Friday, December 13, 2019

সেকাল ও একাল (কবিতা)



‡mKvj I GKvj

- bvRgyj †PŠayix

 

‡mKv‡j g›`vwKbxi ‡kŠP cweÎ Rjvav‡i 
`yl‡Yi Acev` jv‡Mwb ZL‡bv bxjvR‡j
Li‡¯ªvZv b`x Lvj wej kvšÍ cyKzi cv‡o
‡Kvjve¨‡Oiv Avmi Rgv‡Zv iv‡Zi Mfx‡i
cÖfv‡Zi cyw®úZ Kvb‡b cvwL‡`i wePiY
Kvwgbx eKz‡ji myMÜ Qov‡bv w¯œ» mgxiY
cv‡q Pjv †g‡Uvc‡_ my‡kvwfZ j¾¡veZx jZv
cv‡qi ¯ú‡k© by¨R n‡q j¾¡vq fywj‡Zv e¨_v|
 
‡RvbvwKiv euvke‡bi duv‡K AevwiZ cÖvšÍ‡i
wKsev iv‡Zi Avuav‡i evwoi cÖk¯’ AvwObvq
AÜKv‡ii eyK wP‡i Av‡jvi cÖ`xc R¦vjv‡Zv
we`y¨revwZi `vc‡U AvR Zviv cÖvqkt jyß
Anwb©k Awnfz‡Ki c`fv‡i cÖK…wZi A½b
RxeRMZ wb‡q cÖK…wZ mvRv‡Zv m‡L¨i eÜb| 
 
e„wógy³ AvKv‡ki †Kv‡j is ‡eis‡qi Nywo
euv‡ki bvUvB wKsev wU‡bi †KŠVvq m~‡Zv gy‡o
D”Q¦wmZ †Q‡j‡`i `j †g‡Z DV‡Zv Aem‡i
‡Ljvi meyR gv‡V Bj‡k-¸wo e„wó‡Z wf‡R
Djøv‡m wK‡kvi hye‡Kiv †g‡Z DV‡Zv dzUe‡j
mw`© Kvwk R¦‡ii gZ C`„k mewKQz fz‡j
wK‡kvixiv evwoi AvwObvq AšÍi½ †gjvq
‡g‡Z DV‡Zv †MvjøvQzU wKsev KvbvgvwQ †Ljvq
cvovi gwnjviv `vIqvq e‡m ci¯úi evK¨vjv‡c
KvUv‡Zv Aemi we‡Kj ¯^vgx †divi cÖv°v‡j|
 
kx‡Zi kvKmwâ wKsev Mi‡gi gvQgvs‡m
wQjbv digvwjb gvLv‡bvi cÖgË Av‡qvR
`ya `wa wKsev N„‡Z wQjbv ÿwZKviK wgkÖY
K`vwPr †kvbv †hZ al©Y wKsev LybLvivex hZ
K‡Vvi AvB‡bi wePvi †k‡l kvw¯Í AeavwiZ
SMov ‡i‡k eo‡Rvi Po wKsev wKQz wKjNywl
G Aciva wb‡qB em‡Zv cÖexY‡`i mvwjkx
Avcivax ÿgv †P‡q wb‡j `k©K wePviK mgx‡c
ÿgv †c‡q †hZ ‡di bv Kivi kZ© mv‡c‡ÿ| 
 
fveZbv †KD GKiv‡Z GKjv‡d eo‡jvK n‡e
Ryqvi Avm‡i ev jUvwi‡Z A‡Xj UvKv wRZ‡e
Nyl Lv‡e, bxwZ-weewR©Z KvR K‡i gvbyl VKv‡e
¯‹zj K‡j‡R eLv‡U †Q‡j‡`i bv wQj †`ŠovZ¡
GwmW ‡Qvuovi K‚wkÿv wQjbv,bv wQj AvwacZ¨
kvwšÍ wQj, ¯^w¯’ wQj, wQj wbivc` mgvRe¨e¯’v
fvjevmv wQj, kÖ×v wQj, wQj gvbeZvq Av¯’v  
‡m hyM, †mKvj KLb ‡hb A`„k¨ n‡q †M‡Q
‡hw`b gvbyl cÖMwZi WzMWzwM evRv‡Z wk‡L‡Q|
 
b`x¸‡jv AvR eoB wecbœ Aembœ K¬všÍ kixi
ÿxY n‡Z ÿxY, gvSLv‡b Zvi ¯Í‚cxK…Z evjyPi
b`xi ¯^”Q Rjvav‡i gv‡Qiv nvwi‡q‡Q MwZc_
WvjwKwb gv‡QiI iæ× n‡q‡Q gm„Y Pjvi c_
†h b`-b`x cÖvK…wZK wbq‡g e‡q P‡j Aweivg
Pjvi c‡_ euvav w`‡j f‚M‡Z n‡e Zvi cwiYvg
wZ¯Ív dviv°v evu‡ai Kvi‡Y b`x¸‡jvi ¯^vaxKvi
‡¯ªv‡Zi g~‡j b`x kvm‡bi †bB Kv‡ivi AwaKvi
b`x nvj †Q‡o civf‚Z AvR `ye„„„„„„„„„„„„„„„„©Ëcbvi Kv‡Q
b`xZx‡ii Kvkdzj D‡obv Avi SÄvi evZv‡m|
 
¯^v‡`i gv‡Qiv nvwi‡q hv‡”Q `„wói A‡MvP‡i
nvBweªW gv‡Qiv `Lj wb‡q‡Q K…wÎg Rjvav‡i
mv‡ii `vc‡U dm‡ji gv‡V ïay K…wÎg djg~j
`„wó‡Z AvZ¥Z…wß Av‡Q e‡U ¯^v‡`M‡Ü AcÖZzj|   
eq †d«Û Mvj© †d«Û Avi †gvevBj cÖhyw³i hy‡M
hyeK-hyeZxiv jvMvZvi Luy‡R ¯^‡cœi mv_x‡i
†dmey‡Ki wUªMvi wU‡c a‡i mK‡ji A‡MvP‡i
c‡Y©vMÖvwdi G¨vcm LuyR‡Z e¨¯Í iv‡Zi Mfx‡i
mgvR AvwR e›`x Amnvq cÖMwZi evû‡Wv‡i|
 
fvjg›` `yÕ‡UvB cvkvcvwk †mKvj I GKv‡j
‡e‡Q wb‡e fvjwU †Kej g‡›`i †eovRv‡j|

 

          ****************




 সার্চ: www.rokomari.com/book/195353

Tuesday, November 19, 2019

নিশীথের সুতনুকা সুতপা (ছোটগল্প)


নিশীথের সুতনুকা  সুতপা
-নাজমুল চৌধুরী

বিমানবন্দর থেকে টেক্সীক্যাবে সোজা কমলাপুর রেলষ্টেশন। ভাড়া মিটিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে টিকেট কাউন্টারের দিকে উৎকন্ঠিত মনে ছুটতে ছুটতে মনে হল টিকেট পাবতো? কি সর্বনাশ, ছ’টা  বাজে, সোয়া ছ’টায় সিলেটগামী কালনী একপ্রেস ট্রেনটি এয়ারপোর্ট ষ্টেশন ছাড়ার কথা!

প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমান সিলেট অভিমুখী বেশ কিছু যাত্রীর পদচারণায় আশ্বস্থ হলাম। ক্ষীণ আশা নিয়ে টিকেট কাউন্টারে টিকেট চাইতেই প্রথমশ্রেণীর একটি কামড়ায় সিট পেয়েও গেলাম তবে ষ্টেশনমাষ্টার জানালেন খুলনা হতে আগত মালবাহী ট্রেনের একটি বগি টঙ্গী জংশনের আউটার সিগন্যালের কাছে লাইনচ্যুত হওয়ায় উদ্ধার অভিযান চলছে এবং এজন্য সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ষ্টেশন ছেড়ে যেতে তিনচারঘন্টা বিলম্ব হতে পারে।

অগত্যা বিশ্রামকক্ষে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার মত এক যাত্রীর আর কিইবা করার আছে। যাত্রীদের চোখেমুখে উদ্ধেগ, উৎকন্ঠা আর অপেক্ষার প্রহর গুণা। এরই মধ্যে স্থানীয় যাত্রীদের অনেকে টিকেট ফেরত দিয়ে নিজেদের বাসস্থানে  ফিরে  গেছে।  প্ল্যটফর্মে  সীমিত  সংখ্যক  মানুষের  পদচারণা।  প্রথমশ্রেণীর ওয়েটিংরুমে লাগেজ দু’টো রেখে বেতের সোফাটিতে গা এলিয়ে দেই। কমপক্ষে  চারঘন্টা অপেক্ষা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মায়ের চাহিদানুযায়ী জিনিষগুলো কিনতে গিয়ে নিরীহ  এ শরীরটার  উপর কি দখলটাই না গেল বিগত কয়েকটি  দিন।

চোখ বুজতেই একমাত্র ছোটবোন শান্তার সেই কোমল মুখচ্ছবি ভেসে উঠে মনের পর্দায়। প্রবাসের কর্মমূখর দিনগুলোর ফাঁকে কখন যে সে বেড়ে উঠেছে সেই লাল ফ্রক পরা ছোট্ট বোনটি! আশ্চর্য্য দ্রুত চলে টিকটিক সময়গুলো অথচ এই সেদিনও ওর নরম গালে নাক ডুবিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, প্রথম চাকুরী পেয়ে কি আনতে হবে তাড়াতাড়ি বল্? নাকের অত্যাচারে বিব্রত গোলাপী গালদু’টো মুছতে মুছতে বলতো, ছাড়ো বলছি, কিছুই আনতে হবেনা। জানি মুখ ফুটে বলবেনা কখনো। শেষপর্যন্ত ছোট্ট একটি চিরকুট গুজে দিয়েছিল আমার স্যুটকেসের এক কোণে। মেরুন কালারের থ্রি পিস এবং গলার জন্য সাদা রংয়ের ঝলমলে একটি পাথর সেট।

সেই ছোট্ট বোনটির বিয়ের সানাই অচিরেই বাজবে আর তাইতো ছুটে আসতে হল আগাম ছুটি নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে। ওর জন্য দু’হাত ভরে কিনেছি। শশুরবাড়ির লোকেরা দেখে নিশ্চয়ই ’থ’ বনে যাবে। যাবে না ? মেয়েপক্ষের ক’জন উপযাচক হয়ে এত দামী জিনিষ উপহার দেয়! 

আরে নেয়াজভাই যে ? তুমি এখানে কোত্থেকে? চিন্তার বেড়াজাল চিহ্ন করে দেয় সামনে দন্ডায়মান সুন্দরী এক যুবতীর সুরেলা কন্ঠ। হ্যাঁ, আমাকেই উদ্দেশ্য করে বলল মেয়েটি।

তারপর কতকাল পরে বলতো ? কেমন আছ ? ঘনিষ্ট ভঙ্গিতে কাছ ঘেষে দাঁড়ায় তরুণীটি। ছিমছাম গড়ন, অভিজাত চেহারা। একরাশ লাবণ্য সারা অঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। মসৃণ গ্রীবা, উন্নত বক্ষযুগল, ক্ষীণ কটিদেশ আর স্যাম্পু করা আজানুলম্বিত একরাশ কালো চূলের ঝলকানি মিলে তরুণীটি সত্যিই অপরূপা। বিমূঢ় হয়ে মনের আর্শীতে খুঁজতে চেষ্ঠা করি অপরিচিতার মুখ।

একি, একেবারেই ভুলে গেলে ? ডানহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে গুণে গুণে আবারো বিস্ময়মাখানো সুরঃ  মাত্র আট বছরের ব্যবধানে মন থেকে উধাও হয়ে গেলাম ?
দুঃখিত, আমি আপনাকে ........।

থাক, থাক হয়েছে। এখনো তোমার সেই স্বভাব যায়নি দেখছি। আমাকে কথা বলার সুযোগ না  দিয়ে দরজায় অপেক্ষমান ভদ্রলোকের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, আসুন, পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হচ্ছেন আমাদের নেয়াজ ভাই। বিদেশে ভাল চাকুরী করছেন। আর নেয়াজভাই, ইনি হচ্ছেন ডাক্তার অমিতাভ, বিখ্যাত আই স্পেশালিষ্ট। নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। আমি উনার সহকারী, একই হাসপাতালে চাকুরী করছি।

একটুকরো গর্বিত হাসি উপহার দিয়ে ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দেন সৌজন্য বিনিময়ে। তরুণীটি মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলল - ট্রেনেরতো অনেক দেরী। তাছাড়া প্রথমশ্রেণীর এই ওয়েটিংরুমে আমরা মাত্র তিনটি প্রাণী। কফি হলে জমবে ভাল, কি বল ?

উত্তরের অপেক্ষা না করেই একলাফে তরুণীটি বেরিয়ে পড়ল কাছাকাছি ষ্টেশনের কোন এক কফি শপের উদ্দেশ্যে।

ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে বলি, সত্যি বলতে কি আমি আ-স-লে......।

সুতপার সাথে ছাত্রজীবন থেকেই বুঝি পরিচয় ? আমার শুরু করা কথা শেষ না হতেই উত্তরের অপেক্ষায়  ডাক্তার  অমিতাভ।

কথার খেই যেন হারিয়ে ফেলেছি। আবারো কিছু বলতে গিয়ে হ্যাঁ না-র মাঝামাঝি একটি শব্দ বেরিয়ে আসে যা অস্পষ্ট, আড়ষ্ট।

চিনতে পারছিলেন না বুঝি ? পৌঢ় ডাঃ অমিতাভ ডাক্তারী চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন আমাকে। দৃষ্টির প্রখরতা আমাকে যেন চূলছেড়া বিশ্লেষণ করছে। সুতপা নামক তরুণীটির দুর্বলতার কোন আঁচড় অতীতে আমার মনোজগতকে কখনো প্রভাবিত করতে পেরেছিল কিনা তারই প্রতিফলন হয়তো দেখতে চাচ্ছেন ডাক্তার।

ইচ্ছে হল জানিয়ে দেই পরিচয়ের অজ্ঞতার কথা কিন্তু ততক্ষণে কৌতুহলের ভূত মাথায় চেপেছে । দেখা যাক - জল কতটুকু গড়ায় ? বলে উঠিঃ  না, ঠিক সেটা নয়, অনেকদিন পরে দেখাতো, তাছাড়া একটু অন্যমনস্ক হওয়াতে .... বাকীটুকু বিজ্ঞের হাসিতে সমাপ্ত  করলাম।

ওহ, আই সি ....।

সুতপা ফিরে আসে। পেছনে ট্রে হাতে বেয়ারা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সুতপা মেলে ধরে তার আর তথাকথিত নেয়াজভাইয়ের অলিখিত ইতিহাসের কিছুটা অধ্যায়।

আড়চোখে পরখ করি ডাঃ অমিতাভের অভিব্যক্তি। না, সেই অলিখিত ইতিহাসে কোন আগ্রহ নেই ভদ্রলোকের। টিসু দিয়ে ঝাপসা চশমার গ্লাস পরিষ্কারে ব্যস্ত তিনি। দৃষ্টি প্ল্যটফর্মের ফেরীওয়ালাদের দিকে নিবদ্ধ।

জানো নেয়াজভাই, তোমরা বদলি হয়ে অন্যত্র যখন চলে গেলে তারপর আমার জীবনের মোড়টা কেমন করে যে ঘুরে গেল। হঠাৎ বাবা মারা গেলেন একরকম বিনা চিকিৎসায়। মা গত হলেন বাবার দু’বছর পূর্বেই। সিদ্ধান্ত নিলাম মানুষের সেবা করে এ দুঃখটাকে ভুলব। ডিগ্রির পাশাপাশি নার্সিং ডিপ্লোমাও  নিলাম মনের ক্ষত নিরসনে।  মা  বাবার  অকাল  মৃত্যুর  স্মৃতি  শেষপর্যন্ত হাসপাতালের  চাকুরীর  দিকে  ধাবিত করল। চাকুরীর শুরু হতে ডাঃ অমিতাভের সহকারী হিসাবে আছি। কাল সিলেটে একটি বড়ধরণের চোখ অপারেশন করতে স্যারের সাথে যাচ্ছি। স্যার আমাকে শুধু সহকারী হিসাবে দেখেননা, মেয়ের মতই ভালবাসেন।

সহানুভূতি উপচে ওঠে আমার সমগ্র অন্তর জুড়ে। সত্য উদঘাটন করে আত্মপরিচয় তুলে ধরি সে শক্তিটুকু সুতপার কথার যাদুস্পর্শে কোথায় যেন রহিত হল। কেন বলতে পারছিনা ওকে, তোমার কল্পিত নেয়াজভাই আমি নই, আমি এক ভিন্ন সত্ত্বা।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে সময়ের হাত ধরে। রাতের আকাশে তারার মেলা। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে জ¦লমল তারাগুলো হাসছে আকাশের নীল সামিয়ানায়। নিস্তব্ধ রাতের এই প্রহরে প্রাণোচ্ছ্বাস সুতপা তার ষোলকলা মেলে আমাকে এক অনুরাগের আকর্ষণে বন্দী করেছে।

প্রায় পাঁচঘন্টা পর ট্রেন এল। প্রথমশ্রেণীর একটি কেবিনে ওঠে পড়ে ডাঃ অমিতাভ ও সুতপা। দরজা খুলে সুতপা আমাকে আহ্বান জানায়। উঠে পড় নেয়াজভাই, এটা আমাদের রিজার্ভড্‌ কামরা। বুঝতেই  পারছ  আজকাল  রাতে  ভ্রমণ  কতটা  ঝুকিপূর্ণ।  তাইতো  স্যার  কেবিনটা  রিজার্ভ করে রেখেছিলেন আগেভাগেই। সাথে তোমার দু’টো বিদেশী স্যুটকেস। আমাদের কামড়ায় তুমি অনেকটা নিরাপদ থাকবে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে - তাছাড়া তোমার সাথে অনেক কথা জমে আছে। তোমার কথা ভেবে ভেবে আমার কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে, একসময় ভেবেছি যাকে নিয়ে এতো ভাবনা সেতো নাগালের বাইরে। মা তোমাকে কত ভালবাসতেন তা তুমি জান। মৃত্যুর পূর্বে তোমাকে দেখতে চেয়েছিলেন বারবার কিন্তু সে দেখা তার আর হলনা।

ইতস্ততা কাটিয়ে উঠে পড়লাম যদিও প্রথমশ্রেণীর অন্য একটি কামড়ায় আমার নির্দিষ্ট আসন রয়েছে। সুতপা লাগেজ দু’টো টেনে তুলতে আমাকে সাহায্য করে। কিছুক্ষণের মধ্যে এক্সপ্রেস ট্রেনটি খটাস খটাস শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে ছুটতে শুরু করল। কোথাও ফুটে থাকা হাস্নাহেনার মতমাতানো সৌরভ ট্রেনের সরু  জানালাপথে আমাদের কেবিনে প্রবেশ করে পরিবেশকে আরও রোমান্টিক করে দিল।

রাত ক্রমেই গভীর হচ্ছে। তদ্রাচ্ছন্ন ডাঃ অমিতাভ হাই তুলে বললেন আমি আর পারছিনা। আপনারা গল্প করুন এবং কিছু মনে না করলে আমি উপরের সিটে একটু বিশ্রামের আয়োজন করি। অনুমতির অপেক্ষা না করেই তার ফোল্ডিং বিছানা মেলে আমাদের ঠিক উপরে লাগেজের সিটে শোবার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

বিনয় মিশিয়ে বলি, না মনে করব কেন ? ধকলতো আর কম গেলনা। আপনি শুয়ে পড়ুন, আমরা গল্পগুজব করে রাতটা কাটিয়ে দেব। মনে মনে বলি, ডাক্তার তুমি ঘুমিয়ে পড়লে আমি কত যে খুশী হই। দেরী করছ কেন, যত্ত পার ঘুমাও, নাক ডাকিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

সুতপার দিকে তাকিয়ে ঈশারায় বুঝালাম ভালই হল। মুচকী হাসিতে উদ্ভাসিত সুতপার  চোখেমুখে একই অভিব্যক্তি। তারপর দশমিনিটের মত শুনশান নীরবতা। আমরা দু’জন দু’জনার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি, চারচোখের অপলক দৃষ্টি প্রবল অনুরাগের বিকশিত কাননে সুষমা ছড়ায়। বাইরে জ্যোৎস্নার প্লাবন। নীলাকাশ জুড়ে অযুত নক্ষত্রের দীপালী। ট্রেনের সীমিত জানালাপথে ভেসে আসছে ধানী জমিতে খড়পোড়া ধোঁয়ার তীব্র গন্ধ। প্রবাসের কত জ্যোৎস্মামাখা রাতের নিস্তব্ধ প্রহরে একাকী ভালবাসার ডালি সাজিয়ে কল্পনার মানসীকে আহ্বান জানিয়েছি গানে গানে, সে সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে বাতাসের ইথারে কিন্তু আমার মানসকন্যা জ্যোৎস্নার খোলস ভেদ করে আমার কাছে এসে বলেনিঃ এইতো আমি, হাত বাড়িয়ে নাওনা বুকের গভীরে ....।

এবার কতদিনের প্রোগ্রাম নিয়ে দেশে ফিরেছ ? বিয়ের কথা ভাবছ? মৃদু কন্ঠে সুতপা জানতে চায়।

মাস দু’য়েক থাকব। ছোটবোন শান্তার পরইতো আমার সিরিয়াল। তেমন কিছু ঘটলে আরও দু’মাস বাড়িয়ে দিতে পারি। হ্যাঁ, ভাবতেতো হবেই, আর কতকাল সন্যাসব্রত পালন করব বল ?

