গুপ্তচর সংস্থা ইসরাইলী মোসাদ পৃথিবীর দক্ষতম ঘাতক প্রতিষ্ঠান (Must read)
- নাজমুল চৌধুরী
গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা ’মোসাদ’ একটি ভয়ংকর নাম। পৃথিবীর কোন গুপ্তচর সংস্থা এত গুপ্তহত্যা করেনি যতনা এ প্রতিষ্ঠানের গুপ্তচরেরা করেছে। ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী কোন কাজে নিয়োজিত বৈজ্ঞানিক, গবেষক, রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী যে কোন দেশের নাগরিক হোকনা কেন, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর তাদেরকে নির্মুল করাই মোসাদের অন্যতম টার্গেট হিসাবে বিবেচ্য। মানবসভ্যতার অগ্রগতি কিংবা মানবতার নিরিখে এ প্রতিষ্ঠানটির আদর্শ এবং কার্যকলাপ কতটুকু স্বস্থিদায়ক তার মূল্যায়নের ভার পাঠককূলের উপর। হিব্রæ ভাষায় ব্যবহৃত মোসাদের অর্থ ইংরেজীতে দাঁড়ায় ‘দি ইন্সটিটিউট ফর ইনটেলিজেন্স এন্ড স্পেশাল অপারেশনস্’।
১৯৪৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিবে মোসাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর সাথে যুক্ত রয়েছে কাউন্টার ইনটেলিজেন্স উয়ং। অফিস ষ্টাফসহ প্রায় ১২০০-১৪০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারী এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। তামির পার্ডো-এর পরবর্তী ইওসি কোহেন (ণড়ংংর ঈড়যবহ) ২০১৬ সাল হতে এর ১২তম পরিচালক হিসাবে দায়িত্বভার পালন করছেন। প্রধান মন্ত্রীর তত্ত¡াবধানে এর সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এ প্রতিষ্ঠান ইসরাইল রাষ্ট্রের জাতীয় গুপ্তচর সংস্থা হিসাবে পরিচিত। এর জন্য রয়েছে নামে বে-নামে প্রতিষ্ঠিত মোসাদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, কুটনৈতিক মাধ্যম, বন্ধুভাবাপন্ন দেশসমূহের মধ্যে গোপনীয় তথ্য আদান প্রদান, তথ্যসরবরাহের জন্য আধূনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, উন্নত প্রযুক্তি এবং অস্ত্র নির্মাণের জন্য অত্যাধূনিক গবেষণাগার। মোসাদ অভ্যন্তরে রয়েছে মিলিটারী ইনটেলিজেন্স সরবরাহকারী ইউনিট ”আমান”, চোরাগুপ্তা হামলাকারী ইউনিট ”ডিইভডিভান”, গুপ্তহত্যা ও অপহরণকারী ইউনিট ”কিডন”, অভ্যন্তরীন প্রতিরক্ষা ইউনিট ”সিনবেথ”, সাইবার কন্ট্রোল ইউনিট এবং সুদক্ষ বর্ডার পুলিশ ”ইয়ামাম”।
পৃথিবী জুড়ে এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ৩০-৪০ জন কেইস অফিসার যাদেরকে হিব্রæ ভাষায় ’কাট্সা’ নামে অভিহিত করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর তূলনায় মোসাদের কেইস অফিসার সংখ্যায় অত্যন্ত নগন্য। পৃথিবী জুড়ে ইহুদী জাতি জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, ব্যবসায় এবং রাজনীতিতে নিজেদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। ইসরাইলের স্বার্থে দেশে-বিদেশে বসবাসরত ইহুদী স¤প্রদায় একই সূত্রে গাঁথা এক অভিন্ন পরিবার। তাদের দেশপ্রেম, একতাবোধ, সংহতি এবং সহমর্মিতাবোধ তাদেরকে নিয়ে গেছে অনেক উপরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র পৃথিবী জুড়ে নিজেদের স¤প্রদায়ভূক্ত লোকদের দ্বারা তারা এমন একটি বৃত্ত তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে যা তূলনাবিহীন। ইসরাইল সরকারকে এবং গুপ্তচর সংস্থা মোসাদকে সহযোগিতা করার জন্য রয়েছে তাদের বিরাট এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যাদেরকে হিব্রæ ভাষায় ’সায়ানিম’ বলা হয়। বিদেশে সায়ানিমরা মোসাদ কেইস অফিসারদেরকে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে থাকে। যে কারণে আমেরিকান সিআইএ কিংবা রাশিয়ান এফএসডি-কেজিভি-র তূলনায় সংখ্যায় নগন্য হয়েও মোসাদের সাফল্য অপ্রতিরোধ্য এবং অব্যর্থ।
১৯৪৮ সালে এর প্রতিষ্ঠালগ্নে ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ন এ প্রতিষ্ঠানকে দেশের স্বার্থে এক আধুনিক এবং অপ্রতিরোধ্য প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত করার প্রয়াস চালান যার ফলশ্রæতিতে আজকের মোসাদ পৃথিবীর গুপ্তচর সংস্থাগুলোর শীর্ষে অবস্থান করছে। এককথায় মোসাদ-এর শিকড় পৃথিবীর পরাশক্তিধর দেশগুলোর অভ্যন্তরে এমনভাবে বিস্তৃত যা অপ্রতিরোধ্য এবং এর কার্যক্রমের কাছে শক্তিধর দেশগুলোর পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি অনেকটা প্রভাবিত।
এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সরাসরি ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ। মোসাদের কার্যক্রম আমেরিকা, ইংল্যান্ড, আর্জেটিনা, উরুগুয়ে, অষ্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বসনিয়া হারজিগোভিনা, সাইপ্রাস, ফ্রান্স, জার্মানী, গ্রীস, ইতালী, মালটা, নরওয়ে, সুইটজারল্যান্ড, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, মিসর, ইরান, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, পাকিস্তান, ভারত, সিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, উগান্ডা, সাউথ আফ্রিকা, সুদান, জিম্বাবুয়ে, নিউজিল্যান্ড, উত্তর কোরিয়া, চীন ইত্যাদি দেশজুড়ে পরিব্যপ্ত। এ সমস্ত দেশগুলোর বাইরে তাদের কর্মকান্ড পরিচালিত হয় তাদের মিত্র দেশগুলোর সহায়তায়।
মোসাদ কর্তৃক বিভিন্ন সময় নিম্নলিখিত অপরাধমূলক কার্যকলাপ সংঘটিত হয় যার অসংখ্য প্রমাণ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যম ও বইপুস্তকে ছাপা হয় কিন্তু অলিখিত কিংবা অপ্রমাণিত ইতিহাস গোপনীয় থেকে যায় যার সঠিক ইতিহাস মোসাদ প্রতিষ্ঠানের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদেরও অজানা। বিভিন্ন গোয়েন্দা পত্রপত্রিকা, টিভি, রেডিও, বই এবং গণমাধ্যমে শুধু যেগুলো প্রকাশ পেয়েছে তার কিয়দংশ নিম্নে বর্ণিত হল।
মোসাদের হত্যাযজ্ঞ ও প্রবঞ্চণার কিছু নিদর্শন
(সূত্র ঃ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যম, স্পাই পত্রিকা, উইকিপিডিয়া, অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ স্পাই ভিক্টর অষ্ট্রোভাক্সি কর্তৃক লিখিত গ্রন্থ ”বাই ওয়ে অব ডিসেপশন”, ”দি আদার সাইড অব ডিসেপসন” ইত্যাদি দ্রষ্টব্য)
১৯৪৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর মোসাদ জাতিসংঘের প্রতিনিধি কাউন্ট বার্নাডোটিকে হত্যা করে। জাতিসংঘ প্রতিনিধি ইসরাইলী স্বার্থে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেন এ সন্দেহে মোসাদ তাকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
১৯৫৬ সালের ১৩ই জুলাই মিসরীয় সেনাবাহিনীর লেফটেনেন্ট কর্ণেল মোস্তফা হাফিজকে গাজা ভূখন্ডে পার্সেল বোমার মাধ্যমে হত্যা করে।
১৯৫৬ সালের ১৪ই জুলাই জর্ডানের আম্মানে মিসরীয় মিলিটারী এটাচি সালাহ মোস্তফাকে পার্সেল বোমার মাধ্যমে মোসাদ হত্যা করে।
১৯৫৬ সালে মরক্কো হতে মোসাদের একটি টিম মরক্কোতে বসবাসরত ইহুদী স¤প্রদায়কে গোপনে ইসরাইলে সরিয়ে নিয়ে যায়। মরক্কো সরকার বসবাসকারী ইহুদী স¤প্রদায়ের স্থানান্তর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
১৯৫৭ সালে মোহাম্মদ শাহ রেজা পাহলভী ক্ষমতাসীন থাকা আবস্থায় ইরানের ইনটেলিজেন্স উয়ং সাভাক (অরগেনাইজেশন অব ন্যাশনাল সিকিউরিটি এন্ড ইনফরমেশন) গঠিত হয়। শাহ রেজা ইসরাইলকে স্বীকৃতির আশ্বাস দিলে ইসরাইলের মোসাদ ও আমেরিকার সিআইএ ইরানিয়ান ইনটেলিজেন্স প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেয়।
১৯৬০ সালের দিকে ইরানের সাভাক এবং সিআইএ-র মধ্যে নীতিগত কিছুটা ঠান্ডা সম্পর্কের কারণে সিআইএ ট্রেনিং টিম তাদের কার্যক্রম ইরান হতে গুটিয়ে নেয়। সে সুযোগে ইসরাইল তেলসমৃদ্ধ ইরানে তাদের খুঁটি মজবুত করে এবং মোসাদ ক্রমান্বয়ে ইরানিয়ান সামরিক বাহিনীর জেনারেল আলী রেজা আসকরীকে তাদের দলে ভেড়াতে সমর্থ হয়। ইসরাইলকে স্বীকৃতি এবং ইসরাইলী স্বার্থ সংরক্ষণে আসকরী সর্বদা সচেষ্ঠ ছিলেন।
কট্টর ইসলামী নেতা খোমেনী ১৯৮১ সালে শাহ রেজা পাহলভীকে মিসরে নির্বাসিত করে ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করেন এবং ইসরাইলের প্রতি সমর্থন তুলে নেন ফলে ইসরাইলের সাথে ইরানের সম্পর্কে চিড় ধরে।
