Wednesday, December 30, 2020

গুপ্তচর সংস্থা ইসরাইলী মোসাদ পৃথিবীর দক্ষতম ঘাতক প্রতিষ্ঠান (Must read)

 


গুপ্তচর সংস্থা ইসরাইলী মোসাদ পৃথিবীর দক্ষতম ঘাতক প্রতিষ্ঠান  (Must read)


                                                                - নাজমুল চৌধুরী


গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা ’মোসাদ’ একটি ভয়ংকর নাম। পৃথিবীর কোন গুপ্তচর সংস্থা এত গুপ্তহত্যা করেনি যতনা এ প্রতিষ্ঠানের গুপ্তচরেরা করেছে। ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী কোন কাজে নিয়োজিত বৈজ্ঞানিক, গবেষক, রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী  যে কোন দেশের নাগরিক হোকনা কেন, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর তাদেরকে নির্মুল করাই মোসাদের অন্যতম টার্গেট হিসাবে বিবেচ্য। মানবসভ্যতার অগ্রগতি কিংবা মানবতার নিরিখে এ প্রতিষ্ঠানটির আদর্শ এবং কার্যকলাপ কতটুকু স্বস্থিদায়ক তার মূল্যায়নের ভার পাঠককূলের উপর। হিব্রæ ভাষায় ব্যবহৃত মোসাদের অর্থ ইংরেজীতে দাঁড়ায় ‘দি ইন্সটিটিউট ফর ইনটেলিজেন্স এন্ড স্পেশাল অপারেশনস্’।

১৯৪৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিবে মোসাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর সাথে যুক্ত রয়েছে কাউন্টার ইনটেলিজেন্স উয়ং। অফিস ষ্টাফসহ প্রায় ১২০০-১৪০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারী এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। তামির পার্ডো-এর পরবর্তী ইওসি কোহেন (ণড়ংংর ঈড়যবহ) ২০১৬ সাল হতে এর ১২তম পরিচালক হিসাবে দায়িত্বভার পালন করছেন। প্রধান মন্ত্রীর তত্ত¡াবধানে এর সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এ প্রতিষ্ঠান ইসরাইল রাষ্ট্রের জাতীয় গুপ্তচর সংস্থা  হিসাবে পরিচিত। এর জন্য রয়েছে নামে বে-নামে প্রতিষ্ঠিত মোসাদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, কুটনৈতিক মাধ্যম, বন্ধুভাবাপন্ন দেশসমূহের মধ্যে গোপনীয় তথ্য আদান প্রদান, তথ্যসরবরাহের জন্য আধূনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, উন্নত প্রযুক্তি এবং অস্ত্র নির্মাণের জন্য অত্যাধূনিক গবেষণাগার। মোসাদ অভ্যন্তরে রয়েছে মিলিটারী ইনটেলিজেন্স সরবরাহকারী ইউনিট ”আমান”, চোরাগুপ্তা হামলাকারী ইউনিট ”ডিইভডিভান”, গুপ্তহত্যা ও অপহরণকারী ইউনিট ”কিডন”, অভ্যন্তরীন প্রতিরক্ষা ইউনিট ”সিনবেথ”, সাইবার কন্ট্রোল ইউনিট এবং সুদক্ষ বর্ডার পুলিশ ”ইয়ামাম”।

পৃথিবী জুড়ে এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ৩০-৪০ জন কেইস অফিসার যাদেরকে হিব্রæ ভাষায় ’কাট্সা’ নামে অভিহিত করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর তূলনায় মোসাদের কেইস অফিসার সংখ্যায় অত্যন্ত নগন্য। পৃথিবী জুড়ে ইহুদী জাতি জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, ব্যবসায় এবং রাজনীতিতে নিজেদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। ইসরাইলের স্বার্থে দেশে-বিদেশে বসবাসরত ইহুদী স¤প্রদায় একই সূত্রে গাঁথা এক অভিন্ন পরিবার। তাদের দেশপ্রেম, একতাবোধ, সংহতি এবং সহমর্মিতাবোধ তাদেরকে নিয়ে গেছে অনেক উপরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র পৃথিবী জুড়ে নিজেদের স¤প্রদায়ভূক্ত লোকদের দ্বারা তারা এমন একটি বৃত্ত তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে যা তূলনাবিহীন। ইসরাইল সরকারকে এবং গুপ্তচর সংস্থা মোসাদকে সহযোগিতা করার জন্য রয়েছে তাদের বিরাট এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যাদেরকে হিব্রæ ভাষায় ’সায়ানিম’ বলা হয়। বিদেশে সায়ানিমরা মোসাদ কেইস অফিসারদেরকে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে থাকে। যে কারণে আমেরিকান সিআইএ কিংবা রাশিয়ান এফএসডি-কেজিভি-র তূলনায় সংখ্যায় নগন্য হয়েও মোসাদের সাফল্য অপ্রতিরোধ্য এবং অব্যর্থ।

১৯৪৮ সালে এর প্রতিষ্ঠালগ্নে ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ন এ প্রতিষ্ঠানকে দেশের স্বার্থে এক আধুনিক এবং অপ্রতিরোধ্য প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত করার প্রয়াস চালান যার ফলশ্রæতিতে আজকের মোসাদ পৃথিবীর গুপ্তচর সংস্থাগুলোর শীর্ষে অবস্থান করছে। এককথায় মোসাদ-এর শিকড় পৃথিবীর পরাশক্তিধর দেশগুলোর অভ্যন্তরে এমনভাবে বিস্তৃত যা অপ্রতিরোধ্য এবং এর কার্যক্রমের কাছে শক্তিধর দেশগুলোর পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি অনেকটা প্রভাবিত।

এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সরাসরি ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ। মোসাদের কার্যক্রম আমেরিকা, ইংল্যান্ড, আর্জেটিনা, উরুগুয়ে, অষ্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বসনিয়া হারজিগোভিনা, সাইপ্রাস, ফ্রান্স, জার্মানী, গ্রীস, ইতালী, মালটা, নরওয়ে, সুইটজারল্যান্ড, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, মিসর, ইরান, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, পাকিস্তান, ভারত, সিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, উগান্ডা, সাউথ আফ্রিকা, সুদান, জিম্বাবুয়ে, নিউজিল্যান্ড, উত্তর কোরিয়া, চীন ইত্যাদি দেশজুড়ে পরিব্যপ্ত। এ সমস্ত দেশগুলোর বাইরে তাদের কর্মকান্ড পরিচালিত হয় তাদের মিত্র দেশগুলোর সহায়তায়।

মোসাদ কর্তৃক বিভিন্ন সময় নিম্নলিখিত অপরাধমূলক কার্যকলাপ সংঘটিত হয় যার অসংখ্য প্রমাণ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যম ও বইপুস্তকে ছাপা হয় কিন্তু অলিখিত কিংবা অপ্রমাণিত ইতিহাস গোপনীয় থেকে যায় যার সঠিক ইতিহাস মোসাদ প্রতিষ্ঠানের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদেরও অজানা। বিভিন্ন গোয়েন্দা পত্রপত্রিকা, টিভি, রেডিও, বই এবং গণমাধ্যমে শুধু যেগুলো প্রকাশ পেয়েছে তার কিয়দংশ নিম্নে বর্ণিত হল। 

মোসাদের হত্যাযজ্ঞ ও প্রবঞ্চণার কিছু নিদর্শন

(সূত্র ঃ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যম, স্পাই পত্রিকা, উইকিপিডিয়া, অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ স্পাই ভিক্টর অষ্ট্রোভাক্সি কর্তৃক লিখিত গ্রন্থ ”বাই ওয়ে অব ডিসেপশন”, ”দি আদার সাইড অব ডিসেপসন”  ইত্যাদি দ্রষ্টব্য)

১৯৪৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর মোসাদ জাতিসংঘের প্রতিনিধি কাউন্ট বার্নাডোটিকে হত্যা করে। জাতিসংঘ প্রতিনিধি ইসরাইলী স্বার্থে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেন এ সন্দেহে মোসাদ তাকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।

১৯৫৬ সালের ১৩ই জুলাই মিসরীয় সেনাবাহিনীর লেফটেনেন্ট কর্ণেল মোস্তফা হাফিজকে গাজা ভূখন্ডে পার্সেল বোমার মাধ্যমে হত্যা করে।

১৯৫৬ সালের ১৪ই জুলাই জর্ডানের আম্মানে মিসরীয় মিলিটারী এটাচি সালাহ মোস্তফাকে পার্সেল বোমার মাধ্যমে মোসাদ হত্যা করে।

১৯৫৬ সালে মরক্কো হতে মোসাদের একটি টিম মরক্কোতে বসবাসরত ইহুদী স¤প্রদায়কে গোপনে ইসরাইলে সরিয়ে নিয়ে যায়। মরক্কো সরকার বসবাসকারী ইহুদী স¤প্রদায়ের স্থানান্তর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।

১৯৫৭ সালে মোহাম্মদ শাহ রেজা পাহলভী ক্ষমতাসীন থাকা আবস্থায় ইরানের ইনটেলিজেন্স উয়ং সাভাক (অরগেনাইজেশন অব ন্যাশনাল সিকিউরিটি এন্ড ইনফরমেশন) গঠিত হয়। শাহ রেজা ইসরাইলকে স্বীকৃতির আশ্বাস দিলে ইসরাইলের মোসাদ ও আমেরিকার সিআইএ ইরানিয়ান ইনটেলিজেন্স প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেয়। 

১৯৬০ সালের দিকে ইরানের সাভাক এবং সিআইএ-র মধ্যে নীতিগত কিছুটা ঠান্ডা সম্পর্কের কারণে সিআইএ ট্রেনিং টিম তাদের কার্যক্রম ইরান হতে গুটিয়ে নেয়। সে সুযোগে ইসরাইল তেলসমৃদ্ধ ইরানে তাদের খুঁটি মজবুত করে এবং মোসাদ ক্রমান্বয়ে ইরানিয়ান সামরিক বাহিনীর জেনারেল আলী রেজা আসকরীকে তাদের দলে ভেড়াতে সমর্থ হয়। ইসরাইলকে স্বীকৃতি এবং ইসরাইলী স্বার্থ সংরক্ষণে আসকরী সর্বদা সচেষ্ঠ ছিলেন। 

কট্টর ইসলামী নেতা খোমেনী ১৯৮১ সালে শাহ রেজা পাহলভীকে মিসরে নির্বাসিত করে ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করেন এবং ইসরাইলের প্রতি সমর্থন তুলে নেন ফলে ইসরাইলের সাথে ইরানের সম্পর্কে চিড় ধরে। 

ইরানের অনেক মিলিটারী জেনারেলকে দেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে খোমেনী ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলান এবং অনেককে ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে পাঠিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। বিপদের গন্ধ পেয়ে মোসাদ তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু জেনারেল আলী রেজা আসকরীকে ২০০৭ সালের ফেব্রæয়ারী মাসে সপরিবারে ইরান হতে ইসরাইলে সরিয়ে নেয়। ব্রিটেনের দি সানডে টাইমস্-এ প্রকাশিত খবরে জানা যায় জেনারেল আলী রেজা আসকারী ২০০৩ - ২০০৭ সাল পর্যন্ত থেকে মোসাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। 

১৯৫৭ সালে মোসাদ এজেন্ট ”ওয়ালগ্যাঙ্গ লটজ্” জার্মান পাসপোর্ট নিয়ে মিসরে প্রবেশ করে মিসরের বিভিন্ন মিলিটারী স্থাপনাসমূহের উপর নজরদারীর লক্ষে। মিসরের মিসাইল ও অন্যান্য মিলিটারী স্থাপনা এবং কর্মরত পশ্চিম জার্মান রকেট বিজ্ঞানী যারা মিসরীয় মিলিটারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে চুক্তি মোতাবেক কাজ করছিল তাদের তালিকা প্রস্তুত করে ইসরাইলের মোসাদ হেড কোয়ার্টারে তার পাঠানোর কথা ছিল। মিসরীয় ও জার্মান গোয়েন্দা নজরদারীতে লটজ্ এর কর্মকান্ড ধরা পড়ে যাওয়ায় মিসরীয় সরকার মিসরে অবস্থানরত সকল জার্মান পাসপোর্টধারী বিজ্ঞানীদেরকে এক জায়গায় জড়ো করে, যাদের মধ্যে লটজ্ এর নামও ছিল। লটজ্ বুঝতে পারে যে, সে ধরা পড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে মিসরীয় নিরাপত্তা বিভাগের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় এই বলে যে, তার উদ্দেশ্য মিসরের ক্ষতি হয় এমনটা নয় শুধুমাত্র বৃহৎ শক্তিবর্গের ঠান্ডাযুদ্ধের উপকরণ সংগ্রহ করতেই তার আগমন। আমেরিকার সিআইএ-র মধ্যস্থতায় লটজ্ ছাড়া পায়।

১৯৬০ সালে মোসাদ এজেন্টরা আবিষ্কার করে যে, হিটলারের অন্যতম সঙ্গী এডলফ্ আইকম্যান (জার্মানীতে ইহুদী নিধনের অন্যতম সংগঠক) আর্জেন্টিনায় ’রিকার্ডো ক্লিমেন্ট’  ছদ্মনামে বসবাস করে আসছে। ১৯৬০ ইং-র মে মাসে আইকম্যানকে মোসাদ এজেন্টরা ইসরাইলে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আর্জেন্টিনা সরকার এ ধরণের অবৈধ অপহরণকে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে বলে জাতিসংঘে অভিযোগ করলে জাতিসংঘ এর নিন্দা জানায় এবং সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রভাবে আইকম্যান-এর মত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যাওয়া উচিত বলে রায় দেয়।

জাতিসংঘের নিন্দার প্রেক্ষিতে মোসাদ ব্রাজিলে বসবাসরত ছদ্মবেশী অন্য একজন অভিযুক্ত আসামী জোসেফ রোডলফ্ ম্যাংগেলি যাকে মৃত্যুর ফেরেশতা (এঞ্জেল অব ডেথ) বলে অভিহিত করা হত তাকে অপহরণের প্রয়াস থেকে সাময়িকভাবে বিরত হয়। অপহরণের কৌশল বদলানোর জন্য মোসাদ তৎপর থাকা অবস্থায় ম্যাংগেলি ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭৯ সালে ব্রাজিলে মারা যায়।

১৯৬১ সালে গঠিত ইসরাইলী কোর্টে এটর্নী জেনারেল গিডিওন হ্যাসনার ও অন্যান্য বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে আইকম্যানকে দোষী স্বাব্যস্থ করে ১৯৬২ সালে ফাঁসি কার্যকর করে।

জার্মানীতে বসবাসরত সন্দেহভাজন নাজি যুদ্ধপোরাধী ’আলোইস ব্রনারকে’ চিঠি বোমার মাধ্যমে মোসাদ এজেন্ট মারাত্মকভাবে আহত করে।

১৯৬২ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর পশ্চিম জার্মানির মিউনিকে জার্মান রকেট বিজ্ঞানী ”হ্যাঞ্জ ক্রাগকে” মোসাদ অপহরণ করে। হ্যাঞ্জ ক্রাগ মিসরীয় মিসাইল প্রোগ্রামে কর্মরত ছিলেন। সুইস গোয়েন্দারা জানতে পারে যে, মোসাদ এজেন্ট ক্রাগকে অপহরণের পর হত্যা করে।

১৯৬২ সালের ২৮শে নভেম্বর মিসরের হেলুয়ানের মিসাইল ফ্যাক্টরীতে পাঁচজন মিসরীয় মিসাইল টেকনিশিয়ান চিঠি বোমার আঘাতে অন্ধ হয়ে যায় যার নেপথ্যে মোসাদের হাত ছিল বলে জানা যায়।

১৯৬৫ সালের ২৩শে ফেব্রæয়ারী মোসাদ এজেন্ট উরুগুয়ের মন্টিভিডিওতে হার্ভাটস্ কোকুরকে ল্যাটভিয়ান ইহুদী হত্যার অন্যতম সংঘটক সন্দেহে গুলি করে হত্যা করে।

মোসাদ এজেন্ট অষ্ট্রিয়ার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জর্জ হেয়দার (যিনি ফিলিস্তিনী জনগণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার ছিলেন)-এর বাসস্থান কক্ষে একটি ইঁদুরের গায়ে ক্ষুদ্রাকায় ট্রান্সমিটার যন্ত্র গোপনে প্রতিস্থাপন করে যার উদ্দেশ্য ছিল হেয়দারের উদ্দেশ্য সম্মন্ধে জানা।

১৯৬৬ সালে ইরাকী মিগ-২১-এর খ্রিস্টান পাইলট ইরাকী নাগরিক মুনীর রেদফাকে আমেরিকান এক মিলিয়ন ডলার এর বিনিময়ে মোসাদ রিক্রুট করতে সমর্থ হয়। চুক্তি মোতাবেক মুনীর রাশিয়ান মিগ-২১ বিমানটি ইসরাইলে উড়িয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এদিকে মোসাদ এজেন্ট মুনীরের পরিবার পরিজনকে ইরান হয়ে ইসরাইলে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং আশ্রয় দেয়। মোসাদ-এর ভাষায় এ অভিযানের নাম ছিল ’অপারেশন ডায়মন্ড’। রাশিয়ান অত্যাধূনিক মিগ-২১ বিমানটি আমেরিকান সিআইএ এবং তাদের দোসর ইসরাইলী ইঞ্জিনিয়াররা খুঁটে খুঁটে পরীক্ষা করে দেখে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল অত্যাধূনিক রাশিয়ান মিগ-২১ এর বিপরীতে আমেরিকান প্যান্টম-৪ যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখলে নেয় ও সিরিয়ার ৬টি মিগ-২১ বিমান ভূপতিত করতে সক্ষম হয়। সিরিয়া এবং মিসরকে পরাজিত করতে এই মিগ-২১ বিমানটির ক্ষমতা ইসরাইলের যাচাই করার প্রয়োজন ছিল। 

১৯৬৭ সালের ২৫শে মে তেলআবিবে অবস্থানরত সিআইএ কর্মকর্তা জন হেডেন-এর সাথে তৎকালীন ইসরাইলী মোসাদপ্রধান মীর অমিত-এর নীতিগত মতপার্থক্য ঘটে। জন হেডেন ঘোষণা দেন যদি ইসরাইল আকস্মিক মিসর আক্রমণ করে তাহলে আমেরিকা মিসরের পাশে দাঁড়াবে। এ কথা শুনে মোসাদ ডিরেক্টর মীর অমিত তড়িগড়ি ওয়াশিংটন ডিসি-তে আমেরিকার তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রবার্ট ম্যাকনামারার সাথে দেখা করে ইসরাইলের প্রতি মিসরের যুদংদেহী মনোভাব এবং মিসরের যুদ্ধ প্রস্তুতির ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করেন।

আমেরিকান পার্লামেন্টে কর্মরত বিভিন্ন ইহুদী সিনেটর এবং ইহুদী লবীর সহায়তায় অমিত ম্যাকনামারা তথা আমেরিকান সরকারের নিরব সমর্থন নিয়ে ইসরাইলে ফিরে আসে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ইসরাইল ৫ই জুন মিসর, জর্ডান এবং সিরিয়ার ভূখন্ডে আকস্মিক বিমান হামলা চালায়।

১৯৬৭ ইং-র ৫ই জুন থেকে শুরু করে ১০ই জুন পর্যন্ত ছয়দিনের ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বিজয়ের কাছাকাছি গিয়েও ইসরাইলকে আমেরিকার নৈতিক সমর্থন এবং আধূনিক যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের কারণে মিসর, সিরিয়া এবং জর্ডানকে পরাজয়বরণ করতে হয় এবং ইসরাইল মিসরের সিনাই ও গাজা উপত্যকার বিরাট ভূখন্ড, জর্ডানের পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি নিজেদের দখলে নিতে সমর্থ হয়।

মিসরের সাথে শান্তি চুক্তির বিনিময়ে সিনাই মরুঅঞ্চল হতে পরবর্তী পর্যায়ে ইসরাইল সেনাসদস্য সরিয়ে নেয় কিন্তু জর্ডান এবং সিরিয়ার মূল্যবান ভূখন্ড তাদের অধিকারে রাখে। জাতিসংঘে জর্ডান কিংবা সিরিয়ার ভূখন্ড ইসরাইল ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশ সমর্থন করলেও আমেরিকার ভেটো প্রয়োগে জাতিসংঘের নেয়া প্রস্তাব বিভিন্ন সময় নাকচ হয়ে যায়।

১৯৬৮ সালে জার্মানীর এন্টওয়ার্প হতে আফ্রিকার গিনিওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী একটি জাহাজ পথিমধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। জার্মান ইনটেলিজেন্স আবিষ্কার করে যে উক্ত জাহাজে সংরক্ষিত ২০০ টন পরমাণু সরঞ্জাম ছিনতাই করে মোসাদ ইসরাইলী জাহাজে তুলে নেয়।

১৯৬৯ সালে ফ্রান্সের চেরবার্গ প্রজেক্ট হতে আটককৃত ইসরাইলী নেভী বোট ছিনতাই করে মোসাদ ইসরাইলে নিয়ে আসে।

১৯৭২ সালে জার্মানীর মিউনিকে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস্-এ যোগদানরত ১১ জন ইসরাইলী খেলোয়াড়কে হত্যা করার জন্য সন্দেহভাজন ফিলিস্তিনী বø্যাক সেপ্টেম্বর-এর সদস্য হোসেইন আল বশিরকে সাইপ্রাসের নিকোসিয়াতে ১৯৭৩ সালের ২৪শে জানুয়ারী হোটেলকক্ষে মোসাদ এজেন্ট হত্যা করে। 

১৯৭২ সালের ৮ই ডিসেম্বর প্যারিসে পিএলও নেতা ডঃ মাহমুদ হামসারী-কে মিউনিক অলিম্পিক ম্যাসাকার-এর সাথে সম্পৃত্ত সন্দেহে মোসাদ এজেন্ট ডঃ মাহমুদের এপার্টমেন্টের টেলিফোনে গোপনে বিস্ফোরক সংযোজন করে হত্যা করে।

১৯৭২ সালের ১৬ই অক্টোবর মোসাদ হিট স্কোয়ার্ড ইতালীর রোমে ফিলিস্তিনী নেতা আব্দুল ওয়ায়েল জুয়াইটারকে বø্যাক সেপ্টেম্বর সদস্য সন্দেহে হত্যা করে।

১৯৭২ সালে ফিলিস্তিনী ফাতাহ লিবারেশন ফোর্সের প্রথম সারির সদস্য ও স্বনামধন্য লেখক গাস্সান কানাপানির গাড়ীতে বোমা পূঁতে মোসাদ লেবাননে হত্যা করে।

১৯৭৩ সালের ২১শে জুলাই নরওয়ের একটি হোটেলের ওয়েটার মরক্কোর নাগরিক আহমেদ বোচিকিকে মোসাদ এজেন্টরা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নেতা আলী হাসান সালামা সন্দেহে হত্যা করে। আলী হাসান সালামা মিউনিক অলিম্পিক গেমস্-এ ইসরাইলী ১১ জন খেলোয়াড় হত্যাকারীদের একজন বলে মোসাদের সন্দেহের তালিকায় ছিল। নরওয়ে সরকার আলী হাসানকে আশ্রয় দিয়েছিল। মোসাদ এজেন্টরা উক্ত অপারেশন নির্বিঘেœ চালিয়ে যাওয়ার জন্য কানাডিয়ান জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে। জাল পাসপোর্ট নরওয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়াতে ৬ জন মোসাদ এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়। কানাডিয়ান সরকার তার দেশের পাসপোর্ট জালিয়াতীর জন্য নরওয়ে সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ইসরাইল সরকার ভুলক্রমে বোচিকি হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এবং বোচিকি পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে মোসাদ এজেন্টদেরকে ছাড়িয়ে আনে।

১৯৭৩ সালে লেবাননে ফিলিস্তিনী ফাতাহ লিবারেশন ফোর্সের সদস্য বাস্সাম আবু শরীফকে মোসাদ পার্সেল বোমার মাধ্যমে হত্যার চেষ্ঠা করে কিন্তু আবু শরীফ সে বোমার আঘাতে আহত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৭৩ সালের ৬ই এপ্রিল প্যারিসে ফিলিস্তিনী পপুলার লিবারেশন ফ্রন্ট সদস্য ডঃ বাসিল আল-কুবায়সিকে (আইন শাস্ত্রের প্রফেসর, আমেরিকান ভার্সিটি, বৈরুত) মিউনিক ম্যাসাকার-এর সাথে সম্পৃত্ত সন্দেহে মোসাদ হিট স্কোয়ার্ড হত্যা করে।

১৯৭৩ সালের ৯ই এপ্রিল লেবাননের বৈরুতে ফিলিস্তিনী ফাতাহ মুভমেন্টের ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ আল-নাজ্জার, কামাল আদওয়ান ও পিএলও সদস্য কামাল নাসেরকে মোসাদ এজেন্টরা হত্যা করে।

১৯৭৩ সালের ২৮শে জুন ফিলিস্তিন পপুলার লিবারেশন ফ্রন্টের সিনিওর সদস্য মোহাম্মদ বোওদিয়াকে প্যারিসে মোসাদ এজেন্ট তার গাড়ীর সিটের নিচে বোমা পূঁতে হত্যা করে।

১৯৭৩ সালের ১৩ই এপ্রিল গ্রীসের রাজধানী এথেন্সের একটি হোটেলকক্ষে মোসাদ এজেন্ট বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনী ফাতাহ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত নেতা জিয়াদ মুকাসীকে হত্যা করে।

১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে সৌদিআরবের বাদশাহ ফয়সলকে তার ভাইপো প্রিন্স মোসায়েদ একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যার পেছনে মোসাদের ইন্ধন ছিল।

আমেরিকা হতে ১৯৭৯ সালের ২৬শে জানুয়ারীতে প্রকাশিত ’এক্সিকিউটিভ ইনটেলিজেন্স রিভিউ’ ম্যাগাজিন হতে জানা যায় আমেরিকার কলারেডোতে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ-ইসরাইল জয়েন্ট স্পাই নেটওয়ার্ক ’এসপিন ইন্সটিটিউট’ প্রিন্স মোসায়েদ-এর মগজ ধোলাই করে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত করার জন্য প্রস্তুত করেছিল। প্রিন্স মোসায়েদ মাদকাসক্ত ছিল এবং তার ইহুদী বান্ধবী ছদ্মবেশী খ্রিস্টিন সুরমা তার শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে হিরোইন পুশ করত। বাদশাহ ফয়সলকে হত্যা করা হয় এমন একটি সময়ে যখন ইসরাইল মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দতের সাথে ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে ইসরাইল অধিকৃত সিনাই উপত্যকা ফেরতের বিনিময়ে একটি শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে জোর প্রয়াস চালিয়ে আসছিল।

ফয়সল হত্যার দু’দিন পূর্বে আমেরিকার ইহুদী চতুর সেক্রেটারী অব ইউনাইটেড ষ্টেটস্ হেনরী কিসিঞ্জার বাদশাহ ফয়সলের সাথে একটি জরুরী মিটিং করেন যাতে এ চুক্তিতে সই করতে ফয়সল আনোয়ার সা’দতকে উৎসাহিত করেন। বাদশাহ ফয়সল প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দতকে এ চুক্তি সই করতে নিরুৎসাহিত করেন ফলশ্রæতিতে হেনরী কিসিঞ্জারকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়। 

বাদশাহ ফয়সলকে হত্যার পেছনে এ ধরণের একটি উদ্দেশ্য কাজ করছিল। ফয়সলের মৃত্যুর পর অবশ্য পরে একসময় এ চুক্তি বাস্তবায়িত হয়। বাদশাহ ফয়সল আধূনিক, তেলসমৃদ্ধ বর্তমান সৌদি আরবের প্রকৃত রূপকার। তাঁর শাসনামলেই সৌদিআরব মধ্যপ্রাচ্যের একটি ধনী ও তেলসমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত হয়। 

ইসরাইলী স্পাই সংস্থা মোসাদ স্বীকার করে যে, বাদশাহ ফয়সল একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। সৌদিআরবের রাজতন্ত্রের ইতিহাসে এমন রাষ্ট্রনায়ক আর জন্ম নেবে কিনা এ ধরণের একটি সংশয়কে সামনে রেখে মোসাদ ও সিআইএ তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে। 

১৯৭৭ সালে লন্ডনে দর্শন শাস্ত্রে অধ্যয়নরত ফিলিস্তিনী ছাত্র দোরাক কাসিমকে মোসাদ এজেন্টরা প্রচুর লোভ এবং অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করতে সমর্থ হয়। উক্ত ছাত্র পরবর্তী পর্যায়ে ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতের বিশ্বাসভাজন দেহরক্ষীর কাজে নিযুক্ত হয়। ইসরাইল কর্তৃক তিউনিসিয়ায় পিএলও ঘাটি আক্রমণের সময় গোপনীয় তথ্য পাচারকারী বিশ্বাসঘাতক এ দেহরক্ষী ইসরাইলী বিমান আক্রমণে তার একটি পা হারায়। মোসাদ এজেন্টরা তাদের এ দোসরকে গোপনে উত্তর আমেরিকায় সরিয়ে নেয়। 

ইয়াসির আরাফাতের সঠিক অবস্থান এবং ফিলিস্তিনী এ নেতা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এ সমস্ত তথ্যাদি মোসাদ হেড কোয়ার্টারে সহজে দোরাক কাসিমের মাধ্যমে পৌঁছে যেত এবং সে অনুযায়ী ইসরাইল চরম আঘাত হেনে পিএলও-র সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিত।

ফিলিস্তিনী বিভিন্ন সামরিক প্রতিষ্ঠানের বহু বিশ্বসঘাতককে বিভিন্ন সময় মোসাদ অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে, ফলে ফিলিস্তিনী সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো বার বার ইসরাইলী আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষ প্রাণ দিয়েও বিগত ষাট বছরের অধিক সময়ে তাদের হারানো সম্পদ ফিরে পায়নি।

মোসাদ-এর বুদ্ধিমত্তার কাছে পরাজিত হয়ে ফিলিস্তিনী সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সময় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বিভিন্ন নামে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং আত্মকলহ ও অন্তর্দ্বন্ধে লিপ্ত হয়ে ঈষ্পিত লক্ষ অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। সা¤প্রতিককালে ফ্রান্সে প্রয়াত ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতের মরদেহের অটোসপি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী জানা যায় ইয়াসির আরাফাতকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল এবং সন্দেহ করা হচ্ছে যে, মোসাদ এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল। ইসরাইলী সরকারের নিরবতা এ সন্দেহকে সত্যতার জানান দেয়। 

১৯৭৮ সালের ২৮শে মার্চ জার্মানীতে অবস্থানরত ফিলিস্তিনী পপুলার লিবারেশন ফ্রন্ট্রের সক্রিয় নেতা ডঃ ওয়াদী হাদ্দাদকে মোসাদ এজেন্ট বিষাক্ত চকোলেট খাইয়ে হত্যা করে। হাদ্দাদের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনী পপুলার লিবারেশন ফ্রন্ট্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৭৯ সালের ২৬শে জুলাই কেনস্-এ পিএলও নেতা জোহায়ের মহসিনকে এক রেষ্টুরেন্টের সামনে মোসাদ এজেন্ট গুলি করে হত্যা করে।

১৯৭৯ সালে ফিলিস্তিন লিবারেশন অরগেনাইজেশনের অন্যতম নেতা জোহের হোসেনকে মোসাদ ফ্রান্সে গুলি করে হত্যা করে।

১৯৭৯ সালের ২২ শে জানুয়ারী ফিলিস্তিনী প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নেতা আলী হাসান সালামা ও তার চার দেহরক্ষীকে মোসাদ লেবাননের বৈরুতে গোপনে তার গাড়ীতে বোমা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে হত্যা করে।

১৯৭৯ সালের ৫ই এপ্রিল ফ্রান্সের টওলন এর নিকটে সিনে-সুর-মের নদীবন্দরে ইরাকী পরমাণু প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত খুচরো যন্ত্রাংশ ভর্তি দু’টো কন্টেইনার অপেক্ষমান জাহাজে তোলার প্রাক্কালে তিনজন মোসাদ এজেন্ট গোপনে কন্টেইনারের পাশে বোমা স্থাপন করে এবং রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসের সাহায্যে বোমা ফাটিয়ে কন্টেইনার দু’টোর ৬০% খুচরো যন্ত্রাংশ ধ্বংস করে দেয়। যে কারণে ইরাকের আণবিক প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি এবং বিলম্বের সুযোগ নিয়ে পরবর্তীতে ইসরাইলী বিমানবহর (কোড নাম-অপারেশন বেবিলন ) ১৯৮১ সালের ৭ই জুন ইরাকের আণবিক প্রকল্পে চরম আঘাত হেনে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ অকেজো করে দেয়।

কন্টেইনার অভ্যন্তরের খুচরো যন্ত্রাংশের খবরটি মোসাদ সংগ্রহ করতে পেরেছিল প্যারিসে ইরাকের আণবিক প্রকল্পের জন্য কর্মরত ফ্রান্সের বিজ্ঞানীদের সহযোগী ইরাকের পদার্থবিজ্ঞানী ডঃ বুট্রোস ইবনে হালিম-এর মাধ্যমে। ৪২ বছর বয়স্ক বিবাহিত বুট্রোস ইবনে হালিমকে মোসাদ তাদের ফাঁদে আটকাতে পেরেছিল মোসাদ এজেন্ট ’দিনা’ নামক এক সুন্দরী যুবতীকে লেলিয়ে দিয়ে। ’দিনা’ হালিমকে অবাধে সঙ্গ দিয়ে এবং প্রেমের অভিনয় করে হালিমের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিল ঠিক তখনই দিনার অন্য এক বন্ধু (মোসাদ এজেন্ট) দিনার মাধ্যমে হালিমকে অন্য একটি লাভজনক পার্শ-ব্যবসায় অংশীদারিত্বের লোভ দেখিয়ে আয়ত্তে¡ আনতে সক্ষম হয়। পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে তাকে প্রচুর টাকা সম্মানীসূচক অগ্রিম দেয়ার মাধ্যমে মোসাদের ফাঁদে আটকিয়ে হালিমের কার্যকলাপ এবং ইরাকের এই গোপন প্রকল্প সম্মন্ধে ইসরাইল পুরোপুরি অবহিত হয়।  

১৯৮০ সালের ১৩ই জুন মোসাদ হিট স্কোয়াড ইরাকে কর্মরত মিসরীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ডঃ ইয়াহিয়া আল মেসাদকে প্যারিসের ম্যারিডিয়ান হোটেলকক্ষে জবাই করে হত্যা করে। উক্ত বিজ্ঞানীর হোটেল কক্ষে প্রচুর টাকায় ভাড়া করা সুন্দরী পতিতা ”মেরী ক্লোড ম্যাগালকে” লেলিয়ে দিয়েছিল প্যরিসে কর্মরত মোসাদ এজেন্ট। হোটেল কক্ষে হোটেলেরই একজন কর্মচারী সেজে ভাড়া করা এই পতিতা মেসাদের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করলে উক্ত বিজ্ঞানী আকৃষ্ট হন। হত্যাকান্ডের পরপরই ম্যাগালকে নিয়ে মোসাদ এজেন্টরা হোটেল হতে নিরবে পালিয়ে যায়। ম্যাগাল জানতো না যে - এটা ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের পরিকল্পিত কাজ। নির্মম এই হত্যাকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে পরবর্তীতে ম্যাগাল পুলিশকে জানিয়ে দেবে বলে হুমকি দিলে ১৯৮০ সালের ১২ই জুলাই মোসাদ এজেন্ট মার্সিডিস গাড়ীর ধাক্কায় ম্যাগালকে প্যারিসের রাস্তায় হত্যা করে।

ইরাক ও ইরান ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর হতে শুরু করে ১৯৮৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর স্থায়ী হয়। কানাডায় বসবাসকারী অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ভিক্টর অষ্ট্রোভাস্কি তার বই ’বাই ওয়ে অব ডিসেপশন’  গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, কিভাবে মোসাদ ও সিআইএ এজেন্টরা এ যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করে ইরাক ও ইরানের মেরুদন্ড ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছিল !

