Saturday, March 16, 2019

আঁধারের রূপ (ছোটগল্প) Based on underworld true story

       

আঁধারের রূপ

নাজমুল চৌধুরী

 

চাকুরী নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে চলছে মাহমুদ গত দু’বছর ধরে। দারুন হতাশা নিয়ে ফিরে আসতে হয় প্রতিদিন। তবু হাল ছাড়ার পাত্র নয় সে । ভাগ্যিস, পারিবারিক চাপ নেই। একমাত্র ছোট ভাইটিও গেল বছর ম্যালেরিয়ায় পটল তুলেছে। পৈতৃক বিষয়সম্পত্তির অবশিষ্ট বলতে পৈতৃক বাড়িটিই বর্তমান। জমিজমা যা ছিল তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ডিগ্রি নিতে গিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। সকাল বিকেল ছাত্র পড়িয়ে দিনানিপাত আর হন্যে হয়ে চাকুরীর খুঁজে ঘুরপাঁক। তবু চেষ্ঠার অন্ত নেই, শত চেষ্ঠার পর হয়তো একদিন সফলতা আসবে, হৃদয়ে স্বযত্নে পুষে রাখা চেষ্ঠার নীতিকথা তাকে ভবিষ্যতের প্রেরণা যোগায়।

পত্রপত্রিকায় চাকুরীর বিজ্ঞাপন দেখে গত দু’বছরে পঞ্চাশটিরও অধিক দরখাস্ত করেছে সে। উত্তরে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান রিগ্রেট জানিয়ে উত্তর দিয়েছিল। বাকীগুলোর কোন হদিস নেই। দরখাস্তে সুপারিশ করার মত মন্ত্রী, বিধায়কও কেউ নেই তাই হয়তো তার দরখাস্ত ডাষ্টবিনেই নিক্ষিপ্ত হয়। রিগ্রেট জানিযে যে প্রতিষ্ঠানগুলো উত্তর দিয়েছিল সেগুলোর প্রতি মাহমুদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। ভদ্রতারও একটা ভাষা আছে। সবিনয়ে না করে দেওয়ার মধ্যেও ভদ্রতার ছোঁয়া মেলে।

গতকালের ”দৈনিক প্রথম আলো” পত্রিকার একটি বিজ্ঞপ্তিতে হিসাবরক্ষকের একটি পদে আগামীকাল দুপুর বারোটায় কর্তৃপক্ষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নাম নেই তবে ছোট্ট করে একটি ঠিকানা দেয়া আছে - ১১২/৪, ঢাকার ব্যস্তবহুল গুলিস্তান মোড়।

”যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পার মানিক রতন” - সংগ্রামমুখর এ জীবনের একভাগ হারিয়ে গেলেও বিশ্বাসের অতল গভীরে স্বযত্নে লালিত স্বপ্নগুলো একেবারে নিঃশ্বেষ হয়ে যায়নি। ছোটবেলার পাটিগণিত কঠিন ঠেকলেও বাবার মমতামাখানো সেই উপদেশ - চেষ্ঠা চালিয়ে যাও, সফলতা আসবেই, দেখবে কঠিনগুলো একদিন তোমার কাছে সহজ হয়ে ধরা দিবে। মাথায় হাত রেখে বাবার স্নেহপরশ সত্যিই একদিন সত্যি হল। তাই অংকে বরাবরই সে ভাল করেছিল। ভার্সিটিতে একাউন্টিংয়ে সে লেটার মার্কস্‌ পেয়েছিল।

নির্ধারিত সময়ের আগেভাগেই চাকুরীর দরখাস্ত নিয়ে হাজির হয় মাহমুদ গুলিস্তানের মোড়ে। হন্যে হয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ১১০ নং বিল্ডিং পর্যন্ত এসেই থামতে হয়। তারপরেই দুশো ফিট রাস্তার ওপারে একটি খালি মাঠ। মাঠে পড়ে আছে ইলেকট্রিক থামের পাহাড় আর কেবলস্ ভর্তি বিরাট বিরাট কাঠের চাকতি। কোথায় সেই ১১২/৪ নাম্বার অফিস ? আশেপাশে চাকুরী প্রত্যাশী অনেকের একই প্রশ্ন। ভাই ১১২/৪ নাম্বার অফিসটি কোথায় বলতে পারেন ? মাহমুদ নিজের ফাইলটি মেলে ধরে একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় প্রশ্নকারীর দিকে। প্রশ্নকারী প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে মুচকি হেসে কেটে পড়ে।

ক্লান্ত দেহখানাকে ফুটপাতের একটি বেঞ্চিতে এলিয়ে দিয়ে আনমনে বাদাম চিবুচ্ছিল মাহমুদ। রাস্তা আর ফুটপাত জুড়ে যানবাহন আর মানুষের ব্যস্ততম ছুটোছুটি। আনুমানিক বিশহাত দুরে ফুটপাতে বৃত্তাকারে শুয়ে থাকা বিকলাঙ্গ চারজন ভিখারির বিকৃত অংগভঙ্গি সমেত গানের কন্ঠস্বর - শুন মোমিন মুসলমানো, মনো দিয়া শুনো শুনো, একটি টাকা দিয়ে যাও করি নিবেদন গো, করি নি-বে-দ-ন ....।  মুসকিল আহসান হবে, হাশরেতে পার পাবে, সহজ হবে এ দুনিয়ারো কঠিন জীবন গো, এ দুনিয়ার জী-ব-ন....। ওরা যেন মনুষ্যরূপী একেকটি কঠিন পাথর। গ্রীষ্ম, বর্ষা, ঝড়, বৃষ্টি, রোগ-বালাই ওদের স্পর্শ করেনা। ঘড়ির কাঁটার মতই নিয়মতান্ত্রিক ওদের জীবনধারা।

আচমকা করস্পর্শে পিছন ফিরে তাকায় মাহমুদ। পরিষ্কার, সফেদ কাপড় পরিহিত, মুখভর্তি পাকা লম্বা দাঁড়ি, স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত, প্রায় ছ’ফুট লম্বা ফর্সা ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন - সেই সকাল থেকেই দেখছি কারোর প্রতীক্ষায় আছেন, তিনি এলেননা বুঝি ?

না, মানে... এখানে একটি অফিস খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত, কেউ বলতে পারেনা, অগত্যা বসে আছি, কি আর করব ... নিরাশার দীঘর্ঃশাস নাকের ছিদ্র পথে বেরিয়ে আসে অজান্তে।

যদি কিছু মনে না করেন পাশে একটিু বসি ? দীপ্তিময় পাকা দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক - বাড়ি কোথায় ? বাবা কি করেন ? পরিবারে কে কে আছে ? একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন।

অন্য কেউ হলে হয়তো মাহমুদ বলতো, পার্সোনাল ব্যাপারে জানতে আপনার অযাচিত আগ্রহ কেন ?  যানতো, একটু শান্তিতে থাকতে দিন ...। কিন্তু পিতৃসুলভ, স্বর্গীয় দীপ্তিময় এ মানুষটিকে এভাবে বলা যায়না। কে জানে, মনুষ্যরূপে এ ব্যক্তিটি হয়তো কোন পীর, আউলিয়া। শুনেছে প্রত্যেকটি শহরেই একজন শহরকুতুব থাকেন যারা মানুষকে বিপদে সাহায্য করেন।

মৃদু হাসিতে উত্তর দিল, না - কেউ নেই। একেবারেই একা। গেল বছর একমাত্র ছোট ভাইটি ম্যালেরিয়ায় পটল তুলে পরিবারের লোকসংখ্যা গুণার সমাপ্তি ঘটিয়েছে। এ ধরায় আমার আর কেউ রইল না। পিছটান নেই, গ্রামে পৈতৃক বাড়িটি শুধু জানান দেয় ওখানে এককালে একটি সুখী সমৃদ্ধ পরিবার ছিল। বর্তমানে পাশের বাড়ির এক আত্মীয় বাড়ি পাহারা দেন। ঢাকায় মেসে থাকি, ছাত্র পড়িয়ে পেট বাঁচাতে হয়, কবে চাকুরী ভাগ্যে জুটবে তাও জানিনা। আবারো দীর্ঘঃশাস বুক ফেটে প্রবল গতিতে বেরিয়ে এলো মাহমুদের।

ওহ্ মাই গড, আই এ্যাম ভেরী সরি ইয়ং ম্যান .... তা একশত বার নাম্বার অফিস খুঁজছেন ?

আপনি জানলেন কি করে ? পাল্টা প্রশ্ন মাহমুদের।

তা জানব না, ফাইল হাতে অনেকেই আমাকে এ প্রশ্ন করেছিল। আপনার এহেন অবস্থায় সহানুভুতিশীল হয়ে যদি সাহায্য করতে চাই তাহলে আপত্তি নেইতো ?

মাহমুদ নির্বাক। কি উত্তর আছে তার? আশার নিবু নিবু প্রদীপ অকস্মাৎ জ্বলে ওঠে ভদ্রলোকের সহমর্মিতায়। এ যুগেও এমন মানুষ আছে যারা তার মত দুখী মানুষের কষ্ট ভাগাভাগি করে নিতে চায় ! শ্রদ্ধায় বিগলিত অন্তরের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় মাহমুদের বাষ্পায়িত চোখ দু’টো । শান্ত নির্লীপ্ত ভঙ্গিতে সম্মতি জানায় মাহমুদ।

মানুষের প্রচন্ড ভিড়ে ভদ্রলোক কাকে যেন ঈশারায় ডাকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বেঁটে কালো, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, পরনে নীল হাফ সার্ট, সাদা লুঙ্গি, কাঁধে নীল ব্যাগ ঝুলানো একটি লোক কাছে এসে শুধায়, আমাকে ডাকছিলেন ফাদার ?

মাহমুদের দৃষ্টি এড়ায় না। এই লোকটিইতো আজ সকালে কাগজের ঠোঙ্গা হতে রাস্তায় পড়ে থাকা ভিখারি আঁতুড়দেরকে দু’টো করে সিঙ্গারা দিয়েছিল আর ওদের সমবেত সুর হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল আলুমিশ্রিত গরম সিঙ্গারার মৌ মৌ গন্ধে।

হ্যাঁ, মজিদ... এই ভদ্রলোককে ১১২ নাম্বার অফিসে নিয়ে যাও, উনি তাই খুঁজছেন। এবার মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বলেন, যান, ওর সাথে যান। ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে। চাকুরীতো আপনার চাই,তাই না ?

আগন্তুককে অনুসরণ করতে গিয়ে মূহুর্তে দৃষ্টি ফেরায় মাহমুদ ভদ্রলোকের দিকে কৃতজ্ঞ চিত্তে। বেঁটে লোকটি ভদ্রলোককে ফাদার বলে অভিহিত করল, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি খ্রিস্টান মিশনারী হবেন। মিশনারীরা নাকি খুবই দয়ালু। তাঁর সাথে যারা কাজ করে তারাও দয়ালু হবে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?

ভাবতে ভাবতে বিনা বাক্যব্যয়ে মজিদ নামক বেঁটে লোকটিকে অনুসরণ করে মাহমুদ। রাস্তা ক্রস করে বিদ্যুতের থাম পরিবেষ্টিত মাঠটি অতিক্রম করে বেশ ভেতরে একে বেঁকে সরু গলিপথে একটি পানের দোকানের সামনে তাকে নিয়ে হাজির হয় লোকটি। দোকানিকে বলে - নরেশ, নরেশ্যারে..। সুন্দর কইর‌্যা দু’টো পান বানিয়ে দেতো ?

