Wednesday, March 13, 2019

লেখক রচিত ইউরোপে ১৭ দিন বই হতে নেয়া একটি খন্ডিত অংশ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

 

লেখক রচিত ইউরোপে ১৭ দিন বই হতে নেয়া একটি খন্ডিত অংশ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
 নাজমুল চৌধুরী
 


ইংরেজী ২০০০ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর।
 
বেলজিয়ামের ব্রাসেলস্-এ মাহবুবভাইয়ের বাসায় ডলি ভাবীর পরিবেশিত সকালের হেভী চা-নাস্তা পর্ব সেরে পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী নেদারল্যান্ড ও জার্মানী ভ্রমণের নিমিত্তে মাহবুব ভাইয়ের বন্ধু সিলেটের আতিকভাই আমার সঙ্গী হলেন, সাথে আমার ছেলে সাকিব। ব্যক্ত থাকে যে, ইতিপূর্বে লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স, গ্রীস এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্যান্য দেশসমূহে মাহবুবভাই আমার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। 

ব্রাসেলস্ রেলষ্টেশনে যাত্রীদের তেমন ভীড় নেই। পশ্চিম ইউরোপের ইলেকট্রিক ট্রেনগুলোর একই বৈশিষ্ট। সিট সংখ্যানুযায়ী টিকেট ইস্যু, টিকেটের হার এক, নেই কোন শ্রেণীভেদ।সরকারী সম্পত্তির হেফাজত ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় সকল যাত্রীরাই সচেতন। কম্পার্টমেন্ট ফ্লোরে বাদামের খোসা, উচ্ছিষ্ট খাদ্যাংশ কিংবা কাগজের টুকরো নজরে পড়েনি। নির্ধারিত গার্বেজ বিন ব্যবহার করতে কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারী অধিকন্তু যাত্রীরা এ ব্যাপারে ততোধিক সচেতন। ট্রেনের জানালাপথে কাগজ বা পলিথিনের খালি প্যাকেট কেউ ছুঁড়ে ফেলেনা।ধূমপায়ীদের  জন্য ট্রেনে আলাদা কম্পার্টমেন্টের ব্যবস্থা। টয়লেটগুলোও পরিচ্ছন্ন। আমাদের ট্রেনগুলোর টয়লেটে নিচের দিকে ছিদ্র থাকে যাতে মলমূত্র ছিদ্রপথে নিক্ষিপ্ত হয়ে লাইনে পড়ে কিন্তু ইউরোপের ট্রেনগুলোতে প্লেনের মত টয়লেটে কেমিক্যাল ফ্লাশের ব্যবস্থা থাকায় ট্রেন লাইনে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় থাকে।অন্যদিকে ইউরোপের প্রতিটি নাগরিক কুকুর প্রিয়। কুকুর নিয়ে মালিকরা সকাল-বিকেল বেরিয়ে পড়ে পার্কে, রাস্তায়। উদ্দেশ্য কুকুরের মলমূত্র হতে রক্ষা পাওয়া। পার্কে কিংবা রাস্তায় একটু অসাবধান হলে অপবিত্রতা এড়ানো যাবেনা। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সকাল-বিকেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মলমূত্র পরিষ্কার করে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের ন্যাড়া কুকুরছানাও অনেক ভদ্র, মার্জিত সুযোগ বুঝে পাশের  ঝোপে  কিংবা  লাইটপোষ্টের  খুঁটি  ঘেষে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয় এবং দু’পা দিয়ে আঁচড়ে মলমূত্র ঢেকে আসতে ভুল করেনা।

পাক-ভারত উপমহাদেশের সকল স্থানে পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সরকার এবং জনগণ সমভাবে উদাসীন। যেখানে সেখানে স্তূপীকৃত  আবর্জনার  ভাগাড়,  মনে  হয় পরিবেশ দূষণে আমরা অভ্যস্থ এক জাতিসত্ত্বা। আমাদের সরকার এজন্য জনগণ অপেক্ষা অধিক দায়ী। পরিচ্ছন্নতায় জনগণকে সচেতন করতে কিংবা সরকারী ব্যবস্থাপনার পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ব্যাপারে তেমন কোন কড়াকড়ি  নেই,  দূর্বল  আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই।এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, ইত্যাদি দেশে সরকারী নজরদারী ও কঠিন আইনপ্রয়োগের মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় যথেষ্ট সফলতা অর্জিত হয়েছে। পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠিকে সভ্যতা বিকাশের চরম এ সন্ধিক্ষণেও যতটা দায়িত্বশীল করার কথা ছিল ঠিক ততটা করতে পারেনি। ট্রেন কম্পার্টমেন্টে কলার খোসা, কাগজ কিংবা খাবারের মোড়ক ফেলার জন্য ট্রেনের কামড়ায় গার্বেজ বিন থাকেনা। পার্কে, রাস্তায় একই দুরাবস্থা। তাই সাধারণ মানুষের অভ্যাস এবং সরকারের পরিবেশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদাসীনতা সমভাবে এগিয়ে চলছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষতিকারক দিকটা উপলব্ধি করার মত সচেতনতা কয়জনেরই বা আছে।
 
নেদারল্যান্ডের পথে একটি ট্রেন বদল করতে হল। কয়েকঘন্টা অতিক্রম করার পর আতিকভাই জানালেন এইমাত্র আমরা বেলজিয়াম ছেড়ে নেদারল্যান্ডে প্রবেশ করেছি। ডানে বামে যে বাড়িগুলো দেখছেন তার সবক’টিই এদেশের অন্তর্ভূক্ত।
 