ইরানের অনেক মিলিটারী জেনারেলকে দেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে খোমেনী ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলান এবং অনেককে ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে পাঠিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। বিপদের গন্ধ পেয়ে মোসাদ তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু জেনারেল আলী রেজা আসকরীকে ২০০৭ সালের ফেব্রæয়ারী মাসে সপরিবারে ইরান হতে ইসরাইলে সরিয়ে নেয়। ব্রিটেনের দি সানডে টাইমস্-এ প্রকাশিত খবরে জানা যায় জেনারেল আলী রেজা আসকারী ২০০৩ - ২০০৭ সাল পর্যন্ত থেকে মোসাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
১৯৫৭ সালে মোসাদ এজেন্ট ”ওয়ালগ্যাঙ্গ লটজ্” জার্মান পাসপোর্ট নিয়ে মিসরে প্রবেশ করে মিসরের বিভিন্ন মিলিটারী স্থাপনাসমূহের উপর নজরদারীর লক্ষে। মিসরের মিসাইল ও অন্যান্য মিলিটারী স্থাপনা এবং কর্মরত পশ্চিম জার্মান রকেট বিজ্ঞানী যারা মিসরীয় মিলিটারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে চুক্তি মোতাবেক কাজ করছিল তাদের তালিকা প্রস্তুত করে ইসরাইলের মোসাদ হেড কোয়ার্টারে তার পাঠানোর কথা ছিল। মিসরীয় ও জার্মান গোয়েন্দা নজরদারীতে লটজ্ এর কর্মকান্ড ধরা পড়ে যাওয়ায় মিসরীয় সরকার মিসরে অবস্থানরত সকল জার্মান পাসপোর্টধারী বিজ্ঞানীদেরকে এক জায়গায় জড়ো করে, যাদের মধ্যে লটজ্ এর নামও ছিল। লটজ্ বুঝতে পারে যে, সে ধরা পড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে মিসরীয় নিরাপত্তা বিভাগের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় এই বলে যে, তার উদ্দেশ্য মিসরের ক্ষতি হয় এমনটা নয় শুধুমাত্র বৃহৎ শক্তিবর্গের ঠান্ডাযুদ্ধের উপকরণ সংগ্রহ করতেই তার আগমন। আমেরিকার সিআইএ-র মধ্যস্থতায় লটজ্ ছাড়া পায়।
১৯৬০ সালে মোসাদ এজেন্টরা আবিষ্কার করে যে, হিটলারের অন্যতম সঙ্গী এডলফ্ আইকম্যান (জার্মানীতে ইহুদী নিধনের অন্যতম সংগঠক) আর্জেন্টিনায় ’রিকার্ডো ক্লিমেন্ট’ ছদ্মনামে বসবাস করে আসছে। ১৯৬০ ইং-র মে মাসে আইকম্যানকে মোসাদ এজেন্টরা ইসরাইলে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আর্জেন্টিনা সরকার এ ধরণের অবৈধ অপহরণকে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে বলে জাতিসংঘে অভিযোগ করলে জাতিসংঘ এর নিন্দা জানায় এবং সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রভাবে আইকম্যান-এর মত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যাওয়া উচিত বলে রায় দেয়।
জাতিসংঘের নিন্দার প্রেক্ষিতে মোসাদ ব্রাজিলে বসবাসরত ছদ্মবেশী অন্য একজন অভিযুক্ত আসামী জোসেফ রোডলফ্ ম্যাংগেলি যাকে মৃত্যুর ফেরেশতা (এঞ্জেল অব ডেথ) বলে অভিহিত করা হত তাকে অপহরণের প্রয়াস থেকে সাময়িকভাবে বিরত হয়। অপহরণের কৌশল বদলানোর জন্য মোসাদ তৎপর থাকা অবস্থায় ম্যাংগেলি ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭৯ সালে ব্রাজিলে মারা যায়।
১৯৬১ সালে গঠিত ইসরাইলী কোর্টে এটর্নী জেনারেল গিডিওন হ্যাসনার ও অন্যান্য বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে আইকম্যানকে দোষী স্বাব্যস্থ করে ১৯৬২ সালে ফাঁসি কার্যকর করে।
জার্মানীতে বসবাসরত সন্দেহভাজন নাজি যুদ্ধপোরাধী ’আলোইস ব্রনারকে’ চিঠি বোমার মাধ্যমে মোসাদ এজেন্ট মারাত্মকভাবে আহত করে।
১৯৬২ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর পশ্চিম জার্মানির মিউনিকে জার্মান রকেট বিজ্ঞানী ”হ্যাঞ্জ ক্রাগকে” মোসাদ অপহরণ করে। হ্যাঞ্জ ক্রাগ মিসরীয় মিসাইল প্রোগ্রামে কর্মরত ছিলেন। সুইস গোয়েন্দারা জানতে পারে যে, মোসাদ এজেন্ট ক্রাগকে অপহরণের পর হত্যা করে।
১৯৬২ সালের ২৮শে নভেম্বর মিসরের হেলুয়ানের মিসাইল ফ্যাক্টরীতে পাঁচজন মিসরীয় মিসাইল টেকনিশিয়ান চিঠি বোমার আঘাতে অন্ধ হয়ে যায় যার নেপথ্যে মোসাদের হাত ছিল বলে জানা যায়।
১৯৬৫ সালের ২৩শে ফেব্রæয়ারী মোসাদ এজেন্ট উরুগুয়ের মন্টিভিডিওতে হার্ভাটস্ কোকুরকে ল্যাটভিয়ান ইহুদী হত্যার অন্যতম সংঘটক সন্দেহে গুলি করে হত্যা করে।
মোসাদ এজেন্ট অষ্ট্রিয়ার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জর্জ হেয়দার (যিনি ফিলিস্তিনী জনগণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার ছিলেন)-এর বাসস্থান কক্ষে একটি ইঁদুরের গায়ে ক্ষুদ্রাকায় ট্রান্সমিটার যন্ত্র গোপনে প্রতিস্থাপন করে যার উদ্দেশ্য ছিল হেয়দারের উদ্দেশ্য সম্মন্ধে জানা।
১৯৬৬ সালে ইরাকী মিগ-২১-এর খ্রিস্টান পাইলট ইরাকী নাগরিক মুনীর রেদফাকে আমেরিকান এক মিলিয়ন ডলার এর বিনিময়ে মোসাদ রিক্রুট করতে সমর্থ হয়। চুক্তি মোতাবেক মুনীর রাশিয়ান মিগ-২১ বিমানটি ইসরাইলে উড়িয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এদিকে মোসাদ এজেন্ট মুনীরের পরিবার পরিজনকে ইরান হয়ে ইসরাইলে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং আশ্রয় দেয়। মোসাদ-এর ভাষায় এ অভিযানের নাম ছিল ’অপারেশন ডায়মন্ড’। রাশিয়ান অত্যাধূনিক মিগ-২১ বিমানটি আমেরিকান সিআইএ এবং তাদের দোসর ইসরাইলী ইঞ্জিনিয়াররা খুঁটে খুঁটে পরীক্ষা করে দেখে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল অত্যাধূনিক রাশিয়ান মিগ-২১ এর বিপরীতে আমেরিকান প্যান্টম-৪ যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখলে নেয় ও সিরিয়ার ৬টি মিগ-২১ বিমান ভূপতিত করতে সক্ষম হয়। সিরিয়া এবং মিসরকে পরাজিত করতে এই মিগ-২১ বিমানটির ক্ষমতা ইসরাইলের যাচাই করার প্রয়োজন ছিল।
১৯৬৭ সালের ২৫শে মে তেলআবিবে অবস্থানরত সিআইএ কর্মকর্তা জন হেডেন-এর সাথে তৎকালীন ইসরাইলী মোসাদপ্রধান মীর অমিত-এর নীতিগত মতপার্থক্য ঘটে। জন হেডেন ঘোষণা দেন যদি ইসরাইল আকস্মিক মিসর আক্রমণ করে তাহলে আমেরিকা মিসরের পাশে দাঁড়াবে। এ কথা শুনে মোসাদ ডিরেক্টর মীর অমিত তড়িগড়ি ওয়াশিংটন ডিসি-তে আমেরিকার তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রবার্ট ম্যাকনামারার সাথে দেখা করে ইসরাইলের প্রতি মিসরের যুদংদেহী মনোভাব এবং মিসরের যুদ্ধ প্রস্তুতির ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করেন।
আমেরিকান পার্লামেন্টে কর্মরত বিভিন্ন ইহুদী সিনেটর এবং ইহুদী লবীর সহায়তায় অমিত ম্যাকনামারা তথা আমেরিকান সরকারের নিরব সমর্থন নিয়ে ইসরাইলে ফিরে আসে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ইসরাইল ৫ই জুন মিসর, জর্ডান এবং সিরিয়ার ভূখন্ডে আকস্মিক বিমান হামলা চালায়।
১৯৬৭ ইং-র ৫ই জুন থেকে শুরু করে ১০ই জুন পর্যন্ত ছয়দিনের ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বিজয়ের কাছাকাছি গিয়েও ইসরাইলকে আমেরিকার নৈতিক সমর্থন এবং আধূনিক যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের কারণে মিসর, সিরিয়া এবং জর্ডানকে পরাজয়বরণ করতে হয় এবং ইসরাইল মিসরের সিনাই ও গাজা উপত্যকার বিরাট ভূখন্ড, জর্ডানের পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি নিজেদের দখলে নিতে সমর্থ হয়।
মিসরের সাথে শান্তি চুক্তির বিনিময়ে সিনাই মরুঅঞ্চল হতে পরবর্তী পর্যায়ে ইসরাইল সেনাসদস্য সরিয়ে নেয় কিন্তু জর্ডান এবং সিরিয়ার মূল্যবান ভূখন্ড তাদের অধিকারে রাখে। জাতিসংঘে জর্ডান কিংবা সিরিয়ার ভূখন্ড ইসরাইল ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশ সমর্থন করলেও আমেরিকার ভেটো প্রয়োগে জাতিসংঘের নেয়া প্রস্তাব বিভিন্ন সময় নাকচ হয়ে যায়।
১৯৬৮ সালে জার্মানীর এন্টওয়ার্প হতে আফ্রিকার গিনিওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী একটি জাহাজ পথিমধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। জার্মান ইনটেলিজেন্স আবিষ্কার করে যে উক্ত জাহাজে সংরক্ষিত ২০০ টন পরমাণু সরঞ্জাম ছিনতাই করে মোসাদ ইসরাইলী জাহাজে তুলে নেয়।
১৯৬৯ সালে ফ্রান্সের চেরবার্গ প্রজেক্ট হতে আটককৃত ইসরাইলী নেভী বোট ছিনতাই করে মোসাদ ইসরাইলে নিয়ে আসে।
১৯৭২ সালে জার্মানীর মিউনিকে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস্-এ যোগদানরত ১১ জন ইসরাইলী খেলোয়াড়কে হত্যা করার জন্য সন্দেহভাজন ফিলিস্তিনী বø্যাক সেপ্টেম্বর-এর সদস্য হোসেইন আল বশিরকে সাইপ্রাসের নিকোসিয়াতে ১৯৭৩ সালের ২৪শে জানুয়ারী হোটেলকক্ষে মোসাদ এজেন্ট হত্যা করে।
১৯৭২ সালের ৮ই ডিসেম্বর প্যারিসে পিএলও নেতা ডঃ মাহমুদ হামসারী-কে মিউনিক অলিম্পিক ম্যাসাকার-এর সাথে সম্পৃত্ত সন্দেহে মোসাদ এজেন্ট ডঃ মাহমুদের এপার্টমেন্টের টেলিফোনে গোপনে বিস্ফোরক সংযোজন করে হত্যা করে।
১৯৭২ সালের ১৬ই অক্টোবর মোসাদ হিট স্কোয়ার্ড ইতালীর রোমে ফিলিস্তিনী নেতা আব্দুল ওয়ায়েল জুয়াইটারকে বø্যাক সেপ্টেম্বর সদস্য সন্দেহে হত্যা করে।