ঠিক আছে গুরু, ওনাকে কি ধরণের দেবো ?

ওনাকে শুভঙ্কর আর আমাকে মনতোষ, বুঝলি ? স্যারকে একটু ভালা কইর‌্যা দিস যেন।

না, আমার পানের অভ্যাস নেই, আপনি খান, আমাকে শুধু অফিসটা দেখিয়ে দিলে চলবে সবিনয়ে বলে মাহমুদ।

কি যে বলেন স্যার ! পান যে খাননা তা মুখ দেখ্যাই টের পাইছি, কিন্তু নরেশ্যার হাতে বানানো শুভঙ্কর পানটি জীবনে একটিবার খাইয়্যা দেহেন, হারা জীবন মনে থাইকবো। ভুলতি পারবিন না। বিজ্ঞের হাসিতে নিকষ কালো দাঁত বের করে হাসে লোকটি।

মাহমুদের হাসি পাচ্ছিল পানের বহুমাত্রিক নাম শুনে। শুভঙ্কর, মনতোষ, চমনবাহার আরও কত কি ? মজিদ নামক লোকটিকে এ মূহুর্তে বিগড়াতে চায়না সে। অনিচ্ছায় পানটি নরেশের হাত থেকে নিয়ে মুখে পুরে। একটু চিবুতেই মুখে ঘ্রানের আমেজ ছড়িয়ে পানটি অবশেষে মগজে ভর করে। চোখ দু’টো যেন ক্রমে লাল হয়ে আসছে, মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। সামনের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। এলোমেলো হাঁটার ভঙ্গি দেখে মজিদ বলে - আমাকে ধরেন স্যার, পইড়্যা যাবেন যে। মনে লয় জর্দা একটু বেশীই দিছে, তাই মগজে একটু ভর করছে আর কি ? একটু পরেই ঠিক অইয়্যা যাইবো, খাড়া থাকবার চেষ্ঠা করেন স্যার।

না, হাঁটতে পারব। ধরা লাগবেনা। মুখে বললেও মাহমুদ এ মূহুর্তে সত্যিই অসহায়। চোখে শর্ষে ফুল। কি দরকার ছিল পান খাওয়ার। ধন্যবাদ জানিয়ে মজিদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারতো সে।নিজের দূর্বলতাকে প্রশ্রয় দিতে চায়না মজিদের কাছে এ মূহুর্তে, তবু অনিচ্ছায় সে হাত বাড়িয়ে দেয়।

সব তালগোল পাকিয়ে গেছে মাহমুদের। এঁকেবেঁকে সরু গলির রাস্তাগুলো ঠিক মনে পড়ছেনা তার। সামনেই তিনতলা সাতফুট প্রাচীরবেষ্টিত এক ভবন। মুছওয়ালা প্রহরী মজিদের অংগুলী হেলনে লোহার গেটটি খুলে দেয় অতি সন্তর্পণে।

ঘাবড়াবেন না স্যার। এই একটু গাইট লাগছে, পানি খাইলেই সাইর‌্যা যাইব।

মজিদের হাতধরা অবস্থায় লিফটে চড়ে তিনতলায় পৌঁছলো ওরা দু’জন।  মাহমুদের মনে হল সে নিচের দিকে নামছে। চোখ বুঝে আসছে অসারতায়। লিফট থেকে নামতেই খোলা বারান্দা, অন্ধকারে ঢাকা।

অন্ধকারে ভয় পাইতাছেন স্যার ? লোকজনতো এহানে থাহেনা, এর লাগি আইন্ধ্যার। দাঁড়ান, এহনই বাত্তি জ্বালামু, আইন্ধ্যার দুর অইয়া যাইব।

বারান্দা পেরিয়ে সোফাশোভিত একটি কক্ষের ভেতর মাহমুদকে নিয়ে প্রবেশ করে মজিদ। কার্পেটে মোড়া ঘরটি পরিপাটি করে সাজানো।

এহানে বইয়্যা থাহেন স্যার। ফাদার আইলে আপনারে তলব করবো। আমার কাম শেষ। এহন আসি স্যার।

মাহমুদের মাথা তখনো ঘুরছে। চোখের সামনে একটি লাইট হাজারো লাইট হয়ে জ্বলছে। মাইক্রোফোনের আকস্মিক আওয়াজে চমকে উঠে মাহমুদ। ভারিক্কি গলায় কে যেন বলল, বারান্দার ডান দিকে সোজা এগিয়ে আসুন ওয়ালে ফিট করা লাল বাতিটির নিচে। দরজা ফাঁক হলে ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ঢুকে পড়বেন। মাহমুদের বুঝতে অসুবিধা হয়না এ বাড়িতে সিসি টিভি ক্যামেরার মাধ্যমে তার গতিবিধি কেউ লক্ষ করছে।

চোখ রগরাতে রগরাতে অদৃশ্য নিদের্শে এগিযে গেল সে শরীরে প্রচন্ড শক্তি সঞ্চারিত করে। লাল বিন্দুর মত বাতিটির নিচে দাঁড়াতেই কৃত্রিম দেয়ালটি সরে গেল একপাশে। তড়িৎ বেগে ওপাশে যেতেই সামনে পড়লো পিঞ্জরাবদ্ধ এক ময়না। ডানা ঝাপটিয়ে ঘাড় কাত করে দু’কান ফুলিয়ে বলল, যীশুর কৃপায় আপনার মঙ্গল হোক। সামনে বাড়েন, ফাদার সায়মন আপনার অপেক্ষায়।

একটি পাখি এত সুন্দর করে বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে পারে তা শুনে মাহমুদের বিস্ময়ের ঘোর কাটেনা। করিডোর পেরোতেই চোখে পড়ে ফাদার সায়মনের নাম ফলকে লিখা দরজা। আস্তে টোকা দেয় মাহমুদ। উত্তর আসে - ভেতরে আসুন।

বিশমিনিট পূর্বে যার সাথে দেখা হয়েছিল ফুটপাতে, স্বর্গীয় চেহারার সেই লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা আশ্বস্থ হয় মাহমুদ।ভরসা আর নির্ভরতার পরম এ সন্ধিক্ষণে মাহমুদের দেহমন প্রশান্তির এক অনাবিল আনন্দে আপ্লুত হয়। তাহলে ফাদার অন্য কোন গুপ্তপথ দিয়ে তার আগেই এসে পড়েছেন। মনের ভাব গোপন করে অনুমতি নিয়ে ফাদারের সামনে বসতে বসতে বলে, আমাকে কি কিছু বলার জন্য ডেকেছেন ফাদার ?

এত অস্থির হবেন না। তাড়াহুড়া আমি একদম পছন্দ করিনা। দেখুন, এ প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর কিছু কঠিন শর্ত আছে। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এ শর্তগুলো মেনে চলতে হয়, এখানে সবাই তা অক্ষরে অক্ষরে মানে। আপনার পিছটান নেই, এ ধরণের লোকই আমার পছন্দ। এই নিন চাকুরীর শর্তাবলী, মনঃপুত হলে সই করে আজই জয়েন করতে পারেন।

প্রতিষ্ঠানের গোপনীয়তা রক্ষা, অনধিকার চর্চা না করা, চলতি বছরে ছুটি না নেয়া, বর্তিত কাজের বাইরে আগ্রহ প্রকাশ না করা, সঠিক হিসাব রাখা, দেশের বিভিন্ন সেইলস্ সেন্টার হতে আগত টাকাপয়সা প্রতিদিন সকালে লোক মারফত ব্যংকে জমা দেয়া, বন্ধুবান্ধবকে অফিসের ঠিকানা না দেয়া বা কাউকে অফিসে না ডাকা ইত্যাদি। চাকুরীর সুবিধাদির মধ্যে রয়েছে, প্রথম বছরে মাসিক বেতন দশ হাজার টাকা, দু’মাসের বেতনের সমান বার্ষিক বোনাস, খাওয়া, থাকা, চিকিৎসা ফ্রি।

দশ হাজার ! বোনাস ! থাকা খাওয়া ফ্রি ! এত সুবিধা ? অবিশ্বাস্য ! মেঘ না চাইতেই জল ! দেখতে ভুল হয়নিতো ?  বুকের আবেগ যেন হুমড়ি খেয়ে বেরিয়ে এসে বাকরুদ্ধ করে দেয় মাহমুদকে। দু’বছর বেকারত্বের জ্বালা তার চেয়ে ভাল কে বুঝবে ? শর্তগুলো এমন কি কঠিন ? সব শর্তই তার রুচির সাথে যেন হুবহু মিলে গেছে।

কি রাজি ? পারবেনতো ?

আশা করি সামলে নিতে পারবো ফাদার সায়মন। আপনার সুদৃষ্টি থাকলে অবশ্যই পারবো - কথায় জোর দিয়ে বলে মাহমুদ।

আমার নাম জানলেন কি করে ? মজিদ বলেছে ? লোকটি বিশ্বস্ত। ওর মত আরও আছে, তাদের নাম শৈলেন, মিথুন ও টমাস। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। এরা আমার সাথে আছে অনেক বছর ধরে। ওরা প্রত্যেকে এলাকা প্রধান, এ প্রতিষ্ঠানের হাজারো কর্মীকে ওরাই কন্ট্রোল করে। সময় সময় ওরা নিজে এসে সেইল সেন্টারের সমুদয় টাকাপয়সা ব্যংকে জমার নিমিত্তে আপনার কাছে দিয়ে যাবে।

আপনার পবিত্র নাম শুধু মজিদ মিয়াই বলেনি, পোষা ময়না পাখিটিও কিন্তু আপনার নাম সুন্দর করে বলতে পারে।

হ্যাঁ, পাখিটি আমার খুব শখের। যা শুনে অনর্গল বলতে পারে। দারুণ স্মৃতিশক্তি। এক গরীব লোকের মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম ঘটা করে। কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে সে দান করেছিল পোষা এই পাখিটি। বাচ্চাদের মত আগ্রহ নিয়ে পাখিটি শিখতে চায় এবং শিখেছেও অনেক। আমাকে তার ভীষণ পছন্দ। যা বলি সহজেই তা রপ্ত করে। যাকগে, আপনি তাহলে রাজি ?

কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত মাহমুদ কোন কথা না বলে খচ খচ করে দস্তখত করে ফাদারের দিকে এগিয়ে দেয় শর্তের কাগজটি। তবে আমার একটি শর্ত আছে ফাদার। পিতামাতাকে বাল্যকালে হারিয়ে অনাথ হয়েছি। আপনার স্নেহধন্য ও একান্ত বিশ্বস্ত হয়ে থাকতে চাই যতদিন আপনি আমাকে আপনার কাছে রাখেন। আর আমাকে তুমি বলে সম্মোধন করবেন, নাম ধরে ডাকবেন, প্রয়োজনে আদেশ উপদেশ দিবেন ঠিক আমার জন্মদাতা পিতার মত।

কলিংবেল বাজতেই মজিদ গালভর্তি পান চিবুতে চিবুতে ফাদারের সামনে এসে দাঁড়ায়।

কি রে মজিদ, ওকে পান খাইয়েছিস নাকি ? চোখমুখের অবস্থাতো একেবারে খারাপ করে দিয়েছিস।

অভ্যেস নেই, শুধুমাত্র ওনার অনুরোধ রাখতে গিয়ে বেহাল দশা, মুখ নিচু করে সলাজ কন্ঠে বলে মাহমুদ।

ঠিক আছে। এখন খানিকটা রেস্ট নাও। তোমার রুম হয়তো এরই মধ্যে মজিদ রেডি করে রেখেছে।

আমারতো নিজের বলতে কেউ নেই ফাদার। মেসের বন্ধুবান্ধবরা বাসায় না ফিরলে চিন্তা করবে, এই যা....।

ঠিক আছে, খাওয়াদাওয়ার পর মজিদ তোমার মেসের ঠিকানানুযায়ী খবর পৌঁছাবে। তোমাকে যেতে হবেনা। এখন উঠি। যীশু সকলের মঙ্গল করুন। এক স্বর্গীয় সুষমা ছড়িয়ে ফাদার নিষ্ক্রান্ত হলেন।

মজিদ বলে উঠে, বুঝলেন স্যার, ফাদার খুউব ভালা মানুষ। দয়ার সাগর। হিন্দু জমিদার ছিলেন, ত্রিশবছর আগে খ্রিস্টান অইছেন, এখন পাদ্রী। ওনার কথা অইলো, কথা বেশী না বইল্যা, কাজ বেশী করবা। আমার খুউব ভয় করে, এমনিতে ভালা কিন্তু রাইগ্যা গেলে আর রক্ষা নাই। এক্কেবারে আগুনের লুক্কা। পিস্তলের বাটে উনার আংগুল নিসপিস করে। আমারে কইন, মজিদ সকালে ঘুম তনে উইঠ্যা কয়েকজন আঁতুড় দেইখ্যা খাওন দিয়া কাজে লাগবা, দেখবা তোমার হারাদিন ভালা যাইব। আঁতুড় মাইনসের মাঝে নাকি গড লুকায়্যা আছইন। উনার গুণের কথা আর কত কইমু ...। ঠিক আছে স্যার, চলেন আপনার রুমে। আমার আবার অন্যহানে যাইতে অইবো। 

ফাদার সায়মন ও মজিদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয় মাহমুদের। জীবনে কত আঁতুড় মিসকিন দেখেছে সে। ঘরের দোরগোড়া থেকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে বিরক্ত হয়ে। নিজেকে বড়ই অপরাধী ও ছোট মনে হয়।

সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো পাশের অফিসরুমে ঢুকে মজিদ ডাকে, কইরে পরেশ,পরেশ্যারে, কই গেলে ?  একটু ঝাড়মুছ দে। বুঝলেন স্যার, এইটা আপনার অফিস।

উর্দিপরা শৈলেন তৎক্ষণাৎ ঘরে ঢুকে। ঠিক আছে মজিদ ভাই। তুমি তোমার কাজে যাও। ফাদার ওনার সম্পর্কে আমাকে বলে গেছেন, স্যারেরে আমি সামলামু।

এবার মাহমুদের দিকে চেয়ে মজিদ বলে, আমি নিজে আপনার মেসে গিয়া খবরটা দিমু, শুধু একটা চিঠি আর ঠিকানাটা লেইখ্যা দেইন স্যার। আর শৈলেন, তুই স্যারের থাকার ঘরটা দেখাইয়্যা দিস, পরেশরে বলবি খাওন দিতে। ফাদারের মত তর্জনী আংগুল তুলে বলে, কথা কম - কাজ বেশী, বুঝছিস ?

এখানের মানুষগুলো এত ভালো কেন ?

কি যে বলেন স্যার। ফাদারের সাথে থাকলে মাটিও সোনা অইয়্যা যায়, আর আমরাতো মানুষ।

শর্তের কথা মনে হওয়াতে মাহমুদ চুপসে যায়। ওদের সাথে এত কথাই বা কেন ? নিরবে অফিসকক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখে। এই ভাল। বাইরের কোলাহল নেই, আপন ভূবন। মনে পড়ে বাবার সেই উপদেশ - চেষ্ঠা করে যাও, কঠিন জিনিষ সহজ হয়ে ধরা দেবে তোমার হাতের মুঠোয়। বাবা বেঁচে থাকলে বলতে পারত, তোমার কথাই ঠিক বাবা। দু’বছর ধরে ক্রমাগত চেষ্ঠা করেছি বলে আজকের প্রাপ্তি আমাকে পূর্ণ করেছে।

জীবনটা কত বিচিত্র। কখন কি আকস্মিকভাবে ঘটে যায় তা কেউ বলতে পারেনা। খাওয়ার পালা শেষে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মাহমুদ। একরাশ ক্লান্তির পরে নিদ্রা ভর করে চোখের পরতে পরতে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গে মাহমুদের অনেক দেরীতে। ফাদার সায়মন কি তাকে অনেক বেলা করে উঠতে দেখে গেছেন ? বাথরুম সেরে তড়িগড়ি করে আফিসকক্ষে ঢুকে অফিস বয় পরেশকে তার টেবিলে কয়েকটি নীল কাপড়ের ব্যাগ সাজিয়ে রাখতে দেখে। প্রতিটি ব্যাগে লিখা আছে সেইলস্ সেন্টারগুলোর নাম। পেপারওয়েট দিয়ে ঢাকা একটি কাগজে লিখা আছে হিসাবনিকাশ শেষ করে দুপুরের আগেই ব্যংকে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করবে।

বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। ত্রস্থ হাতে প্রতিটি ব্যাগে রাখা অগুণতি কাঁচা পয়সা, পাঁচ ও দশটাকার নোট গুণে প্রতিটি সেন্টারের বিপরীতে ক্যাশবুকে জমা দেয় সে।

দুপুর বারোটার দিকে মজিদ অফিসকক্ষে ঢুকে জানতে চায়, স্যার টাকা গুণা অইছে ? ব্যাংকে যাইতে অইব এহনি, দেরী অইলে জমা নেয়না।

হ্যাঁ, শেষ - এক্ষুণি নিয়ে যেতে পারেন।

বিশহাজার সাতশত পঞ্চাশ টাকা বিশ পয়সার ব্যংক স্লিপ মজিদকে সমজিয়ে অন্যান্য কাজে মগ্ন হয় মাহমুদ। ফাদারের কাছে তাকে প্রমাণ করতে হবে তাকে রিক্রুট করে ফাদার ঠকেননি। হিসাবরক্ষণের সকল আধূনিক ও সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করে উপস্থাপন করবে ফাদারের কাছে। প্রতিদিন ক্যাশবুক দেখে জানার পরিবর্তে ফাদারের কম্পিউটার স্ক্রীনে প্রতিটি সেইলস্ সেন্টারের হিসাব যাতে প্রতিদিন মূর্ত হয়ে উঠে তারজন্য সে বিভিন্ন আধূনিক সফটওয়ার সংযোজন করার প্রস্তাবও দিবে। হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে তার জানা আছে কোন্ সফওয়ারটি এ প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য।

কাজ অনেক। তবু কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চায় মাহমুদ কোলাহলমুক্ত এমন শান্ত পরিবেশে। প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে ব্যবসা হয় রমরমা। মজিদ, মিথুন, শৈলেন অসংখ্য টাকার ব্যাগ নিয়ে এসে জমা দেয় প্রতিদিন মাহমুদের কাছে। পানের রস গিলে মজিদ বলে টেহা গুইন্যা শেষ করতে পারবেন না স্যার উৎসবের দিনগুলোতে - যেদিগে চাইবেন খালি টেহা আর টেহা। ফাদারের মনও খুইব ভালা থাহে। হেই দিনগুলোতে পাঁচতারা হোটেলে ফাদার আমাদের মজার মজার খাওনের ব্যবস্থা করেন।

ফাদারের অনুমোদন নিয়ে ইতোমধ্যে মজিদকে দিয়ে বিভিন্ন কম্পিউটার সফটওয়ার আনিয়েছে মাহমুদ। সহজ উপায়ে সকল হিসাব-নিকাশ কম্পিউটার বটম টিপে ফাদার কিভাবে পেতে পারেন তার সব কলা-কৌশল দেখাচ্ছিল মাহমুদ। ফাদারের শান্ত সৌম্য মুখের অবয়বে খুশীর রেখা কখনো কখনো প্রতিভাত হয়েছে বটে কিন্ত উচ্ছ্বাস কিংবা আবেগে উচ্চশিত প্রশংসা করেননি। সন্তুষ্টিসূচক নিরব প্রশংসা তাকে আপ্লুত করেছে সত্য তবে যতটা সে আশা করেছিল ঠিক ততটা নয়।

মানুষটির গম্ভীর মুখের অবয়ব নিয়ে যখন চূলচেরা বিশ্লেষণ করছিল মাহমুদ ঠিক তখনই উৎকন্ঠিত মজিদ সাত আট বছরের একটি অন্ধ ছেলেকে পাঁজাকোলা করে ফাদারের সামনে হাজির হয়। দরদমাখানো কন্ঠে বলে - অন্ধ, দু’টো চক্ষুই নেই, এই হতভাগাকে কোথায় পাঠামু ফাদার ?

পবিত্র দু’ঠোটে চুক চুক শব্দ করে ফাদার জানতে চাইলেন, কোন্ কেন্দ্রে ছেলেটির অপারেশন হয়েছে ?

হাটকোলা রোডের কালিমন্দিরের পাশের অপারেশন কেন্দ্রে ফাদার। শৈলেনের সাথে কালি ডোমও সাথে ছেলো।

ঠিক আছে, সুস্থ হলে ওকে কেরানীগঞ্জে পাঠিয়ে দিও সজীবের জিম্মায়। তুমি নজরদারীতে রাখবে যাতে ছেলেটি সুস্থ হলে ঠিক জায়গায় কাজ পায়। বুঝলে, কোন ভুল করনা। ছেলেটির গালে গড়িয়ে পড়া ফ্যাকাশে শুষ্ক রক্ত কণিকার দিকে চেয়ে ফাদার চোখ বুঝে বললেন, ওহ যীশু তোমার মঙ্গল হোক, ছেলেটিকে শীঘ্র সুস্থ করে দাও। এক পবিত্র স্বর্গীয় দ্যুতি চোখেমুখে যেন ঠিকরে পড়ছে। মজিদ কি যেন বলতে যাচ্ছিল, ফাদার ধমকের সুরে বললেন, আবার কি বলতে চাও, যা বলছি তাই কর, কথা নয় - কাজ বেশী, এখন যেতে পার।

মাহমুদ চোখ ফেরায় মজিদের কোলে লেপটে থাকা অন্ধ শিশুটির দিকে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে শিশুটি। দু’টো চোখের পাতা গর্ত হয়ে একইঞ্চির মত নিচে নেমে গেছে। নিশ্চয়ই ঠিকানাবিহীন পথশিশু। খেলা নিয়ে সৃষ্ট গোলমালের সূত্র ধরে একপর্যায়ে দুষ্ট সাথীরা হয়তো তাকে প্রবল আঘাতে চোখ দু’টো নষ্ট করে রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়েছে। কি ভয়ংকর এ শিশুগুলো। মাহমুদ শিউরে উঠে এদের পরিণাম ভেবে। এ ধরণের পথশিশুদেরকে কে নিয়ে আসবে আলোর পথে ? হ্যাঁ, ফাদারের মত স্বল্পসংখ্যক মানুষেরাই পারে এদেরকে সুশিক্ষিত করে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনতে।

ফাদারকে পীর দরবেশ মনে হয় মাহমুদের। প্রবল শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে মাহমুদের শির। নত হয়ে ফাদারের পা ছুঁয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, যতটুকু আপনাকে জানি, তারচেয়ে বেশী মহান আপনি। আমার কেউ নেই এ পৃথিবীতে, বাকী জীবনটা আপনার সান্যিধ্যে থেকে যেন দুঃস্থের সেবা করে যেতে পারি ফাদার।

উঠো, যীশু তোমার মঙ্গল করুন। সিলেট ও চট্টগ্রামের সেইলস্ সেন্টারের কর্মচারীদের জুলাই মাসের বেতন পাঠিয়ে দিয়েছ ?