এ যুদ্ধে ইরাককে অস্ত্রসম্ভার দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও তাদের মিত্র শক্তিগুলো। অন্যদিকে ইরানকে অস্ত্রে সজ্জিত করেছিল ইসরাইলের মিলিটারী ইন্ডাষ্ট্রী। মোসাদ কর্মকর্তা তার গ্রন্থে লিখেছেন ১৯৬৭ সালে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সাথে যুদ্ধে যে সমস্ত অস্ত্র ইসরাইল ব্যবহার করেছিল তারমধ্যে যেগুলো অব্যবহৃত ছিল সে সমস্ত জং ধরা অস্ত্রগুলো রং করে পুনরায় ইরানের কাছে বিক্রি করে ইসরাইল অর্থনৈতিক ভাবে প্রচুর লাভবান হয়েছিল।

অন্যদিকে ইরাকের কাছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন তাদের পুরানো মডেলের অস্ত্রগুলোর সৎকার করতে পেরেছিল। ইসরাইলী সমরাস্ত্র ডিলার ইয়াকুব নিমরডী ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের সাথে একটি চুক্তি সাক্ষর করেছিল যার বিপরীতে সমরাস্ত্রের প্রাথমিক মূল্য ধরা হয়েছিল  ১৩,৫৮,৪২,০০০ (তেরো কোটি আটান্ন লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার) আমেরিকান ডলার।

তাছাড়া লেবাননে বসবাসরত বিলিওনার অস্ত্র ব্যবসায়ী সৌদি নাগরিক আদনান কাসুগীর মাধ্যমে ইসরাইল উভয় দেশে প্রচুর অস্ত্রসম্ভার বিক্রি করে। সৌদি নাগরিক আদনান কাসুগীকে অস্ত্র ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে ইসরাইলী মোসাদ একসময় রিক্রোট করতে সমর্থ হয়েছিল। সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা এ খবর পেলে আদনান কাসুগীকে সৌদি সরকার দেশে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করে দেয়। এ কারণে কাসুগী লেবাননে ও আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন।

মোসাদ ও সিআইএ যুদ্ধ প্রলম্বিত করে ইরাক ও ইরান থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়। বৃহৎ শক্তিবর্গ এভাবেই উচ্চাভিলাষী ও উঠতি দেশগুলোর মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে তাদের পুরানো অস্ত্রভান্ডার খালি করার প্রয়াস চালায়।

কানাডায় বসবাসরত প্রাক্তন মোসাদ কর্মকর্তা তার গ্রন্থে লিখেছেন লন্ডনে অবস্থানরত ইসরাইলী মোসাদ এজেন্ট প্রতিদিন লন্ডনস্থ ইরাক ও ইরানের দূতাবাসে বন্ধু সেজে উভয় দেশের তেলবাহী জাহাজের অবস্থান জানাতো। বলাবাহুল্য, যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহের জন্য ইরাক ও ইরান উভয়পক্ষকেই জ্বালানী তেলের বিক্রয়লব্ধ অর্থের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হত।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মোসাদ ও সিআইএ-র এজেন্টরা ইরাক ও ইরানের তেলবাহী জাহাজ কোথায় কোন্টি অবস্থান করছে তা লন্ডনস্থ মোসাদ এজেন্টকে সঠিক সময়ে জানাত। এ নির্ভূল তথ্য পাওয়ার সাথে সাথে ইরাক ও ইরান একে অপরের তেলবাহী জাহাজগুলো বোমা মেরে তাৎক্ষণিক ডুবিয়ে দিয়ে নিজেদের কৃতিত্বের প্রশংসা করত। ইরানের হরমুজ প্রণালী, ভূমধ্য সাগর, আরব সাগর কিংবা লোহিত সাগরের তলদেশে তেলবাহী জাহাজের সারি হতে স্খলিত ভাসমান তেলের প্রলেপে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ দেখিয়ে আবার আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের রেসকিউ জাহাজ এসে ভাসমান তেলগুলো শোষণ করে নিজ দেশে নিয়ে যায়। আবার তেল শোষণের খরচ যুদ্ধ বিধ্বস্থ  ইরাক ও ইরানকেই যোগান দিতে হত। 

বিশ্লেষকদের মতে, বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধে ইরাকের প্রায় ৭ লক্ষ ও ইরানের প্রায় ১০ লক্ষ সেনাসদস্য নিহত হয়েছে। ইরান ও ইরাকের ১২-১৬ বছর বয়সের স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত অসংখ্য মিলিশিয়াকে এ যুদ্ধে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল। জর্জ বুশ ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে বেছে নিয়েছিল ইরানকে শায়েস্থা করতে সেই বুশই সাদ্দাম হোসেনকে আবার ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়েছে।

১৯৮১ সালের ৭ই জুন ইসরাইলের ২৪টি আমেরিকায় তৈরী এফ-১৫ বিমান বহর ’অপারেশন বেবিলন’ কোড নামে বাগদাদের সন্নিকটে টোয়াইতা নামক স্থানে ফ্রান্সের সহায়তায় নির্মিত ইরাকের ৭০০ মেগাওয়াট আণবিক প্রকল্প তামোজ-১৭ বা ওসিরাক প্রকল্প সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। একমাস পর জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক এ প্রকল্প উদ্ভোধন করার কথা ছিল। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেইন এ প্রকল্পের মাধ্যমে ইরাককে আণবিক শক্তিধর দেশে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন।

১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনী আরব লিবারেশন ফ্রন্টের প্রধান আব্দুল ওহাব কৈয়ালীকে মোসাদ এজেন্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হত্যা করে।

১৯৮১ সালের ৩রা জুন ব্রাসেলস্, বেলজিয়াম ব্যুরোর পিএলও সদস্য নায়েম কাদেরকে মোসাদ এজেন্ট রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে।

১৯৮৩ সালের ২১শে আগষ্ট সিনিওর পিএলও নেতা মামুন মেরাইশকে গ্রীসের এথেন্সে মোটরসাইকেলবাহী মোসাদ এজেন্ট তার গাড়ীতে গুলি করে হত্যা করে।

১৯৮৪ সালে ইথিওপিয়া এবং সুদানের বর্ডার এলাকার দুর্ভিক্ষ কবলিত ইহুদি জনগোষ্ঠিকে হেলিকপ্টর বহরের মাধ্যমে রাতের অন্ধকারে মোসাদ সুদান হতে ইসরাইলে সরিয়ে নিতে সমর্থ হয়।

১৯৮৬ সালের ৯ই জুন ফিলিস্তিন ডেমোক্রেট লিবারেশন ফ্রন্ট্রের সেক্রেটারী খালিদ নাজ্জালকে হোটেল হতে নির্গমনের পথে মোসাদ এজেন্ট গুলি করে হত্যা করে।

১৯৮৬ সালে মোসাদ নারী এজেন্ট ’চ্যারিল বেনটভ’ প্রেমের অভিনয় করে প্রাক্তন ইসরাইলী পরমাণু টেকনিশিয়ান মোরদেচাই ভেনুনুকে যুক্তরাজ্য হতে ইতালীতে নিয়ে আসে এবং ভেনুনুকে প্রেমের ফাঁদে নেশাগ্রস্থ করে ঐ তরুণী ভ্রমণের ভান করে গভীর সমুদ্রে মোসাদ নির্ধারিত জাহাজের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সেখানে অপেক্ষমান ইসরাইলী জাহাজে করে মোসাদ এজেন্টরা ভেনুনুকে সরাসরি ইসরাইলে নিয়ে আসে এবং তার বিরুদ্ধে ইসরাইলী পরমাণু প্রকল্পের অতি গোপনীয় ৫৭টি ফটো ব্রিটিশ মিডিয়ার কাছে হস্তান্তর করার অভিযোগে আঠারো বছর কারাবন্দী করে রাখা হয়।

ভেনুনু ইহুদী হতে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার এক জবানবন্দীতে তিনি বলেছেন আমাকে জেল অভ্যন্তরে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। যদি আমি ধর্মান্তরিত না হয়ে ইহুদী থাকতাম তাহলে হয়তো এমন নির্যাতনের শিকার হতাম না।

তিনি লন্ডনের ’দি সানডে টাইমস্’-কে বলেছেন ইসরাইলের ডিমোনা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে কমপক্ষে ১৫০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড রয়েছে অথচ ইসরাইল প্রতিবেশী দেশসমূহসহ সকল মুসলিম বিশ্বে পারমাণবিক প্রকল্পে বাঁধা দিয়ে আসছে। তিনি আরও বলেছেন ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের এক অশুভ শক্তি। এর ধ্বংস হওয়া উচিত কারণ ওরা ফিলিস্তিনী জনগণকে ভিটেছাড়া করেছে এবং নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে আসছে।

ভেনুনুকে ২০০৯ সালে নরওয়ের নোবেল পিস প্রাইজ কমিটি ইসরাইলী আণবিক বোমা প্রস্তুতের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ জানানোর জন্য শান্তিপদক দিতে চাইলে ভেনুনু তা নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বিভিন্ন মিডিয়াকে বলেছেন ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট সিমন পেরেজ ইসরাইলের আণবিক প্রকল্পের মূল হোতা। বর্তমানে ভেনুনু ইসরাইল সরকার কর্তৃক শর্তসাপেক্ষে কারামুক্ত হলেও ইসরাইল অভ্যন্তরে নজরবন্দী রয়েছেন।

১৯৮৮ সালের ১৬ই এপ্রিল পিএলও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আবু জিহাদকে মোসাদ কমান্ডো বাহিনী তিউনিসিয়াতে হত্যা করে।

১৯৮৮ সালে ফাতাহ মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা খলিল আল-ওয়াজিরকে তিউনিসিয়ায় মোসাদ হত্যা করে।

১৯৯০ সালে মোসাদ আবিষ্কার করে যে, একজন হিজবুল্লাহ এজেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহে তৎপর রয়েছে। মোসাদ এবং সিআইএ ঐ হিজবুল্লাহ সদস্যের উপর কড়া নজর রাখে যাতে ওর মাধ্যমে ওদের অন্যান্য কর্মরত হিজবুল্লাহ সদস্যের হদিস পায়। পরবর্তী পর্যায়ে মোসাদ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে হিজবুল্লাহ এজেন্টকে যুক্তরাষ্ট্রে  গ্রেফতার করা হয়।

১৯৯০ সালে জার্মান কম্পিউটার প্রযুক্তির গভীরে প্রবেশ করে মোসাদ এজেন্ট জার্মান কম্পিউটার টেকনোলজির গোপন তথ্য চুরি করে মোসাদ ব্যবহৃত কম্পিউটর প্রযুক্তিকে অধিকতর শক্তিশালী করে।

মোসাদ এজেন্ট ১৯৯০ সালের ২২শে মার্চ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস্-এর একটি এপার্টমেন্টে কানাডিয়ান ব্যালাষ্টিকস্ এক্সপার্ট এবং ইঞ্জিনিয়ার ’গেরাল্ড বোল’ যিনি ইরাকের ’প্রজেক্ট বেবিলন সুপারগান’-এ কর্মরত ছিলেন তাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করে।

১৯৯১ সালে উত্তর কোরিয়া হতে সিরিয়ার জন্য মিসাইল সামগ্রী নিয়ে মরক্কোর ক্যাসাব্ল্যাঙ্কা বন্দরে আল-ইয়ারমুক জাহাজ নোঙ্গর করে। গোপনে মোসাদ গোয়েন্দারা উক্ত জাহাজে ট্রাকিং ডিভাইস সংযোজন করে রাখে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এই ডিভাইসের সহায়তায় নিশ্চিত লক্ষ ঠিক করে ইসরাইলী বিমানবহর হামলা চালিয়ে আল-ইয়ারমুক জাহাজটি রসদসামগ্রীসহ ডুবিয়ে দেয়।

১৯৯১ সালে পিএলও ইনটেলিজেন্স প্রধান সালাহ খালাফকে তিউনিসিয়ায় মোসাদ হত্যা করে। পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের পরেই খালাফের স্থান ছিল।

১৯৯১ সালের ৪ঠা নভেম্বর ব্রিটিশ বহুল প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা ’দি ডেইলী মিরিয়র’ এর সম্পাদক ও মালিক ৬৭ বছর বয়স্ক রবার্ট ম্যাক্সওয়েল যাকে ইসরাইলী মোসাদ গুপ্তচর সংস্থার ’সুপার স্পাই’ হিসাবে অভিহিত করা হত তাকে ভ্রমন তরী ’লেডী গিসলেইন’-এ প্রতিশ্রুত চার মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ দেয়া হবে জানিয়ে মোসাদ সদস্যরা তাকে জিব্রাল্টার হতে ক্যানারী আইল্যান্ড পর্যন্ত এক সৌখিন যাত্রার ব্যবস্থা করে। ম্যাক্সওয়েল ভাবতেও পারেননি যে, মোসাদ তাকে হত্যা করতে পারে। যেহেতু মোসাদের কাছে তিনি একজন সম্মানিত সুপার স্পাই হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। ভ্রমনের এক পর্যায়ে নেশাগ্রস্থ ও লেথেল ইনজেকশন প্রয়োগ করে মোসাদের চার সদস্য সাগরের পানিতে নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করে। ম্যাক্সওয়েল ইসরাইলী মোসাদ সংস্থার কাছে তার প্রেরিত গোপন সংবাদ প্রেরণের জন্য চার মিলিয়ন পাউন্ড দাবী করেছিলেন এবং যদি তা না দেয়া হয় তাহলে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনসহ অন্যান্য পরাশক্তির কাছে মোসাদের বিভিন্ন গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে দিবেন বলে হুমকী দেয়ার পর মোসাদ ম্যাক্সওয়েলকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়।

ম্যাক্সওয়েল তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিকায়েল গর্বাচভ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের উচ্চমহলে বিশেষ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

সাউথ আফ্রিকার জোহান্সবার্গে দু’জন ইরানিয়ান ইনটেলিজেন্স এজেন্টকে মোসাদ এজেন্টরা অনুসরণ করে এবং জোহান্সবার্গ সরকারের অধীনে কর্মরত একজন ইহুদি সেচ্ছাসেবির মাধ্যমে মোসাদ জানতে পারে যে, ইরানের এ দু’জন এজেন্ট সাউথ আফ্রিকা হতে গোপনে উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র সরঞ্জামাদি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে এসেছে। মোসাদ এজেন্টরা সাউথ আফ্রিকার নকল সিকিউরিটি সদস্য সেজে উক্ত দু’জন ইরানিয়ানকে ছিনতাই করে তাদের এক ওয়ারহাউসে নিয়ে বেদম প্রহার করে সাউথ আফ্রিকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে।

আফ্রিকার জিম্বাবুয়েতে বসবাসরত ইহুদি জনগোষ্টিকে সুদানের অনুরূপ কৌশলে মোসাদ ইসরাইলে সরিয়ে নিয়ে যায়। জিম্বাবুয়ে সরকার পিএলও ও লিবিয়ার সমর্থক ছিল বিধায় মোসাদ এ গোপন কৌশল অবলম্বন করে। তাছাড়া মোসাদ সদস্য কৌশলে জিম্বাবুয়ে সরকারের ইনটেলিজেন্স এজেন্সিতে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে আফ্রিকার কঙ্গো হতে উর্বর ইউরেনিয়াম জিম্বাবুয়ে হয়ে উত্তর কোরিয়া, ইরান ও সিরিয়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

১৯৯২ সালে ফিলিস্তিন পপুলার লিবারেশন অরগেনাইজেশনের টপ সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট আতেফ বাসিসো-কে মোসাদ হিট স্কোয়ার্ড ফ্রান্সের লেফট ব্যাংক হোটেলের সামনে গুলি করে হত্যা করে।

১৯৯২ সালে ফিলিস্তিনী সিরিয়াপন্থী প্রতিষ্ঠান হিজবুল্লাহ-এর সেক্রেটারী জেনারেল আব্বাস আল মোছাওয়ি-কে মোসাদ লেবাননে হত্যা করে।

মোসাদ বসনিয়ান ইহুদী জনগোষ্টিকে ১৯৯২-৯৩ সালে রাজধানী সারাজিভো হতে নিরাপদে বিমানে ও স্থলপথে তেলআবিবে নিয়ে আসে।

১৯৯৫ সালে ফিলিস্তিনী ইসলামিক জিহাদ এর সদস্য ফাতহি সিকাকিকে মালটার ডিপ্লোমেট হোটেলের সামনে মোসাদ এজেন্ট গুলি করে হত্যা করে।

১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে হামাস নেতা খালেদ মিশালকে লেসার গানের মাধ্যমে মোসাদ হত্যা করে।

১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পাঁচজন মোসাদ এজেন্ট সুইটজারল্যান্ডে আবস্থানরত একজন হিজবুল্লাহ সদস্যের বাসস্থানের চারপাশে বোমার সরঞ্জাম পূঁতে রাখার সময় সুইস গোয়েন্দাদের কাছে একজন হাতেনাতে ধরা পড়ে। বিচারে সে দোষী স্বাব্যস্থ হয় এবং একবছর কারাদন্ডে দন্ডিত হয় এবং পরবর্তী ৫ বছরের জন্য সুইটজারল্যান্ডে তার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হয়।

২০০০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ফাতাহ নেতা সামি মালাবিকে গাজা ভূখন্ডে মোসাদ এজেন্ট মালাবির মোবাইল ফোনে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করে।

২০০১ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী গাজা ভূখন্ডে মোসাদ হেলিকপ্টর গানসিফ-এর গুলিতে হিজবুল্লাহর মিলিটারী সদস্য লেঃ কর্ণেল মাসউদ আইয়াদ নিহত হন।

২০০১ সালের ২৪শে জুন নাবলুসে আল-আকসা শহীদ ব্রিগেডের সদস্য ওসামা জাওয়াবিরিকে মোসাদ ফোন বোমায় হত্যা করে।

২০০১ সালের ১৭ই জানুয়ারী বেথলেহামে ইজাদ্দিন কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার ওমর সা’দা ও অন্য একজন হামাস নেতা মোসাদের মিসাইল আক্রমণে নিহত হন।

২০০১ সালের ৩১শে জুলাই হামাসের প্রথম সারির নেতা জামাল মনসুর নাবলুসে মোসাদের হেলিকপ্টর বহর হতে প্রেরিত মিসাইল আক্রমণে নিহত হন।

২০০১ সালের ৫ই আগষ্ট হামাসের ছাত্র সংগঠনের নেতা আমর হাদিরি মোসাদের মিসাইল আক্রমণে নিহত হন।

২০০১ সালের ২০শে আগষ্ট ফাতাহ নেতা ইমাদ আবু সিনাকে ফিলিস্তিনের হেবরনে মোসাদ এজেন্টরা গুলি করে হত্যা করে।

২০০১ সালের ২৭শে আগষ্ট জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে ফিলিস্তিনী পপুলার ফ্রন্টের সেক্রেটারী জেনারেল আবু আলী মোস্তফাকে মোসাদ বাহিনী এপাচী হেলিকপ্টর হতে মিসাইল নিক্ষেপে হত্যা করে।

২০০১ সালে মোসাদ আমেরিকান সিআইএ ও এফবিআই- কে জানায় যে, প্রায় ২০০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রচন্ড কোন সন্ত্রাসী হামলা ঘটাতে। যুক্তরাষ্ট্র এ খবরের সত্যতা সম্মন্ধে সন্দেহ পোষণ করে কিন্তু এর মাসখানেক পর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগণে প্রচন্ড আঘাত আসে। তবে অনেকে মনে করেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং আমেরিকার অন্যান্য স্থাপনায় মোসাদই আক্রমণ পরিচালিত করে এবং আমেরিকার উচ্চমহলে অধিষ্ঠিত বিভিন্ন ইহুদী সিনেটর ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সহায়তায় আল-কায়েদার উপর দোষ চাপায়। এধরণের পরিকল্পিত আক্রমণ আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক করতে পারে বলে আমেরিকার সিআইএ এবং এফবিআই গুপ্তচর সংস্থার উচ্চমহলের অনেকেই বিশ্বাস করেনা।

২০০২ সালে ফিলিস্তিনে ইসরাইলী মোসাদ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত বোমা জাতিসংঘ পরিচালিত অন্ধ শিশু বিদ্যালয়ে আঘাত হানে এবং এতে ৪০০ শিশুদের মধ্যে অনেকে আহত হয় এবং অনেক অন্ধ শিশুদের প্রাণহানি ঘটে (ডেইলি টেলিগ্রাফ,ইউ.কে, মার্চ ০৩,২০০২)  

২০০২ সালে ফিলিস্তিনী পপুলার ফ্রন্ট লিবারেশন ফোর্সের নেতা জিহাদ আহমদ জিবরীল মোসাদ কর্তৃক লেবাননে নিহত হন।

২০০২ সালের ১৪ই জানুয়ারী পশ্চিম তীরের শহর তুলকারেমে আল-আকসা শহীদ ব্রিগেড প্রধান রায়েদ কারমীকে বোমার আঘাতে মোসাদ হত্যা করে।

২০০৪ সালে সিনিওর হিজবুল্লাহ সদস্য গালেব আওআলীকে মোসাদ লেবাননে হত্যা করে।

২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিরিয়ার দামেস্ক শহরে ফিলিস্তিনী হামাস নেতা ইজ-আল-দ্বীন শেখ খলিলকে তার গাড়ীর চাকার সাথে বোমা পূঁতে মোসাদ হত্যা করে।

২০০৪ সালে উত্তর কোরিয়াতে সিরিয়া এবং ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামে কর্মরত বেশ কিছু সিরিয়ান নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী এবং পারমাণবিক চুল্লীতে ব্যবহারযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যদি বহনকৃত একটি ট্রেনে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে মোসাদ সিরিয়ান সকল বিজ্ঞানীদেরকে হত্যা ও বহনকৃত সকল সম্পদ ধ্বংস করে দেয়। 

২০০৪ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী জাবালিয়া ফিলিস্তিনী আশ্রয়শিবির হতে অন্যত্র যাওয়ার পথে মোসাদ ইসলামিক জিহাদ কমান্ডার মোহাম্মদ জুদাহ ও তার দু’জন সহযাত্রীকে হেলিকপ্টর গানসিফ হতে মিসাইল আক্রমণে হত্যা করে।

২০০৪ সালের ৩রা মার্চ গাজা সিটিতে সিনিওর হামাস নেতা তারাদ জামাল, ইব্রাহীম দায়িরি ও আম্মার হাসান-এর গাড়ী লক্ষ করে হেলিকপ্টর হতে মিসাইল নিক্ষেপ করে মোসাদ তাদের সকলকে হত্যা করে।

২০০৪ সালের ২২শে মার্চ গাজা ভূখন্ডে হামাসের যুগ্ন প্রতিষ্ঠাতা আহমদ ইয়াসিন ও দু’জন দেহরক্ষীকে মিসাইল আক্রমণে মোসাদ হত্যা করে।

২০০৪ সালের ১৭ই এপ্রিল আহমদ ইয়াসিনের স্থলাভিষিক্ত হামাসের অন্যতম যুগ্ন প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ আল-রানতিসি ও তার পুত্রকে গাজা ভূখন্ডে মোসাদ মিসাইল আক্রমণে হত্যা করে।

২০০৪ সালের ২১শে অক্টোবর গাজায় হামাস অস্ত্র বিশারদ আদনান আল-গউল ও তার সহযোগী ইমাদ আব্বাসকে তাদের গাড়ীতে এপাচী হেলিকপ্টর হতে মিসাইল আক্রমণের মাধ্যমে মোসাদ হত্যা করে।

২০০৬ সালের ২৫শে মে লেবাননের সিডনে ইসলামিক জিহাদ নেতা মাহমুদ আল-মাজয়ূব-এর গাড়ীতে বোমা পুঁতে মোসাদ হত্যা করে।

২০০৬ সালের ৮ই জুন পপুলার রেসিস্টেন্ট কমিটি-এর প্রতিষ্ঠাতা, ফাতাহ এবং তানজিম গ্রুপ-এর প্রাক্তন নেতা জামাল আবু সামাহদানা তার তিনসহযোগীসহ ইসরাইলী বিমান আক্রমণে নিহত হন।

২০০৮ সালে সিরিয়ার পরমাণুবিজ্ঞনী প্রধান মোহাম্মদ সুলাইমানকে সাগর সৈকতে ভ্রমণের সময় একটি স্পীড বোট হতে গুলি করে মোসাদ খুন করে।

২০০৮ সালের ১লা আগষ্ট সিরিয়ার মিলিটারী জেনারেল মোহাম্মদ সুলাইমান যিনি সিরিয়া সরকার এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন তাকে অতর্কিত আক্রমণে মোসাদ হত্যা করে। 

২০০৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী হিজবুল্লাহর সিনিয়র নেতা ইমাদ মুগনিয়াকে দামেক্স শহরে মোসাদ ও সিআইএ-এর যুক্ত পরিকল্পনায় হত্যা করা হয়। মোসাদ সন্দেহ করে যে, এই নেতা ১৯৮৩ সালে দামেস্ক শহরে আমেরিকান দূতাবাসে বোমা মারার সাথে সম্পৃত্ত ছিল।

২০০৯ সালের ১লা জানুয়ারী হামাসের প্রথম সারির কমান্ডার ও নীতিনির্ধারক নিজার রাইয়ান, তার চার স্ত্রী ও এগারো সন্তানকে ইসরাইল মিসাইল আক্রমণে মোসাদ হত্যা করে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ ধরণের নারী এবং শিশু হত্যার নিন্দা জানালে ইসরাইল সরকার হামাসের অস্ত্রাগার ধ্বংসের পরিকল্পনার কথা জানায় এবং এ হত্যাকান্ডকে নিছক দুর্ঘটনা বলে অভিহিত করে দোষ খন্ডন করে।

২০০৯ সালের ৩রা জানুয়ারী হামাসের অন্য একজন কমান্ডার আবু জাকারিয়া আল জামাল যিনি হামাসের রকেট নিক্ষেপণ স্কোয়ার্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন তাকে ইসরাইলী বিমান হতে মিসাইল আক্রমণের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।

২০০৯ সালের ১৫ই জানুয়ারী ফিলিস্তিনী সরকার শাসিত জাবালিয়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাইয়েদ সিয়াম, তার ভ্রাতা, পুত্র এবং হামাস জেনারেল সিকিউরিটি সার্ভিস কমান্ডার সালাহ আবু সারার্ককে মোসাদ মিসাইল আক্রমণে হত্যা করে। 

২০০৯ সালের ৪ঠা মার্চ প্রথম সারির ইসলামিক জিহাদ নেতা খালেদ সালানকে গাজা ভূখন্ডে ইসরাইলী বিমান আক্রমণে হত্যা করা হয়।

২০১০ সালের ১২ই জানুয়ারী তেহরানে ইরানের পরমাণূ বিজ্ঞানী মাসহুদ আলী মোহাম্মদীর গাড়ীতে বোমা পুঁতে মোসাদ হত্যা করে।

২০১০ সালের ১৯শে জানুয়ারী সিরিয়াভিত্তিক হামাস-এর মিলিটারী কমান্ডার মাহমুদ আল-মাবুতকে  দুবাইয়ের হোটেল ’আল-বোস্তান রতানা’র ১৩০ নং কক্ষে রাত সাড়ে ন’টার দিকে ইলেকট্রিক শক ও লেথেল ইনজেকশন প্রয়োগ করে ব্রিটিশ এবং আইরিশ পাসপোর্টধারী মোসাদ এজেন্টরা হত্যা করে। প্যারিস ভিত্তিক প্রকাশিত ইনটেলিজেন্স অনলাইন জার্নাল এবং হোটেলের সিসিটিভিতে ধারণকৃত ছবি হতে জানা যায় এ অভিযানে মোসাদের মোট ১০জন সদস্যের মধ্যে তিনজন নারী সদস্য ছিল। প্রথমে নারী সদস্যের একজন ওয়েটার সেজে মাহমুদ আল মাবুতের ১৩০ নং কক্ষের দরজায় টোকা দেয়। মাবুত এর কিছুক্ষণ পূর্বে দুবাইয়ের সিরিয়ান কনস্যুলেট হতে জরুরী মিটিং শেষে ফিরেছিলেন। নারী ওয়েটারের শব্দ শুনে দরজা খোলা মাত্রই মোসাদ হিট স্কোয়ার্ডের তিনজন সদস্য মাবুতের উপর চড়াও হয় এবং ঠান্ডা মাথায় খুন করে দরজা লাগিয়ে পালিয়ে যায়।

২০১০ সালের ৩১শে জুলাই গাজা ভূখন্ডে হামাস মিলিটারী কমান্ডার এবং রকেট বিজ্ঞানী ঈসা আল-বাতরানকে হেলিকপ্টার গানসিফ হতে গুলি করে মোসাদ হত্যা করে।

ফ্রান্সের ’লা ফিগারো’ পত্রিকায় খবরে জানা যায় ২০১০ সালের ১২ই অক্টোবরে ইরানের ইমাম আলী মিলিটারী বেইসে যে ভয়াবহ বিষ্ফোরণে সংগঠিত হয় তার পেছনে মোসাদের হাত ছিল। উক্ত বিষ্ফোরণে ইরান রিভলিউশনারী গার্ডের ১৮ জন সদস্যের মৃত্যু হয় এবং ১০ জন গুরুতর আহত হয়। মৃতদের মধ্যে রিভলিউশনারী গার্ড প্রধান জেনারেল হাসান তেহরানী মোকাদ্দাম নিহত হন যিনি ইরানের দূর পাল্লার মিসাইল প্রোগ্রামের দায়িত্বে ছিলেন। তাছাড়া সন্দেহ করা হয় যে, ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের পদার্থ বিজ্ঞানী যথাক্রমে মাসুদ আল মোহাম্মদী, আর্দেসির হোসেইনপোর এবং মোস্তফা আহমদী রওশনকে বিভিন্ন সময় মোসাদ এজেন্টরা হত্যা করে। ইসরাইলের তৎকালীন মোসাদ প্রধান মীর দাগান সংবাদ সম্মেলনে ’ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্রেইন’ পৃথিবী হতে বিদায় নেয়ার জন্য শোকরিয়া জানান। এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মোসাদ এ সমস্ত হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল। ইসরাইল এবং আমেরিকা চায়না ইরান আণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন হোক যে কারণে বর্তমান মোসাদ প্রধান তামির পার্ডো ২০১২ সালের ফেব্রæয়ারীতে আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যদি ইসরাইল ইরানের আণবিক শক্তিকেন্দ্রে আচমকা অভিযান চালায় তাহলে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া কি হবে ? উত্তরে আমেরিকা ইরানকে অবরোধের মাধ্যমে একঘরে এবং শক্তিহীন করে দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। ইসরাইল ও আমেরিকা সা¤প্রতিককালে জাতিসংঘের আণবিক পরিদর্শকদের মাধ্যমে ইরানের আণবিক প্রোগ্রাম বন্ধ করার প্রয়াস চালিয়ে আসছে। পরিদর্শকদের মধ্যে অনেক ইহুদী পরিদর্শক রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।

২০১০ সালের ৩রা নভেম্বর গাজা ভূখন্ডে ইসলামিক জিহাদ কমান্ডার মোহাম্মদ নিমনিম-এর গাড়ীতে বোমা পুঁতে মোসাদ হত্যা করে।

২০১০ সালের ১৭ই নভেম্বর গাজা ভূখন্ডে ইসলামিক জিহাদ কমান্ডার মোঃ ইয়াসিনকে ইসরাইলী বিমান আক্রমণে হত্যা করা হয়।

২০১০ সালের ২৯শে নভেম্বর ইরানের পারমাণু বিজ্ঞানী ডঃ মজিদ শাহরিয়ারী এবং ফেরিদৌন আব্বাসীর গাড়ীতে মোসাদ এজেন্ট বোমা পুঁতে রাখে। বিষ্ফোরণে ডঃ মজিদ নিহত হন এবং গুরুতর আহত হয়ে ডঃ ফেরিদৌন প্রাণে বেঁচে যান।

২০১১ সালের ১১ ই জানুয়ারী গাজা ভূখন্ডে ইসলামিক জিহাদ রকেট নিক্ষেপণকারী সদস্য মোহাম্মদ এ. নাজ্জার মটর সাইকেলে আরোহণরত অবস্থায় ইসরাইলী বিমান আক্রমণে নিহত হন।