১৯৭২ সালে ফিলিস্তিনী ফাতাহ লিবারেশন ফোর্সের প্রথম সারির সদস্য ও স্বনামধন্য লেখক গাস্সান কানাপানির গাড়ীতে বোমা পূঁতে মোসাদ লেবাননে হত্যা করে।
১৯৭৩ সালের ২১শে জুলাই নরওয়ের একটি হোটেলের ওয়েটার মরক্কোর নাগরিক আহমেদ বোচিকিকে মোসাদ এজেন্টরা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নেতা আলী হাসান সালামা সন্দেহে হত্যা করে। আলী হাসান সালামা মিউনিক অলিম্পিক গেমস্-এ ইসরাইলী ১১ জন খেলোয়াড় হত্যাকারীদের একজন বলে মোসাদের সন্দেহের তালিকায় ছিল। নরওয়ে সরকার আলী হাসানকে আশ্রয় দিয়েছিল। মোসাদ এজেন্টরা উক্ত অপারেশন নির্বিঘেœ চালিয়ে যাওয়ার জন্য কানাডিয়ান জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে। জাল পাসপোর্ট নরওয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়াতে ৬ জন মোসাদ এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়। কানাডিয়ান সরকার তার দেশের পাসপোর্ট জালিয়াতীর জন্য নরওয়ে সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ইসরাইল সরকার ভুলক্রমে বোচিকি হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এবং বোচিকি পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে মোসাদ এজেন্টদেরকে ছাড়িয়ে আনে।
১৯৭৩ সালে লেবাননে ফিলিস্তিনী ফাতাহ লিবারেশন ফোর্সের সদস্য বাস্সাম আবু শরীফকে মোসাদ পার্সেল বোমার মাধ্যমে হত্যার চেষ্ঠা করে কিন্তু আবু শরীফ সে বোমার আঘাতে আহত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যান।
১৯৭৩ সালের ৬ই এপ্রিল প্যারিসে ফিলিস্তিনী পপুলার লিবারেশন ফ্রন্ট সদস্য ডঃ বাসিল আল-কুবায়সিকে (আইন শাস্ত্রের প্রফেসর, আমেরিকান ভার্সিটি, বৈরুত) মিউনিক ম্যাসাকার-এর সাথে সম্পৃত্ত সন্দেহে মোসাদ হিট স্কোয়ার্ড হত্যা করে।
১৯৭৩ সালের ৯ই এপ্রিল লেবাননের বৈরুতে ফিলিস্তিনী ফাতাহ মুভমেন্টের ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ আল-নাজ্জার, কামাল আদওয়ান ও পিএলও সদস্য কামাল নাসেরকে মোসাদ এজেন্টরা হত্যা করে।
১৯৭৩ সালের ২৮শে জুন ফিলিস্তিন পপুলার লিবারেশন ফ্রন্টের সিনিওর সদস্য মোহাম্মদ বোওদিয়াকে প্যারিসে মোসাদ এজেন্ট তার গাড়ীর সিটের নিচে বোমা পূঁতে হত্যা করে।
১৯৭৩ সালের ১৩ই এপ্রিল গ্রীসের রাজধানী এথেন্সের একটি হোটেলকক্ষে মোসাদ এজেন্ট বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনী ফাতাহ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত নেতা জিয়াদ মুকাসীকে হত্যা করে।
১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে সৌদিআরবের বাদশাহ ফয়সলকে তার ভাইপো প্রিন্স মোসায়েদ একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যার পেছনে মোসাদের ইন্ধন ছিল।
আমেরিকা হতে ১৯৭৯ সালের ২৬শে জানুয়ারীতে প্রকাশিত ’এক্সিকিউটিভ ইনটেলিজেন্স রিভিউ’ ম্যাগাজিন হতে জানা যায় আমেরিকার কলারেডোতে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ-ইসরাইল জয়েন্ট স্পাই নেটওয়ার্ক ’এসপিন ইন্সটিটিউট’ প্রিন্স মোসায়েদ-এর মগজ ধোলাই করে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত করার জন্য প্রস্তুত করেছিল। প্রিন্স মোসায়েদ মাদকাসক্ত ছিল এবং তার ইহুদী বান্ধবী ছদ্মবেশী খ্রিস্টিন সুরমা তার শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে হিরোইন পুশ করত। বাদশাহ ফয়সলকে হত্যা করা হয় এমন একটি সময়ে যখন ইসরাইল মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দতের সাথে ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে ইসরাইল অধিকৃত সিনাই উপত্যকা ফেরতের বিনিময়ে একটি শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে জোর প্রয়াস চালিয়ে আসছিল।
ফয়সল হত্যার দু’দিন পূর্বে আমেরিকার ইহুদী চতুর সেক্রেটারী অব ইউনাইটেড ষ্টেটস্ হেনরী কিসিঞ্জার বাদশাহ ফয়সলের সাথে একটি জরুরী মিটিং করেন যাতে এ চুক্তিতে সই করতে ফয়সল আনোয়ার সা’দতকে উৎসাহিত করেন। বাদশাহ ফয়সল প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দতকে এ চুক্তি সই করতে নিরুৎসাহিত করেন ফলশ্রæতিতে হেনরী কিসিঞ্জারকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়।
বাদশাহ ফয়সলকে হত্যার পেছনে এ ধরণের একটি উদ্দেশ্য কাজ করছিল। ফয়সলের মৃত্যুর পর অবশ্য পরে একসময় এ চুক্তি বাস্তবায়িত হয়। বাদশাহ ফয়সল আধূনিক, তেলসমৃদ্ধ বর্তমান সৌদি আরবের প্রকৃত রূপকার। তাঁর শাসনামলেই সৌদিআরব মধ্যপ্রাচ্যের একটি ধনী ও তেলসমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত হয়।
ইসরাইলী স্পাই সংস্থা মোসাদ স্বীকার করে যে, বাদশাহ ফয়সল একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। সৌদিআরবের রাজতন্ত্রের ইতিহাসে এমন রাষ্ট্রনায়ক আর জন্ম নেবে কিনা এ ধরণের একটি সংশয়কে সামনে রেখে মোসাদ ও সিআইএ তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে।
১৯৭৭ সালে লন্ডনে দর্শন শাস্ত্রে অধ্যয়নরত ফিলিস্তিনী ছাত্র দোরাক কাসিমকে মোসাদ এজেন্টরা প্রচুর লোভ এবং অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করতে সমর্থ হয়। উক্ত ছাত্র পরবর্তী পর্যায়ে ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতের বিশ্বাসভাজন দেহরক্ষীর কাজে নিযুক্ত হয়। ইসরাইল কর্তৃক তিউনিসিয়ায় পিএলও ঘাটি আক্রমণের সময় গোপনীয় তথ্য পাচারকারী বিশ্বাসঘাতক এ দেহরক্ষী ইসরাইলী বিমান আক্রমণে তার একটি পা হারায়। মোসাদ এজেন্টরা তাদের এ দোসরকে গোপনে উত্তর আমেরিকায় সরিয়ে নেয়।
ইয়াসির আরাফাতের সঠিক অবস্থান এবং ফিলিস্তিনী এ নেতা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এ সমস্ত তথ্যাদি মোসাদ হেড কোয়ার্টারে সহজে দোরাক কাসিমের মাধ্যমে পৌঁছে যেত এবং সে অনুযায়ী ইসরাইল চরম আঘাত হেনে পিএলও-র সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিত।
ফিলিস্তিনী বিভিন্ন সামরিক প্রতিষ্ঠানের বহু বিশ্বসঘাতককে বিভিন্ন সময় মোসাদ অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে, ফলে ফিলিস্তিনী সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো বার বার ইসরাইলী আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষ প্রাণ দিয়েও বিগত ষাট বছরের অধিক সময়ে তাদের হারানো সম্পদ ফিরে পায়নি।
মোসাদ-এর বুদ্ধিমত্তার কাছে পরাজিত হয়ে ফিলিস্তিনী সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সময় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বিভিন্ন নামে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং আত্মকলহ ও অন্তর্দ্বন্ধে লিপ্ত হয়ে ঈষ্পিত লক্ষ অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। সা¤প্রতিককালে ফ্রান্সে প্রয়াত ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতের মরদেহের অটোসপি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী জানা যায় ইয়াসির আরাফাতকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল এবং সন্দেহ করা হচ্ছে যে, মোসাদ এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল। ইসরাইলী সরকারের নিরবতা এ সন্দেহকে সত্যতার জানান দেয়।
১৯৭৮ সালের ২৮শে মার্চ জার্মানীতে অবস্থানরত ফিলিস্তিনী পপুলার লিবারেশন ফ্রন্ট্রের সক্রিয় নেতা ডঃ ওয়াদী হাদ্দাদকে মোসাদ এজেন্ট বিষাক্ত চকোলেট খাইয়ে হত্যা করে। হাদ্দাদের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনী পপুলার লিবারেশন ফ্রন্ট্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭৯ সালের ২৬শে জুলাই কেনস্-এ পিএলও নেতা জোহায়ের মহসিনকে এক রেষ্টুরেন্টের সামনে মোসাদ এজেন্ট গুলি করে হত্যা করে।
১৯৭৯ সালে ফিলিস্তিন লিবারেশন অরগেনাইজেশনের অন্যতম নেতা জোহের হোসেনকে মোসাদ ফ্রান্সে গুলি করে হত্যা করে।
১৯৭৯ সালের ২২ শে জানুয়ারী ফিলিস্তিনী প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নেতা আলী হাসান সালামা ও তার চার দেহরক্ষীকে মোসাদ লেবাননের বৈরুতে গোপনে তার গাড়ীতে বোমা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে হত্যা করে।