জ্বী, ফাদার।

তা ভাল। ওরা নিষ্ঠাবান। ওদের সুনিপুণ দক্ষতায় আমাদের প্রতিষ্ঠান চলে। ওদের প্রাপ্য সময়মত দেওয়াই উত্তম। অচিরেই সিলেট ও চট্টগ্রামের পীর-আউলিয়াদের মাজার, কালিমন্দির, রাউজানের বৌদ্ধবিহার এবং রাঙ্গামাটির খ্রিস্টান মিশনে যাব ভেবেছি। এসব জায়গায় গেলে মন পবিত্র হয়। আধ্যাত্মিক জগতের সাথে নিজের মন-মানসিকতার এক সেতুবন্ধন রচিত হয়।

মাহমুদের আজ এক বছর পূর্ণ হল। ফাদার তার কাজে খুশী আছেন বলে মনে হয় কারণ গত এক বছরে ফাদারের কাছ থেকে কোন ধমক কিংবা অসৌজন্যমূলক আচরণ পায়নি। চুক্তি মোতাবেক গভীর আত্মপ্রত্যয়, মেধা ও বিশ্বস্ততার কথা মাথায় রেখে কাজ করেছে সে। ফাদারের অনুমোদনক্রমে তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে বই পড়ে অবসর সময়গুলো অতিবাহিত করে জ্ঞানভান্ডার পরিপক্ষ করার যথেষ্ট সুযোগও পেয়েছে।

মেসের বন্ধবান্ধবের সাথে দেখা হয়নি গত একবছর। ওরা কি করছে, কেমন আছে কে জানে ? বাইরের জগতের সাথে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন সে। অফিসের ব্যস্ততার ফাঁকে কেমন করে কেটে গেল একটি বছর টেরও পায়নি মাহমুদ। কত দ্রুত সময়ের গতি। বর্ষপূর্তিতে মেসের বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা করে এলে কেমন হয় ? চুক্তি মোতাবেক বছরান্তে একসপ্তাহ ছুটি পাওনা আছে তার। ফাদারের অনুমতি নিয়ে কালই যাবে সে।

অনুমতি নিতে এলে ফাদার চুক্তির কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন, সাথে একগাদা উপদেশ। আমি ট্যুরে যাব, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে - সোনাখচিত চশমার ফ্রেমের ফাঁকে ফাদারের শান্ত চাহনির মধ্যে মুখায়বে ফুটে ওঠে কঠিন নির্দেশ।

মজিদের সাথে অফিস ভবনে আসার প্রথম দিনটির কথা মনে পড়ে মাহমুদের। পান খাইয়েছিল মজিদ নরেশের পানের দোকানে। শুভঙ্কর নামের পানটি তার মগজে ভয়ংকর এক ঝড় তুলেছিল। অলিগলি পেরিয়ে বিশমিনিট হেঁটে মাতালের মত টলতে টলতে প্রবেশ করেছিল অফিস আঙ্গিনায়। আজ পুনরায় মজিদের সহায়তায় বেরিয়ে পড়ে সে মহাখালীর বন্ধুদের আস্তানায়। মজিদ তাকে পৌঁছে দেবে গলিপথ পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ পর্যন্ত। তারপর সে একাই একটি ট্যাক্সি ধরে চলে যাবে মহাখালীর মেসের উদ্দেশ্যে।

মেসে ঢুকতেই পুরানো বন্ধুদের তিনজনকেই পেল। তিনজনের মধ্যে দু’জনেরই ছোটখাটো চাকুরী হয়েছে। মাহমুদকে পেয়ে পুরানো সব গল্পে মেতে ওঠে সবাই।

কি-রে এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলি ? তোর মত নেমকহারাম আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। সেই কবে বছরখানেক আগে একটি লোক এসে তোর চাকুরীতে জয়েন করার কথা জানিয়ে গেল কিন্তু কোথায় তা বলে গেলনা। জানলে আমরা নাহয় গিয়ে দেখে আসতাম। অন্ততঃ একটি চিঠি লিখে জানাতে পারতি কেমন আছিস, কোথায় আছিস ?

প্রথমে এর জন্য তোদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, দম ফেলার অবসর ছিলনা। চাকুরীস্থল ঢাকার বাইরে থাকায় ঢাকার সাথে সম্পর্ক একরকম বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারপর চিঠি লিখব, পোষ্টঅফিস কাছে না থাকায় তারও উপায় ছিলনা।

ঢাকার বাইরে হতে পারে কিন্তু সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপারে নয়তো ? কত আর জোড়া লাগাবি শালা। সোজা বললেইতো হয় চাকুরীও করছি, কলিগ মেয়েটির সাথে প্রেমেও হাবুডুবু খাচ্ছি - মুস্তাকের কথায় সবার মুখে হাসির জোয়ার।

চাকুরী যে ভাল বাগিয়েছিস তা তোর কাপড়চোপড় আর পকেটে বেনসনের প্যাকেট দেখেই বুঝতে পারছি - ফোড়ন কাটে খোকন।

তুইতো শালা সিগারেট ছাড়া আর কিছুই দেখিস না। তাইতো আসার পথে তোদের জন্য নিয়ে এলাম। আমিতো ছেড়ে দিয়েছি সেই কবে। নে, যত ইচ্ছা টান, দেখি আজ কত টানতে পারিস, দরকার হলে আর এক প্যাকেট আনিয়ে দেব। বেনসনের প্যাকেটটি ছুড়ে দেয় মাহমুদ খোকনের দিকে। বেনসনের প্যাকেট হতে তিনবন্ধু তিনটি সিগারেট ধরায়, সুখটান দেয়, রিং বানিয়ে একে অপরের দিকে ধোঁয়া ছাড়ে পরম তৃপ্তিতে।

এখন বল এখন তোকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করব। মেসের খাওয়া কি আর তোর পছন্দ হবে ? কি নাদুস নুদুস চেহারা বানিয়েছিস শালা। গালটা হয়েছে ঠিক যেন ডালিমের মত - গালে মৃদু টিপ দেয় শাহেদ।

তামাম পৃথিবী পরিবর্তন হলেও তোর হাত চালানোর অভ্যাসটা পরিবর্তন যে হবেনা তা হলফ করে বলতে পারি। একটা কিল লাগাবো পিঠে বলে দিলাম। যাক, অনেকদিন হল তোদের সাথে খাইনি। মহাখালীর চাইনিজ ড্রাগন আজ তোদের জন্য অপেক্ষা করছে, দেখি কত বিল তুলতে পারিস ? পেট চুক্তি,বুঝলি ? অতএব আর দেরী নয়, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে... সামান্য নাস্তা খেয়ে খালি পেটে আর কত জমবে ? আমার বসের কথা, কথা নয় কাজ বেশী...।

সত্যি বলছিস নাকি ? চাইনিজে গিয়ে খাইয়ে দাইয়ে বিল না দিয়ে যদি বিড়ালের মত পালিয়ে যাস তাহলে আমাদের কি হবে ? তখন কিন্তু আমাদের তিনজনের শরীরের চামড়া বেঁচতে হবে তা বলে রাখলাম। মুস্তাকের কথায় সবাই একসাথে হেসে ওঠে।

বললামতো পকেট ভারি। একদিনের জন্য তোদের কাছে এসেছি। পেট ভরে খাবি, যত ইচ্ছা তত। বিড়ালের মত পালিয়ে যাব কেনরে.. ? বাঘের মত গর্জন করে বিলটা পরিশোধ করব তা দেখে নিস - মাহামুদের কথায় আবারো হাসির ঢেউ।

চাইনিজ ড্রাগনে চার বন্ধুতে মিলে খাওয়ার পালা চুকিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় সবাই।

যা খেয়েছি শালা, তিনদিন মেসের চূলো বন্ধ রাখতে হবে। পেটে হাত দিয়ে বড় বড় ঢেকুর তুলে শাহেদ।

এবারে তোদের কাছ থেকে বিদেয় নিতে হবে। ভাবছি যখন দু’দিনের ছুটি পেয়েছি পৈতৃক বাড়িটাও একবার দেখে আসি। একবছর আগে ফরিদ চাচা বলেছিলেন বাড়ির কিছু জরুরী কাজ করাতে হবে।

বন্ধুদের কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে মাহমুদ এগিয়ে যায় মহাখালী বাসষ্টেন্ডের দিকে। পৈতৃক বাড়ি ঢাকার সন্নিকটে কেরানীগঞ্জের শিবপুর গ্রামে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। পূবআকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘের ছড়াছড়ি।

’পথের সাথী’ বাসে চেপে বসে মাহমুদ । রাস্তায় ট্রাফিক জামের কারণে একঘন্টার পথ পেরোতে তিনঘন্টা লেগে যায়। কেরানীগঞ্জ বাজার হতে শিবপুর গ্রামের তার পৈতৃক বাড়ি পায়ে হেঁটে আধঘন্টার পথ। আকাশের অবস্থাও ভাল নয়, কখন আঝর ধারায় বৃষ্টি নামে তার ঠিক নেই। ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টির ফোটা আর মেঘের গর্জনে আকাশটা ভারী। দেরী না করে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে যায় মাহমুদ কালিমন্দিরের পাশ ঘেষে। রাস্তার বিদ্যুৎবাতি নিবে গেছে। মোমবাতি আর লন্টন জ্বলে ওঠে মন্দির বারান্দায়। ভক্তদের বন্দনা সঙ্গীত তখনো চলছে .... হরে কৃষ্ণ ... হবে রামো .... কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে .....।

মাহমুদ এগিয়ে যাচ্ছে সরু রাস্তা ধরে। মেঘের ভয়ংকর গর্জনে আকাশ যেন ভেঙ্গে পড়বে এক্ষুণি মাহমুদের মাথায়। হঠাৎ বিস্মিত হয় মাহমুদের চোখদু’টো, একি দেখছে সে..। স্বপ্ন নয়তো ? লাইটপোষ্টের নিচে মোমবাতির মৃদৃ আলোয় একটি অন্ধ বালক বসে আছে, একটি লোক সামনে পড়ে থাকা টাকা পয়সা নীল ব্যাগে ভরছে। মৃদু আলোয় লোকটিকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে আর চোখ গর্ত হয়ে যাওয়া বালকটিকে সে দেখেছিল যেন কোথায় ? স্মৃতির অতল গহ্বরে মাহমুদ মূহুর্তে হারিয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক মনে পড়ছে। অন্ধ ছেলেটিকে মজিদের কোলে পাঁজাকোলা অবস্থায় ফাদারের সামনে দেখেছিল সে। তড়িৎ গতিতে লোকটির কাছে গিয়ে সার্টের কলার টেনে দাঁড় করায় মাহমুদ।

স্যার আপনে...?

