ্ছে তা ভেবে নিজেই ভেঙ্গে পড়েন। চিন্তার বেদীমূলে মাথা কুটে মরেন কোন সুরাহা না পেয়ে। গাড়ীর সিটটি পিছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকেন। এক অসহ্য বেদনায় পিতৃহৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
অনাহুত বিপদের হিংস্র থাবার শোকে বিহ্বল
তিনটি হৃদয় গাড়ীর ভিতর ছটফট করে মরে। মুন্নী কি বেঁচে আছে? এ প্রশ্নবাণ তাদের
তিনজনের মনের তিমিরে মাথা কুটে এক অব্যক্ত বেদনায় ঢুকরে কেঁদে উঠে। অন্ধকার গ্রাস
করে পৃথিবীকে।
ঝড়ের তান্ডবলীলা যখন থামল তখন দেলোয়ার সাহেব ছেলেকে বলেন,মামুন তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে যাও। কিন্তু ভাগ্যহত পিতা ও ছেলে শত চেষ্টা করেও দরজা দু’ইঞ্চির বেশী ফাঁক করতে পারলেন না। সমস্ত গাড়ীটি চাপা পড়ে আছে বালুর নিচে। শাস কষ্ট হচ্ছে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে।
এমতাবস্থায় মামুন বসে থাকতে পারেনা। অন্ততঃ বাঁচার জন্য লড়তে হবে যতক্ষণ শ্বাস আছে। উপস্থিত বুদ্ধিকে কাজে লাগায় সে। গাড়ীর রিডিং লাইট জ্বালিয়ে পিছনের সিটটি সামনে এনে ইদুরের মত গাড়ীর ট্রাংকে ঢুকে পড়ে সে। টুলবক্স হতে হাতুড়ি, প্লাস ও স্ক্রু ড্রাইভার বের করে নেয় তড়িৎ গতিতে। হাতের আঙ্গুল চালিয়ে ট্রাংকের তালাটি আলতোভাবে খুলে দেয়। চাকা খোলার জ্যাকটি টুলবক্সের ওপর সঠিক অবস্থানে রেখে ক্রু-ড্রাইভার জ্যাকে ঢুকিয়ে ঘুরাতে থাকে সে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে। জ্যাকটি শক্তি পেয়ে এবার ট্রাংকের বডিকে আস্তে আস্তে উপরের দিকে ঠেলছে। চারইঞ্চির মত ফাক করে মামুন।
বড় করে একটি নিশ্বাস নেয়। শাসকষ্ট হচ্ছে তার। নিশ্চয় বাবা মা অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করছেন নিজেদের সিটে। হঠাৎ মাথায় তার এক বুদ্ধি খেলে যায়। স্পেয়ার টায়ারের বাতাস ছেড়ে দিলে কেমন হয় ? নিশ্চয়ই অক্সিজেন সমস্ত গাড়ীতে ছড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া হাতের কাছে আরও দুটো জিনিষ রয়েছে তার । এগুলোর ব্যবহার না হয় পরে করবে। স্পেয়ার টায়ারের বাতাস ছেড়ে দিয়ে প্রবল শক্তি দিয়ে এবার বডিটি আরও উপরে উঠিয়ে নেয় সে। সুযোগ পেয়ে বালু ঢুকে প্রচুর।
বালু ভেদ করে কোনরকম বেরিয়ে যেতে পারলেই হয়। গাড়ীতে রাখা একটি কাঠের লাঠিকে কাজে লাগায় সে। গাড়ীতে রাখা একটি পলিথিনের ব্যাগে মাথা ও মুখ ঢেকে প্রায় ষোল ইঞ্চি ফাক দিয়ে গড়িয়ে বাইরে এসে কাঠের সাহায্যে বালু সরাতে সরাতে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে থাকে মামুন। বেরোনের সময় সমুদ্রে সাঁতার কাটার জন্য রক্ষিত তার ও মুন্নীর ছোট্ট দু’টো প্লাষ্টিক বোটের বাতাস বেরুনোর জন্য ফুটো করে দিয়ে আসতে ভুলেনা সে, যাতে তার বাপ মায়ের অক্সিজেনের অভাব না হয়।