দিগন্তবিস্তৃত বরফাচ্ছাদিত মাঠ, ঘরবাড়ি, পাতাঝরা বৃক্ষলতাদির সমাহার। হাতেগুণা কয়েকটি মাস এখানে প্রকৃতি তার স্বরূপ ফিরে পায়। তাই সমগ্র ইউরোপ কৃষিক্ষেত্রে অনগ্রসর। খাদ্যসম্ভারের বেশীরভাগই আমদানীনির্ভর। বাধ্য হয়েই ইউরোপে ভারী শিল্প- কারখানা গড়ে উঠেছে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রকৃতিই তাদেরকে নিত্যনূতন আবিষ্কারে মনোযোগী করেছে। বছরের বেশীর ভাগ সময় প্রচন্ড ঠান্ডা এবং  বরফের মাঝে খালি হাতে কাজ করা দুরূহ ব্যাপার। এহেন পরিস্থিতিতে মেশিনের সাহায্য নেয়া ছাড়া তাদের বিকল্প নেই। তাই তারা যন্ত্রদানবের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। ঘন্টাদু’য়েকের মধ্যে অমরা রোটারডাম শিল্পনগরীতে পৌঁছলাম। এটাই নেদারল্যান্ডের অন্যতম প্রধান নৌ- বন্দর। এ বন্দর দিয়ে   ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের আমদানী-রপ্তানী সচল রাখা হয়েছে। রাইন নদীর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বন্দরের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। রাজধানী আমষ্টারডাম ঘন্টা-দু’য়েকের পথ।
 
রোটারডামে পৌঁছতেই আকাশভরা মেঘের ফাঁকে সূর্যরশ্মি  ছড়িয়ে  পড়লো।  খুশীর আমেজ ট্রেনের  যাত্রী এবং স্থানীয় অধিবাসীদের চোখেমুখে। যেখানে নিত্য মেঘের খেলা, বরফবৃষ্টির অবিরাম অত্যাচার সেখানে একটি রৌদ্রজ্জ্বল দিন তাদের কাছে নিঃসন্দেহে আনন্দের বার্তাবাহক। মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীরা যেমন করে আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখলে আনন্দে আপ্লুত হয় তেমনি ইউরোপের অধিবাসীরা সূর্যরশ্মিকে মনেপ্রাণে আমন্ত্রন জানায়।
 
একটানা যাত্রায় বেশ ক্লান্তিবোধ করছিলাম। আতিকভাইকে বললাম, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু বেদনাময় অধ্যায় বলতে গিয়েও গতরাত যা বলতে পারেননি, অসুবিধা না থাকলে সময় কাটানোর জন্য এখন বলতে পারেন। ব্রাসেলস্ নগরীকে কেন এত ভালবাসেন তার উত্তর দিতে গিয়ে আতিকভাই গতরাতে বলতে শুরু করেছিলেন তার জীবনের এক অলিখিত ইতিহাস কিন্তু শুরু করার পরপরই দু’জনের চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। শুনা হয়নি এবং বলাও থেমে যায় নিদ্রাদেবীর আলতো পরশে।
 
কি আর বলব ? মানুষের জীবনে এমন অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যায় যা ঘটবে বলেই ঘটে। এমন একটি স্পর্শকাতর ঘটনা কেন যে আমার জীবনে ঘটে গেল যা আজও আমাকে কাঁদায়। আতিকভাই একটু নড়েচড়ে বসে বলতে শুরু করলেন। ওই যে বলছিলাম জ্যাকেলিনের কথা। হাঁ, স্বীকার করি বেলজিকি মেয়ে সুন্দরী জ্যাকেলিন আমাকে গভীর ভালবেসেছিল কিন্তু পরিণতি যে এতটা ভয়াবহ হবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। ওর সাথে প্রথম দেখা  হয় বাসার পাশের এক রেষ্টুরেন্টে। ওকে দেখেই কেন জানি হৃদয়ের কোণে প্রবল এক অনুরাগ জন্মেছিল। পার্টটাইম ওয়েটার হিসাবে কাজ করতো সে। ব্রাসেলস্ শহরে তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, বেলজিক অরিজিনাল। চোখে একবার দেখা এবং প্রতিদিন ওর পরিবেশনায় এককাপ কফি পান করতে যাওয়ার মধ্যে আমার কোন অবহেলা ছিলনা।
হৃদয়ের গভীরে অজান্তে ওর প্রতি এক প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতাম। একদিন বলেই ফেলি-শুধু তোমাকে একপলক দেখব বলে এখানে প্রতিদিন আসা,তা কি তুমি জানো ?
উত্তরে বলল - তোমার চোখে এ ভাষাই আমি প্রত্যক্ষ করে আসছি কিন্তু কেন বলতো ?