হ্যাঁ, আমি। কিছু লুকাতে চেষ্ঠা করিস না শয়তান। তোদের লিডারের কাছে নিয়ে চল্ আমাকে এক্ষুণি। শেষ বুঝাপড়া করতে হবে ঐ শয়তানটার সাথে।

লোকটির ডান হাত দ্রুত চলে যায় কোমরে। বলে, ফাদারের সাথে শর্তের কথা ভুইল্যা গেছেন ? শর্তভঙ্গকারীকে আল্লাহ একদম পছন্দ করেননা।

কি? শয়তানের মুখে পবিত্র আল্লাহর নাম ? মুষ্টিবদ্ধ হাত দু’টো দিয়ে চেপে ধরে লোকটির সার্টের কলার মাহমুদ প্রবল শক্তিতে। পাল্টা শক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে ছাড়িয়ে দু’পা পিছিয়ে যায় লোকটি।

ফাদারের সাথে দেখা করার সুযোগতো আর অইবোনা মিয়াভাই। পানরাঙ্গা, নিকষ কালো উঁচুনিচু দাঁত বের করে হাসে লোকটি।

কোথায় যেন বাজ পড়লো এরই মধ্যে বিকট শব্দে। অন্ধকারে লোকটির চোখদু’টো জ্বলে উঠে হিংস্র চিতাবাঘের ন্যায়। বিকট শব্দে আবারো বিদ্যুৎ চমকালো। কোমরে গুজে রাখা মজিদের বুভুক্ষ যন্ত্রটি প্রতিশব্দে গর্জে উঠলো মূহুর্তে। হুমড়ি খেয়ে রক্তাক্ত দেহটি লুটিয়ে পড়ে লাইটপোষ্টের নিচে। নিথর দেহটির স্থবির চোখ দু’টো খুঁজতে থাকে আঁধারের প্রকৃত রূপ।

======================


(বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সত্যান্বেষী এ লেখককে তাড়িত করে গল্পটি লিখতে। লেখককর্তৃক এ গল্পসহ অন্যান্য গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ লেখক অধিক সমাদৃত)            


বিষ্টিভদ্রা (নাজমুল চৌধুরী)

Poem by Nazmul Choudhury

হৃষিত হৃদি (নাজমুল চৌধুরী)


Poem by Nazmul Choudhury

বৃতিতে ফেলানী ঝুলে (নাজমুল চৌধুরী)


Poem by Nazmul Choudhury

প্রমুখাৎ (নাজমুল চৌধুরী)


Poem by Nazmul Choudhury

স্বর্গ-সহেলী (নাজমুল চৌধুরী)

Poem by Nazmul Choudhury

অনভিপ্রেত উপাখ্যান (নাজমুল চৌধুরী)

Poem by Nazmul Choudhury

অনাহূত অতিথি (নাজমুল চৌধুরী)

Poem by Nazmul Choudhury

অনন্তযাত্রা (নাজমুল চৌধুরী)


Poem by Nazmul Choudhury

আস্তিক-নাস্তিক (নাজমুল চৌধুরী)

Poem by Nazmul Choudhury

শাশ্বত যাত্রা (নাজমুল চৌধুরী)


Poem by Nazmul Choudhury

ব্রততী-বালা (নাজমুল চৌধুরী)

Poem by Nazmul Choudhury

শিয়রে বকুল মালা (নাজমুল চৌধুরী)

Poem by Nazmul Choudhury

দিনান্তের দিনলিপি (নাজমুল চৌধুরী)

Poem by Nazmul Choudhury

ভ্রান্তির অপরাধ (নাজমুল চৌধুরী)


Poem by Nazmul Choudhury

Wednesday, March 13, 2019

লেখক রচিত ইউরোপে ১৭ দিন বই হতে নেয়া একটি খন্ডিত অংশ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

 

লেখক রচিত ইউরোপে ১৭ দিন বই হতে নেয়া একটি খন্ডিত অংশ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
 নাজমুল চৌধুরী
 


ইংরেজী ২০০০ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর।
 
বেলজিয়ামের ব্রাসেলস্-এ মাহবুবভাইয়ের বাসায় ডলি ভাবীর পরিবেশিত সকালের হেভী চা-নাস্তা পর্ব সেরে পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী নেদারল্যান্ড ও জার্মানী ভ্রমণের নিমিত্তে মাহবুব ভাইয়ের বন্ধু সিলেটের আতিকভাই আমার সঙ্গী হলেন, সাথে আমার ছেলে সাকিব। ব্যক্ত থাকে যে, ইতিপূর্বে লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স, গ্রীস এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্যান্য দেশসমূহে মাহবুবভাই আমার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। 

ব্রাসেলস্ রেলষ্টেশনে যাত্রীদের তেমন ভীড় নেই। পশ্চিম ইউরোপের ইলেকট্রিক ট্রেনগুলোর একই বৈশিষ্ট। সিট সংখ্যানুযায়ী টিকেট ইস্যু, টিকেটের হার এক, নেই কোন শ্রেণীভেদ।সরকারী সম্পত্তির হেফাজত ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় সকল যাত্রীরাই সচেতন। কম্পার্টমেন্ট ফ্লোরে বাদামের খোসা, উচ্ছিষ্ট খাদ্যাংশ কিংবা কাগজের টুকরো নজরে পড়েনি। নির্ধারিত গার্বেজ বিন ব্যবহার করতে কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারী অধিকন্তু যাত্রীরা এ ব্যাপারে ততোধিক সচেতন। ট্রেনের জানালাপথে কাগজ বা পলিথিনের খালি প্যাকেট কেউ ছুঁড়ে ফেলেনা।ধূমপায়ীদের  জন্য ট্রেনে আলাদা কম্পার্টমেন্টের ব্যবস্থা। টয়লেটগুলোও পরিচ্ছন্ন। আমাদের ট্রেনগুলোর টয়লেটে নিচের দিকে ছিদ্র থাকে যাতে মলমূত্র ছিদ্রপথে নিক্ষিপ্ত হয়ে লাইনে পড়ে কিন্তু ইউরোপের ট্রেনগুলোতে প্লেনের মত টয়লেটে কেমিক্যাল ফ্লাশের ব্যবস্থা থাকায় ট্রেন লাইনে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় থাকে।অন্যদিকে ইউরোপের প্রতিটি নাগরিক কুকুর প্রিয়। কুকুর নিয়ে মালিকরা সকাল-বিকেল বেরিয়ে পড়ে পার্কে, রাস্তায়। উদ্দেশ্য কুকুরের মলমূত্র হতে রক্ষা পাওয়া। পার্কে কিংবা রাস্তায় একটু অসাবধান হলে অপবিত্রতা এড়ানো যাবেনা। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সকাল-বিকেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মলমূত্র পরিষ্কার করে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের ন্যাড়া কুকুরছানাও অনেক ভদ্র, মার্জিত সুযোগ বুঝে পাশের  ঝোপে  কিংবা  লাইটপোষ্টের  খুঁটি  ঘেষে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয় এবং দু’পা দিয়ে আঁচড়ে মলমূত্র ঢেকে আসতে ভুল করেনা।

পাক-ভারত উপমহাদেশের সকল স্থানে পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সরকার এবং জনগণ সমভাবে উদাসীন। যেখানে সেখানে স্তূপীকৃত  আবর্জনার  ভাগাড়,  মনে  হয় পরিবেশ দূষণে আমরা অভ্যস্থ এক জাতিসত্ত্বা। আমাদের সরকার এজন্য জনগণ অপেক্ষা অধিক দায়ী। পরিচ্ছন্নতায় জনগণকে সচেতন করতে কিংবা সরকারী ব্যবস্থাপনার পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ব্যাপারে তেমন কোন কড়াকড়ি  নেই,  দূর্বল  আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই।এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, ইত্যাদি দেশে সরকারী নজরদারী ও কঠিন আইনপ্রয়োগের মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় যথেষ্ট সফলতা অর্জিত হয়েছে। পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠিকে সভ্যতা বিকাশের চরম এ সন্ধিক্ষণেও যতটা দায়িত্বশীল করার কথা ছিল ঠিক ততটা করতে পারেনি। ট্রেন কম্পার্টমেন্টে কলার খোসা, কাগজ কিংবা খাবারের মোড়ক ফেলার জন্য ট্রেনের কামড়ায় গার্বেজ বিন থাকেনা। পার্কে, রাস্তায় একই দুরাবস্থা। তাই সাধারণ মানুষের অভ্যাস এবং সরকারের পরিবেশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদাসীনতা সমভাবে এগিয়ে চলছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষতিকারক দিকটা উপলব্ধি করার মত সচেতনতা কয়জনেরই বা আছে।
 
নেদারল্যান্ডের পথে একটি ট্রেন বদল করতে হল। কয়েকঘন্টা অতিক্রম করার পর আতিকভাই জানালেন এইমাত্র আমরা বেলজিয়াম ছেড়ে নেদারল্যান্ডে প্রবেশ করেছি। ডানে বামে যে বাড়িগুলো দেখছেন তার সবক’টিই এদেশের অন্তর্ভূক্ত।
 
দিগন্তবিস্তৃত বরফাচ্ছাদিত মাঠ, ঘরবাড়ি, পাতাঝরা বৃক্ষলতাদির সমাহার। হাতেগুণা কয়েকটি মাস এখানে প্রকৃতি তার স্বরূপ ফিরে পায়। তাই সমগ্র ইউরোপ কৃষিক্ষেত্রে অনগ্রসর। খাদ্যসম্ভারের বেশীরভাগই আমদানীনির্ভর। বাধ্য হয়েই ইউরোপে ভারী শিল্প- কারখানা গড়ে উঠেছে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রকৃতিই তাদেরকে নিত্যনূতন আবিষ্কারে মনোযোগী করেছে। বছরের বেশীর ভাগ সময় প্রচন্ড ঠান্ডা এবং  বরফের মাঝে খালি হাতে কাজ করা দুরূহ ব্যাপার। এহেন পরিস্থিতিতে মেশিনের সাহায্য নেয়া ছাড়া তাদের বিকল্প নেই। তাই তারা যন্ত্রদানবের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। ঘন্টাদু’য়েকের মধ্যে অমরা রোটারডাম শিল্পনগরীতে পৌঁছলাম। এটাই নেদারল্যান্ডের অন্যতম প্রধান নৌ- বন্দর। এ বন্দর দিয়ে   ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের আমদানী-রপ্তানী সচল রাখা হয়েছে। রাইন নদীর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বন্দরের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। রাজধানী আমষ্টারডাম ঘন্টা-দু’য়েকের পথ।
 
রোটারডামে পৌঁছতেই আকাশভরা মেঘের ফাঁকে সূর্যরশ্মি  ছড়িয়ে  পড়লো।  খুশীর আমেজ ট্রেনের  যাত্রী এবং স্থানীয় অধিবাসীদের চোখেমুখে। যেখানে নিত্য মেঘের খেলা, বরফবৃষ্টির অবিরাম অত্যাচার সেখানে একটি রৌদ্রজ্জ্বল দিন তাদের কাছে নিঃসন্দেহে আনন্দের বার্তাবাহক। মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীরা যেমন করে আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখলে আনন্দে আপ্লুত হয় তেমনি ইউরোপের অধিবাসীরা সূর্যরশ্মিকে মনেপ্রাণে আমন্ত্রন জানায়।
 