দু'হাতে এবং কাঠের সাহায্যে বালু সরিয়ে কোনরকম গাড়ীর ট্রাংকের উপরে উঠে দাঁড়ায় মামুন। এবার বালুতে গেড়ে যাবার ভয় নেই। প্রবল শক্তি ব্যয় করে বালুর পাহাড় ভেদ করে মামুন যখন উঠে দাঁড়ায় তখন তার গলা অবধি বালুর উপরে উঠে আসে। পেঁচানো পলিথিন ব্যাগটি মুখ হতে সরিয়ে লম্বা করে মুক্ত নিঃশ্বাস নেয় সে। বালুর উপর একমিটারের মত হাতের কাঠটির উপর ভর করে আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসে মামুন। বাহির হতে কেউ বুঝতেও পারবেনা এ বালুর ডিবির নীচে একটি গাড়ী ও তার ভিতর দু'টো নরনারী মৃত্যুর প্রহর গুণছে
হাতে সময় খুবই অল্প। বাবা মাকে আগে বাঁচাতে হবে। তারপর সবাই মিলে মুন্নীকে খুঁজবে। ফজরের আজান পড়ছে চর্তুদিকে। অন্ধকার তখনো কাটেনি। অজানা এক আশঙ্কায় মনটি তার কেঁপে উঠে। যে বাতাস ছেড়ে দিয়ে এসেছে তাতে হয়তো ঘন্টাদুয়েক অক্সিজেনের কাজ চলবে। কিন্তু তারপর? ভাবতে পারেনা মামুন।
দৌড়ে যায় বড়রাস্তা ধরে। কোথাও কোন লোকজন নেই। আল-নাখল পল্লী এখান হতে সাত-আট কিলোমিটার দুরে। কি করবে সে এখন? আকস্মিক দুরে একটি গাড়ীর হেডলাইট দেখে মনে আশার সঞ্চার হয়। লোকটি গাড়ী হয়তো থামাবে না ইশারা দিলেও। যা করার এখনই করতে হবে। অগত্যা রাস্তার ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ায় মামুন। হেডলাইটের আলোতে তাকে রাস্তার মধ্যখানে দেখে নিশ্চয়ই গাড়ী থামাতে বাধ্য হবে লোকটি।
গাড়ীটি এগিয়ে আসছে দেখতে দেখতে। হেডলাইটের তীব্র আলো মামুনের চোখ ঝলসে দেয়। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে সে নির্ভয়ে। কাছে আসতেই কড়া ব্র্যাক কষে ড্রাইভার। রাস্তার সাথে টায়ারের ঘর্ষণে ধোঁয়ার সাথে পোড়া গন্ধ নির্গত হয়। দরজা খুলে তড়িৎগতিতে নেমে আসে সিকিউরিটি পুলিশ। খামছে ধরে মামুনের সার্টের কলার। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করতে এসেছে ছেলেটি।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা আরবী ও ইংলিশের সংমিশ্রনে মামুন বুঝাতে চেষ্ঠা করে আত্মহত্যা তার উদ্দেশ্য নয়। তাদের বিপদের কথা বুঝিয়ে বলে পুলিশকে।
সিকিউরিটি পুলিশরা ঝড়ের বেগে মামুনকে নিয়ে চলে মরু অভ্যন্তরে। মামুন দেখিয়ে দেয় তাদের চাপা পড়া গাড়ীর সঠিক অবস্থান। মোবাইলে পুলিশ অফিসার কাকে যেন কিছু নির্দেশ দেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ ভ্যানে একটি ক্রেন এসে উপস্থিত হয়। ক্রেইনের হুক দুটো সাথে নিয়ে একজন বালুরাশির ভিতর হাতড়িয়ে কিছুক্ষণ পর উঠে আসে।
এবার ক্রেইনটি পিছনের দিকে সাজোরে টেনে আটকে পড়া গাড়ীটিকে নিয়ে আসে সমতলে। দরজা খুলে দেলোয়ার সাহেব ও তার স্ত্রী রত্নাকে বাইরে বের করে আনা হয় জ্ঞানহীন অবস্থায়।