জানিনা তোমাকে কি নামে ডাকব ? তবে বলতে অসুবিধা নেই প্রথমদিন দেখেই তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি আর এ কারণেই এখানে প্রতিদিন আসা।
 
পুরুষরা মেয়েদেরকে আকর্ষণ করার জন্য এ ধরণের অনেক কথাই বলে। এই আমি জ্যাকেলিন এ ধরণের কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি, তাই আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।
 
দ্যাখো, এ কথাগুলো তোমাকে এভাবে বলতে চাইনি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথাও ভেবে দেখিনি। আমার অন্তরে যে ভালবাসার ফল্গুধারা প্রবাহিত হচ্ছে তা বুঝতে হলে আমার মনের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। তোমাকে আজ মনের কথাগুলো বলতে পেরে কি যে আনন্দ লাগছে, কি করে তোমাকে বৃুঝাবো।
 
জ্যাকেলিন একটু গম্ভীর স্বরে বলল, স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়াতে ওকে ডিভোর্স দিয়েছি। চেয়েছিলাম সুখী সুন্দর একটি দাম্পত্যজীবন কিন্তু হলনা। মানুষ যা চায় তা পায়না। তুমি যে ভালবাসার কথা বলছ এমন এক প্রগলভ ভালবাসা আমি চেয়েছিলাম যেখানে থাকবে শুধু অনাবিল সুখ আর আনন্দ। পারবে তুমি তেমন ভালবাসতে ?
 
যে বয়সে মানুষ ভালবাসতে চায়, সকল বাঁধাকে জয় করে সামনে এগুতে চায় সে বয়স আমার। জ্যাকেলিনের কথার প্রেক্ষিতে আমার অন্তরে ভালবাসার দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। ওর নিটোল হাতে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম - পারবো জ্যাকি, পারেবো। আমার বুকে কান পেতে শুন হৃদয়ে উৎসারিত এক স্বর্গীয় প্রেমের স্পন্দন।
 
আমার কথার মধ্যে কতটুকু অভিব্যক্তি ছিল জানিনা তবে জ্যাকি যেন এর আগে কখনো এ ধরণের কথা শুনেনি, নীরবে আমাকে প্রত্যক্ষ করলো অনেকক্ষণ, যেন চূলছেড়া এক গভীর বিশ্লেষণ। তারপর আমাকে টেনে নিয়ে গেল রেষ্টুরেন্টের ষ্টাফ রুমের খালি একটিতে।  বুকে মাথা রেখে বলল দ্যাখো, আমাদের দেশের পুরুষদের আমি বিশ্বাস করিনা। ওরা সম্ভোগপ্রিয় ও বহুগামীতে অভ্যস্থ। তোমার চোখেমুখে যে জিনিষটি আমি লক্ষ করেছি তাতে মনে হয় তুমি ওদের মত নও - একটু ব্যতিক্রমধর্মী।
 
প্রচন্ড শীতে, বাইরে বরফবৃষ্টির মধ্যেও ভেতরে আমদের দু’জনের শরীরে বইছে অগ্নেগিরির প্রচন্ড উত্তাপ। প্রচন্ড এ উত্তাপে অগ্নেগিরির উৎসমুখে যেন এখনই ফাটল ধরবে, আর আমরা দু’জন সে অগ্নিদাহে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাব।  জ্যাকির প্রেমময় চাহনি, অবিরাম ঠোটের দংশন আর লেপটে থাকা কবোষ্ণ বক্ষের উষ্ণতায় আমি দিশেহারা।
 
কতক্ষণ কেটেছিল জানিনা। রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজারের উপস্থিতি টের পাইনি। মুচকি হেসে বলল - রাত বেশ হয়েছে, বন্ধ করতে হবে। অধিক সময় দেয়া যাবেনা  বলে দুঃখিত। জ্যাকির সুঢৌল হাত আমার  হাতের  মুঠোয়।  পরস্পর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ একজোড়া কপোত-কপোতী। হাত ছাড়িয়ে নেয়ার বদলে আমার অনামিকায় উপর্যুপরি চাপ সৃষ্টি করছে জ্যাকি। কাঁপছে তার দেহবল্লরী। আর আমি আমার আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে সমর্পিত ওর বাহুডোরে।
 
হোটেল ম্যানেজারের দিকে একপলক তাকিয়ে এবার ফিস ফিস করে বলল - রাত অনেক হয়েছে, ঘরে যাবেনা? কাঁপা কাঁপা স্বরে পুনরায় জ্যাকি বলল, কাল আসছ তো ? আমি অপেক্ষায় থাকবো। দ্যাখো, আবার ভুলে যেওনা যেন। তোমরা পুরুষরা সহজেই তা পার, কি ঠিক বলিনি?  নারীসুলভ কৃত্রিম অভিমান তার মুখচ্ছবিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলল।
 
আবেগে বলে উঠি, আমার তৃষিত বুকে আজ যে আনন্দের বন্যা তার সবটুকুই তোমাকে ঘিরে। আমার পদ্মফোঁটা হৃদয় সরোবরে অবগাহন করে দ্যাখো ওখানে ফুটে আছে কতশত অনাঘ্রাত লালপদ্ম। মনে হচ্ছে আমি যেন সাতসাগরে ডুব দিয়ে এনেছি অসংখ্য মনিকাঞ্চন। পূর্ণতার এ শুভক্ষণে কেমন করে বলতে পারলে তোমায় আমি ভুলে যাব ? আজকের এই স্মুতিময় রাত আমার কি কাটতে চাইবে ?
 