১৯৭৯ সালের ৫ই এপ্রিল ফ্রান্সের টওলন এর নিকটে সিনে-সুর-মের নদীবন্দরে ইরাকী পরমাণু প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত খুচরো যন্ত্রাংশ ভর্তি দু’টো কন্টেইনার অপেক্ষমান জাহাজে তোলার প্রাক্কালে তিনজন মোসাদ এজেন্ট গোপনে কন্টেইনারের পাশে বোমা স্থাপন করে এবং রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসের সাহায্যে বোমা ফাটিয়ে কন্টেইনার দু’টোর ৬০% খুচরো যন্ত্রাংশ ধ্বংস করে দেয়। যে কারণে ইরাকের আণবিক প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি এবং বিলম্বের সুযোগ নিয়ে পরবর্তীতে ইসরাইলী বিমানবহর (কোড নাম-অপারেশন বেবিলন ) ১৯৮১ সালের ৭ই জুন ইরাকের আণবিক প্রকল্পে চরম আঘাত হেনে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ অকেজো করে দেয়।
কন্টেইনার অভ্যন্তরের খুচরো যন্ত্রাংশের খবরটি মোসাদ সংগ্রহ করতে পেরেছিল প্যারিসে ইরাকের আণবিক প্রকল্পের জন্য কর্মরত ফ্রান্সের বিজ্ঞানীদের সহযোগী ইরাকের পদার্থবিজ্ঞানী ডঃ বুট্রোস ইবনে হালিম-এর মাধ্যমে। ৪২ বছর বয়স্ক বিবাহিত বুট্রোস ইবনে হালিমকে মোসাদ তাদের ফাঁদে আটকাতে পেরেছিল মোসাদ এজেন্ট ’দিনা’ নামক এক সুন্দরী যুবতীকে লেলিয়ে দিয়ে। ’দিনা’ হালিমকে অবাধে সঙ্গ দিয়ে এবং প্রেমের অভিনয় করে হালিমের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিল ঠিক তখনই দিনার অন্য এক বন্ধু (মোসাদ এজেন্ট) দিনার মাধ্যমে হালিমকে অন্য একটি লাভজনক পার্শ-ব্যবসায় অংশীদারিত্বের লোভ দেখিয়ে আয়ত্তে¡ আনতে সক্ষম হয়। পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে তাকে প্রচুর টাকা সম্মানীসূচক অগ্রিম দেয়ার মাধ্যমে মোসাদের ফাঁদে আটকিয়ে হালিমের কার্যকলাপ এবং ইরাকের এই গোপন প্রকল্প সম্মন্ধে ইসরাইল পুরোপুরি অবহিত হয়।
১৯৮০ সালের ১৩ই জুন মোসাদ হিট স্কোয়াড ইরাকে কর্মরত মিসরীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ডঃ ইয়াহিয়া আল মেসাদকে প্যারিসের ম্যারিডিয়ান হোটেলকক্ষে জবাই করে হত্যা করে। উক্ত বিজ্ঞানীর হোটেল কক্ষে প্রচুর টাকায় ভাড়া করা সুন্দরী পতিতা ”মেরী ক্লোড ম্যাগালকে” লেলিয়ে দিয়েছিল প্যরিসে কর্মরত মোসাদ এজেন্ট। হোটেল কক্ষে হোটেলেরই একজন কর্মচারী সেজে ভাড়া করা এই পতিতা মেসাদের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করলে উক্ত বিজ্ঞানী আকৃষ্ট হন। হত্যাকান্ডের পরপরই ম্যাগালকে নিয়ে মোসাদ এজেন্টরা হোটেল হতে নিরবে পালিয়ে যায়। ম্যাগাল জানতো না যে - এটা ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের পরিকল্পিত কাজ। নির্মম এই হত্যাকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে পরবর্তীতে ম্যাগাল পুলিশকে জানিয়ে দেবে বলে হুমকি দিলে ১৯৮০ সালের ১২ই জুলাই মোসাদ এজেন্ট মার্সিডিস গাড়ীর ধাক্কায় ম্যাগালকে প্যারিসের রাস্তায় হত্যা করে।
ইরাক ও ইরান ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর হতে শুরু করে ১৯৮৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর স্থায়ী হয়। কানাডায় বসবাসকারী অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ভিক্টর অষ্ট্রোভাস্কি তার বই ’বাই ওয়ে অব ডিসেপশন’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, কিভাবে মোসাদ ও সিআইএ এজেন্টরা এ যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করে ইরাক ও ইরানের মেরুদন্ড ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছিল !
এ যুদ্ধে ইরাককে অস্ত্রসম্ভার দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও তাদের মিত্র শক্তিগুলো। অন্যদিকে ইরানকে অস্ত্রে সজ্জিত করেছিল ইসরাইলের মিলিটারী ইন্ডাষ্ট্রী। মোসাদ কর্মকর্তা তার গ্রন্থে লিখেছেন ১৯৬৭ সালে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সাথে যুদ্ধে যে সমস্ত অস্ত্র ইসরাইল ব্যবহার করেছিল তারমধ্যে যেগুলো অব্যবহৃত ছিল সে সমস্ত জং ধরা অস্ত্রগুলো রং করে পুনরায় ইরানের কাছে বিক্রি করে ইসরাইল অর্থনৈতিক ভাবে প্রচুর লাভবান হয়েছিল।
অন্যদিকে ইরাকের কাছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন তাদের পুরানো মডেলের অস্ত্রগুলোর সৎকার করতে পেরেছিল। ইসরাইলী সমরাস্ত্র ডিলার ইয়াকুব নিমরডী ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের সাথে একটি চুক্তি সাক্ষর করেছিল যার বিপরীতে সমরাস্ত্রের প্রাথমিক মূল্য ধরা হয়েছিল ১৩,৫৮,৪২,০০০ (তেরো কোটি আটান্ন লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার) আমেরিকান ডলার।
তাছাড়া লেবাননে বসবাসরত বিলিওনার অস্ত্র ব্যবসায়ী সৌদি নাগরিক আদনান কাসুগীর মাধ্যমে ইসরাইল উভয় দেশে প্রচুর অস্ত্রসম্ভার বিক্রি করে। সৌদি নাগরিক আদনান কাসুগীকে অস্ত্র ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে ইসরাইলী মোসাদ একসময় রিক্রোট করতে সমর্থ হয়েছিল। সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা এ খবর পেলে আদনান কাসুগীকে সৌদি সরকার দেশে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করে দেয়। এ কারণে কাসুগী লেবাননে ও আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন।
মোসাদ ও সিআইএ যুদ্ধ প্রলম্বিত করে ইরাক ও ইরান থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়। বৃহৎ শক্তিবর্গ এভাবেই উচ্চাভিলাষী ও উঠতি দেশগুলোর মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে তাদের পুরানো অস্ত্রভান্ডার খালি করার প্রয়াস চালায়।
কানাডায় বসবাসরত প্রাক্তন মোসাদ কর্মকর্তা তার গ্রন্থে লিখেছেন লন্ডনে অবস্থানরত ইসরাইলী মোসাদ এজেন্ট প্রতিদিন লন্ডনস্থ ইরাক ও ইরানের দূতাবাসে বন্ধু সেজে উভয় দেশের তেলবাহী জাহাজের অবস্থান জানাতো। বলাবাহুল্য, যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহের জন্য ইরাক ও ইরান উভয়পক্ষকেই জ্বালানী তেলের বিক্রয়লব্ধ অর্থের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হত।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মোসাদ ও সিআইএ-র এজেন্টরা ইরাক ও ইরানের তেলবাহী জাহাজ কোথায় কোন্টি অবস্থান করছে তা লন্ডনস্থ মোসাদ এজেন্টকে সঠিক সময়ে জানাত। এ নির্ভূল তথ্য পাওয়ার সাথে সাথে ইরাক ও ইরান একে অপরের তেলবাহী জাহাজগুলো বোমা মেরে তাৎক্ষণিক ডুবিয়ে দিয়ে নিজেদের কৃতিত্বের প্রশংসা করত। ইরানের হরমুজ প্রণালী, ভূমধ্য সাগর, আরব সাগর কিংবা লোহিত সাগরের তলদেশে তেলবাহী জাহাজের সারি হতে স্খলিত ভাসমান তেলের প্রলেপে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ দেখিয়ে আবার আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের রেসকিউ জাহাজ এসে ভাসমান তেলগুলো শোষণ করে নিজ দেশে নিয়ে যায়। আবার তেল শোষণের খরচ যুদ্ধ বিধ্বস্থ ইরাক ও ইরানকেই যোগান দিতে হত।
বিশ্লেষকদের মতে, বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধে ইরাকের প্রায় ৭ লক্ষ ও ইরানের প্রায় ১০ লক্ষ সেনাসদস্য নিহত হয়েছে। ইরান ও ইরাকের ১২-১৬ বছর বয়সের স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত অসংখ্য মিলিশিয়াকে এ যুদ্ধে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল। জর্জ বুশ ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে বেছে নিয়েছিল ইরানকে শায়েস্থা করতে সেই বুশই সাদ্দাম হোসেনকে আবার ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়েছে।
১৯৮১ সালের ৭ই জুন ইসরাইলের ২৪টি আমেরিকায় তৈরী এফ-১৫ বিমান বহর ’অপারেশন বেবিলন’ কোড নামে বাগদাদের সন্নিকটে টোয়াইতা নামক স্থানে ফ্রান্সের সহায়তায় নির্মিত ইরাকের ৭০০ মেগাওয়াট আণবিক প্রকল্প তামোজ-১৭ বা ওসিরাক প্রকল্প সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। একমাস পর জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক এ প্রকল্প উদ্ভোধন করার কথা ছিল। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেইন এ প্রকল্পের মাধ্যমে ইরাককে আণবিক শক্তিধর দেশে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন।
১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনী আরব লিবারেশন ফ্রন্টের প্রধান আব্দুল ওহাব কৈয়ালীকে মোসাদ এজেন্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হত্যা করে।
১৯৮১ সালের ৩রা জুন ব্রাসেলস্, বেলজিয়াম ব্যুরোর পিএলও সদস্য নায়েম কাদেরকে মোসাদ এজেন্ট রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে।
১৯৮৩ সালের ২১শে আগষ্ট সিনিওর পিএলও নেতা মামুন মেরাইশকে গ্রীসের এথেন্সে মোটরসাইকেলবাহী মোসাদ এজেন্ট তার গাড়ীতে গুলি করে হত্যা করে।
১৯৮৪ সালে ইথিওপিয়া এবং সুদানের বর্ডার এলাকার দুর্ভিক্ষ কবলিত ইহুদি জনগোষ্ঠিকে হেলিকপ্টর বহরের মাধ্যমে রাতের অন্ধকারে মোসাদ সুদান হতে ইসরাইলে সরিয়ে নিতে সমর্থ হয়।
