স্বদেশ-বিহীনা
- গুলশান চৌধুরী
এক.
ওয়াফা এখন অবিকল তার ম্যাথ-টিচার মিসেস ডিলিয়নের অঙ্গভঙ্গী ধারণ করে অনুজকে কাউন্টিং শেখাতে ব্যস্ত। মাথার ওপর ফ্যানের বাতাসে ঝিলমিল করে দোল খাওয়া ঝাড়বাতির সারি দেখিয়ে বলে : এগুলো কাউন্ট কর। বল, ওয়ান - টু - থ্রী । একান্ত অনুগত ছাত্র সাকিব সাথে সাথে নির্দেশ পালন করে : ওয়ান , তু, থী ..
ভেরি গুড, এবার বাংলায় শেখো, এক দুই তিন চার পাঁচ ----
এক দুই তিন চাল পাত।
সাদা সালোয়ার কামিজ পরিহিতা বৃদ্ধা তসবী পড়তে পড়তে এতক্ষণ বার বার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন।
ওদের পাশে এসে আদর করে বলেন, তুমলোক বাংলাদেশী হ্যায় ?
জ্বী দাদী, আমরা বাংলাদেশী।
বৃৃদ্ধা হাত বাড়ান। অমনি চাপাচাপি করে ওরা কোলে চড়ে বসে। গলা জড়িয়ে ধরে। যেন কতকালের চেনা। কোলে বসার সমান অধিকার দুজনেরই। কোল দখলের পাকাপোক্ত কৃতিত্ব নিয়ে এবার ডাক দেয় ঃ মা, দেখ, এই যে আমাদের দাদী।
মৃদু হেসে তাকে সালাম দেই। দোয়া-দরূদের বইটি বন্ধ করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলি, বেশ তো। দাদীকে তাহলে কষ্ট দিচ্ছ কেন ? কোল থেকে নেমে বস।
কোই বাত নেহি মাজ্বী। আমার তকলিফ হচ্ছেনা। তোমরা কোলেই বস, মেরা জান’।
ওমা ! মহিলা বেশ বাংলা জানে দেখছি। হ্যান্ডশেক করে জিজ্ঞেস করি ঃ আপনি ইন্ডিয়ান?
না পাকিস্তানী?
কিউ মাজ্বী ? আমি কি বাংলাদেশী হতে পারিনা?
অবশ্যই হতে পারেন। তাহলে আপনি বাংলাদেশী?
কি জানি। জোর দিয়ে তো বলতে পারিনা।
মানে?
মানে আমি খাস বাঙালী ঠিকই। লেকিন আপনা দেশ হয়ে গেছে পরদেশ।
স্যরি, বুঝলাম না।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, তকদিরের ফেরে আজ আমার ঠিকানা অনেক দেশে। ওয়াফা বেহেনজ্বীর মত কাউন্ট করে বুঝিয়ে বলি।
মহিলা আঙ্গুলে গণনা শুরু করেন ঃ এক, ঊনিশ শ সাতচল্লিশ তক ইন্ডিয়ান। দুই, রায়ট কা বাদ পূর্ব পাকিস্তানী। তিন, শাদী কো বাদ পশ্চিম পাকিস্তানী। চার –
চার ? মানে এখন কোন্্ দেশী ?
ক্যাতনা দেশ কো নাম শুনবে? আমার দো বেটা। বড় বেটা মোমেন খান আমেরিকান। ছোট বেটা শাহীন খান কানাডিয়ান। একটাই বেটি, নাম বুলবুল খান। মাকান লন্ডনে। বেটা বেটি তিনজনাই ডাক্তার। দুই নাতিও ডাক্তার, একজন সিঙ্গাপুরে, আরেকজন অস্ট্রেলিয়ায়। উধারসে তারাও আপনা আপনা মাকানের মালিক। এখন বোঝ কাহাসে মেরা ওয়াতান ।
সারা দুনিয়ায়। বাহ্্! ভালই তো। ঐ সব ক’টা দেশেরই নাগরিক আপনি ?
নাহ্। বড় বেটার কারণে এখন আমেরিকান।
পাকিস্তানে থাকেন না ?
করাচীমে এ্যাতনা বড়া একটা আপনা মাকান থা। ছিলাম ওখানে। তোমহার খালুর ইন্তেকাল কা বাদ মেরা বেটা বেটি কেউই উধারসে আমাকে একলা থাকতে দেয়না । তাই কয়েক মাস পর পর দুনিয়ার সব দেশ ঘুরে বেড়াই ওদের সাথে। আজ ইহাসে তো কাল উহাসে। আমার পিয়ারের একটা কবিতার লাইন কি জান, ‘চীন আরব হামারা, হিন্দুস্থান হামারা, -----সারা জাহান হামারা।
আপনার লাইফটা ভেরী ইন্টারেস্টিং তো।
তা বলতে পার। এখন তোমার কথা বল। মদীনাতেই থাক ?
জ্বীনা, জেদ্দায়।
মাস্টারী কর বুঝি ?