আমার কথাগুলো আমাকেই যেন ব্যঙ্গ করলো। আমার জীবনে এই প্রথম সরাসরি এক বিদেশিনীকে ভালবাসার কথা বলতে পারা। আমি যেন জয় করে এসেছি এই বিশ্বব্রহ্মান্ড। এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে আতিকভাই বললেন, বুঝলেন প্রচন্ড এ আবেগই হয়েছিল আমার কাল্। আমার প্রেমের বহিঃপ্রকাশ জ্যাকিকে ভাসিয়ে দিয়েছিল ভালবাসার প্রবল স্রোতে। ওখান হতে ফিরে আসার সাধ্য না ছিল তার, আর না ছিল আমার।
 
এরপর হতে মিথুন-মিথুনীর মত ডানা মেলে আমরা একত্রে অবাধে বিচরণ করেছি ব্রাসেলস্-এর  রাজপথে, রেষ্টুরেন্টে, পার্কে কিংবা অন্য কোথাও। হিংস্র কামনার উদ্যামতায় আমরা মিশেছি পরস্পরের বাহুডোরে। নিত্যনূতন ভালবাসার ডালি সাজিয়ে একে অপরের প্রতীক্ষায়  কাঁটিয়েছি ক্ষণ, গেথেছি মালিকা, সাজিয়েছি বাসর। ও সময় পেলেই ছুটে আসতো আমার আস্তানায়। অগোছালো বিছানাপত্র, কাপড়চোপড় ঝাড়মোছ দিয়ে শাসিয়ে যেত যাতে নিজের চালচলনে যত্নবান হই।
 
একদিন ওর পিতামাতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানালো আমাকে অচিরেই বিয়ে করতে যাচ্ছে। পিতামাতা আশীর্বাদ করলেন যাতে বিবাহিত জীবনে আমরা সুখী হই।
 
আমি এখানে এসেছিলাম ট্যুরিষ্ট ভিসা নিয়ে। রাজনৈতিক আশ্রয়দানের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম উকিল মারফত। কেইস তখনও কোর্টে। জ্যাকি আশ্বাস দিল বিয়ের পর কাগজপত্র দেখিয়ে রেসিডেন্ট পারমিট পেতে অসুবিধা হবেনা। তাই একদিন কোর্টে গিয়ে আমাদের বিয়ে হল এবং সে অনুযায়ী জ্যাকী আমার রেসিডেন্ট পারমিটের  দাবী  নিয়ে  কোর্টে  কাগজপত্র দাখিল করল। একসময় তা পেলাম বটে কিন্তু বিধিবাম। বিয়ের ব্যাপারটি বন্ধুদের কারোর পছন্দ হয়নি এমন কারোর মাধ্যমে খবরটি রাতারাতি পৌঁছে গেল দেশে।
 
একদিন পিতার পত্র এলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। ওনার শরীর ভেঙ্গে পড়েছে, বাঁচার আশা ক্ষীণ। হাসপাতাল বেডে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন, অবস্থা বে- গতিক। মৃত্যুর পূর্বে তিনি বংশের প্রথম বউমা দেখে মরতে চান, ক’নে ঠিক হয়ে আছে, সুতরাং কালবিলম্ব না করে দেশে যেন প্রত্যাবর্তন করি।
 
জ্যাকি এবং আমার সংসারে বিপর্যয়ের ঘনঘটা। শরবিদ্ধ পাখির ন্যায় ছটফট করতে দেখে জ্যাকি শুধালো, আজকাল তুমি এত মনমরা  থাকো কেন, কি হয়েছে, আমাকে খুলে বল।
 
পিতার মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো মনের আয়নায়। সঠিক লক্ষ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বিপরীত কোন প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে জ্যাকিকে কিছু জানাইনি। ভাবলাম  পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জানাবো। কয়েকদিন পালিয়ে বেড়ালাম নানা ছলে জ্যাকির কাছ থেকে। নেদারল্যান্ডের সীমান্ত শহর এনস্কিডে বসবাসরত নিকটতম বন্ধু সফিকের কথা মনে হল। ও শুধু আমার ছোট্ট বেলার বন্ধুই নয়, প্রবাসে আমার একজন হিতাকাঙ্খীও বটে। তার বাড়ি বাংলাদেশে আমাদের পাশের গ্রামেই। আমার পিতামাতা, ভাইবোন সবার সাথেই রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। তার মাধ্যমে আমার পরিবারকে সমগ্র বিষয় বুঝিয়ে বলতে হবে যাতে আমার সাম্প্রতিক ব্যাপার কারোর কাছে বিরক্তির কারণ না হয়।
 
একদিন ব্রাসেলস্ হতে পাড়ি জমালাম নেদারল্যান্ডের এনস্কিডে  বন্ধু  সফিকের বাসায়। সফিক জানে বেলজিয়ামে আমি ট্যুরিষ্ট ভিসায় এসেছিলাম, জ্যাকি আমাকে বিয়ে করাতে স্থায়ীভাবে বসবাসের এবং কাজের সরকারী অনুমোদন পেয়েছি। যদিও শুধুমাত্র এ কারণে জ্যাকিকে আমি বিয়ে করিনি, বিয়ে করেছিলাম জ্যাকিকে সত্যিকার ভালবেসে। ওর কাছে আমি পেয়েছি জীবনের শ্রেষ্ট পাওয়াগুলোর সবক’টি। ওর নিখাদ ভালবাসা, সংসারের প্রতি কর্তব্যবোধ, প্রতিটি ধাপে সে এক আদর্শ জীবনসঙ্গিনী। সফিক এ কারণে বহুবার আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে - বলেছে, বন্ধু তুমি সত্যিই ঠকোনি।
 