১৯৮৬ সালের ৯ই জুন ফিলিস্তিন ডেমোক্রেট লিবারেশন ফ্রন্ট্রের সেক্রেটারী খালিদ নাজ্জালকে হোটেল হতে নির্গমনের পথে মোসাদ এজেন্ট গুলি করে হত্যা করে।
১৯৮৬ সালে মোসাদ নারী এজেন্ট ’চ্যারিল বেনটভ’ প্রেমের অভিনয় করে প্রাক্তন ইসরাইলী পরমাণু টেকনিশিয়ান মোরদেচাই ভেনুনুকে যুক্তরাজ্য হতে ইতালীতে নিয়ে আসে এবং ভেনুনুকে প্রেমের ফাঁদে নেশাগ্রস্থ করে ঐ তরুণী ভ্রমণের ভান করে গভীর সমুদ্রে মোসাদ নির্ধারিত জাহাজের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সেখানে অপেক্ষমান ইসরাইলী জাহাজে করে মোসাদ এজেন্টরা ভেনুনুকে সরাসরি ইসরাইলে নিয়ে আসে এবং তার বিরুদ্ধে ইসরাইলী পরমাণু প্রকল্পের অতি গোপনীয় ৫৭টি ফটো ব্রিটিশ মিডিয়ার কাছে হস্তান্তর করার অভিযোগে আঠারো বছর কারাবন্দী করে রাখা হয়।
ভেনুনু ইহুদী হতে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার এক জবানবন্দীতে তিনি বলেছেন আমাকে জেল অভ্যন্তরে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। যদি আমি ধর্মান্তরিত না হয়ে ইহুদী থাকতাম তাহলে হয়তো এমন নির্যাতনের শিকার হতাম না।
তিনি লন্ডনের ’দি সানডে টাইমস্’-কে বলেছেন ইসরাইলের ডিমোনা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে কমপক্ষে ১৫০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড রয়েছে অথচ ইসরাইল প্রতিবেশী দেশসমূহসহ সকল মুসলিম বিশ্বে পারমাণবিক প্রকল্পে বাঁধা দিয়ে আসছে। তিনি আরও বলেছেন ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের এক অশুভ শক্তি। এর ধ্বংস হওয়া উচিত কারণ ওরা ফিলিস্তিনী জনগণকে ভিটেছাড়া করেছে এবং নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে আসছে।
ভেনুনুকে ২০০৯ সালে নরওয়ের নোবেল পিস প্রাইজ কমিটি ইসরাইলী আণবিক বোমা প্রস্তুতের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ জানানোর জন্য শান্তিপদক দিতে চাইলে ভেনুনু তা নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বিভিন্ন মিডিয়াকে বলেছেন ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট সিমন পেরেজ ইসরাইলের আণবিক প্রকল্পের মূল হোতা। বর্তমানে ভেনুনু ইসরাইল সরকার কর্তৃক শর্তসাপেক্ষে কারামুক্ত হলেও ইসরাইল অভ্যন্তরে নজরবন্দী রয়েছেন।
১৯৮৮ সালের ১৬ই এপ্রিল পিএলও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আবু জিহাদকে মোসাদ কমান্ডো বাহিনী তিউনিসিয়াতে হত্যা করে।
১৯৮৮ সালে ফাতাহ মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা খলিল আল-ওয়াজিরকে তিউনিসিয়ায় মোসাদ হত্যা করে।
১৯৯০ সালে মোসাদ আবিষ্কার করে যে, একজন হিজবুল্লাহ এজেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহে তৎপর রয়েছে। মোসাদ এবং সিআইএ ঐ হিজবুল্লাহ সদস্যের উপর কড়া নজর রাখে যাতে ওর মাধ্যমে ওদের অন্যান্য কর্মরত হিজবুল্লাহ সদস্যের হদিস পায়। পরবর্তী পর্যায়ে মোসাদ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে হিজবুল্লাহ এজেন্টকে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৯০ সালে জার্মান কম্পিউটার প্রযুক্তির গভীরে প্রবেশ করে মোসাদ এজেন্ট জার্মান কম্পিউটার টেকনোলজির গোপন তথ্য চুরি করে মোসাদ ব্যবহৃত কম্পিউটর প্রযুক্তিকে অধিকতর শক্তিশালী করে।
মোসাদ এজেন্ট ১৯৯০ সালের ২২শে মার্চ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস্-এর একটি এপার্টমেন্টে কানাডিয়ান ব্যালাষ্টিকস্ এক্সপার্ট এবং ইঞ্জিনিয়ার ’গেরাল্ড বোল’ যিনি ইরাকের ’প্রজেক্ট বেবিলন সুপারগান’-এ কর্মরত ছিলেন তাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করে।
১৯৯১ সালে উত্তর কোরিয়া হতে সিরিয়ার জন্য মিসাইল সামগ্রী নিয়ে মরক্কোর ক্যাসাব্ল্যাঙ্কা বন্দরে আল-ইয়ারমুক জাহাজ নোঙ্গর করে। গোপনে মোসাদ গোয়েন্দারা উক্ত জাহাজে ট্রাকিং ডিভাইস সংযোজন করে রাখে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এই ডিভাইসের সহায়তায় নিশ্চিত লক্ষ ঠিক করে ইসরাইলী বিমানবহর হামলা চালিয়ে আল-ইয়ারমুক জাহাজটি রসদসামগ্রীসহ ডুবিয়ে দেয়।
১৯৯১ সালে পিএলও ইনটেলিজেন্স প্রধান সালাহ খালাফকে তিউনিসিয়ায় মোসাদ হত্যা করে। পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের পরেই খালাফের স্থান ছিল।
১৯৯১ সালের ৪ঠা নভেম্বর ব্রিটিশ বহুল প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা ’দি ডেইলী মিরিয়র’ এর সম্পাদক ও মালিক ৬৭ বছর বয়স্ক রবার্ট ম্যাক্সওয়েল যাকে ইসরাইলী মোসাদ গুপ্তচর সংস্থার ’সুপার স্পাই’ হিসাবে অভিহিত করা হত তাকে ভ্রমন তরী ’লেডী গিসলেইন’-এ প্রতিশ্রুত চার মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ দেয়া হবে জানিয়ে মোসাদ সদস্যরা তাকে জিব্রাল্টার হতে ক্যানারী আইল্যান্ড পর্যন্ত এক সৌখিন যাত্রার ব্যবস্থা করে। ম্যাক্সওয়েল ভাবতেও পারেননি যে, মোসাদ তাকে হত্যা করতে পারে। যেহেতু মোসাদের কাছে তিনি একজন সম্মানিত সুপার স্পাই হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। ভ্রমনের এক পর্যায়ে নেশাগ্রস্থ ও লেথেল ইনজেকশন প্রয়োগ করে মোসাদের চার সদস্য সাগরের পানিতে নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করে। ম্যাক্সওয়েল ইসরাইলী মোসাদ সংস্থার কাছে তার প্রেরিত গোপন সংবাদ প্রেরণের জন্য চার মিলিয়ন পাউন্ড দাবী করেছিলেন এবং যদি তা না দেয়া হয় তাহলে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনসহ অন্যান্য পরাশক্তির কাছে মোসাদের বিভিন্ন গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে দিবেন বলে হুমকী দেয়ার পর মোসাদ ম্যাক্সওয়েলকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়।
ম্যাক্সওয়েল তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিকায়েল গর্বাচভ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের উচ্চমহলে বিশেষ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
সাউথ আফ্রিকার জোহান্সবার্গে দু’জন ইরানিয়ান ইনটেলিজেন্স এজেন্টকে মোসাদ এজেন্টরা অনুসরণ করে এবং জোহান্সবার্গ সরকারের অধীনে কর্মরত একজন ইহুদি সেচ্ছাসেবির মাধ্যমে মোসাদ জানতে পারে যে, ইরানের এ দু’জন এজেন্ট সাউথ আফ্রিকা হতে গোপনে উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র সরঞ্জামাদি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে এসেছে। মোসাদ এজেন্টরা সাউথ আফ্রিকার নকল সিকিউরিটি সদস্য সেজে উক্ত দু’জন ইরানিয়ানকে ছিনতাই করে তাদের এক ওয়ারহাউসে নিয়ে বেদম প্রহার করে সাউথ আফ্রিকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে।
আফ্রিকার জিম্বাবুয়েতে বসবাসরত ইহুদি জনগোষ্টিকে সুদানের অনুরূপ কৌশলে মোসাদ ইসরাইলে সরিয়ে নিয়ে যায়। জিম্বাবুয়ে সরকার পিএলও ও লিবিয়ার সমর্থক ছিল বিধায় মোসাদ এ গোপন কৌশল অবলম্বন করে। তাছাড়া মোসাদ সদস্য কৌশলে জিম্বাবুয়ে সরকারের ইনটেলিজেন্স এজেন্সিতে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে আফ্রিকার কঙ্গো হতে উর্বর ইউরেনিয়াম জিম্বাবুয়ে হয়ে উত্তর কোরিয়া, ইরান ও সিরিয়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
১৯৯২ সালে ফিলিস্তিন পপুলার লিবারেশন অরগেনাইজেশনের টপ সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট আতেফ বাসিসো-কে মোসাদ হিট স্কোয়ার্ড ফ্রান্সের লেফট ব্যাংক হোটেলের সামনে গুলি করে হত্যা করে।
১৯৯২ সালে ফিলিস্তিনী সিরিয়াপন্থী প্রতিষ্ঠান হিজবুল্লাহ-এর সেক্রেটারী জেনারেল আব্বাস আল মোছাওয়ি-কে মোসাদ লেবাননে হত্যা করে।
মোসাদ বসনিয়ান ইহুদী জনগোষ্টিকে ১৯৯২-৯৩ সালে রাজধানী সারাজিভো হতে নিরাপদে বিমানে ও স্থলপথে তেলআবিবে নিয়ে আসে।
১৯৯৫ সালে ফিলিস্তিনী ইসলামিক জিহাদ এর সদস্য ফাতহি সিকাকিকে মালটার ডিপ্লোমেট হোটেলের সামনে মোসাদ এজেন্ট গুলি করে হত্যা করে।
১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে হামাস নেতা খালেদ মিশালকে লেসার গানের মাধ্যমে মোসাদ হত্যা করে।
১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পাঁচজন মোসাদ এজেন্ট সুইটজারল্যান্ডে আবস্থানরত একজন হিজবুল্লাহ সদস্যের বাসস্থানের চারপাশে বোমার সরঞ্জাম পূঁতে রাখার সময় সুইস গোয়েন্দাদের কাছে একজন হাতেনাতে ধরা পড়ে। বিচারে সে দোষী স্বাব্যস্থ হয় এবং একবছর কারাদন্ডে দন্ডিত হয় এবং পরবর্তী ৫ বছরের জন্য সুইটজারল্যান্ডে তার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হয়।
