Monday, April 22, 2019

সহস্রায়ূ (ছোটগল্প) Related to expansion of life which people wants

সহস্রায়ূ

-নাজমুল চৌধুরী


ভার্সিটি জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু আলফ্রেডকে আজও  ভুলতে পারেনি নিকোলাস জীবনের সিঁড়ি বেয়ে কতটি বছর পেরিয়ে গেল এরই মধ্যেগত পঁচিশ বছর ধরে গবেষণাগারে কাটছে তার বেশীরভাগ সময়বিভিন্ন দেশ হতে সংগ্রহ করতে হয়েছে তাকে অজস্র গাছের ফুল আফ্রিকা,এশিয়া আর ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন বনাঞ্চল এবং কতনা বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরেছে সে।  পৃথিবীর আলোবাতাসে ফুটে ওঠা হাজারো ফুলের সাথে পরিচয় তার তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রতিটি ফুলগহ্বরের নির্যাস সেই সাথে আলফ্রেডকেও খুঁজেছে হন্যে হয়ে কিন্তু কোথায় লুকিয়ে গেল আলফ্রেড ?

সন্ধ্যা পিদিম জ্বলে উঠেছে গির্জায় গীর্জায়,ঘন্টাধ্বনিও থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেঅন্ধকারে বসে থাকতে বেশ ভালই লাগছে তারকি হবে আলো জ্বেলে? জীবনের অন্ধকার হয়তো এমন করেই নেমে আসবে নিজের অজান্তে

শীতের কনকনে বাতাস বইছেঅকস্মাৎ ভীষণ শব্দে গবেষণাগারে কাঁচের কোন এক কনিক্যাল ফ্লাক্স বাতাসের ঝাপটা সামলাতে না পেরে মেঝেতে ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল চেয়ার ছেড়ে উঠে দেখার আগ্রহ নেই নিকোলাসের সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে এই ফ্লাক্সগুলোতে ফুলের পাঁপড়ি ঢেলে ম্পিরিট ল্যাম্পের হালকা গরমে ফুলগুলোকে ভিজিয়ে রেখে নির্যাস বের করে নিয়ে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখা তার নিত্যদিনের অভ্যাস ফুলের রং-বেরঙ্গের নির্যাস ঘিরে কতনা রহস্য তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে,কত অজানা রহস্য আবিষ্কার করেছে সে কিন্তু ঈষ্পিত লক্ষ অর্জিত হয়নি আজও তারচেষ্ঠার অতলান্ত গভীরে বার বার হোঁচট খেয়েও দমে যায়নি সে তাকে পারতেই হবে, ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে পরাজয় মেনে নিতে পারবেনা সে পিতা সিনারাকে কথা দিয়েছে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে আজীবন চেষ্ঠা চালিয়ে যাবে সে

স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ছাত্রজীবনের কত কথাই মনে হয় একে একে বোটানীর একই ক্লাসের সহপাঠি আলফ্রেডের সাথে ভাব জমে উঠেছিল তার কোন এক অন্তরঙ্গ মূহুর্তে হ্যান্ডসাম আলফ্রেড আর তার ব্যক্তিত্ব প্রফেসর এবং সহপাঠিদেরকে আকৃষ্ট করতো এক মোহনীয় যাদুর মত সামান্য অজুহাতে সহপাঠি সুন্দরীদের কাছে ঘেষার প্রবণতা আলফ্রেডের কাছে জলবৎ তরলং এড়িয়ে চলতো সহপাঠিনীদেরকে মেপে মেপে কথা বলার এক অদ্ভুত মোহনীয় শক্তি কেমন করে অর্জন করেছিল আলফ্রেড তা একমাত্র সেই জানে বৈজ্ঞানিক গরীক্ষাগারে একদিন আচমকা এক খবর পরিবেশন করে চমকে দিয়েছিল সে সবাইকে গাছের লতাপাতা আর ফুলের মধ্যেই নাকি লুকিয়ে আছে অমরত্মের মহাষৌধ পৃথিবীতে জন্ম নেয়া লক্ষ-কোটি প্রজাতি গাছপালার মধ্যে মাত্র একটি গাছের কচি পাতা ফুলের নির্যাসের সংমিশ্রনে প্রস্তুতকৃত এই ঔষধ পরপর তিনদিন খেলেই একজন মানুষ শত শত বছর বেঁচে থাকতে পারে দেহের রক্তকণিকায় কোন ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করলেও ঔষধের গুণে তা অকেজো হয়ে পড়ে যে কারণে আয়ূ বৃদ্ধি পায় ছাত্র-শিক্ষকের প্রবল চাপের মুখে সে বলতে বাধ্য হয়েছিল গাছটি পৃথিবীর বহু দেশে জন্মালেও মাত্র তিনটি দেশের মাটি গাছটিকে পল্লবিত পুষ্পিত করার শক্তি রাখে প্রজাতির গাছ হাজার বছর বেঁচে থাকে বিশবছর পরপর গাছটিতে তিনচারটি ফুল ফুটে, আয়ূষ্কাল হয় মাত্র একসপ্তাহ ফুল ফোঁটার ষোল ঘন্টার মধ্যেই ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে থাকে নির্যাস নির্যাস জমিয়ে উক্ত গাছটির কচি পল্লবের নির্যাসের সাথে মিশিয়ে পরপর তিনদিন পান করলেই একজন বেঁচে থাকতে পারে শত শত বছর