জ্যাকি আমাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন সফিকের বাসায় হাজির। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল - বল কি দোষ করেছি আমি?  কি অপরাধে আমাকে এমন মানসিক যন্ত্রণা পেতে হচ্ছে, কি হয়েছে তোমার ? আমাকে না জানিয়ে এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? একসাথে অনেক অভিযোগ। আমি নীরব, উত্তরের ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছি। উত্তর না পেয়ে জ্যাকি জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। চোখ তার ছলছল। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমার উপর দিয়ে এক প্রবল বৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে, ক্ষত-বিক্ষত এক পাখির ন্যায় ডালে ডালে বিচরণ করছি ঝড়ের ঝাপটা সামলাবো বলে।
 
সফিক নিরবতা ভাঙ্গল। আমার মন খারাপের ব্যাপারটি জ্যাকিকে বুঝিয়ে বলল। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জীবনের উপর পিতামাতা ভাইবোনদের প্রভাব থাকবে কেন এটা বুঝাতে ব্যর্থ হল।
 
ইউরোপের  মেয়েরা  স্বচ্ছতা  পছন্দ  করে।  বললাম, তোমাকে দূঃখ দিতে চাইনি বলে পালিয়ে  বেড়াচ্ছিলাম। যে কথাটি তুমি সহজে বলতে পারলে আমাদের সমাজে তা অচল। বিয়ের ব্যাপারে ব্যক্তিগত পছন্দের চেয়ে পারিবারিক পছন্দ আমাদের সমাজে অধিক গ্রহণযোগ্য। বাবাকে আমি চিনি, আমাদের ব্যাপারটি জানালে তিনি আমাকে ত্যাজ্য করতে দ্বিধাবোধ করবেন না। তাছাড়া তিনি হাসপাতালের বেডে শয্যাশায়ী, এমন খবরে তিনি হার্টফেলও করতে পারেন।
 
আমাদের সমাজ সংস্করের কথা জ্যাকিকে আমি বিশদভাবে ব্যাখা করে পূর্বেও অনেকবার বলেছি। এমতাবস্থায় সে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে চাইল। বললাম, বাবাকে বাঁচাতে হবে এবং পারিবারিক ভাঙ্গন ঠেকাতে  হলে আমাকে কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরে যেতে হবে। আমার বিশ্বাস, ওখানে যাওয়ার পর একটা সুষ্ঠ সমাধান খুঁজে পাব।
 
জ্যাকি বলল, তার চেয়ে এই ভাল আমাকেও তোমার সাথে বাংলাদেশে নিয়ে চল। তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলব, আমরা ভালবেসে একে অপরকে বিয়ে করেছি এবং এতে দোষটা কিসের ? আশা করি তিনি বুঝবেন এবং আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবেন। উত্তরে বললাম, জ্যাকি আমাদের সমাজব্যবস্থা সম্মন্ধে তোমার জানা নেই। পশ্চিমা মেয়েদেরকে তারা ভাল চোখে দেখেনা কারণ পশ্চিমাদের সাথে আমাদের সামাজিক রীতিনীতির কোন মিল নেই। তারচেয়ে এই ভাল, আমি একাই যাই। আশা করি আমি সফিকের সাথে পরামর্শ করে এর একটা নিশ্চিত সমাধা খুঁজে বের করবো।
 
কেন পশ্চিমা হলেও আমি আমার বাবা মার মতামত নিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার ধর্ম গ্রহণ করেছি যদিও নামাজ, কু’রআন পড়তে এখনো শিখিনি তবু রোজাতো রাখছি। পিতামাতা আমার ধর্মান্তরিত হওয়াকে খুব ভাল চোখে দেখেননি তবু আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দকে তারা প্রাধান্য দিয়েছেন।
 
বন্ধু সফিকের সাথে পরামর্শ করে একটা সমাধান খুঁজে পাব এই আশ্বাস দিয়ে জ্যাকিকে বেলজিয়ামে বিদায় করলাম। বিপর্যস্ত মন নিয়ে বেলজিয়ামে ফিরে এলাম পাঁচদিন পর। বোনের লিখা আরেকটি কড়া চিঠি পেলাম এরই মধ্যে। যদি বাবাকে দেখতে চাও তাহলে আর একমূহূর্ত দেরী করনা ভাই। সম্ভবতঃ বাবা তোমার জন্যই বেঁচে আছেন।
 
পারিবারিক প্রলয় ঠেকাতে আমার দেশে ফেরা জরুরী বিধায় বিমানের টিকেট হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। জ্যাকিকে বোনের লিখিত চিঠি তর্জমা করে পড়ে শুনালাম। জ্যাকি তন্ময় হয়ে শুনল। ছলছল চোখে বলল আমি এক অশুভ ইঙ্গিত টের পাচ্ছি আতিক। মনে হচ্ছে পারিবারিক চাপে তুমি বিয়ে করবে, এখানে আর ফিরবেনা এবং আমার সাজানো সংসার তাসের ঘরের মতই ভেঙ্গে যাবে।
 
কি বলছ জ্যাকি? তোমাকে কথা দিচ্ছি সব সামলে আমি শীঘ্রই ফিরবো। মনে রেখো, তোমাকে আমি ভালবেসে বিয়ে করেছি আর তোমকে পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য। আমি দেশ থেকে ফেরা অবধি তুমি তোমার মায়ের কাছে থাকবে। ফিরে এসে তোমাকে বাসায় নিয়ে আসব। মনে হচ্ছে তুমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, মায়ের কাছে থাকলে ভাল থাকবে।
 