অক্সিজেনের অভাবে তাহলে কি তার বাবা মা...? ভাবতে পারেনা মামুন। স্কুলে শেখানো পানিতে ডোবা ও আগুনের ধোঁয়ায় জ্ঞানহীন ব্যক্তিকে কিভাবে শ্বাস ফিরিয়ে আনতে হয় সে শিক্ষানুযায়ী নুয়ে পড়ে মায়ের মুখের উপর মুখ লাগিয়ে পাগলের মত ফুঁ দিতে থাকে মামুন। পেটে ও বুকে জোরে জোরে চাপ দিতে থাকে। ফ্লাক্স হতে একটু পানি ঢেলে দেয় মুখে। একটু পরে গভীর একটি নিঃশ্বাস নিয়ে মিসেস রত্না চোখ মেলে তাকান। মামুনের পিতাকে একজন পুলিশ অফিসার মুখে ফু ও বুকে চাপ দিতে থাকলে কিছুক্ষণ পর তিনিও চোখ মেলে তাকান। দু’জনই এবার উঠে বসেন।
দেলোয়ার সাহেবের কাছে সমস্ত ঘটনা জেনে নিয়ে পুলিশের লোকজন সারা মরুভূমি জুড়ে মুন্নীকে চষে বেড়ায় কিন্তু পরপর তিনদিন খোঁজাখুঁজি করেও মুনীর কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
চারবছরের মুন্নীর খোঁজ পরবর্তী দীর্ঘ ন'বছরেও কেউ এনে দিতে পারেনি। দেলোয়ার পরিবারের প্রত্যেকের হৃদয়ে পাথরচাপা একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস স্থায়ী হয়ে রয় পরবর্তী ন’টি বছর।
মামুন কমপিউটার সায়েন্স নিয়ে আমেরিকায় পড়ে। বছরের দু’টো ঈদের দিনগুলোতে ছুটে আসে পিতামাতার কাছে। এখানে বেড়াতে এলেই আল-রাওয়ার বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তরে একবার হলেও আসে। মুন্নীর স্মৃতি ভুলতে পারেনা সে। তাই মরুর তৃষিত বক্ষে প্রতিবারই দু'ফোটা চোখের অশ্রু মুন্নীর জন্য রেখে যায় একান্ত গোপনে। নিশ্চয়ই মুন্নীর অবস্থা সেদিন তাদের গাড়ীর মতই হয়েছিল। জীবন্ত সমাধি ঘটেছিল বালুর কঠিন আবরণে। কোথায় হারিয়ে গেল তার প্রাণপ্রিয় বোনটি?
আল নাখল বেদুঈন পল্লীতে পশু কিনতে এসেছেন দেলোয়ার সাহেব স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে। প্রতি বছর কোরবাণীর পশুর হাট বসে এখানে। অনেক দুরদুরান্ত থেকে বেদুঈনরা গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ও উট নিয়ে আসে পিকআপ ভর্তি করে।
স্ত্রীকে গাড়ীতে রেখে মামুনকে নিয়ে এগিয়ে যান দেলোয়ার সাহেব মামুনের পছন্দ অনুযায়ী পশু কিনতে। শেষ পর্যন্ত একটি সাদা ভেড়া মামুন পছন্দ করে।
টেনে টেনে ভেড়াটিকে নিয়ে আসে গাড়ীর কাছে। মায়ের দিকে চেয়ে বলে - নিশ্চয়ই এতক্ষণ বসে থাকতে খুব কষ্ট হয়েছে, তাইনা মা ? কোরবানীর পশু পছন্দ করা কি চাট্টিখানি কথা ?
- না, না, তেমন কষ্ট হয়নি। আর আমিতো ব্যস্ত ছিলাম মুন্নীর মত একটি মেয়েকে নিয়ে।
- তোমার ভাগ্য ভালই বলতে হবে। যেখানেই যাও সেখানেই মুন্নীর মত একটা মেয়ে পেয়ে যাও। রসিকতা করে বলেন দেলোয়ার সাহেব।
- সবজায়গাতে পেলে কোথায়? তোমরা প্রথম যেখানে পশু দেখতে গিয়েছিলে তার পাশেই একটা ছোট্ট পিকআপ দেখতে পাওনি ?