২০০০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ফাতাহ নেতা সামি মালাবিকে গাজা ভূখন্ডে মোসাদ এজেন্ট মালাবির মোবাইল ফোনে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করে।
২০০১ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী গাজা ভূখন্ডে মোসাদ হেলিকপ্টর গানসিফ-এর গুলিতে হিজবুল্লাহর মিলিটারী সদস্য লেঃ কর্ণেল মাসউদ আইয়াদ নিহত হন।
২০০১ সালের ২৪শে জুন নাবলুসে আল-আকসা শহীদ ব্রিগেডের সদস্য ওসামা জাওয়াবিরিকে মোসাদ ফোন বোমায় হত্যা করে।
২০০১ সালের ১৭ই জানুয়ারী বেথলেহামে ইজাদ্দিন কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার ওমর সা’দা ও অন্য একজন হামাস নেতা মোসাদের মিসাইল আক্রমণে নিহত হন।
২০০১ সালের ৩১শে জুলাই হামাসের প্রথম সারির নেতা জামাল মনসুর নাবলুসে মোসাদের হেলিকপ্টর বহর হতে প্রেরিত মিসাইল আক্রমণে নিহত হন।
২০০১ সালের ৫ই আগষ্ট হামাসের ছাত্র সংগঠনের নেতা আমর হাদিরি মোসাদের মিসাইল আক্রমণে নিহত হন।
২০০১ সালের ২০শে আগষ্ট ফাতাহ নেতা ইমাদ আবু সিনাকে ফিলিস্তিনের হেবরনে মোসাদ এজেন্টরা গুলি করে হত্যা করে।
২০০১ সালের ২৭শে আগষ্ট জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে ফিলিস্তিনী পপুলার ফ্রন্টের সেক্রেটারী জেনারেল আবু আলী মোস্তফাকে মোসাদ বাহিনী এপাচী হেলিকপ্টর হতে মিসাইল নিক্ষেপে হত্যা করে।
২০০১ সালে মোসাদ আমেরিকান সিআইএ ও এফবিআই- কে জানায় যে, প্রায় ২০০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রচন্ড কোন সন্ত্রাসী হামলা ঘটাতে। যুক্তরাষ্ট্র এ খবরের সত্যতা সম্মন্ধে সন্দেহ পোষণ করে কিন্তু এর মাসখানেক পর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগণে প্রচন্ড আঘাত আসে। তবে অনেকে মনে করেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং আমেরিকার অন্যান্য স্থাপনায় মোসাদই আক্রমণ পরিচালিত করে এবং আমেরিকার উচ্চমহলে অধিষ্ঠিত বিভিন্ন ইহুদী সিনেটর ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সহায়তায় আল-কায়েদার উপর দোষ চাপায়। এধরণের পরিকল্পিত আক্রমণ আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক করতে পারে বলে আমেরিকার সিআইএ এবং এফবিআই গুপ্তচর সংস্থার উচ্চমহলের অনেকেই বিশ্বাস করেনা।
২০০২ সালে ফিলিস্তিনে ইসরাইলী মোসাদ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত বোমা জাতিসংঘ পরিচালিত অন্ধ শিশু বিদ্যালয়ে আঘাত হানে এবং এতে ৪০০ শিশুদের মধ্যে অনেকে আহত হয় এবং অনেক অন্ধ শিশুদের প্রাণহানি ঘটে (ডেইলি টেলিগ্রাফ,ইউ.কে, মার্চ ০৩,২০০২)
২০০২ সালে ফিলিস্তিনী পপুলার ফ্রন্ট লিবারেশন ফোর্সের নেতা জিহাদ আহমদ জিবরীল মোসাদ কর্তৃক লেবাননে নিহত হন।
২০০২ সালের ১৪ই জানুয়ারী পশ্চিম তীরের শহর তুলকারেমে আল-আকসা শহীদ ব্রিগেড প্রধান রায়েদ কারমীকে বোমার আঘাতে মোসাদ হত্যা করে।
২০০৪ সালে সিনিওর হিজবুল্লাহ সদস্য গালেব আওআলীকে মোসাদ লেবাননে হত্যা করে।
২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিরিয়ার দামেস্ক শহরে ফিলিস্তিনী হামাস নেতা ইজ-আল-দ্বীন শেখ খলিলকে তার গাড়ীর চাকার সাথে বোমা পূঁতে মোসাদ হত্যা করে।
২০০৪ সালে উত্তর কোরিয়াতে সিরিয়া এবং ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামে কর্মরত বেশ কিছু সিরিয়ান নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী এবং পারমাণবিক চুল্লীতে ব্যবহারযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যদি বহনকৃত একটি ট্রেনে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে মোসাদ সিরিয়ান সকল বিজ্ঞানীদেরকে হত্যা ও বহনকৃত সকল সম্পদ ধ্বংস করে দেয়।
২০০৪ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী জাবালিয়া ফিলিস্তিনী আশ্রয়শিবির হতে অন্যত্র যাওয়ার পথে মোসাদ ইসলামিক জিহাদ কমান্ডার মোহাম্মদ জুদাহ ও তার দু’জন সহযাত্রীকে হেলিকপ্টর গানসিফ হতে মিসাইল আক্রমণে হত্যা করে।
২০০৪ সালের ৩রা মার্চ গাজা সিটিতে সিনিওর হামাস নেতা তারাদ জামাল, ইব্রাহীম দায়িরি ও আম্মার হাসান-এর গাড়ী লক্ষ করে হেলিকপ্টর হতে মিসাইল নিক্ষেপ করে মোসাদ তাদের সকলকে হত্যা করে।
২০০৪ সালের ২২শে মার্চ গাজা ভূখন্ডে হামাসের যুগ্ন প্রতিষ্ঠাতা আহমদ ইয়াসিন ও দু’জন দেহরক্ষীকে মিসাইল আক্রমণে মোসাদ হত্যা করে।
২০০৪ সালের ১৭ই এপ্রিল আহমদ ইয়াসিনের স্থলাভিষিক্ত হামাসের অন্যতম যুগ্ন প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ আল-রানতিসি ও তার পুত্রকে গাজা ভূখন্ডে মোসাদ মিসাইল আক্রমণে হত্যা করে।
২০০৪ সালের ২১শে অক্টোবর গাজায় হামাস অস্ত্র বিশারদ আদনান আল-গউল ও তার সহযোগী ইমাদ আব্বাসকে তাদের গাড়ীতে এপাচী হেলিকপ্টর হতে মিসাইল আক্রমণের মাধ্যমে মোসাদ হত্যা করে।
২০০৬ সালের ২৫শে মে লেবাননের সিডনে ইসলামিক জিহাদ নেতা মাহমুদ আল-মাজয়ূব-এর গাড়ীতে বোমা পুঁতে মোসাদ হত্যা করে।
২০০৬ সালের ৮ই জুন পপুলার রেসিস্টেন্ট কমিটি-এর প্রতিষ্ঠাতা, ফাতাহ এবং তানজিম গ্রুপ-এর প্রাক্তন নেতা জামাল আবু সামাহদানা তার তিনসহযোগীসহ ইসরাইলী বিমান আক্রমণে নিহত হন।
২০০৮ সালে সিরিয়ার পরমাণুবিজ্ঞনী প্রধান মোহাম্মদ সুলাইমানকে সাগর সৈকতে ভ্রমণের সময় একটি স্পীড বোট হতে গুলি করে মোসাদ খুন করে।
২০০৮ সালের ১লা আগষ্ট সিরিয়ার মিলিটারী জেনারেল মোহাম্মদ সুলাইমান যিনি সিরিয়া সরকার এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন তাকে অতর্কিত আক্রমণে মোসাদ হত্যা করে।
২০০৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী হিজবুল্লাহর সিনিয়র নেতা ইমাদ মুগনিয়াকে দামেক্স শহরে মোসাদ ও সিআইএ-এর যুক্ত পরিকল্পনায় হত্যা করা হয়। মোসাদ সন্দেহ করে যে, এই নেতা ১৯৮৩ সালে দামেস্ক শহরে আমেরিকান দূতাবাসে বোমা মারার সাথে সম্পৃত্ত ছিল।
২০০৯ সালের ১লা জানুয়ারী হামাসের প্রথম সারির কমান্ডার ও নীতিনির্ধারক নিজার রাইয়ান, তার চার স্ত্রী ও এগারো সন্তানকে ইসরাইল মিসাইল আক্রমণে মোসাদ হত্যা করে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ ধরণের নারী এবং শিশু হত্যার নিন্দা জানালে ইসরাইল সরকার হামাসের অস্ত্রাগার ধ্বংসের পরিকল্পনার কথা জানায় এবং এ হত্যাকান্ডকে নিছক দুর্ঘটনা বলে অভিহিত করে দোষ খন্ডন করে।
২০০৯ সালের ৩রা জানুয়ারী হামাসের অন্য একজন কমান্ডার আবু জাকারিয়া আল জামাল যিনি হামাসের রকেট নিক্ষেপণ স্কোয়ার্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন তাকে ইসরাইলী বিমান হতে মিসাইল আক্রমণের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
২০০৯ সালের ১৫ই জানুয়ারী ফিলিস্তিনী সরকার শাসিত জাবালিয়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাইয়েদ সিয়াম, তার ভ্রাতা, পুত্র এবং হামাস জেনারেল সিকিউরিটি সার্ভিস কমান্ডার সালাহ আবু সারার্ককে মোসাদ মিসাইল আক্রমণে হত্যা করে।
২০০৯ সালের ৪ঠা মার্চ প্রথম সারির ইসলামিক জিহাদ নেতা খালেদ সালানকে গাজা ভূখন্ডে ইসরাইলী বিমান আক্রমণে হত্যা করা হয়।
২০১০ সালের ১২ই জানুয়ারী তেহরানে ইরানের পরমাণূ বিজ্ঞানী মাসহুদ আলী মোহাম্মদীর গাড়ীতে বোমা পুঁতে মোসাদ হত্যা করে।
২০১০ সালের ১৯শে জানুয়ারী সিরিয়াভিত্তিক হামাস-এর মিলিটারী কমান্ডার মাহমুদ আল-মাবুতকে দুবাইয়ের হোটেল ’আল-বোস্তান রতানা’র ১৩০ নং কক্ষে রাত সাড়ে ন’টার দিকে ইলেকট্রিক শক ও লেথেল ইনজেকশন প্রয়োগ করে ব্রিটিশ এবং আইরিশ পাসপোর্টধারী মোসাদ এজেন্টরা হত্যা করে। প্যারিস ভিত্তিক প্রকাশিত ইনটেলিজেন্স অনলাইন জার্নাল এবং হোটেলের সিসিটিভিতে ধারণকৃত ছবি হতে জানা যায় এ অভিযানে মোসাদের মোট ১০জন সদস্যের মধ্যে তিনজন নারী সদস্য ছিল। প্রথমে নারী সদস্যের একজন ওয়েটার সেজে মাহমুদ আল মাবুতের ১৩০ নং কক্ষের দরজায় টোকা দেয়। মাবুত এর কিছুক্ষণ পূর্বে দুবাইয়ের সিরিয়ান কনস্যুলেট হতে জরুরী মিটিং শেষে ফিরেছিলেন। নারী ওয়েটারের শব্দ শুনে দরজা খোলা মাত্রই মোসাদ হিট স্কোয়ার্ডের তিনজন সদস্য মাবুতের উপর চড়াও হয় এবং ঠান্ডা মাথায় খুন করে দরজা লাগিয়ে পালিয়ে যায়।
২০১০ সালের ৩১শে জুলাই গাজা ভূখন্ডে হামাস মিলিটারী কমান্ডার এবং রকেট বিজ্ঞানী ঈসা আল-বাতরানকে হেলিকপ্টার গানসিফ হতে গুলি করে মোসাদ হত্যা করে।