রহস্যের কথা আলফ্রেড জানতে পেরেছিল তার পিতামহ প্রকৃতি বিজ্ঞানী মাইকেল গারিয়ার কাছে যিনি পৃথিবীতে বেঁচেছিলেন পুরো দেড়শো বছর বজ্রপাতে যদি তার অকালমৃত্যু না হত তাহলে তিনি সহস্র বছর বা তার অধিক বেঁচে থাকতে পারতেন আলফ্রেড আরও জানতে পেরেছিল গাছটি ব্রাজিলের আমাজান অববাহিকায়, আফ্রিকার মাদাগাষ্কার দ্বীপ দক্ষিণ-এশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের গহীন জঙ্গলে বিশ বছরে একবার ফুলে ফলে বিকশিত হয় অদ্ভূত গাছটি বিজ্ঞানীদেরকে আকৃষ্ট করলেও তার সন্ধানে জঙ্গলে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন কিংবা ব্যর্থ হয়েছেন খুঁজে পেতে মাইকেল গারিয়া কিভাবে এর সন্ধান পেয়েছিলেন এর প্রকৃত রহস্য আজও  অজানা রয়ে গেছে আলফ্রেডের

পৃথিবীতে অদ্যাবধি তিনলক্ষ ষাট হাজার প্রজাতির বৃক্ষকূলের সন্ধান পাওয়া যায় তন্মধ্যে দুলক্ষ বিশহাজার গাছে ফুল ধরে

সূত্র ধরে নিকোলাস যাবত হাজার হাজার গাছের পাতার রস ফুলের নির্যাস গবেষণাগারে পরীক্ষা করেছে রাইগ্রাস, হ্যাজেল, রেড মালভেরী, ক্যারো লিলিয়ানা, সলানাম নিগ্রাম, প্রসোপিস গ্লানডোলসা, ক্লাসপিং মিল্কওয়েড, আকিলিয়া মিলিফলিয়াম, উইলো, অর্চিড, ড্যানডিলিয়ন, সাইকামোর, বারডক, হেথ্রন, ড্যাফডিল, ডালিয়া, লোটাস, ওয়াটারলিলিসহ হাজার হাজার গাছের পাতা ফুল

আলফ্রেডের রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে রহস্য উদঘাটনের জন্য নিকোলাস ব্রাজিলের রেইন ফরেষ্ট, মাদাগাষ্কার সুমাত্রা দ্বীপের গহীন অরণ্যে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কষ্টের মহাসাগর অতিক্রম করে সংগ্রহ করেছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল পাতা প্রায় একলক্ষ প্রজাতির ফুলের ন্যাকটার গাছের কচি পল্লব গরীক্ষাগারে পরীক্ষা করেছে সে গড়ে তুলেছে গবেষণাগারে পাতা ফুলসমূহের এক জীবন্ত এলবাম যা ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীদেরকে দেবে এক নূতন জগতের সন্ধান অমরত্মের সন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য রোগের পথ্য কিন্তু নিকোলাসের চাই অমরত্মের গোপন মহাষৌধ