- কই নাতো - ঠিক লক্ষ্ করিনি। কেন কি হয়েছে? মামুন প্রশ্ন রাখে মায়ের কাছে।
বারো তেরো বছরের বেদুঈন একটি মেয়ে ঐ গাড়ী হতে নেমে আমাদের গাড়ীর পাশে আসে গান শুনার জন্য। আমাকে সালাম দিয়ে গাড়ীতে হেলান দিয়ে গান শুনতে থাকে। তখন ঐ ছড়াগানটি চলছিল - মেরী হ্যাজ এ লিটল ল্যাম্ব....লিটল ল্যাম্ব..। মেয়েটিও সুর মিলাচ্ছিল গানের সাথে সাথে। কি আনমনেই না শুনছিল।
আমিতো খুব ভাল আরবী বলতে পারিনা, শুধু জানতে চেয়েছিলাম এস্ ইছমাক্- তোমার নাম কি ? হেসে উত্তর দিল, মনিরা। ক্যাসেট দেখিয়ে আরবীতে বললাম –উহিব্বু গান্না ? (গান খুব ভালবাস?)
মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে বলল - নায়াম, উহিব্বু কা-তি...র (হ্যাঁ, খুউব ভালবাসি।কাল বোরখাতে আধো ঢাকা ওর মুখ ।
একফাঁকে দেখলাম হাসতে গেলেই ওর গালে টোল পড়ে। মুন্নীর কথা মনে পড়ে গেল। হাসলে ওর গালেও টোল পড়তো। বললাম - ঠিক আছে, ক্যাসেটটি নিয়ে যাও। তোমাদের গাড়ীতে বাজাবে।
কি যে বলব - মেয়েটি কি যে খুশী হল। মনে হল জীবনে এত খুশী সে কখনো হয়নি। হুট করে আমার গলা জড়িয়ে ধরে দু গালে দু’টো চুমু খেল। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। সাথে সাথে আমিও ওকে ধরে দু’টো চুমু খেলাম - মনে হচ্ছিল আমি যেন মুন্নীকে জড়িয়ে ধরে আছি। অনুভব করলাম আমার হৃদয়ের সমগ্র চেতনা যেন ওর শরীরের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ও আমার শরীরের আরও কাছে এসে লেপটে ধরলো আমাকে দু’হাতে। অবাধ্য চোখের অশ্রু টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছিল আমার। মেয়েটি পরম আদরে মুছে দিল তার ওড়না দিয়ে।
কথাগুলো শুনতে শুনতে মামুন একটু অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। মন তার কোথায় যেন শূন্যে ওড়াল মেরেছে। মুন্নীর কথা উঠলেই সে স্থির থাকতে পারেনা। প্রতিবছর মুন্নীর প্রিয় ছড়াগানের ক্যাসেটের এককপি সে কিনতে ভুল করেনা। আজ নুতন কেনা ক্যাসেটটি গাড়ীর অডিও-তে লাগিয়ে রেখেছিল।
- ভেড়াটাকে গাড়ীতে উঠাও – তোমার আবার কি হল মামুন?
পিতার কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় মামুন। বলে-আম্মু, কোথায় সেই মেয়েটি ?
এইতো একটু আগে তোমরা এখানে ফেরার পূর্বেই মেয়েটি তার পিতার সাথে তাদের ভেড়া ছাগল নিয়ে চলে গেল। ভাল বিক্রি হচ্ছেনা দেখে হয়তো অন্য কোন হাটে গেল।
-কোন্ রাস্তা ধরে ওরা গেছে মা ? মামুন উত্তর খুঁজে মায়ের কাছে।
-এইতো ঐ রাস্তা ধরে... ইশারায় দেখান মিসেস রত্না।
তাড়াতাড়ি ভেড়াটিকে গাড়ীতে উঠিয়ে মামুন বলে - বাবা, তাড়াতাড়ি ওদেরকে ফলো কর, প্লিজ বাবা...।
মামুনের খামখেয়ালীর কোন সূত্র খুঁজে পাননা দেলোয়ার সাহেব। একমাত্র ছেলের অনুরোধে অগত্যা উক্ত রাস্তা ধরেই ছুটলেন।
দশপনেরো মিনিটের মাথায় আল-রাওয়া পাহাড়টি ও বিস্তীর্ণ মরুভূমি দৃষ্টিগোচর হল। এ পাহাড় আর মরুপ্রান্তর দেলোয়ার পরিবারের এক দুঃখজনক স্মৃতির অধ্যায়।