ফ্রান্সের ’লা ফিগারো’ পত্রিকায় খবরে জানা যায় ২০১০ সালের ১২ই অক্টোবরে ইরানের ইমাম আলী মিলিটারী বেইসে যে ভয়াবহ বিষ্ফোরণে সংগঠিত হয় তার পেছনে মোসাদের হাত ছিল। উক্ত বিষ্ফোরণে ইরান রিভলিউশনারী গার্ডের ১৮ জন সদস্যের মৃত্যু হয় এবং ১০ জন গুরুতর আহত হয়। মৃতদের মধ্যে রিভলিউশনারী গার্ড প্রধান জেনারেল হাসান তেহরানী মোকাদ্দাম নিহত হন যিনি ইরানের দূর পাল্লার মিসাইল প্রোগ্রামের দায়িত্বে ছিলেন। তাছাড়া সন্দেহ করা হয় যে, ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের পদার্থ বিজ্ঞানী যথাক্রমে মাসুদ আল মোহাম্মদী, আর্দেসির হোসেইনপোর এবং মোস্তফা আহমদী রওশনকে বিভিন্ন সময় মোসাদ এজেন্টরা হত্যা করে। ইসরাইলের তৎকালীন মোসাদ প্রধান মীর দাগান সংবাদ সম্মেলনে ’ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্রেইন’ পৃথিবী হতে বিদায় নেয়ার জন্য শোকরিয়া জানান। এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মোসাদ এ সমস্ত হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল। ইসরাইল এবং আমেরিকা চায়না ইরান আণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন হোক যে কারণে বর্তমান মোসাদ প্রধান তামির পার্ডো ২০১২ সালের ফেব্রæয়ারীতে আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যদি ইসরাইল ইরানের আণবিক শক্তিকেন্দ্রে আচমকা অভিযান চালায় তাহলে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া কি হবে ? উত্তরে আমেরিকা ইরানকে অবরোধের মাধ্যমে একঘরে এবং শক্তিহীন করে দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। ইসরাইল ও আমেরিকা সা¤প্রতিককালে জাতিসংঘের আণবিক পরিদর্শকদের মাধ্যমে ইরানের আণবিক প্রোগ্রাম বন্ধ করার প্রয়াস চালিয়ে আসছে। পরিদর্শকদের মধ্যে অনেক ইহুদী পরিদর্শক রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
২০১০ সালের ৩রা নভেম্বর গাজা ভূখন্ডে ইসলামিক জিহাদ কমান্ডার মোহাম্মদ নিমনিম-এর গাড়ীতে বোমা পুঁতে মোসাদ হত্যা করে।
২০১০ সালের ১৭ই নভেম্বর গাজা ভূখন্ডে ইসলামিক জিহাদ কমান্ডার মোঃ ইয়াসিনকে ইসরাইলী বিমান আক্রমণে হত্যা করা হয়।
২০১০ সালের ২৯শে নভেম্বর ইরানের পারমাণু বিজ্ঞানী ডঃ মজিদ শাহরিয়ারী এবং ফেরিদৌন আব্বাসীর গাড়ীতে মোসাদ এজেন্ট বোমা পুঁতে রাখে। বিষ্ফোরণে ডঃ মজিদ নিহত হন এবং গুরুতর আহত হয়ে ডঃ ফেরিদৌন প্রাণে বেঁচে যান।
২০১১ সালের ১১ ই জানুয়ারী গাজা ভূখন্ডে ইসলামিক জিহাদ রকেট নিক্ষেপণকারী সদস্য মোহাম্মদ এ. নাজ্জার মটর সাইকেলে আরোহণরত অবস্থায় ইসরাইলী বিমান আক্রমণে নিহত হন।
২০১১ সালের ৯ই এপ্রিল গাজা ভূখন্ডে উচ্চপদস্থ হামাস কমান্ডার তৈসির আবু স্নিমা ও তার দু’জন দেহরক্ষী ইসরাইলী বিমান আক্রমণে নিহত হন।
২০১১ সালের ২৩শে জুলাই ইরানের পরমাণূ বিজ্ঞানী ডঃ দারউইস রেজাইনিজাদকে মটর সাইকেল আরোহী মোসাদ এজেন্ট গাড়ীতে গুলি করে হত্যা করে।
২০১১ সালের ১৮ই আগষ্ট গাজা ভূখন্ডে পপুলার রেসিস্টেন্ট কমিটি কমান্ডার আবু কুদ আল নিরব এবং খালেদ সাথকে ইসরাইলী বিমান আক্রমণে হত্যা করা হয়।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দিরার আবু সিসি নামের একজন ফিলিস্তিনী ইঞ্জিনিয়ার ইউক্রেনের নাগরিকত্ব লাভের চেষ্টা করতে গিয়ে ইউক্রেনের একটি ট্রেনে মোসাদ এজেন্টের কাছে ধরা পড়ে। তিনসপ্তাহ পরে তাকে ইসরাইলের জেলহাজতে দেখা যায়।
২০১২ সালের ৯ই মার্চ গাজা ভূখন্ডে ফিলিস্তিনী পপুলার রেসিস্টেন্ট কমিটির সেক্রেটারী জেনারেল জোহের আল-কায়িসি-কে বিমান আক্রমণে মোসাদ হত্যা করে।
২০১২ সালের ১৪ই নভেম্বর গাজা ভূখন্ডে হামাস মিলিটারী উয়ং কমান্ডার আহমদ জাবারীকে মোসাদ পরিচালিত ইসরাইলী বিমানবহর হত্যা করে।
২০১৪ সালের ৮ই জুলাই হতে শুরু করে পরবর্তী আগষ্ট মাস ব্যাপী ফিলিস্তিনের গাজা ভূ-খন্ডে আমেরিকান প্রশাসনের সমর্থনে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে বুড়ো আংঙ্গুল দেখিয়ে ইসরাইল নির্বিচারে একতরফা গণহত্যা চালায়। এতে গাজায় বসবাসরত দু’হাজারেরও বেশী ফিলিস্তিনী সাধারণ মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় বারহাজার নিরোপরাধ মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। নিহত এবং আহতদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশী। আঠারো লক্ষ গাজাবাসীর ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা নিরুপণ করা প্রায় অসম্ভব কারণ ইসরাইলী কামানের গোলায় প্রায় প্রতিটি ঘরবাড়ী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
হত্যাযজ্ঞে পারদর্শী মোসাদ ১৯৪৮ সাল হতে এ পর্যন্ত সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ইরান, ইরাক, মিসর তিউনিসিয়া, লিবিয়া এবং ফিলিস্তিন জুড়ে কতশত হত্যা করেছে তার সঠিক হিসাব অলিখিতই রয়ে গেছে। ইসরাইলী জেলে অগণিত ফিলিস্তিনী বন্দীরা ইসরাইলী সেনাদের জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে অথবা পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে তার সঠিক হিসাব কারও জানা নেই। মানবাধিকার প্রশ্নে পরাশক্তি আমেরিকা, ব্রিটেন, ইসরাইল এবং তাদের দোসররা পৃথিবী জুড়ে মানবাধিকার প্রশ্নে অত্যন্ত সোচ্চার থাকলেও ইসরাইলী জেলহাজতে কিংবা আমেরিকার গুয়েনতানামো-বে কারাগারে জেলহাজতে নিরীহ স্বাধীনতাকামী বন্দীদের উপর কুকুর লেলিয়ে তাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করার দৃশ্য এবং অন্যান্য পাশবিক নির্যাতনের দৃশ্য যখন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে দেখানো হয় তখন মানবাধিকার প্রশ্নটি হতবাক হয়ে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে।
আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান, জর্ডান, লিবিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে মোসাদ অত্যন্ত সক্রিয়। মনুষ্যবিহীন রিমোটকন্ট্রোল ড্রোন বিমান যা বর্তমান বিশ্বের ত্রাস - এ বিমানটি ইসরাইলের বিমান কোম্পানী ঞঅউওজঅঘ এবং আমেরিকার বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড-এ অবস্থিত অঅও ঈড়ৎঢ়. যুক্তভাবে তৈরী করে। ব্যক্ত থাকে যে, এ বিমানটি আফগানিস্তানের তালেবান এবং আল-কায়েদার মুক্তিকামী মানুষের উপর আঘাত হেনে আফগান এবং পাকিস্তানের অসংখ্য নিরীহ মানুষ এবং সেনাসদস্যকে হত্যা করে যার সত্যিকার হিসাব সম্ভবতঃ সঠিকভাবে অদ্যাবধি ইতিহাসে স্থান করে নেয়নি।
সা¤প্রতিককালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে শক্তিশালী করার লক্ষে ইসরাইলী মোসাদ বেশ কিছু ড্রোন বিমান ভারতের কাছে বিক্রি করে। আমেরিকার ”ম্যাকডোনেল ডগলাস” বিমান প্রস্তুতকারী কোম্পানীতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইহুদী বিধায় ঐ কোম্পানী কোন্ মুসলিম দেশে কতটি যুদ্ধবিমান বা যাত্রীবাহী বিমান বিক্রি করে তার হিসাব ইসরাইল সহজে পেয়ে যায়।
মোসাদ স্পাই একাডেমীতে ক্যাডারদের পৃথিবীর প্রধান কয়েকটি ধর্মের মূলমন্ত্র, অনুসরণীয় দিকসমূহ, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, জালিয়াতি, ঠান্ডা মাথায় খুন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মোসাদের করণীয়, দেশে দেশে ইহুদী এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ, একই স¤প্রদায়ের লোকদের মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ইত্যাদি বিষয়ে এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয় যাতে করুণা, ভালবাসা, মানবতা, দূর্বলতা এবং মোহ মন থেকে চিরতরে রহিত হয়। তাই একাডেমী প্রধান অৎধষবয ঝযবৎভ মোসাদ ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে একসময় বলেছিলেন ঃ ”আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে - প্রতারণার মাধ্যমে অর্জন। তোমরা ক্যাডেটরা এ মুহূর্তে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য এক ধরণের কাঁচামাল। এ কাঁচামাল দিয়ে আমরা এমন একটি প্রোডাক্ট বানাবো যা হবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন মানবসত্ত¡া। আমরা কাউকে পাশ মার্ক দেইনা যতক্ষণ না পর্যন্ত সে শতভাগ যোগ্যতা অর্জন না করে” (সূত্র ঃ বাই ওয়ে অব ডিসেপশন ঃ ভিক্টর অষ্ট্রোাভাক্সি (অবঃ) মোসাদ কেইস অফিসার)
আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিং তার এক ভাষণে বলেছিলেন Do not do an immoral things for a moral reason অর্থাৎ নৈতিক কারণে অনৈতিক কোন কাজ করনা। মোসাদ একাডেমীর ট্রেনিং পদ্ধতি ঠিক তার উল্টো। মানবতা কিংবা শান্তিতে অন্যান্য ধর্মের লোকদের সাথে সহাবস্থান এ সমস্ত নীতিবাক্য মোসাদ স্পাইদের কাছে সামান্যই তাৎপর্য বহন করে।
