Thursday, August 8, 2019

কুকুর বিভ্রাট (প্রতিবেদন)

কুকুর বিভ্রাট
-নাজমুল চৌধুরী


বাসার সন্নিকটে আসতেই গেটের সামনে লোকজনের ভিড় ঠেলে দেখতে পেলাম আমার কাজের মেয়ে নাজমার মা অর্থৎ সকিনা তার নাতিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। জানতে চাইলাম কি হয়েছে তোমার?  কেউ মেরেছে? আর তোমার নাতিকে জড়িয়ে আছ কেন? নয়দশ বছর বয়সের নাতি আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে নানাজান আমাকে পাগলা কুকুর কামড় দিয়েছে। নাজমার মা এবার আমার দিকে তাকিয়ে উৎকন্ঠিত স্বরে বলে একটা দু’টো নয়, তিন তিনটে কামড়! উরুতে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে হারামজাদা কুকুর। এখন কি হবে ওর ? কুকুরের বাচ্চা পেটে জন্মাবে আর নাতিটি মারা যাবে, মেয়ের কাছে কি জওয়াব দেব? 

বললাম, ওকে নিয়ে বাসায় যাও। দেখি কি করা যায়?  জানতে চাইলাম তোমার মেয়ে নাজমা কোথায়? 

ও তো সেই সাতসকালে গার্মেন্টের কাজে গেছে, ফিরতে বিকেল হবে। এসে যখন দেখবে ছেলেটিকে কুকুর কামড়েছে তখন কি আর আমাকে আস্ত রাখবে। নাতিটিকে ওর বাপের কাছে রেখে আপনাগোর বাসায় কাজে এসেছিলাম কিন্তু আমার খুঁজে নাতিটি আপনাদের বাসার গেটের কাছে আসতেই ঘটে গেল ব্যাপারটি। পাগলা কুকুরটি ছোটমানুষ পেয়ে কামড় বসিয়ে দিল। বোধহয় নাতিটি ইটপাটকেল ছুঁড়েছিল।

ঠিক আছে, এখন কি আর করা যায়। কুকুরের পায়ে তো প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কামড়ানো যাবেনা। বাসায় গিয়ে ডেটল দিয়ে ক্ষতস্থানগুলো ভালভাবে পরিষ্কার কর। এখনই যেতে হবে মহাখালী চিকিৎসা কেন্দ্রে। আমি গাড়ি বের করছি। তুমি তাড়াতাড়ি ওকে রেডি করে নিয়ে আস। 

ঢাকার মহাখালী পশুর কামড়ের প্রতিষেধক চিকিৎসা কেন্দ্র আমার বাসা হতে প্রায় বিশ কিলোমিটারের পথ। নানী-নাতীকে নিয়ে মানবিক কারণে অগত্যা ছুটতে হল। পৌঁছতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেল। ইমারজেন্সীর ডাক্তারের কাছে ব্যাপারটি বলার পরপরই ডাক্তার একটি প্রতিষেধক ইনজেকশন দিয়ে বললেন ছেলেটিকে চৌদ্দটি ইনজেকশন দিতে হবে প্রতি তিনদিন পরপর। নিয়ে আসতে পারবেনতো? দেখুন অবশ্যই তিনদিন পরপর নিয়ে আসতে হবে নতুবা ইনজেকশনের কর্মক্ষমতা লোপ পাবে এবং ছেলেটি মারাও যেতে পারে। 

নাজমার মা অর্থাৎ সকিনাকে বললাম, প্রতি তিনদিন পরপর নিয়ে আসতে হবে তোমার নাতিকে, এতে অন্যথা হলে তোমার নাতির বিপদ ঘটতে পারে। 

কাঁদো কাঁদো স্বরে নাজমার মা বলল ঠিক আছে সাহেব, আমি বাসে চড়ে নাহয় ওকে সময় সময় নিয়ে আসব। কপাল খারাপ নতুবা এমন হবে কেন? 