কেমন করে যৌবনের উষ্ণ দিনগুলো কেটে গেল নিকোলাসের পিতা মাইকেল সিনারা তার লেদার ফ্যাক্টরীতে শত অনুরোধ করে বসাতে পারেননি তাকে এমনকি বিয়ের পিড়িঁতে বসতে চায়নি সে সেই একই কথা আমার গবেষণা তোমাকে সত্যি সত্যিই একদিন অমরত্ম দান করবে ড্যাড, সময় হলে প্রমাণ পাবে বরং তুমি আমাকে সাহা্য্য করতে পার তোমার বিশাল সম্পত্তির ক্ষুদ্রতম এক অংশ খরচ করে তোমাকে আমি হাজার বছর বেঁচে থাকার সব ব্যবস্থা করে দেব দ্যাখো আমাকে ঘন ঘন ব্রাজিল, মাদাগাষ্কার আর সুমাত্রায় যাওয়ার খরচ আর একটি বিশাল গবেষণাগার তোমার কাছে এইটুকুই চাই,ব্যাস 

পাগল ছেলে কি বলে! ছেলে একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী বিজ্ঞানীরা এক সূত্র ধরে এগোয় কিন্তু গবেষণার মধ্যপ্রান্তে এসে অন্য একটি ফরমূলা আবিষ্কার করে বসে যা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেয় তাই নিকোলাসের প্রবল ইচ্ছার কাছে হার মেনে সম্পদের কিছু অংশ খরচ করে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর বিশাল পরীক্ষাগারের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেন সিনারা

ল্যাবরেটরীর চেয়ারে হেলান দিয়ে ড্যানডিলিয়ন এবং অর্চিড ফুলের ন্যাকটারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে নিকোলাস অদ্ভূত মিষ্টি এক সুগন্ধ বাতাসে আমেজ ছড়ায় রাত পেরিয়ে সবেমাত্র ভোরের আকাশে রক্তিম সূর্যে্র উঁকিঝুঁকি তারই সোনালী কিরণ গবেষণাগারের কাঁচের জানালা ভেদ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছে কত বিনিদ্র রজনীকে ক্ষুদ্র জীবনে অভিশাপের মত মনে হয়েছে, আবার কত কর্মমুখর দিনের আলো প্রেরণা যুগিয়েছে নিকোলাসকে ব্যর্থতার গ্লানি আজকাল জিদে পরিণত হয়েছে তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত খুঁজবে সে অমরত্মের মহাষৌধ

মনে পড়ে আলফ্রেডের সাথে তার শেষ দিনটির কথা আলফ্রেড ছিল এক রহস্যময় পুরুষ যার কামনা ছিল বাসনা ছিলনা, ব্যক্তিত্ব ছিল অহংকার ছিলনা, সৌন্দর্য ছিল প্রকাশ ছিলনা, শক্তি ছিল প্রয়োগ ছিলনা সেই আলফ্রেড এক দূর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছিল তার এবং ভার্সিটির শিক্ষক সহপাঠিদের মধ্যে প্রকাশ্যে ক্যান্টিনে তাকে খাবার খেতে কিংবা ক্লাবে আড্ডার আসরে তাকে কেউ কখনো দেখেনি সুঠাম স্বাস্থ্য, রমনীয় কোমলতা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারণে তার চারপাশে খাতির জমাতে চেষ্ঠা করতো সহপাঠিনীদের অনেকেই কিন্তু যৎকিঞ্চিৎ হাসি ছড়িয়ে পাত্তা না দিয়ে সে সিটকে পড়তো

নিকোলাস জানতে চেয়েছিল সহপাঠিনী সুন্দরী রিটার নিখাদ ভালবাসাকে প্রত্যাখ্যান করতে আলফ্রেডের কেন এত অহংকার? যার সান্যিধ্য পাওয়ার জন্য কত ছেলে মরিয়া সেখানে সে কিনা অবহেলাচ্ছলে তাকে এড়িয়ে যায় নিয়ে নিকোলাসকে কেঁদে প্রশ্ন করেছিল রিটা,তোমার বন্ধুটি এমন কেন? অথচ আমি আলফ্রেডকে ছাড়া অন্য কাউকে জীবনে ভাবতে পারিনা ওকে বল রিটা তার জন্য আজীবন প্রতীক্ষায় থাকবে, নিজের অজান্তে ওকে আমি গভীর ভালবেসে ফেলেছি