ইহুদী জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় - পৃথিবীতে যুগে যুগে, মানুষে মানুষে, দেশে দেশে, কালে কালে যে সমস্ত অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তার বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ইহুদী জাতি পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল এবং এ সমস্ত কারণে পরিশেষে ইহুদীদের ভাগ্যে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তাদেরকে হাজার হাজার বছর নির্বাসিত জীবনযাপন এবং যুদ্ধবিগ্রহে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছিল যদিও তারা ধনসম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, ব্যবসাক্ষেত্রে, বুদ্ধি ও সাহসিকতায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের তূলনায় অধিক অগ্রগামী।
অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ কেইস অফিসার ভিক্টর অষ্ট্রোভাক্সি তার বই ’বাই ওয়ে অব ডিসেপশন’ গ্রন্থে লিখেছেন - মোসাদ ক্যাডারদেরকে প্রতিটি কাজ হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। এমনকি মোসাদ হেড কোয়ার্টারে প্রায় ১০০ ফিট মাপের একটি ফোল্ডিং স্ক্রিন রয়েছে যেখানে বাস্তবে দেখানো হয় ইসরাইলের শত্রæরা কে কোথায় আবস্থান করছে বা কি করছে। এ স্ক্রিনের নিচে অসংখ্য কম্পিউটার এবং ইনফরমেশন টেকনোলজী লুক্কায়িত রয়েছে যেখানে নির্দিষ্ট টেকনিশিয়ান ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার নেই।
ধরুন - একজন ফিলিস্তিনী শত্রু নেতা এ মূহুর্তে কোথায় অবস্থান করছে, গত তিনদিন সে কোথায় ছিল এটা জানতে হলে ঐ নেতার নাম কম্পিউটারে পুশ করলেই তার সঠিক অবস্থান জানা যাবে। বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত মোসাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চ চব্বিশ ঘন্টা এ ধরণের তথ্য সরবরাহে নিয়োজিত এবং এ সব তথ্য প্রতিটি মূহূর্তে কম্পিউটারে আপডেট করা হয়। এ কারণে মোসাদ স্পাই রিং তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়না। তাদের অব্যর্থ এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ তাদেরকে পৃথিবীর সেরা স্পাই প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ইহুদিরা ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী লোক এবং মুসলিম সমৃদ্ধ দেশগুলোকে তাদের প্রধান শত্রু হিসাবে ভাবে। যে কারণে মোসাদ স্পাই রিং-এ কর্মরত প্রত্যেক ক্যাডারকে ট্রেনিংকালীন সময়ে ছয় সপ্তাহ ইসলামী রীতিনীতি এবং ধর্মগ্রন্থ আল-কু’রআনের উপর বিশেষ ট্রেনিং নিতে হয়। মোসাদ হিট স্কোয়ার্ডের সদস্যদেরকে খুন-খারাবীর জন্য বিভিন্ন দেশে ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশের জন্য জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করতে হয়। জাল পাসপোর্ট তৈরীর জন্য তাদের রয়েছে স্পেশাল ডিপার্টমেন্ট এবং জনবল। অবিকল পাসপোর্ট, ভিসা তৈরীর যাবতীয় সরঞ্জাম, কোড নাম্বার ইত্যাদির জন্য যাবতীয় সিলমোহর প্রস্তুতে তাদের জুড়ি নেই। তাছাড়া পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি বড় বড় হোটেলের মূল চাবির ডুপ্লিকেট মাষ্টারকপি তাদের সংগ্রহে রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে যত নামকরা তালা প্রস্তুতকারী কারখানা রয়েছে তাদের প্রস্তুতকৃত তালার মান-নিয়ন্ত্রণের জন্য লন্ডনে এর একটি কার্যালয় রয়েছে। যে কোন ধরণের তালা প্রস্তুত করার পর লন্ডনস্থ মান-নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ে পাঠানোর বিধান রয়েছে। উক্ত প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের পর এ তালা বাজারে ছাড়ার অনুমতি প্রদান করা হয়। লন্ডনস্থ তালার মান-নিয়ন্ত্রন কার্যালয়ে কর্মরত মোসাদ স্পাই কিংবা সায়ানিমের (সাহায্যকারী) মাধ্যমে মোসাদ চাবির ফটো কৌশলে সংগ্রহ করে থাকে যাতে করে মোসাদ গোপনে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ কিংবা তথ্য সংগ্রহের জন্য শত্রæর আস্তানায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র টেলিফোন যন্ত্র প্রতিস্থাপন করে আড়ি পাতার কাজে ব্যবহার করতে পারে।
বিদেশে বসবাসরত ইহুদী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যারা ইহুদী স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ মোসাদ তাদের সাহায্য নেয়। মোসাদের ভাষায় তাদেরকে ’সায়ানিম’ বা সাহায্যকারী বলা হয়। বিভিন্ন দেশে মোসাদের হাজার হাজার ’সায়ানিম’ রয়েছে, শুধুমাত্র লন্ডন শহরে প্রায় দুইহাজার ’সায়ানিম’ রয়েছে এবং সমগ্র ব্রিটেন জুড়ে আরও ছয়হাজার ’সায়ানিম’ মোসাদের লিষ্টে আছে। সায়ানিমরা রেন্ট-এ-কার, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, হোটেল, মানি এক্সচেঞ্জ এবং বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, মোসাদ স্পাই রিং এদের সাহায্য নিয়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পাদন করে।
মুসলিম দেশগুলোর কাছে মিসাইল, সাবমেরিন ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত টর্পেডো, বিমান ও ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইল, দুরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র কিংবা আধূনিক যুদ্ধবিমান তৈরীর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই এবং বর্তমান মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ইরান, তুরস্ক, কাজাখিস্থান এবং পাকিস্তানের কাছে এসমস্তের প্রযুক্তি থাকলেও খুচরো যন্ত্রাংশ প্রস্তুতে আমদানী নির্ভর হওয়ায় তাদেরকে ফ্রান্স, আমেরিকা, ব্রিটেন কিংবা রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রয় করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হয়।
উন্নত দেশগুলোর অস্ত্র কারখানায় কর্মরত অসংখ্য ইহুদী টেকনিশিয়ান এবং বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় মোসাদ জানতে পারে সামরিকভাবে মুসলিম দেশগুলোর কোন্টি কতটুকু শক্তিশালী। তাছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি মুসলিম দেশের অভ্যন্তরে সরকারী উচ্চপদে অধিষ্ঠিত সামরিক ও বে-সামরিক কর্মকর্তা কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের অনেককেই বিভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগ করে, ক্ষমতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার শর্তে, বিভিন্ন লবিং-এর মাধ্যমে, বø্যাকমেইল কিংবা টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে মোসাদ গোপন তথ্য জানতে পারে।
অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ কেইস অফিসার ভিক্টর অষ্ট্রোভাষ্কি তার ”বাই ওয়ে অব ডিসেপশন” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন মোসাদ বিভিন্ন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, সরকারের মন্ত্রীসভার মধ্য হতে শক্তিশালী মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কিংবা উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে কৌশলে রিক্রুট করে তাদের স্বার্থে কাজ করতে প্রভাবিত করে এবং সুচারুরূপে সে কাজ সম্পন্ন করে। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিতে ইসরাইলী বিশেষজ্ঞরা বর্তমান বিশ্বে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর তথ্য প্রযুক্তির নেপথ্যে ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের এক গোপনীয় সংযোগ রয়েছে যে কারণে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আরব দেশগুলো নিজেদের মধ্যে যে গোপনীয় তথ্যসমূহ আদানপ্রদান করে তাতে মোসাদ অনায়াসে আড়ি পাততে পারে। ভূমধ্যসাগরের তলদেশ দিয়ে যে ”সারমেরিন কেবল” প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তা ইতালীর পালমোর-এ এসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ইসরাইল এ সংযোগস্থলে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে আড়ি পেতে সকল গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম।
============================================
(অনেক কিছু জানার আছেঃ লেখক রচিত বই, ২০২০ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত,মুখোশের অন্তরালে)বই হতে নেয়া কিয়দংশ। বইটি সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন:
†gvevBj : 01572 410 018
facebook.com/projonmopublication
No comments:
Post a Comment
What do you think?