দু’টো স্যুটকেসে এত কি এনেছ ? সব প্রবাসীদের এই একই বাতিক, দেশে আসতে গেলে দু’তিনটি লাগেজ থাকতেই হবে। কেন, খালি হাতে আসতে পারনা ? বাংলাদেশে কিনা পাওয়া যায় বল ?

একমাত্র ছোটবোন শান্তার আসন্ন বিয়ে উপলক্ষে আসতে হল। ওর জন্য ইচ্ছেমত কিনেছি। ভারী হীরের সেট ছাড়াও অসংখ্য নামীদামী ব্রান্ডের উপহারসামগ্রী। তাছাড়া ওর শশুড়বাড়ির লোক এবং ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজনদের কেউ বোধহয় বাদ যাবেনা। মনের মাধুরী মিশিয়ে দু’হাতে কিনেছি, হিসেব করিনি। যাক্ - শুধু নিজের কেনাকেটার কথাই বলে যাচ্ছি। তুমিতো ফুটে আাছ, বিয়ের ফুল ফুটেনি কেন জানতে পারি?

তোমার মত একজনকে পাইনি বলে ? অপেক্ষার প্রহর গুণেছি। কেন যেন মনে হয়েছিল একদিন না একদিন তোমার দেখা পাব। ছোটবেলায় জ্যোৎস্না রাতে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে দুষ্টামী করে তুমিই প্রস্তাব দিয়েছিলে আমাকে নিয়ে রাজা রাণী খেলতে চাও, কি মনে নেই? তুমি তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী আর আমি তখন সবেমাত্র এইটের ছাত্রী। মেয়েরা যে এইট-নাইনে পড়তেই ইঁচড়েপাঁকা হয়ে যায়। সেদিন থেকে তোমাকে আমার হৃদয়সিংহাসনের সম্রাট বলে ভাবতে শুরু করেছিলাম। লজ্জ্বারাঙ্গা সুতপা মুখায়োববে আবীরের রং ছড়িয়ে বলে, কি - এখনো আমাকে রাণী সাজাতে স্বাধ জাগে?

উত্তরের ভাষা আমার জানা নেই কারণ সুতপা নামক কোন মেয়ে আমার শৈশবের খেলার সাথী কখনো ছিলনা কিংবা আমি ওর কল্পিত নেয়াজভাইও নই। তাহলে কি সত্যিটা প্রকাশ করে দেব ? না, তা হয়না। সেটা করলে এ মূহুর্তে আমার সকল অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। সুতপা কষ্ট পাবে। তারচেয়ে এই ভাল শান্তার বিয়ের পালা সেরে সুতপাকে টেনে হিঁচড়ে মায়ের কাছে নিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে সত্যটা প্রকাশ করব। সুতপা নিশ্চয়ই আমার মত একজনকে পেলে খুশীই হবে। মেনে নিবে অকাতরে।

গাঢ় ঘুমে ডাঃ অমিতাভের নাক ডাকছে জ্যান্ত ষাড়ের ন্যায়। পাশে উপবিষ্ট সুতপা। শত শাসন উপেক্ষা করে নিজের অজান্তে ওর কোমল মসৃণ হাতটি টেনে নিলাম আমার হাতের মুঠোয়। মুখের কথাগুলো কন্ঠনালীতে আটকা পড়ে আকুলি-বিকুলি করছে। স্পষ্ট শুনতে পারছি ওর বুকের গভীরে  হৃৎপিন্ডের স্পন্দন। কাঁপছে তার দেহবল্লরী। কোমল হাতটি ছাড়িয়ে নিতে ওর কোন ইচ্ছা নেই বরং আত্মসমর্পনের উচ্ছ্বাস নিয়ে ক্রমেই সে এলিয়ে পড়ে আমার বাহুডোরে। বাতাসে ওর খুচরো চূলগুলো আমার গলা পেঁচিয়ে আছে। এ মূহুর্তে সুতপা একান্তই আমার আর আমি ওর হারিয়ে যাওয়া নেয়াজভাই, এরচেয়ে বেশীকিছু আমি জানতে চাইনা।
 
এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানিনা। সুতপার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমার কাঁধে এলিয়ে পড়া ওর কপোলে আলতো একটি চুম্বন এঁকে দিয়ে বলি, চানাচুর খাবে ? শুকনো মুখে আর কত বকবক করব।

না, বড্ড ঘুম পাচ্ছে, রাত চারটা বাজে। 

এমন স্বপ্নালু রাতে কি ঘুমিয়ে কাটানো উচিত?

একসময় সুতপা আমার হাতের মুঠো থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসে। ব্যথা পেলাম। ওর যেন কোন অধিকার নেই নিজেকে সরিয়ে নেবার। হাই তুলে পুনরায় বলল, তুমি শুয়ে পড়। আমি তোমার চূলে বিলি কেটে দিচ্ছি।

চূলে বিলি কেটে দেবার প্রবল লোভ আমাকে স্থির থাকতে দিলনা। পরণের জ্যাকেটকে বালিশ বানিয়ে এক মূহুর্ত দেরী না করে শুয়ে পড়লাম ওর সুডৌল উরুতে। ওর মসৃণ আঙুলের সেবা পাওয়ার এক প্রবল নেশা আমার নাদুস নুদুস দেহের কোষে কোষে নূতন করে উন্মাদনা ছড়ায়।

সুতপার কোমল আঙুল আমার চূলের গভীরে। বুদ হয়ে নেশাগ্রস্থের মত পড়ে রইলাম। এ আমার পরম সৌভাগ্য। এত সুখ এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল ? তৃপ্তির মহানন্দে আমি বাকহারা, শিরায় শিরায় শিহরণ জাগানো আবেশের মুগ্ধতায় আমি ধন্য। ওর হ্যান্ডব্যাগ হতে ছোট্ট একটি সেন্টের শিশি বের করে পরম আদরে আমার মুখমন্ডলে মাখিয়ে দেয়। বাতাসে ভেসে আসা ট্রেনের ডিজেল পোড়া প্রকট গন্ধ আমাদের উভয়ের সান্নিধ্যকে যেন ব্যহত করতে না পারে তারজন্য হয়তো এ আয়োজন। আমার নাসারন্দ্রে সেন্টের প্রকট গন্ধে কিছুক্ষণের মধ্যে মগজে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে, ঘুমের আবেশে দু’চোখ মুদে আসে ইচ্ছার বিরুদ্ধে। 

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানিনা। ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকে যখন ঘুম ভাঙলো তখন একফালি রোদ জানালা ভেদ করে চোখেমুখে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। হকচকিয়ে উঠে বসে নিশীথের সুতনুকা সুতপা এবং ডাক্তার অমিতাভের অস্থিত্ব উপলব্ধির চেষ্ঠা করলাম কিন্তু কামড়াতে আমি ছাড়া কারোর অস্থিত্ব নেই। একপ্রেস ট্রেনটি ততক্ষণে শ্রীমঙ্গল ষ্টেশন ছেড়ে খটাস খটাস শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে এগিয়ে চলছে গন্থব্যের সন্ধানে। মেঝেতে রাখা আমার দু’টো স্যুটকেসের অস্থিত্ব খুঁজে পেলামনা। বালিশ বানিয়ে ঘুমুতে যাওয়া জ্যাকেটে সংরক্ষিত  মানিব্যাগটিও  যথাস্থানে  নেই।

ঘটনার আকস্মিকতায় চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বহমান বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম প্রাণ ভরে, সে নিঃশ্বাসে ছিলনা বৈষয়িক কিছু হারানোর বেদনা, ছিল বিশ্বাসের বেদীমূলে ঠুকরানো একরাশ যাতনা।

**************************

Thursday, August 8, 2019

কুকুর বিভ্রাট (প্রতিবেদন)

কুকুর বিভ্রাট
-নাজমুল চৌধুরী


বাসার সন্নিকটে আসতেই গেটের সামনে লোকজনের ভিড় ঠেলে দেখতে পেলাম আমার কাজের মেয়ে নাজমার মা অর্থৎ সকিনা তার নাতিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। জানতে চাইলাম কি হয়েছে তোমার?  কেউ মেরেছে? আর তোমার নাতিকে জড়িয়ে আছ কেন? নয়দশ বছর বয়সের নাতি আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে নানাজান আমাকে পাগলা কুকুর কামড় দিয়েছে। নাজমার মা এবার আমার দিকে তাকিয়ে উৎকন্ঠিত স্বরে বলে একটা দু’টো নয়, তিন তিনটে কামড়! উরুতে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে হারামজাদা কুকুর। এখন কি হবে ওর ? কুকুরের বাচ্চা পেটে জন্মাবে আর নাতিটি মারা যাবে, মেয়ের কাছে কি জওয়াব দেব? 

বললাম, ওকে নিয়ে বাসায় যাও। দেখি কি করা যায়?  জানতে চাইলাম তোমার মেয়ে নাজমা কোথায়? 

ও তো সেই সাতসকালে গার্মেন্টের কাজে গেছে, ফিরতে বিকেল হবে। এসে যখন দেখবে ছেলেটিকে কুকুর কামড়েছে তখন কি আর আমাকে আস্ত রাখবে। নাতিটিকে ওর বাপের কাছে রেখে আপনাগোর বাসায় কাজে এসেছিলাম কিন্তু আমার খুঁজে নাতিটি আপনাদের বাসার গেটের কাছে আসতেই ঘটে গেল ব্যাপারটি। পাগলা কুকুরটি ছোটমানুষ পেয়ে কামড় বসিয়ে দিল। বোধহয় নাতিটি ইটপাটকেল ছুঁড়েছিল।

ঠিক আছে, এখন কি আর করা যায়। কুকুরের পায়ে তো প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কামড়ানো যাবেনা। বাসায় গিয়ে ডেটল দিয়ে ক্ষতস্থানগুলো ভালভাবে পরিষ্কার কর। এখনই যেতে হবে মহাখালী চিকিৎসা কেন্দ্রে। আমি গাড়ি বের করছি। তুমি তাড়াতাড়ি ওকে রেডি করে নিয়ে আস। 

ঢাকার মহাখালী পশুর কামড়ের প্রতিষেধক চিকিৎসা কেন্দ্র আমার বাসা হতে প্রায় বিশ কিলোমিটারের পথ। নানী-নাতীকে নিয়ে মানবিক কারণে অগত্যা ছুটতে হল। পৌঁছতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেল। ইমারজেন্সীর ডাক্তারের কাছে ব্যাপারটি বলার পরপরই ডাক্তার একটি প্রতিষেধক ইনজেকশন দিয়ে বললেন ছেলেটিকে চৌদ্দটি ইনজেকশন দিতে হবে প্রতি তিনদিন পরপর। নিয়ে আসতে পারবেনতো? দেখুন অবশ্যই তিনদিন পরপর নিয়ে আসতে হবে নতুবা ইনজেকশনের কর্মক্ষমতা লোপ পাবে এবং ছেলেটি মারাও যেতে পারে। 

নাজমার মা অর্থাৎ সকিনাকে বললাম, প্রতি তিনদিন পরপর নিয়ে আসতে হবে তোমার নাতিকে, এতে অন্যথা হলে তোমার নাতির বিপদ ঘটতে পারে। 

কাঁদো কাঁদো স্বরে নাজমার মা বলল ঠিক আছে সাহেব, আমি বাসে চড়ে নাহয় ওকে সময় সময় নিয়ে আসব। কপাল খারাপ নতুবা এমন হবে কেন? 

ডাক্তার একটি কার্ড দিলেন এবং ইনজেকশনের তারিখগুলো কার্ডে লিখে দিতে ভুললেননা। ধন্যবাদ জানালে বললেন, দেখুন প্রতিদিন এখানে কুকুরের কামড়ানো বিশপঁচিশটি রোগী আসে। এইতো কিছুক্ষণ আগে একজন পরিবেশবাদী নেতার ছেলে ও একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলারের ছেলেকে একই কারণে ইনজেকশন দিয়েছি।   

প্রত্যুষে হাঁটা আমার নিয়মিত অভ্যাস। প্রতিদিন দুই কিলোমিটার হাঁটতে হয় কারণ পরীক্ষা করে ডায়াবেটিকের লক্ষণ শেষপ্রান্তে উঠানামা করছিল। তাছাড়া চাকুরী হতে অবসর নেয়ার পর হাঁটাচলা কম বলে শরীরে রক্ত চলাচলও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।  বাসার সামনেই পিচঢালা আঠারো ফিট পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে প্রতিদিন দেখা হয় একপাল কুকুরের সাথে। দলের মধ্যে কোন কোন সময় চল্লিশ পঞ্চাশটিও থাকে। খুব সাবধানে ওদেরকে অতিক্রম করতে হয়। সমগ্র রাস্তা জুড়ে ওদের বিচরণ, কামড়া-কামড়ি, ধস্থাাধস্থি, ঘেউ ঘেউ করে একজনের পেছনে আরেকজনের ধাওয়া দেখতে দেখতে আজকাল অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। অনেক সময় লজ্জা-সম্ভ্রমের মাথা খেয়ে রাস্তার মাঝখানেই রতিলীলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের অনেকেই। অপেক্ষমান যুবক কুকুররা তাদের পালার অপেক্ষায় ঘেউ ঘেউ শব্দে দ্রুত সমাপ্তির আহ্বান জানায়। পথিকরা উৎসুক দৃষ্টি প্রসারিত করে রতিলীলা উপভোগ করে। দুষ্ট ছেলেরা রতিলীলার বিচিত্র টানাটানি দেখে ইট-পাটকেলও ছুঁড়তে দ্বিধা করেনা। বয়স্করা নিম্নদৃষ্টিতে তড়িগড়ি করে পালিয়ে বাঁচে। প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়ে পরা মহিলারা এরূপ দৃশ্য দর্শনে লজ্জায় মাথার কাপড় টেনে দ্রুত স্থান ত্যাগে তৎপর হয়ে উঠে।  

ব্রিটিশ ভারতে ১৯২০ সালে পশু-পক্ষীদের উপর অমানবিক আচরণ করার বিপরীতে একটি আইন পাশ হয় ১৯২০ সালে, যা ১৯৪৭ সাল হতে পাকিস্তানের আইনের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ আইন অনুসারে পশু-পক্ষীর সাথে অমানবিক আচরণ বা অন্যায়ভাবে হত্যা করলে এবং হত্যাকারীর বিরুদ্ধে মামলা হলে, হত্যাকারী নিজের দোষ স্বীকার করলে মাত্র ২০০/- টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়া পাওয়ার বিধান ছিল। পাখী শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেক আইনপ্রণেতারাও পাখী-শিকারে অভ্যস্থ ছিলেন। কুকুরের উপদ্রব হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য কুকুর-বিড়াল হত্যা করার উপরও আইনের তেমন কোন প্রয়োগ ছিলনা। বিশেষ করে ক্ষেপা কুকুর মারার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা হত। 
 
২০১৫-২০১৮ সালের মধ্যে অহেতুক পশু নিধনের কারণে পশু-অধিকার সংরক্ষণ সংগঠনের পক্ষ হতে মাত্র তিনটি মামলা রুজু করা হয়। কিন্তু সকল মামলা প্রয়োজনীয় সাক্ষী এবং দুর্বল আইনের কারণে স্থগিত হয়ে যায়। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ”পশু-পক্ষী অভয়ারণ্য সংগঠনের” উদ্যোগে ঢাকার রামপুরায় একটি কুকুর হত্যার দায়ে মামলা হলে তিনজন মানুষকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং এই প্রথমবারের মত কুকুর হত্যার দায়ে মামলা এবং মামলার প্রেক্ষিতে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা নিজেদের দোষ স্বীকার করে জনপ্রতি মাত্র ৩০০/- করে জরিমানা দিয়ে ছাড়া পায়।  
  
পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মীদের আন্দোলনের চাপে সরকার পক্ষ হতে সাম্প্রতিককালে পশু-পক্ষী, কুকুর বিড়ালের উপর অমানবিক আচরণের নিমিত্তে শাস্তির বিধান রেখে কঠোর আইন প্রণয়ণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শাস্তিমূলক আইনের এ বিধানে পশু-পক্ষী হত্যার অপরাধে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা ও উর্ধ্বে দু’বছরের জেল কিংবা উভয়প্রকার শাস্তির বিধান রাখা হয়। কিন্তু এ বিধানও কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণ হওয়াতে পশু-অধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয় অনেক সময় পশুর অপ্রত্যাশিত ব্যবহারের কারণে মানুষও আঘাতপ্রাপ্ত কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ হয় সুতরাং পশু-পক্ষীদের অভয়ারণ্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ প্রয়োজন উপলব্ধি করে সরকার বৃহত্তর সিলেটের হাওরাঞ্চল ও বনাঞ্চল, খুলনার সুন্দরবন, ভোলার সন্নিকটে নিঝুম দ্বীপ এবং চট্রগ্রামের কিছু কিছু বনাঞ্চল পশু-পক্ষীর অভয়ারণ্য হিসাবে সংরক্ষণ ও শিকার নিষিদ্ধ করে। 