রিটার হয়ে আলফ্রেডকে বুঝিয়ে বললেও উত্তর এসেছিল,দ্যাখ্ নিকোলাস, রিটা এবং আমার মধ্যে বিস্তর ফারাক, আকাশ পাতাল ব্যবধান এটা জানার পরও কি আমি তার মত করে ভাববো? ঈশ্বর গোটা পৃথিবীকে মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযোগী করেছেন, কিছু মানুষ তাঁর মহান সৃষ্টিকে নিয়ে গবেষণা করে এমন কিছু আবিষ্কার করেছে যা অকল্পনীয়,অবিশ্বাস্য আর আমার বিজ্ঞানী দাদু মাইকেল গারিয়া ইচ্ছা করে আমার উপর পরীক্ষা চালাতে গিয়ে এমন কান্ড ঘটিয়েছেন যা মানুষ শুধু কল্পনা করে তাই আমি কাউকে আমার জীবনে জড়াতে চাইনা, রিটাকে বলিস ক্ষমা করতে

কি সব হেঁয়ালী বলে যাচ্ছিস এতক্ষণ ধরে। তোর কোন কথাই আমার বোধগম্য হচ্ছেনা, প্রত্যেত্তরে বলে নিকোলাস

একদিন সব ফাঁস হয়ে গেলআলফ্রেড হয়তো ভাবতে পারেনি এভাবে সে ধরা পড়ে যাবে !

নিকোলাসের পিতামহ লুইস গিনেস বুকে স্থান করে নিয়েছিলেন স্মরণকালের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বয়োজৈষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে বয়স তার একশত ত্রিশ অতিক্রম করেছে খবরটি কথাচ্ছলে নিকোলাস গর্ব করে বলেছিল আলফ্রেডকে গভীর উপলব্ধি নিয়ে খবরটি শুনে আলফ্রেড নিকোলাসের পিতামহ লুইসের কথা ভাবনার অতলান্ত গভীরে হারিয়ে যায় তার অধরা মন

এমন বয়োজৈষ্ঠ ব্যক্তিকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করাতে ভার্সিটির ছুটিতে নিকোলাস তাকে নিয়ে ওরিন্টায় পিতামহ লুইসের সাথে দেখা করতে যায় পথে লুইসের সাথে নিকোলাসের অনেক মধুময় স্মৃতি শেয়ার করে আলফ্রেড ওর কথা শুনে লুইসের মুখচ্ছবি কেমন হবে ভাবতে থাকে আলফ্রেড,তাহলে কি সেই লুইস যে একদিন তার সহপাঠি ছিল ?

বিকেলের সূর্য্য তখনো অস্ত যায়নি লুইস লাটিতে ভর করে অভ্যাসানুযায়ী ফুল বাগানে পায়চারী করছিলেন পিতামহকে বাগানে পায়চারী করতে দেখে নিকোলাস আলফ্রেডকে নিয়ে সরাসরি ওখানে যায় নিকোলাসের সাথে করমর্দন করে আলফ্রেডের দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে ওঠেন লুইস নিজের অলক্ষে, আলফ্রেডের প্রতিক্রিয়াও তদ্রুপ

হাতের লাঠিতে ভর করে বিস্ময়ের সুরে বলে ওঠেন,আলফ্রেড না? তুইতো দেখি এখনো টাটকা জোয়ান ত্রিশ বছরের যুবকের মতই বলিষ্টতা কতকাল পর দেখা হল বল্তো? একশতের উপরেতো হবেই,ঠিক বলিনি? তোর পিতামহ মাইকেল গারিয়া তো একশত পঞ্চাশ বছর বেঁচেছিলেন! মনে হয় তুই তাকেও ডিঙ্গিয়ে যাবি এবার নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে বলেন, ওকে তুই কোত্থেকে ধরে আনলি,জানিস ছাত্রজীবনে আমরা ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলাম,কি আশ্চর্য্, ওর সাথে যে আবার দেখা হবে ভাবতেই পারিনি