ডাক্তার একটি কার্ড দিলেন এবং ইনজেকশনের তারিখগুলো কার্ডে লিখে দিতে ভুললেননা। ধন্যবাদ জানালে বললেন, দেখুন প্রতিদিন এখানে কুকুরের কামড়ানো বিশপঁচিশটি রোগী আসে। এইতো কিছুক্ষণ আগে একজন পরিবেশবাদী নেতার ছেলে ও একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলারের ছেলেকে একই কারণে ইনজেকশন দিয়েছি।   

প্রত্যুষে হাঁটা আমার নিয়মিত অভ্যাস। প্রতিদিন দুই কিলোমিটার হাঁটতে হয় কারণ পরীক্ষা করে ডায়াবেটিকের লক্ষণ শেষপ্রান্তে উঠানামা করছিল। তাছাড়া চাকুরী হতে অবসর নেয়ার পর হাঁটাচলা কম বলে শরীরে রক্ত চলাচলও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।  বাসার সামনেই পিচঢালা আঠারো ফিট পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে প্রতিদিন দেখা হয় একপাল কুকুরের সাথে। দলের মধ্যে কোন কোন সময় চল্লিশ পঞ্চাশটিও থাকে। খুব সাবধানে ওদেরকে অতিক্রম করতে হয়। সমগ্র রাস্তা জুড়ে ওদের বিচরণ, কামড়া-কামড়ি, ধস্থাাধস্থি, ঘেউ ঘেউ করে একজনের পেছনে আরেকজনের ধাওয়া দেখতে দেখতে আজকাল অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। অনেক সময় লজ্জা-সম্ভ্রমের মাথা খেয়ে রাস্তার মাঝখানেই রতিলীলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের অনেকেই। অপেক্ষমান যুবক কুকুররা তাদের পালার অপেক্ষায় ঘেউ ঘেউ শব্দে দ্রুত সমাপ্তির আহ্বান জানায়। পথিকরা উৎসুক দৃষ্টি প্রসারিত করে রতিলীলা উপভোগ করে। দুষ্ট ছেলেরা রতিলীলার বিচিত্র টানাটানি দেখে ইট-পাটকেলও ছুঁড়তে দ্বিধা করেনা। বয়স্করা নিম্নদৃষ্টিতে তড়িগড়ি করে পালিয়ে বাঁচে। প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়ে পরা মহিলারা এরূপ দৃশ্য দর্শনে লজ্জায় মাথার কাপড় টেনে দ্রুত স্থান ত্যাগে তৎপর হয়ে উঠে।  

ব্রিটিশ ভারতে ১৯২০ সালে পশু-পক্ষীদের উপর অমানবিক আচরণ করার বিপরীতে একটি আইন পাশ হয় ১৯২০ সালে, যা ১৯৪৭ সাল হতে পাকিস্তানের আইনের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ আইন অনুসারে পশু-পক্ষীর সাথে অমানবিক আচরণ বা অন্যায়ভাবে হত্যা করলে এবং হত্যাকারীর বিরুদ্ধে মামলা হলে, হত্যাকারী নিজের দোষ স্বীকার করলে মাত্র ২০০/- টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়া পাওয়ার বিধান ছিল। পাখী শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেক আইনপ্রণেতারাও পাখী-শিকারে অভ্যস্থ ছিলেন। কুকুরের উপদ্রব হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য কুকুর-বিড়াল হত্যা করার উপরও আইনের তেমন কোন প্রয়োগ ছিলনা। বিশেষ করে ক্ষেপা কুকুর মারার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা হত। 
 
২০১৫-২০১৮ সালের মধ্যে অহেতুক পশু নিধনের কারণে পশু-অধিকার সংরক্ষণ সংগঠনের পক্ষ হতে মাত্র তিনটি মামলা রুজু করা হয়। কিন্তু সকল মামলা প্রয়োজনীয় সাক্ষী এবং দুর্বল আইনের কারণে স্থগিত হয়ে যায়। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ”পশু-পক্ষী অভয়ারণ্য সংগঠনের” উদ্যোগে ঢাকার রামপুরায় একটি কুকুর হত্যার দায়ে মামলা হলে তিনজন মানুষকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং এই প্রথমবারের মত কুকুর হত্যার দায়ে মামলা এবং মামলার প্রেক্ষিতে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা নিজেদের দোষ স্বীকার করে জনপ্রতি মাত্র ৩০০/- করে জরিমানা দিয়ে ছাড়া পায়।  
  
পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মীদের আন্দোলনের চাপে সরকার পক্ষ হতে সাম্প্রতিককালে পশু-পক্ষী, কুকুর বিড়ালের উপর অমানবিক আচরণের নিমিত্তে শাস্তির বিধান রেখে কঠোর আইন প্রণয়ণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শাস্তিমূলক আইনের এ বিধানে পশু-পক্ষী হত্যার অপরাধে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা ও উর্ধ্বে দু’বছরের জেল কিংবা উভয়প্রকার শাস্তির বিধান রাখা হয়। কিন্তু এ বিধানও কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণ হওয়াতে পশু-অধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয় অনেক সময় পশুর অপ্রত্যাশিত ব্যবহারের কারণে মানুষও আঘাতপ্রাপ্ত কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ হয় সুতরাং পশু-পক্ষীদের অভয়ারণ্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ প্রয়োজন উপলব্ধি করে সরকার বৃহত্তর সিলেটের হাওরাঞ্চল ও বনাঞ্চল, খুলনার সুন্দরবন, ভোলার সন্নিকটে নিঝুম দ্বীপ এবং চট্রগ্রামের কিছু কিছু বনাঞ্চল পশু-পক্ষীর অভয়ারণ্য হিসাবে সংরক্ষণ ও শিকার নিষিদ্ধ করে। 

আইন মেনে চলার কারণে আজকাল কুকুর-বিড়ালের উৎপাত ক্রমশ: বেড়েই চলছে। একটি সমীক্ষায় দেখা যায় বাংলাদেশের ষোলকোটি মানুষের বিপরীতে কুকুর-বিড়ালের সংখ্যার সঠিক তথ্য নেই। তবে অনুমান করা যায় এ সংখ্যা ক্রমেই বিপদসীমা অতিক্রম করবে। মানুষের চেয়ে একটি কুকুর বছরে ছয়মাস অন্তর চার-পাঁচটি করে বছরে দু’বারে আট-দশটি বাচ্চা প্রসব করে। বিড়ালও বছরে সমপরিমাণ বাচ্চা প্রসব করে। অথচ মানুষ বছর-দু’বছরের ব্যবধানে প্রসব করে মাত্র একটি বাচ্চা। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ূ ৭২ বছর। এই আয়ূর মধ্যে একজন মহিলা ১৩-৩৫ বছরের মধ্যে ১০-১২টি সন্তান প্রসবে সক্ষম। এ সংখ্যাটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কারণে আজকাল ২-৫ টি সন্তানের জন্ম দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ কুকুর কিংবা বিড়ালের মানুষের মত কোন সীমাবদ্ধতা নেই বলে তাদের গড় আয়ূ ১০-১৫ বছরের মধ্যে মানুষের চেয়ে শতকরা ১৩% বেশী সন্তান প্রসবে সক্ষম। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার চেয়ে আনুপাতিক হারে কুকুর-বিড়ালের সংখ্যা একসময় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

আমেরিকার বে-সরকারী গবেষণা সংস্থা ((Dogbite org. & trauma center studies) তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে উল্লেখ করে যে ২০০৫-২০১৮ সালের মধ্যে  গৃহপালিত কুকুরের অক্রমণে ৪৭১ জন মানুষ আমেরিকায় মারা যায়। 