ওকে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলাম কর্মস্থলের পাশাপাশি এক বন্ধুর বাসায়। বাংলাদেশ বিমানে সিট পেলাম বুকিংয়ের পাঁচদিন পর।
 
পাঁচদিনের মাথায় নিজের বাসায় লাগেজ নিতে এসে সিঁড়ি বেয়ে আমার দোতালার ফ্লাটে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় একজন পুলিশ অফিসার আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল - স্যার, আপনার নামই কি আতিকুর রহমান ? হাঁ- বাচক শব্দ শুনে বলল - এখনই আপনাকে হাসপাতালে যেতে হবে একটি লাশ শনাক্ত করতে। জানতে চাইলাম কাকে ? পুলিশ অফিসার জানাল এ ব্যাপারে সে কিছুই জানেনা। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ সে পালন করছে মাত্র।
 
আমার চেতনায় আমাদের পাশের গ্রামের আব্দুস সালামের মুখচ্ছবি ভেসে উঠল। ব্রাসেলস্-এ একটি গ্লাস ফ্যাক্টরীতে চাকুরী  করত  সে।  বহুদিন ধরে ক্যান্সারে ভূগছিল  লোকটি, নিশ্চয়ই সে মারা গেছে কোন দুর্ঘটনায়। পুলিশ তাকে হয়তো সনাক্ত করতে পারছেনা।

পুলিশ  ভ্যানে  করে  হাসপাতালের  মর্গে  পৌঁছতে দেরী হলনা। ওখানে কর্তব্যরত তিনজন পুলিশ অফিসারের পেছনে পেছনে মর্গে সারিবদ্ধ লাশের কাছে পৌঁছতেই একটি লাশ উন্মোক্ত করা হল। সাদা কাপড়ে আবৃত লাশটির মুখ খুলতেই দেখি জ্যাকি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। পিস্তলের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে গেছে ওর মাথার খুলির একাংশ। চুলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছে ফ্যাকাশে রক্তকণিকা। ভাবতেও পারিনি জ্যাকিকে আমি এ অবস্থায় দেখব। মনে হল আমিও একজন মৃত ব্যক্তি। আমার কোন সত্ত্বা নেই। অবশ দেহখানার ভেতর  হৃৎপিন্ড  প্রবলভাবে দুলছে। পুলিশ অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে সংবিত ফিরে পেয়ে বললাম - ও আমার বিবাহিতা স্ত্রী। কয়েকদিন পূর্বে ওর পিত্রালয়ে সে বেড়াতে গিয়েছিল। পুলিশ অফিসার জানালো - ওর  লাশের  পাশে  আমরা  একটি চিরকুট পেয়েছি। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এর প্রেক্ষিতে আপনার মতামত জানতে চাইছে। জানতে চাইলাম কি লেখা আছে এতে? একজন অফিসার বলল - জবানবন্দির জন্য ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নেওয়ার পর বিষয়বস্তু জানা যাবে তার আগে নয়।
 
ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে চিরকুটটি পড়ে আমাকে শোনানো হল। ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখা এর সারাংশ এই দাঁড়ায় যে,”আতিককে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম ওকে নিয়েই বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেব। সে তার পিতার চিঠির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পিতামাতার প্রতি ওর আনুগত্য এদেশে কারোর মধ্যে আমি দেখিনি। ওর পিতা ওর জন্য বিয়ের ক’নে ঠিক করে রেখেছেন, আমি একপ্রকার নিশ্চিত যে, সে তার পিতামাতার অবাধ্য হবেনা। ওদেরকে খুশী করার জন্য সে কিনা করতে পারে ! আমার জীবিতবস্থায় আতিক অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে এ হতে পারেনা।  তার বিয়ের খবর শুনার পূর্বেই আমি মৃত্যুকে বেছে নিলাম” --- জ্যাকেলিন।
 
আতিকভাই এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন - বিস্ময়ের বজ্রাঘাতে ম্যজিষ্ট্রেটের প্রশ্নের উত্তরে কি কি বলেছিলাম তা এই মূহূর্তে সবকিছু মনে করতে পারছিনা কারণ ঐ সময় আমি মানসিকভাবে এমনই বিপর্যস্ত ছিলাম যে, কথার সব খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম যা ম্যাজিষ্ট্রেটকেও তাৎক্ষণিক  চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। কোর্টের সামনে দৃঢ়তার সাথে বলতে পেরেছিলাম যে, নিজের স্ত্রীর কাছে এটা বলা প্রয়োজন ছিল যে, মৃত্যুপথযাত্রী পিতা আমার জন্য বিয়ের ক’নে ঠিক করে রেখেছেন, যে কারণে পিতাকে একবার দেখার প্রয়োজনে হলেও আমাকে দেশে যেতে হবে। বিয়ের ব্যাপারে পিতাকে বুঝিয়ে বলে পুনরায় বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি এড়াতে পারবো এ কথাটিও জ্যাকিকে বারবার বলেছি। শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে একজন স্ত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেনা, এর পেছনে অন্য কোন কারণ থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
 