আইন মেনে চলার কারণে আজকাল কুকুর-বিড়ালের উৎপাত ক্রমশ: বেড়েই চলছে। একটি সমীক্ষায় দেখা যায় বাংলাদেশের ষোলকোটি মানুষের বিপরীতে কুকুর-বিড়ালের সংখ্যার সঠিক তথ্য নেই। তবে অনুমান করা যায় এ সংখ্যা ক্রমেই বিপদসীমা অতিক্রম করবে। মানুষের চেয়ে একটি কুকুর বছরে ছয়মাস অন্তর চার-পাঁচটি করে বছরে দু’বারে আট-দশটি বাচ্চা প্রসব করে। বিড়ালও বছরে সমপরিমাণ বাচ্চা প্রসব করে। অথচ মানুষ বছর-দু’বছরের ব্যবধানে প্রসব করে মাত্র একটি বাচ্চা। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ূ ৭২ বছর। এই আয়ূর মধ্যে একজন মহিলা ১৩-৩৫ বছরের মধ্যে ১০-১২টি সন্তান প্রসবে সক্ষম। এ সংখ্যাটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কারণে আজকাল ২-৫ টি সন্তানের জন্ম দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ কুকুর কিংবা বিড়ালের মানুষের মত কোন সীমাবদ্ধতা নেই বলে তাদের গড় আয়ূ ১০-১৫ বছরের মধ্যে মানুষের চেয়ে শতকরা ১৩% বেশী সন্তান প্রসবে সক্ষম। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার চেয়ে আনুপাতিক হারে কুকুর-বিড়ালের সংখ্যা একসময় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

আমেরিকার বে-সরকারী গবেষণা সংস্থা ((Dogbite org. & trauma center studies) তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে উল্লেখ করে যে ২০০৫-২০১৮ সালের মধ্যে  গৃহপালিত কুকুরের অক্রমণে ৪৭১ জন মানুষ আমেরিকায় মারা যায়। 

প্রতিদিন আমেরিকায় প্রায় ১০০০ জন মানুষ কুকুরের কামড়ের শিকার হন এবং বছরে ৯,৫০০ জন হাসপাতালে আহত অবস্থায় ভর্তি হন। ইউরোপ ও আফ্রিকার খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশগুলোতে লোকসংখ্যার আনুপাতিক হারে প্রতি বছর গৃহপালিত কুকুরের আক্রমণের কারণে লোকজনের হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর রেকর্ডকৃত জরীফে দেখা যায় শুধু আমেরিকাতেই ১৯৯৬ সালে গৃহপালিত ৬৬,৩০,০০০ কুকুর এবং বিড়াল বাচ্চার জন্ম হয়েছে, তন্মধ্যে ১০০০টি কুকুরের বাচ্চার মধ্যে ৮ টি এবং বিড়ালের বাচ্চাদের মধ্যে ৮.৫ টি প্রসূতি ঘরে মারা গিয়েছে। 

কুকুর-বিড়াল এবং মানুষের তূলনামূলক জন্মের হার ঃ 

জাপানে কুকুরের জন্মহার আমেরিকা ও ইউরোপের তূলনায় অনেক বেশী। জাপানে মানুষের জন্মহার ১০০০ মানুষের বিপরীতে ৭.৮৭ জন। অন্যদিকে আমেরিকাতে হাজারে ১৪.৪, অস্ট্রেলিয়াতে হাজারে ১২ এবং যুক্তরাজ্যে হাজারে ১২ জন মানবসন্তান জন্ম নেয়। প্রতি হাজারে গড়ে ৪২-৪৫ জন জন্ম নেয় আফ্রিকার  এঙ্গোলা, নাইজার, মালি, উগান্ডা, জাম্বিয়া, বুরুন্দি, বুকিনি ফ্যাসো, মালায়ি, সুদান এবং সোমালিয়ায় এবং এশিয়ার আফগানিস্থান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ২৩-৩৫ জন। 

কুকুর-বিড়াল যৌবনে উপনীত হওয়ার প্রথম ৫ বছরে ৪০-৪৫টি সন্তান প্রসবে সক্ষম। পক্ষান্তরে আমাদের মহিলারা আনুপাতিক হারে বিয়ের প্রথম ৫ বছরে গড়ে তিনটি সন্তান এবং ১৩-৩৫ বছরের মধ্যে ১০-১২টি সন্তান প্রসব করতে সক্ষম। তবে বর্তমান জমানায় অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আনুষাঙ্গিক চাপের কারণে পরিবার পরিকল্পনার গ্রহণের মাধ্যমে কিংবা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমাদের সমাজে নর-নারীরা গড়ে ২টি সন্তানের পিতামাতা হতে আগ্রহী। এতে সহজেই অনুমেয় যে, সময় সন্ধিক্ষণে আমাদের দেশে মানুষের তূলনায় কুকুর-বিড়ালের সংখ্যা বেড়ে যাবে অনেকগুণ। বিশেষায়িত হাসপাতালে কুকুরে কামড়ানো প্রতিষেধক অপ্রতুল থাকার কারণে আমাদের সময়মত সু-চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভবপর হচ্ছেনা। 
 
এমতাবস্থায় ভবিষ্যত পরিকল্পনা হিসাবে আমাদের কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশ অথচ লোকসংখ্যা প্রতি বর্গমাইলে ১২০০ এর উপরে। লোকসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ছে অথচ নদীভাঙ্গন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। জমির তূলনায় মানুষের আধিক্য বেশী থাকায় এদেশ ক্রমেই বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যদি কুকুর-বিড়াল প্রজাতি প্রতি বছর ১৩% হারে বাড়তে থাকে তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরে কুকুর-বিড়াল শুধুমাত্র কামড়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা, সুযোগ পেলে বন্য কুকুরের মত জীবন্ত মানুষকে শিকার করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ে তাদের উদর পূর্ণ করবে।

অনাগত ভবিষ্যতের এহেন পরিস্থিতিতে এখনই সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে হবে নতুবা কোনক্রমেই বিপদ এড়ানো সম্ভব হবেনা। পরিবেশবাদীরা কি ভাবছেন তাদের উত্তরসূরীরা এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে কি করবে? 

হ্যাঁ - আমাদের সামনে একটি পথ খোলা আছে। যদি সরকার এবং পরিবেশবাদীরা  শুধুমাত্র বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের উন্নতির কথা ভাবেন তাহলে কচ্ছপ এবং ব্যঙের মত কুকুরও রপ্তানী করা যেতে পারে। এ পৃথিবীতে অনেক দেশের বেশরিভাগ লোক কুকুরের মাংস ভক্ষণ করে থাকে। যেমন চীন, উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ার নৃগোষ্ঠী, ভারতের নাগাল্যান্ড, সুইটজারল্যান্ড প্রমুখ দেশসমূহ। শুধুমাত্র কুকুরের মাংস ভক্ষণকারী কোরিয়াতে ১৭,০০০ কুকুরের খামার রয়েছে আমাদের দেশের হাঁস-মুরগীর খামারের মত।  চীনে প্রতিবছর ৫০ লক্ষ, কোরিয়ায় ৩৫ লক্ষ, ভিয়েতনামে ৪০ লক্ষ, ভারতের নাগাল্যান্ডে ১৫ লক্ষ, ইন্দোনেশিয়ার নৃগোষ্টীর লোকেরা ১০ লক্ষ এবং সুইটজারল্যান্ডে খ্রিস্টমাসের দিনগুলো কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ কুকুরের মাংস ভোজনের হিড়িক পড়ে যায়। তাছাড়া আফ্রিকার কিছু কিছু দেশের অধিবাসীরা কুকুরের মাংস ভক্ষণ করে থাকে। 

আমাদের নেতা-নেত্রীরা শুধুমাত্র বক্তব্যের মধ্যে আটকে আছেন। বিদেশী ঋণ সহায়তা আমাদের বাজেটের একটি বিরাট অংশ জুড়ে থাকে। অনির্দিষ্ট বিদেশী সাহায্য ও ঋণকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় বাজেট প্রনয়ণ করা হয় এবং বাৎসরিক জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়। জাতীয় উন্নয়নের জন্য বে-সরকারী বিনিয়োগ উদ্যোগ একান্ত জরুরী তাই সরকারকে সেভাবেই চিন্তা করতে হবে। আমাদেরকে স্বাবলম্বী হতে হবে। রপ্তানীমুখী পণ্যের উদ্ভাবন করতে হবে। বে-সরকারী উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে। নতুবা প্রবৃদ্ধির হার কমবে বই বাড়বেনা। যেহেতু আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান এবং সরকারী পৃষ্টপোষকতায় কৃষিভিত্তিক রপ্তানীযোগ্য দ্রব্যাদির উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৎপর হতে হবে। সরকারীভাবে বে-সরকারী খাতে নিম্নলিখিত কৃষিপণ্য উৎপাদনের অবাধ ছাড়পত্র দিতে হবে যাতে কৃষক এবং বিনয়োগকারীরা উৎসাহিত হন এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখেন ঃ


১) যেহেতু পশু-পক্ষী নিধনের বিপরীতে বাংলাদেশে শাস্তিমূলক অপরাধ আইন কার্যকরী, এ কারণে বর্তমানে কুকুর-বিড়ালের প্রজনন বিপদসীমা অতিক্রম করতে চলেছে এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট খাদ্যঘাটতি রয়েছে। এমনও দিন আসবে যখন কুকুররা সংঘবদ্ধভাবে খোলা রাস্তায় মানুষেকে আক্রমণ করবে বন্য কুকুরের মত। এতে বাংলাদেশের স্কুলগামী কোমলমতি শিশু এবং প্রাপ্তবয়ষ্করা নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। তাই রাস্তার নেড়ী কুকুর আধূনিক পদ্ধতিতে ধরে উপরোক্ত দেশসমূহের আমদানীকারকদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে জীবিত অবস্থায় জাহাজ বোঝাই করে রপ্তানীর ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবী যাতে দেশের মানুষের নিরাপত্তা হুমকি প্রতিরোধ করা যায় এবং পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা নিশ্চিত করা যায়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া, সুদান, সোমালিয়া ইত্যাদি দেশ পবিত্র হজ্জের সময় সৌদিআরবে জাহাজ বোঝাই করে লক্ষ লক্ষ কু’রবানীর পশু রপ্তানী করে কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে আসছে। তাহলে আমাদের দেশের রপ্তানীকারকরা কেন পারবেননা ? শুধুমাত্র সরকারী অনুমোদন এবং উৎসাহ পেলে রপ্তানীকারকরা স্ব-ইচ্ছায় এগিয়ে আসবেন বলে বিশ্বাস।  


২) চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশে আমাদের দেশের আনাচে কানাচে, জলাশয়ে এবং কৃষি জমিতে জন্মলাভ করা কোলা ব্যঙ বা ঘাউরা ব্যঙ, কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি এবং কচ্ছপ ঐ সমস্ত দেশে অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার বিধায় রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী এবং কৃষকরা এ ব্যাপারে সরকারী পৃষ্টপোষকতা এবং অনুমোদন ছাড়াই আইনের ফাঁকফোকরে কোলা ব্যঙ রপ্তানী করে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সমর্থ হচ্ছেন। বর্তমানে কেবল গলদা চিংড়ি রপ্তানী হচ্ছে। তাই অবিলম্বে বে-সরকারী উদ্যেক্তাদেরকে অব্যবহৃত জলাশয়ে চিংড়ি ঘেরের মত করে কোলা ব্যঙ, কচ্ছপ এবং কাঁকড়ার ঘের নির্মাণ করে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারীভাবে অনুমোদন ও উৎসাহ প্রদান করা প্রয়োজন যাতে উদ্যেক্তারা নূতন উদ্দমে উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেন।

৩) ঔষধ শিল্পে সাপের বিষ একান্ত জরুরী বিধায় দেশের প্রয়োজনে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাপের খামার গড়ে তোলা প্রয়োজন। সাপের বিষ দেশে এবং বহির্বিশ্বের ঔষধশিল্পে দামী প্রতিষেধক হিসাবে বিবেচিত। আমাদের দেশে বনে-জঙ্গলে অনেক বিষাক্ত সাপ রয়েছে। এগুলো সংগ্রহ করে সাপের খামার গড়ে তোলার জন্য সরকারী পৃষ্পপোষকতা ও অনুমোদন প্রয়োজন। সরকারী অনুমোদন পেলে আমাদের বে-সরকারী উদ্যোক্তারা সাপের খামার গড়ে মূল্যবান সাপের বিষ সংগ্রহে উৎসাহী হবেন বলে বিশ্বাস।সাপের কামড়ের প্রতিষেধক আমাদেরকে বিদেশ হতে আমদানী করতে হয়। যদি উক্ত প্রতিষেধক আমাদের দেশেই সাপের খামার হতে উৎপাদন সম্ভব হয় তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো সম্ভব হবে। 

৪) কুমীরের চামড়া ও মাংসের কদর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে কুমীরের খামার গড়ে তোলার জন্য সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও অনুমোদন প্রয়োজন যাতে উদ্যোক্তারা এ শিল্পে উৎসাহিত হয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, অব্যবহৃত পতিত জলাশয়ে কুমীর উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমাদের কৃষিব্যবস্থায় কিছুসংখ্যক উদ্যোগী কুমীর চাষে আগ্রহী হলেও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ার কারণে চাষীরা  এ শিল্পে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

পরিশেষে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটা বলা যায়, আমাদের সরকার এবং বিরোধীদল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ত। দেশের উন্নয়নের জন্য যা যা প্রয়োজন সে সমস্ত ব্যাপারে উদাসীন এবং শুধুমাত্র রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যেই উন্নয়ন সীমাবদ্ধ। দেশের সার্বিক উন্নয়নে নূতন নূতন রপ্তানী ক্ষেত্র উদ্ভাবন করা এখন সময়ের দাবী।         
     
==========================
    

Wednesday, July 24, 2019

ভারত সরকার কর্তৃক ঘোষিত “তালাক ফৌজদারী অপরাধ” প্রসঙ্গে

নারী-পুরুষের অধিকার
(প্রসঙ্গ: ভারতে ”তালাক-ফৌজদারী অপরাধ”) 
- নাজমুল চৌধুরী


সাম্প্রতিককালে পত্র-পত্রিকায়, ইউ টিউবে, মানবাধিকার সংস্থা এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে ভারতীয় মুসলিম সমাজে ”তালাক - ফৌজদারী অপরাধ” শীর্ষক আলোচনা সমগ্র ভারত সরগরম হয়ে উঠেছে। ভারত সরকার অর্ডিন্যান্স জারীর মাধ্যমে ভারতীয় মুসলিম সমাজে তালাকের মাধ্যমে বিবাহ-বিচ্ছেদকে ”ফৌজদারী অপরাধ” হিসাবে গণ্য করে আইন পাশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। 

মুসলিম ধর্মগ্রন্থে এবং বিধিবিধানে ভুল ধরা কিংবা ভারতের পঁচিশ কোটি মুসলিম জনসাধারণকে হেয় প্রতিপন্ন করা ভারতীয় সরকারের সাংবিধানিক দায়িতে¦র অংশ কিনা তা আলোচনার প্রতিপাদ্য। এক বিশাল মুসলিম জনগোষ্টির ধর্মীয় সত্ত¡ায় কিংবা আচারঅনুষ্ঠানে তাদের জন্য হালাল আমিষ খাদ্য (গো-মাংস) ভক্ষণে কিংবা হিন্দু ধর্মের ”জয় শ্রীরাম” মন্ত্র কিংবা ”বন্দেমাতরম (মাতৃভূমির বন্দনা)” জোরপূর্বক পড়িয়ে নেয়া কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনে বাধাপ্রদান ইত্যাদি বিষয় একধরণের হিংসার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হয়। মুসলিমরা একমাত্র আল্লাহর বন্দনা করে, আল্লাহ সৃষ্ট মাটিকে নয় তাই ”বন্দেমাতরম” উচ্চারণে তাদের আপত্তি। ”বন্দেমাতরম” শব্দটি শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার লেখালেখিতে প্রথমে উচ্চারণ করেন। এ শব্দটি যে হিন্দু ধর্মের কোন প্রবর্তক কিংবা ধর্মীয় গ্রন্থ বেদের নির্দেশ তা কিন্তু নয়। তাই ”বন্দেমাতরম” না বলায় যে ভারতীয় মুসলিমরা দেশপ্রেমিক নন এটা প্রমাণিত হয়না। 

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল সম্প্রদায়ের লোকজনের অবদান অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পাকভারত উপমহাদেশের সকল শ্রেণীর লোকই অংশগ্রহণ করেছিল এবং এ আন্দোলনের ফসল হিসাবে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তবে ব্রিটিশরা ”ডিভাইড এন্ড রোল” মন্ত্রটি ভারতবর্ষের নের্তৃবৃন্দের মগজে এমনভাবে পাকাপোক্ত করে গেছে যে, যার প্রতিক্রিয়া এ উপমহাদেশের অধিবাসীদের রক্তে স্থায়ীভাবে মিশে আছে। এ উপমহাদেশে হাজার হাজার বছর ধরে প্রত্যেক ধর্মের লোকই নিজেদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে আসছে। মুঘল শাসনে ধর্মপালনে পরম সহিষ্ণুতা ছিল এবং কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা ছিলনা।      

পৃথিবীর সর্বত্রই অর্থাৎ ৯৭ টি ধর্মেই এবং শতকরা ৯৯.৯ টি দেশেই গো-মাংস ভক্ষণে বা কে কি খাবে বা না খাবে তার উপর কোন বিধিনিষেধ নেই। এমনকি সাম্প্রতিককালে জাপানের বিশেষায়িত কিছু রেষ্টুরেন্টে সদ্য মৃত মানুষের মাংসসহ নানাধরণের কীট-পতঙ্গ ভক্ষণ করারও সরকারী লাইসেন্স রয়েছে। কোরিয়া, ভিয়েতনাম, চীন কিংবা আফ্রিকার অনেক দেশেই কীট-পতঙ্গ, সরীসৃপ, কুকুর, বিড়াল, শুকর ইত্যাদির মাংসও মানুষ ভক্ষণ করে থাকে এবং এজন্য রেষ্টুরেন্টগুলো সরকারী অনুমোদন পেয়ে থাকে। এমনকি সনাতন হিন্দুধর্মের প্রবর্তক ও পুরোহিত পর্যায়ে গো-মাংস ভক্ষণের রেওয়াজও প্রচলিত ছিল। বর্তমান ভারতে ও বাংলাদেশে অনেক হিন্দুরা গো-মাংস পছন্দ করে থাকেন। ভারতে গো-মাংস নিষিদ্ধ করে যখন আইন পাশ হয় তখনও অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের নের্তৃবৃন্দ এবং আমজনতার কিছু অংশ প্রতিবাদ করেছিলেন এবং তারা নিজেও গো-মাংসে ভুরিভোজন পছন্দ করেন বলে প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন। তারা এও বলেছিলেন হিন্দুধর্মে গো-মাংস ভক্ষণ অপরাধযোগ্য নয়। হিন্দুধর্মের ঋগবেদের ১০ নং গ্রন্থের ৮৬ অনুচ্ছেদের ১৩ পরিচ্ছেদে, মনুশ্রুতির ৫ নং অধ্যায়ের  ৩০-৩১-৩৫ ও ৪২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে তোমরা মাংস খাবে, মাংস উপকারী। প্রাচীনকালে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা গরু বলি দিত এবং গরুর মাংস ভক্ষণও করত। গান্ধী রচিত “হিন্দু ধর্ম” গ্রন্থে বর্ণীত হয়েছে প্রাচীন ব্রাক্ষণরা গরুর মাংস ভক্ষণ করিত। মহাভারতের ৮৮ অনুশাসন পর্বে এবং মনুশ্রুতির ৩ নং অধ্যায়ের ২৬৬-২৭২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে ঈশ্বর বিষ্ণু যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিচ্ছেন তোমাদের পূর্বপুরুষদের প্রয়াত আত্মাকে সন্তুষ্ঠ করতে যদি শাকসব্জি খাদ্য হিসাবে বিতরণ কর তাহলে আত্মা ১ মাস, মাছ দিলে ২ মাস, হরিণের মাংস দিলে ৩ মাস, ভেড়ার মাংস দিলে ৪ মাস, পাঠার মাংস দিলে ৫ মাস, ছাগলের মাংস দিলে ৬ মাস, চিত্রা হরিণের মাংস দিলে ৭ মাস, কালো হরিণের মাংস দিলে ৮ মাস, গরুর মাংস দিলে ১২ মাস, ষাড়ের মাংস দিলে ১২ বছর এবং গন্ডারের লাল মাংস খাওয়ালে তাদের আত্মা অনন্তকাল সন্তুষ্ট থাকবে।