প্রতিদিন আমেরিকায় প্রায় ১০০০ জন মানুষ কুকুরের কামড়ের শিকার হন এবং বছরে ৯,৫০০ জন হাসপাতালে আহত অবস্থায় ভর্তি হন। ইউরোপ ও আফ্রিকার খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশগুলোতে লোকসংখ্যার আনুপাতিক হারে প্রতি বছর গৃহপালিত কুকুরের আক্রমণের কারণে লোকজনের হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর রেকর্ডকৃত জরীফে দেখা যায় শুধু আমেরিকাতেই ১৯৯৬ সালে গৃহপালিত ৬৬,৩০,০০০ কুকুর এবং বিড়াল বাচ্চার জন্ম হয়েছে, তন্মধ্যে ১০০০টি কুকুরের বাচ্চার মধ্যে ৮ টি এবং বিড়ালের বাচ্চাদের মধ্যে ৮.৫ টি প্রসূতি ঘরে মারা গিয়েছে। 

কুকুর-বিড়াল এবং মানুষের তূলনামূলক জন্মের হার ঃ 

জাপানে কুকুরের জন্মহার আমেরিকা ও ইউরোপের তূলনায় অনেক বেশী। জাপানে মানুষের জন্মহার ১০০০ মানুষের বিপরীতে ৭.৮৭ জন। অন্যদিকে আমেরিকাতে হাজারে ১৪.৪, অস্ট্রেলিয়াতে হাজারে ১২ এবং যুক্তরাজ্যে হাজারে ১২ জন মানবসন্তান জন্ম নেয়। প্রতি হাজারে গড়ে ৪২-৪৫ জন জন্ম নেয় আফ্রিকার  এঙ্গোলা, নাইজার, মালি, উগান্ডা, জাম্বিয়া, বুরুন্দি, বুকিনি ফ্যাসো, মালায়ি, সুদান এবং সোমালিয়ায় এবং এশিয়ার আফগানিস্থান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ২৩-৩৫ জন। 

কুকুর-বিড়াল যৌবনে উপনীত হওয়ার প্রথম ৫ বছরে ৪০-৪৫টি সন্তান প্রসবে সক্ষম। পক্ষান্তরে আমাদের মহিলারা আনুপাতিক হারে বিয়ের প্রথম ৫ বছরে গড়ে তিনটি সন্তান এবং ১৩-৩৫ বছরের মধ্যে ১০-১২টি সন্তান প্রসব করতে সক্ষম। তবে বর্তমান জমানায় অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আনুষাঙ্গিক চাপের কারণে পরিবার পরিকল্পনার গ্রহণের মাধ্যমে কিংবা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমাদের সমাজে নর-নারীরা গড়ে ২টি সন্তানের পিতামাতা হতে আগ্রহী। এতে সহজেই অনুমেয় যে, সময় সন্ধিক্ষণে আমাদের দেশে মানুষের তূলনায় কুকুর-বিড়ালের সংখ্যা বেড়ে যাবে অনেকগুণ। বিশেষায়িত হাসপাতালে কুকুরে কামড়ানো প্রতিষেধক অপ্রতুল থাকার কারণে আমাদের সময়মত সু-চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভবপর হচ্ছেনা। 
 
এমতাবস্থায় ভবিষ্যত পরিকল্পনা হিসাবে আমাদের কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশ অথচ লোকসংখ্যা প্রতি বর্গমাইলে ১২০০ এর উপরে। লোকসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ছে অথচ নদীভাঙ্গন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। জমির তূলনায় মানুষের আধিক্য বেশী থাকায় এদেশ ক্রমেই বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যদি কুকুর-বিড়াল প্রজাতি প্রতি বছর ১৩% হারে বাড়তে থাকে তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরে কুকুর-বিড়াল শুধুমাত্র কামড়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা, সুযোগ পেলে বন্য কুকুরের মত জীবন্ত মানুষকে শিকার করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ে তাদের উদর পূর্ণ করবে।

অনাগত ভবিষ্যতের এহেন পরিস্থিতিতে এখনই সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে হবে নতুবা কোনক্রমেই বিপদ এড়ানো সম্ভব হবেনা। পরিবেশবাদীরা কি ভাবছেন তাদের উত্তরসূরীরা এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে কি করবে? 