পশ্চিম ইউরোপের প্রত্যেকটি প্রিন্ট মিডিয়া ও গণমাধ্যমে জ্যাকির অকালমৃত্যু ও আমাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি ও সমালোচনার ঝড় উঠল। সন্দেহাতীতভাবে আমাকে পুলিশের জিম্মায় আটকে রাখা হল। আটককালীন অবস্থায় সাংবাদিকদের সামনে ঘন ঘন উপস্থিত করা হল। সরকারী মনোবিজ্ঞানী দ্বারা আমাকে বিভিন্ন সময় পরীক্ষা করা হল। বিচারকদের সামনে এবং বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে রেকর্ডকৃত জবানবন্দিতে কোনরূপ অসংগতি আছে কিনা তা খুঁটিয়ে দেখার প্রায় একবছর পর আমাকে নির্দোষী হিসাবে অবমুক্ত করা হল।
 
দেশে গিয়েছিলাম কিন্তু পিতাকে জীবিত দেখার সৌভাগ্য হয়নি। প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস সহ্য করতে না পেরে বিপর্যস্ত বলাকারা ভারসাম্য হারিয়ে যেভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আমারও তখন একই অবস্থা। প্রায় ছ’মাস দেশে অবস্থান করলাম। শান্তির শ্বেতকপোত কোথায় নিরুদ্দেশ হল, বিস্মৃতির অতলগহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে জ্যাকিকে নিয়ে আমার স্মৃতিময় দিনগুলো ব্রাসেলসে ফিরে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে রইল।
 
আমার মানসিক চাপ রোধে নেদারল্যান্ডে বসবাসরত বন্ধু সফিক তার শশুরের কাছে ও আমার পরিবারের কাছে যুক্তি দেখিয়ে অসংখ্য পত্র ও ফোনালাপের মাধ্যমে তার স্ত্রীর খালাতো বোন নাঈমাকে বিয়ে করানোর ব্যাপারে যুক্তি খাড়া করলো। আমাকে লিখলো - বন্ধু, তোর ভালো চাই বলে অনুরোধ করছি নাঈমাকে বিয়ে করে ফিরে  আয়।  তোর  জীবনের  বাকী  দিনগুলো নিজের চোখের সামনে নষ্ট দেখতে চাইনা। জ্যাকিতো আর ফিরে আসবেনা বরং তার স্মৃতি তোকে শেষ করে দিবে।
 
শেষপর্যন্ত সফিকের যুক্তি, তার শশুড়, পারিবারিক চাপ এবং পিতার অন্তিম ইচ্ছার কাছে আমাকে নতি স্বীকার করতে হল। নাঈমার সাথে অনাড়ম্বর বিয়ে হল। বাসর রাতে নাঈমাকে জিজ্ঞেস করলাম, জেনেশুনে বিয়েতে রাজী হয়েছিলে কেন ? উত্তরে বললো, সফিক ভাইয়ের সাথে ফোনালাপে সব জেনেছি, বিদেশে নাগরিকত্ব পেতে কনট্রাক্ট ম্যারেজ নাগরিকত্ব পেতে সহায়ক ভূমিকা রাখে, আপনার বেলায়ও  এমনটি  ঘটেছে। পশ্চিমা মেয়েরা টাকার লোভে কনট্রাক্ট ম্যারেজে রাজী হয় এটা এদেশের সকলেই জানে। তবে টাকা নিয়ে অজানা, অচেনা কাগুজে সই করা বিদেশী স্বামীর প্রেমে আত্মহত্যা কেউ করতে পারে এমন ঘটনা ওদেশে বিরল এবং অবিশ্বাস্য। ঐ বিদেশিনী মরেছে অন্য কোন কারণে, আপনার দোষ নেই এতে। যতটুকু জেনেছি আপনি সহজ সরল নির্ভেজাল একজন পুরুষ। আমাদের বিয়ে হয়েছে, আপনাকে সুখী দেখতে চাই। এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে আমার কাছে কিছু থাকবেনা।
 
না, তুমি যা জেনেছ তার সবক’টি সঠিক নয় নাঈমা।
 
দেখুন, আমি যা জেনেছি পারিবারিক সূত্রে ও সফিক ভাইয়ের কাছে তা যথেষ্ট বলে মনে করি। তাই আর ঘাটাঘাটি করতে চাইনা। আপনি মহানুভব তাই অনর্থক সেই বিদেশিনীর কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছেন। জানেন, কষ্ট মানুষকে প্রতারিত করে। জীবনের চোরাগলিতে হাঁটতে গিয়ে অনেক ঘটনা ঘটে যা স্মরণ করলে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সেই দুঃসহ ঘটনাগুলোকে ঝেড়ে মুছে নূতন করে জীবনের হিসাব মেলাতে হয়। আশা করি আমার মনের কোণে পুষে রাখা রঙ্গিন স্বপ্নগুলোকে নিরর্থক বাক্যবাণে ব্যর্থ করে দিবেননা।
 