২০১১ সালের ৯ই এপ্রিল গাজা ভূখন্ডে উচ্চপদস্থ হামাস কমান্ডার তৈসির আবু স্নিমা ও তার দু’জন দেহরক্ষী ইসরাইলী বিমান আক্রমণে নিহত হন।

২০১১ সালের ২৩শে জুলাই ইরানের পরমাণূ বিজ্ঞানী ডঃ দারউইস রেজাইনিজাদকে মটর সাইকেল আরোহী মোসাদ এজেন্ট গাড়ীতে গুলি করে হত্যা করে।

২০১১ সালের ১৮ই আগষ্ট গাজা ভূখন্ডে পপুলার রেসিস্টেন্ট কমিটি কমান্ডার আবু কুদ আল নিরব এবং খালেদ সাথকে ইসরাইলী বিমান আক্রমণে হত্যা করা হয়।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দিরার আবু সিসি নামের একজন ফিলিস্তিনী ইঞ্জিনিয়ার ইউক্রেনের নাগরিকত্ব লাভের চেষ্টা করতে গিয়ে ইউক্রেনের একটি ট্রেনে মোসাদ এজেন্টের কাছে ধরা পড়ে। তিনসপ্তাহ পরে তাকে ইসরাইলের জেলহাজতে দেখা যায়।

২০১২ সালের ৯ই মার্চ গাজা ভূখন্ডে ফিলিস্তিনী পপুলার রেসিস্টেন্ট কমিটির সেক্রেটারী জেনারেল জোহের আল-কায়িসি-কে বিমান আক্রমণে মোসাদ হত্যা করে।

২০১২ সালের ১৪ই নভেম্বর গাজা ভূখন্ডে হামাস মিলিটারী উয়ং কমান্ডার আহমদ জাবারীকে মোসাদ পরিচালিত ইসরাইলী বিমানবহর হত্যা করে।

২০১৪ সালের ৮ই জুলাই হতে শুরু করে পরবর্তী আগষ্ট মাস ব্যাপী ফিলিস্তিনের গাজা ভূ-খন্ডে আমেরিকান প্রশাসনের সমর্থনে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে বুড়ো আংঙ্গুল দেখিয়ে ইসরাইল নির্বিচারে একতরফা গণহত্যা চালায়। এতে গাজায় বসবাসরত দু’হাজারেরও বেশী ফিলিস্তিনী সাধারণ মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় বারহাজার নিরোপরাধ মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। নিহত এবং আহতদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশী। আঠারো লক্ষ গাজাবাসীর ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা নিরুপণ করা প্রায় অসম্ভব কারণ ইসরাইলী কামানের গোলায় প্রায় প্রতিটি ঘরবাড়ী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

হত্যাযজ্ঞে পারদর্শী মোসাদ ১৯৪৮ সাল হতে এ পর্যন্ত সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ইরান, ইরাক, মিসর তিউনিসিয়া, লিবিয়া এবং ফিলিস্তিন জুড়ে কতশত হত্যা করেছে তার সঠিক হিসাব অলিখিতই রয়ে গেছে। ইসরাইলী জেলে অগণিত ফিলিস্তিনী বন্দীরা ইসরাইলী সেনাদের জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে অথবা পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে তার সঠিক হিসাব কারও জানা নেই। মানবাধিকার প্রশ্নে পরাশক্তি আমেরিকা, ব্রিটেন, ইসরাইল এবং তাদের দোসররা পৃথিবী জুড়ে মানবাধিকার প্রশ্নে অত্যন্ত সোচ্চার থাকলেও ইসরাইলী জেলহাজতে কিংবা আমেরিকার গুয়েনতানামো-বে কারাগারে জেলহাজতে নিরীহ স্বাধীনতাকামী বন্দীদের উপর কুকুর লেলিয়ে তাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করার দৃশ্য এবং অন্যান্য পাশবিক নির্যাতনের দৃশ্য যখন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে দেখানো হয় তখন মানবাধিকার প্রশ্নটি হতবাক হয়ে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে।

আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান, জর্ডান, লিবিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে মোসাদ অত্যন্ত সক্রিয়। মনুষ্যবিহীন রিমোটকন্ট্রোল ড্রোন বিমান যা বর্তমান বিশ্বের ত্রাস - এ বিমানটি ইসরাইলের বিমান কোম্পানী ঞঅউওজঅঘ এবং আমেরিকার বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড-এ অবস্থিত অঅও ঈড়ৎঢ়. যুক্তভাবে তৈরী করে। ব্যক্ত থাকে যে, এ বিমানটি আফগানিস্তানের তালেবান এবং আল-কায়েদার মুক্তিকামী মানুষের উপর আঘাত হেনে আফগান এবং পাকিস্তানের অসংখ্য নিরীহ মানুষ এবং সেনাসদস্যকে হত্যা করে যার সত্যিকার হিসাব সম্ভবতঃ সঠিকভাবে অদ্যাবধি ইতিহাসে স্থান করে নেয়নি।

সা¤প্রতিককালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে শক্তিশালী করার লক্ষে ইসরাইলী মোসাদ বেশ কিছু ড্রোন বিমান ভারতের কাছে বিক্রি করে। আমেরিকার ”ম্যাকডোনেল ডগলাস” বিমান প্রস্তুতকারী কোম্পানীতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইহুদী বিধায় ঐ কোম্পানী কোন্ মুসলিম দেশে কতটি যুদ্ধবিমান বা যাত্রীবাহী বিমান বিক্রি করে তার হিসাব ইসরাইল সহজে পেয়ে যায়। 

মোসাদ স্পাই একাডেমীতে ক্যাডারদের পৃথিবীর প্রধান কয়েকটি ধর্মের মূলমন্ত্র, অনুসরণীয় দিকসমূহ, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, জালিয়াতি, ঠান্ডা মাথায় খুন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মোসাদের করণীয়, দেশে দেশে ইহুদী এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ, একই স¤প্রদায়ের লোকদের মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ইত্যাদি বিষয়ে এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয় যাতে করুণা, ভালবাসা, মানবতা, দূর্বলতা এবং মোহ মন থেকে চিরতরে রহিত হয়। তাই একাডেমী প্রধান অৎধষবয ঝযবৎভ  মোসাদ ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে একসময় বলেছিলেন ঃ  ”আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে - প্রতারণার মাধ্যমে অর্জন। তোমরা ক্যাডেটরা এ মুহূর্তে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য এক ধরণের কাঁচামাল। এ কাঁচামাল দিয়ে আমরা এমন একটি প্রোডাক্ট বানাবো যা হবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন মানবসত্ত¡া। আমরা কাউকে পাশ মার্ক দেইনা যতক্ষণ না পর্যন্ত সে শতভাগ যোগ্যতা অর্জন না করে” (সূত্র ঃ বাই ওয়ে অব ডিসেপশন ঃ ভিক্টর অষ্ট্রোাভাক্সি (অবঃ) মোসাদ কেইস অফিসার) 

আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিং তার এক ভাষণে বলেছিলেন  Do not do an immoral things for a moral reason অর্থাৎ নৈতিক কারণে অনৈতিক কোন কাজ করনা। মোসাদ একাডেমীর ট্রেনিং পদ্ধতি ঠিক তার উল্টো। মানবতা কিংবা শান্তিতে অন্যান্য ধর্মের লোকদের সাথে সহাবস্থান এ সমস্ত নীতিবাক্য মোসাদ স্পাইদের কাছে সামান্যই তাৎপর্য বহন করে।

ইহুদী জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় - পৃথিবীতে যুগে যুগে, মানুষে মানুষে, দেশে দেশে, কালে কালে যে সমস্ত অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তার বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ইহুদী জাতি পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল এবং এ সমস্ত কারণে পরিশেষে ইহুদীদের ভাগ্যে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তাদেরকে হাজার হাজার বছর নির্বাসিত জীবনযাপন এবং যুদ্ধবিগ্রহে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছিল যদিও তারা ধনসম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, ব্যবসাক্ষেত্রে, বুদ্ধি ও সাহসিকতায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের তূলনায় অধিক অগ্রগামী।

অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ কেইস অফিসার ভিক্টর অষ্ট্রোভাক্সি তার বই ’বাই ওয়ে অব ডিসেপশন’ গ্রন্থে লিখেছেন - মোসাদ ক্যাডারদেরকে প্রতিটি কাজ হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। এমনকি মোসাদ হেড কোয়ার্টারে প্রায় ১০০ ফিট মাপের একটি ফোল্ডিং স্ক্রিন রয়েছে যেখানে বাস্তবে দেখানো হয় ইসরাইলের শত্রæরা কে কোথায় আবস্থান করছে বা কি করছে। এ স্ক্রিনের নিচে অসংখ্য কম্পিউটার এবং ইনফরমেশন টেকনোলজী লুক্কায়িত রয়েছে যেখানে নির্দিষ্ট টেকনিশিয়ান ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার নেই।

ধরুন - একজন ফিলিস্তিনী শত্রু নেতা এ মূহুর্তে কোথায় অবস্থান করছে, গত তিনদিন সে কোথায় ছিল এটা জানতে হলে ঐ নেতার নাম কম্পিউটারে পুশ করলেই তার সঠিক অবস্থান জানা যাবে। বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত মোসাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চ চব্বিশ ঘন্টা এ ধরণের তথ্য সরবরাহে নিয়োজিত এবং এ সব তথ্য প্রতিটি মূহূর্তে কম্পিউটারে আপডেট করা হয়। এ কারণে মোসাদ স্পাই রিং তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়না। তাদের অব্যর্থ এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ তাদেরকে পৃথিবীর সেরা স্পাই প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ইহুদিরা ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী লোক এবং মুসলিম সমৃদ্ধ দেশগুলোকে তাদের প্রধান শত্রু হিসাবে ভাবে। যে কারণে মোসাদ স্পাই রিং-এ কর্মরত প্রত্যেক ক্যাডারকে ট্রেনিংকালীন সময়ে ছয় সপ্তাহ ইসলামী রীতিনীতি এবং ধর্মগ্রন্থ আল-কু’রআনের উপর বিশেষ ট্রেনিং নিতে হয়। মোসাদ হিট স্কোয়ার্ডের সদস্যদেরকে খুন-খারাবীর জন্য বিভিন্ন দেশে ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশের জন্য জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করতে হয়। জাল পাসপোর্ট তৈরীর জন্য তাদের রয়েছে স্পেশাল ডিপার্টমেন্ট এবং জনবল। অবিকল পাসপোর্ট, ভিসা তৈরীর যাবতীয় সরঞ্জাম, কোড নাম্বার ইত্যাদির জন্য যাবতীয় সিলমোহর প্রস্তুতে তাদের জুড়ি নেই। তাছাড়া পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি বড় বড় হোটেলের মূল চাবির ডুপ্লিকেট মাষ্টারকপি তাদের সংগ্রহে রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে যত নামকরা তালা প্রস্তুতকারী কারখানা রয়েছে তাদের প্রস্তুতকৃত তালার মান-নিয়ন্ত্রণের জন্য লন্ডনে এর একটি কার্যালয় রয়েছে। যে কোন ধরণের তালা প্রস্তুত করার পর লন্ডনস্থ মান-নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ে পাঠানোর বিধান রয়েছে। উক্ত প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের পর এ তালা বাজারে ছাড়ার অনুমতি প্রদান করা হয়। লন্ডনস্থ তালার মান-নিয়ন্ত্রন কার্যালয়ে কর্মরত মোসাদ স্পাই কিংবা সায়ানিমের (সাহায্যকারী) মাধ্যমে মোসাদ চাবির ফটো কৌশলে সংগ্রহ করে থাকে যাতে করে মোসাদ গোপনে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ কিংবা তথ্য সংগ্রহের জন্য শত্রæর আস্তানায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র টেলিফোন যন্ত্র প্রতিস্থাপন করে আড়ি পাতার কাজে ব্যবহার করতে পারে।

বিদেশে বসবাসরত ইহুদী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যারা ইহুদী স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ মোসাদ তাদের সাহায্য নেয়। মোসাদের ভাষায় তাদেরকে ’সায়ানিম’ বা সাহায্যকারী বলা হয়। বিভিন্ন দেশে মোসাদের হাজার হাজার ’সায়ানিম’ রয়েছে, শুধুমাত্র লন্ডন শহরে প্রায় দুইহাজার ’সায়ানিম’ রয়েছে এবং সমগ্র ব্রিটেন জুড়ে আরও ছয়হাজার ’সায়ানিম’ মোসাদের লিষ্টে আছে। সায়ানিমরা রেন্ট-এ-কার, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, হোটেল, মানি এক্সচেঞ্জ এবং বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, মোসাদ স্পাই রিং এদের সাহায্য নিয়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পাদন করে।

মুসলিম দেশগুলোর কাছে মিসাইল, সাবমেরিন ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত টর্পেডো, বিমান ও ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইল, দুরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র কিংবা আধূনিক যুদ্ধবিমান তৈরীর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই এবং বর্তমান মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ইরান, তুরস্ক, কাজাখিস্থান এবং পাকিস্তানের কাছে এসমস্তের প্রযুক্তি থাকলেও  খুচরো যন্ত্রাংশ প্রস্তুতে আমদানী নির্ভর হওয়ায় তাদেরকে ফ্রান্স, আমেরিকা, ব্রিটেন কিংবা রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রয় করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হয়।

উন্নত দেশগুলোর অস্ত্র কারখানায় কর্মরত অসংখ্য ইহুদী টেকনিশিয়ান এবং বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় মোসাদ জানতে পারে সামরিকভাবে মুসলিম দেশগুলোর কোন্টি কতটুকু শক্তিশালী। তাছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি মুসলিম দেশের অভ্যন্তরে সরকারী উচ্চপদে অধিষ্ঠিত সামরিক ও বে-সামরিক কর্মকর্তা কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের অনেককেই বিভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগ করে, ক্ষমতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার শর্তে, বিভিন্ন লবিং-এর মাধ্যমে, বø্যাকমেইল  কিংবা টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে মোসাদ গোপন তথ্য জানতে পারে।

অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ কেইস অফিসার ভিক্টর অষ্ট্রোভাষ্কি তার ”বাই ওয়ে অব ডিসেপশন” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন মোসাদ বিভিন্ন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, সরকারের মন্ত্রীসভার মধ্য হতে শক্তিশালী মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কিংবা উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে কৌশলে রিক্রুট করে তাদের স্বার্থে কাজ করতে প্রভাবিত করে এবং সুচারুরূপে সে কাজ সম্পন্ন করে। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিতে ইসরাইলী বিশেষজ্ঞরা বর্তমান বিশ্বে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর তথ্য প্রযুক্তির নেপথ্যে ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের এক গোপনীয় সংযোগ রয়েছে যে কারণে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আরব দেশগুলো নিজেদের মধ্যে যে গোপনীয় তথ্যসমূহ আদানপ্রদান করে তাতে মোসাদ অনায়াসে আড়ি পাততে পারে। ভূমধ্যসাগরের তলদেশ দিয়ে যে ”সারমেরিন কেবল” প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তা ইতালীর পালমোর-এ এসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ইসরাইল এ সংযোগস্থলে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে আড়ি পেতে সকল গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম।

============================================

(অনেক কিছু জানার আছেঃ লেখক রচিত বই, ২০২০ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত,মুখোশের অন্তরালে)বই হতে নেয়া কিয়দংশ। বইটি সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন:

    প্রজন্ম পাবলিকেশন, 45 evsjvevRvi, Kw¤úDUvi Kg‡cø·, XvKv-1100

†gvevBj : 01572 410 018

   facebook.com/projonmopublication

                                            www.projonmo.pub   


Saturday, December 19, 2020

পুতুল রাষ্ট্র আমেরিকা : আমেরিকান পরাশক্তি ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পায়ের কাছে নতজানু (Must read)

 

cyZzj  ivóª  Av‡gwiKv t  Av‡gwiKvb civkw³ BmivBjx cÖavbgš¿x †bZvwbqvûi cv‡qi Kv‡Q bZRvby t

DR.  PAUL CRAIG ROBERTS

 

(g~j cÖwZcv`¨ t)Puppet State America

 “The “American superpower” groveling at Netanyahu’s feet!”

DR.  PAUL CRAIG ROBERTS :  NOVEMBER 20, 2012

(Paul Craig Roberts, is a former Assistant Secretary of the US Treasury and former associate editor of the Wall Street Journal)

 

Av‡gwiKvb miKv‡ii cÖv³b mnKvix †UªRvix †m‡µUvix cj †µBM ievU©m& (wLª÷vb) `ytL K‡i e‡jwQ‡jb - ÓAv‡gwiKvi Ae¯’vb GLb U‡q‡j‡U Ges GUv c„w_exi meviB RvbvÓ|

 hy³ivó miKvi Ges mswkøóiv g‡b K‡i †h, Av‡gwiKv c„w_exi GKgvÎ civkw³ wKš‘ †Kgb K‡i G †`k wb‡R‡K civkw³ e‡j AvL¨vwqZ Ki‡e hLb miKvi Ges mswkøóiv I Pv‡P©i Ava¨vwZ¥K ¸iæiv BmivBjx cÖavbgš¿xi cv‡q bZRvby ? ga¨cÖv‡P¨i e¨vcv‡i G †`kwUi ciivóª bxwZ wba©vi‡Y †h NvUwZ cwijw¶Z nq Zv‡Z Av‡gwiKv‡K wKfv‡e civkw³ai wnmv‡e we‡ePbv Kiv hvq ? GUv GKwU cyZzj miKvi Ges AveviI ewj mv¤cÖwZK Ae¯’v`„‡ó g‡b nq Ócivkw³ai Av‡gwiKv †bZvbBqvûi cv‡qi Kv‡Q bZRvbyÓ|

 ‡bZvbBqvû hLb cybivq e¨³ K‡ib MvRvi Aewkó wdwjw¯Íbx bvix I wkï‡K ea Ki‡eb Ges BmivBjx‡`i AvZ¥i¶vi bv‡g MvRvi Aewkó wdwjw¯Íbx‡`i `vjvb‡KvVv mg~‡j aŸsm K‡i w`‡eb ZLb Av‡gwiKvb wm‡bU, †nvqvBU nvDm Ges MYgva¨g mv‡_ mv‡_ †bZvbBqvûi G ai‡Yi Acivag~jK AwfcÖvq‡K m¤§wZ Rvbvq|

2015 mv‡ji 16B b‡f¤^i Av‡gwiKvb Ks‡MÖm, wm‡bU Ges Av‡gwiKv-BmivBj cvewjK G‡dqvm© KwgwU (AvB‡cK - BmivBjx jex) KZ©„K wjwLZ cÖ¯Íve GKev‡K¨ mg_©b K‡i| AvB‡cK M‡e©i mv‡_ Av‡gwiKvb cÖkvm‡bi Dci Bû`x‡`i cÖfv‡ei K_v e‡j _v‡K| †eb iWm&, †nvqvBU nvD‡mi †WcywU wbivcËv Dc‡`ôv ciw`b 17B b‡f¤^i MYgva¨g‡K e‡jb - ÓBmivBj miKvi hv Pvq Zv‡Z Avgv‡`i c~Y© m¤§wZ i‡q‡QÓ|

MvRvq emevmiZ wdwjw¯Íbx‡`i‡K Zv‡`i emZwfUv n‡Z DrLvZ K‡i BmivB‡j AvMZ wfb‡`kx kibv_©x‡`i ¯’vqx evm¯’vb wbg©v‡bi `vexi †cÖw¶‡Z †bZvbBqvû Zv‡`i mg_©b K‡i MvRvq Avµg‡Yi wm×všÍ †bb|

†nvqvBU nvDm BmivBjx jexi wm×v‡šÍ mË¡i mvov †`q Ges MvRvq BmivBjx mvgwiK Kg©KvÛ‡K ¯^xK…wZ †`q| hLbB wek^we‡eK wdwjw¯Íbx RbM‡Yi AwaKvi Ges b¨vh¨ wePvi wb‡q RvwZms‡N BmivBj miKv‡ii weiæ‡× cÖ¯Íve MÖnY K‡i ZLbB Av‡gwiKv †m wm×v‡šÍi weiæ‡× BmivB‡ji cÿ wb‡q †f‡Uv cÖ‡qvM K‡i|

150 eQi c~‡e© Av‡gwiKvb wjsKwjb wicvewjKvbiv †iW-BwÛqvb‡`i weiæ‡× hv K‡iwQj †bZvbBqvûi BmivBjI wVK Gfv‡eB Ki‡Q hw`I AvšÍR©vwZKfv‡e cwðg Zxi I MvRv f~-LÛ‡Z wdwjw¯Íbx‡`i AwaKvi wbwðZ Kiv n‡q‡Q| GZ`m‡Ë¡I Av‡gwiKvb miKvi BmivBjx‡`i cyZzj wnmv‡e RvwZms‡N evi evi Zv‡`i c‡¶ †f‡Uv cÖ‡qvM Ki‡Q|

wdwjw¯Íbxiv BmivB‡ji wbivcËvi ûgwKmiƒc GUv fvev †hgb Am¤¢e †Zgwb Av‡gwiKvi weiæ‡× ûgwK wnmv‡e AvdMvwb¯Ívb, BivK, wjweqv, †mvgvwjqv, cvwK¯Ívb Ges Bivb‡KI fvev hvqbv|

19†k b‡f¤^iÕ2015 mv‡j MvRvq BmivBjx hyׇcvivax‡`i‡K †`vlgy³ Ki‡Z Ievgv ej‡jb - Óc„w_exi †Kvb †`kB mn¨ Ki‡ebv hLb †m †`‡ki gvby‡li Dci mxgvšÍ n‡Z kÎæiv wgmvBj AvµgY K‡iÓ wKš‘ GK_v mZ¨ †h hyׇcvivax Ievgvi AvdMvwb¯Ívb, BivK, cvwK¯Ívb, B‡q‡gb, wjweqv, †mvgvwjqv Ges wmwiqvmn AmsL¨ †`k Ab¨vqfv‡e Av‡gwiKvi wgmvBj el©Y mn¨ K‡i‡Q| m¤¢eZt Bivb Ievgvi cieZ©x j¶ (e¨³ _v‡K †h, Bivb AvµgY Kivi e¨vcv‡i BmivBj Av‡gwiKv‡K D‡Øv× K‡i Avm‡Q)

Iqvi‡kv‡Z Rvg©vbxi Bû`x wba‡bi b„ksmZvi KLv BwZnvm¯^xK…Z| H ai‡Yi NUbvq Gev‡i cÖagev‡ii gZ Bû`xiv m¤¢eZt nZ¨vh‡Ái wkKvi bv n‡q wkKvix n‡e| BmivB‡ji ¯^ivóªgš¿x Bwj Bmvqx D”PviY K‡i‡Qb - ÓMvRv f~LÛ‡K ga¨hy‡M wdwi‡q wb‡Z †h‡Z n‡eÓ|


Av‡gwiKv BmivB‡ji µxZ`vm

(Av‡gwiKv t K‡jvwb n‡Z GKwU RvwZ, µgvš^‡q µxZ`vm)

 

Michael Scheuer Av‡gwiKvb Bb‡Uwj‡RÝ ms¯’v ÓwmAvBG-iÓImvgv webjv‡`b Bm¨y m¤úwK©Z †W·-Gi cÖv³b cÖavb Kg©KZ©v| Zvi wjwLZ mvgªv‡R¨i `¤¢ (Imperial Hubris) MÖš’wU cvVK mgx‡c mgv`„Z I eûj Av‡jvwPZ)


2012 mv‡ji 19†k A‡±vei ÓBbdi‡gkb wK¬qvwis nvDmÓ KZ©„K cÖKvwkZ Michael Scheuer wjwLZ Dc‡iv³ wk‡ivbv‡g GK wbeÜ cÖKvwkZ nq hv wbgœiƒc t 

ÓAv‡gwiKvi MZ †cÖwm‡W›U wbe©vP‡bi cªPvivwfhv‡bi w`‡K g‡bvwb‡ek Ki‡j †`Lv hvq, †cÖwm‡W›U ev‡iK Ievgv Ges MfY©i igwb `yÕRbB †cÖwm‡W›U c`cÖv_©x wnmv‡e Zviv Zv‡`i c~e©m~ix Ks‡MÖmg¨vb‡`i gZ B”Qvc~e©K Av‡gwiKvi Aw¯’Z¡ Ges ¯^ve©‡fŠgZ¡ BmivB‡ji Kv‡Q mgc©Y K‡iwQ‡jb hv wKQzmsL¨K Av‡gwiKvi Bû`x I Zv‡`i wLª÷vb eÜzfvevcbœ m½x Ges Bû`x wbqwš¿Z MYgva¨g †h¸‡jv G `yÕRb c`cÖv_©xi c¶ wb‡q djvI K‡i cÖPvi K‡i| GK_v mywbwkPZfv‡e aiv hvq †h, Ievgv Ges igwb wbe©vPbx LiP †hvMv‡bvi Rb¨ Av‡gwiKvi abx Bû`x, eÜzfvevcbœ wLª÷vb m½x Ges BmivB‡ji cÖavb gš¿x †ebBqvwgb †bZvwbqvûi Øvi¯’ n‡qwQ‡jb wb‡R‡`i AvZ¥gh©v`v wemR©b w`‡q| ¯^vaxbZv I ¯^ve©‡fŠgZ¡ i¶vq RvZxq miKv‡ii †h‡Kvb D‡`¨vM n‡e RbM‡Yi g½‡ji Rb¨ wKš‘ Zviv g‡b K‡ib miKvi hv‡`i Dci b¨¯Í ïay ZvivB GKKfv‡e wm×všÍ wb‡eb hy‡× Rwo‡q co‡eb wKbv ? A_P Av‡gwiKvi msweavb g‡Z †Kvb †`‡ki weiæ‡× hy× †NvlYvi Av‡M RbM‡Yi ivq wb‡Z nq|

miKvix Ges we‡ivax cvwU©i Kvcyiæl msL¨vMwió Ks‡MÖm m`m¨iv hLbB †cÖwm‡W‡›Ui c¶ wb‡q Zv‡`i wm×všÍ Rvbvb ZLb †cÖwm‡W›U cÖ_‡g RvwZmsN‡K cÖfvweZ K‡ib hv‡Z wjweqv wKsev Ab¨Î (Biv‡K) bviKxqfv‡e †evgv el©Y Ki‡Z †Kvb cÖwZeÜKZv bv _v‡K| hy× Bm¨y‡K †K›`ª K‡i ZLb BmivBj Av‡gwiKvb cÖkvm‡bi ûKzg`vZv n‡q hvq Ges GUv nIqvi †cQ‡b BmivB‡ji cÖavbgš¿x †ebBqvwgb †bZvwbqvûi Kv‡Q Ievgvi KvcyiæwlZ bZRvby bxwZB KvR K‡i Ges RvwZmsN ZLb Dc-`k©‡Ki f~wgKv cvjb K‡i| Ks‡MÖm wm‡bUiiv w`‡bi †k‡l †Kvb cÖkœ e¨wZ‡i‡K Av‡gwiKvi †cÖwiZ †mbvm`m¨ hv‡`i‡K g„Z¨yi `yqv‡i cvVv‡bv nq Zv‡`i LiP †gUvq hv cÖK…Zc‡¶ Av‡gwiKvi RvZxq ¯^v_©i¶vq Zv †Kvb Kv‡R Av‡mbv wKš‘ BmivBj, RvwZmsN Ges wg‡mm wK¬sUb, wgm ivBm RvZxq wKQzmsL¨K iYPÛx gwnjv‡`i I hy×evR g¨vK‡KBb Ges MÖvnvg‡K Lykx K‡i|

myZivs Avgiv cÖ‡Z¨‡K 2014 mv‡ji b‡f¤^‡i †fvU cÖ`vb Kie wKš‘ Avgv‡`i ¯^xKvi Kiv DwPZ Ievgv wKsev igwb †KDB Av‡gwiKvi ¯^ve©‡fŠgZ¡ Ges ¯^vaxbZv cybtcÖwZwôZ Ki‡Z cvi‡ebbv| †cÖwm‡W›U wnmv‡e D³ `yÕR‡bi g‡a¨ GKRb Av‡gwiKv‡K Biv‡bi weiæ‡× hy‡× †V‡j w`‡eb| Ievgv Pvb GUv 6B b‡f¤^‡ii wbe©vP‡bi c‡i nDK KviY GUv BmivBj Ges Zv‡`i m½xiv Pvq| Bivb, Aek¨B Av‡gwiKvi kw³kvjx cÖwZc¶ bq wKš‘ Bivb G AhvwPZ hy‡×i wnsmª cÖwZwµqv Rvbv‡Z cv‡i cvim¨ DcmvM‡i Av‡gwiKvb †Zjevnx RvnvR PjvP‡ji Dci wb‡lavÁv A‡ivc K‡i hv Av‡gwiKvi A_©bxwZi Dci we‡kl Pvc m„wó Ki‡e|

GZme Z¨vM ¯^xKvi wK‡mi Rb¨ ? G Ae¯’v n‡Z jvNe †c‡Z Av‡gwiKv Biv‡bi Dci Ab¨vqfv‡e wegvb Avµg‡Yi wm×všÍ wb‡Z cv‡i Ges cvigvYweK †evgv we‡õviY Qvov G hy× Rq AgxgvswmZ †_‡K hv‡e| Av‡gwiKvi Dfq `‡ji ivR‰bwZK †bZ…©e„›` †kl ch©šÍ BmjvwgK we‡k¦i mv‡_ hy‡× Rwo‡q co‡Z cv‡i|

hLb Av‡gwiKv weªwUk ivR‡Z¡i Ask wQj, Av‡gwiKvbiv weª‡U‡bi n‡q hy‡× Ask †bIqv Qvov Ab¨ †Kvb c_ †Lvjv wQjbv| weMZ `yBkZ eQ‡ii AwaK mg‡qi g‡a¨ hLb Avgiv weª‡Ub n‡Z ¯^vaxbZv jvf Kwi Gici n‡Z Avgv‡`i gvbexq ¸Yvejx, mvaviYÁvb, KZ©e¨wbóv Ges Avgv‡`i mvsweavwbK `vwqZ¡ n‡Z `y‡i m‡i Avwm Ges wewfbœ hy‡× Rwo‡q cwo we‡`kx Kv‡ivi wb‡`©‡k hv Av‡gwiKvb‡`i ¯^v‡_©i cwicš’x| GQvov Avgv‡`i †Kej †bUIqvK© wm‡óg BmivBjx cÖavbgš¿xi c‡¶ Ges Av‡gwiKvi †cÖwm‡W‡›Ui wec‡¶ hLb wbqwgZ cÖPvivwfhvb Pvjvq ZLb BmivB‡ji ¯^v_©B msiw¶Z nq|wLª÷vb a‡g©i bv‡g Ges Av`k© RvwZ wnmv‡e hLb Avgiv kvwšÍgq GK c„w_exi K_v ewj, - †K Rv‡b, m¤¢eZt Avgiv GKw`b weªwUk ivR n‡Z †K‡U co‡Z cvwi| weªwUkiv cÖvqB hy× K‡i wKš‘ ïaygvÎ weªwUk ¯^v_©i¶vi Rb¨|Ó 

(লেখক রচিত বই (মুখোশের অন্তরালে,২০২০ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত) বই হতে নেয়া কিয়দংশ। বইটি সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন:

    প্রজন্ম পাবলিকেশন, 45 evsjvevRvi, Kw¤úDUvi Kg‡cø·, XvKv-1100

†gvevBj : 01572 410 018

   facebook.com/projonmopublication

                                            www.projonmo.pub   

 

Friday, October 30, 2020

লোহিতের তীরে (ভ্রমণ কাহিনী) Enjoyable & informative

লোহিতের তীরে 

(ভ্রমণ কাহিনী) 

- নাজমুল চৌধুরী


নেক অশ্রু বিসর্জন এবং স্নেহাসিক্ত বন্ধন ছিন্ন করে সৌদিআরবের জেদ্দায় অবতরণের মধ্য দিয়ে বংশের খাতায় প্রথম প্রবাসী হিসাবে নাম লিখাতে হয়েছিল ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে। ভিন্ন এক দেশ, ভিন্ন এক জাতি। এখানে নেই বাংলাদেশের শ্যামলিমা। নেই ষড়ঋতুর সংমশ্রিনে অপরূপ বৈচিত্র। এটা এমন একটি দেশ যেখানে রাতের স্বচ্ছ নীলাকাশে জ্বল জ্বল করে লক্ষ কোটি তারা। শহর থেকে একটু দূরে বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তে চাঁদের কিরণে চক চক করে মরুর বালুরাশি। দিগন্ত বিস্তৃত বৃক্ষহীন বাদামী রঙ্গের ছোটবড় পাথুরে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত প্রহরীর মত। পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর জুড়ে ছুটোছুটি করে নির্ভীক আরব বেদুঈন আর তাদের নিরীহ উটের পাল। দমকা লু-হাওয়ার উষ্ণ পরশে প্রকৃতিতে নেমে আসে রুক্ষতার আমেজ।

মে মাসের প্রচন্ড গরমে প্রবাসী আখড়ায় ফোমের বিছানায় দিন পনেরো ঘুমিয়ে কাটাতে হল ওয়ার্ক পারমিটের প্রতীক্ষায়।এরই মধ্যে পৌঁছার সংবাদ জানিয়ে উত্তরের অপক্ষোয় প্রহর গুণতে গুণতে একদিন একপশলা বৃষ্টির মত শান্তির বার্তা নিয়ে হাজির হল প্রিয়জনদের চিঠি। পরিবারের ছোট বড় সকলে অনেক কথাই লিখেছে। তেরো বছরের ছোট ভাইটিও বড়দের মত লিখেছে, ভাইয়া, নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখো, বিদেশে স্বাস্থ্যই সম্বল। মুরব্বীদের স্বভাবসুলভ উপদেশের মত শোনালেও বড়ভাইয়ের প্রতি কিশোর মনের অভিব্যক্তি নিঃসন্দেহে হৃদয়র্স্পশী।

মা লিখেছেন, কিভাবে রেঁধে খাচ্ছ ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, অনিয়মিত খাওয়া দাওয়াতে নিশ্চয় এতদিনে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছ। চাকুরী হওয়া মাত্রই ভাল রান্না জানে এমন একটি বাবুর্চি রাখতে যেন ভুল না হয়। ছোটবোন অনেক উপদেশ ঝেড়ে জানতে চেয়েছে লোহিত সাগরের পানি কি লাল? মনে পড়ে শৈশবের কথা - প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্বে সাগর স্রোতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বন্ধুসুলভ মামা বলেছিলেন, প্রশান্ত মহাসাগর নামকরণ কেন হয়েছে জান? কারণ এ বিশাল মহাসাগর এতই শান্ত যে, যে কারণে তার ’প্রশান্ত' নামকরণ করা হয়ছে। উৎসুক হয়ে বলছেলিাম, তাহলেতো মামা এ সাগরে সাঁতার কাটতে নিশ্চয়ই কোন অসুবিধা হবেনা?