পৃথিবীর খাদ্যসম্ভার মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। প্রত্যেকটি জীবেরই তার পছন্দনীয় খাবার ভোগ করার অধিকার মহান সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন। শুধুমাত্র ভারতেই এর ব্যতিক্রম। সাম্প্রতিককালে গো-মাংস ভক্ষণের বা বহনের অপরাধে কিংবা প্রতিহিংসার কারণে মিথ্যে অপবাদে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অনেক মুসলিম নাগরিককে প্রাণ দিতে হয় অথবা শারিরীকভাবে লাঞ্চনার শিকার হতে হয়। ভারতে অসংখ্য ধর্মবলম্বীদের বসবাস, তাদের খাদ্যদ্রব্যের মেনু নিয়ে সরকার বা হিন্দু জনতা কখনো মাথা ঘামায়নি বা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার প্রমাণ নেই অথচ শুধুমাত্র মুসলিম নাগরিকদের অধিকারের উপর সরকার কিংবা মৌলবাদী হিন্দুদের খর্গহস্ত কেন তা বোধগম্য নয়।     

”তালাক ফৌজদারী অপরাধ” - ভারত সরকার কর্তৃক এ অর্ডিন্যান্স জারী প্রসঙ্গে কিছু কথা ঃ

এ অর্ডিন্যান্স জারির প্রাক্কালে ভারত সরকার কি কোন মুসলিম ধর্ম বিশেষজ্ঞ কিংবা মুসলিম ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কু’রআনে বিশদভাবে বর্ণিত বিধিবিধানের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন নাকি চোখ-কান বন্ধ করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে একটি শৃঙ্খলিত ধর্মের অনুশাসনকে অবজ্ঞা করে এ ধরণের অনধিকার চর্চার প্রয়াস চালিয়ে আসছেন তা ভারতীয় এবং পৃথিবীব্যাপী মুসলিম সমাজে আজ প্রশ্নবিদ্ধ। 

একথা অনস্বীকার্য যে, ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলা সকল ধর্মের মানুষের মৌলিক অধিকার, এটাকে পরিবর্তন করার অধিকার কোন সরকার বা ব্যক্তিবিশেষের নেই। কারণ ধর্ম মানুষ পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে পালন করে আসছে এবং যুগে যুগে মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রেরিত ধর্মপ্রবর্তকদের মাধ্যমে সেই সময়ের মানুষকে ধর্মপালনের বিধিবদ্ধ নিয়মে বিধাতার গুণগান, সমাজের মধ্যে বৈষম্য, হিংসাবিদ্বেষ, লোভ, পরশ্রীকাতরতা, সামাজিক অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ রাখার প্রয়োজনে সে সমস্ত জনগোষ্টির জন্য ধর্মপ্রচার করে গেছেন। পবিত্র কু’রআনে মহান আল্লাহ বলেছেন : আমি প্রত্যেক দেশে, প্রত্যেক জাতি ও সমাজের কাছে বার্তাবাহক পাঠিয়েছি যাতে তারা বলতে না পারে আমাদেরকে পূর্বে হুশিয়ার করা হয়নি।  

মানুষের জন্যই ধর্ম এবং ধর্ম যুগে যুগে প্রবর্তিত হয়েছে। যেমন হিন্দু ধর্ম প্রায় পাঁচহাজার বছরের পুরানো, বৌদ্ধ, মসীহি (ইয়াহুদ) ও ঈসায়ী (খ্রিষ্ট) ধর্ম প্রচারের সময়কাল দু’হাজার পাঁচশত থেকে তিনহাজার পাঁচশত বছরের মধ্যে এবং সর্বশেষ ইসলাম প্রায় পনরো বছরের পুরানো।

তাই সকল ধর্মেই সমাজে নর-নারীর অধিকার সজ্ঞায়িত করা হয়েছে যা শুধু সেই সমাজের বা সেই ধর্মের জন্যই প্রযোজ্য। সকল ধর্মেই নর-নারীর অধিকারের সীমা নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, যদি কোন ধর্মে নর-নারীর সামাজিক অধিকারের প্রশ্নে কোনরূপ বৈষম্য থাকে কিংবা কোন ব্যাপারে ধর্ম কোন সমাধান দিতে পারেনা সেক্ষেত্রে ধর্মীয় পুরোহিতগণ ধর্মগ্রন্থ মোতাবেক বিচার বিবেচনা করে একটি সমাধানের পথ বের করেন যা সেই সমাজ মেনে নেয় এবং সেভাবেই ধর্মপালনে ব্রতী হয়। কিন্তু কোন রাজনৈতিক নেতা, গোষ্ঠী বা সরকার তাদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে হাজার হাজার বছরের নিয়মপ্রথা কিংবা ধর্মের চিরাচরিত বিধান পরিবর্তন করে তাদের নিজস্ব মতামতের প্রেক্ষিতে আইন প্রণয়ন করার অধিকার রাখেনা। 


মুসলিম ধর্মে তালাকের বিধান এবং নারী অধিকার প্রশ্নে ধর্মগ্রন্থ আল-কু’রআনে বিশদভাবে বর্ণনা ব্যক্ত করা হয়েছে যা অন্যান্য ধর্মের সাথে ত‚লনা করলে দেখা যায় ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যে ধর্মে নারীদের অধিকার সুষ্টভাবে বন্টন করা হয়েছে। 

আসুন মুসলিম ধর্মে নারী-পুরুষের অধিকার নিয়ে যে সমস্ত বিধিবিধান রয়েছে সে সমস্ত বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যাক।

পবিত্র কু’রআনে বলা হয়েছে ঃ  ”তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের সাথে শান্তিতে বসবাস করতে পার এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাদি রয়েছে। (সুরা রুম ঃ ২০)”

”তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ (সুরা বাকারা ঃ ১৮৭)”

রাসুল (সঃ) বলেছেন  তোমাদের মধ্যে বেশী উত্তম সে, যে নিজের স্ত্রীর কাছে উত্তম আর আমি আমার স্ত্রীদের কাছে উত্তম (বুখারী ও মুসলিম)।

পারিবারিক জীবনগঠনের কয়েকটি উদ্দেশ্য রয়েছে।

এক ঃ নৈতিক চরিত্রের এবং সতীত্বের হেফাজত।

দুই ঃ পারস্পরিক ভালবাসা ও আন্তরিকতা।

তিন ঃ আদর্শ পরিবার গঠন এবং এ পরিবারের মাধ্যমে জন্ম নেয়া বংশধরগণ দেশ, জাতি ও সমাজগঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করবে এবং একটি আদর্শ সমাজ ও সরকার গঠন করবে।

পবিত্র কু’রআনের বিভিন্ন সুরায় মানবজাতির জীবনবিধানের কথা উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে বেশীরভাগ সুরাতেই পারিবারিক জীবনের বিষয়, যেমন : বিবাহের মাধ্যমে সম্পর্ক, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তান পালন, স্ত্রীর ভরণপোষণ, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও কর্তব্যের কথা রয়েছে। 

রাসুল (সঃ) এর হাদীসে উল্লেখ আছে ”তালাকপ্রথা আল্লাহর কাছে হালাল বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত বস্তু। কোন মহিলাকে তার স্বামী অন্যায়ভাবে তালাক দিলে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠে।” 

তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিয়মের ভেতর সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসাবে তালাক প্রযোজ্য। তবে এ ক্ষেত্রগুলোর ব্যাপারে কমসংখ্যক লোকই অবহিত। ধর্মের বিধিবিধান না জানার কারণে বা অজ্ঞতাপ্রসূত তালাকের কারণে অনেকর সাজানো সংসার নষ্ট হয়ে যায়।

ইসলাম যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিধান দিয়েছে সেখানে নিজেদের মধ্যে ভুলবুঝাবুঝি, ঝগড়াবিবাদ নিষ্পত্তির পথও বাৎলে দিয়েছে। পবিত্র কু’রআন ও হাদিসের বিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে সমস্যা সমাধানে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকেনা।
 
রাগের মাথায় অনেকে অতি তুচ্ছ কারণে ঝগড়াবিবাদকে কেন্দ্র করে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেয়। তিনতালাক দিয়েই বিবাহবিচ্ছেদের পরিসমাপ্তি ঘটায়। অথচ ইসলাম এ ধরণের তাৎক্ষণিক তিন তালাক সমর্থন করেনা।
 
আমি ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পবিত্র কা’বা শরীফের ঈমাম ডঃ সালেহ বিন হুমাইদ কর্তৃক প্রদত্ত জু’মার খুতবায় তালাকের বিধান সম্পর্কিত বয়ানের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি। তিনি তার খুতবার ভাষণে বলেছেন ঃ      

ক) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতভেদের কারণে তালাক শব্দ প্রয়োগ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। মানসিক উত্তেজনা ত্যাগ করে বিভেদের মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের কোন কাজ বা আচরণ পছন্দ নাও হতে পারে কিন্তু তাই বলে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। স্ত্রীর কোন কাজ পছন্দ না হলে তার সাথে দুর্ব্যবহার করা যাবেনা। 

পবিত্র কু’রআনে সুরা নিসার ১৯নং আয়াতে বলা হয়েছে ঃ ”স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। যদি তোমরা তাদের কোন কাজ অপছন্দ কর তাহলে মনে রাখবে যে, তাদের অনকে বিষয় তোমাদের পছন্দ হয়না কিন্তু আল্লাহ এর মধ্যে তোমাদের জন্য মঙ্গল রেখেছেন।” 

খ) যদি স্ত্রীর বাস্তবিক কোন গর্হিত ত্রুটি ধরা পড়ে বা তিনি যদি স্বামীর সাথে অবাধ্যমূলক বা পছন্দের পরিপন্থী আচরণ করেন, এমতাবস্থায় তাকে তালাক দেওয়ার কথা এমনকি আকারে ইঙ্গিতেও তালাক শব্দ ব্যবহার করা অন্যায়। সুরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে পবিত্র আল্লাহ বলেছেন ঃ ”তোমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে তাদের আচরণে যদি আশংকা জাগে তাহলে তাদেরকে উপদেশ দাও। উপদেশ দেওয়ার নিয়ম হচ্ছে ন¤্রভাবে বুঝানো। স্নেহমমতার ভাষায় তার ত্রæটিগুলো ধরিয়ে দিতে হবে এবং এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতে হবে।” 

গ) আয়াতের দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছে নম্রভাবে ভুল সংশোধনের ব্যাপারে যদি স্ত্রী সংশোধিত না হয় তাহলে তার বিছানা আলাদা করে দাও। এ পর্যায়েও যদি কাজ না হয় তাহলে তাকে ভিন্ন রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে। এ পদ্বতিতে একাকীত্বের কারণে স্ত্রীর মনে শুভ চিন্তার উদয় হতে পারে এবং অনুশোচনা জাগতে পারে। বিছানা আলাদা করে দেওয়া মানে ঘর থেকে বের করে দেওয়া নয়। স্ত্রীর প্রতি অরোপিত শাস্তির কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করাটাও জায়েজ নয় যেহেতু এটি স্বামী-স্ত্রীর আভ্যন্তরিণ ব্যাপার। 

ঘ) এরপরও যদি স্ত্রী অবাধ্যতার ব্যাপারে জেদ ধরে তাহলে তাকে মৃদৃ প্রহার করবে তবে এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে এ প্রহারে সীমালঙ্গিত না হয় অর্থাৎ স্ত্রীর কোন অঙ্গহানি বা মারাত্মক শারিরীক ক্ষতি না হয়।

ঙ) এতদসত্তে¡ও যদি স্বামীর আনুগত্যে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে পরবর্তী পর্যায় সমঝোতা বা মধ্যস্থতার পথ খোলা রাখা। এ পদ্ধতি সম্মন্ধে কু’রআনে বর্ণিত সুরা নিসার ৩৫নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে ঃ ”যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভাঙ্গনের আশংকা দেখা দেয় তাহলে এ পর্যায়ে স্বামীর পক্ষ থেকে একজন এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন সালিশ উপস্থিত কর। যদি তারা মধ্যস্থতায় উপনীত হয় তাহলে আল্লাহ তাদের মধ্যস্থতাকারীদের এবং তাদেরকে সাহায্য করবেন।” 

চ) সব ধরণের উপদেশ ও যাবতীয় পদ্বতি অবলম্বন করা সত্ত্বেও যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা সম্ভব না হয় এবং স্বামী-স্ত্রীর পরিবারের লোকজনের সকল চেষ্ঠা ব্যর্থ হয় তখনই তালাকের আশ্রয় নিতে হবে। 

এ হচ্ছে পবিত্র কা’বা শরীফের ঈমামের জুমার নামাজে প্রদত্ত তালাক সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ভাষণের অংশবিশেষ। 

এখন আসা যাক্ ইসলামে তালাকের বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য যা মুসলিম ধর্মে এবং মুসলিম সমাজে প্রযোজ্য।

একান্তই বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে যদি তালাক দিতে হয় তাহলে অবশ্যই নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে নতুবা ইসলামের দৃষ্টিতে তা বৈধ বলে গণ্য হবেনা।

১)প্রথমে স্ত্রীকে এক তালাক দিতে হবে এবং একমাস পর্যন্ত এক তালাক অবস্থায় ছেড়ে দিতে হয়। এ অবস্থায় তাকে ঘর থেকে বহিষ্কার করা যাবেনা বরং স্ত্রী তার স্বামীর বাড়িতেই অবস্থান করবে। উভয়ের সম্পর্ক পূর্বের মতই বহাল থাকবে বটে তবে ক্ষণিক সময়ের জন্য তাদেরকে আলাদা থাকতে হবে যাতে স্ত্রী বা স্বামী নিজেদের মনোভাব পরিবর্তন করার সুযোগ পান। একমাসের মধ্যে স্ত্রী সংশোধিত হলে স্বামী পুনরায় নিজের কাছে গ্রহণ করে নিতে পারবেন।

২)যদি একমাস পেরিয়ে যায় এবং স্ত্রী সংশোধিত না হন বা অনুশোচনা না জাগে তাহলে মাসপুর্তির পরপরই তাকে দ্বিতীয় তালাক দেওয়া যাবে এবং এভাবে আরও একমাস এ অবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় মাসের শেষ অবধি পর্যন্ত যদি স্ত্রী সংশোধিত হয়ে স্বামীর ঘর করতে রাজী হন তাহলে স্বামী স্ত্রীকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করাতে কোন আপত্তি নেই। 

৩)এরপরও যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হয় তাহলে পারিবারিকভাবে উভয়পক্ষের মনোনিত ব্যক্তিদ্বয়ের মধ্যস্থতায় সমঝোতার চেষ্টা করতে হবে যাতে বিচ্ছেদের ভয়াবহ পরিণতি এবং ভবিষ্যতের কথা মনে রেখে পুনরায় সংসারে ফিরে আসতে পারে।

৪)মহিলাদের মাসিক রক্তস্রাব অবস্থায় তালাক দেওয়া ইসলামে জায়েজ নহে। 

৫)উপরোক্ত নিয়ম পালন করে যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সংসার করা সম্ভব না হয় তখন স্বামী চূড়ান্ত তালাক বা আরবী পরিভাষায় ”তালাকে মুগাল্লাজা” দিতে পারেন। তবে স্বামী স্ত্রীকে সম্মানের সাথে বিদায় দিতে হবে। স্ত্রীর প্রাপ্য মোহরানা সময়ের ব্যবধানে সমপরিমাণ, অলংকারাদি, পরনের বস্ত্র এবং বাড়তি কিছু সাহায্য দিয়ে বিদায় দিতে হবে। সেজন্য আল্লাহতায়ালা স্ত্রীকে উত্তম পদ্ধতিতে বিদায় দেওয়ার কথা বলেছেন (সুরা বাকারা ঃ ২৩১ এবং সুরা তালাক ঃ ১-২)। 

তালাকের ব্যাপারে ইসলামে স্ত্রীর অধিকারসমূহ ঃ

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্ধ বা বাড়াবড়ি যেমন স্ত্রীর পক্ষ থেকে হতে পারে তেমনি স্বামীর পক্ষ থেকেও হতে পারে। সমাজে বহু বদ-মেজাজী, দুশ্চরিত্র, লম্পট, কপট, যৌতুকলোভী স্বার্থপর স্বামী আছে যারা স্ত্রীর উপর অত্যাচার নিপীড়ন চালায়। অনেক সময় মারধর, খুন এবং এসিড নিক্ষেপ করে অথবা নিঃসম্বল অবস্থায় ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়। এধরণের লোকেরা মুসলিম নামধারী হলেও ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার সম্মন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে সমাজে স্ত্রীদেরকে ক্রীতদাসী মনে করে। স্ত্রী মানেই ঘরের কাজকর্ম করবে, স্বামীর পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের সেবা করবে এরূপ মনমানসিকতা আমাদের সমাজে চালু রয়েছে। বাড়ির মুরব্বীদের খেদমত কিংবা দেবর-ননদের সাথে মতপার্থক্য হলে তার উপর সম্মিলিতভাবে চালানো হয় অত্যাচারের ষ্টীমরোলার। অনেক সময় শশুর-শাশুড়ী, দেবর-ননদরা ছেলের বউয়ের উপর অন্যায়ভাবে অকথ্য নির্যাতন চালায় এবং স্ত্রীকে তালাক দিতে স্বামীকে উস্কানী দেয়। স্বামী স্ত্রীকে মনেপ্রাণে ভালবাসলেও পরিবারের লোকজনের উস্কানিতে স্ত্রীকে অনেকসময় তালাক দিতে বাধ্য হয়। স্বামী স্ত্রী উভয়েই এ কারণে নির্মম পরিণতির শিকার হয়। 