একটানা যাত্রায় বেশ ক্লান্তিবোধ করছিলাম। আতিকভাইকে বললাম, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু বেদনাময় অধ্যায় বলতে গিয়েও গতরাত যা বলতে পারেননি, অসুবিধা না থাকলে সময় কাটানোর জন্য এখন বলতে পারেন। ব্রাসেলস্ নগরীকে কেন এত ভালবাসেন তার উত্তর দিতে গিয়ে আতিকভাই গতরাতে বলতে শুরু করেছিলেন তার জীবনের এক অলিখিত ইতিহাস কিন্তু শুরু করার পরপরই দু’জনের চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। শুনা হয়নি এবং বলাও থেমে যায় নিদ্রাদেবীর আলতো পরশে।
 
কি আর বলব ? মানুষের জীবনে এমন অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যায় যা ঘটবে বলেই ঘটে। এমন একটি স্পর্শকাতর ঘটনা কেন যে আমার জীবনে ঘটে গেল যা আজও আমাকে কাঁদায়। আতিকভাই একটু নড়েচড়ে বসে বলতে শুরু করলেন। ওই যে বলছিলাম জ্যাকেলিনের কথা। হাঁ, স্বীকার করি বেলজিকি মেয়ে সুন্দরী জ্যাকেলিন আমাকে গভীর ভালবেসেছিল কিন্তু পরিণতি যে এতটা ভয়াবহ হবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। ওর সাথে প্রথম দেখা  হয় বাসার পাশের এক রেষ্টুরেন্টে। ওকে দেখেই কেন জানি হৃদয়ের কোণে প্রবল এক অনুরাগ জন্মেছিল। পার্টটাইম ওয়েটার হিসাবে কাজ করতো সে। ব্রাসেলস্ শহরে তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, বেলজিক অরিজিনাল। চোখে একবার দেখা এবং প্রতিদিন ওর পরিবেশনায় এককাপ কফি পান করতে যাওয়ার মধ্যে আমার কোন অবহেলা ছিলনা।
হৃদয়ের গভীরে অজান্তে ওর প্রতি এক প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতাম। একদিন বলেই ফেলি-শুধু তোমাকে একপলক দেখব বলে এখানে প্রতিদিন আসা,তা কি তুমি জানো ?
উত্তরে বলল - তোমার চোখে এ ভাষাই আমি প্রত্যক্ষ করে আসছি কিন্তু কেন বলতো ?

জানিনা তোমাকে কি নামে ডাকব ? তবে বলতে অসুবিধা নেই প্রথমদিন দেখেই তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি আর এ কারণেই এখানে প্রতিদিন আসা।
 
পুরুষরা মেয়েদেরকে আকর্ষণ করার জন্য এ ধরণের অনেক কথাই বলে। এই আমি জ্যাকেলিন এ ধরণের কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি, তাই আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।
 
দ্যাখো, এ কথাগুলো তোমাকে এভাবে বলতে চাইনি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথাও ভেবে দেখিনি। আমার অন্তরে যে ভালবাসার ফল্গুধারা প্রবাহিত হচ্ছে তা বুঝতে হলে আমার মনের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। তোমাকে আজ মনের কথাগুলো বলতে পেরে কি যে আনন্দ লাগছে, কি করে তোমাকে বৃুঝাবো।
 
জ্যাকেলিন একটু গম্ভীর স্বরে বলল, স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়াতে ওকে ডিভোর্স দিয়েছি। চেয়েছিলাম সুখী সুন্দর একটি দাম্পত্যজীবন কিন্তু হলনা। মানুষ যা চায় তা পায়না। তুমি যে ভালবাসার কথা বলছ এমন এক প্রগলভ ভালবাসা আমি চেয়েছিলাম যেখানে থাকবে শুধু অনাবিল সুখ আর আনন্দ। পারবে তুমি তেমন ভালবাসতে ?
 
যে বয়সে মানুষ ভালবাসতে চায়, সকল বাঁধাকে জয় করে সামনে এগুতে চায় সে বয়স আমার। জ্যাকেলিনের কথার প্রেক্ষিতে আমার অন্তরে ভালবাসার দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। ওর নিটোল হাতে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম - পারবো জ্যাকি, পারেবো। আমার বুকে কান পেতে শুন হৃদয়ে উৎসারিত এক স্বর্গীয় প্রেমের স্পন্দন।
 
আমার কথার মধ্যে কতটুকু অভিব্যক্তি ছিল জানিনা তবে জ্যাকি যেন এর আগে কখনো এ ধরণের কথা শুনেনি, নীরবে আমাকে প্রত্যক্ষ করলো অনেকক্ষণ, যেন চূলছেড়া এক গভীর বিশ্লেষণ। তারপর আমাকে টেনে নিয়ে গেল রেষ্টুরেন্টের ষ্টাফ রুমের খালি একটিতে।  বুকে মাথা রেখে বলল দ্যাখো, আমাদের দেশের পুরুষদের আমি বিশ্বাস করিনা। ওরা সম্ভোগপ্রিয় ও বহুগামীতে অভ্যস্থ। তোমার চোখেমুখে যে জিনিষটি আমি লক্ষ করেছি তাতে মনে হয় তুমি ওদের মত নও - একটু ব্যতিক্রমধর্মী।
 
প্রচন্ড শীতে, বাইরে বরফবৃষ্টির মধ্যেও ভেতরে আমদের দু’জনের শরীরে বইছে অগ্নেগিরির প্রচন্ড উত্তাপ। প্রচন্ড এ উত্তাপে অগ্নেগিরির উৎসমুখে যেন এখনই ফাটল ধরবে, আর আমরা দু’জন সে অগ্নিদাহে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাব।  জ্যাকির প্রেমময় চাহনি, অবিরাম ঠোটের দংশন আর লেপটে থাকা কবোষ্ণ বক্ষের উষ্ণতায় আমি দিশেহারা।
 
কতক্ষণ কেটেছিল জানিনা। রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজারের উপস্থিতি টের পাইনি। মুচকি হেসে বলল - রাত বেশ হয়েছে, বন্ধ করতে হবে। অধিক সময় দেয়া যাবেনা  বলে দুঃখিত। জ্যাকির সুঢৌল হাত আমার  হাতের  মুঠোয়।  পরস্পর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ একজোড়া কপোত-কপোতী। হাত ছাড়িয়ে নেয়ার বদলে আমার অনামিকায় উপর্যুপরি চাপ সৃষ্টি করছে জ্যাকি। কাঁপছে তার দেহবল্লরী। আর আমি আমার আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে সমর্পিত ওর বাহুডোরে।
 
হোটেল ম্যানেজারের দিকে একপলক তাকিয়ে এবার ফিস ফিস করে বলল - রাত অনেক হয়েছে, ঘরে যাবেনা? কাঁপা কাঁপা স্বরে পুনরায় জ্যাকি বলল, কাল আসছ তো ? আমি অপেক্ষায় থাকবো। দ্যাখো, আবার ভুলে যেওনা যেন। তোমরা পুরুষরা সহজেই তা পার, কি ঠিক বলিনি?  নারীসুলভ কৃত্রিম অভিমান তার মুখচ্ছবিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলল।
 
আবেগে বলে উঠি, আমার তৃষিত বুকে আজ যে আনন্দের বন্যা তার সবটুকুই তোমাকে ঘিরে। আমার পদ্মফোঁটা হৃদয় সরোবরে অবগাহন করে দ্যাখো ওখানে ফুটে আছে কতশত অনাঘ্রাত লালপদ্ম। মনে হচ্ছে আমি যেন সাতসাগরে ডুব দিয়ে এনেছি অসংখ্য মনিকাঞ্চন। পূর্ণতার এ শুভক্ষণে কেমন করে বলতে পারলে তোমায় আমি ভুলে যাব ? আজকের এই স্মুতিময় রাত আমার কি কাটতে চাইবে ?
 
আমার কথাগুলো আমাকেই যেন ব্যঙ্গ করলো। আমার জীবনে এই প্রথম সরাসরি এক বিদেশিনীকে ভালবাসার কথা বলতে পারা। আমি যেন জয় করে এসেছি এই বিশ্বব্রহ্মান্ড। এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে আতিকভাই বললেন, বুঝলেন প্রচন্ড এ আবেগই হয়েছিল আমার কাল্। আমার প্রেমের বহিঃপ্রকাশ জ্যাকিকে ভাসিয়ে দিয়েছিল ভালবাসার প্রবল স্রোতে। ওখান হতে ফিরে আসার সাধ্য না ছিল তার, আর না ছিল আমার।
 
এরপর হতে মিথুন-মিথুনীর মত ডানা মেলে আমরা একত্রে অবাধে বিচরণ করেছি ব্রাসেলস্-এর  রাজপথে, রেষ্টুরেন্টে, পার্কে কিংবা অন্য কোথাও। হিংস্র কামনার উদ্যামতায় আমরা মিশেছি পরস্পরের বাহুডোরে। নিত্যনূতন ভালবাসার ডালি সাজিয়ে একে অপরের প্রতীক্ষায়  কাঁটিয়েছি ক্ষণ, গেথেছি মালিকা, সাজিয়েছি বাসর। ও সময় পেলেই ছুটে আসতো আমার আস্তানায়। অগোছালো বিছানাপত্র, কাপড়চোপড় ঝাড়মোছ দিয়ে শাসিয়ে যেত যাতে নিজের চালচলনে যত্নবান হই।
 
একদিন ওর পিতামাতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানালো আমাকে অচিরেই বিয়ে করতে যাচ্ছে। পিতামাতা আশীর্বাদ করলেন যাতে বিবাহিত জীবনে আমরা সুখী হই।
 
আমি এখানে এসেছিলাম ট্যুরিষ্ট ভিসা নিয়ে। রাজনৈতিক আশ্রয়দানের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম উকিল মারফত। কেইস তখনও কোর্টে। জ্যাকি আশ্বাস দিল বিয়ের পর কাগজপত্র দেখিয়ে রেসিডেন্ট পারমিট পেতে অসুবিধা হবেনা। তাই একদিন কোর্টে গিয়ে আমাদের বিয়ে হল এবং সে অনুযায়ী জ্যাকী আমার রেসিডেন্ট পারমিটের  দাবী  নিয়ে  কোর্টে  কাগজপত্র দাখিল করল। একসময় তা পেলাম বটে কিন্তু বিধিবাম। বিয়ের ব্যাপারটি বন্ধুদের কারোর পছন্দ হয়নি এমন কারোর মাধ্যমে খবরটি রাতারাতি পৌঁছে গেল দেশে।
 
একদিন পিতার পত্র এলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। ওনার শরীর ভেঙ্গে পড়েছে, বাঁচার আশা ক্ষীণ। হাসপাতাল বেডে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন, অবস্থা বে- গতিক। মৃত্যুর পূর্বে তিনি বংশের প্রথম বউমা দেখে মরতে চান, ক’নে ঠিক হয়ে আছে, সুতরাং কালবিলম্ব না করে দেশে যেন প্রত্যাবর্তন করি।
 
জ্যাকি এবং আমার সংসারে বিপর্যয়ের ঘনঘটা। শরবিদ্ধ পাখির ন্যায় ছটফট করতে দেখে জ্যাকি শুধালো, আজকাল তুমি এত মনমরা  থাকো কেন, কি হয়েছে, আমাকে খুলে বল।
 