জানেন, বিস্মিত হলাম নাঈমার বাকপটুতায়। লেখাপড়া জানা গ্রামের সহজ সরল মেয়েকে মনে মনে দাঁড় করালাম জ্যাকির বিপরীতে। জ্যাকি নারীস্বাধীনতায় বেড়ে ওঠা স্বনির্ভর স্বাধীন এক বিদেশিনী,  দাম্পত্যজীবনে একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী হয়ে না থাকার সন্দেহ তাকে আত্মঘাতী করেছে। আমার জীবনে সম্ভাব্য অন্য কোন নারীর আবির্ভাব কোনক্রমেই সে সহ্য করতে পারবেনা এমন আবেগমিশ্রিত উৎকন্ঠার চিরকুট লিখে সে চলে গেল না ফেরার দেশে। শেক্সপিয়ারের ”হেমলেট” নাটককেও যেন সে হার মানিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের নরম ঘাসফুলে গড়াগড়ি খেয়ে বেড়ে ওঠা নাঈমা দাম্পত্যজীবনের শুরুতে অবিশ্বাসকে তুড়ি মেরে বিশ্বাসের খুঁটি  মজবুত  করতে চায়। ঘটে যাওয়া বেদনার উপর শক্তির প্রলেপ মাখিয়ে আমাকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়।
 
উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা আতিকভাইয়ের হৃদয়ের গভীরে জ্যাকির ভালবাসা মেশানো ক্ষতটি কিভাবে ক্ষণে ক্ষণে মোচড় দিচ্ছে তারই এক অসহ্য প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করছি তার চোখেমুখে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অনুমতি চেয়ে বললাম জানেনতো আমার লেখালেখির অভ্যাস রয়েছে। আমার কোন লেখায় যদি আপনার এ ঘটনার কথা এসে যায় তাহলে আপত্তি নেইতো ? উত্তরে জানালেন - এ ঘটনা পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে প্রায় একবছর সুতরাং জানাজানির ভয় আমার নেই।
 
জানেন, একসময় মনে হয় ওর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। বাবার চিঠির কথা ওকে না জানালেই পারতাম। এমনটি যে ঘটে যাবে ভাবতেই পারিনি। বুক পকেটে রাখা ম্যানিবেগে সযত্নে রক্ষিত জ্যাকি ও ওনার মুখোমুখি একটি ফটো বের করে দিলেন আমার হাতে।
 
ছবি যেন কথা বলে উঠল আতিকভাইয়ের চোখে চোখ রেখে। ’কেমন আছ আতিক ? অনেক ভেবেচিন্তে তোমার পিতার ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দিয়ে আমি নিজেকে সরিয়ে নিলাম। আমি কি জানতাম আমি নিঃশেষ হয়ে গেলে তুমি ওমনভাবে ছটফট করবে ? আমি ভুল করেছি আতিক আবেগের বশে। এ বিরাট ভুলের ক্ষমা নেই। দেশে গিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী তোমার পিতার আদেশ পালন করে সুখী হও আতিক। পারলে আমাকে ক্ষমা করো। পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে জ্যাকেলিন তোমার জন্য জন্ম জন্মান্তর অপেক্ষা করবে।’
 
আতিকভাইয়ের চোখে অশ্রু। ট্রেনের জানালাপথে উদাস দৃষ্টি নিবদ্ধ। এক পিচ্ছিল, দুঃস্বপ্নের মহাসিড়ি পেরিয়ে তিনি ব্রাসেলসে ফিরে এসেছেন। নববধূ নাঈমা চোখের জলে বিদায় জানিয়েছে। এখানে ফিরে আসার পর জ্যাকির স্মৃতি তাকে অহরহ কাঁদাচ্ছে। বাকহারা আমি। আতিকভাইকে শান্তনা দেয়ার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছি।
 
মনটি বেদনার নীল জলে সিক্ত হয়ে বোবা কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে হরিয়ে গেছে শূন্যতায়। মনে মনে অভিসম্পাত জানালাম মূর্খ এ ভালবাসাকে। আতিকভাইকে  বললাম - যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি এ ছবিটি অবশ্যই বুক পকেট হতে সরিয়ে ফেলুন। এটি কথা বলবে, জ্বালা ধরাবে, জ্বালিয়ে মারবে, স্মৃতিকে তছনছ করবে। কি লাভ এতে ? নববধূ নাঈমার ব্যাপারে যতটুকু জানলাম তাতে মনে হচ্ছে সেও বুদ্ধিদীপ্ত অসাধারণ এক মেয়ে। ওকে শীঘ্র এখানে নিয়ে আসুন, ওর মুখমন্ডলে জ্যাকির প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে নূতনভাবে জীবন শুরু করুন। আর হ্যাঁ - ব্রাসেলস্-এ ফিরে জ্যাকির কবরে একগুচ্ছ ফুল বিছিয়ে দিয়ে তার ভালবাসাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসব।
 
নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমষ্টারডামে প্রবেশ করছিল ট্রেনটি। আমরা উঠে দাঁড়ালাম, এবার আমাদের গন্তব্য এন্সকিডে অতিকভাইয়ের বন্ধু ও পরম আত্মীয় সফিকের বাসা।
 ===========

(লেখাটি লেখকের প্রকাশিত বই ”ইউরোপে সতেরো দিন” বই হতে নেয়া সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি খন্ডচিত্র। বইটি দেশে-বিদেশে পাঠককূলে প্রচুর সুখ্যাতি কুঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থা, খ্যাদ্যাভাস, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদির গভীরে প্রবেশ করে বইটিতে লেখক একটি বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এ বইটি পেতে হলে যোগাযোগ করুন : বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ  বুক সোসাইটি, ১২৫, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা । মোবাঃ ০১৭১১-৮১৬০০১, তোফাজ্জল হোসেন, ম্যানেজার)
 
 

 

No comments:

Post a Comment

What do you think?