আমাদের মনে রাখতে হবে ইসলামে স্ত্রীদেরকে শুধুমাত্র স্বামীর ভালমন্দ দেখা, সেবা করা এবং সন্তানদের লালনপালন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এর বাইরে উপরোক্ত দায়িত্ব স্ত্রীর দায়িত্বের অংশ নয়। তবে স্বামীর পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, ভাইবোনদের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের ভালমন্দের সাথে একাত্মতা পোষণ করা, স্বামীর পরিবারের উন্নতিতে অবদান রাখা স্ত্রীর মহানুভবতা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে এবং এ কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসা প্রগাঢ় হয়, সুখের সংসার রচিত হয়।

স্বামীর আয়ের উপর স্ত্রীর পূর্ণ অধিকার থাকে। মহান আল্লাহ তাকে এ অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সে অধিকার দেওয়া হয়না। স্ত্রীর হাতখরচের জন্য স্বামীর আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ তুলে দিক এটা মুরব্বীদের পছন্দ নয়। মুরব্বীরা চান ছেলের উপার্জিত সমুদয় অর্থ তাদের হাতে আসুক, তারপর ইচ্ছে হলে ছেলের বউকে হাতখরচের জন্য কিছু দেবেন নতুবা দেবেননা এটা নির্ভর করে তাদের ইচ্ছার উপর। এটাও স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীকে উস্কানী দেবার অন্যতম কারণ। 

ইসলামে যৌতুকপ্রথার কোন বিধান নেই। ক’নেপক্ষ ছেলেপক্ষকে যৌতুক দিতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই, অপরদিকে স্বামী স্ত্রীকে সম্পূর্ণ দেনমোহর প্রধান করার পর তার অধিকার প্রয়োগ করবে। স্বামীর আর্থিক স্বচ্ছলতার উপর দেনমোহর নির্ধারিত হওয়ার কথা থাকলেও ক’নেপক্ষের মুরব্বীরা জোরপূর্বক স্বামীর আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূত অর্থ মোহরানা হিসাবে নির্ধারণ করার প্রয়াস চালিয়ে যান, এতে স্বামী সম্পূর্ণ দেনমোহর প্রদান না করে আংশিক পরিশোধ করে স্ত্রীকে স্পর্শ করে যা ইসলামে বৈধ নয়। অনেক সময় স্বামী অপারগ হয়ে বাসর ঘরে স্ত্রীর কাছে দেনমোহর প্রদানে অপারগতার কারণে স্ত্রীর কাছে  মাফ চেয়ে নেন, পারিপার্শিক কারণে অগত্যা স্ত্রী একরকম বাধ্য হয়ে স্বামীর দেনমোহরের  বোঝা মাফ করে দেয়। তাই ইসলামিক বিধান মতে ছেলেমেয়ের পরিবার বিয়েতে সম্মত হলে উভয়পক্ষ ছেলের আর্থিক সংগতির উপর নির্ভর করে এবং ছেলের মতামত নিয়ে মোহরানা ধার্য করাকে ইসলাম উৎসাহিত করে। 

রাসুল (সঃ) এর আমলে অনেক গরীব সাহাবারা শুধুমাত্র ছোটখাটো খেজুর বাগান কিংবা দা, কুড়াল ইত্যাদি দেনমোহর স্বাব্যস্থ করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অসংখ্য নজীর রয়েছে। এমনকি বর্তমান যুগেও আরবের যুবকেরা কিছু খেজুর এবং মাত্র পাঁচ/দশ রিয়াল মোহরানা দিয়ে বিয়ে করার কথা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে দেখা যায়। তারা ক’নেকে দেনমোহর হিসাবে প্রচুর অর্থপ্রদানে যে অপারগ সে কারণে নয়, শুধুমাত্র মুসলিম সমাজে দু’পক্ষকে মোহরানা সংক্রান্ত দেন-দরবারের অবসানের উদ্দেশ্যে এ মহৎ উদ্যোগ নিতে দেখা যায়।             

ইসলামে বিয়ের পূর্বে ছেলে মেয়ে একে অপরকে স্বচক্ষে দেখার এবং প্রয়োজনীয় খোঁজখবর নেবার অধিকার দেয়া হয়েছে অথচ আমাদের সমাজে দু’পক্ষের মুরব্বীরা ছেলে-মেয়েকে দেখে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করেন যে কারণে অনেকসময় বিয়ের কিছুদিন পরেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অপছন্দের কারণে মনমালিন্যের সৃষ্টি হয়।  

লম্পট, লোভী, দুশ্চরিত্র স্বামীর কারণে নারীরা যেমন নির্যাতিত হয় তেমনি অনেক স্ত্রীও আছে যারা পরকীয়া প্রেমে আসক্তির বশবর্তী হয়ে কিংবা শারিরীকভাবে দুর্বল, মানসিক বিকারগ্রস্থ ও আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল স্বামীর উপর নির্যাতন চালায়। পরকীয়ার কারণে স্বামীকে স্ত্রী খুন করতেও দেখা যায়। এরূপ ঘটনা আমাদের সমাজে বিদ্যমান। এক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ জরুরী হয়ে পড়ে। 

স্বামী স্ত্রীকে বিশ্বাসভঙ্গের কারণে বা অবাধ্য হওয়ার কারণে তালাক দিতে বাধ্য হয় তেমনি নারীরাও স্বামীর অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে কোর্টের মাধ্যমে, গ্রামীন সালিশের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। একজন মহিলা আল্লাহর রাসুল (সঃ) এর কাছে স্বামীর অত্যাচারের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোর আবেদন জানালে তিনি তাকে বিচ্ছেদের অনুমতি দিলেন এবং সেই সাথে স্বামীর কাছ থেকে ঐ স্ত্রী মোহর হিসাবে যে খেজুরবাগানটি পেয়েছিলেন তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ইসলামী পরিভাষায় স্ত্রী স্বামীকে তালাক দেওয়ার এ বিধানকে বাংলাভাষায় ”খোলা” বলে। সকল ঈমাম ও ফিকাহবিদদের মতে ”খোলা”র মাধ্যমে স্ত্রী লম্পট স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিতে পারে। এক্ষেত্রে স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ সুন্দরভাবে ফেরত দিতে হবে।

সুখী দাম্পত্যজীবনের জন্য আমাদের প্রিয় নবীর একটি হাদিস রয়েছে। তিনি বলেন ” মানুষ সাধারণত যে কোন চারটি গুণের ভিত্তিতে বিয়ে করে থাকে যেমন, এক সৌন্দর্য্য, দুই সম্পদ, তিন বংশ এবং চার ধর্মীয় আদর্শ। তবে ধর্মীয় আদর্শবান নারীকে যে বিবাহ করবে সে-ই দাম্পত্যজীবনে সফল হবে”।   
  
উপরোক্ত নিয়মসমূহ উপেক্ষা করে তালাক দেওয়ার কোন বিধান ইসলামে নেই। পারিবারিক প্রশান্তি এবং স্থায়িত্বের জন্য ইসলাম যে বিধান দিয়েছে এর চেয়ে শ্রেষ্ট, যুক্তিসঙ্গত, উন্নত এবং সঠিক বিধান আজ পর্যন্ত অন্য কোন ধর্ম দিতে পারেনি। 

তাই পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্ধ, অবিশ্বাস, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, কলহ, নির্যাতন, পরকীয়া, ডিভোর্স, বিয়ে না করে লিভ-টুগেদার ইত্যাদি লেগেই আছে। ইসলাম নারী-পুরুষের সামাজিক অধিকার পূর্ণমাত্রায় দিয়েছে, পৈর্তৃক সম্পত্তি কিংবা স্বামীর মরনোত্তর সম্পত্তিতে নারীর নিশ্চিত অধিকার সংরক্ষণ করেছে যা অন্যধর্মে নেই। 

তাই আজ একথা প্রমাণিত, যারা ইসলামের বিধান মেনে চলবে তারাই সুখী দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করবে। এ সত্যটি আজ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নারীসমাজের অনেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছে তাই অন্যান্য ধর্মের নারীরা ইসলামে নারী অধিকার সংরক্ষণের বিধানসমূহে আকৃষ্ট হয়ে প্রতিদিন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। 

ভারত সরকার ইসলামকে অবমাননার জন্য ”তালাক-ফৌজদারী অপরাধ” আইনটি পাশ করার কারণে  পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৩৩% মুসলিমদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? ভারত সরকার যদি ভারতীয় মুসলিমদেরকে ইসলামে তালাকের বিধান না মানলে ”ফৈৗজদারী অপরাধ” বলে গণ্য হবে এ ধরণের একটি আইন পাশ করত তাহলে সমগ্র মুসলিম জাহানে ভারত সরকার নিঃসন্দেহে প্রশংসিত হত।  হিন্দু সমাজের চিরাচরিত একস্ত্রীবাদী রীতি বর্তমান  সমাজ আর তেমনভাবে গ্রহণ করছেনা এবং এটা কোন যৌক্তিক সমাধান নয়। একজন স্ত্রী কিংবা একজন স্বামী উম্মাদ, মাদকাসক্ত, অত্যাচারী, পরকিয়ার আসক্ত একজনকে নিয়ে চিরদিন সংসার করতে পারেনা। তাছাড়া যৌতুক দেয়নেয়ার ভয়কে হিন্দুসমাজ কোনক্রমেই এড়াতে পারেনা। তাই হিন্দু সমাজে অসংখ্য কন্যসন্তানকে প্রসবের পূর্বেই হত্যা করা হয়।তাই ভারত সরকার যদি সামাজিক এ সমস্ত ব্যাধি এড়াতে তালাক আইনের পরিবর্তে নিজেদের ধর্মের বিধিবিধানের উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ নিত তাহলে হিন্দু সমাজের ভিত আরও মজবুত হত। 
 
বিভিন্ন ধর্মের উপদেশবাণী ঃ  

মানুষের যে সমস্ত জিনিষ বা ব্যবহার তোমার পছন্দ হয় সে সমস্ত জিনিষ বা ব্যবহার তোমার পক্ষ হতে মানুষকে ফিরিয়ে দিও : Christianity/Islamism

মহান আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করনা, প্রতিবেশীকে ভুখা রেখে খেয়োনা, অনাথ এতিমকে দয়া কর, নিজের মঙ্গলের জন্য যা যা কর, প্রতিবেশীর জন্যও তাই করবে এবং ভিন্ন ধর্মের লোককে গালমন্দ করনা  বরং তার সত্য উপলব্ধি ও হেদায়তপ্রাপ্তির জন্য দোয়া কর : Islamism

তুমি অন্যকে মনোকষ্ট দিওনা, যে অনুরূপ কষ্ট তোমাকে দেয়। কোন জীবকে অহেতুক কষ্ট দিওনা, প্রত্যেক জীবকে ভালবাসার মধ্যে ধর্ম :  Buddhism

অন্যের প্রতি এমন ব্যবহার করিওনা, অন্য হতে প্রাপ্ত যে অনুরূপ ব্যবহার তোমাকে পীড়া দেয় : Brahmanism/Hinduism 

তোমার প্রতিবেশীর খুশীতে খুশী হও এবং তাদের বিপদকে তোমার বিপদ মনে কর : Taoism,Confucius preached, চীন)

তোমার কাছে যা খারাপ বলে মনে হয়, তোমার প্রতিবেশীর জন্যও তা খারাপ বলে মনে করবে ঃ Judaism//Islamism

একজন মানুষ পৃথিবীর প্রত্যেক সৃষ্টিকূলের প্রতি সতর্ক থাকবে যেমন সতর্কতা নিজের প্রতি অবলম্বন করে :Jainism 

তোমার চোখে যে বিচারটি সঠিক বলে মনে হয়, প্রতিবেশীর প্রতিও সে সুবিচার কর : Baha'i /Islamism

তাই আসুন, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে উপরোক্ত উপদেশসমূহের আলোকে আমরা মানবতার জয়গান গাই, নিজের ধর্মে অটল থাকি এবং অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করি কারণ প্রত্যেক ধর্মের মূলমন্ত্রই মানবজাতির মঙ্গলসাধন।

সকল ধর্মের মূলমন্ত্রই মানবতা রক্ষা, ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পরিহার করতে উপদেশ দেয়া হয়েছে। আশা করা যায় ভারত সরকার এবং জনগণ তাদের সনাতন ধর্মের অনুশাসন মেনে চলবেন এবং সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের লোকদের সামাজিক ও ধর্মীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন এবং মনগড়া আইন প্রণয়ন করে তাদের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন করবেননা। 

=========================

Saturday, July 20, 2019

কয়েকটি চিঠি এবং একটি ত্রিশ তারিখ (ছোটগল্প)


কয়েকটি চিঠি এবং একটি  ত্রিশ  তারিখ

গুলশান চৌধুরী

১.

দোয়া পর সমাচার এই বাবা মিন্টু, তুমি চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসিতেছ জানিয়া যার পর নাই খুশি হইলাম। দোয়া করি সহি সালামতে পৌঁছাও।

লিখিয়াছ, বিদেশের এত বছরের ঘানিটানা খাটুনি আর শরীরে কুলায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়াছ যে, একেবারে চলিয়া আসিবা। আর দীর্ঘ ষোল বছরে যাহা সঞ্চয় করিয়াছ তাহা দিয়া দেশে আসিয়া ব্যবসা করিবা। কিন্তু আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত যথাযথ নহে। আরো দুই তিন বছর থাকিয়া হাতে অন্তত এক কোটি টাকা লইয়া দেশে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। নতুবা ব্যবসা করিবা কী দিয়া? আজকাল গাঁওগেরামে একটা পানের দোকান দিয়ে ব্যবসা করিতেও পঞ্চাশ হাজার লাগে। তুমি অবশ্য পানের ব্যবসা করিবে না। ইহা একটি কথার কথা। তোমার বুঝার সুবিধার্থে লিখিলাম আর কি।

এদিকে আমার আর তোমার মায়ের হজ্ব বাকি। এতদিন তুমি যুক্তি দেখাইয়াছ যে, হাসনা ও হেনার বিবাহ দেওয়া আমার পয়লা নম্বর ফরয কাজ। এখন তো এই পয়লা নম্বর ফরয কাজ আদায় হইয়া গিয়াছে। মামলা-মোকাদ্দমার ঝামেলাও শেষ। এই বৎসর হজ্ব না করিলে সমাজে মুখ তো রক্ষা হয় না। পিন্টুর শ্বশুর ম্যানপাওয়ারের ব্যবসা করেন। তিনি তো সপরিবারে তিনবার হজ্ব করিয়া ফেলিলেন। তিনি এবং পাড়াপড়শী সকলেই বলে, ‘আপনার ছেলে সৌদীতে থাকে অথচ আজ পর্যন্ত হজ্ব করিলেন না?’ কথা তো ঠিকই। সুতরাং আমি ইরাদা করিয়াছি এই বৎসর হজ্বে যাইব। তাই তোমার উক্ত সিদ্ধান্ত পরিহার কর। তবে অবশ্যই অন্যবারের মত ছুটিতে আসিবা। দেশের আবহাওয়া এখন খুব গরম। ফ্যানের বাতাসে কুলায় না। আসার সময় অন্তত একটা এসি নিয়া আসিবা। পিন্টুর শ্বশুরের বাসায় তিনটি আছে। তিনি তাহার কন্যা নাতাশার কামরার জন্য একটি দান করিয়াছেন। একই ফ্ল্যাটে থাকি, অথচ আমার নিজের কামরায় এসি নাই। বড়ই সংকোচ লাগে। মুগদাপাড়ার কুদ্দুসভাইর ছেলে তাহার বৃদ্ধ মাতাপিতার জন্য দুইটা এসি পাঠাইয়াছে। ড্রয়িংরুমের জন্য একটা ইরানী কার্পেটও পাঠাইয়াছে। দেখিলে চক্ষু জুড়ায়। মাতাপিতার সেবায় তাহার জুড়ি নাই দেখিয়া আমার মনও জুড়ায় বৈকি।

বিদেশে যাহারাই গেল তাহারাই শহরে একটি বাসা বানাইয়া ফেলিল। কেবল তোমারই বাসা হয় নাই। এইবারে আসিয়া বড় একটি বাসা বানাইবার ব্যবস্থা করিবা। বাসাভাড়া দিতে দিতে আমার পিন্টুর সর্বস্বান্ত অবস্থা। শহরে একটা বাসা হইলে তোমরা সকল ভাইবোন মিলিয়া মিশিয়া নিশ্চিন্তে থাকিবার ব্যবস্থা হইবে। টাকাও বাঁচিবে। বাবা, একটি কথা। তোমার পাঠানো টাকায় পিন্টু আইসক্রীম ফ্যাক্টরীটা তাহার নিজের নামে খরিদ করিয়াছে বলিয়া অনেক রাগ করিয়াছ। তাহাকে অনেক গালাগালি করিয়াছ। চিঠিপত্র লিখা বন্ধ করিয়াছ। পরের ঘর হইতে আসা মেয়েলোকের কথায় কেন তুমি স্ত্রৈন হইয়া গেলে?  ইহা সমীচীন নহে। সে তোমারই তো ভাই। তোমার টাকা, তাহার টাকা সমান নহে কি? আল্লাহ্ তোমাকে পিন্টুর চাইতে বেশি ভাগ্যবান করিয়া দুনিয়ায় পাঠাইয়াছেন। তুমি জীবনে যে কাজে হাত দিয়াছ সেই কাজেই সফল হইয়াছ। ইচ্ছা করিলেই তুমি ভবিষ্যতে এর চেয়ে বড় ফ্যাক্টরীর মালিক হইতে পারিবা। কিন্তু পিন্টু পারিবেনা। তাহার সেই তকদিরও নাই, ঘিলুও নাই। এইসব বিবেচনা করিয়া তোমাকে নির্দেশ দিতেছি, দেশে আসিয়া তাহার সাথে মন কষাকষি করিও না। আমার নূতন বৌমা নাতাশা কিংবা বেয়াই সাহেব শুনিলে কী বলিবেন? আমার মানসম্মানের কথা বিবেচনা করিও। এই ফ্যাক্টরী দেখিয়াই তো বেয়াই সাহেব তাহার মেয়েকে পিন্টুর কাছে বিবাহ দিলেন।  নচেৎ পিন্টুর মত বেকার ছেলেকে কে পাত্তা দিত? শহরে এত বড়লোকের সাথে কি আজ কুটুম্বিতা করিতে পারিতাম ?