দাদু,তুমিতো বেশ ঠাট্টা করতে জানো!আমার বন্ধু হয়ে গেল কিনা তোমার বন্ধু বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে নাকি তোমার? যাক্গে, তোমার নাম গিনেস বুকে যুক্ত হয়েছে জেনে তোমাকে দেখতে এসেছে আলফ্রেড ওর সাথে না হয় কিছু সময় রসিকতা করো, সময় কাটবে ভাল এর মধ্যে আমি তোমার সুইমিং পুলে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসি এখানে এলে এত সুন্দর সুইমিং পুলে সাঁতার কাটার লোভ সংবরণ করতে পারিনা তাছাড়া এটা এভাবে অব্যবহৃত থাকলে ঈশ্বরের কাছে ফরিয়াদ করবে যে? হাসতে হাসতে নিকোলাস এগিযে যায় বাগানের ওধারে সুইমিংপুল লক্ষ করে

ঘন্টাখানেক সুইমিং শেষে নিকোলাস ফিরে এল ভেজা কাপড়েআনন্দমাখানো চড়া গলায় বলে,এই আলফ্রেড একবার সুইমিং করে আয়না দোস্ত দেখবি মন জুড়িয়ে যাবে

আলফ্রেডকে খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খায় নিকোলাস দাদুর কাছে জানতে চায় আলফ্রেডের উপস্থিতি একটি খাম বাড়িয়ে দেন লুইস নিকোলাসের দিকে বলেন, তোর খুঁজেইতো আলফ্রেড ওদিকটায় গেল আর চিঠিটা তোকে দিতে বলল একা এলি যে, কোথায়?

চিন্তাক্লিষ্ট নিকোলাস মেলে ধরে চিঠিখানা চোখের সামনেঃ

বন্ধু নিকোলাস, বিশ্বাস কর্ আর নাই কর্ একথা সত্য যে লুইস আমার সহপাঠি এককালের নিকটতম বন্ধু তোর দাদুর পরিচয় তোর কাছে সেদিন জানামাত্রই আমার সন্দেহ হয়েছিল লুইসের ব্যাপারে আমার সন্দেহ যদি সত্যি হয় তাহলে নির্ঘাৎ আমি ধরা পড়ব এবং আমাকে নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যাবে ভার্সিটিতে এবং বন্ধুমহলে, এই ভয়ে পত্রটি লিখে এনেছি

শুধু লুইস কেন,ওর আগে কতশত লোক গত হয়েছে এমন অনেকেই আমার বন্ধু সহপাঠি ছিল আমার জীবনের পরিধি অনেক তাই বিশ্বের বিভিন্ন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে জ্ঞানান্বেষনে ব্যস্ত থাকতে ভালবাসি পিতামহ গারিয়া যখন বজ্রপাতে একশো পঞ্চাশ বছর বয়সে মারা গেলেন,সেমিটারীতে কবর দেয়া হল শোকাহত আমি সেমিটারীতে অনেকক্ষণ বসেছিলাম চন্দ্রালোকিত রাতে

আকস্মিক এক সেইন্ট কাছে এসে বললো,গারিয়া তোকে অমর রাখতে চেয়েছিল হাজার বছরের জন্য সে নিজের জন্যও তাই চেয়েছিলঅমরত্মের গোপন তথ্য সে খুঁজে পেয়েছিল তার গবেষণায় তোর উপর এর প্রভাব দেখতে চেয়ে তোর রক্তেও মিশিয়েছিল অতি প্রাকৃতিক এক ধরণের ঔষধ ঈশ্বরের নিয়ম সে ভঙ্গ করেছিল, পাপে দেড়শো বছর পর বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়েছে তবে তুই বাঁচবি তার চেয়ে অনেক বেশী কারণ তোকে তো তার পাপের জন্য দায়ী করা যায়না,তবে তোর মৃত্যু হবে কোন এক যুদ্ধে তোকে যেতেই হবে ঈশ্বরের কাছে কারণ এটাই তার বিধান

একথা বলে সেইন্ট হঠাৎ করেই নিষ্ক্রান্ত হল আমি ভয় পেলাম বিস্তৃত জীবন পেয়েছি বটে কিন্তু মনের শান্তি বিদুরিত হয়েছে অনেক আগেই কারণ বয়োজৈষ্ষ্ঠদের কাছে ধরা পড়ার আগেই আমি সটকে পড়ি অন্য কোন দেশে,অন্য কোন প্রান্তে যেখানে আমাকে কেউ চিনেনা যুদ্ধে মারা যাব এই আশায় আমি নিষ্ঠুরতার চরম মন্ত্রে নিজেকে প্রস্তুত করেছি যেখানে যুদ্ধ সেখানেই আমি স্থান করে নিই মারতে গেলে অনেকসময় মরতে হয় সে কারণে আমি নিষ্ঠুরতাকে বেছে নিয়েছি আশা করছি যুদ্ধে কোন একদিন হয়তো মরব