মামাকে অনেক পরে একদিন হেসে বলেছিলাম,মামা যাবে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রশান্ত রূপ দেখতে? যে মহাসাগর টর্ণেডো সৃষ্টি করছে প্রতিটি মূহুর্তে তার কোন কোনটি সাগর স্রোতের পথ ধরে তীব্র আকার ধারণ করে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বছরে দু’একবার তছনছ করে দেয় এবং তার ছোবলে পড়ে কত মানুষ হয় গৃহহারা আর শত শত মাঝিমাল্লা হয় নিঁখোজ।

মামার জ্ঞানের পরিধি তখন শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে, বললেন মানুষ যেমন কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখে, তেমনি অশান্তকে প্রশান্ত বলার ব্যখ্যা দিয়ে সুন্দরভাবে নিজের ভুল এড়িয়ে গেলেন,তর্কের ধারে কাছেও গেলেননা। যা হোক, বোনটি পথ চেয়ে আছে লোহিতের পানি সত্যিই লাল কিনা জানার প্রতীক্ষায়। লোহিত সাগর তখনো দেখা হয়নি, কি লিখব বোনটিকে?

মাসখানেকের মাথায় একদিন সুযোগ এল। মেসের ক’জন সঙ্গী নিয়ে মনোয়ারের ছোট্ট গাড়ীতে করে সাগর সৈকতে উপস্থিত হলাম। সন্ধ্যে হওয়ার বেশী দেরী নেই। বিরাট থালার মত অস্তগামী সূর্য্য সোনালী কিরণ ছড়িয়ে ঢলে পড়েছে লোহিতের অথৈ জলের গভীরে।একি! স্বচ্ছ নীল জলরাশি ধীরে ধীরে রক্তর্বণ ধারণ করছে। রক্তলাল ফেনিল উর্মিমালা কূলে এসে লুটিয়ে পড়ছে একের পর এক ।আরবীতে ’বাহার আল- আহমার'-এর অর্থ দাঁড়ায় লোহিত সাগর।

অতি প্রবীণ কোন আরবীয় নাবিক কিংবা জেদ্দা শহরের আমুরিয়া এলাকায় চল্লিশহাতের মত লম্বা দু’টো কবরের বাসিন্দা কথিত আদি পিতামাতা আদম ও হাওয়া হয়তোবা কোন এককালে আমার মত রক্তবর্ণ লোহিতের জলরাশির এ রূপ দেখে তন্ময় হয়ে সাগরটিকে ”বাহার আল-আহমার”(লোহিত সাগর)নামটি দিয়েছিলেন।

সূর্যাস্তে বঙ্গোপসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে কখনো এমন লাল রূপ দেখিনি লোহিতের মত। বোনটিকে চিঠির উত্তরে এসব লিখেছিলাম। মামা হলে হয়তো যুক্তির অবতারণা দেখিয়ে বলতেন, বস্তুর নাম রাখা হয় তার প্রকৃতি দেখে, যেমন কালো পানির সাগরকে কালো সাগর বা ব্লেক সি, তেমনি লাল পানিসমৃদ্ধ সাগরকে লোহিত সাগর আবার সাদা পানির সাথে মিল রেখে ’সাদা সাগর’ যেমন ভূমধ্যসাগরকে আরবরা ‘বাহার আল্‌-আবইয়াদ ওয়া মোতাওয়াচ্ছত' বলে ডাকে র্অথাৎ ‘ভূ-মধ্যের সফেদ সাগর’।

পাশাপাশি কয়েকটি দেশের পাশ ঘেষে একই সাগরের ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে মানুষ নিজেদের করে নিয়েছে। মিশরের সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে লোহিত এবং ভূমধ্যসাগরের মিলন ঘটানো হয়েছে। জর্দান সিরিয়া, ইসরাইল, ফিলিস্তিন এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু দেশের অধিবাসীরা (প্রাচীন শ্যাম দেশের অর্ন্তগত) ভুমধ্য সাগরকে 'সফেদ সাগর' বলে নিজেদের অধিকারে নিয়েছে তখন মিশর, ইয়েমেন, ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, জিবুতী, সৌদিআরব ও সুদানের বাসিন্দারা ’লোহিত সাগর'-কে নিজেদের করে নিয়েছে। আবার এ সমস্ত দেশগুলোর কোন কোনটি দু’সাগরকেই নিজেদের ভাবে কারণ তাদের দেশ লোহিত এবং ভূমধ্যসাগরকে ঘিরে রয়েছে।

এই লোহিতের অনেক ইতিহাস। আমাদের মহানবীর (সঃ) কত সঙ্গীসাথী এ সাগর অতিক্রম করে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশসমূহে। লোহিতের বিশাল জলরাশির উপর ভর করে কত আরবীয় নাবিক ব্যবসা এবং ধর্মপ্রচার উপলক্ষে ছড়িয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তে।

মক্কার জালেমদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে সুদুর মদীনা হতে লোহিতের অপর পাড়ে অবস্থিত আবিসিনিয়াতে (বর্তমান ইথিওপিয়া) রাসুল (সঃ) এর নির্দেশে মদীনা এবং জেদ্দা হতে দু’দফায় নৌকাযোগে পাড়ি জমিয়েছিলেন জাফর ইবনে আবু তালিবের নের্তৃত্বে শত শত সাহাবীরা তৎকালীন খ্রিস্টান অধ্যুষিত আবিসিনিয়াতে। ঈসা নবী (সঃ) তাঁর ভবিষ্যতবাণীতে মুহাম্মদের (সঃ) আগমন সম্পর্কে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন সে অনুযায়ী আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান সম্রাট নাজ্জাসী মুহাম্মদকে (সঃ) আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবী বলে বিশ্বাস করেছিলেন এ কারণে হিজরত করা সকল মুসলিম নরনারীকে সম্মানের সহিত আবিসিনিয়াতে বসবাসের সুযোগ দিয়েছিলেন। সাহাবীরা খ্রিস্টান সম্রাট নাজ্জাসীর উদারতায় সেখানে বসবাস এবং ধর্মপ্রচারের সুযোগ পেয়েছিলেন, ফলশ্রুতিতে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল জঙ্গলাকীর্ণ আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। এই লোহিত অতিক্রম করে বিভিন্ন দরবশে, আউলিয়ারা আরব ইয়েমেন  হতে ভারত উপমহাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। অত্যন্ত সুন্দর আবহাওয়াজনিত কারণে (বৎসরে গড়ে ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ইথিওপিয়া (প্রাক্তন আবিসিনিয়া) প্রচুর কফি, কৃষিপণ্য, ফলমূল, মিলেট, ভোজ্যতেলের বীজ, প্রাকৃতিক গ্যাস ও সোনাসহ অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ এবং মধ্যপ্রাচ্যে পশু রফতানী করে এ দেশটি জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতি বৎসর গড়ে প্রায় ছয়শতাংশ প্রবৃদ্ধি লাভ করে। বিশেষ করে হজ্জ্বের মাসে এ দেশটি সৌদিআরবে প্রচুর পশু রফতানী করে হাজীদের কুরবানীর যোগান দেয়। ১৯৩৬ হতে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এ দেশটি ইতালীর কলোনী ছিল। ইথিওপিয়াকে আফ্রিকার সিং বলা হয়। পূর্বে সোমালিয়া, পশ্চিমে দক্ষিণ সুদান, উত্তরে ইরিত্রিয়া এবং দক্ষিণে কেনিয়া অবস্থিত। ৫৯,২৫১ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ইথিওপিয়ায় রয়েছে পাহাড়পর্বত, কৃষি উপযোগী পাহাড়ী উপত্যকা, সমভূমি এবং বালাদেশের মত অসংখ্য নদনদী।

দশজন বিশিষ্ট যে মেসে প্রথমে উঠেছিলাম সে মেসে আমার এককালের কলিগ ব্যতীত অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্কুলের গন্ডি পার হয়নি। মেসের রান্নাবান্না সপ্তাহে রুটিন করে দেওয়ায় আমাকেও রান্না করতে হত। বাঙালী মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে মা-বোনদের হাতের সুস্বাদু রান্না খেয়েই অভ্যস্থ। অনভ্যাসের কারণে রান্না যে সুস্বাদু হবনো এটাই স্বাভাবিক।

খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো যখন পাশের রুম হতে আমার রান্না নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য কানে আসত – তিনি হচ্ছেন গিয়ে বড়লাট, রান্না জানেন না, হুহ, শুনেছি তিনি নাকি বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারী ও আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা ছিলেন। অন্যজন ব্যঙ্গর্পূণ কষ্ঠ যোগ করে বলে - আবার নাকি তিনি সরকারের কাষ্টমস্‌ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও ছিলেন। এমনই যদি হত তাহলে এখানে আসার দরকার কি ছিল? মনে করেছেন গপ্প মারলে মেসের লোকদের সহানুভূতি পাওয়া যাবে, রান্না করতে হবেনা, এই আর কি? এবার ব্যঙ্গোক্তি মিশোনো তৃতীয় কন্ঠ যোগ হল - এই লোকটির এখানে যদি চাকুরী হয় তাহলে আমার নামে কুকুর পুষবে, হুহ....।

অতীতে আমি কি করতাম তা এই পরিবেশে কথা প্রসঙ্গে বলাটা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মত হবে অন্ততঃ এ জ্ঞানটুকু আমার ছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার এককালের অধীনস্থ কর্মচারী মাণিক খবর পেয়ে আমাকে দেখতে এসে আমার অতীতকে যদি ফাঁস না করে দিত তাহলে হয়তো এ ধরণের নাজেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতোনা। অফিস ফেরত রুমমেট ও এককালের কলিগ বন্ধু কাসেমের কাছে পরামর্শ চাইলে সে বলল-ওহ,এই কথা? তোমার ভাগ্য ভাল তাই মোটামোটি ভাল কথা শুনেছ – চাকুরী পাওয়ার পূর্বে আমি যা শুনেছিলাম তা যদি তুমি শুনতে তাহলে বিছানাবালিশ বগলদাবা করে মসজিদের আশ্রয় নিতে। সুতরাং চাকুরী পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চোখকান বন্ধ রাখবে আর যেদিন তোমার রান্না নেই সেদিন খাওয়ার সময় ছাড়া ঘরে ফিরবেনা,এটাই একমাত্র পথ। যখন চাকুরী হবে সুযোগ বুঝে কেটে পড়বে। এখন যেখানে আছ তা মনে কর অনাথ আশ্রম। আমি শুধু প্রবেশনাল পিরিয়ডটা কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি। চাকুরীর  কন্‌ফারমশেন হয়ে গেলে এখানে আর থাকে কে?

বন্ধুর কথায় মনটা বেশ হালকা হল। সে যাক, ভাগ্যবলে হোক আর যোগ্যতাবলে হোক মাসখানেকের মধ্যে একটি মাঝারী ধরণের প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষকের চাকুরীটা পেয়ে যাওয়াতে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম এবং চাকুরীটা পাওয়ার সাথে সাথে অফিস সংলগ্ন ফার্নিশড্ এপার্টমেন্ট রুমে থাকার পারমিশনটাও পেয়ে গেলাম। পুরানো মেস হতে বিদায় নিয়ে আসার সময় যারা আমার কর্ণে নিত্যই গরম তেল ঢালতো এবার তারা মধুবর্ষণ করে বলতে লাগল - সুযোগ পেলে চাকুরীর ব্যাপারে তাদেরকে যাতে না ভুলি, অনুনয়ের স্বরে তা বলতে বলতে আমার লাগজে ট্যাক্সিক্যাব পর্যন্ত পৌঁছে দিল। অনেকেই বলল,আপনার যে ভাল চাকুরী হবে তা আগেই জানতাম।

বিনয়ের সাথে হাসিমুখে সকলের দোয়া চেয়ে একসময় বিদায় নিলাম। কাজর্কমে নিজেকে ভাল প্রমাণের চেষ্ঠার অন্ত ছিলনা তবে কাজের ফাঁকে ভাইবোন ও পিতামাতার কথা মনে হলেই ভীষণ ফাঁকা অনুভব করতাম। অফিস শেষে নিজের রুমে ফেরার পর একবাটি চাল একচূলোয় আর অন্য চুলোয় ডিম ভাজার প্রস্তুতি নিতে গেলে মায়ের উপদেশের কথা ভীষণভাবে মনে হত,“চাকুরী পাওয়া মাত্র ভাল দেখে বাবুর্চী রাখতে ভুলবেনা ... হায়রে মায়ের মন, মনে মনে বল্লাম, মাগো, এ উপদেশটি না দিয়ে অতীতে কঠোর হয়ে যদি বলতে, চাকর বাকরের কোন দরকার নেই, নিজের কাজ নিজেই সামলাবে, নিজের কাজকে সম্মান করবে এবং পারতঃপক্ষে অন্যের মুখাপেক্ষী কখনো হবেনা, তাহলে আজকের এই উদ্ভট পরিস্থিতির সৃষ্টি হতোনা। কবিগুরুর কবিতার কিয়দংশ মনে পড়ল "সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি।”

আমার একাকীত্বের অবসান হলো যখন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কোম্পানীর একটি প্রজেক্টে পয়ষট্টি বছর বয়স্ক আমেরিকান আর্কিট্যাক্ট ইঞ্জিনিয়ার ডঃ রিচার্ড সেনফিল্ড আমার রুমমেট হলেন। জীবনের এই প্রথম একজন আমেরিকানের সাথে সহবস্থান। আমরা দু’জন দু'প্রান্তের মানুষ। একজন বাংলার নরম মাটিতে স্নেহমমতার পরশে বড় হয়েছে, অন্যজন জন্ম হতেই অত্যাধুনিক কলকব্জার ঘড়ঘড় শব্দের মধ্যে জীবনকে জানতে শিখেছে। দু’একদিনের মধ্যেই চাকুরীদাতা আমাকে জানালেন, তোমার রুমমেটটি নিউইয়র্কের বেশ কিছু বিলাসবহুল আকাশছোঁয়া অট্টালিকার আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। মাসান্তে একবার আমেরিকা যাওয়া আসার খরচসহ তার অন্যান্য যাবতীয় খুঁটিনাটি খরচের হিসাবনিকাশ প্রজেক্টের খাতায় লিখে রাখবে। কঠিন এক দায়িত্বের বোঝা যেন মাথায় চেপে বসল।

একই রুমে থাকি দুজন, প্রথমে মেপে মেপে সৌজন্যমূলক কথা বিনিময়। তারপর নীরবে একজন আরেকজনকে বুঝার চেষ্ঠা। রাত দশটার দিকে ডঃ সেনফিল্ড ঘুমিয়ে পড়লে আস্তে আস্তে কিচেনে গিয়ে ভাত বসিয়ে ডিম সিদ্ধ করে চারটি খাওয়ার তোড়জোড়। আমার দৈন্যতা ঢাকতে গিয়েও একদিন ধরা পড়ে গেলাম। একরাতে সবে ডিমের খোসা ছাড়িয়ে কড়াইতে ঢেলেছি পিছন ফিরে দেখি ডঃ সেনফিল্ড দাঁড়িয়ে, বলল, কি পাকাচ্ছ? বললাম না তেমন কিছু নয়, এই একটা ডিম ফ্রাই করছি মাত্র, তেমন খাওয়ার ইচ্ছে নেই, তাই লাইট ব্যবস্থা। পাশে রাখা ট্রাসকেনের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে চোখ তার ছানাবড়া। বলল - এত ডিম তুমি খাও? ইউ উইল বি সিওরলি ইন ট্রাভলস্‌

বললাম শুধু ডিম কেন - ফলমূল, ইয়গহার্ট, সালাদ এটাসেটা দিয়ে চালিয়ে নেই। হোটেলের খাওয়া পছন্দ নয় অগত্যা এ ব্যবস্থা। দৈন্যতা ধরা পড়ে যাওয়াতে সাহসও যেন বেড়ে গেল দ্বিগুণ। বললাম -একা একা খেতে ভাল লাগনো, আজ তুমি আমার সাথে খেতে বসনা যদিও খাদ্য তালিকায় পুওর আইটেম তবুও গল্পগুজব করে একত্রে খাওয়ার মজাটাই আলাদা?

ম্যানি থ্যাংকস, আমি খেয়ে এসেছি, তাছাড়া বুড়ো বয়সে একটু ডায়েট কন্ট্রোল করতে হয়। আমার অনুরোধে কি ছিল জানিনা তবে আমেরিকান এ ব্যক্তিটির কাছে এধরণের আন্তরিক আহ্বান হয়তো তাকে কিছুটা চমকে দিয়েছিল। অনেকের কাছে শুনেছি আমেরিকানরা সপ্তাহের ছুটিতে দু'বন্ধু একসাথে হোটেলে খেয়ে স্ব স্ব বিল পরিশোধ করে। বন্ধুত্ব আছে ভাল কথা কিন্তু টাকা পয়সা বন্ধুর নীচে উড়ানো এটা অন্য বন্ধুর পক্ষে মান হানিকর অথবা এ ধরণের প্রথা তাদের সমাজে চালু নেই। আমার পিঠ চাপড়ে আবারো বলল, আই এপ্রিসেট ইউর হস্‌পিটেলিটি এন্ড আই ডোন্ট লাইক টু হার্ট ইউ, জাষ্ট টু অনার ইউর রিকোয়েষ্ট আই উড লাইক টু হ্যাভ সাম কোল্ড ড্রিংকস্‌, ইফ ইউ হ্যাভ?

ফ্রিজ হতে বের করে একলিটারের একটি পেপসি দিতেই ডঃ সেনফিল্ডের মুখে খই ফুটতে লাগল। প্রজেক্টের ভালমন্দ নিয়ে অনেক কথা। তার চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলার মধ্যে শতকরা ষাট ভাগই বোধগম্য হয়না, বাকী চল্লশিভাগ দিয়ে ষাটভাগ বুঝে নিতে হয়। আমাদের একসেন্ট বা ইংরেজী বলার ধরণ আর আমেরিকান বা ইউরোপিয়দের বলার ধরণ এক নয়। প্রজেক্ট সম্মন্ধে আমিও কিছু জানার চেষ্ঠা করলাম। কিছুক্ষণ পর পর কান বাড়িয়ে বলে, আই ব্যাগ ইউর পার্ডন তাই আমাকে বার বার রিপিট করতে হত কথাগুলো। দু’জনই ইংরেজীতে কথা বলছি অথচ একজন অন্যজনের কথা ভালভাবে বুঝতে পারছনিা। যাক, আস্তে আস্তে একসেন্টের বিস্তর ব্যবধান দু’জনই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি কিছুদিনের মধ্যে।

সপ্তাহে চারদিন সেভ, মাসের শেষে চুল কাটা, লন্ড্রী খরচ, জুতা পরিষ্কার, ফাইভষ্টার হোটেলে খাওয়াদাওয়া, মাসের মাথায় একবার আমেরিকা যাওয়া আসা এবং মাসিক পাঁচ অংকের বেতনের ভারী বোঝায় আমার লেজার বুক দিনে দিনে ভারী হচ্ছে।আশ্চর্য হয়ে ভাবি, লোকটা এত টাকা কি করে? অন্যান্য খরচ বাদে বাংলাদেশী টাকায় মাসিক নগদ পনেরো লক্ষের মত নিচ্ছে। ছয়মাসের কনট্র্যাক্ট পিরিওডের জন্য বাংলাদেশী নব্বই লক্ষ টাকা! ওর বয়স আমার বয়সের দ্বিগুণেরও বেশী তাই একটু সমীহ এবং ব্যবধান বজায় রেখে চলার চেষ্ঠা করতাম। কিন্তু প্রবাসে বোধহয় বয়সের ব্যাপারটা নিয়ে কেউ এতটা মাথা ঘামায়না অথবা তাদের দেশে হয়তো মুরব্বীদের সাথে আমাদের দেশের মত মেপে মেপে কথা বলতে হয়না। তাই বুড়ো লোকটি আমার সাথে তার অতীতের অনেক ঘটনা বলে যেত নির্বিবাদে।

রবীন্দ্রনাথের পোষ্টমাষ্টার গল্পের কথা প্রায়ই মনে হত। যুবক পোষ্টমাষ্টারের গল্পের সাথী গ্রামের নয় বছরের ছোট্ট বালিকা রতন। সেভাবে পয়ষট্টি বছর বয়স্ক ভিনদেশী ইঞ্জিনিয়ার বলছে আটাশ বছরের যুবকের কাছে তার যৌবনের অলিখিত ইতিহাস। বউয়ের সাথে রং তামাশার কথাও বাদ যায়নি। একদিন বউকে চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়ে বলে অফিসের ড্রাইভারকে দিয়ে পোষ্ট করিয়ে নিও। তার আগে একবার দ্যাখোনা ডালিংকে কি লিখেছি? এনভেলাপের মুখটি তখনও খোলা, হয়তো আমাকে দেখানোর জন্য এই আয়োজন। আমি অপ্রস্তুত হলেও তার অনুরোধে প্রথম কয়েকটি লাইনে চোখ বুলালাম......।

জ্যানিফার,

হাউ বিউটিফুল ইউর ব্লু আইজ আর!, কানট্ ফরগেট ইউর লাষ্ট কিস ! ওয়েট পেসেন্টলি, উইল কাম আফটার টু উইকস্‌, কানট্ ইউ---? দু,লাইনের চিঠি কিন্তু এর গভীরতা অনেক।

একটু হেসে বলল, বুড়ো বয়সের প্রেমটাই আলাদা। যৌবনে আমার ছিল বেশ কয়েকজন গার্লফ্রেন্ড, ওর যে ছিলনা তা নয়। আমি আমার বান্ধবীদেরকে সময় দিতাম, ও ওর বন্ধুদেরকে। এতে আমাদের বিবাহিত জীবনটা আরও মধুময় হত।

প্রজেক্টের কাজ দেখতে দেখতে একরকম শেষের পর্যায়ে। ড. সেনফিল্ডয়ের পরিকল্পনামাফিক সুন্দর অবয়বে একটি আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হল। আমার চাকুরীদাতা সৌদি এয়ারলাইনস্-এর প্রাক্তন পাইলট শারিয়া আল-খাতিবের বোনের জামাই ডাক্তার ইরফান বাগাডো হাসপাতালের প্রকৃত মালিক। তখনও কিছু কিছু কাজ বাকী। তবে আর্কিট্যাক্ট ডঃ সেনফিলড্-এর তেমন কোন কাজ নেই। অন্যান্য ইঞ্জিনিয়াররা ওর দেয়া ডিজাইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ কাজটি সমাপ্ত করবে।

ছয়মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর একদিন সেনফিল্ডকে ঘটা করে বিদায় দেয়া হল। স্থানীয় ইন্টারকণ্টিনেন্টেল হোটেলের ওপেন ভূপেতে গ্রান্ড পার্টির মাধ্যমে। সেনফিল্ড বিশেষভাবে আমাকে পার্টিতে যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল শারিয়া আল-খাতিবের সামনেই। শারিয়া বলেছিল হ্যাঁ, সেতো তোমার রুমমেট, অবশ্যই পার্টিতে যাবে।

হোটেলের ওপেন ভূফেতে প্লেটে পছন্দমত খাবার নিয়ে বসতে যাচ্ছি এমন সময় ড.সেনফিল্ড তার খাবার নিয়ে আমার সামনে বসে বলল, তোমাকে এমন বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন? এ্যানি প্রোব্লেম? বললাম, না তেমন কিছু নয়। তুমি চলে যাচ্ছ, এতদিন একসাথে থেকেছি, সুখদুঃখের ভাগীদার ছিলাম, কত গল্প করেছি কিন্তু আজ  হতে আবার একা হয়ে গেলাম, তাই একটু মন খারাপ। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের হাতে তেমন কোন কাজ আপততঃ নেই, হয়তো আমাকে অন্য কোথাও সরে পড়তে হবে।

শান্তনার স্বরে সেনফিল্ড বলল -ওহ, এজন্য তোমার মন খারাপ? এ প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে অনেকের সাথেই আমার পরিচয় ঘটেছে, যদি বল তাহলে তোমাকে কোথাও আত্মীয়করণ করার ব্যাপারে ডা.ইরফানকে বলে দেখতে পারি এবং আশা করি সে আমার কথা ফেলবেনা। নিজের প্রেজটিস বলে কথা, বললাম না, সবেমাত্র হাসপাতালটি খাড়া হল, এখনও বেশ কাজ বাকী। তেমন প্রয়োজন পড়লে আমি শারিয়া আল-খাতিবকে সময়মত বলব।

ড. সেনফিল্ড চলে যাওয়ার পর আমার হাতেও তেমন কাজ নেই। ক্যাশ ও লেজার বুক ক্লোজ করে শারিয়া আল-খাতিবের কাছে জমা দিয়ে বললাম, কাজকর্ম নেই অথচ বেতন নিচ্ছি ঠিকই, তাই খুব খারাপ লাগছে নিজের বিবেকের কাছে। আমি না হয় অন্যদিকে চাকুরী দেখি? শারিয়া আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ অবাক পানে চেয়ে বলল, তুমি আমাকে আশ্চর্য্য করেছ! এখানের কোন কর্মচারী কখনো আমাকে এভাবে বলেনি। তাছাড়া এখন কাজ নেই, আগামীতে আরও কত প্রজেক্ট আসবে, তাতে তুমি শংকিত হচ্ছ কেন? তবে তোমার যদি ভাল না লাগে সে অন্য কথা। আচ্ছা ঠিক আছে, হয়তো তেমন বেতন দিতে পারছিনা, তুমি হয়তো আরও বেশী পেতে আশা করছ, আর কে না চাইবে ভবিষ্যৎ তার উজ্জ্বল হোক। তাই তোমার যখন ইচ্ছে তখন চেষ্ঠা চালিয়ে যাও, আমিও দেখব তোমার জন্য এর চেয়ে ভাল কিছু করতে পারি কিনা। আর ভাল চাকুরী না হওয়া পরযন্ত আমার এখানে থাকতে সংকোচবোধ করবনো। বলাবাহুল্য, আমার বড়ভাই ফুয়াদ আল-খাতিব তোমাদের দেশে বর্তমানে সৌদিআরবের রাষ্ট্রদূত। তাই তোমার প্রতি খেয়াল রাখা আমার নৈতিক কর্তব্য।  

এবার শুরু হল অন্যত্র ভাল চাকুরী খোঁজার জন্য ঘোড়দৌড়। অনেক জায়গায় চাকুরী হয়েও হয়নি বিশেষ করে পাকিস্তানী ও ভারতীয়দের জন্য। বড়ই হিংসুটে ওরা। ওরা আমাকে অবজ্ঞা করেছে, চাকুরী পেতে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানী ও ভারতীয়রা এদেশে আসতে শুরু করেছে বিগত ত্রিশ চল্লিশ বছর ধরে আর বিপরীতে বাঙালীরা সবেমাত্র ঊনিশশো ছিয়াত্তর সাল হতে। বাংলাদেশের জন্ম না হলে বাঙালীরা এদেশে আসতে পারতো কিনা সন্দেহ কারণ অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রায় সব ক’টি এ্যামব্যাসী, কনসুলেট পাকিস্তানের ইসলামাবাদে এবং করাচীতে ছিল যার কারণে বাঙালীরা এদেশে আগমনের সুযোগ খুব কমই পেয়েছে। এদেশে এসে বুঝতে পারলাম প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা কিভাবে বঞ্চিত হয়েছে প্রতিটি স্তরে, সাধে বাঙালীরা অস্ত্র ধরেনি।

সৌদিতে ছ'মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর পবিত্র হজ্জ্ব এসে যাওয়াতে হজ্জে যোগদান করলাম। লক্ষ লক্ষ মানুয়ের মিলনমেলায় মহামিলনের পরম অভিজ্ঞতা নিয়ে স্রষ্টার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে পবিত্র মন নিয়ে মাথা ন্যাড়া করে পবিত্র হজ্জ্ব হতে ফিরেছি। সরকারী বন্ধ শেষে অফিস আদালতে পুনরায় কাজ শুরু হয়েছে। আয়নাতে ন্যাড়া মাথা দেখে নিজেকে চিনতে পারছিলামনা। বিভিন্ন অফিসের দরজায় ধর্নারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশের বাদামী রঙের লোকদের স্বাস্থ্য ও গায়ের রং ফর্সা মধ্যপ্রাচ্যবাসীদের তুলনায় টোকাই সদৃশ্য।

নিজেকে চাকুরীর বাজারে কিভাবে উপস্থাপন করব এ নিয়ে ভাবছিলাম। সোনার হরিণ ধরার নেশায় পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশের উঁচু, নীচু, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের পদভারে সৌদিআরবসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য গমগম করছে। বেঁচে থাকতে হলে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে এবং সে প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে হলে ভাগ্যের সাথে কর্মক্ষমতা ও বুদ্ধি একসাথে কাজে লাগাতে হবে। শুরুতে ডঃ সেনফিল্ডের সাথে থেকে অন্ততঃ এটুকু শিখেছি “সারভাইবাল ফর দি ফিটেষ্ট” কথাটি সত্যিকার অর্থে ক্যারিয়ার গঠনের প্রধান  নিয়ন্ত্রক।

চাকুরীর অন্বেষায় ন্যাড়া মাথায় টুপী লাগিয়ে কয়েকটি জায়গায় গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। তাহলে কি ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে যাব? মেডিকেল ছুটিতে থাকা পুরানো চাকুরীতে যোগ দেব? ব্যক্ত থাকে যে, আমি এদেশে এসেছিলাম তিনমাসের মেডিকেল ছুটি নিয়ে। উদ্দেশ্য, ভাল চাকুরী পেলে এদেশেই থেকে যাব আর না পেলে বাধ্য হয়ে ফিরে যাব। দেশে ভাল পদে সরকারী চাকুরীকে কোনক্রমেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই, তফাৎটা শুধু এখানে সদোপায়ে পেট্রোডলারে বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা অনেকটা বেশী।

একটি দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। মহিলাদের দীর্ঘ চুল শোভা পাচ্ছে শো-কেসে। থমকে দাঁড়ালাম। মাথায় চুল পুরোপুরি গজানোর জন্য চার পাঁচটি মাস বসে থাকার বদলে পরচুলা লাগালে কেমন হয়? নিশ্চয়ই স্মার্ট দেখাবে।দোকানীকে ইংরজেীতে জিজ্ঞেস করলাম মাথার জন্য পুরুষের জন্য কৃত্রিম চূল আছে? আরবী ভাষায় আমার জ্ঞান তখন হাঁটি হাঁটি পা পা। দোকানী আমার কথা হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে আমতা আমতা করছিল।বুঝাতে গিয়ে টুপী খুলে ন্যাড়া মাথা দেখালাম। এবার দোকানী বুঝে একটু হেসে দু'তিনটি বাক্স হাজির করল। তিন রঙের চূল। কালো মখমলের টুপীর উপরে সুন্দরভাবে পরিপাটি করে সাজানো কালো চুলের তোড়াটি মাথায় বসিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখলাম।  আ-হা, ঠিক যেন নায়কোচিত চেহারা! ত্রিশ রিয়াল দোকানীকে দিয়ে বাসে চেপে বসলাম। স্যুটকোট, টাই, সদ্যকেনা মাথায় বাবরি চুলের বহর লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একাকী রাতের নিঝুম প্রহরে আমার প্রতিবিম্বের সাথে চাকুরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলাম। ডঃ সেনফিল্ড নেই, আমি অফিসিয়াল কোয়ার্টারের নিঃসঙ্গ বাসিন্দা।

ইতোমধ্যে কয়েকটি বড় বড় কোম্পানীর নাম ও ঠিকানা জেনে নিয়েছি। ভাল চাকুরী পাওয়ার জন্য আরেকটি জিনিষের বড় প্রয়োজন অনুভব করলাম, তা হল বিভিন্ন ভাষায় তোতাপাখীর বুলির মত ভালমন্দ কিছু কথা শিখা অত্যন্ত জরুরী, অর্থাৎ যার কাছে চাকুরীর জন্য যাব তার মার্তৃভাষাতে প্রথমে দু'চারটি কথা বলে দৃষ্টিআকর্ষণ করে আসল ব্যাপারটি প্রকাশ করতে হবে ইংরেজীতে। এদেশের অফিস আদালতে কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিরা সাধারণতঃ সৌদি, গ্রীক, জার্মান, কানাডীয়, লেবাননী, মিসরীয়, আমেরিকান, ফ্রান্স, ফিলিস্তিনী, ব্রিটিশ, ইতালীয় কিম্বা স্পেনিস নাগরিক। তাদের কাছে পৌঁছাতে হলে সাধারণতঃ পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইন, মিসর, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, লেবানন, কেনিয়া, সুদান কিংবা ফিলিস্তিনী সেক্রেটারীদেরকে অতিক্রম করতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে এড়িয়ে কিভাবে সরাসরি কর্তা ব্যক্তিটির কাছে যেতে পারা যায় তার কিছুটা কৌশলও ইতোমধ্যে রপ্ত করে নিয়েছি। চেহারা দেখে কোন্ দেশের নাগরিক হতে পারে তাও আঁচ করে নিতে পারার মত অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছি। 