কি করে বুঝলেন?
ব্যাগের সাইড পকেটে লাল কলম, মার্কার পেন এসব দেখে। তো, সৌদী স্কুলে ?
জ্বীনা। বাংলাদেশ এ্যাম্বেসী স্কুলে।
মাশাআল্লাহ।
বৃদ্ধার গোলাপী গালে এক নদী গোলাপী মমতার স্রোত। একটু পর পর সে মমতা তির তির করে নামছে ওয়াফা-সাকিবের গালে।
ওয়াফা গলা জড়িয়ে ধরে বলে, দাদী, পানি খাবো।
সাথে সাথে প্রতিধ্বনি সাকিবের ঃ দাদী, আমিও পানি খাবো।
আবদারের ঢং দেখে ধমক দিয়ে বলি, এ্যাই, দাদী কে আর কত জ্বালাবে? এস আমার সাথে। দিচ্ছি।
ওহ্ হো, বকছো কেন মাজ্বী? তুম ব্যাঠো। আমি পানি দিচ্ছি।
কয়েক হাত এগিয়ে ওদেরকে নিয়ে সারি বাধাঁ জমজমের পানির কন্টেইনারের কাছে যান। ডিসপজেবল গ্লাসে ঢেলে খাইয়ে দেন। ফিরে এসে বলেন, দেখলে মাজ্বী, এই যে ওরা অচেনা একজনকে দাদী দাদী বলে মিশে গেছে, এটা এমনি এমনি না। একে বলে দেশের রক্তের টান।
দুই.
হেরেম শরীফের দুগ্ধ-ধবল অঙ্গনে হিমেল বাতাস বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে জুমার আজানের মধুর সুর। দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে আসা নামাযীদের ভীড় ক্রমশ বাড়ছে। মহিলারা ঢুকছেন মহিলাদের গেট দিয়ে। পুরুষরা ঢুকছেন পুরুষদের গেট দিয়ে। তুলতুলে কচি শিশুদের গালিচায় শুইয়ে রেখে জননীরাও কাতরে দাঁড়িয়ে যান। মাইক্রোফোনে ইমামের কন্ঠের গম্বীর আওয়াজ ভেসে আসতেই আচমকা ভয় পেয়ে যায় ঐ সব শিশু। সমস্বরে আরম্ভ হয় কচিকন্ঠের ভীত সন্ত্রস্থ কান্না। একসময় আমিও দুই শিশু নিয়ে নামায পড়তে এসে ওদের এ রকম কান্না মেনে নিয়েই নামায পড়েছি। অনেক সময় বাধ্য হয়ে কোলে নিয়েই নামায আদায় করতে হয়েছে। সেকী বিব্রতকর অবস্থা! আরাধনায় নিবিষ্ট হবার জো নেই। কেবল মনে হত ইমাম সাহেব কেন ক্বেরাত সংক্ষিপ্ত করছেন না?
নামাজ শেষে ঘরমুখো মহিলাদের ভীড় কমতে শুরু করে। যারা বসে আছেন তারা আমার মত রওজা শরীফের দর্শনার্থী। দুপুর দুটোয় মহিলাদের জিয়ারতের জন্য অভ্যন্তরীণ গেইট খুলে দেওয়া হবে। ততক্ষণ বসে বসে কেউ দরূদ পড়ছেন, কেউবা তেলাওয়াৎ করছেন। কেউ কেউ আগেভাগে যাওয়ার জন্য গেটের কাছে গিয়ে বসেছেন। ভীড় আরেকটু কমে গেলে আমি দুরন্ত বাচ্চাদুটোকে দিয়ে আসব ওদের বাবার কাছে। ওদের নিয়ে রওজা শরীফে ঢোকা অসম্ভব। হাত ফসকে গেলে ভীড়ের চাপে হয় চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হবে, নয়তো জনারণ্যে হারিয়ে গিয়ে লঙ্কাকান্ড ঘটাবে। অতীতে এমনটি ঘটেছেও দু’একবার।
বৃদ্ধা আগের মতই কোল দখলের দৌরাত্ম্য সহাস্যে মেনে নিয়ে গালিচায় বসেেেছন আর ওদের পাঁচমিশেলী প্রশ্নপর্র্ব সামাল দিচ্ছেন। হাতের আমলকী-রঙ্গা তসবী এতক্ষণ দুলছিল। এবার এটাও দখল হয়ে গেল। ওয়াফা পুনরায় ভারপ্রাপ্ত ম্যাথ-টিচার মিসেস ডিলিয়ন। আর তসবী হয়েছে ভারপ্রাপ্ত এ্যাবাকাস। একমাত্র ছাত্র সাকিবের টেষ্ট চলছে। দুই হাতে টান টান করে তসবী ধরে ওয়াফা। আর সাকিব গণনা করে, ওয়ান, তু, থী, ফো, ফাইভ, সিস--- । তসবীর সম্ভাব্য ছিন্নভিন্ন পরিণতির চিত্র যেন মেনেই নিলেন বৃদ্ধা। সহাস্যে ওদের কান্ড-কীর্তি উপভোগ করতে থাকেন। তারপর বলেন,‘আচ্ছা মাজ্বী, বাংলাদেশে তোমার মাকান কি মোমেন শাহী জেলায়’?