হ্যাঁ - আমাদের সামনে একটি পথ খোলা আছে। যদি সরকার এবং পরিবেশবাদীরা  শুধুমাত্র বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের উন্নতির কথা ভাবেন তাহলে কচ্ছপ এবং ব্যঙের মত কুকুরও রপ্তানী করা যেতে পারে। এ পৃথিবীতে অনেক দেশের বেশরিভাগ লোক কুকুরের মাংস ভক্ষণ করে থাকে। যেমন চীন, উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ার নৃগোষ্ঠী, ভারতের নাগাল্যান্ড, সুইটজারল্যান্ড প্রমুখ দেশসমূহ। শুধুমাত্র কুকুরের মাংস ভক্ষণকারী কোরিয়াতে ১৭,০০০ কুকুরের খামার রয়েছে আমাদের দেশের হাঁস-মুরগীর খামারের মত।  চীনে প্রতিবছর ৫০ লক্ষ, কোরিয়ায় ৩৫ লক্ষ, ভিয়েতনামে ৪০ লক্ষ, ভারতের নাগাল্যান্ডে ১৫ লক্ষ, ইন্দোনেশিয়ার নৃগোষ্টীর লোকেরা ১০ লক্ষ এবং সুইটজারল্যান্ডে খ্রিস্টমাসের দিনগুলো কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ কুকুরের মাংস ভোজনের হিড়িক পড়ে যায়। তাছাড়া আফ্রিকার কিছু কিছু দেশের অধিবাসীরা কুকুরের মাংস ভক্ষণ করে থাকে। 

আমাদের নেতা-নেত্রীরা শুধুমাত্র বক্তব্যের মধ্যে আটকে আছেন। বিদেশী ঋণ সহায়তা আমাদের বাজেটের একটি বিরাট অংশ জুড়ে থাকে। অনির্দিষ্ট বিদেশী সাহায্য ও ঋণকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় বাজেট প্রনয়ণ করা হয় এবং বাৎসরিক জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়। জাতীয় উন্নয়নের জন্য বে-সরকারী বিনিয়োগ উদ্যোগ একান্ত জরুরী তাই সরকারকে সেভাবেই চিন্তা করতে হবে। আমাদেরকে স্বাবলম্বী হতে হবে। রপ্তানীমুখী পণ্যের উদ্ভাবন করতে হবে। বে-সরকারী উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে। নতুবা প্রবৃদ্ধির হার কমবে বই বাড়বেনা। যেহেতু আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান এবং সরকারী পৃষ্টপোষকতায় কৃষিভিত্তিক রপ্তানীযোগ্য দ্রব্যাদির উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৎপর হতে হবে। সরকারীভাবে বে-সরকারী খাতে নিম্নলিখিত কৃষিপণ্য উৎপাদনের অবাধ ছাড়পত্র দিতে হবে যাতে কৃষক এবং বিনয়োগকারীরা উৎসাহিত হন এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখেন ঃ


১) যেহেতু পশু-পক্ষী নিধনের বিপরীতে বাংলাদেশে শাস্তিমূলক অপরাধ আইন কার্যকরী, এ কারণে বর্তমানে কুকুর-বিড়ালের প্রজনন বিপদসীমা অতিক্রম করতে চলেছে এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট খাদ্যঘাটতি রয়েছে। এমনও দিন আসবে যখন কুকুররা সংঘবদ্ধভাবে খোলা রাস্তায় মানুষেকে আক্রমণ করবে বন্য কুকুরের মত। এতে বাংলাদেশের স্কুলগামী কোমলমতি শিশু এবং প্রাপ্তবয়ষ্করা নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। তাই রাস্তার নেড়ী কুকুর আধূনিক পদ্ধতিতে ধরে উপরোক্ত দেশসমূহের আমদানীকারকদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে জীবিত অবস্থায় জাহাজ বোঝাই করে রপ্তানীর ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবী যাতে দেশের মানুষের নিরাপত্তা হুমকি প্রতিরোধ করা যায় এবং পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা নিশ্চিত করা যায়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া, সুদান, সোমালিয়া ইত্যাদি দেশ পবিত্র হজ্জের সময় সৌদিআরবে জাহাজ বোঝাই করে লক্ষ লক্ষ কু’রবানীর পশু রপ্তানী করে কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে আসছে। তাহলে আমাদের দেশের রপ্তানীকারকরা কেন পারবেননা ? শুধুমাত্র সরকারী অনুমোদন এবং উৎসাহ পেলে রপ্তানীকারকরা স্ব-ইচ্ছায় এগিয়ে আসবেন বলে বিশ্বাস।  


২) চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশে আমাদের দেশের আনাচে কানাচে, জলাশয়ে এবং কৃষি জমিতে জন্মলাভ করা কোলা ব্যঙ বা ঘাউরা ব্যঙ, কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি এবং কচ্ছপ ঐ সমস্ত দেশে অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার বিধায় রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী এবং কৃষকরা এ ব্যাপারে সরকারী পৃষ্টপোষকতা এবং অনুমোদন ছাড়াই আইনের ফাঁকফোকরে কোলা ব্যঙ রপ্তানী করে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সমর্থ হচ্ছেন। বর্তমানে কেবল গলদা চিংড়ি রপ্তানী হচ্ছে। তাই অবিলম্বে বে-সরকারী উদ্যেক্তাদেরকে অব্যবহৃত জলাশয়ে চিংড়ি ঘেরের মত করে কোলা ব্যঙ, কচ্ছপ এবং কাঁকড়ার ঘের নির্মাণ করে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারীভাবে অনুমোদন ও উৎসাহ প্রদান করা প্রয়োজন যাতে উদ্যেক্তারা নূতন উদ্দমে উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেন।

৩) ঔষধ শিল্পে সাপের বিষ একান্ত জরুরী বিধায় দেশের প্রয়োজনে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাপের খামার গড়ে তোলা প্রয়োজন। সাপের বিষ দেশে এবং বহির্বিশ্বের ঔষধশিল্পে দামী প্রতিষেধক হিসাবে বিবেচিত। আমাদের দেশে বনে-জঙ্গলে অনেক বিষাক্ত সাপ রয়েছে। এগুলো সংগ্রহ করে সাপের খামার গড়ে তোলার জন্য সরকারী পৃষ্পপোষকতা ও অনুমোদন প্রয়োজন। সরকারী অনুমোদন পেলে আমাদের বে-সরকারী উদ্যোক্তারা সাপের খামার গড়ে মূল্যবান সাপের বিষ সংগ্রহে উৎসাহী হবেন বলে বিশ্বাস।সাপের কামড়ের প্রতিষেধক আমাদেরকে বিদেশ হতে আমদানী করতে হয়। যদি উক্ত প্রতিষেধক আমাদের দেশেই সাপের খামার হতে উৎপাদন সম্ভব হয় তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো সম্ভব হবে। 

৪) কুমীরের চামড়া ও মাংসের কদর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে কুমীরের খামার গড়ে তোলার জন্য সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও অনুমোদন প্রয়োজন যাতে উদ্যোক্তারা এ শিল্পে উৎসাহিত হয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, অব্যবহৃত পতিত জলাশয়ে কুমীর উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমাদের কৃষিব্যবস্থায় কিছুসংখ্যক উদ্যোগী কুমীর চাষে আগ্রহী হলেও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ার কারণে চাষীরা  এ শিল্পে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

পরিশেষে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটা বলা যায়, আমাদের সরকার এবং বিরোধীদল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ত। দেশের উন্নয়নের জন্য যা যা প্রয়োজন সে সমস্ত ব্যাপারে উদাসীন এবং শুধুমাত্র রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যেই উন্নয়ন সীমাবদ্ধ। দেশের সার্বিক উন্নয়নে নূতন নূতন রপ্তানী ক্ষেত্র উদ্ভাবন করা এখন সময়ের দাবী।         
     
==========================
    

No comments:

Post a Comment

What do you think?