সেলফ-হেল্প বলে একটা কথা আছে, প্রথমে যত্ন করে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে গাছ রোপন করতে হয় তবেই না ধরবে আশানুরূপ ফল। আন্তর্জাতিক কমপিটিশনের বাজারে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হলে বাংলাদেশের সরলতা ও কথায় কথায় বিনয়, নম্রতা ভুলে গিয়ে বাচনভঙ্গি, চলনভঙ্গি সবকিছুতে একটা আমুল পরিবর্তন আনতে হবে এটুকু বুঝতে তেমন দেরী হলনা। তাই চাকুরীর ব্যাপারে তেমনি ক্ষেত্র প্রস্তুতের প্রাথমিক পর্যায় হিসাবে বিভিন্ন দেশের কিছু কিছু কথ্য ভাষা শুদ্ধভাবে আমাকে শিখতে হবে। তবে এটা খেয়াল রাখতে হবে ছোট ছোট কথাগুলো যেন কোন কারণে বিকৃত না হয়ে যায়। কারণ মানুষ নিজের মার্তৃভাষা বিকৃতরূপে শুনতে পছন্দ করেনা। কেউ যদি কথ্য ভাষা প্রয়োগ করে সঠিক উচ্চারণে কথা বলতে না পারে তাহলে শ্রোতার মনে হবে বক্তা তার সাথে তামাশা করছে তখন শ্রোতা ব্যক্তিটি ক্ষেপে যাবে কিংবা এড়িয়ে যাবে আর যদি সঠিক উচ্চারণের মাধ্যমে কথা বলতে বক্তা সক্ষম হয় তখন শ্রোতা উপযাচক হয়ে বক্তাকে জানার ব্যাপারে উৎসাহিত হবে এবং বক্তাকে আপন একজন ভাবতে শুরু করবে। এটা ভেবেই পরের দিন চাকুরী খোঁজা শেষে বর্তমান কর্মস্থলের পাশাপাশি মাঝারী আকারের একটি পোষ্ট অফিসের সামনে খাতাকলম নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।প্রিয়জনদের কাছে বিভিন্ন ভাষাভাষি লোকজন চিঠি ছাড়তে আসছে একে একে। এরমধ্যে বেছে বেছে শিক্ষিত লোকদের মনযোগ আর্কষণ করে ইংরেজীতে বলি, দেখুন, আমি একজন লেখক, অবসরে বই এবং পত্রপত্রিকায় লিখি। আপনাদের দেশের ভাষাটা আমার খুব প্রিয়। আমার লিখাতে আপনাদের মার্তৃভাষার কিছু সংলাপ ঢুকাতে চাই, দয়া করে কিছু সময় দেবেন কি? আমি যে কথাগুলো জানতে চাইবো আপনি আপনার ভাষায় বলে ইংরেজীতে অনুবাদ করে আমাকে সঠিকভাবে বলবেন, সে অনুযায়ী আমি লিখে নেব। আশা করি এতে আপনার তেমন আপত্তি নেই এবং এজন্য বেশী কিছু জানতে চেয়ে আপনার মূল্যবান সময়ও নষ্ট করবনা। 

সে সময়টি ছিল ১৯৯০ সাল, প্রিয়জনদের কাছে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চিঠি। এই চিঠি যে কি জিনিষ তা প্রযুক্তির এই যুগে জন্ম নেয়া উত্তরসূরীরা বুঝবে না। স্কুল পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতো, পিতার কাছে পরীক্ষার ফিস চেয়ে একখানা পত্র লিখ। তখন মুসলিম হলে লিখতে হত, “শ্রদ্ধেয় আব্বাজান, হাজার হাজার সালাম পর পাকজনাবে আরজ এই যে, সামনে পরীক্ষা, আগামী পনেরো তারিখের মধ্যে পরীক্ষার ফিস বাবদ দশ টাকা জমা দিতে হইবে, আমি মনযোগ সহকারে পড়াশুনা করিতেছি, তাই চিঠি লিখার সময় বাহির করিতে পারিনা, এইজন্য মনে কষ্ট নিবেননা, আম্মাকে সালাম দিবেন, বোন শাহানাকে আদর দিবেন আর আমার জন্য চিন্তা করিবেননা, আশা করি ভাল পরীক্ষা দিয়ে আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করিতে পারিবইত্যাদি ইত্যাদি। আর হিন্দু হলে ”শ্রী শ্রী চরণেষু পরম শ্রদ্ধেয় বাবা, আশা করি ভগবানের অশেষ কৃপায় মা ও ছোট্ট বোন শিপ্রাকে নিয়া অনেক ভাল আছেন। তারপর নিবেদন করি সামনে পরীক্ষা, পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আগামী পনেরো তারিখের মধ্যেই পরীক্ষার ফিস বাবদ দশ টাকা পরিশোধ করিতে বলিয়াছেন, তাই লিখি একমণ ধান বিক্রি করিয়া হইলেও তাড়াতাড়ি টাকা মানিওর্ডার করিয়া পাঠাইয়া দিতে চেষ্ঠা করিবেন নতুবা পরীক্ষা দিতে পারিবনা..ইত্যাদি ইত্যাদি।

মনে পড়ে আমার প্রথম লিখা চিঠি, আমি তখন দশম শ্রেণীতে পড়ি, সেটা কিশোর মনের প্রেম ছিল কিনা জানিনা, তবে চিরকুটখানা জিলুয়ার কাছে পৌঁছে দেয়াটা ছিল আমার কাছে বড়ই আনন্দের আর বীরত্বের। পাশের বাসার অষ্টম শ্রেণীর পরমা সুন্দরী, গোল্লাছুট খেলার সাথী জিলুয়াকে ছোট্ট একটি চিরকুট লিখে তার বইয়ের ভেতর গোপনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম’তোমার ঐ লাল নাইলনের জামাতে তোমাকে ভারী সুন্দর দেখায়’। চিরকুটটি বইয়ের ভেতর ঢুকিয়ে ঘেমে নেয়ে পালিয়ে এসেছিলাম ওদের বাসা থেকে। কি জানি কি হয়? যদি চিরকুটের কথাটি জিলুয়া প্রকাশ করে দেয় তাহলে কি হতে পারে সে শংকায় দু’টো বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি। এর দু’দিন পর জিলুয়া আমাদের বাসায় আসে, বলে একটি অংক দেখিয়ে দেবে? অংকটি মাথায় ঢুকছেনা। মা বললেন, যা না মেয়েটিকে দেখিয়ে দে। এক ছূঁতোয় জিলুয়া ছোট্ট একটি চিরকুট আমার সার্টের পকেটে আলতোভাবে ঢুকিয়ে দিয়ে লজ্জ্বায় চোখ তুলতে পারছিলনা, অগত্যা পালিয়ে গেল। দুরু দুরু বক্ষে সোজা বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকিয়ে সময় নিয়ে পড়লাম ‘তোমাকেও আমার খুব ভাল লাগে, আর ঐ পাতা কালারের সার্ট আর পাজামাতে তোমাকেও কিন্তু দারুণ লাগে’। কতবার পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই, হৃদয়ের সকল তন্ত্রী জুড়ে আনন্দের ফল্গুধারা আমাকে আকস্মিক অভিভূত করে তুলে। অদ্ভুত এক শিহরণের দোলাচলে সদ্য ফোঁটা প্রেমের নূতন কুঁড়িতে সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল থেকে থেকে, মনে হয়েছিল আমি হিমালয় জয় করে এসেছি, বিশ্বভ্রম্রান্ড জয়ের সে কি পরিতৃপ্তি তা কেবল আমার বয়সের একজনই অনুমান করতে পারবে।

জিলুয়ার সাথে সেদিন হতে এক বিস্তর ব্যবধান তৈরী হল। দুর থেকে দেখা হয় কিন্তু এক অজানা পাপে দু’জনের মধ্যে যোজন যোজন দুরত্ব সৃষ্টি হল। সেই জিলুয়া পিতার নূতন কর্মস্থলে একদিন চলে গেল, এখন কোথায় জানিনা, হয়তো সংসারের আবর্তে পাঁক খাচ্ছে। সে সময়কাল আমাদের জীবন থেকে কবে হারিয়ে গেছে যে সময় ছিল সম্ভ্রমের, মর্যাদার, বিনয়ের আর নম্রতার।

প্রবাস হেত দেশে স্থায়ী হওয়ার পর পাড়ার ভার্সিটিতে পড়ুয়া ফুয়াদ আমাকে রাস্তায় দেখে সালাম জানিয়ে বলেছিল,আংকেল দোয়া করবেন,আজ হতে আমার তৃতীয় সেমিস্টার শুরু, তাই পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।পাশে পার্ক করা মোটর বাইকে উঠে সাথের মেয়েটিকে বলল, নাসরিন, উঠে পড়, সময় কম, আগেভাগেই পৌঁছতে হবে। জানতে চাইলাম, মেয়েটি কে? বলল, আমার গার্লফ্রেন্ড, সহপাঠি। মেয়েটি আমাকে সালাম দিয়ে ফুয়াদের পিছনে বাইকে উঠে নিরাপত্তার জন্য দু’হাতে ফুয়াদের পেট জড়িয়ে ধরতেই একরাশ কালো ধোঁয়া ঠিক আমার মুখ বরাবর নির্গত করে বাইকটি ছুটে চলল। নাসরিনের উন্নত বক্ষযুগল ফুয়াদের পিঠ জুড়ে লেপটে আছে। এতে ফুয়াদের অনুভূতি কি ছিল তা জানতে না পারলেও এ বয়সে ওদের নির্লজ্জ্ব সুড়সুড়ি জাগানো প্রগতির নীরব সাক্ষী হয়ে রইলাম। ফুয়াদ যেভাবে পাশের মেয়েটিকে গার্লফ্রেন্ড বলে অবাধে পরিচয় দিল  ঠিক তেমনি আজকাল পিতামাতার কাছে মেয়েকে বলতে শুনেছি অমুক আমার বয়ফ্রেন্ড। ভাবি আমাদের সেই ভদ্র ঊনিশ শতক কবে যেন বাসী হয়ে গেছে। মুরব্বীদের সামনে এ ধরণের পরিচয় দেয়া কিংবা অবাধে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড বলা যে শিষ্টাচার বহির্ভূত কতবড় জঘন্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হত তা কেবল প্রবীণ ব্যক্তিরাই স্মরণ করতে পারবে। আর এ কারণে প্রগতির এই যুগে দেশে দেশে নারী নির্যাতন. ধর্ষণ একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বেপরোয়া যুবক-যুবতীর সৎ-সতী কথাটির নিশ্চয়তা দেওয়ার মত তেমন লোক হয়তো আজকাল খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

বাংলাদেশে তথা পাক-ভারত উমহাদেশে ঊনিশ শতকের সমাজব্যবস্থা আর বিশ শতকের সমাজব্যবস্থায় বিরাট ব্যবধান লক্ষনীয়। ঊনিশ শতকে সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকা বিকৃত যৌনতাকে তৎকালীন সমাজবিজ্ঞানীদের প্ররোচনায় সরকার প্রশ্রয় দেয় কিন্তু উপমহাদেশের সমাজবিজ্ঞানীরা এ ব্যবস্থাকে অশ্লীল বলে মনে করত। ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ ডাক্তার ডাঃ চেসার ছয়হাজার রমনীর নিকট হতে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে ‘সতীত্ব কি অতীতের স্মৃতি’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন বিয়ের পূর্বে ব্রিটেনে তিনজন নারীর মধ্যে একজন বিয়ের পূর্বেই সতীত্ব হারায়। অবাধ যৌনতার স্বীকৃতি পেয়ে যুবক যুবতীদের মধ্যে ব্যভিচার প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সমগ্র ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বিয়ের পূর্বে সতীত্ব এবং কুমারত্ব হারানোর গড় শতকরা পচান্নব্বই-এ পৌঁছেছে এবং ক্রমেই তা শতকের কোঠায় উন্নীত হবে এটা একরকম নিশ্চিত।         

যাক্‌ - পোষ্ট অফিসে আসা বিভিন্ন ভাষাভাষি লোকজনের কাছে জানতে চেয়েছি মাত্রাতিরিক্ত বিনয় মিশিয়ে। ওরা সগৌরবে নিজের মার্তৃভাষাকে প্রকাশ করেছে। প্রায় দু’সপ্তাহ এ অভিযান চালিয়েছি একই কায়দায়। নোটবুকে জমা পড়েছে অনেক ভাষার অক্ষরমালা।যদি ভালভাবে এ কথাগুলো রপ্ত করতে পারি তাহলে সময় সময় প্রয়োগ করা যাবে এটা ভেবে সন্ধ্যার পর রীতমিত ক্লাসওয়ার্ক করেছি।

আমার বাসস্থানের পাশে বড়সড় এক লাইব্রেরীতে খাতা কলম কিনতে গিয়ে লক্ষ করলাম বুক সেলফে পাঠকদের প্রয়োজনে জার্মান, সুইডিস, ইতালী, ফ্রেন্স, আরবী, উর্দু, জাপানী, কেরেলিয়, আমহারী, ফিলিপিনো, গ্রীক এবং অন্যান্য ভাষার উপর সাজানো কথোপকথনের বেশ কিছু বই শোভা পাচ্ছে। ইংরেজীতে তর্জমাকৃত প্রয়োজনীয় বইগুলো কিনে নিলাম একান্ত আগ্রহে। পরের দিন হতে পোষ্টঅফিসের বারান্দা ছেড়ে দিয়ে কঠিন অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ভাষায় কথোপকথনের প্রয়োজনীয় বাক্যগুলো শিখে নিলাম যা আমার চাকুরীর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে।

আমার ভাষা শিখার প্রথম প্রয়োগ ঘটালাম এখানের এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী খুঁজতে গিয়ে। রিসিপশন কাউন্টারে গিয়ে চেয়ারে উপবিষ্ট লোকটিকে বললাম,হাউ আর ইউ? ইফ আই এম নট রং, আই থিংক ইউ আর এন ইথিওপিয়ান? উত্তর এল, ইয়েস, ইউ আর কারেক্ট,আই এম আব্দুল্লাহ ফ্রম আদ্দিসআবাবা। 

ইংরেজীতে আলাপের মধ্য দিয়ে অনেকটা অন্তরঙ্গ হলাম। একটু মুচকি হেসে ইথিওপিয়ান আমহারী ভাষায় বললাম – আব্দুল্লাহ, ইন্‌ডামিন ডিনাহ? আহুন আনতা সিমাগিল্লাহ নেহ, মাছা কাছিরা টিকোমাল্লেহ্‌ মাছা টিমাল্লাসালেহ্‌? (আব্দুল্লাহ তুমি কেমন আছ ? বয়স তোমার কম কিন্তু এদেশের একাকীত্বে মনে হয় দিনগুলো খুব ভাল যাচ্ছেনা, আর কতদিন এদেশে চাকুরী করবে বলে মনস্থ করেছ?)

আব্দুল্লাহ হেসে বলে – এক্‌জাবের ইয়াউকাল্‌ (আল্লাহ জানেন)

মার্তৃভাষা ভিনদেশীর মুখে শুনতে কার না ভাল লাগে? আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা আমহারী ভাষার কিছুটা সংলাপ আব্দুল্লাহকে কিছুটা আনন্দিত হওয়ার উপকরণ যোগালো।আব্দুল্লাহ অতি আপনজনের মত এ কোম্পানীর নাড়ীনক্ষত্র, বিভিন্ন শাখা প্রদানের পরিচয়, কে ভাল, কে উগ্র, কে পরোপকারী এ ধরণের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সেদিন আমার যে উপকার সাধন করেছিল তা আজ  প্রায় দু’যুগ পরও ভুলতে পারিনি।

ইথিওপিয়ানরা সহজ সরল এবং বন্ধুভাবাপন্ন। তাদের মার্জিত ব্যবহার প্রশংসার দাবীদার। একসময় ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া একই দেশ ছিল। ১৯৩০ সাল থেকে সম্রাট হাইলি সেলাসি কর্তৃক ইথিওপিয়া দেশটি শাসিত হয়ে আসছিল। সম্রাট হাইলি সেলাসীর বিরুদ্ধে সেনাপ্রধান দার্গ এর সামরিক অদ্ভুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং প্রায় বত্রিশ বছর এ গৃহযুদ্ধ অব্যাহত থাকে এবং ফলশ্রুতিতে ১৯৯১ সালে সম্রাট হাইলি সেলাসির পতন ঘটে এবং ইথিওপিয়া দু’টো অংশে ভাগ হয়ে যায়। তার অন্যটি হল ইরিত্রিয়া।

আব্দুল্লাহর কাছ থেকে এ বিরাট আন্তর্জাতিক কোম্পানীটির বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে আমার ন্যাড়া মাথায় কৃত্রিম চুল,সদ্য কেনা নেভী ব্লু রঙের মখমলের ফ্রেন্স স্যুট পরিধান করে যখন উক্ত কোম্পানীর এপ্লায়েনশেস ডিভিশনের গ্রীক জেনারেল ম্যানেজার আকিলো ট্রাগেলিসের সাথে সরাসরি দেখা করে দু'চারলাইন গ্রীক ভাষায় সৌজন্য বিনিময় করে নিজের চাকুরীর প্রয়োজন জানিয়েছিলাম তখন সাথে সাথে ভদ্রলোক না বলতে পারেনি। ভাগ্য আমার হয়তো সুপ্রসন্ন ছিল। তারই ডিপার্টমেন্টের জার্মান এক ভদ্রলোক মিঃ ষ্টিফেন ব্লো, যে কোম্পানীর এই শাখার আন্তর্জাতিক আমদানী-রপ্তানী শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল সে অন্যত্র ভাল চাকুরীতে চলে যাওয়ার কথা জানালে তারই জায়গায় পাঁচদিনব্যাপী ব্যাপক চূলছেড়া ইন্টারভিউ শেষে এবং দেশে আমার কাষ্টমস্‌ বিভাগে আমদানী-রপ্তানীর উপর অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দেখে  আমাকে ওর স্থলাভিষিক্ত করা হল। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গরীব দেশের নাগরিক বিধায় বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে ষ্টিফেন ব্লো এবং আমার মধ্যে ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও আমার উপযুক্ত কাজ পেয়ে আল্লাহর কাছে অশেষ শোকরিয়া জানালাম।

উপরোক্ত জার্মান ভদ্রলোকের সাথে প্রথম কিছুদিন কাজ করে কাজকর্ম বুঝে নেয়ার নির্দেশ পেলাম। প্রথমদিন ওর সাথে বসে আলাপ জুড়ে দিলাম আমার অল্প শেখা জার্মান ভাষা দিয়েঃ Hallo, wiegeht es dir? (হ্যালো,কেমন আছেন?)

একবার আমার দিকে একটু আশ্চর্য্য ভঙ্গিতে চেয়ে ভদ্রলোক উত্তরে বললেন Danke, gut und Dir? (ভালো,আপনি কেমন?)

Gut, ich ho’r Du willst diese Firma Verlassen? Gibtes Probleme? (ভালো, জানতে পারলাম আপনি এ কোম্পানী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন? কোন সমস্যা আছে নাকি?)

Nicht wirklich, Es ist nicht schlecht hier Du arbeikn aber ich mochte nicht ewig ouf dem gleichen stuhl situen. (সমস্যা ঠিক নয়, এখানে কাজে খুব আরাম কিন্তু আমি দীর্ঘদিন একজায়গায় বসে থাকার লোক নই তাই ছেড়ে যাচ্ছি)

Vertehe! Du bist ein komischer ker (আশ্চর্য্য,আপনিতো দেখছি একজন মজার মানুষ !)

Du weisst unser lebensdawer ist doch techt kuiz und wir Sollten dos Beste daraus machen? (দেখুন, আমাদের জীবনের পরিধি অত্যন্ত স্বল্প সুতরাং এই স্বল্প সময়ের ভেতর জীবনটাকে ভোগ করে যাওয়াটা কি অযৌক্তিক?)

পরদিন হতে ভদ্রলোকের সহযোগিতায় কোম্পানীর কাজে আমি যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করি। সেই হতে বাইশটি বছর একই কোম্পানীতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কোম্পানীর কাজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকের সাথে পরিচয় ঘটেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খাবার খেয়েছি। হাজারো মানুয়ের মেলায়, বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্টের মারপ্যাচে নিজেকে বাজিয়ে নিয়েছি। আমার চাকুরীজীবনের প্রথম তিনচারটি মাস পরচুলা লাগিয়েই কাজ করেছি। মাথায় চুল পুরোপুরি গজানোর পর একদিন অফিসে এলে বস্ শুধায়, তোমার এত সুন্দর চুল গেল কোথায়? বললাম,সে চুল আমার ছিলনা বলে রেখে এসেছি। ব্যাপারটি খুলে বলার পর গ্রীক জেঃ ম্যানেজার হেসে বলেছিল,সত্যি যদি তুমি ন্যাড়া মাথায় চাকুরীর জন্য আসতে তাহলে অবশ্যই তোমার চাকুরী হতনা, ইউ আর রিয়ালি ইনটেলিজেন্ট!

নিউজিল্যান্ডের “ফিসার এন্ড প্যাকেল” কোম্পানীর চুয়াল্লিশ বছর বয়স্ক চেয়ারম্যান জন বার্ণ একদিন আমাকে বলেছিল, জীবন মানেই অভিজ্ঞতা। তাই এই ক্ষুদ্র জীবনের সামনে যা আসবে তাকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে পথ চলতে হবে। সদা হাস্যময় এই ভদ্রলোক বছরে দু'বার ব্যবসা উপলক্ষে আমার কাছে আসত । আমাদের কোম্পানীর সাথে তাদের জমজমাট ব্যবসা। বাংলাদেশের কথা উঠলেই বলত, ওখানের সব মানুষ কি তোমার মত? জানিনা কেন আমাকে তার এত পছন্দ?

সেদিনের সেই কথাগুলো বলে সে দেশে ফিরে যাওয়ার প্রায় দু'মাস পর আকস্মিক এক ফ্যাক্স আসল ডিপার্টমেন্টে, জন বার্ণ ঘাড়ের ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করেছে। আমার কাছে বসলেই জন বার্ণ ঘাড়ে টিপতে থাকতো। তখন বুঝতে পারিনি তার হাত কেন বেশীরভাগ সময় ঘাড়ের উপর থাকতো। কোম্পানীর কাজে জন বার্ণসহ নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন কোম্পানীর কর্মকর্তাদের সাথে পরিচয় ছিল আমার। নিউজিল্যান্ডের মানুষগুলোর ভদ্রতা আমাকে মুগ্ধ করত।

আমি যার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলাম, শুনেছি হেরোইন আসক্ত জার্মানীর সেই ষ্টিফেন ব্লো ড্রাগ মামলায় পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। তার ভাগ্যে পরে কি ঘটেছিল তা জানতে পারিনি। হিটলারের দেশ জার্মানীর অনেকের সাথেই আমার পরিচয়। ওরা আলাপ পরিচয়ে ভদ্র হলেও বেশ অহংকারী। তারা মনে করে এ পৃথিবীতে তারাই শ্রেষ্ট জাতি যেমনটি ইহুদিরা ভাবে। এটার কারণ হল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে জার্মান ইহুদিরা ছিল প্রবল পরাক্রম। ইহুদিদের আত্মঅহংকার জার্মান জাতির রক্তে মিশে যাওয়াতে এটা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্টে রূপলাভ করেছে। 

আমেরিকানরা একগুয়ে। তারা যা ভাল মনে করে তা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনা। কোম্পানীর ব্যবসায়িক স্বার্থে আমার কাছে অনেকেরই আসাযাওয়া। যেহেতু আমি কোম্পানীর পলিসি মোতাবেক আন্তর্জাতিক অর্ডার প্লেস করি, আমদানী-রপ্তানীর কাজকর্ম তদারকি করি সে কারণে অন্ততঃ পঁচিশটি আন্তর্জাতিক কোম্পানীর প্রতিনিধিরা বৎসরে বিভিন্ন সময় আমাদের কাছে আসতো। তাদের একগুয়েমী এবং জোরে চাপানোর প্রবণতা আমাকে অনেকসময় বিব্রত করতো। চুক্তি করে চুক্তিভঙ্গ করা তাদের একধরণের স্বভাব।আমেরিকান প্রশাসনের দিকে তাকালে এর সত্যতা নিরূপণ করা যাবে। বিশ্বে অশান্তি তারাই ডেকে আনে। তাদের কারণেই পুথিবীতে যত সংঘাত। তারা এক দিয়ে তিন আদায় করে।বিভিন্ন দেশের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে তারা চুক্তি করে কিন্তু চুক্তি বহির্ভূত কাজে তারা অত্যন্ত দক্ষ। যা দেয় তার তিনগুণ বিভিন্ন কলাকৌশলে হাতিয়ে নেয়। বিশ্ব রাজনীতিতে বিভিন্ন দেশের সাথে করা চুক্তি কিভাবে তারা লঙ্গন করে তার যথেষ্ট প্রমাণ বিশ্ববাসী জানে।

বিভিন্ন দেশের উন্নয়নমূলক প্রজেক্টে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কিন্তু মেনটেনেন্স ও প্রযুক্তি সাহায্যের নামে তারা বহুগুণ আদায় করে নেয়। তাদের পণ্যের গুণগত মান ভাল কিন্তু প্রযুক্তি অত্যন্ত প্যাঁচালো বিধায় তাদেরকেই আবার ডাকতে হয়।তারা শান্তিচুক্তি করে অথচ তাদের প্রয়োজনে নিদ্বিধায় তা ভঙ্গ করে। তাদের এ মনমানসিকতা আমি প্রত্যক্ষ করেছি জো পাইলট, বব, আলফ্রেড, পিটার, মরিসন, উইলসন এবং আরও অনেকের মাঝে। বাঁধ সেধেছি অনেকক্ষেত্রে এবং যুক্তি ও চুক্তির শর্ত দেখিয়ে কোম্পানীর টাকা বিভিন্ন সময় আদায়ও করেছি। অনেক লোকের ভীড়ে একটি মানুষের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। নিকোলাস মেট্রস, বিখ্যাত আমেরিকান সেলডন কোম্পানীর মালিক। আমাকে কথাচ্ছলে বলেছিল - দ্যাখো, মানুষ ইচ্ছে করলইে তার জীবনের পরিধি বাড়াতে পারে। জানতে চাইলাম কেমন করে? ধূমপান এবং অপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ছেড়ে দাও, নিরামিষ খাও, তাহলেই জীবনের পরিধি বেড়ে যাবে - and I maintain it, because I don’t like to die before my death. I wish to enjoy longer life.

আমার সাথে কথা বলে যাওয়ার মাসখানেক পর নিকোলাস মেট্রসের ছেলে পিল্‌ মেট্রসের কাছ থেকে ফোন আসে নিকোলাস আকস্মিক হৃদরোগে মারা গেছে। কোন্পানীর সাথে চুক্তি মোতাবেক তার ছেলে কাজ চালিয়ে যাবে। মনে মনে ভাবলাম এ পৃথিবীর প্রত্যকেই এক একজন নিকোলাস–”যেতে নাহি চায় মন ফেলে হেলা খেলা,সাঙ্গ হবে খেলা তব ফুরাবে গানেরও মেলা”।

ব্রিটিশ চরিত্রে তাদের পূর্বপুরুষদের রক্তের ধারা বিদ্যমান। ”ডিভাইড এন্ড রোল”- চাকুরীক্ষেত্রেও তারা এ নীতিতে বিশ্বাসী। টিকে থাকার জন্য একই অফিসে ষ্টাফদের মধ্যে তারা বিভেদের জন্ম দেয়। অধীনস্থ ষ্টাফরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয় এবং সিনিওর ব্রিটিশ কর্মকর্তা দু’পক্ষের নিয়ন্ত্রক হয়ে উভয় পার্টির কাছ হতে সম্মানজনক অবস্থান বজায় রেখে চাকুরীজীবন অতিবাহিত করে। স্বদেশী আন্দোলনের চাপ সহ্য করতে না পেরে পাক-ভারত উপমহাদেশ হতে ব্রিটিশ যখন বিদায় নেয় তখন ঠিক এ নীতিতে দু-দেশের মধ্যে এমনভাবে সীমান্ত পিলার স্থাপন করে যায় তা আজ সত্তর বছর পরও সীমান্তের অনেক জায়গাই অমীমাংসিত থেকে যায়, সাথে সাথে তারা সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পও ছড়িয়ে যায় যার রেশ এ উপমহাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে সম্ভবতঃ চিরকাল বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে হিংসাত্বক পরিবেশ বজায় রাখবে। উইলিয়ম, হ্যারিসন, জন পোর্টার, মার্গারেট, নীল এমনি অনেকের সাথে কোম্পানীর ব্যবসার স্বার্থে দহরম মহরম রাখতে হয়েছে। তাদের মধ্যে চিরাচরিত এ নীতি লক্ষ করেছি। প্রবাসের দীর্ঘ চাকুরী জীবনে ওদের অনেকে আমার বাসায় এসেছে, খেয়েছে, আড্ডা দিয়েছে। বন্ধুবান্ধবের নীচে পয়সা খরচ করার প্রবণতা তাদের মধ্যে খুব কম। ভবিষ্যতের জন্য তারা মরিয়া হয়ে টাকা জমায় তবে জমানো অর্থের অবশিষ্টাংশ মৃত্যুকালে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে দান করে যায়। যেহেতু তারা একান্নবর্তী থিওরীতে বিশ্বাসী নয়। ছেলেমেয়ে, মা, বাবা প্রত্যেকেই স্বনির্ভর সুতরাং নিজের পরিশ্রমের অর্থ নিজে ভোগ করার রীতি তাদের সমাজে প্রচলিত। এ রীতি তাদেরকে জীবনব্যাপী আনন্দমুখর রাখে। শুধু তাদের মধ্যেই এ রীতি প্রচলিত নয়, ইউরোপ ও আমেরিকার সর্বত্রই এ  রীতিতে বিশ্বাসী।

আমার মনে হয়, এ রীতিতে বিশ্বাসী বলে স্বল্প সময়ের ভেতর পারিবারিক অভাব অভিযোগ কাটিয়ে উঠতে তারা সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছে অথচ আমাদের দেশে উপার্জনশীল সদস্যের সংখ্যা কম বিধায় সংসারের অন্যান্যরা উপার্জনকারীর উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। কষ্টসহিষ্ণ লোকটি সংসারের উন্নতিকল্পে খেটে মরে এবং পরিবারের নিষ্ক্রীয় সদস্যরা তার কষ্টার্জিত অর্থ নির্দ্বিধায় ভোগ করে। আমাদের পারিবারিক রীতিনীতি এ কারণে সংসারের বেশীরভাগ সদস্যকে পঙ্গু বানিয়ে রাখে। এরূপ সমাজ ব্যবস্থার কারণে আমাদের সামগ্রিক উন্নতি ব্যহত হয়। আমাদের দেশের শতকরা আশিজন পিতামাতার মজ্জাগত প্রত্যাশা এই যে, ছেলেমেয়েদেরকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে পারলে বড় হয়ে উপার্জন করে বৃদ্ধ বয়সে সন্তানরা তাদের ভরনপোষণের দায়িত্ব নেবে। ব্রিটিশ জাতি তাদের চতুর বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে একসময়  অর্ধেক পৃথিবী শাসন করতে পেরেছে। শাসনের ব্যাপারে তারা সর্বত্রই ”ডিভাইড এবং রোল” থিয়রী প্রয়োগ করে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ শাসন করেছে।   

গ্রীকরা এককালে ওলন্দাজ নামে পরিচিত ছিল। সমুদ্রে লুণ্ঠন, পথিকদের পাথেয় হরণ করে এধরণের জঘন্য কাজের মাধ্যমে ইতিহাসে তারা একসময় কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছিল। আজও  তাদের কথায় এবং কাজে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সমুদ্রপথে তারা পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসার যোগসূত্র স্থাপন করে। এ কারণে আজ বিশ্বের বেশীরভাগ শিপিং কোম্পানীর মালিকানা পর্তুগীজদের দখলে। 

সুইটজারল্যান্ড, ইতালী, সুইডেন, বেলজিয়াম, গ্রীস, স্পেন এবং স্ক্যনডিনাবিয়ান দেশগুলোর লোকেরা আইনের প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল। এই সমস্ত দেশের লোকেরা আমেরিকান, ফ্রান্স এবং ব্রিটিশদের মত একগুয়ে কিংবা যুদাংদেহী মনোভাবাসম্পন্ন নয়। যদিও ইতালীয়রা ব্যবসাক্ষত্রে ক্ষেত্রবিশেষে ফাঁকিঝুকির আশ্রয় নিতে দেখা যায় এজন্য ইতালীকে ইউরোপের তাইওয়ান বলা হয়। তাছাড়া ইতালীর কোন কোন অঞ্চল মাফিয়াদের দখলে। মাফিয়া ড্রাগস পাচারকারী একটি ক্রিমিনাল সংস্থা। ১৯৬০ দশক হতে শুরু করে ইতালীর বিভিন্ন অংশে এ সংস্থা বিভিন্ন কূকর্ম করে আসছে। ইতালীর মাফিয়ারা স্বদেশে এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে আসছে তা কারোর অজানা নয়।

ইউরোপীয়রা ইহকালীন জীবনকে প্রাধান্য দেয়। দুনিয়ার সব আনন্দ লুটপেুটে নাও, ডানে বামে যেভাবে পার, এ ভাবখানাই তাদের পার্থিব জীবনের একমাত্র চিন্তাধারা। ফ্রান্সের মসিয়ে প্যারী তাদের বিখ্যাত আইবিএম কোম্পানীর ব্যবসা উপলক্ষে বছরে দু'তিনবার আমাদের কোম্পানীতে আসত  কারণ সৌদিআরবে আমরাই তাদের একমাত্র ডিস্ট্রিবিউটার। পয়ষট্টি বছরের এ লোকটির মুখ কথা বলতে সারাক্ষণই কাঁপত। এটা এক ধরণের রোগ। সে অনেক ভাষায় পন্ডিত। যে কোন দেশের ভাষা শিখতে তার আগ্রহের সীমা নেই। আমাকে বলত -তুমি আমাকে বাংলা শিখাবে আর আমি তোমাকে ফ্রেন্স,কেমন? কাজ শেষ হলে ফিরে যাবার সময় কিছু প্রয়োজনীয় বাংলা কথাবার্তা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে লিখে নিত এবং আমাকে ফ্রেন্স ভাষায় প্রয়োজনীয় কিছু কথাবার্তা লিখে দিত।বলত -পুনরায় যখন আসব তখন কিন্তু তোমাকে এ কথাগুলো জিজ্ঞেস করতে ভুলবনা। ছ‘মাস পর শেষবারের মত এসে বলল –কেইমন আছ ,কাজ কেইমন টলছে? (কেমন আছ, কাজকর্ম কেমন চলছে?) ষ্টকের বাংলা শেষ হলে ফ্রেন্স ভাষায় বলল - Donne Moi Ton Briquet. (আমাকে সিগারেট লাইটারটা দাও)। হেসে হেসে পুনরায় বলল - Ne Travaille Pa‘ Trop, Sinon Tu Mourras Tot (বুঝলে,এত কাজর্কম ভাল নয়,ফল হবে নির্ঘাত মৃত্যু)।

হেসে বললাম - Mourir ou vivre, Tout est entre les mains de dieu. (বাঁচামরা সবকিছু বিধাতার হাতে,বুঝলে ?)