‘জ্বীনা। কাছাকাছি জেলায়। ঐ জেলা আপনি চেনেন’?
‘হা, ওহি তো আমার বাপের দেশ। এ কারণেই তো আমার দুই বেটার নাম রেখেছি মোমেন খান, শাহীন খান। মাজ্বী, মোমেন শাহীর কথা কেন বললাম জান’?
‘কেন’?
‘তোমাকে দেখে বার বার মোমেনশাহীর এক বিবির কথা ইয়াদ হচ্ছে। এক চেহারা, এক সুরৎ। ফারাক শধু কালারে। উনি ছিলেন গোরা। আর তুমি --।
মৃদু হেসে কথাটা সমাপ্ত করি, ‘কালো’।
‘তোবা তোবা, তাই বলেছি নাকি? তুমি কালো হতে যাবে কেন? তুমি তো সাওলা। ইয়ে কালার তো আচ্ছা কালার, বেটি’।
আমার হাসি দেখে চিবুক ছুঁয়ে নিয়ে ছোঁয়া লাগা আঙুলে চুমু খেয়ে বলেন, ‘তাজ্জব কি বাত। তোমার হাসিটাও অবিকল ওনার মত। জানো, ঐ বিবিসাবকে আমি ক্যাতনা সাল তক তালাশ করে বেড়াই। দুনিয়ার যেখানে যে বাঙ্গালী পাই তাকেই পুঁছ করি। হেরেম শরীফে যখনই আসি তখনই সেজদায় পড়ে মোনাজাত করি আল্লাহ্ যেন তার সাথে জরূর মোলাকাত করিয়ে দেন’।
‘উনি কি আপনার আত্মীয়’?
‘তার চেয়ে বেশি। উনকো উছিলায়ই তো আজ আমার জিন্দেগী ভর এ্যাতনা দৌলত, এ্যাতনা ইজ্জত। উনকো হাত মে এ্যাতনা বরকত থা, ঠিক যেন আলাদীনের চেরাগ’।
‘তাই নাকি’?
‘হা। নাইলে তো আজতক আমি মোমেনসিংয়ের এক বস্তি কা নোকরানী হয়েই থাকতাম। তিন তিনটা হীরার টুকরো বেটা বেটির মা হতে পারতাম না। আজ আমার পরিবারে বেটা,বউমা,দামান্দ, নাতিপুতি সবমিলে আট জন ডাক্তার। উপরমে দেখ, ঐ ঝাড়বাতির মতই আমার রোশনাই জিন্দেগী। উপরওয়ালার মেহেরবানীতে ইয়ে জিন্দেগীর সব মকসুদ হাসিল। স্রেফ এক আখেরী মকসুদই বাকি। আমি জানি, তাও আল্লাহ্ উয়ো বিবি সাহাবকে দিয়েই পুরা করবেন‘।
‘ঠিক। তো, আপনার আখেরী মকসুদ কী’?
‘মউতের আগে একটিবার আমার বাপের দেশে যাওয়া। মা বাবার কবর জিয়ারত করব আর ভাই বেহেন রিসতাদার সবাই কে এক নজর দেখব। দুঃখের কথা কি জান, আমার বেটারা এতে নারাজ। কিন্তু আমি ইরাদা করেছি যাবই যাব। বেটাদের তোয়াক্কা না করে আমি একলাই যাব ঐ চৌধুরী বিবি সাহেবানীর মাকানে। আমি জানি, বাংলাদেশে গেলে একমাত্র উনিই আমার দিকে হাত বাড়াবেন। তার হাত যে চেরাগী হাত’।
ভদ্রমহিলা বলেই যাচ্ছেন। কথার সম্মোহন থেকে আমার আর রেহাই নেই বুঝি। দরূদ পাঠে মনোনিবেশ করতে পারব না। বৃত্তান্ত শুনেই যাব। ইতি টানার ছলে গম্ভীর মুখে বইয়ের পাতা ওল্টাই। এবার তার তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি বাংলা অক্ষরের দিকে।
‘এটা বাংলা কেতাব না’ ?
‘জ্বী। পড়তে পারেন’?
‘সব ভুল গেয়ি। স্বরে অ স্বরে আ হরফগুলো থোড়া থোড়া ইয়াদ আছে। লেকিন পড়তে পারিনা। দেখি তো দ কোন হরফ। এইযে, এইটা।
জ্বী। ঠিক ধরেছেন।
এটা কিউ ইয়াদ করতে পারলাম জানো? মাষ্টার সাব বোর্ডে একটা চিড়িয়ার ছবি এঁকে একটা খেলা খেলতেন। একটু মনে আছে। উনি বলতেন, এক যে ছিল ‘দ’। ধরল তার মাথা ব্যথা। কপালে দিল মলমের ভরন। নৌকা দিয়ে আইল এক ডাক্তার। তাকে বসতে দেওয়া হল দুইটা ছিয়া। চুলে ধরে মারল টান, হয়ে গেল এক টিয়া।
আমি হেসে বলি, এটা ছোটবেলায় আমরাও করতাম।
তাই নাকি ?
মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করি, কতদূর পড়াশুনা করেছিলেন?
মোমেনসিঙ্গে ক্লাশ টু তক স্কুলে গিয়েছি। আব্বার ওফাতের পর আম্মা বাসায় কাম-কাজ শুরু করলেন। ছোটি ছোটি ভাই-বেহেন কো দেখভাল করতে গিয়ে স্কুল বাদ’।
এবার দীর্ঘশ্বাস। বইটা নেড়ে চেড়ে স্মৃতির অতল থেকে মুক্তা কুড়ানোর বৃথা কোশেশ করতে থাকেন। বলেন, ওহ্ ! আমার বাংলাভাষা। এ ভাষার জন্য খুব হাঙ্গামা হয়েছিল। দিল্মে কেতনা পিয়াস -- তোমাকে বুঝাতে পারব না, মাজ্বী। বাঙালী দেখলেই কলিজা উড়াল দেয় বাংলাদেশে। আহা, কী নরম জমিন! পায়ের বুড়ো আঙুলে খুঁড়ে বীজ লাগালেই লাউ শিম পুঁই ঝিঙ্গায় ঘরবাড়ি সবুজ রঙে উজালা। দুদিন বাদেই ফুলে ফলে সয়লাব’।
অনর্গল কথার সয়লাবে আমার দোয়া-দরূদও ভাসছে। কি যে মুশকিলে পড়া গেল। জানি, মসজিদে অনর্থক খেজুরে আলাপ করা গর্হিত কাজ। কিন্তু মায়ের বয়সী গুরুজন বলে থামিয়ে দিতেও পারছিনা। দেড়টা বাজে। হাতে আর আধ ঘন্টা । ক্ষণিকের জন্য দুনিয়াদারী গালগল্পের ঊর্ধে উঠে কিছুক্ষণ অন্তত দরূদ পাঠ করি।
অন্তরের কথাগুলো হয়ত বুঝতে পারলেন । সাথে মাথে বললেন, ‘সরি মাজ্বী, তোমাকে ডিসটার্ব করছি। কি করব বল। কত সাল হয় বাপের দেশে যাই না। বাপের দেশের একটা চিজ দেখলেই দিল্ উথাল পাথাল করে। তুমি তো বাপের দেশের বেটিয়া। আচ্ছা মাজ্বী, মোমেনশাহী তে একটা রাজবাড়ি আছে না? নাম শশীলজ। তুমি ঐ এলাকা জান’?
‘জ্বী। ওখানে এখন টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’।
শাহীনও তাই বলেছে।
শাহীন কে ?
শাহীন আমার ছোট বেটা। আগে বললাম না ?
ও হ্যাঁ, বলেছিলেন।
শাহীন একবার ক্রিকেট বোর্ডের ফিজিও হিসেবে চান্স পেল বাংলাদেশে যাওয়ার। এ্যাতনা খোশ খবর। মেরা দিল তখন চিড়িয়ার পাখনার মত ছটফট করছে। ওর সাথে আমিও যাব আমার দো ভাই রফি শফি আর দো বেহেন জরী-পরীকে দেখতে। ছোট্টি বাচ্চার ইয়াদ করতে লাগলাম, আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই -----। লেকিন শাহীন রাজি হল না।
কেন ?
থোড়া দিন আগে গলব্লাডার অপারেশন হয়েছিল বলে কমজোর ছিলাম। শাহীন বলল, ক্রিকেট খেলা শেষ হওয়া মাত্রই সে মোমেনশাহীতে গিয়ে মামার বাড়ির লোকেশান নোট করে আনবে। আত্মীয় স্বজন কারো না কারোর সাথে মোলাকাত করবে। ঠিকানা আনবে। তারপর আমার তবিয়ত ঠিক হলে নিয়ে যাবে সোজা আমার বাপের বাড়িতে।
তারপর ? বাপের বাড়ি গিয়েছেলেন ?