মাইল দুয়েক দুরে দেখা গেল একটি পিকআপ ঝড়ের বেগে ধূলো উড়িয়ে আল-রাওয়া পাহাড় ঘেষে ছুটে চলছে এক অজানা গন্থব্যে।
গাড়ী থামিয়ে দেলোয়ার সাহেব ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন - বুঝতে পারলাম না মামুন তোমার কি উদ্দেশ্য? মরুভূমির মধ্য দিয়ে এ ধরণের হাটের খুঁজে গাড়ী চলতে দেখেছ কোনদিন ? তাছাড়া ওদের পিছনে ধাওয়া কেন? বেদুঈনরা এমনিতে খুব সহজ সরল হলেও ওদের এরিয়াতে তাদের সমাজের বাইরের কাউকে দেখলে ওরা হিংস্র হয়ে উঠে। না, না, চলো ফিরে যাই ...।
মায়ের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে মামুন বলে, মা আমি কমপিউটার সায়েন্সের ছাত্র। সবকিছু হিসাব করে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয় আমাদেরকে। যদি আমার হিসাব ভুল না হয় তাহলে বলব - ন'বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মুন্নীকে পুনরায় হারালাম।
তার প্রথম কারণ হল –শিশুমন একবার যা শিখে তা কোনদিনই ভুলে না। মুন্নীর প্রিয় ইংলিশ ছড়াগানটি ছিল ‘ম্যারী হ্যাজ এ লিটল ল্যাম্ব...' এবং আমাদের গাড়ীতে এ ছড়াগানটি বাজতে শুনে তার স্মৃতি কথা বলে উঠেছিল। তাই ক্যাসেটটি পেয়ে সে এমন খুশী হয়েছিল যে ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। নতুবা এক অশিক্ষিত বেদুঈন মেয়ে ইংলিশ ছড়াগানে এত আনন্দিত হওয়ার কথা নয়।
দ্বিতীয়তঃ - তার নাম মুনীরা। মুন্নীর নামের সাথে এর একটি সামঞ্জস্য আছে। হয়ত আমাদের হারিয়ে যাওয়া মুন্নীর মুখে তার নামটি শুনে পালটিয়ে কেউ তার নাম ‘মুনীরা' রেখেছে।
তৃতীয়তঃ - আমাদের মুন্নীর মত হাসতে গেলে ওর গালে টোল পড়ে।
চতুর্থতঃ - মায়ের ভাষ্য মতে মেয়েটির বয়স বার তেরো বছর। আমাদের মুন্নী আমাদের মাঝে থাকলে এ বয়সেরই হতো।
পঞ্চমতঃ - ওদের বসবাস এই আল-রাওয়া পাহাড়ের পাশাপাশি কোন এক মরুপল্লীতে কিংবা এই পাহাড়ের কোন এক গুহায় এবং এই মরুতেই আমাদের মুন্নী নিখোঁজ হয়েছিল।
ষষ্টতঃ - মা যখন ওকে আদর করে চুমু খান তখন উনার দেহমনে এবং রক্তের মধ্যে এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল যা কেবলমাত্র রক্তের বাঁধনেই সম্ভবপর। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে আমি বলতে পারি এ মেয়েটিই ছিল আমাদের হারিয়ে যাওয়া মুন্নী। উকিলের জেরার মতই মামুন জোর দিয়ে বলে কথাটি ।
মামুনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দেলোয়ার সাহেব বলেন - তুমি যে যুক্তি দেখাচ্ছ তা ভুলও হতে পারে মামুন। কারণ হিসাবে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি একে একে।
যে ছড়াগানটি শুনে মেয়েটি ছুটে এসেছিল তোমার মায়ের কাছে, সে গানটি বিশ্বজুড়ে সকল ভাষাভাষী শিশুদের কাছে নন্দিত। এমনও গান আছে যার মর্ম না বুঝলেও আমাদের কাছে ভাল লাগে। এই ছড়াগানটির মধ্যে ভেড়া'-র ডাকের শব্দ আছে তা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ। যেহেতু মেয়েটি বেদুঈন - বকরী, ভেড়া আর উট চড়ানোর মধ্যেই তাদের জীবন। সে কারণে যখনই গানের মধ্যখানে ডেড়ার ডাক শুনতে পেয়েছিল তখনই এ গান তাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে।