পরে একদিন ওদের কোম্পানী হতে চিঠি পেলাম প্যারীর দুটো সন্তান ও স্ত্রী ছুটি কাটাতে গিয়ে আকস্মিক গাড়ীর ব্রেক ফেল করে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে নিচে গড়িয়ে পড়ে স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে মৃত্যুবরণ করেছে, সে কারণে প্যারী বাকরুদ্ধ এবং স্মৃতিশক্তি একেবারে হারিয়ে ফেলেছে। কোম্পানী তাকে অবসর দিয়েছে। খবরটি শুনে পুনরায় স্বাগতোক্তি করলাম - Mourir ou vivre, Tout est entre les mains de dieu. (বাঁচামরা সব স্রষ্টার হাতে)।

আফ্রিকার সেনিগাল, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, কঙ্গো, চাদ, ইথিওপিয়া, মিশর, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, সোমালিয়া, মরক্কো এবং সুদানসহ আর কিছু কিছু দেশের মানুষের সাথে আমার সুদীর্ঘ বাইশ বছরের প্রবাসী জীবনে পরিচয় ঘটেছে। তাদের কাউকে নিকটস্থ প্রতিবেশী কিংবা সহকর্মী হিসাবে তাদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি অতি কাছে থেকে। আফ্রিকানরা বিশেষ করে সেনিগাল, বুকিনিফ্যাসো, কেনিয়া, উগান্ডা, নাইজেরিয়া ও কঙ্গোর অধিবাসীরা পশুর চামড়ার তৈরী জিনিষপত্র খুব পছন্দ করে। পোষাক পরিচ্ছদে গাছপালা, লতাপাতা ও পশুপক্ষীর ছবি না থাকলেই যেন নয়।

আফ্রিকা একটি বিরাট মহাদেশ। অধিকাংশ দেশের অধিবাসীরা গরীব, যদিও এ মহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্ভার। এ মহাদেশের অধিকাংশ দেশই ফ্রান্স, ব্রিটিশ, স্পেনিশ ও ইতালীর কলোনী ছিল। জঙ্গলাকীর্ণ এ দেশগুলোকে শাসন এবং শোষণের মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদেরকে ওরা আলোর পথ দেখায়নি। নানারকম ড্রাগ যেমন হেরোইন, কোকেন, মারিজুয়েনা উৎপাদনকারী এ দেশগুলোর অধিবাসীদের অনেকেই চোরাই পথে ড্রাগস পাচার করে থাকে। বিশেষ করে নাইজেরিয়া ও সেনিগালের শত শত লোকদের মধ্যে ড্রাগস্-এর প্রতি আসক্তি দেখেছি। পরচিত হয়েছি বিভিন্ন সময়ে ওদের সহজ সরল জীবনধারার সাথে। সেনিগালের এক ডিপ্লোমেটের বাসায় দেশ হতে আসা পোড়া এক অজানা গুইসাপ কিংবা কুমীরের বাচ্চা সদৃশ সরীসৃপের ডিসের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে যদিও আন্তরিক এ আপ্যায়নে কৌশলে আমাকে খাওয়ার ছলে শুধু হাত নাড়াচাড়া করতে হয়েছিল। সেনিগাল বাংলাদেশ হতে পাটজাত দ্রব্য এবং কাঁচা পাট আমদানী করতে চাইলে বাংলাদেশ জুট মার্কেটিং কর্পোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব মনিরউদ্দিন আহমদ সময় স্বল্পতার জন্য আমাকে সব বুঝিয়ে ওর সাথে ফলোআপের দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং তিনি সুদান সরকারের সাথে পাট রপ্তানী সংক্রান্ত ব্যাপারে পূর্ব নির্ধারিত আলাপ আলোচনার জন্য ঐদিনই সুদান গমন করেন। এ কারণে সেনিগালের ডিপ্লোমেট আমাকে আলাপ আলোচনার জন্য তার বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। চেয়ারম্যান সাহেব আমার আত্মীয় হওয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রটোকল মেইনটেন না করে আমার বাসায় উঠেছিলেন।

আফ্রিকার অধিবাসীদের মধ্যে বিশেষ করে অভিযুক্ত নাইজেরীয় ড্রাগস্‌ পাচারকারী প্রায় দুইশতের উপরে সৌদি আরবে ড্রাগস পাচার এবং চুরি ডাকাতির অভিযোগে দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে মুক্ত আঙ্গিনায় তরবারীর নীচে শির দিতে হয়েছিল। আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মধ্যে তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া এবং মিশরের লোকদের গায়ের রং খুব সুন্দর। মিসরীয়রা ঢং তামাশায় অত্যন্ত পারদর্শী। হাসিখুশীর মধ্যে ওরা দিন কাটাতে পছন্দ করে তবে নিজেদের স্বার্থের ক্ষেত্রে কোনরূপ ছাড় দিতে রাজী নয়। 

মিশরের অধিকাংশ নরনারী পাশ্চাত্য সভ্যতাকে পছন্দ করে বিধায় বিকৃত রুচিবোধ তাদের নীতিনৈতিকতাকে দিনে দিনে অধঃপতনের পথে ধাবিত করছে।মিশরীয়দের মধ্যে শিক্ষিতের হার সম্ভবতঃ পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের এবং আফ্রিকান মুসলিম দেশগুলোর চেয়ে বেশী। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে সুদানের লোকজন উত্তম চরিত্রের অধিকারী।ওরা পরোপকারী ও বিনয়ী। শিক্ষিত লোকরা মার্জিত, ভদ্র ও কাজকর্মে দক্ষ। সুদানী লোকদের পরোপকার এবং সহমর্মিতাবোধ আমাকে বিভিন্ন সময় মুগ্ধ করেছে।

ইতালীয়রা ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও ইরিত্রিয়াকে দীর্ঘদিন কলোনী বানিয়ে রাখে। শোষণ আর নিষ্পেষণের কারণে স্থানীয় অধিবাসীরা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। অভাবের রাহুগ্রাসে তারা জর্জরিত। শত শত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে প্রতিদিন অনাহারে। এসমস্ত দেশের অধিবাসীরা বহুবৎসর যাবত গোত্র কলহে লিপ্ত। চাদ আফ্রিকার সবচেয়ে গরীব দেশ। ফ্রান্স এদেশকে দীর্ঘকাল শাসন করেছে। ফলে তাদের স্বকীয়তার বিকাশ তেমন ঘটেনি। সহজ সরল বেশীরভাগ কালো মানুষগুলো অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে বেঁচে আছে। আধূনিক শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগবঞ্চিত এদেশের বেশীরভাগ মানুষগুলোকে আত্মকলহে লিপ্ত রেখে ফ্রান্স শাসন করেছে যুগের পর যুগ।

আফ্রিকা মহাদেশের কালো বাসিন্দাদের প্রায় সব ক'টি সমাজের শিশুরা মায়ের পিঠে কাপড়ের ঝোলার মধ্যে বড় হয়। কোলের বাচ্চাকে বাঁদরের মত পিছনে ঝোলাবন্দী রেখে মায়েরা দৈনন্দিন কাজকর্ম সারে। রোদ, গরম, ধূলোবালি ও ঝোলার মধ্যে বড় হওয়া শিশুরা প্রকৃত শিক্ষার অভাবে ছোটবেলা থেকেই পরনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠে। আফ্রিকার দেশগুলোতে যেখানে বিধাতা খনিজ এবং প্রাকৃতিক ধনভান্ডার উজার করে দিয়েছেন সেখানে মানুষ এত গরীব কেন? তাদের দেশেই তারা পেশীবলের কাছে জিম্মি এবং অত্যাচারিত কেন?। কারণ এ দেশগুলোতে বিদেশী বেনিয়ারা তাদেরকে ভাল থাকতে দেয়নি। তারা ক্রীতদাস হিসাবে

বিবেচিত হয়েছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালী, স্পেনিশ ও পর্তুগীজরা যুগের পর যুগ তাদেরকে শোষণ করেছে, মাটির নীচের প্রাকৃতিক সম্ভার সবলরা লুটেপুটে নিয়েছে। সভ্যতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে শাসনের নামে রক্ত শুষে নিয়েছে। তা না হলে আজকের আফ্রিকা মহাদেশে অন্যান্য মহাদেশের তূলনায় অধিক উচ্চতায় থাকতো। 

এশিয়া একটি ঘনবসতিপূর্ণ বিরাট এক মহাদেশ। পৃথিবীর তিনভাগের দু'ভাগ মানুষই এ মহাদেশের অধিবাসী।এশিয়া মহাদেশের প্রায় সব ক’টি দেশের অসংখ্য মানুষের সাথে আমার এ দীর্ঘ বাইশ বছরের কর্মজীবনে পরিচয় ঘটেছে। তাদের মন মেজাজ এবং সংস্কৃতির সাথে পরচিতি হতে সময় লাগেনি। রাশিয়ার উজবেকিস্থান, বোখারা থেকে শুরু করে পাকিস্তান, চীন, জাপান, আফগানিস্তান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা, ইরাক, ইয়েমেন, জর্ডান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর অধিবাসীদের মধ্যে কাউকে সহকর্মী, কাউকে প্রতিবেশী হিসাবে পেয়েছি সময় সময়।

পাকিস্তানীদের মধ্যে ”গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল” এ ধরণের মনমানসিকতা পরিলক্ষিত হয়। এদের মধ্যে মোটাবুদ্ধি ও একঘেয়ে লোকদের সংখ্যাই বেশী। তবে তারা যাকে হৃদয়ে স্থান দেয় তার জন্য তারা সর্বাত্বক সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। বিশেষ করে পাঠান জাতি অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ ও আন্তরিক। বাংলাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে বিশেষ করে মুরব্বীশ্রেণীর লোকদের অনেকেই পাকিস্তানীদের সম্মন্ধে এখনো উঁচু ধারণা পোষণ করেন।তবে আমার দীর্ঘ বাইশ বছরের প্রবাসী জীবনে শত শত পাকিস্তানী প্রতিবেশী, কলিগ পেয়েছি যাদের বেশীরভাগ লোকের চরিত্রের মধ্যে দেখেছি প্রবল আত্মঅহমিকা, বাংলাদেশীদের প্রতি হিংসাত্বক এবং বিদ্বেষমূলক আচরণ। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশীদের চাকুরীক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অফিসে জেঁকে বসা পাকিস্তানী ও ভারতীয়রাও বাংলাদেশীদের চাকুরী ক্ষেত্রে নানারূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। বাংলাদেশীরা যদি কোন অফিসে নিজ যোগ্যতাবলে ভাল চাকুরী পেয়ে যায় তাহলে এ দু’দেশের কলিগরা প্রথম ছ’মাস সহযোগিতার বদলে কোম্পানীর মালিক বা উপরওয়ালাদের কান ভারী করতে থাকে। প্রবাসে চাকুরীকালীন সময়ে এ ধরণের মন্তব্য আমি বাংলাদেশীদের কাছে প্রথম থেকেই শুনে আসছিলাম, বর্তমান কোম্পানীতে চাকুরী পাওয়ার প্রথম ছ’মাস এ ধরণের আচরণের শিকার হলেও আমি দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করে তাদেরকে এমনভাবে আপন করে নিয়েছিলাম তা বলাই বাহুল্য। দেশে ফেরার প্রাক্কালে তাদের অনেকেই বুকে জড়িয়ে ধরে ভারাক্রান্ত মনে বিদায় জানিয়েছে। অনেকে তাদের বাসায় নিমত্রণ করেছে আবার অনেকে স্মৃতিরক্ষর্থে উপহারসামগ্রী নিয়ে অফিসে ও বাসায় হাজির হয়েছে। তাই একটি কথা সর্বকালে প্রযোজ্য, হিংসার পরিবর্তে হিংসা নয়, ভালবাসা দিয়ে জয় করে নিতে হয় ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে। কথায় আছে ”নিজে ভালতো জগত ভাল”।       

পাকিস্তানী এবং আফগানীরা এদেশে নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত কলংকিত করেছে ড্রাগস্‌জনিত অপরাধে। ১৯৯৪ সাল হতে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের ড্রাগস্‌ পাচারের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে এদেশের বুকে আমার জানামতে পাকিস্তানী প্রায় চারশতাধিক লোকের শিরোচ্ছেদ করা হয়েছে এবং অনেকেই একই অপরাধে মৃত্যুর প্রহর গুণছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, জালিয়াতি, খুনখারাবী ইত্যাদি কারণে মহিলাসহ আরও অনেক লোককে অভিযুক্ত করে বিভিন্ন শাস্তি দিয়ে জেলবন্দী করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও পাকিস্তানী ও আফগানীস্তানের হাজার হাজার লোক ড্রাগস্‌ পাচারের অভিযোগে জেল কাটছে। ভারতীয়দের অনেকেই সমাজবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে শিরোচ্ছেদসহ অন্যান্য সাজা পেলেও ড্রাগস্‌-এর কারণে খুবই নগন্য। আফগানীস্তানের অধিবাসীরা আমাদের দেশে কাবুলী নামে পরিচিত। সুদ ও ড্রাগস্ ব্যবসাতে তারা সিদ্ধহস্ত। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে হেরোইন, কোকেন, গাজা, মারিজুয়েনা পাচারে যে সমস্ত দেশের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় তারমধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মেক্সিকো, ইতালীর মাফিয়া এবং নাইজেরীয়ানরা উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ড্রাগস্‌-এর ব্যবসা হয় এবং এর খরিদ্দার রয়েছে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে। এ সমস্ত ড্রাগস্‌-এর একটি চালান নিরাপদে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারলে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়। উপরোক্ত দেশসমূহে এবং পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহের অনেক বিলিয়নারই ড্রাগস্‌ পাচারের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। শুধুমাত্র সৌদিআরবে এবং পার্শবর্তী আরব দেশসমূহে আফগানীদের প্রায় তিনশত ব্যক্তি ড্রাগ পাচারে অভিযুক্ত হয়ে তরবারীর নীচে শির হারিয়েছে।গোত্রীয় প্রাধান্যতা ও রাজনৈতিক অপরিপক্কতার জন্য ওরা বিগত দুই যুগ ধরে আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে স্ব-জাতীয় প্রায় সত্তর হাজারের অধিক লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে। অন্যান্য মুসলিম দেশের তুলনায় শিক্ষাক্ষেত্রেও আফগানীরা অনেক পিছিয়ে। আফগানীস্তান পাহাড়-পর্বতবেষ্টিত এক দেশ। এর তিনদিকে বেষ্টন করে আছে পাকিস্তান, রাশিয়া ও ইরান। পশতু, ফারসী আর উজবেক ভাষার সংমশ্রিনে তাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি তিনটি সীমান্ত দিয়ে অবাধে হেরোইন, গাজা, আফিম সারা দুনিয়ার মাদকাসক্ত লোকদের কাছে পাচার করছে সীমান্তজুড়ে।

একবার একটি ছোটখাটো আফগান রেষ্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আফগানীদের তৈরী ফুল (বিচির তরকারী) ও তন্দুর রুটি কিংবা রুজ-বুখারী (এক ধরণের পোলাও) প্রস্তুতে তাদের জুড়ি নেই। আমার অল্প শেখা ফার্সী ভাষায় দোকানীকে বললাম - এক নফর পালাও ওয়া নুছ মুরক্‌ বিয়ার (একজনের পরিমাণ পোলাও ও অর্ধেক পোড়া মুরগী দাও)। দোকানী উজবেক ভাষায় সহকর্মীর সাথে কথা বলছে শুনে পুনরায় বললাম - এক নফর পোলাও ওয়া নুছ মুরক্‌ মে খুরুম (একজনের পোলাও ও আধা মুরগী দাও)। ইশারায় জানালো শেষ হয়ে গেছে। বললাম, চারবাজ তুলকিনো তোত্তম ওখনেত্তুম (একজনের পরিমাণ পোলাও খাসির গোশত দাও)।

নিজেদের ভাষার কিছুটা ছোঁয়াছ পেয়ে দোকানী অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে একটা প্লাষ্টিকের প্লেটে খাদ্যসামগ্রী প্যাক করে দিতেই বললাম, কেতনা মে খুরুম? (কত হয়েছে)। বলল, চান্দাস দারেফা (দশ রিয়াল)। দশ রিয়াল বাক্সে ঢুকাতে ঢুকাতে দোকানী হেসে বলল, তা-শাকুর (ধন্যবাদ)।

দোকানীকে একা পেয়ে এদিক সেদিক চেয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপি চুপি বললাম, লিগা পাউডার বিয়ার, পয়সা চান্দ মেশা (পাউডার বলতে ওরা হেরোইনকে বুঝায় (এক পুরিয়া হেরোইন দিতে পার, ভাল পয়সা দেব)

দোকানী আমাকে আপাদমস্তক পরখ করল। চারিদিকে চেয়ে বলল, পাত্তা হাসত্‌ (গাঁজা আছে)।

তড়িৎ পদে কোন কথা না বলে পা বাড়ালাম। মনে হল জেদ্দা শহরের সব আফগানী দোকানদার এ ধরণের কোন না কোন নেশা বিক্রির সাথে জড়িত।

বাংলাদেশের মানুষ দেশে যাই করুক প্রবাসে তারা সহজ সরল একটি জাতি হিসাবে বিদেশীদের কাছে পরিচিত। পাসপোর্ট, ঝগড়াঝাটি এবং ওয়ার্কপারমিট জালিয়াতির কারণে কিছুসংখ্যক বাংলাদেশী এদেশে কারাবন্দী হয়েছে সত্য কিন্তু ড্রাগস্‌ ব্যবহার কিংবা ড্রাগস্‌ ব্যবসায়ে কোন বাংলাদেশীর নাম নেই। প্রায় দশলক্ষের মত বাংলাদেশীরা এদেশে বসবাস করছে। তৃতীয় বিশ্বের শান্তিপ্রিয় জাতি হিসাবে বাংলাদেশীদের নাম প্রথম সারিতে রয়েছে। তাই বাংলাদেশীদেরকে এদেশের মানুষ ভালবাসে ও বিশ্বাস করে।

একবার পাকিস্তানী বিমানে করে দেশ হতে ফেরার পর জেদ্দাস্থ কাষ্টমস্ কাউন্টারে আমাকে বাংলাদেশী জেনে কোনরূপ চেকিং ছাড়াই ছেড়ে দেয় অথচ পাকস্তানী বৃদ্ধ, যুবক, মহিলা সবাইকে তন্ন তন্ন করে চেক করা দেখেই বুঝে নিয়েছিলাম সৌদি ইমিগ্রেশেন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশীদেরকে কতটুকু বিশ্বাস করে। বাংলাদেশীরা সৌদিদের এবং এদেশে বসবাসরত অন্যান্য নাগরিকদের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে বটে তবে প্রবাস জীবনে দেশীয় রাজনীতির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের হিংসা, বিদ্বেষ, দলাদলির ব্যাপারে প্রবাসী বাঙালীরা অত্যন্ত সক্রিয় যা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান কিংবা নেপালীদের মধ্যে নেই বললে চলে। আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক ধারা পৃথিবীর সকল দেশেই সমভাবে কাজ করছে। জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হলেও বিরোধী দলের ভূমিকা বিরোধিতা করা, এটাই আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে কিংবা পাকিস্তানে ছাত্রদেরকে লাগামহীনভাবে রাজনৈতিক নেতারা ব্যবহার করেনা অথচ আমাদের নেতারা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ছাত্রদেরকে রাজনৈতিক ময়দানে ব্যবহার করে। নিজেদের ছেলেমেয়েদেরকে তারা পড়াশুনার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। এ ধরণের নজির বোধহয় পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। জানিনা কবে বাঙালী জাতির সুবুদ্ধির উদয় হবে?

এদেশে ফিলিপিনো রয়েছে প্রচুর। দলবদ্ধ হয়ে বসবাস, চলাফেরা এবং টেকনিক্যাল কাজে অভিজ্ঞতাজনিত কারণে এখানে ওরা বেশ সুনাম কুঁড়িয়েছে। তবে চুরি ডাকাতি মদ্যপান এবং সমকামিতা ইত্যাদি কারণে ওরাও কলংকিত।

বড় মেয়ের অভিভাবক হিসাবে একসময় অভিভাবকরা আমাকে ভোটের মাধ্যমে জেদ্দাস্থ ফিলিপাইন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক-অভিভাবক এসোসিয়েশনের দু-বছর মেয়াদী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিল। সে কারণে এবং সহকর্মীদের সাথে দীর্ঘদিন কাজের মাধ্যমে ফিলিপিনো মনমানসকিতা এবং কৃষ্টির সাথে আমার যথেষ্ট পরিচয় ঘটে। ভাতে মাছে বাংগালী শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। আমরা যেমন ভাতে-মাছে বাংগালী, ওরা ও তেমনি মাছে-ভাতে ফিলিপিনো। থাইল্যান্ডীরাও অনুরূপ। ফিলিপিনোরা ইলেকট্রনিক এবং টেকনিক্যাল কাজে অভিজ্ঞ এবং শিক্ষিতের হারও তাদের শতকরা ৭৫% ভাগ। তাদের প্রত্যেকটি পরিবারে উপার্জনকারীদের সংখ্যা একাধিক। এতদসত্ত্বেও পৃথিবীর গরীব দেশের তালিকায় ফিলিপিনোদের নাম রয়েছে। এর একটিই কারণ। তাদের রাজনৈতিক নেতারা আমাদের দেশের মত দ্বিধাবিভক্ত ও নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে অধিক তৎপর। আমাদের রাজনীতিবিদরা পুকুর চুরি করে যা আমাদের জাতীয় উন্নতির অন্তরায়, দুঃখ করে জানায় আমার এক ফিলিপিনো সহকর্মী।

হেসে ওকে ফিলিপিনো তাগালগ ভাষায় বললাম-”কাতুলাদ কা রিন নামিং কোমাকাইন নাং কানিন আত্‌ ইছুদা, কায়া আং লায়ুনিন নাং পিনুনো নাং আমিং বানসা (তোমাদের জাতীয় নেতারা আমাদের নেতাদের মত ভাত মাছ খায় তাই মনমানসিকতা আমাদের উভয় দেশের নেতাদের অভিন্ন)

প্রতোত্তরে সে অট্টহাসি যোগ করে বলল – কোহাং কোহা মু কাইবিগান ইতই তালাগাং কাতুতুহানান।(তুমি ঠিকই ধরতে পেরেছ, এটাই আমাদের ব্যাপারে সত্য এবং সর্বনাশের মূল)।

থাইল্যান্ড উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমানে নিজস্ব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ওরা আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। যুবসম্প্রদায়ের অনেকেই সমকামী এবং বেশ্যাবৃত্তি থাইল্যান্ডে যত্রতত্র যারজন্য ওখানে এইডস্‌ রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সংখ্যায় জাপান, কোরিয়ান এবং তাইওয়ানীরা সৌদিআরবে কম হলেও এখানের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টে ওরা চুক্তিতে কাজ করে। জাপানীরা সভ্য এবং শান্তিপ্রিয় জাতি যার জন্য ওরা বহির্বিশ্বে শ্রদ্ধার পাত্র। তাইওয়ানী, চীনা এবং কোরিয়ানরা কষ্টসহিষ্ণ যার কারণে ওরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেগা প্রজেক্টে ওরা কাজ করছে।

কোরিয়ানরা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টে (১৯৭০-৯০) এদেশে কাজ করতে এসে কুকুরের মাংস অনেক ভক্ষণ করেছে। কুকুরের মাংস ওদের প্রিয় খাবার। ইসলামে কুকুর পোষাকে নিরুৎসাহিত করার কারণে এখানে রাস্তাঘাটে কিংবা কুকুর পোষাতে এদেশের মানুষের ঝোঁক নেই। কিছুসংখ্যক কুকুর মরুভূমিতে বিচরণ করে সেগুলো কোরিয়ানরা বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজে এসে খেয়ে নির্বংশ করেছে। কোম্পানীর ব্যবসার স্বার্থে উপরোক্ত তিনটি দেশের অনেকেরই সাথে পরিচয় ঘটেছে। ওদের কাজের গতি, একনিষ্টতা এবং কর্তব্যপরায়ণতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। 

মুসলিম তুর্কীরা কামাল আতাতুর্কের পালটে দেয়া সমাজব্যবস্থার কারণে মুসলিম কালচার থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছে। পাশ্চাত্য সমাজের অশ্লীলতা আজকাল তুরস্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে ভোগবিলাস প্রাধান্যতা লাভ করেছে। ইসলামের বিধিনিষেধ আজকাল সেখানে সেকেন্ডারী বিষয়ে পরিণত হয়েছে।তুরস্কের ইস্তাম্বুলের মুসলিমরা বেশ ধার্মিক তবে রাজধানী আঙ্কারাসহ অন্যান্য প্রদেশগুলোর মানুষগুলোর চালচলনে বুঝাই যায়না তারা মুসলিম সমাজের ঐতিয্যপূর্ণ এক জাতি হিসাবে একদিন পরিচিত ছিল।তবে আশার কথা এই যে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ানের শাসনামলে তুরস্ক অটোম্যান সাম্রাজ্যের আদলে মুসলিম ঐতিয্য রক্ষায় ক্রমেই ফিরে যাচ্ছে।  

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিন, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, কুয়েত, কাতার, আবুধাবী ও বাহরাইন-এর অসংখ্য লোক এদেশে বিভিন্ন পেশা ও ব্যবসা উপলক্ষে কাজ করছে। উপরোক্ত দেশসমূহের অসংখ্য লোক এবং তাদের কৃষ্টির সাথে আমার এ দীর্ঘ কর্মজীবনে পরিচয় ঘটেছে। বর্তমানে ফিলিস্তিনিরা আরব দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষায়-দীক্ষায় এগিয়ে রয়েছে।

ফিলিস্তিনীদের শিক্ষার হার বর্তমানে ৯৫%। ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের নিষ্পেষণে এই জাতির উত্তরসূরীরা তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসের সাথে পরিচিত। বিগত সত্তর বছর ধরে তারা ইহুদী ইসরাইলী সরকারের অত্যাচারের শিকার। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই তারা ইহুদী বর্বরতার শিকারে পরিণত হচ্ছে। শুরু হতে স্বজাতি দালালদের অর্থলিপ্সা ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ইহুদীরা তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বানচাল করে দিচ্ছে।ফিলিস্তিনী দালালদের সহযোগিতায় ইসরাইলী মোসাদ তাদের গুরুত্বপূর্ণ নের্তৃবর্গকে প্রতিনিয়তই হত্যা করছে ফলে তাদের সত্তর বছর জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনীদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে এ কারণে তারা কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে।

ফিলিস্তিনীরা মিষ্টিজাতীয় খাবারে সিদ্ধহস্ত। তাদের কোন দেশ নেই, যে দেশে বাস করে কখন সে দেশ হতে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয় এ ধরণের একটা আশংকা সবসময় তাদের মধ্যে কাজ করে, তাই তারা নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্যংকে টাকাপয়সা রাখার বদলে নিজেদের কাছে সোনা গচ্ছিত রাখতে পছন্দ করে। ফিলিস্তিনীরা অতিথিপরায়ণ কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে সুদের কারবার প্রচলিত আছে। ইহুদিরা অতি প্রাচীনকাল হতে সুদের কারবারে অভ্যস্থ, বিশ্বের ব্যংক এবং সুদ ব্যবস্থা ইহুদিরাই প্রথমে প্রবর্তন করে। ফিলিস্তিনের মুসলিম সম্প্রদায়ও তাদের কাছ থেকে সুদের কারবার শিখেছে। পাশাপাশি সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ইরাক রয়েছে। সিরিয়ানরা তূলনামূলকভাবে অন্যান্য আরব দেশের লোকদের তূলনায় ভদ্র ও মার্জিত। জর্ডানী ও লেবানীজদের মধ্যে পাশ্চাত্যপ্রীতি লক্ষ করা যায়। তারা চালচলনে পরিচ্ছন্ন, স্মার্ট এবং শিক্ষিত যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশসমূহে চাকুরীক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান তারা মজবুত রেখেছে। শুকনো এবং সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুতে লেবানীজদের জুড়ি নেই। তবে ওরা বেশ স্বার্থপর। সহমর্মিতাবোধ তাদের মধ্যে খুবই কম। সিরিয়ান ও লেবানীজ মেয়েদের রং, গড়ন, উচ্চতা মিলিয়ে সুন্দরী হিসাবে খ্যাতি রয়েছে। ইরাকীরা একগুয়ে। আরব দেশগুলোর লোকদের তূলনায় তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ট মনে করে। এর কারণ হিসাবে ধরা যায়, মধ্যযুগে ইরাকের বাগদাদ এবং কুফা নগরী জ্ঞানে, বিজ্ঞানে এবং স্থাপত্যশৈলীতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থানে ছিল। ইরাকের বেবিলন,কুফা এবং বাগদাদের পুরোকীর্তি আজও  বিশ্বের কাছে সভ্যতার নিদর্শন বহন করে। বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় বাগদাদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মধ্যযুগে অনন্য ভূমিকা রাখে। বাগদাদ ঘিরেই অসংখ্য পন্ডিত ব্যক্তিরা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। খলিফা মোয়াবিয়ার রাজত্বকাল থেকে ইসলামের ইতিহাসে দলীয় কোন্দল সৃষ্টি হয়।বাগদাদ নগরী বিভিন্ন সময় বহিশত্রুর আক্রমণে লন্ডভন্ড হয়। প্রাচীনকাল থেকেই ইরাকে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকতো। চেঙ্গিশ খাঁ হতে শুরু করে গ্রীক, মামলুক এবং সর্বশেষ ব্রিটিশ আক্রমণে বাগদাদ নগরী কলংকিত হয়। যে কারণে আজও  ইরাকীদের মজ্জায় মজ্জায় যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশের মানুষের সাথে ইয়েমেনীদের এক অদ্ভুত মিল রয়েছে। সুদুর ইয়েমেন হতে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে প্রাচীন ভারতবর্ষে ইয়েমেনীরা পাড়ি জমিয়েছে। তাছাড়া ইয়েমেনের এডেন সমুদ্র বন্দর হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। প্রাচীন ইয়েমেনে ভারতবর্ষের গরম মশলার এক বিশাল বাজার ছিল। ইয়েমেনী ব্যবসায়ীরা ইউরোপের বিভিন্ন গন্থব্যে গরম মশলার ব্যবহার ছড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতবর্ষে মূলতঃ ইয়েমেনী  ব্যবসায়ীদের অবাধ বিচরণ এবং পীর আউলিয়াদের ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্র হওয়ায় ইয়েমেনীদের অনেকেই উপমহাদেশে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলে। বাংলাদেশের সিলেটে যে তিনশত ষাটজন আউলিয়া আগমন করেন তাদের বেশীরভাগই ইয়েমেনী বংশদ্ভোত। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে পীর আউলিয়ারা ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন এবং বিয়েশাদীর মাধ্যমে এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাই বাংলাদেশ এবং ভারতের যেসমস্ত অঞ্চলে ধর্মপ্রচারকের সমাগম হয় সে সমস্ত অঞ্চলের মানুষের সাথে ইয়েমেনীদের যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন সমাজে লুঙ্গি পরিধান প্রবর্তন  ইয়েমেনীদের মাধ্যমে প্রসার লাভ করে। লুঙ্গি এবং নিমা জাতীয় সার্ট (হাফহাতা পাঞ্জাবী) ইয়মেনীদের জাতীয় কৃষ্টির অর্ন্তভূক্ত। এগুলো তাদের ঘরোয়া পোষাক হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। পরিবার পরিজন নিয়ে একসাথে বসবাস, খাওয়াদাওয়া, সহমর্মিতাবোধ ইত্যাদি ইয়েমেনী রীতিনীতি বাংলাদশের কৃষ্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইয়মেনীরা অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, ওৱা মাপঝোঁকে কখনো কম করেনা। দুধের সাথে পানি মিশিয়ে, মধুর সাথে চিনির রস মিশিয়ে অর্থাৎ ক্রেতাদেরকে প্রতারণা করেনা। সম্ভবতঃ ইয়মেনীরা আরব বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মপরায়ণ এবং নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ‍হিসাবে সুপরিচিত।

ইন্দোনেশিয়া দেশটি গরীব হলেও আমাদের দেশ হতে তারা আজকাল অনেকটা অগ্রগামী। ওরা সহজ, সরল ও ধর্মভীরু। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া মাত্রই মুসলিম নরনারী তাদের হজব্রত পালন করে। যে কারণে তারা ধর্মীয় অনুশাসনে অধিক মনোযোগী। অধিকাংশক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বিয়েই হয়না হজ্ব না করা পর্যন্ত। ইন্দোনেশিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ এবং জনসংখ্যার দিক দিয়েও তারা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে প্রথমে অবস্থান করছে। অর্থনৈতিক উন্নতিকল্পে ইন্দোনেশিয়া আজকাল যথেষ্ট ভূমিকা নেওয়াতে ক্রমেই তাদের অর্থনৈতিক বিকাশ সাধিত হচ্ছে।

মালয়েশিয়ানরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সত্তর আশির দশকে এক বিরাট অংশ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিল। নব্বই দশক হতে ডঃ মাহাথির মাহমুদের নের্তৃত্বে প্রচুর অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে জাপান, চীন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এদেশে প্রচুর বিনিয়োগ করে।যে কারণে মালয়েশিয়াতে চাকুরীর বাজার এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধি ক্রমেই সম্প্রসারিত হতে থাকে। ফলে যারা মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরীতে নিযুক্ত ছিল তাদের প্রায় সবাই নিজ দেশে ফিরে যায়। উন্নতির অগ্রযাত্রায় মালয়েশিয়া আজ  মধ্যম আয়ের দেশে পরিগণিত হয়েছে এবং ক্রমেই উন্নত বিশ্বের কাতারে স্থান করে নেওয়ার প্রচেষ্ঠায় আছে।

সৌদিদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ অনেকটা কম। বিদেশীরা তাদের ধনসম্পদ লুটেপুটে নিচ্ছে অথচ তাদের মধ্যে বিদেশীদের প্রতি হিংসামূলক মনোভাব পোষণ করতে কমই দেখা যায়। সৌদিআরবের মূল বাসিন্দা বেদুঈন সম্প্রদায়ের আতিথ্যপরায়ণতা প্রসিদ্ধ। সহজ সরল বেদুঈনদের সাথে শহুরে সৌদির অনেক তফাৎ। আমি শহুরে সৌদিদের অনেককে দেখেছি যারা বিদেশীদেরকে খাটিয়ে ঠিকমত বেতন দেয়না, অত্যাচার করে, অধিক খাটায় আবার এরকমও দেখেছি যারা অত্যন্ত হৃদয়বান, নিজের অধীনস্থ কর্মচারীর আর্থিক অসুবিধায় তারা উপযাচক হয়ে কর্মচারীর ঋণ পরিশোধ করেছে হাসিমুখে। বিদেশীদের অনেকেই গাড়ী এ্যাকসিডেন্ট করে রক্তপণ দিতে অকৃতকার্য হওয়ায় অথবা ছোটখাটো অপরাধে জরিমানা দিতে না পারায় জেল খাটছে। অজানা, অচনো এই ভিনদেশীদেরকে অনেক সৌদি ব্যক্তি পবিত্র রমজান মাসে অথবা ঈদের দিনগুলোতে জরিমানার টাকা পরিশোধ করে জেল হতে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়। পবিত্র এ দিনগুলোতে তারা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে হাজতিদের হাজতবাসের কারণ জানতে চায় এবং সে অনুযায়ী তাদের পক্ষে জরিমানার টাকা পরিশোধ করে দেয়। মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি অনেকসময় জানতেও পারেনা কে সেই হৃদয়বান যার কারণে সে জেল হতে মুক্তি পেল। ওরা লিল্লাহ, সাদাকা, জাকাত দিতে কার্পণ্যতা করেনা। ধনী ব্যক্তি তৃষ্ণার্থ পথিকের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বাড়ীর দেয়ালের সাথে ওয়াটার কুলার লাগিয়ে রাখে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই অসংখ্য ধনীদের বাস অথচ তৃষ্ণার্থদের জন্য এধরণের ব্যবস্থা কিংবা অচনো, অজানা, অনাত্মীয়কে জরিমানার টাকা পরিশোধ করে মুক্ত করার মত মনোবৃত্তি সৌদিদের মত ভিন্ন জাতিসত্ত্বায় সাধারণতঃ চোখে পড়েনা। ছোটবড় সকলে ধর্মরক্ষায় মনযোগী। তবে ছেলেমেয়েদেরকে সুগঠিত এবং পার্থিব সুশিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তারা বেশ উদাসীন। স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা রাস্তাঘাটে অধিক রাত অবধি ফুটবল খেলতে দেখা যায়। ফুটবল তাদের প্রিয় খেলা। পিতামাতা এ ব্যাপারে অন্যান্য দেশের পিতামাতার মত সচেতন নন। বিবাহযোগ্য মেয়েদের কদর এখানে অনেক বেশী। ক’নের পরিবার পাত্রপক্ষের কাছে বিপুল পরিমাণ নগদ মোহরানা দাবী করে যার জন্য বিবাহযোগ্য ছেলেরা সময়মত বিয়ে করতে পারেনা। মোহরানার টাকা যোগাড় করতে গিয়ে মধ্যবিত্ত সমাজের ছেলেরা হিমসিম খায়। নারীসমাজ এদেশে কঠিনভাবে পর্দাপ্রথা মেনে চলে। এমনকি ইউরোপ আমেরিকার স্বর্ণকেশীরাও এখানে বোরকা ছাড়া বাইরে বেরোনোর নিয়ম নেই। কিছু কিছু গোত্রের মেয়েরা বিবাহপোযুক্ত হলে বাড়ীর ছাদে বিভিন্ন রংয়ের পতাকা উড়তে দেখা যায়। এতে বিবাহপোযুক্ত পাত্রীর সন্ধান পেতে সহজ হয়। উপমহাদেশে মেয়েদের সময়মত বিয়ে হয়না যৌতুক প্রদানের অপরাগতায় আর এখানে ছেলেদের সময়মত বিয়ে হয়না পাত্রীপক্ষের চাহিদামত মোহরানা দেওয়ার অপারগতায়। পাত্রকে নগদে বিয়ের পূর্বেই মোহরানার সমুদয় টাকা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে অথচ আমাদের দেশে ছেলেপক্ষ নামমাত্র মোহরানার টাকা পরিশোধ করে ক’নে ঘরে তুলে।

বর্তমান বিশ্বে সৌদিআরব একটি নিরাপদ আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত। মক্কা এবং মদীনা পৃথিবীর ধর্মস্থানগুলোর মধ্যে মানমর্যাদা এবং শান্তির শীর্ষে অবস্থান করছে। চুরি, ডাকাতি, হানাহানি, মারামারি, ধর্ষণ, লুন্ঠন, প্রতারণা, অনাচার, উৎপীড়ন বহির্ভূত এ দুটো জায়গাতে শুধু শান্তির ফল্গুধারা বয়ে যাচ্ছে। এক মহামানবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এ দুটো জায়গার অধিবাসীরা বিশ্ববাসীকে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ইসলামিক বিধিবিধান মেনে চললে শান্তির পায়রা কখনো বিদুরিত হয়না এবং কবির কথাই সত্য বলে মেনে নিতে হয়- “কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদুর, মানুষের মাঝে স্বর্গনরক মানুষেতেই সুরাসুর

লোহিত সাগরের দৈর্ঘ দু’হাজার একশো ও প্রস্থ কোথাও তিনশত আবার কোথাও সাড়ে তিনশত মাইল। লোহিতের তীর ঘেষে যে কয়টি শহর ও বন্দর গড়ে উঠেছে তারমধ্যে পূর্বপ্রান্তে সৌদিআরবের জেদ্দা,ইয়ানবু, জিজান, আল ওয়াজ এবং ইয়েমেনের হোদাইদা, মাকাহ্‌ এবং পশ্চিমপ্রান্তে রয়েছে সুদানের পোর্টসুদান সুয়াকিন, ইরিত্রিয়ার মোছাওয়া, ইথিওপিয়ার আছাব, জিবুতীর বীরইলুই ও মিশরের সাফাগা, কোছাইর ও সুয়েজ বন্দর। তন্মধ্যে সবচে সুন্দর ও বৃহত্তম বন্দরনগরী হল জেদ্দা। তাই জেদ্দাকে ”লোহিত বধু” হিসাবে ভূষিত করা হয়। পৃথিবী বিলয় হওয়া পর্যন্ত জেদ্দা শহরের গুরুত্ব অপরিসীম যেহেতু এই জেদ্দাই হল পবিত্র মক্কা এবং মদীনা নগরীর প্রবেশদ্বার। এ পৃথিবীতে অনেক বড় বড় সুন্দর শহর রয়েছে যেগুলোর নাম অনেকেই জানেনা কিন্তু এই লোহিত বধূ জেদ্দাকে সবাই চিনে কারণ পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে পিপিলিকার সারির মতই কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলিম নরনারী মক্কা মদীনায় প্রবশে করে এই শহরের মধ্য দিয়েই। তাই প্রয়োজনে এখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কলকারখানা, আকাশচুম্বী অট্টালিকার সারি ও অসংখ্য রাজপথ। এখানের আবহাওয়া এমনই শুষ্ক যে,সদ্য প্রস্তুত একটি রুটি মাত্র তিনঘন্টার ব্যবধানে পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়। বছরের বারো মাস জেদ্দার বুকে লোহিতের ফুরফুরে হাওয়া বয়ে যায়। পার্শবর্তী এলাকার বিশাল মরুর উত্তপ্ত বাতাসের সাথে মিশে সাগরবক্ষ হতে ভেসে আসা জলীয়বাষ্পর্পূণ শীতল বাতাসও শুষ্ক হয়ে উঠে। বছরে পাঁচমাস গরম, তিনমাস নাতিশীতোষ্ণ, তিনমাস শীত ও একমাস বসন্ত নিয়ে জেদ্দার আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে। শীতের শুরুতে ও শীতকালীন সময়ে পার্শবর্তী পার্বত্য অঞ্চল তায়েফ, আলবাহা ও আল-আভার ৭,০০০ ফুট উঁচু পর্বতশৃঙ্গে জমে থাকা মেঘমালার কারণে বছরে চারপাঁচদিন যৎসামান্য বৃষ্টিপাত ঘটে। বৃষ্টির পূর্বলক্ষণ জেদ্দার অলিগলির আবাল বৃদ্ধবণিতাদের কাছে নিয়ে আসে আনন্দের সওগাত।

নদনদীবিহীন এ শহরটি লোহিতের তীরে এক অস্পরীর ন্যায় সৌর্ন্দয্যের শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে আছে। যে জেদ্দা এককালে মরুশহর নামে অভিহিত ছিল আজ  এখানে সবুজের ছোঁয়া লেগেছে। রং বেরঙ্গের টিয়া, শালিক, ঘুঘু, চড়ুই, কাক আর বুলবুলের গানে মুখরিত সবুজ তরুপল্লব। বট, নিম, কুল, আম, নারিকেল, খেজুর, পাতাবাহার আর লুজ গাছে আবৃত লোহিত-বধূকে করেছে মায়াময়।

বিগত বাইশ বছর এ শহরটির আলোবাতাসে আমার স্বপ্নের দিনগুলো কেটেছে। এখানে বসবাসরত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো মানুষের সাথে মিশে প্রতিদিন যুক্ত হয়েছে নুতন নূতন অভিজ্ঞতা।আমি ভালবাসি মায়াময় এ শহরকে আর এ শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে। যে শহরে মানুষ নিজের স্বার্থের কারণে অন্যের জীবনকে বিড়ম্বিত করেনা। জানমালের নিরাপত্তা এখানকার দৈনন্দিন জীবনে সবাই ভোগ করছে কঠিন আইনের অনুশাসনে। লোহিত বধূ তার বক্ষে ধারণ করছে প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ আর তাদের মুক্ত নিঃশ্বাসের প্রয়োজনে বয়ে চলেছে লোহিতের মৃদুমন্দ বাতাস।

লোহিত হতে সৃষ্ট ঢেউ কিংবা ঝড়বৃষ্টি এ শহরের অধিবাসী কিংবা পাশ্ববর্তী দেশসমূহের জনজীবনের আশা-আকাঙ্খাকে লন্ডভন্ড করে দেয়না। লোহিতের নীল জলরাশির নীচে লুকিয়ে থাকা অফুরান সম্পদ মানুষের কল্যাণে উজার করে দিচ্ছে বিনম্র আনন্দে। ভালবাসার এ বিশাল জলরাশির উপর ভর করে এক অজানাচিত নেশায় আমি ছুটে গিয়েছি এপার হতে ওপারে। অনন্ত নীল আকাশ, অযুত নক্ষত্রের দীপালী, চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণ আর অস্তগামী সূর্যের রক্তাক্ত লালিমা যার প্রশস্থ বক্ষে হয়েছে বন্দী। বিভিন্ন আঙ্গিকে একে দেখেছি মুগ্ধ নয়নে বারবার, প্রতিবার, তবু এ দেখার যেন শেষ নেই।

১৯৯৮ সালের আগষ্ট মাস। দিবানিশি লোহিতের বুকে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অবলোকন করছিলাম মুগ্ধ বিস্ময়ে। বন্দর হতে বন্দর অতিক্রম করে দেখেছি মাটি, মানুষ, চন্দ্র, সূর্য আর তারাদের মিলনের গান। অশান্ত ঢেউয়ের তালে তালে সারিবদ্ধ ডলফিন,হাঙ্গর আর  তিমিদের অক্লান্ত বিচরণ।

লোহিতবক্ষে নীরব নিস্তব্ধ রাতের অতন্দ্র প্রহরে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অবলোকন করছিলাম সৃষ্টি রহস্যের অপার মহিমা। ভাবছিলাম অনেক কথা, আকস্মিক কারোর উপস্থিতি অনুভব করে ফিরে দেখি উপমহাদেশীয় চেহারার এক যুবক আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। নীরব প্রশ্নবাণ ফুটে উঠছে তার চোখেমুখে। ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কোন্ দেশের?

উত্তর এল ”আনা মা আরিফ ইংরেজী কালাম”(আমি ইংলিশ জানিনা)।পুনরায় প্রশ্ন করলো,ইন্‌তা হিন্দি? (আপনি ভারতীয়? )

উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, আনা হিন্দি, মিন কেরেলা। ফি শুগুল বাখেরা, ক্লিনার! (আমি ভারতীয়, কেরেলার অধিবাসী, জাহাজে ক্লিনারের চাকুরী করি।)

পুনরায় যা জানতে চাইল তাতে বুঝলাম এদেশে তার খুব বেশীদিন হয়নি, আরবীতে ভাল কথোপকথনও জানেনা, অগত্যা আমাকে মালয়ালম ভাষার আশ্রয় নিতে হল আমার স্বল্প শেখা মালয়ালম ভাষা প্রয়োগ করে, – সুগামাল্লেহ? জলি ইয়াংগানিউন্ন্ড কাপ্পালিল? (কেমন আছেন? জাহাজের চাকুরী কেমন লাগছে?)

মার্তৃভাষার স্বাদ পেয়ে লোকটি ভারী খুশী হয়ে বলল, তারক্কেভিল্লা। না-ম ইরুভারম অরুয়ে নাট্টুকারানেন্নু তনুন্নু। ইয়াতাইআলুম নি ওয়িগে বা-কী ইল্লাঅরুম নাম্মুডে নাট্টুকার ইয়ান্নু তনুন্নু। ইয়াবিডিকো পয়ুন্নুডাহ্? (ভাল, আপনি যে আমাদের এলাকার লোক তা প্রথম দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। যাক্, মনে হয় আপনি ছাড়া আমাদের দেশের দ্বিতীয় কেউ এ জাহাজে নেই? তা কোথায় যাচ্ছেন? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলাম...।

পেরেন্ডা নিংগারে? (আপনার নাম কি?)

উত্তর এল - আব্দুল করিম।

নিংগালুডে নাডু কান্ডিট ইয়াত্রা কালামায়ি? (দেশে কতদিন হয় যাননি?)

আঞ্জে কুল্লমাইটুম (তা প্রায় পাঁচবছর হয়ে গেল)

প্রসঙ্গ পালটিয়ে বললাম, সেরী নাঙ্গালিকু জলিকু সামাইয়ামি। পিন্নে কানম ইয়ানঅরু বাংলাদেশ কারেনান্নু (ঠিক আছে কাজে যান, পরে কথা হবে, আর আমি একজন বাংলাদেশী,কেরালিটি নই।)

ইয়ানথে? নি কেরেলাকরণ আল্লে? বাংলাদেশী? নিহ্‌ ইয়ান্নে আর্শ্চয্যপেডুট্টি! (কি বললেন, আপনি কেরালিটি নন, বাংলাদেশী! আর্শ্চয্য!)

আশ্চারিয়াপেডেনডা। ইয়ানিক্কু দারালাম কেরেলাকারুন্ডে সামছারিক্কান।(আর্শ্চয্য হওয়ার কি আছে? আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ও কলিগ আছেন যারা কেরালিটি, তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কিছু শিখে নিয়েছি)

ফলসরূপ আব্দুল করিম লোহিতবক্ষে তিনদিন তিনরাত্রি আমাকে এবং আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে পরম আত্মীয়ের মত বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছিল। বিশাল এই সাততলা জাহাজের কোথায় ছেলেমেয়েদের খেলার ব্যবস্থা আছে,মধ্যমাকারের খেলার মাঠ এবং আমাদের পাঁচতলায় কেবিন সংলগ্ন আর কি কি সুবিধা আছে তাও জানিয়ে দিল। 

আব্দুল করিম দু’টো পয়সা কামানোর উদ্দেশ্যে জাহাজে চাকুরী নিয়েছে। প্রিয়জনদের মুখচ্ছবি সে সাগরের নীলাভ অথৈ জলের গভীরে খুঁজে বেড়ায় অথচ সে ভারতের এক সমৃদ্ধ এলাকার বাসিন্দা। যেখানে ভারতের শতকরা ৮০ ভাগ রাবার, ৬০ ভাগ চা ও কফি, ৩০ ভাগ চাউল, নারিকেল আর সর্বপ্রকার গরম মশলার ছড়াছড়ি। শুধুমাত্র এলাচি শতকরা ৬০ ভাগ ভারতের এ অঞ্চলে জন্মে। ভারত সরকার প্রতি বছর ১৫০ কোটি টাকার মশল্লাজাতীয় জিনিষ রপ্তানী করে থাকে যার শতকরা ৮০ ভাগই দাক্ষিণাত্যের কেরেলাতে  জন্মায়। এ কারণে পর্তুগীজ জলদস্যুরা এবং ব্রিটিশ ও আরবীয় ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলে মধ্যযুগ হতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চলকে ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিল। রান্নায় বিভিন্ন প্রকার গরম মশল্লার ব্যবহার প্রকৃতপক্ষে এ অঞ্চল হতে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

মনে পড়ে সৌদি সরকারের স্পীকার ডঃ আব্দুল্লাহ ওমর নসীফ আমাদের সাহিত্যপত্রিকা ”সম্প্রীতি”র সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,আমি ভাবতে পারিনা, সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা বাংলাদেশ এবং ভারতের মানুষ এত গরীব হয় কি করে? একটি ধানের শীষ ছুঁড়ে ফেললে যেখানে কিছুদিনের ব্যবধানে হাজারো শীষ উৎপন্ন হয়, সেখানের মানুষ নিশ্চয়ই কোন না কোনভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে।

স্পীকার অত্যন্ত সুন্দরভাবে কাউকে দোষী স্বাব্যস্থ না করে বিষয়টি প্রকাশ করেছিলেন।উনি হয়তো জানেননা অথবা ভাবতেও পারেননা, আবদুল করিম কিংবা আমি যে দেশে জন্মেছি সে দেশের মাটি ও মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচে গড়া। মাটি উদগীরণ করে ফসল আর নেতারা সে ফসলের ভাগাভাগি নিয়ে হরিলুটে হয় মত্ত। মৃত্যুর কথা, পরকালের  কথা, অন্যায় অবিচারের কথা আমাদের অধিকাংশ নেতারা ভাবেনা কোনদিন। শুধু নিজের সম্পদ বাড়াও, যত পার ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাতিয়ে নাও গরীবের টাকা, দেশের টাকা লুট করে বিদেশের নিরাপদ কোন ব্যংকে পাচার কর, লুট কর ব্যাঙ্ক, বীমা, ইনস্যুরেন্স আর মানি মার্কেট। উত্তরসূরীদের জন্য তাদের কতনা আয়োজন। তবু আরো চাই। কতটুকু হলে তাদের অশান্ত মন শান্ত হবে তা তারা নিজেও জানেনা।এ সমস্ত কারণে আব্দুল করিম বা আমি আমাদের সোনা ফলানো মাটির মায়া ত্যাগ করে বিদেশে আসি সম্মানজনক জীবিকার আশায়।

জেদ্দার বুকে আমার চাকুরীজীবনের প্রথম একটি বছর বেশ নাজুক অবস্থায় কাটাতে হয় বিশেষতঃ ভাষাগত সমস্যার কারণে। দেশে বাঙ্গালীদের সাথে কাজ করেছি দেশীয় চিরাচরিত নিয়মে, সামাজিক রীতিনীতির ব্যত্যয় কখনো ঘটেনি। একই জাতের লোকদের সাথে কাজ করলে বুদ্ধিবিবেচনা, চিন্তাধারা, দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্যবোধ, কাজের ধারা, রুচিজ্ঞান একই ভাবধারায় প্রভাবিত বিধায় মানসিক বিকাশলাভ ঘটার তেমন সুযোগ ঘটেনি অথচ এখানে বিভিন্ন ভাষাভাষি লোকদের সাথে কাজ করে আমার রুচিজ্ঞান, বিবেকবুদ্ধি, চিন্তাশক্তি এবং কাজের স্পৃহার এক আমুল পরিবর্তন ঘটেছে গত প্রায় দুই যুগ ধরে।

এ পরিবর্তন ঘটার পেছনে কাজ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন জাতের মানুষের সংস্পর্শ। মানুষ কত দ্রুত চলতে পারে, দ্রুত চিন্তা করতে পারে, দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে পারে - কত ফাষ্ট এ পৃথিবী? সময়ের কাজ নির্ধারিত সময়ের ভেতর শেষ করতে হবে, আগামীকালের জন্য ফেলে রাখা যাবেনা নতুবা নূতন কোন সমস্যা যোগ হয়ে সমস্যার বিকাশলাভ ঘটবে তাই কোনকিছুকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। রুটিনমাফিক জীবনকে পরিচালনা করতে হবে। রুটিনের পরিবর্তন হলে জীবন থেকে খসে যাবে আরও কিছুটা সময়, এটাই উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহের মানুষের ভাবনা। তাইতো তারা এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি স্তরে আর আমরা কাজ ফেলে রাখি বলে পিছিয়ে যাই উন্নয়নের অমিত সম্ভাবনাকে সময়মত কাজে না লাগিয়ে।

আমাদের অফিস আদালতে জট লেগে থাকে হাজারো ফাইল, কোর্টে বিচারাধীন মামলার জটে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। বছরের পর বছর কোর্ট প্রাঙ্গনে ধর্ণা দিতে দিতে বিচারের রায় পাওয়ার পূর্বেই অসংখ্য লোকের জীবন প্রদীপ নিবে যায় অথচ এই রাজতন্ত্রের দেশে দেখে আসছি অবহেলায় কোন কাজ ফেলে রাখা হয়না। কোর্টে বিচারাধীন মামলা তিনমাসের মধ্যে অবশ্যই রায় দিতে হবে। অনেকক্ষেত্রে বিশেষ করে দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত মামলায় কাজীর আদালতে একদিনের ভেতর রায় আসে, পক্ষান্তরে আমাদের দেশে দুর্ঘটনাজনিত মামলায় যে যানবাহন জব্দ করে থানায় নিয়ে আসা হয় সে যান থানার আঙ্গিনায় বছরের পর বছর পড়ে থেকে এর মধ্যে উদ্ভিদ গজায় কিন্তু মামলা দীর্ঘদিন ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে থাকে। এতে করে প্রকৃত অপরাধী আড়ালে থেকে যায়, বিচারপ্রার্থী সঠিক বিচার পায়না, নষ্ট হয় জীবনের মূল্যবান সময়। এ মনমানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, উন্নত জীবনের শর্ত মানতে হবে যদি আমরা জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চাই।

মনে হয় একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর পদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। প্রযুক্তির এই যুগেও আমরা লালফিতার দৌড়াত্যের চাপে পড়ে নিঃস্ব ও বঞ্চিত হচ্ছি প্রতিটি মূহুর্তে। আমাদের জাতীয় সাফল্য যখন ৩০% ভাগে পৌঁছে বিশ্বের উন্নত দেশের সাফল্যের মাত্রা তখন একশোভাগে উন্নীত হয়।সমাজের উন্নতির জন্য, দেশের আপামর জনতার মঙ্গলের জন্য বেশীর ভাগ আইনপ্রণেতাদের ভাবনা সীমাবদ্ধতার গন্ডি পেরোয়না, যারা কিছু করতে চায় তাদরেকে হিংসার বশর্বতী হয়ে করতে না দেওয়াটা প্রতিপক্ষের আত্মগর্বের কারণ। গণতন্ত্রের বড় বড় বুলি আমাদের জাতীয় নেতাদের মুখে মুখে অথচ তারাই জোরপূর্বক হরণ করে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার।

ভারত উপমহাদেশ শাসিত হয়েছে যুগের পর যুগ। শাসকগোষ্ঠি আমাদের শিখিয়েছে “ডিভাইড এন্ড রোল”। এ মন্ত্র আমাদেরকে কোনঠাসা করে রেখেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এর ফলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, প্রাণহরণ, অন্যের সম্পদ কুক্ষিগতকরণ, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, অবিচার এবং সর্বোপরি খর্ব হয়েছে সত্যিকার বাক-স্বাধীনতা। উপমহাদেশ জুড়ে চলছে একই সন্ত্রাসের রাজত্ব। গণমানুষের মৌলিক অধিকার আজ শুধু মুখের কথা,বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই।

গণতন্ত্র নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন জাগে - গণতন্ত্র কি মানুষের মুক্তি দিতে পেরেছে? টাইম ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম আমেরিকার নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে ১৯৯৪-৯৫ সালে মোট পাঁচহাজারেরও বেশী গুপ্তহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এর কিছুদিন পূর্বে আমেরিকার ম্যাগাজিন “সাপ্তাহিক নিউজউইক” পত্রিকায় ব্যাংক ডাকাতির একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল তাতে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালী, ফ্রান্স ও ব্রাজিলের নাম শীর্ষে রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে সভ্যতার দাবীদার পশ্চিমা বিশ্বের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে একথা বলা যেতে পারে পাশ্চাত্য প্রবর্তিত গণতন্ত্র মানুষের মুক্তির সংজ্ঞা হতে পারেনা কিংবা মুক্তির সঠিক উপায় বলে বিবেচিত হতে পারেনা। গণতান্ত্রিক দেশ বলে খ্যাত সকল দেশেই কলহ, বিবাদ, অশান্তি লেগেই আছে তাহলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার আর কি কি উপায় আমাদের হাতে রয়েছে? গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র-সব তন্ত্রই যুগে যুগে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। তবে এসবের মধ্যে মন্দের ভাল গণতন্ত্র। একথা সত্য যে, পৃথিবীর সকল ধর্মই ন্যায় এবং মানবতার কথা বলে। যুগে যুগে ধর্মগুরুদের দ্বারা ধর্মগ্রন্থসমূহে রূপান্তর ঘটেছে। প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলোতে নিজেদের স্বার্থের অনুকুলে রূপান্তর ঘটানো হয়েছে। তা না হলে খ্রিস্টানদের বাইবেলের পুরাতন এবং নূতন সংস্করণে, ইহুদিদের তোরাহ/তালমুদের পুরাতন এবং নূতন সংস্করণে, বেদ এবং ত্রিপিটকের বিভিন্ন সংস্করণে পার্থক্য কেন? বৌদ্ধদের বুদ্ধ ভিক্ষু এবং হিন্দু ধর্মগ্রন্থে ধর্মগুরু ছাড়া সাধারণের প্রবেশাধিকারে এত বাঁধা কেন? বাইবেল, তালমুদ, বেদ কিংবা ত্রিপিটকে মানবজীবনের অসংখ্য সমস্যার কথা থাকলেও জটিল সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তেমন কোন পথনির্দেশ নেই। তাই আমাদেরকে অনুসরণ করতে হবে মহান স্রষ্টা কর্তৃক প্রণীত সঠিক এবং মানব সমাজের রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক ধর্মগ্রন্থ যেখানে থাকবে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়বস্তর নির্ভুল চিত্র ও যথার্থ সমাধান। জীবনের নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বিনয়, নম্রতা, পরনিন্দা, পরর্চচা, জবরদখল, ধর্ষণ, লুন্ঠন, নিপীড়ন ইত্যাদি পরিহারক্ষেত্রে যে ধর্মগ্রন্থ বলিষ্ট ভূমিকা রেখেছে সে ধর্মগ্রন্থের অনুশাসনকে সামনে রেখে কঠোর আইনপ্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে গড়ে তুলতে হবে কাঙ্খিত সমাজ এবং জীবনব্যবস্থা।

গণতন্ত্র বলতে আমরা অজ্ঞান অথচ বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্ব কি পৃথিবীর মানুষগুলোকে স্বস্থিতে সহবস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পেরেছে? না পারেনি। যদি পারত তাহলে পৃথবিীর ৮৫% ভাগ মানুষ ভূখা থাকতো না, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধবিগ্রহ, হিংসা, বৈষম্য লেগে থাকতোনা। মানুষের বসবাসযোগ্য এ ক্ষুদ্র পৃথিবী নামক গ্রহটি যুদ্ধের ডামাঢোলে আজ  এক জলন্ত অগ্নেয়গিরি। এ অগ্নেয়গিরির  দাবদাহে কখন যে কার প্রাণ যায় তা কেউ বলতে পারেনা। চারিদিকে নারকীয় হিংসা-প্রতিহিংসার বিষবাষ্পে মানবতা পরাক্রান্ত, বিপর্যস্থ। স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় রক্তপাতের মাধ্যমে। এ পৃথিবীতে যত স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিনা রক্তপাতে সেগুলো হয়নি। নিজেদের দুর্দশার প্রেক্ষিতে বর্ণনা করছিল লোহিত তীরের ইরিত্রিয়ার অর্ন্তগত মোছাওয়া বন্দরের অধিবাসী ওমর। ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলি সেলাসী কঠোর হস্তে দমন করতে চেয়েছিল ইরিত্রিয়ার শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠিকে। সুর্দীঘ বত্রিশ বছর স্বাধীনতা সংগ্রাম করে অবশেষে জনগণের বিজয় অর্জিত হয়। যুবসমাজের অধিকাংশই স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত থাকার কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারা তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। অভাবের করালগ্রাসের আবেষ্টনীতে বন্দী হয়ে আছে সেখানকার জনজীবন। যৎসামান্য ইংরেজী জানা মটর মেকানিক ওমরকে আমার স্বল্প জানা ইরিত্রিয় তিগরিনিয়া আমহারী ভাষায় জানতে চেয়েছিলাম, মিন্‌ চিম্‌কা? (আপনার নাম কি?)

আনে ওমর আলী ওমর (আমি ওমর আলী ওমর)

কেন্‌ডিটু কনু সেড্রাবেট্‌? (সংসারে কে কে আছে?)

হাদা ইয়াল্লান। কুল্লুহুম মৈতিমুম্‌। হামুস্‌তা হাওয়াতা কুল্লুহুম সয়িয়ূম বিজেক্কা আনে তারিফা আল্‌লুকু। ইয়া আম্মান হিসবে ইরাত্রা বুজুহ্‌দম্‌ বুজুহাট্‌ হিস্‌বে তা সয়িয়ুম, দম্‌ হিস্‌বে বেলাস্‌ আইফাসসিন্‌ আইয়ূ। (কেউ নেই। যারা ছিল তারা সবাই স্বাধীনতা সংগ্রামে মারা পড়েছে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে আমিই শুধু শেষ পরিণতি দেখার জন্য বেঁচে আছি। আমার বিশ্বাস, আমরা একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবো, এতগুলো মানুষ মরলো, তাদের রক্ত কি বৃথা যাবে?)

তামারিকা ডিকা? (আপনি বিবাহিত?)

মারা? ওয়াদ্দি আস্‌সারতা সিডিস্‌তা কুরলুকু আব্‌গাড্‌লি তাসাতিফা। দাহ্‌রিন মুস্‌তাআলে আড্‌মে আরবাহ্‌ সুমন্‌তান্‌ আমেদ্‌ ইহাহ্‌লিফা সিলাজি কুম্‌নগর নেহ্‌, মারা আইতা আইওদ্‌কুল্লুন। (বিয়ে? ষোলবছর বয়স থেকে বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি। বিয়ের কথা যখন ভাবলাম তখন দেখি বয়স পেরিয়ে গেছে, অগত্যা আইবুড়ো।)

সিলামিন্‌তাই? গুবজ্‌ আল্‌লুকা। (কেন, আপনাকে দেখেতো যুবকই মনে হয়)

আনে ওয়াতাহাদ্দর নিরা। নিছানাতা কামিগ্গারা আহলিফাইয়ো।ইজাক্কার বাহাদুআগান্‌ জামাজা কাইয়েদ আব্‌জাআলম। (আমি সৈনিক। যুদ্ধ করেছি। যৌবনের দিনগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল? একসময় ভাবি, কি পেলাম, কি হারালাম আর কি পাব?)