শহরে আসার পর হইতে আমার শরীর-মন ভাল যাইতেছে না। হয়ত জানিয়াছ যে, গ্রামে আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়া তোমার অতি সোহাগের ছোটভাই সোহাগ সাহেব আমার মান সম্মানের মাথা খাইয়া চেয়ারম্যানের কালো কুৎসিত মেয়ে শোভাকে বিবাহ করিয়াছে। তাও কিনা কোর্টম্যারেজ। আমাদের সাথে যাহাদের ত্রিশ বছর পর্যন্ত মামলা চলিতেছিল তাহাদের মেয়েকে সোহাগ কোন আক্কেলে ঘরে তুলিল? অতীতে মামলায় জিতিয়া ব্যাটা আমাদের বাপ-দাদার সবচেয়ে দামী জমিটা দখল লইয়াছে। আমার সন্দেহ, ঐ পাজীটা সোহাগকে হাত করিয়া ধীরে ধীরে আরো দখল করিবে। মেয়েটির বয়স যদি আঠারোর নীচে হইত, খোদার কসম আমি ওর বাপের নামে মামলা ঠুকিতাম। বেকুব সোহাগ ইহা কী করিল? খাল কাটিয়া কুমির আনিল? আমি স্থির করিয়াছি, তাহাকে পৃথক করিয়া দিব। দরকার হইলে ত্যাজ্যপুত্র বলিয়া ঘোষণা দিব। সে তাহার চেয়ারম্যান শ্বশুরের লেজুড়বৃত্তি নিয়া দিনপাত করুক।    

কিছু জিনিসপত্র আর ওষুধের লিস্ট দিলাম। আসার আগে মনে করিয়া সবগুলি কিনিয়া সুটকেসে ঢুকাইও।

ইতি

তোমার আব্বা

তারিখ ১০. ৬. ১৯৮৬ ইং

পুনশ্চঃ আবারও বলিতেছি, বাৎসরিক ছুটিতে আসিবা। চাকুরি ছাড়িয়া চিরতরে আসিবা না।

২.

দোয়া পর সমাচার এই যে বাবা মিন্টু, চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ তুমি দেশে আসিতেছ জানিয়া খুশি হইলাম। এতদিন যাবৎ এই খবরেরই অপেক্ষা করিতেছিলাম। কারণ পরিবারের অনেক কাজ তোমার জন্য আটকা পড়িয়া রহিয়াছে। তুমি আসার পর সব কাজ এক এক করিয়া সমাধা করা হইবে। তোমার আব্বা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছেন। মনও ভাল না। সোহাগের বিবাহের খবর শোনা মাত্রই অসুখ বাড়িয়া গিয়াছে। এই কথা বিবেচনা করিয়া বসুন্ধরায় পিন্টুর শ্বশুর বাসাতে আসিয়াছি। ভাবিতেছি, জীবনের শেষ কয়টা দিন শহরেই কাটাইব। এইখানে ভাল চিকিৎসা হইবে। গ্রামে থাকিলে কোন প্রকার লাভ হইবে না।

দেশে আসিবার পর  তোমার প্রথম কাজ হইল, বসুন্ধরায় একটি জমি কিনা। মিরপুরে বাসা বানাইবে বলিয়া তোমার সম্বন্ধীর বাসার নিকটে জমি কিনিয়াছ। ইহা কেমন কথা। তাছাড়া বড় বউমা কেনইবা তোমার সম্বন্ধীর বাসায় ভাড়া দিয়া থাকিতেছে ? পিন্টু তোমার আপন ভাই। সে এখানে থাকিতে তুমি মিরপুরে বড়বৌমাকে রাখিতে গেলে কেন? দেশে আসিয়া ঐ জমি বেচিয়া তোমার ভাইদের লইয়া একত্রে থাকিবার নিমিত্তে বসুন্ধরায় বড় বাসা বানাইবা। মিরপুরের তুলনায় বসুন্ধরা অনেক সুন্দর ও উন্নত এলাকা। রাস্তা অনেক বড়। মিরপুরে চিপা গলির মত রাস্তা। সেদিন তো একটু হইলেই একটি গাড়ি আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়া ফেলিয়াছিল। সুতরাং তুমি আসিয়া বসুন্ধরায় তিনভাইর জন্য তিনতলা বাসা তেরি করিবা। পিন্টুর শশুর রড-সিমেন্টের ব্যবসা করেন। তিনি সুযোগ সুবিধা দিতে পারিবেন।

দ্বিতীয় কাজ হইল, বড়বৌমাকে আনিয়া আমাদের কাছেই রাখিবা। আগে আমরা গ্রামে থাকিতাম। তাই মেয়েদের পড়ালেখার অসুবিধার দোহাই দিয়া বড়বৌমা মিরপুরে তাহার ভাইয়ের বাসায় চলিয়া আসিলেন। এখন তো আমরাও শহরে থাকি। অসুবিধা হইবে কেন? মিরপুরে তুমি তাহাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, আবার এখানেও আমাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, ইহাতে ডাবল টাকা খরচ হইতেছে না? একত্রে থাকিলে তো খরচ বাঁচে। এইসব বিবেচনা করিয়া আমি ও তোমার বাবা গত সপ্তাহে গিয়াছিলাম বৌমাকে আনিতে। সে তোমার অনুমতির কথা বলিল। আমরা বাঁচিয়া থাকিতে তোমার আবার কিসের অনুমতি, বুঝিলাম না। মেয়েটি বড়ই চালাক। চিঠিতে আর কিছু লিখিলাম না। তুমি দেশে আসিলে সব বলিব। তুমি আশা মাত্রই তাহাকে এখানে আনিবা। পিন্টুর শশুর বাড়িতে বাবুর্চি আছে। আর বৃদ্ধ বয়সে আমরা বুয়ার হাতের বাজে রান্না খাই। আমাদের এইসব অসুবিধার কথা কি বড়বউমার বুঝা উচিত না? বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ির খেদমত করা তাহার উচিত না? মেজবৌমা নাতাশা ছেলেমানুষ। লেখাপড়া নিয়া সারাদিন বাহিরে থাকে। সে কিভাবে রান্না করিয়া খাওয়াইবে ? ইহাও বড়বৌমার বিবেচনা করা উচিত। ভাইয়ের বাসায় আরামে বসিয়া থাকিলেই চলিবে? সে নাহয় থাকিল। কিন্তু সাফা-মারোয়া? তাহারা তো আমার নাতিন। তাহারা কেন পরের বাসায় থাকিবে? 

এইবার পিন্টুর কথায় আসি। তুমি দেশে আসিয়া তাহার সাথে রাগারাগি করিও না। হাজার দোষ করুক, সে তোমারই মায়ের পেটের ভাই। আমার কড়া হুকুম, মায়ামমতা বজায় রাখিবা। আরেক কথা। যদিও তাহার বিবাহের গহনাসহ যাবতীয় খরচ দিয়াছ তবুও নাতাশাকে এই প্রথমবারের মত দেখিবে। সালামী হিসাবে তাহার জন্য একপদ স্বর্ণালঙ্কার আনিও। শাড়ি আনিও না। আজকালকার মেয়ে শাড়ি টাড়ি পরে না। বিবাহের সময় সোহাগ একটি শাড়ি দিয়াছিল। দামী হইলেও তাহা সে পরে নাই। কাউকে দিয়া দিয়াছে। তাহারা উচু বংশের মানীলোক। নাতাশার মা-বাবার জন্যও কিছু গিফ্ট আনিও। ইহাতে আমাদের কদর বাড়িবে। আর কার কার জন্য কি কি আনিতে হইবে তাহার একটি তালিকা দিলাম। প্রতিটি জিনিস মনে করিয়া আনিও। ভুলিওনা।

ইতি

তোমার আম্মা

পুনশ্চঃ হাসনা আর হেনার চিঠির উত্তর দাও নাই কেন ? তাহারা মনে কষ্ট পাইয়াছে। আসিবার সময় জামাইদের জন্য সু্ট কোট আনিবে। বেয়াইনদের জন্য শাড়ি। পুত্রা-ঝিয়ারিদের জন্য টুকিটাকি যা পার।

তারিখঃ ১০. ৬. ১৯৮৬ ইং

 

৩. 

লিখেছ, আমাদের জন্য কী কী আনতে হবে? ওগো, আমি কী চাই, তুমি কি জান না? দু’বছর ধরে দেশে আসছ না পারিবারিক কলহ এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার চাপে। ত্রিশ তারিখ তুমি আসবে - এটাই পরম পাওয়া। সহিসালামতে চলে এস। ব্যাস, আর কিছু চাই না। তোমার মেয়েরা রোজ দশবার ক্যালেন্ডারের পাতায় ‘ত্রিশ তারিখ’ দেখে। তাদের দিনও যেন ফুরোতে চায়না। তুমি এলে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে সারাক্ষণ তারই পরিকল্পনা। দাম্মামে থাকতে সী-বিচে কত আনন্দ করে বেড়িয়েছে তোমার হাত ধরে। সেই সোনালী দিনগুলো তো আর ফিরে পাবে না। তাই তুমি আসার অপেক্ষা করেই যাচ্ছে। ওদের দাম্মামের বন্ধুদের কয়েকটা ছবি আনতে বলেছে। এলবামে রাখবে। সেই পিচ্ছিরা এতদিনে নিশ্চয় বেশ বড় হয়ে গেছে। আমারও খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ওখানকার ভাবীদের কথাও খুব মনে পড়ে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল দিনগুলো কাটিয়েছি ওখানে। সবাইকে আমার সালাম বলো। 

চিঠির এক কোনায় হাসপাতালে যাবার কথা লিখেছ। সিরিয়াস কোন অসুখ নয়তো? এবারের পাঠানো ছবিতে এত রোগা রোগা লাগছে কেন? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। বছরের পর বছর ওভারটাইমসহ ছুটিহীন খাটুনি দিচ্ছ। আমি পাশে নেই। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে নিশ্চয়। দেশে এসে যদি দু’তিন মাস থাকতে পারতে তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত। জানি তো, প্রবাসজীবনের বিরামহীন কষ্ট মানুষকে সুস্থ্য থাকতে দেয়না। দেখনা, অন্তত দুমাসের ছুটি নিতে পার কিনা।

 গতকাল গ্রামের বাড়ি থেকে সোহাগ এসেছিল নূতন বউ নিয়ে। শোভা খুব লক্ষী মেয়ে। গায়ের রং শ্যামলা। কিন্ত পয়মন্ত চেহারার মধ্যে প্রখর বুদ্ধির ছাপ। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছে। ভাল রেজাল্ট। ওকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বলেছি। তুমি যদি ভাল মনে কর তাহলে মিরপুরে আমার কাছে রেখে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। আমাদের মত করে ওকে গড়ে তুলব। কি বল ? এতে করে বাবা-মার মন থেকে ওদের কোর্টম্যারেজ সংক্রান্ত মনোকষ্ট ধীরে ধীরে ঘুচবে। আমার প্রস্তাবে সোহাগ খুশি হয়েছে। এখন তোমার মতামতের অপেক্ষা।

সেদিন মা এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে। বললেন, আমাকে ওনাদের কাছেই থাকতে হবে। সাফা-মারওয়া  নাকি বসুন্ধরার স্কুলেই পড়বে। ঐ স্কুলে পিন্টুভাইর শালাশালীরা পড়ে। এটা নাকি শহরের সবচেয়ে ভাল স্কুল, ইত্যাদি অনেক যুক্তি। মার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজী হতে আমার বিবেক সায় দেয়নি। প্রথমতঃ বাসার মালিক পিন্টুভাইর শশুর। আমার শশুর নন। তাছাড়া বাসাটা ভাড়া হয়েছে পিন্টুভাইর নামে, তোমার নামে নয়। দ্বিতীয়তঃ যে ভাইকে তুমি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছ, তার কাছ থেকে পেয়েছ অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসঘাতকতা। ওর বাসায় তোমার অনুমতি ছাড়া যাব কেন ? গেলে তুমি কষ্ট পাবে। তাছাড়া সে কি শুধু তোমার মনেই কষ্ট দিয়েছে ? আমার নামেও তো নানারকম অপবাদ দিতে ছাড়েনি। আমিই নাকি ভাইয়ে ভাইয়ে শ্ত্রুতা তৈরি করেছি। সে তো এটুকুও ভাবল না যে, দাম্মামের সুখের সংসার ছেড়ে, সাফা-মারওয়াকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে আমি চলে দেশে এসেছিলাম শুধুমাত্র পয়সা বাঁচাব বলে। আর ঐ বাঁচানো টাকা সঞ্চয় করে তিনভাইর যৌথ ব্যবসার জন্য আইসক্রীম ফ্যাক্টরী আর তিনভাই একসাথে থাকার জন্য বড় একটা বাসা কিনব বলে। ফ্যাক্টরী তো হল। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের উন্নতির জন্য তোমার যে সুদূরপ্রসারী ধ্যানধারণা ছিল তার কী হল? সাফা-মারওয়া, তুমি-আমি এ চারজনের আত্মত্যাগের মূল্য কী এই? 

যাহোক। একদিন সে তার ভুল বুঝবে। ক্ষমা করতে তোমার কষ্ট হবে জানি। তবু পারলে ধীরে ধীরে তাকে ক্ষমা করে দিও। আমি জানি আল্লাহ্ আমাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করবেন। দেশে এসে তার সাথে রাগারাগি করনা। তোমার জন্য দিনরাত দোয়া করছি। ভাল থেকো। সুস্থ্য থেকো। সহিসালামতে পৌঁছাও।

ইতি

একমাত্র তোমারই জান্নাত আরা

তারিখ : ১৫. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চঃ আবার বলছি, কষ্ট করে অযথা এটা সেটা কিনে লাগেজ ভারি করতে যেয়োনা। সব সময়ই তো পাঠাও। কিছুই আনতে হবেনা। তাছাড়া মনে রেখো আমার জন্য আনতে গেলে আরো অনেকের নাম উঠে আসে। দেশে এসে এ নিয়ে অপ্রিয় কথা শুনবে আর কষ্ট পাবে। তোমার এ কষ্ট আমি দেখতে চাই না।    

৪.

বড় ভাইয়া, আমাদের সালাম নিও। গতকাল মিরপুর গিয়েছিলাম আমার মহিয়সী ভাবী আর কলিজার টুকরো দুই ভাতিজীকে দেখতে। শোভার কথা নিশ্চয় শুনেছ। ওকে কীভাবে গ্রহণ করবে এই ভয়ে এতদিন সরাসরি লিখতে সাহস করিনি। বড়ভাবী এই পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি নিজের গহনা পরিয়ে ওকে আশীর্বাদ করে স্বীকৃতি দিলেন। তারপরই না তোমার কাছে চিঠি লিখতে সাহস পেলাম। ভাবীর ¯œহের ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব জানিনা। মাঝে মাঝে তুলনা করে আশ্চর্য হই, আল্লাহ্ কীভাবে যে জোড়া মিলিয়ে দিলেন! বড়ভাবীর মনটা ঠিক তোমার মত। আর ছোটভাবীর মনটা ঠিক ছোটভাইয়ার মত। আব্বা আম্মাতো ধনের জৌলুস দেখে ছোটভাবীকে মাথায় তুলে রেখেছেন। আমার বিশ্বাস, দেরিতে হলেও একদিন খাঁটি সোনা চিনতে পারবেন।

বড়ভাবীর মুখে শুনলাম, এ মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসছ। শুনে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিস্ক নেবার মত ভরসা পাচ্ছি। প্রথমতঃ তোমার উপস্থিতিতে আব্বা আম্মাকে বুঝিয়ে শোভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তোলা।

দ্বিতীয়তঃ আলীগঞ্জ বাজারে লাভজনক একটা একতলা দোকান বিক্রি হচ্ছে। ভবিষ্যতে দোতলা বা তিনতলা করা যাবে। গ্রামে বসেই শহরে ব্যবসা করা যাবে। ওরা সর্বমোট দু’লাখ চায়। অগ্রিম পঞ্চাশ হাজার টাকা আমি আমাদের সমিতি থেকে ধার নিতে পারব। তোমার কাছে বাকি দেড় লাখ টাকা চাইতে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমাকে মাস্টার্স পাশ করাতে তুমি যথেষ্ট অর্থব্যয় করেছ। কিন্তু বৃথা গেল। এসব খোটা দিয়ে আব্বা আম্মা আমাকে হরদম বকাঝকা করেন। তোমার অতি আদরে নাকি আমি বাঁদর হয়েছি। মানুষ হইনি। সব দোষ নাকি তোমার।

কিন্তু ভাইয়া, মানুষ না হলেও অমানুষ তো হইনি। কাদের স্যারের অগ্নিমন্ত্রে আমি দীক্ষিত। গ্রামের সার্বিক কল্যাণের জন্য এখন অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। গ্রামে আমার সুনাম এবং প্রতিপত্তি যথেষ্ট রয়েছে। আমাদের  প্রতিপক্ষ ছিল দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান। শোভার কল্যাণে আজকাল তিনিও পাল্টাতে আরম্ভ করেছেন। শোভাকে বিয়ে করেছি বলে আব্বা তো বলেন, আমি নাকি খালকেটে কুমীর এনেছি। আব্বা আমার পলিটিক্স বুঝবেন কী করে? বুঝেন তো কেবল মামলা-মোকদ্দমা। আমি খাল কেটে কুমীর আনিনি। বরং গ্রাম থেকে কুমীরের রাজত্ব উৎখাত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তদুপরি আমার বাপ-দাদা যা পারেন নি আমি তা পেরেছি। বিগত ত্রিশ বছরের মহাযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে প্রকারান্তরে চেয়ারম্যানকে সারেন্ডার করতে বাধ্য করেছি। জবরদখলকৃত জমি উনি ফিরিয়ে দিতে রাজী। শুধু কি তাই? ইউনিয়নবাসীর উন্নতির দিকেও আজকাল মনোযোগী হয়েছেন। আব্বা আর কী চান? যদি গ্রামের মঙ্গল চান তাহলে আমার প্রতিটি কৌশল বোঝার কথা। পক্ষান্তরে উনি যদি আমাদের পরিবারের বহিরাগত মন্ত্রণাদাতা জনৈক বেয়াইকে (পিন্টুভাইর শ্বশুর) প্রাতঃস্মরণীয় মহাজ্ঞানী মহাজন ভাবেন, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।

যাহোক। যা বলছিলাম, তুমি দেশে এসে দোকানটা দেখবে। পছন্দ হলে তোমার নামেই কিনে ফেলব এবং ব্যবসা আরম্ভ করে বেকারত্ব ঘুচাব। টাকাটা আমি ধার হিসেবেই চাচ্ছি। আমাকে অবিশ্বাস কর না ভাইয়া। আমি তোমার এম. এ পাশ করা পিন্টু নই।

পিন্টুসাহেবের বসুন্ধরার বাসায় গিয়ে আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে এসেছি। শ্বশুরের দেওয়া দামী ফার্নিচারে ঠাসা তার বাসা। এমন কোন জিনিস নেই যা পিন্টুভাইর নিজের টাকায় কেনা। আব্বা আম্মাকে দেখলাম খুব গর্বিত। শোভা মিরপুর আছে জেনেও না জানার ভান করলেন। ওনাদের বকাঝকা তো আমার নিত্যসাথী। এখন আর দুঃখ পাইনা। কিন্তু দুঃখ লাগে, আমাদের যে মাতাপিতা অল্পেতুষ্টি আর সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, সেই মাতাপিতা এখন শহরের জৌলুস আর বিলাসী জীবনের প্রতি ক্রমশ ঝুঁকে পড়েছেন। ওনাদের কামরায় এখন নিজস্ব রঙীন টিভি। বিদেশী চ্যানেলের সিরিয়ালের নেশায় থাকেন বুঁদ। দুনিয়াদারী চাহিদার শেষ নেই। কে তাদেরকে পল্লীবাংলার দিকে ফেরাবে? কে ফেরাবে আখেরাতের চিন্তার দিকে ?