নাহ্। দিলে বড় সদমা নিয়ে ঘরে ফিরল শাহীন।
কি হয়েছিল? পায়নি কাউকে ? একটা করূণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বৃদ্ধা।
শাহীন বাংলাদেশে এসেই মায়ের দেওয়া ম্যাপ অনুযায়ী মামার বাড়ির লোকেশন জানতে চেয়েছিল। হোটেলে ময়মনসিংহের ঐ এলাকার এক কর্মকর্তা বললেন, সব বদলে গেছে। ছনের ঘর, টিনশেডের বাড়ি বা কদম গাছ কিছুই নেই। বড় বড় রাস্তা হয়েছে, উঁচু উঁচু বিল্ডিং হয়েছে। শুধুমাত্র সেই শশীলজই মহাকালের সাক্ষী হয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে। এরপরও ভদ্রলোক অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে জানালেন, রফি শফি বা জরী পরী নামের কেউ নেই ওখানে।
মহাকালের স্রোতে পৃথিবীর চেহারা তো কতই বদলায়। তাই মামার বাড়ির লোকেশন খুঁজে না পাবার আফসোস স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিল শাহীন । কিন্তু তার ভয়ানক কষ্ট অন্য জায়গায়। হোটেলে বাঙালী প্লেয়ারদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে কিছুটা গর্বের সাথে সরল মনে গল্প করেছিল তার না দেখা মামার বাড়ির কথা। চুয়ান্ন বা পঞ্চান্ন সালে কিভাবে একদিন কদম ফুল কুড়িয়ে ফেরার পথে শাহীনের কিশোরী আম্মাজান নজরে পড়েছিলেন এক বেলুচী সিপাহীর। কিভাবে সেই সিপাহী মসজিদের মৌলভী সাহেবকে ধরেছিলেন শাদীর ইন্তেজাম করার জন্য। দু’অঞ্চলের দুই ভাষা তরুণ দুটি প্রাণে কোন অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি সেদিন।
শাহীনের গর্ব খর্ব হতে বেশিক্ষণ লাগেনি। বাঙালী শ্রোতাদের কাছে সে একজন ঘৃণ্য পাকসেনার ছেলে। ফিসফিস আওয়াজের কয়েকটা বাক্যবাণ তার কানের পর্দা রক্তাক্ত করে দেয়। ওরা তো জানত না যে, শাহীন অল্পসল্প বাংলা বোঝে।
ঢাকা থেকে ফিরে এসে প্রচন্ড জেদ ধরে শাহীন। মাকে কিছুতেই বাংলাদেশে যেতে দেবেনা। মা সিংহীর মত গর্জে ওঠে ঃ শাহীন, আজ যা বলেছিস, খোদ তোর বাবা কক্ষনো তা বলেননি। বাংলাদেশ আজাদ হবার পর আমাকে বাপের দেশে নাইওর পাঠাতে পারেননি বলে তার কি আফসোস! ইন্তেকালের আগে আমার হাত ধরে এ আফসোসের কথা বারবার উচ্চারণ করছিলেন, আর মাফ চেয়েছিলেন। সেটা তোর ইয়াদ নেই ?
শাহীন মায়ের পায়ের কাছে বসে হাটুতে মাথা রেখে বলে, ‘আমাকে ভুল বুঝবেন না, আম্মিজান। আমার ডর তো অন্য জায়গায়। মামার দেশের কেউ যদি আপনাকে অপমান করে? আমি কি এটা সহ্য করতে পারব? দিন বদলেছে। ওদেশে আপনি এখন একটা অচল পয়সা।
অচল পয়সা মানে?
ছোটবেলায় তো বাংলা ছড়া শিখিয়েছিলেন ঃ ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই। কিন্তু বাস্তব বলছে ভিন্ন কথা। ফুলের মালা নয় কাঁটার মালা। আম্মিজান, কাঁটার মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাবার কথা আমাকে আর বলবেন না, প্লিজ। আমরা তো সেই ছোট বয়স থেকেই মেনে নিয়েছি যে, খোদা আমাদের তকদিরে মামাবাড়ির সোহাগ লিখেন নি।
কী ব্যাপার? ঢাকায় কি কেউ কিছু বলেছে ? খুলে বলবি তো।
খুলে বলল শাহীন। তারপর বলল, আম্মিজান, সেভেন্টি ওয়ানের লড়াই পাকিস্তানকে শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নয়, তামাম দুনিয়ার সামনে যে কত নিচে নামিয়েছে, জানেন? আজ কিনা আমি সেই ঘৃণ্য পাক সেনার ছেলে।
তোর বাবাকে তো ওরা চেনে না। চিনলে হয়ত ভিন্ন কথা বলত। উনি যুদ্ধে জড়িত ছিলেন না। বেলুচ রেজিমেন্টের একটা দল রাগ করে ঢাকা থেকে ফিরে এসেছিল মার্চের পহেলা ভাগে। কারণ ধর্মরক্ষার দোহাই দিয়ে তাদের পাঠানো হলেও তারা বাঙালীদের ধর্মহীনতার পরিচয় মোটেই পায়নি। ঢাকায় নেমেই মসজিদে মসজিদে আজান শুনেছে, নামাজ দেখেছে। তোর বাবা ছিলেন সেই রেজিমেন্টের বেলুচ সেনা। এ সত্যটা তাদের বলতে পারতি।
আম্মিজান, একশ জুলুমের মাঝে ঐ একখান ভাল ইনসানিয়াত কিছুই না। সাধে কি আব্বাজান অছিয়ত করে গেছেন যে, ‘ইয়ার মুহাম্মদ খানের আওলাদের মধ্যে কেউ যেন কোনদিন আর্মিতে জয়েন না করে’। শালা ইয়াহিয়া খান। কিয়ামত তক ওর সেই গোয়ার্তুমীর মাশুল দিতে হবে আমাদের আওয়ামকে। তামাম পাকিস্তানকে। ইচ্ছে করে ওর কবরে গিয়ে লাথি মারি।
মা আহত গলায় বলে, ‘শাহীন, আর শুনতে চাইনা ঐ দুঃখের কাহানী। আমাকে আমার বাংলাদেশে নিয়ে যাবার কি কোন উপায়ই নেই, বাবা ?