মুন্নীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে মুনীরা রাখা হয়েছে - এ ধারণাটাও ভুল। এ দেশের প্রচলিত কয়েকটি নাম হল ফাতেমা, জোহরা, মানাল, আয়েশা, বদরিয়া কিংবা মুনীরা। এ ধরণের নাম রাখার রীতি চলে আসছে তাদের সমাজে হাজার বছর ধরে সুতরাং....।
হাসতে গেলে টোল পড়ে এমন মেয়েদের সংখ্যা অসংখ্য। সুতরাং এটা শুধু মুন্নীরই ছিল এ ধরণের ভাবা ঠিক হবেনা।
মুন্নীর বয়সের মত অন্য কোন মেয়ে এ বাজারে যে ছিলনা এটা ঠিক নয়। তুমি হয়তো লক্ষ করনি শতকরা ত্রিশটি পিকআপ গাড়ীতে বেদুঈনদের ছেলে, মেয়ে অথবা পরিবার ছিল। এটা তাদের সামাজিক রীতি।
এই গরু ছাগলের হাটটি আল-রাওয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলের বেদুঈনদের বেচাকেনার জায়গা। সুতরাং মেয়েটি যদি এ অঞ্চলের হয়ে থাকে তাহলে অবাক হওয়ার কারণ নেই।
মুন্নীকে হারানোর পর মুন্নীর বয়সের সব মেয়েদেরকেই তোমার মা আদর করে আসছেন। মুন্নীর পিতা হিসাবে আমারও তাই করতে ইচ্ছে হয়। মেয়েটি যখন ক্যাসেট পেয়ে খুশী হয়ে তোমার মাকে গলায় জড়িয়ে ধরে আদর করল তখন তোমার মায়ের মত একজনের মাতৃস্নেহ প্রবলভাবে উথলে উঠারই কথা – এটাকে অন্যভাবে নেয়া ঠিক হবেনা।
আশা করি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছ মামুন ...।
বাবা, এমনতো হতে পারে, আমরা যখন বালুচাপা পড়ে গাড়ীর ভিতর বন্দী ছিলাম তখন এ অঞ্চলের কোন বেদুঈন কাফেলা এ পথ ধরে উটের বহর নিয়ে যাচ্ছিল। ঝড়ের শিকার ছোট্ট একটি শিশুকে জ্ঞানহীন অবস্থায় পেয়ে তারা তুলে নেয় এবং সুস্থ করে তুলে। পরে তাদের মধ্যে সন্তানহীন কেউ মুন্নীকে বড় করে তুলে।
মামুন, যখন আমরা গাড়ীর ভিতর বন্দী তখন বাইরে চলছিল ধূলো ঝড়ের তান্ডবলীলা। অন্ধকার ঘিরে রেখেছিল পুরো অঞ্চলকে। আমরা গাড়ীসমেত ঢাকা পড়লাম বালুর কঠিন আস্তরণে। তুমি যখন চেষ্টা করে উপরে উঠে আসতে পারলে তখনও ছিল অন্ধকার। এরূপ প্রচন্ড ঝড়ে কোন বেদুঈন কাফেলা দীর্ঘ মরুপথ অতিক্রম করবে বলে মনে হয়না। তাছাড়া মুন্নী যখন ঝড়ের কবলে পড়ে তখন ছিল অন্ধকার শেষ রাত্রি। তোমাদের ভাইবোনকে ফিরিয়ে আনার শত চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হই। তোমার উপস্থিত বুদ্ধি খরচ না করলে বালুর নিচে ঘটত আমাদের জীবন্ত সমাধি। মুন্নী যখন ঝড়ের কবলে পড়ে তখন অন্ধকারের মধ্যে তুমি তাকে খুঁজে পাওনি। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলে।
মামণি তোমাকে ডেকে ডেকে হয়তো তিনচার মিটার যেতেই দমকা বাতাসে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আমাদের মুন্নি বালুর নীচে চাপা পড়ে অথবা দমকা ঝড়ো বাতাস তাকে কিছুদুর গড়িয়ে নিয়ে যায় এবং পরে বালুর আস্তরণে তার কচি দেহ চাপা পড়ে। আমার মায়ের যে কি কষ্ট হয়েছিল......গলা ধরে যায় দেলোয়ার সাহেবের। অস্পষ্ট শব্দে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠেন।
মিসেস রত্নাও স্বামীর কথা শুনে কাপড়ে মুখ ঢাকেন।