পিতার মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো মনের আয়নায়। সঠিক লক্ষ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বিপরীত কোন প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে জ্যাকিকে কিছু জানাইনি। ভাবলাম  পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জানাবো। কয়েকদিন পালিয়ে বেড়ালাম নানা ছলে জ্যাকির কাছ থেকে। নেদারল্যান্ডের সীমান্ত শহর এনস্কিডে বসবাসরত নিকটতম বন্ধু সফিকের কথা মনে হল। ও শুধু আমার ছোট্ট বেলার বন্ধুই নয়, প্রবাসে আমার একজন হিতাকাঙ্খীও বটে। তার বাড়ি বাংলাদেশে আমাদের পাশের গ্রামেই। আমার পিতামাতা, ভাইবোন সবার সাথেই রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। তার মাধ্যমে আমার পরিবারকে সমগ্র বিষয় বুঝিয়ে বলতে হবে যাতে আমার সাম্প্রতিক ব্যাপার কারোর কাছে বিরক্তির কারণ না হয়।
 
একদিন ব্রাসেলস্ হতে পাড়ি জমালাম নেদারল্যান্ডের এনস্কিডে  বন্ধু  সফিকের বাসায়। সফিক জানে বেলজিয়ামে আমি ট্যুরিষ্ট ভিসায় এসেছিলাম, জ্যাকি আমাকে বিয়ে করাতে স্থায়ীভাবে বসবাসের এবং কাজের সরকারী অনুমোদন পেয়েছি। যদিও শুধুমাত্র এ কারণে জ্যাকিকে আমি বিয়ে করিনি, বিয়ে করেছিলাম জ্যাকিকে সত্যিকার ভালবেসে। ওর কাছে আমি পেয়েছি জীবনের শ্রেষ্ট পাওয়াগুলোর সবক’টি। ওর নিখাদ ভালবাসা, সংসারের প্রতি কর্তব্যবোধ, প্রতিটি ধাপে সে এক আদর্শ জীবনসঙ্গিনী। সফিক এ কারণে বহুবার আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে - বলেছে, বন্ধু তুমি সত্যিই ঠকোনি।
 
জ্যাকি আমাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন সফিকের বাসায় হাজির। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল - বল কি দোষ করেছি আমি?  কি অপরাধে আমাকে এমন মানসিক যন্ত্রণা পেতে হচ্ছে, কি হয়েছে তোমার ? আমাকে না জানিয়ে এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? একসাথে অনেক অভিযোগ। আমি নীরব, উত্তরের ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছি। উত্তর না পেয়ে জ্যাকি জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। চোখ তার ছলছল। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমার উপর দিয়ে এক প্রবল বৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে, ক্ষত-বিক্ষত এক পাখির ন্যায় ডালে ডালে বিচরণ করছি ঝড়ের ঝাপটা সামলাবো বলে।
 
সফিক নিরবতা ভাঙ্গল। আমার মন খারাপের ব্যাপারটি জ্যাকিকে বুঝিয়ে বলল। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জীবনের উপর পিতামাতা ভাইবোনদের প্রভাব থাকবে কেন এটা বুঝাতে ব্যর্থ হল।
 
ইউরোপের  মেয়েরা  স্বচ্ছতা  পছন্দ  করে।  বললাম, তোমাকে দূঃখ দিতে চাইনি বলে পালিয়ে  বেড়াচ্ছিলাম। যে কথাটি তুমি সহজে বলতে পারলে আমাদের সমাজে তা অচল। বিয়ের ব্যাপারে ব্যক্তিগত পছন্দের চেয়ে পারিবারিক পছন্দ আমাদের সমাজে অধিক গ্রহণযোগ্য। বাবাকে আমি চিনি, আমাদের ব্যাপারটি জানালে তিনি আমাকে ত্যাজ্য করতে দ্বিধাবোধ করবেন না। তাছাড়া তিনি হাসপাতালের বেডে শয্যাশায়ী, এমন খবরে তিনি হার্টফেলও করতে পারেন।
 
আমাদের সমাজ সংস্করের কথা জ্যাকিকে আমি বিশদভাবে ব্যাখা করে পূর্বেও অনেকবার বলেছি। এমতাবস্থায় সে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে চাইল। বললাম, বাবাকে বাঁচাতে হবে এবং পারিবারিক ভাঙ্গন ঠেকাতে  হলে আমাকে কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরে যেতে হবে। আমার বিশ্বাস, ওখানে যাওয়ার পর একটা সুষ্ঠ সমাধান খুঁজে পাব।
 
জ্যাকি বলল, তার চেয়ে এই ভাল আমাকেও তোমার সাথে বাংলাদেশে নিয়ে চল। তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলব, আমরা ভালবেসে একে অপরকে বিয়ে করেছি এবং এতে দোষটা কিসের ? আশা করি তিনি বুঝবেন এবং আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবেন। উত্তরে বললাম, জ্যাকি আমাদের সমাজব্যবস্থা সম্মন্ধে তোমার জানা নেই। পশ্চিমা মেয়েদেরকে তারা ভাল চোখে দেখেনা কারণ পশ্চিমাদের সাথে আমাদের সামাজিক রীতিনীতির কোন মিল নেই। তারচেয়ে এই ভাল, আমি একাই যাই। আশা করি আমি সফিকের সাথে পরামর্শ করে এর একটা নিশ্চিত সমাধা খুঁজে বের করবো।
 
কেন পশ্চিমা হলেও আমি আমার বাবা মার মতামত নিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার ধর্ম গ্রহণ করেছি যদিও নামাজ, কু’রআন পড়তে এখনো শিখিনি তবু রোজাতো রাখছি। পিতামাতা আমার ধর্মান্তরিত হওয়াকে খুব ভাল চোখে দেখেননি তবু আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দকে তারা প্রাধান্য দিয়েছেন।
 
বন্ধু সফিকের সাথে পরামর্শ করে একটা সমাধান খুঁজে পাব এই আশ্বাস দিয়ে জ্যাকিকে বেলজিয়ামে বিদায় করলাম। বিপর্যস্ত মন নিয়ে বেলজিয়ামে ফিরে এলাম পাঁচদিন পর। বোনের লিখা আরেকটি কড়া চিঠি পেলাম এরই মধ্যে। যদি বাবাকে দেখতে চাও তাহলে আর একমূহূর্ত দেরী করনা ভাই। সম্ভবতঃ বাবা তোমার জন্যই বেঁচে আছেন।
 
পারিবারিক প্রলয় ঠেকাতে আমার দেশে ফেরা জরুরী বিধায় বিমানের টিকেট হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। জ্যাকিকে বোনের লিখিত চিঠি তর্জমা করে পড়ে শুনালাম। জ্যাকি তন্ময় হয়ে শুনল। ছলছল চোখে বলল আমি এক অশুভ ইঙ্গিত টের পাচ্ছি আতিক। মনে হচ্ছে পারিবারিক চাপে তুমি বিয়ে করবে, এখানে আর ফিরবেনা এবং আমার সাজানো সংসার তাসের ঘরের মতই ভেঙ্গে যাবে।
 
কি বলছ জ্যাকি? তোমাকে কথা দিচ্ছি সব সামলে আমি শীঘ্রই ফিরবো। মনে রেখো, তোমাকে আমি ভালবেসে বিয়ে করেছি আর তোমকে পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য। আমি দেশ থেকে ফেরা অবধি তুমি তোমার মায়ের কাছে থাকবে। ফিরে এসে তোমাকে বাসায় নিয়ে আসব। মনে হচ্ছে তুমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, মায়ের কাছে থাকলে ভাল থাকবে।
 
ওকে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলাম কর্মস্থলের পাশাপাশি এক বন্ধুর বাসায়। বাংলাদেশ বিমানে সিট পেলাম বুকিংয়ের পাঁচদিন পর।
 
পাঁচদিনের মাথায় নিজের বাসায় লাগেজ নিতে এসে সিঁড়ি বেয়ে আমার দোতালার ফ্লাটে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় একজন পুলিশ অফিসার আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল - স্যার, আপনার নামই কি আতিকুর রহমান ? হাঁ- বাচক শব্দ শুনে বলল - এখনই আপনাকে হাসপাতালে যেতে হবে একটি লাশ শনাক্ত করতে। জানতে চাইলাম কাকে ? পুলিশ অফিসার জানাল এ ব্যাপারে সে কিছুই জানেনা। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ সে পালন করছে মাত্র।
 
আমার চেতনায় আমাদের পাশের গ্রামের আব্দুস সালামের মুখচ্ছবি ভেসে উঠল। ব্রাসেলস্-এ একটি গ্লাস ফ্যাক্টরীতে চাকুরী  করত  সে।  বহুদিন ধরে ক্যান্সারে ভূগছিল  লোকটি, নিশ্চয়ই সে মারা গেছে কোন দুর্ঘটনায়। পুলিশ তাকে হয়তো সনাক্ত করতে পারছেনা।

পুলিশ  ভ্যানে  করে  হাসপাতালের  মর্গে  পৌঁছতে দেরী হলনা। ওখানে কর্তব্যরত তিনজন পুলিশ অফিসারের পেছনে পেছনে মর্গে সারিবদ্ধ লাশের কাছে পৌঁছতেই একটি লাশ উন্মোক্ত করা হল। সাদা কাপড়ে আবৃত লাশটির মুখ খুলতেই দেখি জ্যাকি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। পিস্তলের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে গেছে ওর মাথার খুলির একাংশ। চুলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছে ফ্যাকাশে রক্তকণিকা। ভাবতেও পারিনি জ্যাকিকে আমি এ অবস্থায় দেখব। মনে হল আমিও একজন মৃত ব্যক্তি। আমার কোন সত্ত্বা নেই। অবশ দেহখানার ভেতর  হৃৎপিন্ড  প্রবলভাবে দুলছে। পুলিশ অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে সংবিত ফিরে পেয়ে বললাম - ও আমার বিবাহিতা স্ত্রী। কয়েকদিন পূর্বে ওর পিত্রালয়ে সে বেড়াতে গিয়েছিল। পুলিশ অফিসার জানালো - ওর  লাশের  পাশে  আমরা  একটি চিরকুট পেয়েছি। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এর প্রেক্ষিতে আপনার মতামত জানতে চাইছে। জানতে চাইলাম কি লেখা আছে এতে? একজন অফিসার বলল - জবানবন্দির জন্য ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নেওয়ার পর বিষয়বস্তু জানা যাবে তার আগে নয়।
 
ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে চিরকুটটি পড়ে আমাকে শোনানো হল। ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখা এর সারাংশ এই দাঁড়ায় যে,”আতিককে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম ওকে নিয়েই বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেব। সে তার পিতার চিঠির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পিতামাতার প্রতি ওর আনুগত্য এদেশে কারোর মধ্যে আমি দেখিনি। ওর পিতা ওর জন্য বিয়ের ক’নে ঠিক করে রেখেছেন, আমি একপ্রকার নিশ্চিত যে, সে তার পিতামাতার অবাধ্য হবেনা। ওদেরকে খুশী করার জন্য সে কিনা করতে পারে ! আমার জীবিতবস্থায় আতিক অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে এ হতে পারেনা।  তার বিয়ের খবর শুনার পূর্বেই আমি মৃত্যুকে বেছে নিলাম” --- জ্যাকেলিন।
 