অনেক কিছু লিখলাম। ভুল বুঝো না যেন। আমার ওপর আস্থা রেখো। শোভার সালাম নিও। আমরা ভাল আছি।

ইতি

তোমার ছোটভাই সোহাগ

তারিখ : ২০. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চঃ এয়ারপোর্টে অবশ্যই ভাবী আর সোনামণিদেরকে নিয়ে আমি উপস্থিত থাকব। কোনো চিন্তা কর না।

 

 ৫.

আমি মিন্টু বলছি। আমার কলিগ মাসুদ খান অফিস থেকে ফেরার পথে হাসপাতলে এসে এই চারটা চিঠি দিয়ে গেল। এখনই উত্তর লিখে ফেলা দরকার। কারণ ধূসর সময়টাকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। মহাকাল আমাকে আর বেশি সময় দেবে বলে মনে হচ্ছে না।

চাওয়া মাত্রই নার্স কাগজ-কলম দিয়ে গেল। আলাদা করে সবার চিঠির জবাব দেবার মত সময় বা মন কোনটাই নেই। যতদূর আন্দাজ করছি, আজই আমাকে লাইফ-সাপোর্টে নেওয়া হবে। তাই সময় থাকতে অছিয়ত-নামা লিখে যাচ্ছি। এতেই একত্রে সবার চিঠির জবাব থাকবে।

আমার পুত্রসন্তান নেই বিধায় প্রবাসজীবনের ষোলটি বছরের উপার্জিত স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পদ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক নিম্নলিখিত ওয়ারিশদের নামে বন্টন করে দিচ্ছি। এরপর পৃথিবীতে যেভাবে নিঃস্ব অবস্থায় এসেছিলাম, ঠিক সেভাবেই নিঃস্ব অবস্থায় পরম করূণাময়ের কাছে প্রত্যাবর্তন করব।

ক. মা-বাবা এবং দুই বোন ঃ নদীর পারে যে জমি কিনেছিলাম তা সম্পূর্ণ তাদের নামে যাবে। দেখেশুনে প্রত্যেকে শরীয়ত মোতাবেক বন্টন করে নেবেন। আব্বা-আম্মা তাগিদ দিচ্ছিলেন এ বৎসর ওনাদেরকে হজ্ব করাতে। হজ্ব করানোর মালিক তো আল্লাহ। আমি নই। তাছাড়া হজ্ব করতে হয় নিজস্ব আয় বা সম্পদ থেকেই। সুতরাং উক্ত জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ওনারা এ বৎসর হজ্ব করুন।

খ. দুই ভাইঃ  আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে পিন্টু ফ্যাক্টরীটা নিজের নামে লিখে নিয়েছে। সে তার প্রাপ্য অংশের বেশি পেয়েছে। সুতরাং তার আর পাওনা নেই। আমার স্ত্রীর অনুরোধক্রমে তাকে  আমি ক্ষমা করলাম। কিন্তু কয়েক শর্তে। তার একমাত্র জীবিত ভাই সোহাগকে যেন না ঠকায়। আব্বাআম্মার যেন অযতœ না হয়। তাদের জন্য ভাল একটা বাবুর্চি যেন রেখে দেয়। আমবাগান, লিচুবাগানের ফল আর জমির ফসল বিক্রির সব টাকা যেন ওনাদের হাতেই তুলে দেয়। আর বোনদের হক যেন আদায় করে। অর্থাৎ পৈত্রিক সম্পদের অংশ প্রদান করা, খোঁজখবর নেওয়া, মাঝেমাঝে নাইওর আনা, সামাজিকতা লৌকিকতা বজায় রাখা ইত্যাদি।

দাম্মামে আমার গাড়ি এবং ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা আমার বন্ধু মাসুদ খানের তদারকিতে থাকবে। উক্ত টাকা সোহাগের জন্য রইল। সে তার ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়ে বাকি টাকা দিয়ে শোভার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে এবং ওদের রিসিপশনের অনুষ্ঠানে ব্যয় করবে। খোদার হুকুমেই তো ওদের বিয়ে হয়েছে। এ হুকুম বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে আব্বাআম্মা যেন তাদেরকে সমাদরে গ্রহণ করেন এবং চেয়ারম্যানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। তিনি তো গ্রামসম্পর্কে আব্বারই জ্ঞাতিভাই। সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানেই মঙ্গল। 

গ. আমার স্ত্রী এবং জমজ কন্যাঃ  আমার মৃত্যুর পর কোম্পানী থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে তা এবং সোনালী ব্যাংকে যৎসামান্য যা আছে তা সম্পূর্ণ তাদের। মিরপুরে আমার স্ত্রীর নামে কেনা একটুকরো জমি আছে। এ টাকায় তেতলা বাড়ি হবে। দোতলায় ওরা থাকবে এবং বাকি অংশ ভাড়া দিয়ে দিন গোজরান করবে। তাদের হেফাজতের ভার আল্লাহ তা’লার ওপর রইল। আমার সম্বন্ধীর কাছে অনুরোধ রইল তিনি যেন তাদেরকে তার কাছাকছিই রাখেন। আরেকটা কথা বিশেষভাবে বলছি, আমার মেয়েরা যেন তাদের দাদাবাড়ির অধিকার ও স্নেহমমতা থেকে বঞ্চিত না হয়।

রণক্লান্ত হাতখানি অবশ হয়ে আসছে। আর লিখতে পারছি না। ত্রিশ তারিখ দেশে যাবার জন্য বিমানের টিকিট নেবার পরদিন থেকে হাসপাতালে পড়ে আছি। বন্ধুরা সান্তনা দেয় ভাল হয়ে যাব বলে। ডাক্তারও পেশাসুলভ পজিটিভ অভিব্যক্তি দেখায়। কিন্তু আমি জানি বাংলাদেশ বিমান আমাকে কি অবস্থায় স্বদেশে দেশে নিয়ে যাবে। দাম্মামের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ: আমার চলিত মাসের বেতন থেকে যেন হাসপাতালের পাওনা মেটানো হয়। আমাকে যেন শোয়ানো হয় গ্রামের বাড়ির শ্যামল মাটিতে। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।

ইতি

হতভাগ্য মিন্টু

তারিখ : ২৬. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চ ঃ বন্ধু মাসুদ, প্রতিদিন তুমি এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছ। তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে আরো একটি অনুরোধ করছি। আমার এ চিঠি ফটোকপি করে রেখো। মূলকপি যাবে তোমার ভাবীর কাছে। আর সাত কপি যাবে আমার মা বাবা, দুইভাই আর দুইবোন আর আমার সমন্ধীর কাছে। অপর পৃষ্ঠায় ঠিকানা দেওয়া আছে। বিদায়।

রচনাঃ ১৯৮৯ জেদ্দা

১.

দোয়া পর সমাচার এই বাবা মিন্টু, তুমি চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসিতেছ জানিয়া যার পর নাই খুশি হইলাম। দোয়া করি সহি সালামতে পৌঁছাও।

লিখিয়াছ, বিদেশের এত বছরের ঘানিটানা খাটুনি আর শরীরে কুলায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়াছ যে, একেবারে চলিয়া আসিবা। আর দীর্ঘ ষোল বছরে যাহা সঞ্চয় করিয়াছ তাহা দিয়া দেশে আসিয়া ব্যবসা করিবা। কিন্তু আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত যথাযথ নহে। আরো দুই তিন বছর থাকিয়া হাতে অন্তত এক কোটি টাকা লইয়া দেশে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। নতুবা ব্যবসা করিবা কি দিয়া? আজকাল গাঁওগেরামে একটা পানের দোকান দিয়ে ব্যবসা করিতেও পঞ্চাশ হাজার লাগে। তুমি অবশ্য পানের ব্যবসা করিবে না। ইহা একটি কথার কথা। তোমার বুঝার সুবিধার্থে লিখিলাম আর কি।

এদিকে আমার আর তোমার মায়ের হজ্ব বাকি। এতদিন তুমি যুক্তি দেখাইয়াছ যে, হাসনা ও হেনার বিবাহ দেওয়া আমার পয়লা নম্বর ফরয কাজ। এখন তো এই পয়লা নম্বর ফরয কাজ আদায় হইয়া গিয়াছে। মামলা-মোকাদ্দমার ঝামেলাও শেষ। এই বৎসর হজ্ব না করিলে সমাজে মুখ তো রক্ষা হয় না। পিন্টুর শ্বশুর ম্যানপাওয়ারের ব্যবসা করেন। তিনি তো সপরিবারে তিনবার হজ্ব করিয়া ফেলিলেন। তিনি এবং পাড়াপড়শী সকলেই বলে, ‘আপনার ছেলে সৌদীতে থাকে অথচ আজ পর্যন্ত হজ্ব করিলেন না?’ কথা তো ঠিকই। সুতরাং আমি ইরাদা করিয়াছি এই বৎসর হজ্বে যাইব। তাই তোমার উক্ত সিদ্ধান্ত পরিহার কর। তবে অবশ্যই অন্যবারের মত ছুটিতে আসিবা। দেশের আবহাওয়া এখন খুব গরম। ফ্যানের বাতাসে কুলায় না। আসার সময় অন্তত একটা এসি নিয়া আসিবা। পিন্টুর শ্বশুরের বাসায় তিনটি আছে। তিনি তাহার কন্যা নাতাশার কামরার জন্য একটি দান করিয়াছেন। একই ফ্ল্যাটে থাকি, অথচ আমার নিজের কামরায় এসি নাই। বড়ই সংকোচ লাগে। মুগদাপাড়ার কুদ্দুসভাইর ছেলে তাহার বৃদ্ধ মাতাপিতার জন্য দুইটা এসি পাঠাইয়াছে। ড্রয়িংরুমের জন্য একটা ইরানী কার্পেটও পাঠাইয়াছে। দেখিলে চক্ষু জুড়ায়। মাতাপিতার সেবায় তাহার জুড়ি নাই দেখিয়া আমার মনও জুড়ায় বৈকি।

বিদেশে যাহারাই গেল তাহারাই শহরে একটি বাসা বানাইয়া ফেলিল। কেবল তোমারই বাসা হয় নাই। এইবারে আসিয়া বড় একটি বাসা বানাইবার ব্যবস্থা করিবা। বাসাভাড়া দিতে দিতে আমার পিন্টুর সর্বস্বান্ত অবস্থা। শহরে একটা বাসা হইলে তোমরা সকল ভাইবোন মিলিয়া মিশিয়া নিশ্চিন্তে থাকিবার ব্যবস্থা হইবে। টাকাও বাঁচিবে। বাবা, একটি কথা। তোমার পাঠানো টাকায় পিন্টু আইসক্রীম ফ্যাক্টরীটা তাহার নিজের নামে খরিদ করিয়াছে বলিয়া অনেক রাগ করিয়াছ। তাহাকে অনেক গালাগালি করিয়াছ। চিঠিপত্র লিখা বন্ধ করিয়াছ। পরের ঘর হইতে আসা মেয়েলোকের কথায় কেন তুমি স্ত্রৈন হইয়া গেলে?  ইহা সমীচীন নহে। সে তোমারই তো ভাই। তোমার টাকা, তাহার টাকা সমান নহে কি? আল্লাহ্ তোমাকে পিন্টুর চাইতে বেশি ভাগ্যবান করিয়া দুনিয়ায় পাঠাইয়াছেন। তুমি জীবনে যে কাজে হাত দিয়াছ সেই কাজেই সফল হইয়াছ। ইচ্ছা করিলেই তুমি ভবিষ্যতে এর চেয়ে বড় ফ্যাক্টরীর মালিক হইতে পারিবা। কিন্তু পিন্টু পারিবেনা। তাহার সেই তকদিরও নাই, ঘিলুও নাই। এইসব বিবেচনা করিয়া তোমাকে নির্দেশ দিতেছি, দেশে আসিয়া তাহার সাথে মন কষাকষি করিও না। আমার নূতন বৌমা নাতাশা কিংবা বেয়াই সাহেব শুনিলে কী বলিবেন? আমার মানসম্মানের কথা বিবেচনা করিও। এই ফ্যাক্টরী দেখিয়াই তো বেয়াই সাহেব তাহার মেয়েকে পিন্টুর কাছে বিবাহ দিলেন,নচেৎ পিন্টুর মত বেকার ছেলেকে কে পাত্তা দিত? শহরে এত বড়লোকের সাথে কি আজ কুটুম্বিতা করিতে পারিতাম ?

শহরে আসার পর হইতে আমার শরীর-মন ভাল যাইতেছে না। হয়ত জানিয়াছ যে, গ্রামে আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়া তোমার অতি সোহাগের ছোটভাই সোহাগ সাহেব আমার মান সম্মানের মাথা খাইয়া চেয়ারম্যানের কালো কুৎসিত মেয়ে শোভাকে বিবাহ করিয়াছে। তাও কিনা কোর্টম্যারেজ। আমাদের সাথে যাহাদের ত্রিশ বছর পর্যন্ত মামলা চলিতেছিল তাহাদের মেয়েকে সোহাগ কোন্‌ আক্কেলে ঘরে তুলিল? অতীতে মামলায় জিতিয়া ব্যাটা আমাদের বাপ-দাদার সবচেয়ে দামী জমিটা দখল লইয়াছে। আমার সন্দেহ, ঐ পাজীটা সোহাগকে হাত করিয়া ধীরে ধীরে আরো দখল করিবে। মেয়েটির বয়স যদি আঠারোর নীচে হইত, খোদার কসম আমি ওর বাপের নামে মামলা ঠুকিতাম। বেকুব সোহাগ ইহা কী করিল? খাল কাটিয়া কুমির আনিল? আমি স্থির করিয়াছি, তাহাকে পৃথক করিয়া দিব। দরকার হইলে ত্যাজ্যপুত্র বলিয়া ঘোষণা দিব। সে তাহার চেয়ারম্যান শ্বশুরের লেজুড়বৃত্তি নিয়া দিনানিপাত করুক।   

কিছু জিনিসপত্র আর ওষুধের লিস্ট দিলাম। আসার আগে মনে করিয়া সবগুলি কিনিয়া সুটকেসে ঢুকাইও।

ইতি

তোমার আব্বা।

২২. ৬. ১৯৮৬ ইং

পুনশ্চ: আবারও বলিতেছি, বাৎসরিক ছুটিতে আসিবা। চাকুরি ছাড়িয়া চিরতরে আসিবা না।

 

২.

দোয়া পর সমাচার এই যে বাবা মিনটু, চলিত মাসের ত্রিশ তারিখ তুমি দেশে আসিতেছ জানিয়া খুশি হইলাম। এতদিন যাবৎ এই খবরেরই অপেক্ষা করিতেছিলাম। কারণ পরিবারের অনেক কাজ তোমার জন্য আটকা পড়িয়া রহিয়াছে। তুমি আসার পর সব কাজ এক এক করিয়া সমাধা করা হইবে। তোমার আব্বা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছেন। মনও ভাল না। সোহাগের বিবাহের খবর শোনা মাত্রই অসুখ বাড়িয়া গিয়াছে। এই কথা বিবেচনা করিয়া বসুন্ধরায় পিনটুর বাসাতে আসিয়াছি। ভাবিতেছি, জীবনের শেষ কয়টা দিন শহরেই কাটাইব। এইখানে ভাল চিকিৎসা হইবে। গেরামে থাকিয়া কোন প্রকার লাভ হইবে না।

দেশে আসিয়া তোমার প্রথম কাজ হইল, বসুন্ধরায় একটি জমি কেনা। মিরপুরে বাসা বানাইবে বলিয়া তোমার সমন্ধীর বাসার নিকটে জমি কিনিয়াছ। ইহা কেমন কথা ? তাছাড়া বড় বউমা কেনইবা তোমার সমন্ধীর বাসায় ভাড়া দিয়া থাকিতেছে ? পিনটু তোমার আপন ভাই। সে এখানে থাকিতে তুমি মীরপুরেইবা বড়বৌমাকে রাখিতে গেলে কেন? দেশে আসিয়া ঐ জমি বেচিয়া তোমার ভাইদের লইয়া একত্রে থাকিবার নিমিত্তে বসুন্ধরা বড় বাসা বানাইবা। মিরপুরের তুলনায় বসুন্ধরা অনেক উন্নত। রাস্তা অনেক বড়। খোলামেলা জায়গা। মিরপুরে চিপা গলির মত রাস্তা। সেদিন তো একটু হইলেই একটি গাড়ি আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়া ফেলিয়াছিল। সুতরাং তুমি আসিয়া বসুন্দরায় তিনভাইর জন্য তিনতলা বাসা তেরি করিবা। পিন্টুর শশুর রড-সিমেনটের সুবিধা দিতে পারিবেন।

দ্বিতীয় কাজ হইল, বড়বৌমাকে আনিয়া আমাদের কাছেই রাখিবা। আগে আমরা গ্রামে থাকিতাম। তাই মেয়েদের পড়ালেখার অসুবিধার দোহাই দিয়া বড়বৌমা মীরপুরে তাহার ভাইয়ের বাসায় চলিয়া আসিলেন। এখন তো আমরাও শহরে থাকি। অসুবিধা হইবে কেন? মীরপুরে তুমি তাহাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, আবার এখানেও আমাদের জন্য টাকা পাঠাইতেছ, ইহাতে ডাবল টাকা খরচ হইতেছে না? একত্রে থাকিলে তো খরচ বাঁচে। এইসব বিবেচনা করিয়া আমি ও তোমার বাবা গত সপ্তাহে গিয়াছিলাম বৌমাকে আনিতে। সে তোমার অনুমতির কথা বলিল। আমরা বাঁচিয়া থাকিতে তোমার আবার কিসের অনুমতি, বুঝিলাম না। মেয়েটি বড়ই চালাক। চিঠিতে আর কিছু লিখিলাম না। তুমি দেশে আসিলে সব বলিব। তুমি আসা মাত্রই তাহাকে এখানে আনিবা। পিনটুর শশুরের বাসায় বাবুরচি আছে। আর আমরা বৃদ্ধ বয়সে বুয়ার রান্না খাই। আমাদের এইসব অসুবিধার কথা কি বড়বউমার বুঝা উচিত না? বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ির খেদমত করা তাহার উচিত না? মেজবৌমা নাতাশা ছেলেমানুষ। লেখাপড়া নিয়া সারাদিন বাহিরে থাকে। রান্না করিয়া খাওয়াইবে কিভাবে ? ইহাও বড়বৌমার বিবেচনা করা উচিত। ভাইয়ের বাসায় আরামে বসিয়া থাকিলেই চলিবে? সে নাহয় থাকিল। কিন্তু সাফা-মারোয়া? তাহারা তো আমার নাতিন। তাহারা কেন পরের বাসায় থাকিবে? 