মামুন আর কথা বাড়ায় না। তবে তার মনে হত লাগল এ মেয়েটিই মুন্নী ছিল। মায়ের দিকে চোখ রাখে। মায়ের চাহনিতে একই ভাব ফুটে উঠে। মামুন শুনেছে অন্ধ মা-ও তার সন্তানকে গায়ের গন্ধ শুঁকে নির্দিধায় বলে দিতে পারে এ তার সন্তান কিনা ? নাড়ী ছেঁড়া ধনকে প্রত্যেক মা-ই চিনতে পারে – এটা চিরসত্য।আর সন্তানও মায়ের শরীরের গন্ধ ভালভাবেই টের পায় তাই অন্ধ মেয়েও তার মা-কে চিনে নিতে পারে।
বাবার যুক্তিও অখন্ডনীয় তবে
অনুমাননির্ভর। কথা না বাড়িয়ে মামুন গাড়ীর ভিতরে গিয়ে ড্রয়ার হতে একটি সাদা কাগজ
ও একটি অব্যবহৃত খাম নিয়ে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে কৃষ্ণপক্ষের আঁধারে বাঁকা চাঁদ
পূর্ব-আকাশের কোণে জেগে উঠেছে। মামুন একদৃষ্টে চেয়ে থাকে মলিন মুখে।
এখ বোবা কান্না তার বুকে পাথরের মত চেপে বসে বুকখানাকে যেন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।
শীর্ণ চাঁদ উঠেছে, নীল আকাশ জুড়ে লক্ষ তারার মেলা কিন্তু এত বিবর্ণ কেন? চোখ ভরে তার কান্না উপচে আসে বাঁধভাঙ্গা বন্যার মত। পিতামাতার দিকে চেয়ে বলে - একটা অনুরোধ করবো বাবা, রাখবে ?
কিসের অনুরোধ মামুন ? দেলোয়ার সাহেব ছেলের দিকে এগিয়ে আসেন দু’পা। মামুন এবং তার মায়ের যুক্তিকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেননা তিনি। যেহেতু মামুনের যুক্তিতে ধারালো কিছু বক্তব্য আছে। কিন্তু কোথায় যেন খটকা, বুঝে উঠতে পারছেননা তিনি।
বাবা, বলছিলাম কি - যে ভেড়াটি কোরবাণীর জন্য কিনে এনেছি এটাকে এখানে মুক্ত করে দিতে চাই মুন্নীর জানের সাদাকা হিসাবে, যেখানে মুন্নী খেলছিল ঠিক সেখানে।
খুব ভাল কথা বাবা, হাঁ, তা-ই কর। কাপড়ে অশ্র মুছে বাবা মা দুজনে একসাথে সম্মতি জানান।
মামুন ভেড়াটিকে নামিয়ে আনে গাড়ী হতে। পকেট হতে কাগজটি বের করে ক্ষীণ চাঁদের আলোয় খস খস করে লিখতে থাকে ”মরুঝড়ের তান্ডবে ১৯৮৯ সালে নিখোঁজ হওয়া চারবছরের মুন্নীকে কোন সহৃদয় ব্যক্তি যদি পেয়ে থাকেন তাহলে নিচের ঠিকানায় যোগাযোগ করার অনুরোধ রইল। মুন্নীর প্রিয় গানটি ছিল ”ম্যারী হ্যাজএ লিটল ল্যাম্ব ...লিটল ল্যাম্ব'...... । নিজের পকেট থেকে পরিচয় পত্রের প্লাষ্টিকের কভারটি বের করে গুজে দেয় ছোট্ট চিরকুটটি।
মা বাবার চোখ হতে নির্গত অশ্রু আঙ্গুল
দিয়ে মুছে এনে খামে লাগিয়ে দেয় কোন এক অজানা বিশ্বাসে। ভেড়ার গলে নাইলনের সূঁতো
দিয়ে ভাল করে আটকে দিয়ে বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে বলে -মুন্নীকে খোঁজার জন্য এ
ভেড়াটিও আজীবন মরুতে ফেরারী হয়ে থাক মা....। কোনদিন যদি মুন্নীর আশ্রয়দাতা এ
ভেড়াটি খুঁজে পায় তাহলে আমরা কি আশা করতে পারিনা মুন্নীকে হয়তো আমরা ফিরে পেতে
পারি। তোমাদের কল্যাণময় অশ্রু ভেড়াটিকে এবং মুন্নীকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করবে
বাবা। চলো বাবা, এখানে আর একমূহুর্ত দেরী নয়...।
===================
No comments:
Post a Comment
What do you think?