মাফ করবেন আম্মিজান। এটা আমি কিছুতেই সহ্য করবনা, মামার বাড়ির কেউ যদি আমার মাকে পাকসেনার বিবি বলে বেইজ্জত করে।
তিন.
মাইকে ঘোষিত হচ্ছে মহিলাদের জিয়ারতে যাবার আহ্বান। গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। ত্রস্ত পায়ে উঠে দাঁড়াই। এখনই বাচ্চাদেরকে ওদের বাবার জিম্মায় রেখে আসতে হবে। গল্পে গল্পে কত যে সময় নষ্ট হল। মাফ কর খোদা। মসজিদে নববীতে বসে দীনদারীর বদলে দুনিয়াদারীতে মশগুল হয়েছি।
আমাকে উঠতে দেখে মহিলা বললেন, ‘ক্যায়া বাত, মাজ্বী? চলে যাবে ? জিয়ারত করবেনা’ ?
ওদের নিয়ে নিশ্চিন্তে জিয়ারত করা যাবেনা, চাচী। যা দুষ্টু। দেখছেন তো। ওদের বাবার কাছে রেখে আসছি। এক নাম্বার গেটে উনি অপেক্ষা করছেন।
ঠিক হ্যায়। আমাদের গেট নাম্বার ইয়াদ রাখ। আমি এখানেই আছি। এক সাথমে জিয়ারতে যাব।
জ্বী আচ্ছা।
এক বাত শোন বেটি, আমি যে হোটেলে উঠেছি, জিয়ারতকা বাদ ঐ হোটেলে আমার সাথে যাবে। এক সাথে খানাপিনা করব। মেরি বাংলাদেশ কা গপ্স করব। কত সাল হয় তাকে দেখি না। কত সাল হয় দেখিনা আমার জরী পরী রফি শফিকে ! ওহ্, দিলের এই পেরেশোনীর কথা কাকে বলি? ও হ্যা, দামান মিয়াকে এই গরীবের জিয়াফতের কথা বল কিন্তু।
জ্বী আচ্ছা, বলব।
আচ্ছা, আরেক বাত শোন, বেটি। হাল জমানা তো মিডিয়ার জমানা। দামান মিয়া যদি পেপারে সেই চৌধ্রী বিবিসাহাবের খবর তালাশ কররার জন্য একটা এলান ছেপে দেন ---- ওহহো। উর্ধাসে দামান মিয়া ইন্তেজার করছেন। হোটেলে গিয়ে এ নিয়ে বাত চিত হবে।
অবশ্যই। আসি তাহলে।
মেরি জান ওয়াফা বাজী আওর সাকিব ভাইয়া। জলদি চল। জিয়ারত কা বাদ আমরা ব্রোষ্ট খাব, আইসক্রিম খাব, চিপস্ খাব, হা।
সত্যি বলছেন, দাদী? ঈয়ে -- এ ---এ--’।
এক নাম্বার গেটে ওদের বাবার হাতে দিয়ে এসে গোলকধাঁধায় পড়ে যাই। যাবার আগে গেটের নাম্বারটা খেয়াল করিনি। বেমালুম ভুলে গেছি কোন গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকেছিলাম। মহিলাদের জন্য নির্ধারিত গেটা তো অনেকগুলো। কোন গেটে ঢুকলে যে মহিলাকে পাব, মনেই করতে পারছি না। হাজার দর্শনার্থীর ভিড়ে তার খোঁজ করা আর খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজা সমান কথা।
খোঁজাখুঁজির ভাবনা ছেড়ে দিয়ে যে গেট.চোখের সামনে ছিল, সে গেটেই ঢুকে পড়ি। চারদিক তাকাতে তাকাতে অনেক হেঁটে মহিলার খোঁজ করি। চোখে পড়ে না। রওজাশরীফের অভ্যন্তরীণ গেটা খুলে দেওয়া হয়েছে মহিলাদের জন্য। জনস্রোত ওদিকেই। সব শেষে আমিও মিশে গেলাম। জিয়ারতের পর না হয় আরেক দফা খুঁজে নেব।
পারলৌকিক চিন্তা-চেতনার আবেশ নিয়ে কেবল সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি, অমনি মায়াবী দুনিয়ার বিমূর্ত মায়া আমাকে পেছন দিকে টেনে ধরে। যাকে বলে মহাভিলেন শয়তানের ওয়াসওয়াসা। আমার অন্তরের একনিষ্ঠ ধ্যানের ভেতর হঠাৎ আবির্ভূত হয় একটি নাম - ইয়ার মুহাম্ম্দ খান।
সিপাহী ইয়ার মুহাম্মদ খান? ছোটবেলায় আমার মার মুখে এ নাম তো কতবার শুনেছি। ঊনিশ শ বা ঊনপঞ্চাশ বা পঞ্চাশের দিকে মা তখন নূতন সংসার পেতেছেন বাবার কর্মস্থল ময়মনসিংহ শহরে। বাবা অফিসে চলে গেলে অবসরের সঙ্গী হয় কাজের মেয়ে নূরী। কাজ করে ঝটপট আর গল্প করে অনর্গল। কিভাবে বিয়ে হয়েছে, পাড়া-পড়শী তখন কি কি বলাবলি করেছে, প্রবাসী স্বামী মাসিক কতটাকা খরপোষ পাঠাচ্ছে, করাচীতে নিয়ে যাবার জন্য কেমন চেষ্টা করছে, মা কোন মতলবে যেতে দিচ্ছেনা, এসব। একদিন ফোলা ফোলা ভেজা চোখ নিয়ে অনেক দেরি করে এসে হাজির। মা জিজ্ঞেস করেন, ‘কিরে ? কী হয়েছে ? দেরি কেন’?