১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনের রাজা জেমস্-এর একজন সেনাপতি হিসাবে রাজকীয় বাহিনীর জেনারেল স্যার ওয়াল্টার ্যালের মস্তক রাজার নির্দেশে আমিই গিলেটিনে মাথা ঠেকিয়ে দ্বি-খন্ডিত করেছিলাম তবে দুঃখ হয়েছিল তার বিরহী পত্নী এলিজাবেথের জন্য মহিলা আমৃত্যু একটি সোনার থালায় বরফ মাখিয়ে তার স্বামীর খন্ডিত মস্তক ফ্রিজে রেখেছিল আর সময়ে অসময়ে সামনে রেখে অপলক নয়নে চেয়ে থাকতো চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়তো অঝর ধারায় একটানা ঊনত্রিশ বছর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এভাবেই সে তার স্বামীকে স্মরণ করেছিল

তোর হয়তো জানা নেই স্যার ওয়াল্টার ্যালেই জীবদ্দশায় রচনা করেছিল দি হিষ্ট্রি অব ওয়ার্ল্ড তোদের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার Hugh Beaver এর চেয়ে অনেক বেশী নামডাক ছিল স্যার ওয়াল্টার ্যালের সে ছিল একজন দক্ষ সেনাপতি সু-লেখক

১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে লর্ড ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে নবাবকে পরাজিত করে নবাবের অনেক সৈন্যকে বন্দীকক্ষে ক্লাইভের নির্দেশে আমিই হত্যা করেছিলাম

লোকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে মীরজাফরকে জানে কিন্তু লোকটি যতটা আমাদেরকে সাহায্য করেছিল তারচেয়ে শতগুণ বেশী চক্রান্ত করেছিল ওখানকার ব্যবসায়ী মহলের রায়বল্লভ, জগৎশেঠ ঊর্মিচাদের মত লোকেরা ধনদৌলত রাজত্বের লোভ দেখিয়ে ওরা মীরজাফরসহ নবাবের সৈন্যদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল

প্রমাণ হিসাবে লন্ডন এবং কলকাতা মিউজিয়ামে ক্লাইভ এবং ব্যবসায়ীদের সাথে চক্রান্তের চিঠিপত্র সংরক্ষিত আছে মীরজাফর প্রথমে আমাদের সাথে হাত মিলায়নি কিন্তু জগৎশেঠ রায়বল্লভের প্ররোচনায় অবশেষে আমাদের সাথে হাত মিলাতে বাধ্য হয়েছিল অথচ প্রধান সেনাপতি হিসাবে মীরজাফরের ললাটেই লিখা হয় বিশ্বাসভঙ্গের রাজটিকা

আরো শুনবি...?

১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জার্মান সম্রাট ফ্রান্সিসকে গদিচ্যুত করতে সম্রাট নেপোলিয়নের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম এবং ফ্রান্সিসের বিপুল যুদ্ধবন্দীকে আমিই হত্যা করেছিলাম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে আমি হিটলারের পক্ষ নিয়ে অসংখ্য ইহুদিকে গ্যাসচেম্বারে হত্যা করেছিলাম তোরা হলি বিংশ শতাব্দীর মানুষ আর আমি মধ্যযুগে জন্ম নেয়া ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী আমি যুগে যুগে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার দেখেছি নিউটন, রাইট ব্রাদার্স, ওপেনহোমার, আর্কিমিডিস, গ্যালিলিও কিংবা আইনষ্টাইনের মত বিজ্ঞানীদের বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলাম

চীনের প্রাচীর, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, আগ্রার তাজমহল নির্মাণের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি আমার শত শত বছরের জীবনে এসেছিল অসংখ্য নারী ওদেরকে শরীরের উত্তাপ দিয়ে আনন্দ দিয়েছি, হয়তো অনেকের গর্ভে আমার সন্তান জন্ম নিয়েছে আবার মরেও গিয়েছে এখনো হয়তো নিচ্ছে কিন্তু তুই বল আমি ঘর বাঁধি কি করে? আমার জীবনের পরিধির বিপরীতে একজন নারীর জীবনের পরিধি কি সমান হবে? মিথ্যে ভালবাসা বিনিময় করে আমি কাউকে জীবনের সাথে জড়াতে চাইনা

সহপাঠি রিটাকে বলিস আমাকে ক্ষমা করতে তার চোখেমুখে নিখাদ ভালবাসার চিহ্ন দেখেছি কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছিআমার কোন দেশ নেই,নেই জীবিত কোন আত্মীয়স্বজন যখনই ধরা পড়ার ভয় থাকে তখনই পালিয়ে যাই অন্যদেশে, ভিন্ন সমাজে

বন্ধু হিসাবে তোকে কেন যেন ভালবেসে ফেলেছিলাম বেশ কয়েকটি বছর তোদের সাথে কাটালাম আমাকে তোর জীবদ্দশায় আর কোনদিন খুঁজে পাবিনা তোর মত অসংখ্য বন্ধু আমাকে খুঁজে খুঁজে হতাশ হয়ে পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছে

পিতামহ গারিয়া জীবিত থাকলে হয়তো আমাকে শিখিয়ে দিতেন অমরত্মের মহাষৌধ কোথায় পাওয়া যায় ব্রাজিলে, মাদাগাষ্কারে না সুমাত্রায় আমাকে তিনি ভালবাসতেন তাই চেয়েছিলেন আমি সহস্র বছর বেঁচে থাকি আর তাইতো আমার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন সেই মহাশক্তিধর ঔষধ জানিনা পিতামহ গারিয়ার মাথায় আমাকে নিয়ে অদ্ভূত খেয়াল চেপেছিল কেন?

সময় কাটেনা বন্ধু, কবরস্থানে সেই সেইন্টের ভবিষ্যৎবাণী আমার জীবনে কখন প্রতিফলিত হবে সেই অপেক্ষায় আছি যেকোন যুদ্ধে মারা যাব তাই যুদ্ধের কথা শুনলেই আমি সেখানে হাজির হই আত্মহত্যা করে মরতে পারতাম কিন্তু আত্মহত্যা কাপুরুষতা তাই এ পথে মরার কথা ভাবতে পারিনা

তোর পিতামহ লুইস আমার এককালের সহপাঠি বন্ধু ছিল ওকে দেখে বড় ভাল লেগেছিল সে এখন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বয়োজৈষ্ঠ একজন মানব সে অশীতিপর বৃদ্ধ অথচ আমার অঙ্গ জুড়ে যৌবনের সুষমা

কে বিশ্বাস করবে মধ্যযুগে জন্ম নেয়া আমার বয়স বর্তমানে চারশো অতিক্রম করছেতোর বিশ্বাস হয়? এখন হয়তো হবে কারণ তোর দাদু আমার পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছেন তোর গবেষণা চালিয়ে যা বন্ধু, হয়তো একদিন খুঁজে পাবি অমরত্মের সেই গোপন রহস্য

সষ্ট্রার বিধানে মানুষকে পৃথিবীতে গড়ে ৮৫ বছর বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে এটাই মানুষের জন্য মঙ্গল তরুপল্লবে নূতনের জন্ম হবে পুরানো পাতা ঝরে পড়বে এটাইতো স্বাভাবিক প্রার্থনা করিস আমি যেন নিঃশেষ হয়ে যাই কোন এক যুদ্ধে

ঢুলু ঢুলু ঘুম নামে নিকোলাসের চোখের পাতায় আলফ্রেডের চিঠির পরবর্তী অংশ মিলিয়ে যায় চোখের গভীরে অবশ চোখে তাকায় গবেষণাগারের অসংখ্য কনিক্যাল ফ্লাক্সের দিকে যেগুলোতে শোভা পাচ্ছে হাজারো ফুলের ন্যাকটার পাশের দেয়ালের বিশাল আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠে কুঁচকে গেছে মুখের অবয়ব, মাথাভর্তি পাকা চুল সহস্রায়ূর গোপন রহস্য জীবনে খুঁজে পাবেতো?

 

                       ===========================