আতিকভাই এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন - বিস্ময়ের বজ্রাঘাতে ম্যজিষ্ট্রেটের প্রশ্নের উত্তরে কি কি বলেছিলাম তা এই মূহূর্তে সবকিছু মনে করতে পারছিনা কারণ ঐ সময় আমি মানসিকভাবে এমনই বিপর্যস্ত ছিলাম যে, কথার সব খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম যা ম্যাজিষ্ট্রেটকেও তাৎক্ষণিক  চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। কোর্টের সামনে দৃঢ়তার সাথে বলতে পেরেছিলাম যে, নিজের স্ত্রীর কাছে এটা বলা প্রয়োজন ছিল যে, মৃত্যুপথযাত্রী পিতা আমার জন্য বিয়ের ক’নে ঠিক করে রেখেছেন, যে কারণে পিতাকে একবার দেখার প্রয়োজনে হলেও আমাকে দেশে যেতে হবে। বিয়ের ব্যাপারে পিতাকে বুঝিয়ে বলে পুনরায় বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি এড়াতে পারবো এ কথাটিও জ্যাকিকে বারবার বলেছি। শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে একজন স্ত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেনা, এর পেছনে অন্য কোন কারণ থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
 
পশ্চিম ইউরোপের প্রত্যেকটি প্রিন্ট মিডিয়া ও গণমাধ্যমে জ্যাকির অকালমৃত্যু ও আমাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি ও সমালোচনার ঝড় উঠল। সন্দেহাতীতভাবে আমাকে পুলিশের জিম্মায় আটকে রাখা হল। আটককালীন অবস্থায় সাংবাদিকদের সামনে ঘন ঘন উপস্থিত করা হল। সরকারী মনোবিজ্ঞানী দ্বারা আমাকে বিভিন্ন সময় পরীক্ষা করা হল। বিচারকদের সামনে এবং বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে রেকর্ডকৃত জবানবন্দিতে কোনরূপ অসংগতি আছে কিনা তা খুঁটিয়ে দেখার প্রায় একবছর পর আমাকে নির্দোষী হিসাবে অবমুক্ত করা হল।
 
দেশে গিয়েছিলাম কিন্তু পিতাকে জীবিত দেখার সৌভাগ্য হয়নি। প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস সহ্য করতে না পেরে বিপর্যস্ত বলাকারা ভারসাম্য হারিয়ে যেভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আমারও তখন একই অবস্থা। প্রায় ছ’মাস দেশে অবস্থান করলাম। শান্তির শ্বেতকপোত কোথায় নিরুদ্দেশ হল, বিস্মৃতির অতলগহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে জ্যাকিকে নিয়ে আমার স্মৃতিময় দিনগুলো ব্রাসেলসে ফিরে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে রইল।
 
আমার মানসিক চাপ রোধে নেদারল্যান্ডে বসবাসরত বন্ধু সফিক তার শশুরের কাছে ও আমার পরিবারের কাছে যুক্তি দেখিয়ে অসংখ্য পত্র ও ফোনালাপের মাধ্যমে তার স্ত্রীর খালাতো বোন নাঈমাকে বিয়ে করানোর ব্যাপারে যুক্তি খাড়া করলো। আমাকে লিখলো - বন্ধু, তোর ভালো চাই বলে অনুরোধ করছি নাঈমাকে বিয়ে করে ফিরে  আয়।  তোর  জীবনের  বাকী  দিনগুলো নিজের চোখের সামনে নষ্ট দেখতে চাইনা। জ্যাকিতো আর ফিরে আসবেনা বরং তার স্মৃতি তোকে শেষ করে দিবে।
 
শেষপর্যন্ত সফিকের যুক্তি, তার শশুড়, পারিবারিক চাপ এবং পিতার অন্তিম ইচ্ছার কাছে আমাকে নতি স্বীকার করতে হল। নাঈমার সাথে অনাড়ম্বর বিয়ে হল। বাসর রাতে নাঈমাকে জিজ্ঞেস করলাম, জেনেশুনে বিয়েতে রাজী হয়েছিলে কেন ? উত্তরে বললো, সফিক ভাইয়ের সাথে ফোনালাপে সব জেনেছি, বিদেশে নাগরিকত্ব পেতে কনট্রাক্ট ম্যারেজ নাগরিকত্ব পেতে সহায়ক ভূমিকা রাখে, আপনার বেলায়ও  এমনটি  ঘটেছে। পশ্চিমা মেয়েরা টাকার লোভে কনট্রাক্ট ম্যারেজে রাজী হয় এটা এদেশের সকলেই জানে। তবে টাকা নিয়ে অজানা, অচেনা কাগুজে সই করা বিদেশী স্বামীর প্রেমে আত্মহত্যা কেউ করতে পারে এমন ঘটনা ওদেশে বিরল এবং অবিশ্বাস্য। ঐ বিদেশিনী মরেছে অন্য কোন কারণে, আপনার দোষ নেই এতে। যতটুকু জেনেছি আপনি সহজ সরল নির্ভেজাল একজন পুরুষ। আমাদের বিয়ে হয়েছে, আপনাকে সুখী দেখতে চাই। এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে আমার কাছে কিছু থাকবেনা।
 
না, তুমি যা জেনেছ তার সবক’টি সঠিক নয় নাঈমা।
 
দেখুন, আমি যা জেনেছি পারিবারিক সূত্রে ও সফিক ভাইয়ের কাছে তা যথেষ্ট বলে মনে করি। তাই আর ঘাটাঘাটি করতে চাইনা। আপনি মহানুভব তাই অনর্থক সেই বিদেশিনীর কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছেন। জানেন, কষ্ট মানুষকে প্রতারিত করে। জীবনের চোরাগলিতে হাঁটতে গিয়ে অনেক ঘটনা ঘটে যা স্মরণ করলে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সেই দুঃসহ ঘটনাগুলোকে ঝেড়ে মুছে নূতন করে জীবনের হিসাব মেলাতে হয়। আশা করি আমার মনের কোণে পুষে রাখা রঙ্গিন স্বপ্নগুলোকে নিরর্থক বাক্যবাণে ব্যর্থ করে দিবেননা।
 
জানেন, বিস্মিত হলাম নাঈমার বাকপটুতায়। লেখাপড়া জানা গ্রামের সহজ সরল মেয়েকে মনে মনে দাঁড় করালাম জ্যাকির বিপরীতে। জ্যাকি নারীস্বাধীনতায় বেড়ে ওঠা স্বনির্ভর স্বাধীন এক বিদেশিনী,  দাম্পত্যজীবনে একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী হয়ে না থাকার সন্দেহ তাকে আত্মঘাতী করেছে। আমার জীবনে সম্ভাব্য অন্য কোন নারীর আবির্ভাব কোনক্রমেই সে সহ্য করতে পারবেনা এমন আবেগমিশ্রিত উৎকন্ঠার চিরকুট লিখে সে চলে গেল না ফেরার দেশে। শেক্সপিয়ারের ”হেমলেট” নাটককেও যেন সে হার মানিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের নরম ঘাসফুলে গড়াগড়ি খেয়ে বেড়ে ওঠা নাঈমা দাম্পত্যজীবনের শুরুতে অবিশ্বাসকে তুড়ি মেরে বিশ্বাসের খুঁটি  মজবুত  করতে চায়। ঘটে যাওয়া বেদনার উপর শক্তির প্রলেপ মাখিয়ে আমাকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়।
 
উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা আতিকভাইয়ের হৃদয়ের গভীরে জ্যাকির ভালবাসা মেশানো ক্ষতটি কিভাবে ক্ষণে ক্ষণে মোচড় দিচ্ছে তারই এক অসহ্য প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করছি তার চোখেমুখে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অনুমতি চেয়ে বললাম জানেনতো আমার লেখালেখির অভ্যাস রয়েছে। আমার কোন লেখায় যদি আপনার এ ঘটনার কথা এসে যায় তাহলে আপত্তি নেইতো ? উত্তরে জানালেন - এ ঘটনা পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে প্রায় একবছর সুতরাং জানাজানির ভয় আমার নেই।
 
জানেন, একসময় মনে হয় ওর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। বাবার চিঠির কথা ওকে না জানালেই পারতাম। এমনটি যে ঘটে যাবে ভাবতেই পারিনি। বুক পকেটে রাখা ম্যানিবেগে সযত্নে রক্ষিত জ্যাকি ও ওনার মুখোমুখি একটি ফটো বের করে দিলেন আমার হাতে।
 
ছবি যেন কথা বলে উঠল আতিকভাইয়ের চোখে চোখ রেখে। ’কেমন আছ আতিক ? অনেক ভেবেচিন্তে তোমার পিতার ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দিয়ে আমি নিজেকে সরিয়ে নিলাম। আমি কি জানতাম আমি নিঃশেষ হয়ে গেলে তুমি ওমনভাবে ছটফট করবে ? আমি ভুল করেছি আতিক আবেগের বশে। এ বিরাট ভুলের ক্ষমা নেই। দেশে গিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী তোমার পিতার আদেশ পালন করে সুখী হও আতিক। পারলে আমাকে ক্ষমা করো। পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে জ্যাকেলিন তোমার জন্য জন্ম জন্মান্তর অপেক্ষা করবে।’
 
আতিকভাইয়ের চোখে অশ্রু। ট্রেনের জানালাপথে উদাস দৃষ্টি নিবদ্ধ। এক পিচ্ছিল, দুঃস্বপ্নের মহাসিড়ি পেরিয়ে তিনি ব্রাসেলসে ফিরে এসেছেন। নববধূ নাঈমা চোখের জলে বিদায় জানিয়েছে। এখানে ফিরে আসার পর জ্যাকির স্মৃতি তাকে অহরহ কাঁদাচ্ছে। বাকহারা আমি। আতিকভাইকে শান্তনা দেয়ার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছি।
 
মনটি বেদনার নীল জলে সিক্ত হয়ে বোবা কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে হরিয়ে গেছে শূন্যতায়। মনে মনে অভিসম্পাত জানালাম মূর্খ এ ভালবাসাকে। আতিকভাইকে  বললাম - যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি এ ছবিটি অবশ্যই বুক পকেট হতে সরিয়ে ফেলুন। এটি কথা বলবে, জ্বালা ধরাবে, জ্বালিয়ে মারবে, স্মৃতিকে তছনছ করবে। কি লাভ এতে ? নববধূ নাঈমার ব্যাপারে যতটুকু জানলাম তাতে মনে হচ্ছে সেও বুদ্ধিদীপ্ত অসাধারণ এক মেয়ে। ওকে শীঘ্র এখানে নিয়ে আসুন, ওর মুখমন্ডলে জ্যাকির প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে নূতনভাবে জীবন শুরু করুন। আর হ্যাঁ - ব্রাসেলস্-এ ফিরে জ্যাকির কবরে একগুচ্ছ ফুল বিছিয়ে দিয়ে তার ভালবাসাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসব।
 
নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমষ্টারডামে প্রবেশ করছিল ট্রেনটি। আমরা উঠে দাঁড়ালাম, এবার আমাদের গন্তব্য এন্সকিডে অতিকভাইয়ের বন্ধু ও পরম আত্মীয় সফিকের বাসা।
 ===========

(লেখাটি লেখকের প্রকাশিত বই ”ইউরোপে সতেরো দিন” বই হতে নেয়া সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি খন্ডচিত্র। বইটি দেশে-বিদেশে পাঠককূলে প্রচুর সুখ্যাতি কুঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থা, খ্যাদ্যাভাস, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদির গভীরে প্রবেশ করে বইটিতে লেখক একটি বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এ বইটি পেতে হলে যোগাযোগ করুন : বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ  বুক সোসাইটি, ১২৫, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা । মোবাঃ ০১৭১১-৮১৬০০১, তোফাজ্জল হোসেন, ম্যানেজার)