দেরির কারণ নূরীর হুজুর। মাঝপথে হঠাৎ দেখা। চার পাশে কেউ নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে হুজুর বললেন, ‘নূরী, এতদিন ধরে যে কথাটা বলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না আজ অল্পকথায় বলে ফেলি। তোর মাকে বলিস না যেন। দেখ নুরী, তুই আমার চোখের সামনেই বড় হয়েছিস। আমিই তোকে কোরাণ শিক্ষা দিয়েছি। তুই আমার মেয়ের মত। আজকাল তোর মা আামকে বলে তোর সাথে যেন কক্ষণো দেখা না করি।
ওমা, কন কি?
হ্যাঁ। আমি নাকি বেগানা পুরুষ। কলঙ্ক রটবে। সিপাহীর কানে গেলে নাকি তোর সংসারে ঝামেলা হবে। আসলে তার ভয়, যদি তোর কাছে সব সত্য ফাঁস করে দেই । ও নূরী, তোর বিয়ের ঘটকালী করে ভুল করলাম নাকি রে ?
নাহ।
আমি কিন্তু বড় অশান্তিতে আছিরে মা। কোরাণ পাকে ইরশাদ হয়েছে, ‘সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকো না। জেনেশুনে সত্য গোপন করনা’’। আজ যদি কয়েকটা সত্য কথা তোকে না জানাই তাহলে তো দোজখবাসী হবো রে মা।
কী কথা, হুজুর ?
জানিস তো, ইয়ার তোকে করাচীতে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তোর মা আমাকে দিয়ে হরদম চিঠি লেখায় যে তুই নাকি বাপের বাড়ি ছেড়ে অতদূর যেতে চাসনা।
এ্যাঁ ?
চমকে উঠিসনা। আরো আছে। তোর খোকার দুধ খাবার জন্য একটা গাভীর দরকার বলে বাড়তি টাকা চেয়েছে তোর মা। বেচারা ঘাসকাটার লোকের বেতন সহ গাভী কেনার টাকাও পাঠিয়েছে। কিন্তু তোর মা ঐ টাকা ঘর বানানোর কাজে লাগিয়েছে। আজ আবার আরো বেশি টাকার আরেক অজুহাত নিয়ে চিঠি লিখাতে এসেছিল।
কন কি ?
আমি সাফ বলে দিয়েছি, আর মিথ্যা চিঠি লিখে গোনাহ্গার হতে চাইনা। যাই, কেউ দেখলে তোর মার কানে লাগিয়ে দেবে। আমার শেষ কথাটা শোন, নওজোয়ান স্বামীটাকে আর কষ্ট দিসনা। গোনাহগার হবি। তোকে সে খুব ভালবাসে। ইচ্ছে করলে সে দোসরা শাদী করতে পারত। কিন্তু করেনি। সময় থাকতে যেভাবে পারিস তার কাছে চলে যা। স্বামীর হক বলে কথা। তাছাড়া তোর খোকার ভবিষ্যতের কথাও ভাবতে হবে তোকে।
নূরী কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো খুলে বলেছিল আমার মাকে। সব শুনে মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কথা বল। তুই যেতে চাস তো’?
জ্বী আফা। কিন্তুক, ক্যামনে তারে খবর দেই ?
আমি চিঠি লিখে দিই ?
এ্যাঁ? আফনে উর্দু লেখাফড়া জানৈন ?