এইবার পিনটুর কথায় আসি। তুমি দেশে আসিয়া তাহার সাথে রাগারাগি করিও না। হাজার দোষ করুক, সে তোমারই মায়ের পেটের ভাই। আমার কড়া হুকুম, মায়ামমতা বজায় রাখিবা। আরেক কথা। যদিও তাহার বিবাহের গহনাসহ যাবতীয় খরচ দিয়াছ তবুও নাতাশাকে এই প্রথমবারের মত দেখিবে। সালামী হিসাবে তাহার জন্য একপদ স্বর্ণালঙ্কার আনিও। শাড়ি আনিও না। আজকালকার মেয়ে শাড়িটাড়ি পরে না। বিবাহের সময় সোহাগ একটি শাড়ি দিয়াছিল। দামী হইলেও তাহা সে পরে নাই। কাউকে দিয়া দিয়াছে। তাহারা উচু বংশের মানীলোক। নাতাশার মা-বাবার জন্যও কিছু গিফট্‌ আনিও। ইহাতে আমাদের সম্মান বাড়িবে। আর কার কার জন্য কি কি আনিতে হইবে তাহার একটি তালিকা দিলাম। প্রতিটি জিনিস মনে করিয়া আনিও।

ইতি

তোমার আম্মা

তারিখ: ২২. ৬. ১৯৮৬ ইং

পুনশ্চ: হাসনা আর হেনার চিঠির উত্তর দাও নাই কেন ? তাহারা মনে কষ্ট পাইয়াছে। আসিবার সময় জামাইদের জন্য সুট কোট আনিবে। বেয়াইনদের জন্য শাড়ি। পুত্রা-ঝিয়ারিদের জন্য টুকিটাকি যা পার।

 

৩. 

লিখেছ, আমাদের জন্য কী কী আনতে হবে? ওগো, আমি কী চাই, তুমি কি জান না? দু’বছর ধরে দেশে আসছ না পারিবারিক কলহ এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার চাপে। তুমি আসবে - এটাই পরম পাওয়া। সহি সালামতে চলে এস। ব্যাস, আর কিছু চাই না। তোমার মেয়েরা রোজ দশবার ক্যালেন্ডারের পাতায় আগামী মাসের ‘ত্রিশ তারিখ’ দেখে। তাদের দিনও যেন ফুরোতে চায়না। তুমি এলে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে সারাক্ষণ তারই পরিকল্পনা। দাম্মামে থাকতে সী-বিচে কত আনন্দ করে বেড়িয়েছে তোমার হাত ধরে। সেই সোনালী দিনগুলো তো আর ফিরে পাবে না। তাই তুমি আসার অপেক্ষা করেই যাচ্ছে। ওদের দাম্মামের বন্ধুদের কয়েকটা ছবি আনতে বলেছে। এলবামে রাখবে। সেই পিচ্ছিরা এতদিনে নিশ্চয় বেশ বড় হয়ে গেছে। আমারও খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ওখানকার ভাবীদের কথাও খুব মনে পড়ে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল দিনগুলো কাটিয়েছি ওখানে। সবাইকে আমার সালাম বলো। 

চিঠির এক কোনায় হাসপাতালে যাবার কথা লিখেছ। সিরিয়াস কোন অসুখ নয়তো? এবারের পাঠানো ছবিতে এত রোগা রোগা লাগছে কেন? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। বছরের পর বছর ওভারটাইমসহ ছুটিহীন খাটুনি দিচ্ছ। আমি পাশে নেই। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে নিশ্চয়। দেশে এসে যদি দু’তিন মাস থাকতে পারতে তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত। জানি তো, প্রবাসজীবনের বিরামহীন কষ্ট মানুষকে সুস্থ্য থাকতে দেয়না। দেখনা, অন্তত দুমাসের ছুটি নিতে পার কিনা।

 গতকাল গ্রামের বাড়ি থেকে সোহাগ এসেছিল নূতন বউ নিয়ে। শোভা খুব লক্ষী মেয়ে। গায়ের রং শ্যামলা। কিন্ত পয়মন্ত চেহারার মধ্যে প্রখর বুদ্ধির ছাপ। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছে। ভাল রেজাল্ট। ওকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বলেছি। তুমি যদি ভাল মনে কর তাহলে মীরপুরে আমার কাছে রেখে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। আমাদের মত করে ওকে গড়ে তুলব। কি বল ? এতে করে বাবা-মার মন থেকে ওদের কোর্টম্যারেজ সংক্রান্ত মনোকষ্ট ধীরে ধীরে ঘুচবে। আমার প্রস্তাবে সোহাগ খুশি হয়েছে। এখন তোমার মতামতের অপেক্ষা।

সেদিন মা এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে। বললেন, আমাকে ওনাদের কাছেই থাকতে হবে। সাফা-মারওয়া নাকি ওখানকার স্কুলেই ভর্তি হবে। বললেন, ঐ স্কুলে পিন্টুভাইর শালাশালীরা পড়ে। এটা নাকি শহরের সবচেয়ে ভাল স্কুল, ইত্যাদি। মার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজী হতে আমার বিবেক সায় দেয়নি। প্রথমত: বাসাটা ভাড়া হয়েছে পিন্টুভাইর নামে, তোমার নামে নয়। দ্বিতীয়ত: যে ভাইকে তুমি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছ, তার কাছ থেকে পেয়েছ অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসঘাতকতা। ওর বাসায় তোমার অনুমতি ছাড়া যাব কেন ? গেলে তুমি কষ্ট পাবে। তাছাড়া সে কি শুধু তোমার মনেই কষ্ট দিয়েছে ? আমার নামেও তো নানারকম অপবাদ দিতে ছাড়েনি। আমিই নাকি ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা তৈরি করেছি। সে তো এটুকুও ভাবল না যে, দাম্মামের সুখের সংসার ছেড়ে, সাফা-মারওয়াকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে আমি চলে দেশে এসেছিলাম শুধুমাত্র পয়সা বাঁচাব বলে। আর ঐ বাঁচানো টাকা সঞ্চয় করে তিনভাইর যৌথ ব্যবসার জন্য আইসক্রীম ফ্যাক্টরী আর একসাথে থাকার জন্য বড় একটা বাসা কিনব বলে। ফ্যাক্টরী তো হল। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের উন্নতির জন্য তোমার যে সুদূরপ্রসারী ধ্যানধারণা ছিল তার কী হল? সাফা-মারওয়া, তুমি-আমি এ চারজনের আত্মত্যাগের মূল্য কী এই? 

যাহোক। একদিন সে তার ভুল বুঝবে। ক্ষমা করতে তোমার কষ্ট হবে জানি। তবু পারলে ধীরে ধীরে তাকে ক্ষমা করে দিও। আমি জানি অল্লাহ্ আমাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করবেন। দেশে এসে তার সাথে রাগারাগি করনা। তোমার জন্য দিনরাত দোয়া করছি। ভাল থেকো। সুস্থ্য থেকো। সহিসালামতে পৌঁছাও।

ইতি

একমাত্র তোমারই জান্নাত

তারিখ : ২৩.৬. ১৯৮৬

পুনশ্চ: আবার বলছি, কষ্ট করে অযথা এটা সেটা কিনে লাগেজ ভারি করতে যেয়োনা। সব সময়ই তো পাঠাও। কিছুই আনতে হবেনা। তাছাড়া মনে রেখো আমার জন্য আনতে গেলে আরো অনেকের নাম উঠে আসে। দেশে এসে এ নিয়ে অপ্রিয় কথা শুনবে আর কষ্ট পাবে। তোমার এ কষ্ট আমি চাই না।  

 

৪.

বড় ভাইয়া, আমাদের সালাম নিও। গতকাল মীরপুর গিয়েছিলাম আমার মহিয়সী ভাবী আর কলিজার টুকরো দুই ভাতিজীকে দেখতে। শোভার কথা নিশ্চয় শুনেছ। ওকে কীভাবে গ্রহণ করবে এই ভয়ে এতদিন সরাসরি লিখতে সাহস করিনি। বড়ভাবী এই পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি নিজের গহনা পরিয়ে ওকে আশীর্বাদ করে স্বীকৃতি দিলেন। তারপরই না তোমার কাছে চিঠি লিখতে সাহস পেলাম। ভাবীর স্নেহের ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব জানিনা। মাঝে মাঝে তুলনা করে আশ্চর্য হই, কীভাবে যে জোড়া মিলে যায়। বড়ভাবীর মনটা ঠিক তোমার মত। আর ছোটভাবীর মনটা ঠিক ছোটভাইয়ার মত। আব্বা আম্মাতো ধনের জৌলুস দেখে তাকে মাথায় তুলে রেখেছেন। আমার বিশ্বাস, দেরিতে হলেও একদিন খাঁটি সোনা চিনতে পারবেন।

বড়ভাবীর মুখে শুনলাম, এ মাসের ত্রিশ তারিখ দেশে আসছ। শুনে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিস্ক নেবার মত ভরসা পাচ্ছি। প্রথমতঃ তোমার উপস্থিতিতে আব্বা আম্মাকে বুঝিয়ে শোভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তোলা।

দ্বিতীয়তঃ আলীগঞ্জ বাজারে লাভজনক একটা একতলা দোকান বিক্রি হচ্ছে। ভবিষ্যতে দোতলা বা তিনতলা করা যাবে। গ্রামে বসেই শহরে ব্যবসা করা যাবে। ওরা সর্বমোট দু’লাখ চায়। অগ্রিম পঞ্চাশ হাজার টাকা আমি আমাদের সমিতি থেকে ধার নিতে পারব। তোমার কাছে বাকি দেড় লাখ টাকা চাইতে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমাকে মাস্টার্স পাশ করাতে তুমি যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করেছ। বৃথা গেল এই খোটা দিয়ে আব্বা আম্মা আমাকে হরদম বকাঝকা করেন। তোমার অতি আদরে নাকি আমি বাঁদর হয়েছি। মানুষ হইনি। সব দোষ নাকি তোমার।

কিন্তু ভাইয়া, মানুষ না হলেও অমানুষ তো হইনি। কাদের স্যারের অগ্নিমন্ত্রে আমি দীক্ষিত। গ্রামের সার্বিক কল্যাণের জন্য এখন অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। গ্রামে আমার সুনাম এবং প্রতিপত্তি যথেষ্ট রয়েছে। আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান। শোভার কল্যাণে আজকাল তিনিও পাল্টাতে আরম্ভ করেছেন। শোভাকে বিয়ে করেছি বলে আব্বা তো বলেন, আমি নাকি খাল কেটে কুমীর এনেছি। আব্বা অত পলিটিক্স বুঝবেন কী করে? বুঝেন তো কেবল মামলা-মোকদ্দমা। আমি খাল কেটে কুমীর আনিনি। বরং গ্রাম থেকে কুমীরের রাজত্ব উৎখাত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তদুপরি আমার বাপ-দাদা যা পারেননি আমি তা পেরেছি। বিগত ত্রিশ বছরের মহাযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে প্রকারান্তরে চেয়ারম্যানকে সারেন্ডার করতে বাধ্য করেছি। জবরদখলকৃত জমি উনি ফিরিয়ে দিতে রাজী। শুধু কি তাই? ইউনিয়নবাসীর উন্নতির দিকেও আজকাল মনোযোগী হয়েছেন। আব্বা আর কী চান? যদি গ্রামের মঙ্গল চান তাহলে আমার প্রতিটি কৌশল বোঝার কথা। পক্ষান্তরে উনি যদি আমাদের পরিবারের বহিরাগত মন্ত্রণাদাতা জনৈক বেয়াইকে (পিন্টুভাইর শ্বশুর) প্রাতঃস্মরণীয় মহাজ্ঞানী মহাজন ভাবেন, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।

যাহোক। যা বলছিলাম, তুমি দেশে এসে দোকানটা দেখবে। পছন্দ হলে তোমার নামেই কিনে ফেলব এবং ব্যবসা আরম্ভ করে বেকারত্ব ঘুচাব। টাকাটা আমি ধার হিসেবেই চাচ্ছি। আমাকে অবিশ্বাস কর না ভাইয়া। আমি তোমার এম. এ পাশ করা পিন্টু নই।

পিন্টুসাহেবের বসুন্ধরার বাসায় গিয়ে আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে এসেছি। শ্বশুরের দেওয়া দামী ফার্নিচারে ঠাসা তার বাসা। এমন কোন জিনিস নেই যা পিন্টুভাইর নিজের কেনা। আব্বা আম্মাকে দেখলাম খুব গর্বিত। শোভা মীরপুর আছে জেনেও না জানার ভান করলেন। ওনাদের বকাঝকা তো আমার নিত্যসাথী। এখন আর দুঃখ পাইনা। কিন্তু দুঃখ লাগে, আমাদের যে মাতাপিতা অল্পেতুষ্টি আর সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, সেই মাতাপিতা এখন শহরের জৌলুস আর বিলাসী জীবনের প্রতি ক্রমশ ঝুঁকে পড়েছেন। ওনাদের কামরায় এখন নিজস্ব রঙীন টিভি। বিদেশী চ্যানেলের সিরিয়ালের নেশায় থাকেন বুঁদ। দুনিয়াদারী চাহিদার শেষ নেই। কে তাদেরকে পল্লীবাংলার দিকে ফেরাবে? কে ফেরাবে আখেরাতের চিন্তার দিকে ?

অনেক কিছু লিখলাম। ভুল বুঝো না যেন। আমার ওপর আস্থা রেখো। শোভার সালাম নিও। আমরা ভাল আছি।

ইতি

তোমার ছোটভাই সোহাগ

তারিখ : ২৪. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চ: এয়ারপোর্টে অবশ্যই ভাবী আর সোনামণিদেরকে নিয়ে আমি উপস্থিত থাকব। কোন চিন্তা কর না।

 

 ৫.

আমার কলিগ মাসুদ খান অফিস থেকে ফেরার পথে হাসপাতলে এসে এই চারটা চিঠি দিয়ে গেল। এখনই উত্তর লিখে ফেলা দরকার। কারণ ধূসর সময়টাকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। মহাকাল আমাকে আর বেশি সময় দেবে বলে মনে হচ্ছে না।

চাওয়া মাত্রই নার্স কাগজ-কলম দিয়ে গেল। আলাদা করে সবার চিঠির জবাব দেবার মত সময় বা মন কোনটাই নেই। যতদূর আন্দাজ করছি, শীঘ্রই আমাকে লাইফ-সাপোর্টে নেওয়া হবে। তাই সময় থাকতে অছিয়ত-নামা লিখে যাচ্ছি। এতেই একত্রে সবার চিঠির জবাব থাকবে।

আমার পুত্র সন্তান নেই বিধায় প্রবাসজীবনের ষোলটি বছরের উপার্জিত স্থাবর অস্থাবর যৎসামান্য সম্পদ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক নিম্নলিখিত ওয়ারিশদের নামে বন্টন করে দিচ্ছি। এরপর পৃথিবীতে যেভাবে নিঃস্ব অবস্থায় এসেছিলাম, ঠিক সেভাবেই নিঃস্ব অবস্থায় পরম করূণাময়ের কাছে প্রত্যাবর্তন করব।

 

ক. মা-বাবা এবং দুই বোন: নদীর পারে যে জমি কিনেছিলাম তা সম্পূর্ণ তাদের নামে যাবে। দেখেশুনে প্রত্যেকে শরীয়ত মোতাবেক বন্টন করে নেবেন। আব্বা-আম্মা তাগিদ দিচ্ছিলেন ওনাদেরকে হজ্ব করাতে। হজ্ব করানোর মালিক তো আল্লাহ। আমি নই। আর হজ্ব করতে হয় নিজস্ব সম্পদ থেকেই। সুতরাং উক্ত জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ওনারা এ বৎসর হজ্ব করবেন।      

খ. দুই ভাইঃ  আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে পিন্টু ফ্যাক্টরীটা নিজের নামে লিখে নিয়েছে। সে তার প্রাপ্য অংশের বেশি পেয়েছে। সুতরাং তার আর পাওনা নেই। আমার স্ত্রীর অনুরোধক্রমে তাকে আমি ক্ষমা করলাম। কিন্তু কয়েক শর্তে। তার একমাত্র জীবিত ভাই সোহাগকে যেন না ঠকায়। আব্বা আম্মার যেন অযত্ন না হয়। তাদের জন্য ভাল একটা বাবুর্চি যেন রেখে দেয়। আমবাগান, লিচুবাগানের ফল আর জমির ফসল বিক্রির সব টাকা যেন ওনাদের হাতেই তুলে দেয়।আর বোনদের হক যেন আদায় করে। অর্থাৎ পৈত্রিক সম্পদের অংশ প্রদান করা, খোঁজখবর নেওয়া, মাঝেমাঝে নাইওর আনা, সামাজিকতা লৌকিকতা বজায় রাখা ইত্যাদি।

দাম্মামে আমার গাড়ি এবং ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা আমার বন্ধু মাসুদ খানের তদারকিতে থাকবে। উক্ত টাকা সোহাগের জন্য রইল। সে তার ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়ে বাকি টাকা দিয়ে শোভার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে এবং ওদের রিসিপশনের অনুষ্ঠানে ব্যয় করবে। খোদার হুকুমেই তো ওদের বিয়ে হয়েছে। এ হুকুম বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে আব্বা আম্মা যেন তাদেরকে সমাদরে গ্রহণ করেন এবং চেয়ারম্যানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। তিনি তো গ্রামসম্পর্কে আব্বারই জ্ঞাতিভাই। সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানেই মঙ্গল।

 

গ. আমার স্ত্রী এবং জমজ কন্যাঃ আমার মৃত্যুর পর কোম্পানী থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে তা এবং সোনালী ব্যাংকে যৎসামান্য যা আছে তা সম্পূর্ণ তাদের। মীরপুরে আমার স্ত্রীর নামে কেনা একটুকরো জমি আছে। এ টাকায় তেতলা বাড়ি হবে। দোতলায় ওরা থাকবে এবং বাকি অংশ ভাড়া দিয়ে দিন গোজরান করবে। তাদের হেফাজতের ভার আল্লাহতা’লার ওপর রইল। আমার সম্বন্ধীর কাছে অনুরোধ রইল তিনি যেন তাদেরকে তার কাছাকাছিই রাখেন। আরেকটা কথা বিশেষভাবে বলছি, আমার মেয়েরা যেন তাদের দাদাবাড়ির অধিকার ও স্নেহমমতা থেকে বঞ্চিত না হয়।

রণক্লান্ত হাতখানি অবশ হয়ে আসছে। আর লিখতে পারছি না। ত্রিশ তারিখ দেশে যাবার জন্য বিমানের টিকিট নেবার পরদিন থেকে হাসপাতালে পড়ে আছি। বন্ধুরা সান্তনা দেয় ভাল হয়ে যাব বলে। ডাক্তারও পেশাসুলভ পজিটিভ অভিব্যক্তি দেখায়। কিন্তু আমি জানি বাংলাদেশ বিমান আমাকে কী অবস্থায় স্বদেশে দেশে নিয়ে যাবে। দাম্মামের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ: আমার চলিত মাসের বেতন থেকে যেন হাসপাতালের পাওনা মেটানো হয়। আমাকে যেন শোয়ানো হয় গ্রামের বাড়ির শ্যামল মাটিতে। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।

ইতি

একজন হতভাগ্য মিন্টু

তারিখ : ২৬. ৬. ১৯৮৬

পুনশ্চঃ বন্ধু মাসুদ, প্রতিদিন তুমি এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছ। তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে আরো একটি অনুরোধ করছি। আমার এ চিঠি ফটোকপি করে রেখো। মূলকপি যাবে তোমার ভাবীর কাছে। আর সাত কপি যাবে আমার মা বাবা, দুইভাই আর দুইবোন আর আমার সমন্ধীর কাছে। অপর পৃষ্ঠায় ঠিকানা দেওয়া আছে। বিদায়।

--------------------------