জানি।
তাইলে দেইন না লেইখ্যা। আফনের ফায়ে ধরি।
পায়ে ধরতে হবে না। লিখে দিচ্ছি। কিন্তু ঠিকানা লাগবে তো। আচ্ছা, মানি-অর্ডারের কুপনের টুকরো যেখানে সিপাহী ছোট্ট চিঠি লিখে সে টুকরোগুলো আছে তো ?
সব আছে আফা। বড় চিঠিও আছে। বৈয়ামে যত্ন কইরা রাখছি।
ও। সিপাহীর ভালবাসা আচার বানিয়ে রেখেছিস। আচ্ছা বৈয়ামটা নিয়ে আসিস। আগে পুরো বিষয়টা বুঝতে হবে। তারপর চিঠি লিখে দেব। তুই শুধু সই করে দিবি।
দিয়াম।
পরদিন লুকিয়ে সব এনে দেখায় নূরী। কুপনের টুকরোর হরফে হরফে নূরী আর তার দেড় বছরের খোকার জন্য প্রেরকের প্রাণের আকুতি মিনতি দোল খাচ্ছে। বড় চিঠি গুলো পড়ে মা অবাক। নূরী আসবে না জেনে নিরাশ হয়ে ইয়ার খান দ্বিতীয় বিয়ের জন্য তৈরি হচ্ছিল। বাদ সাধল তার মায়ের বয়সী সৎবোন জামিলা। দু’মাস বয়সে মা মারা যাবার পর জামিলাই ইয়ারকে কোলেপিঠে মানুষ করেছে। সে বলল, ‘শোন মেরা ভাই, এক শাদীতে বেহেস্ত। বহুুশাদীতে দোজখ। বহুুশাদীতে আমাদের খান্দান কিভাবে খান খান হয়ে গেল, দেখিস না ? তাই বলছি, ছবর কর। তোর মহব্বতে জোর থাকলে নূরী আসবেই।
শেষ চিঠিতে লেখা ঃ ইন্তেজার করছি, নূরী। তুমি যেদিনই বলবে আমি সেদিনই চলে আসব।
চিঠির ভাষা শুনতে শুনতে নূরীর গোলাপী গাল বেয়ে ঝরতে থাকে শ্রাবণের অঝোর ধারা। আমার মা ওর প্রাণের আবেগ ফুটিয়ে তুললেন চিঠিতে। পোস্ট করে দিলেন বাবার অফিসের পিওনকে দিয়ে।
চিঠি পাওয়া মাত্রই চলে আসে ইয়ার। পরদিন নিয়ে যায় নূরীকে। মৌলভী সাহেব দু’রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আর নূরীর মা বস্তি কাঁপিয়ে বিলাপ করতে থাকে, ‘অতবড় দুশমনি কেডায় করল রে ? কেডায় ছিটি লেইখ্যা আমার নূরীরে খেদাইয়া দিল? নাতি লইয়া আমি সুখে থাকবাম হেইডা কারো পরাণে সইল না ? ও নাতিরে। তোরে ছাড়া কেমনে বাঁচিরে’?
বছর দুয়েক পর নূরী নিজ হাতে উর্দুতে চিঠি লিখে আমার মার কাছে। ‘‘ আমার লেখা দেখে অবাক হচ্ছেন আপা ? জামিলা বাজ্বী আমাকে লেখাপড়া শিখাচ্ছেন। উনি আমার মেয়ের নাম রেখেছেন আপনার নামেই। বুলবুল খান। তবে এ নাম ধরে কাউকেই ডাকতে দেন না। এতে নাকি আপনার প্রতি বেয়াদবী করা হয়। তাই উনি ডাক নাম রেখেছেন ‘গুড়িয়া’। এর অর্থ পুতুল। পরে আমার ইচ্ছা অনুযায়ী বাংলা শব্দ পুতুল বলেই ডাকা হচ্ছে ওকে’’।
মার গল্প করেছিলেন ওসব। আমি চমকে উঠি। সেকি ! আমার মার নামই তো বুলবুল চৌধুরী। লন্ডনে থাকেন। ওনার চেহারার সাথে আমার চেহারার অদ্ভত মিলের কথা সবাই বলে। এই বৃদ্ধাও তো বলেছিলেন। হঠাৎ আমার হাতের তসবী থেমে যায়।
মাথা থেকে সব ঝেড়েঝুড়ে রওজা শরীফের কাছে যাই। জেয়ারত করি। ফিরে আসার সময় ফিরে আসি বৃদ্ধার কথায়। চারদিকে তাকাই। হাজার হাজার মহিলা-দর্শনার্থীর স্রোতে ব্যাকুল দৃষ্টিতে খুঁজতে থাকি গোলাপী গালের বৃদ্ধার মুখ। যার মেয়ে বুলবুল খান। থাকে লন্ডনে।
অসম্ভব জেনেও বৃদ্ধার খোঁজে আমার অনুতপ্ত ব্যাকুল চোখ দ্রুত সঞ্চালিত হতে থাকে ভীড়ের মাঝে। কোথায় পাব তাকে ?
=====================
No comments:
Post a Comment
What do you think?