অন্যমনস্ক ওমরের দিকে চেয়ে মায়া হল। প্রচুর কফি, মিলেট, ম্যাজ উৎপাদনকারী ইরিত্রিয়া ধাপে ধাপে একদিন হয়তো মাথা তুলে দাঁড়াবে। মাত্র নয়মাস যুদ্ধ করে ওরা স্বাধীন হয়নি আমাদের মত। সুদীর্ঘ বত্রিশ বছর ওরা একনায়ক সম্রাট হাইলি সেলাসী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। পঞ্চাশ হাজারেরও অধিক নরনারী যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। তাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে শতকরা ৩০% নারী পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। শতকরা ৪০ ভাগ সুন্নী মুসলিম, ৪০ ভাগ খ্রিস্টান এবং অবশিষ্ট পশু, দেবদেবী ও অগ্নি উপাসক উপজাতি নিয়ে ইরিত্রিয়ার জনগোষ্ঠি। আরবী ও তিগরিনীয়া ওখানের প্রধান দু’টো ভাষা। বাংলাদেশ হতে সামান্য ছোট দেশ ইরিত্রিয়া, আয়তনে ৪৬,৭৭২ বর্গমাইল। জনসংখ্যা প্রায় সায়ত্রিশ লক্ষ। ভূখন্ডের তূলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব নগন্য। লোহিত সাগরের উপকূল জুড়ে বিশাল ডেনাকিল মরুভূমি আর বন্ধুর পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে ইরত্রিয়ার  ভৌগলিক অবস্থান হওয়ায় লোকসংখ্যার ঘনত্ব কম। এদেশে কয়েকধরণের আবহাওয়া বিদ্যমান। প্রচন্ড গরম, নাতিশীতোষ্ণ ও শীতপ্রধান অঞ্চল নিয়ে এদেশটি গঠিত। বেশ বড় বড় কয়েকটি নদনদী পরিবেষ্টিত এদেশের সামাজিক রীতিনীতি অনেকটা বাংলাদেশের মত। শতকরা ৮০% লোক কৃষিজীবি। বছরে চারমাস প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। লোহিতসাগরের তীর ঘেষে এদেশটি ইয়েমেন ও সৌদিআরবের বিপরীতে অবস্থিত। পাশাপাশি রাষ্ট্র জিবুতী।

বাংলাদেশের মত একান্নবর্তী পরিবার হয়ে ওরা জীবনযাপন করতে ভালবাসে। তাদের প্রধান প্রধান ‍ডিসের নাম হল সুরো, ইন্‌জেরা, টাইটাহ্‌, কাটচাহ্‌, ফিট্‌ফিট্‌, গাট্‌ ইত্যাদ। তাছাড়া ইটালিয়ান খাদ্যদ্রব্যেও তারা অভ্যস্থ কারণ একসময় এদেশ ইতালীর কলোনি ছিল। রাজধানী আসমারাতে ইতালীয়দের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন এখনো সংরক্ষিত আছে। আশা করা যাচ্ছে হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বহির্ভূত, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এ দেশটির মানুষগুলো হয়তো একদিন তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবে।

লোহিতের পশ্চিমতীরে মিশরের সাফাগা, কোছাইর ও সুয়েজ বন্দর অবস্থিত। তন্মধ্যে সাফাগা ও সুয়েজ বন্দর বিখ্যাত। জাহাজে চড়ে উপরোক্ত প্রত্যেকটি বন্দরে গিয়েছি, সেখানকার অধিবাসীদের সাথে প্রাণ খুলে মিশেছি। সাফাগা ও কোছাইর বন্দর হতে আপার মিশরে সহজে যাওয়া যায়। সুয়েজ হতে কায়রোর দুরত্ব একশত বিশ কিলোমিটারের মত। সুয়েজ বন্দরের পাশ দিয়ে প্রায় একশত বিশ কিলোমিটার খাল কেটে লোহিত সাগরের সাথে ভূমধ্যসাগরের সংযোগ ঘটানো হয়েছে। এ খাল খননের তিনটি উদ্দেশ্য ছিল তারমধ্যে ভূমধ্য সাগরের তীরবর্তী মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে সুয়েজ বন্দরের সংযোগ স্থাপন করে আরব বিশ্বের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি সাধন এবং ইউরোপের সাথে প্রাচ্যের সংক্ষিপ্ত নৌ-যোগাযোগ স্থাপন। এ খালের কারণে ইউরোপ ও আফ্রিকার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্যিক দুরত্ব প্রায় পাঁচহাজার মাইল কমে যায়।

জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দুপুরের সোনালী রোদে উপচে পড়া মুক্তার মত ঢেউগুলো দেখছিলাম বিমূর্ত বিস্ময়ে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ভাষাভাষি কয়েকজন ফটো তুলছিল বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। হয়তো সাগরে কোন জরিপ কার্য পরিচালনা করার জন্য জাহাজে চড়েছে ওরা জেদ্দা হতে। কিছু দুরে দাঁড়িয়ে থাকা যে দু’জন বেঁটে লোক কথা বলছিল তাদেরকে দেখেই মনে হল ওরা জাপানী আর জাপানী ভাষায় কথা বলছে একে অপরের সাথে। টুকরো টুকরো কথা কানে আসছিল। অনেকটা বুঝতে পারলাম কারণ গত ঊনিশ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় জ্ঞানলাভ করার নেশা আমাকে নেশাগ্রস্থ করে রেখেছিল একসময় । মাথায় হেট পরা লোকটি সাথীকে বলল -নো-কাসুরি ওয়া আরিমাছু কা আসুপিরিন ? গা ইটাইন্‌ ডেসুগা আটামা । নান্নিচি গোরাল ডি টিছুকিমাছুকা? (আপনার কাছে এসপ্রিন আছে? বড্ড মাথা ধরেছে। পৌঁছতে আমাদের আর কতক্ষণ লাগবে?)

সোসো ও-মাছি কুডাসাই (একটু চুপ থাকুনতো দেখি।)

ওর সাথীটি বিরক্তিভরা মুখে কথাটি বলে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালো।

মাথায় ব্যথাধরা লোকটি এবার আমার দিকে ফিরে একটু মুচকি হাসল। জাপানী কান্‌জি ভাষায় বললাম - মসি মসি হাজিমেমাসিটি ওমিনি কাকারিমাছু (হ্যালো, কেমন আছেন ?)

অ-ছরিরিমাছু-গা, মো-ইছিডো অনিগাই ইটাছিমাছু? (আমি দুঃখিত, আপনার কথাটি আবার বলুনতো, বুঝতে পারিনি।)

হাজিমেটি ওমিনি কাকারিমাছু (কেমন আছেন?) অগত্যা পুনরাবৃত্তি করলাম অন্যভাবে।

কিবুনগা ওয়ারুয়িন ডেসু? ডমো আরিগাটো গোজাইমাছিতা। (ভীষণ খারাপ লাগছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ)

কথাবার্তা জমলো লোকটির সাথে। বলল- ওয়িয়োগি নি ইকিতেইন ডেছুগা (আমার ইচ্ছে হচ্ছে সাগরে সাঁতার কাটি)

মিছিছিয়ো ওয়া-ইট্‌ছু ডেসুকা। আছকো ওয়া আবুনাই ডেসুকা। (কি ভীষণ ঢেউ। এ ঢেউয়ে সাঁতার কাটার ইচ্ছে ভয়ানক ইচ্ছা নয় কি?) - একটু হেসে উত্তর দিলাম।

লোকটি হেসে উঠলো – সুকি ডেসু (আমি এটা পছন্দ করি)। বলল ও-কুনি ওয়া ডছিরা ডেসুকা? ডছিরানি অছুমাই ডেসুকা? (আপনি কোন্‌ দেশের? বর্তমানে কোথায় বাস করেন?)

বললাম- নো-ছুচ্ছিন ডেছু বাংলাদেশ। কাইসানি টিছুটামেটি ইমাসু, জেদ্দা। (আমি বাংলাদেশী এবং জেদ্দায় একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানীতে কাজ করি)।

জাপান এমন একটি দেশ যে দেশটি বুকে ধারণ করছে অসংখ্য পর্বতমালা। শতকরা আশিভাগ পাহাড়-পর্বতবেষ্ঠিত এদেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প জনজীবনকে করে রাখে সবসময়ই আতঙ্কগ্রস্থ। প্রস্থে ছোট, দৈর্ঘে লম্বাটে একটি দেশ। সমগ্র পৃথিবীর মানুষগুলোকে মোহগ্রস্থ করে রেখেছে তাদের নব নব আবিষ্কার দিয়ে। পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের কে না চেনে জাপানীদেরকে। বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত, ভূমিকম্পপ্রবণ এ দেশকে সূর্যোদয়ের দেশ বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরপরই জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, নিত্যনূতন আবিষ্কারে নিজেদের অবস্থানকে তারা এতই সূদৃঢ রেখেছে যে, দৈনন্দিন জীবনে মেশিনারীজ, ইলেকট্রনিক্স এবং বিনোদন জগতের বেশীরভাগ পণ্যই তাদের আবিষ্কার। তাদের গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যসামগ্রীর চাহিদা বিশ্বজুড়ে। সংসার, অফিস, যাতায়াত, যোগাযোগ, বিনোদন এবং ছোট, মাঝারী ও ভারী শিল্পায়নের প্রয়োজনে তারা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে আসছে। নব নব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে তারা বিশ্ববাসীকে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, জাতি হিসাবে তারা এক আত্মনির্ভরশীল জাতি। বিভিন্ন রুচিশীল দ্রব্যাদি প্রস্তুতিতে তাদের জুড়ি নেই। জাপানের রেষ্টুরেন্টগুলোতে ঢুকলে দেখা যায়, যে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য এ সমস্ত রেষ্টুরেন্টগুলো প্রস্তুত করে তার হুবহু নমুনা প্লাষ্টিকের তৈরী শো-কেশে শোভা পাচ্ছে। কি কি জিনিষ দিয়ে এ সমস্ত খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা হয় তারও একটি তালিকা রাখা হয়, এতে খদ্দের তার চাহিদা এবং রুচিমত খাদ্যের স্বাদ নিতে পারে। সোসি, ইয়াকিউদন, ছবায়া, ইয়াকিটরিয়া, টংকাটসুইয়া, রামেনইয়া, ওজাসিকি, কায়িসিকি, রাইসু, সোচিউ, উমেছহু ইত্যাদি জাপানী সুস্বাদু ডিস জাপানীসহ হাজারো বিদেশীদের পছন্দ। এদেশে মৃত মানুষের মাংসও বিশেষ হোটেল-রেষ্টুরেন্টে পাওয়া যায়। সরকারী অনুমোদন নিয়ে দুর্ঘটনায় তাজা বে-ওয়ারিশ মৃত মানুষের বিভিন্ন অংগ-প্রত্যঙ্গের মাংসের কাবাব বিশেষায়িত এসমস্ত হোটেল-রেষ্টুরেন্টে পাওয়া যায়। মানুষের মাংসের স্বাদ নিতে বিভিন্ন দেশের মানুষ এ সমস্ত রেষ্টুরেন্টগুলোতে ভিড় জমায়।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর পর জাপানীরা বুঝতে শিখেছে পৃথিবীকে জয় করতে হলে প্রযুক্তি কাজে লাগাতে হবে, গায়ের জোরে যা সম্ভব নয়। তাই তারা ২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে নব নব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন দিয়ে। ‍নিত্যনূতন আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে জাপানে গড়ে উঠেছে লক্ষ লক্ষ প্রযুক্তিনির্ভর কল কারখানা। কারখানায় ভরপুর জাপানে পতিত জমির বড়ই অভাব। সমৃদ্ধি, সমৃদ্ধি আর সমৃদ্ধি। দেশ গড়তে গিয়ে তাদের অক্লান্ত চেষ্ঠা ও দেশপ্রেম তাদেরকে নিয়ে গেছে অনেক উর্ধ্বে। নিজেদের দেশ নিজেরাই গড়বে, অন্যকে ডেকে এনে নিজেদের জায়গার দখল দিয়ে তাদের লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেওয়ার প্রয়োজন কি আছে? কবিগুরুর কথাই সত্যিকার অর্থে জাপানীদের বেলায় প্রযোজ্য - ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট্ট এ তরী, আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।

জাপানীরা দাতা হতে চায়, গ্রহীতা নয়, কারণ দাতাদের সম্মান সর্বকালে সর্বদেশে স্বীকৃত। গরীব দেশগুলোকে দান করে যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায় সে আত্মতৃপ্তিতো পেতে হবে। তাই চাই আরো টাকা। দেশের জন্য তো বটেই, সাথে সথে গরীব দেশগুলোকে সাহায্যের মাধ্যমে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটানো। তাছাড়া যে সমস্ত দেশগুলোকে দান করবে সে সমস্ত দেশগুলোর গণমানুষের শ্রদ্ধাবোধ জাপানীদের আরও একধাপ উপরে নিয়ে যাবে। শিল্পযাত্রার প্রভূত উন্নয়নের কারণে তাদের পতিত ও কৃষি জমির পরিমাণ কমে গেছে। তাই তাদের কৃষিজমি রক্ষা করতে তারা এক নূতন পন্থা অবলম্বন করেছে। তাদের বড় বড় কোম্পানীগুলো বিদেশে বিনিয়োগ করে টাকা উপার্জনের লক্ষে বিদেশে জমি ক্রয় করে মাল্টিমিলিয়ন ডলারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিদেশে জাপানী গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যাদি ও ভারী মেশিনারীজের প্রচুর চাহিদা রয়েছে এবং এ সমস্ত শিল্পের জন্য প্রচুর জমির প্রয়োজন। জাপানে শিল্পবিপ্লবের কারণে কৃষি জমি লোপ পাচ্ছে তাই বিদেশে যদি তাদের শিল্পকারখানা স্থানান্তরিত করা যায় তাহলে দু’দিকেই তারা লাভবান হবে, নিজেদের জমি বাঁচবে অথচ আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে জাপানী অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। অন্যদিকে ভৌগলিক কারণে জাপান ভূমিকম্পপ্রবণ হওয়ায় ঘনঘন ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতেও ভারী শিল্পকারখানাগুলোও রক্ষা পাবে। এসমস্ত লক্ষ সামনে রেখে তারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্রেও তাদের বিনিয়োগ সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখিত দেশসমূহ জাপানী বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেখিয়ে সাদরে আমন্ত্রন জানাচ্ছে।

আমেরিকা ও জাপানের বৈদেশিক নীতির মধ্যে পার্থক্য হল, আমেরিকা বিশ্বের খ্যাতিমান বুদ্ধিসত্ত্বাকে নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে কিনে নেয়, দেয় সম্মানিত নাগরিকত্ব ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক। এ ফাঁদে পড়ে মেধাবীরা আমেরিকাতেই গবেষণার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজদেশে ফেরার কথা ঐ সমস্ত মেধাবীরা চিন্তাও করেনা বরং তাদের নিত্যনূতন আবিষ্কার দিয়ে প্রকারান্তরে আমেরিকার অর্থনৈতিক মেরুদন্ডকে চাঙ্গা রাখে।

১৯৮৬ সালে ঐতিহাসিক Richard Rhodes কর্তৃক প্রকাশিত "The Making of the Atomic Bomb" গ্রন্থ হতে জানা যায় আমেরিকার ম্যানহোটান প্রজেক্টে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান-এর নির্দেশে প্রায় সাতহাজার বৈজ্ঞানিক ও টেকনিশিয়ান আণবিক বোমা তৈরীর কাজে নিযুক্ত ছিল এদের অধিকাংশই ছিল ইহুদী টেকনিশিয়ান ও বৈজ্ঞানিক। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা চর্চা শুরু হয়।

মোট ১১ জন বিজ্ঞানী যারা পারমাণবিক বোমার রূপকার তাদের দশজনই ছিল ইহুদী। এগারোজনের মাত্র একজন ছিল ’ফারমী’ নামক এক ইটালিয়ান খ্রিষ্টান তবে তার স্ত্রী ছিল ইহুদী। হাঙ্গেরিতে জন্ম নেয়া জে. রবার্ট ওপেনহিমার এর নের্তৃত্বে উক্ত প্রধান এগারোজন বিজ্ঞানী চূড়ান্তভাবে আণবিক বোমার কার্যক্ষমতা নিয়ে নিশ্চিত রির্পোট আমেরিকার সরকারকে অবহিত করে। জে. রবার্ট ওপেনহিমারকে আণবিক বোমা তৈরীর জনক, এডওয়ার্ড টেলারকে হাইড্রোজেন বোমার জনক এবং অষ্ট্রিয়ায় জন্ম নেয়া স্যামুয়েল টি কোহেনকে নিউট্রন পারমাণবিক বোমার জনক হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। ওদের তিনজনই ইহুদী। বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, নাসা এবং অন্যান্য আণবিক পরীক্ষাগারের বেশীরভাগ বৈজ্ঞানিকই জন্মগতভাবে আমেরিকান নয়।

জাপানীদের ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তারা নিজেদের মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে নিত্যনূতন জিনিষ আবিষ্কার করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। তাদের বিশ্বাস তারাই শ্রেষ্ট জাতি। নিজ জাতিকে কাজে লাগিয়ে জীবনের জন্য যা দরকার – কাপড় হতে শুরু করে বুলেট ট্রেন পর্যন্ত তারা তৈরী করে। কি নেই তাদের নিত্যনূতন আবিষ্কারে? জাপানীরা সম্ভবতঃ পৃথিবীর সবচে শৃঙ্খলিত জাতি। ২য় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে অনেক জাপানী আত্মহত্যা করেছে। দেশপ্রেম ও আত্মনির্ভরশীলতার পরম দৃষ্টান্ত জাপানীদের কাছে শিক্ষনীয়।

এদিকে আমাদের দিকে যখন তাকাই তখন এক শূন্যতা মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়। পরাজয়ই আমাদের জয়। তৃপ্তি আমাদের অতৃপ্তিতে। অখাদ্য আমাদের সুখাদ্য। পরাজয়ের বেদনা, অসম্মান আমাদের মনকে নাড়া দেয়না। পরাজয়ের মধ্যেও আমাদের চোখেমুখে একধরণের তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। নিজেদের স্বার্থে সমগ্র জাতিকে পিছিয়ে দিতে আমাদের জুড়ি নেই। আমাদের মরণ নেই, আত্মগর্বের মরণ! যে মরণে স্বাদ আছে, আত্মতৃপ্তি আছে, আছে উত্তরসূরীদের জন্য রেখে যাওয়া মর্যাদাবোধের নিদর্শন। আমাদের সুন্দর এক দেশে জন্ম হয়েছে অসুন্দর এক জনগোষ্ঠির। জাপানের শতকরা আশিভাগ জমি পাহাড়-পর্বত পরিবেষ্টিত আর আমাদের শতকরা পঁচান্নব্বই ভাগ মাটি উর্বর এবং সমতল ?

বিধাতা আমাদেরকে দিয়েছেন অনেককিছু, দেননি উন্নতির চাবিকাঠি। আমাদের আছে জনশক্তি, আছে উর্বর মাটি, আছে কর্মক্ষমতা – কি নেই ? হ্যাঁ, নেই মনমানসিকতা, প্রকৃত দেশপ্রেম ও জাতির প্রতি কর্তব্যবোধ। আমরা নের্তৃত্বের জন্য লড়াই করি, প্রতিপক্ষকে কিভাবে ঘায়েল করা যায় তার পেছনে লেগে থাকি দেশ-মার্তৃকাকে ভুলে। সত্যকে চাপা দিয়ে যা অর্জন করি তা বুমেরাংয়ের মত ফিরে আসে আমাদের জীবনকে বিদ্ধ করতে। 

একটি মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশী জিনিষের দরকার হয়না। শুধুমাত্র একান্ত প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। উত্তরসূরীদের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়ার কোন প্রয়োজন নেই। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় যদি দেশের আর্থসামাজিক উন্নতি ঘটানো যায় তাহলে উত্তরসূরীদের জীবনের মান এমনিতেই বেড়ে যাবে এটা সুনিশ্চিত। ”সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”-এ সত্য হোক আমাদের মূলমন্ত্র। 

আঁতুড়, লোলা, লেংড়া পৃথিবীর সব দেশেই আছে। এদেরকে কাজে লাগাতে হবে, তাদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে তাদেরকে উপযুক্ত কাজ দিয়ে। জাপানে অসংখ্য খেলনা তৈরীর কারখানা আছে যেখানে এসমস্ত আঁতুড়রা কাজ করে দেশের জন্য নিয়ে আসছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অথচ আমাদের আঁতুড়দেরকে বাধ্য হয়ে রাস্তায় ফুটপাতে ভিক্ষার মাধ্যমে জীবন চালাতে হয়। আমরা কি পারিনা তাদের কর্মউপযোগী প্রতিষ্ঠান গড়তে যাতে তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে পারে? রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি কল্যাণমূলক হলে অবশ্যই সরকার পারে।

বিভিন্ন দেশের জরিপে দেখা যায় সমাজের অবহেলিত ব্যক্তিসত্ত্বাকে কাজে লাগিয়ে সরকার বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। এমনকি হিজরা জনগোষ্ষ্ঠিকে কাজ দিয়ে ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। আমাদের সরকার ও সমাজহিতৈষীদেরকে এদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরী। ওদের দুঃখ-বেদনার কথা আমরা না ভাবলেও উন্নত দেশগুলো ভাবে, জাতীয় জীবনে তাদের অবদানের স্বীকৃতি দেয়, তাদেরকে কাজে লাগায়। আজকাল অলিম্পিকের বিশ্বআসরে যুক্ত হয়েছে অটিষ্টিক ছেলেমেয়েদের খেলাধূলা। তাদের সুনিপুণ খেলা দেখলে বিস্ময়ে অভিভুত হতে হয়। বিধাতার সৃষ্ট এ পৃথিবীতে যে কত ধরণের লোক এবং ভাষা আছে তার ইয়ত্তা নেই। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এ পৃথিবীতে প্রধান দশটি ভাষাতে লোকজন কথা বলেঃ

চাইনিজঃ ১৩১১ মিলিয়ন, স্পেনিশঃ  ৪৬০ মিঃ, ইংলিশঃ ৩৭৯ মিঃ, হিন্দিঃ ৩৪১ মিঃ, আরবীঃ ৩১৯ মিঃ, বাংলাঃ ২২৮ মিঃ, পর্তুগীজঃ ২২১ মিঃ, রাশিয়ানঃ ১৫৪ মিঃ, জাপানিজঃ ১২৮ মিঃ, পাঞ্জাবী (Lahnda) ১১৯ মিলিয়ন।

এ পৃথিবীতে সাতটি মহাদেশ জুড়ে দশহাজারেরও উপরে ছোটবড় গোত্র রয়েছে। মনের ভাব প্রকাশের জন্য প্রত্যেক গোত্রের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তাহলে ধরে নেয়া যেতে পারে যে, এ পৃথিবীতে দশহাজারের উপরে ভাষা রয়েছে। আদি পিতা আদম ও মাতা হাওয়ার গর্ভ হতে জন্ম নেয়া উত্তরসূরী এ পর্যন্ত সাতশত ষাট কোটি মানুষের ভাষা এবং সংস্কৃতিগতভাবে যথেষ্ট তফাৎ রয়েছে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে “আমি দেশে দেশে মানব জাতিকে গোত্রে গোত্রে ছড়িয়ে দিয়েছি বিভিন্ন রং-য়ে এবং বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রনে, যাতে তারা একে অপরকে চিনতে পারে”।

ভাষাগত, জাতিগত, রংয়ের প্রকারভেদে, ধর্মগত এবং সংস্কৃতিগত পার্থক্য থাকলেও কয়েকটি ব্যাপারে মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যেমন-হাসিকান্না, ভালমন্দ, ব্যথা-বেদনা, রক্তের রং ইত্যাদি ক্ষেত্রে। লক্ষণীয় এই যে, যে মানুষটি যেথায় জন্ম নিয়েছে, জন্মের পর যে আলোবাতাসে সে বড় হয়েছে, যে ভাষা জন্মলগ্ন হতে মার্তৃক্রোড়ে শুনে এসেছে সেগুলো হতে সে কখনো দুরে সরে যেতে পারেনা। তাই মানুষ ভিনদেশীর মুখে নিজের মার্তৃভাষায় কথা বলতে শুনলে এবং পরের মুখে নিজের প্রশংসা শুনলে খুশী হয়। নিজে যা পছন্দ করে অন্যের মধ্যে তার পছন্দনীয় জিনিষ দেখলে আরও বেশী খুশী হয়।

বিগত বছরগুলোতে আমি অনূভব করেছি মানুষ সবচে বেশী খুশী হয় এবং কাছের মানুষ বলে অন্যকে ভাবে যখন ভিন্ন সমাজের একজন লোক তার মার্তৃভাষায় কথা বলে। এ পৃথিবীর অগণিত ভাষা পুরোপুরি রপ্ত করা সম্ভব নয় তবে আলাপচারিতার জন্য, প্রতিপক্ষের মন জয়ে, বিদেশী ব্যক্তিটির কাছ থেকে নমনীয় এবং মধুর ব্যবহার পেতে, সহজ আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেওয়ার প্রয়োজনে কিছুটা বিদেশী ভাষা শিখতে পারলে কোথাও আপনি অকৃতকার্য হবেননা এটা সুনিশ্চিত। দেশে-বিদেশে কঠিন সময়েও আপনি এর সুফল পেতে থাকবেন।

এ সত্যটা উপলব্ধি করে আমিও চেষ্ঠা করেছি পৃথিবীর কয়েকটি প্রধান ভাষায় কথা বলা কিছুটা রপ্ত করতে এবং এর জন্য যথেষ্ট সাধনাও করতে হয়েছে। আরবী ভাষার একটি শব্দের মানে জানতে আমি এককিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে কলিগদের কাছে গিয়ে জানতে চেষ্ঠা করেছি। ফলে আমার কোষাগারে দিনে দিনে জমা পড়েছে অনেক শব্দ যা আমি চলতি পথে ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছি, অসম্ভবকেও অনেক সময় বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়েছে। Dale Carnegie তার How to win friends & influence people”- বইয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছেন।

১৯৯৮ সালের ১৮ই আগষ্ট। প্রায় ষোল ঘন্টা একটানা যাত্রার পর আমাদের ৭তলা বিশিষ্ট ’সালাম’ নামক বিশাল জাহাজ মিশরের সাফাগা বন্দরে পৌঁছে নোঙ্গর করতে লেগে যায় প্রায় বিশমিনিট। সাফাগাবাসী মিশরীয় স্থানীয় যাত্রীদের হৈ-হুল্লারে মুখরিত জাহাজ ও বন্দর প্রাঙ্গন। যাত্রীরা তাড়াহুড়া করে মালামাল নিয়ে নামতে শুরু করলো জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে একে একে। চারিদিকে খুশীর জোয়ার। নিজেদের দেশে এসে পড়েছে সাফাগার যাত্রীরা। কেউ হয়তো পরবাসে পাঁচবছরের অধিক, কেউবা তিনবছর আবার কেউবা ‍দু’বছর পর আপনজনদের সাথে ছুটি কাটাতে এসেছে। উন্মুখ আপনজনেরা হয়তো তাদের আগমনী প্রতীক্ষায় সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। প্রবাসের একঘেয়েমী কর্মজীবনের এক নির্দিষ্টকাল অতিক্রম শেষে দেশে ফেরার আনন্দ কতটুকু মনকে আপ্লুত করে তা একমাত্র প্রবাসীরাই মনেপ্রাণে অনুভব করে থাকে।

পাঁচতলায় আমাদের নির্ধারিত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত দু’টো কেবিনের একটিতে ছেলেমেয়েদের চারজন মিলে তাদের প্রিয় খেলা ‘ইনু’-তে মশগুল ছিল। সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা, এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।

ঘড়ির কাঁটা রাত একটা অতিক্রম করেছে। আমরা দু’জন কেবিনের দরজা খুলে বাইরের ডেকে পাশাপাশি সোফায় বসে উন্মোক্ত আকাশে চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণ আর ঝিকিমিকি তারাদের হাতছানির এক অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিলাম। দুরে, অনেক দুরে অন্যান্য নৌযান হেডলাইট জ্বালিয়ে বিভিন্ন বন্দর হতে বিপরীতমুখী গন্থব্যে ধাবমান। লোহিতবক্ষের বিস্তীর্ণ জলরাশির স্ফটিক জলের গভীরে আঁধাবাঁকা চাঁদটির প্রতিফলন ক্ষণে ক্ষণে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে ফেটে পড়ছিল। সাগরের নীলাভ জলে লক্ষকোটি তারাদের প্রতিফলন অদ্ভূত এক ভাললাগার অনুভূতি মনকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। এ অনুভূতি আনন্দের, উচ্ছ্বাসের এবং উপলব্ধির। একান্ত ব্যক্তিগত এ আনন্দকে কারোর সাথে ভাগাভাগি করা যায়না।

গিন্নীর পরণে গাঢ় নীল পেড়ে আকাশী রংয়ের শাড়ি। আর আমার পরণে নীল রংয়ের ম্যাচিং স্লিপিংস্যুট। আকাশ আর জলের সাথে অদ্ভূত ম্যাচিং। সাগরের নীলাভ জলরাশি আর নীল আকাশের সামিয়ানার নিচে আমাদের উপচে পড়া আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ফুটে ওঠে সাজসজ্জায়। কেবিনের বাইরে উর্দি পরা ওয়েটার বসে ঝিমুচ্ছে। দু’কাপ কফির অর্ডার দিয়ে সোফায় ফিরে এলাম।

জাহাজটি কিছুক্ষণ আগে সাফাগা বন্দর ছেড়েছে। সামনে হয়তো কোছাইর এবং তারপরে সুয়েজ বন্দর, ওখানেই আমাদের গন্তব্য। আরো ষোল সতেরো ঘন্টার একটানা যাত্রা। কাল দিবাগত গভীর রাতে সুয়েজ বন্দরে পৌঁছার কথা। কেবিনের দরজায় আলতো ঠোকার মাধ্যমে ওয়েটার তার উপস্থিতি জানান দিতেই নিয়ে এলাম সৌরভ ছড়ানো দু’কাপ গরম কফি। গিন্নীর প্রশ্ন, কেমন করে বুঝলে এ মূহুর্তে আমার কফি চাই ?

বুঝবো না? তোমার শ্বাস-প্রশ্বাস, পছন্দ-অপছন্দ আমার মনের রন্দ্রে রন্দ্রে অনুপ্রবেশ করে আমার বোধশক্তিকে অনেক পূর্বেই শিক্ষিত করে তুলেছে।

বাড়িয়ে বলতে তোমার জুড়ি নেই একথা সেই কবে থেকেই জানি। এবার বলো, এমনি এক রোমান্টিক পরিবেশ তোমার কেমন লাগছে?

দ্যাখো, ভাললাগার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। সৃষ্টিতেই আনন্দের উপকরণ বিদ্যমান। এমন রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করার অভিপ্রায় নিয়েইতো এবারের সমুদ্রযাত্রা। প্ল্যানটি কিন্তু তিনমাস পূর্বে এমন এক রাতের প্রহরে দু’জন মিলেই করেছিলাম, মনে নেই? তোমার আমার জীবনকে প্রতিদিন নূতন করে সাজানোর কৌশল রপ্ত করেছি বলেইতো আমরা উভয়েই সংসারের একঘেয়েমী কাটিয়ে শান্তির নীড় রচনা করতে প্রায়শঃই সচেষ্ঠ থাকি। মধ্যে মধ্যে এ ধরণের আয়োজন কম কিসে? তুমি না বলেছিলে, বিয়ের পূর্বেই আমার একটি লিখা পড়ে এই অধম লেখকের প্রতি তোমার অনুরাগ জন্মেছিল। আমার বেলায়ও ঠিক তাই, লেখিকা জেনে অদেখা বধুকে নির্ভৃতে নিরলে কল্পনায় পাশে দাঁড় করিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখেছিলাম। ম্যাচিং করাতো সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য, নয় কি?

কেবিনের রেলিং ধরে নিচের দিকে তাকাও, দ্যাখো, ওখানে বেশ কয়েকটি বড়সড় রাবারের লাইফ সেভিং বোট জাহাজের সাথে বাঁধা আছে। জানতে চেয়েছিলে, এমন রোমান্টিক মূহুর্ত কেমন লাগছে? ইচ্ছে হচ্ছে, ওগুলোর একটিতে তোমাকে নিয়ে ঝাপ দেই, আর দু’জনে মিলে খুঁজে নেই নির্জন একটি দ্বীপ। যেখানে নূতন করে আমরা ঘর বাঁধবো, সাগরে ডুব দিয়ে মাছ ধরবো আর তুমি সেই মাছ খড়খুটো দিয়ে পুড়িয়ে আমার পাতে তুলে দিবে।

আশ্চর্য্য, অদ্ভূত মিল রয়েছে তোমার আমার কল্পনায়। ঠিক এমনি কল্পনা আমার মনের গভীরে অনুভব করেছিলাম। ব্যবধানটা শুধু এই যে, তুমি ডুব দিয়ে মাছ ধরার কল্পনা করেছ আর আমার কল্পনায় বড়শীতে টোপ লাগিয়ে বেশ বড়সড় মাছ ধরছিলাম।

আর নিশ্চয়ই সাগর পাড়ের বনাঞ্চল হতে সংগৃহীত মরা গাছের ছালের ভেতর যে পোকাগুলা কিলবিল করে সেগুলো বড়শীর টোপ হিসাবে ব্যবহার করেছিলে? আবারো হাসির জোয়ার। 

জানো, গতমাসে ঘটে যাওয়া এ জাহাজের আরেকটি লোমহর্ষক ঘটনা যা ইংরেজী দৈনিকে পড়েছিলাম। এ জাহাজের সপ্তম তলায় অর্থাৎ ছাদে একটি খেলার মাঠ রয়েছে। ইনডোর এবং আউটডোর গেম খেলার ব্যবস্থা সেখানে রয়েছে। মিশরের কোন এক দম্পতি ওখানে খেলতে গিয়েছিল তিনচার বছরের একটি বাচ্চা নিয়ে সেদিনের ঝড়ের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে।

সেদিন সাগর ছিল উত্থাল, প্রচন্ড ঝড়ো বাতাসে মা বাচ্চাকে সামলাতে পারেনি। একরকম খড়খুটোর মত উড়িয়ে বাচ্চাটাকে প্রচন্ড শক্তিতে বাতাস সাগরের অথৈ জলের গভীরে নিক্ষেপ করেছিল। অগত্যা ছেলেটির বাবা পাশের সাইরেন বটম টিপে ধরেছিল, মা অজ্ঞান অবস্থায় জাহাজের ডেকে পড়েছিল। জাহাজের গতি শ্লুথ করতে বাধ্য হয় ক্যাপ্টেন। জাহাজের ক্রু-রা ছুটোছুটি করে সপ্তম তলায় এসে খবরটি জানতে পারে। ডুবুরী ক্রু-রা দড়ির সিঁড়ি বেয়ে লা্‌ইফ বোটে করে সার্চলাইটের মাধ্যমে তন্ন তন্ন করে একমাইল এলাকা জুড়ে খুঁজে কিন্তু সকল প্রচেষ্ঠাই বিফলে যায়। কে জানে ছেলেটি কোন্‌ তিমির পেটের ক্ষুধা নিবারণ করেছিল !  মা-বাবার অবস্থা কল্পনা করে দেখ,  কি অবস্থা হয়েছিল তাদের? সন্তান হারানোর বেদনা কতনা মর্মান্তিক !

গিন্নীর চেহারা যেন কালো মেঘে ঢেকে গেল। কোন কথা না বলে সন্তানদের কেবিনের দিকে ধাবিত হয় এক অজানা আশংকায়। আমিও কিছু না বুঝে গিন্নীর পিছু নিলাম। ছেলেমেয়েরা কেবিনে অঘোরে ঘুমুচ্ছে। গিন্নী ওদের পাশে শুয়ে একে একে ওদের মাথায় ও বুকে হাত রেখে আমার দিকে ফিরে বলল, তুমি আমাদের কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়ো, রাত অনেক হয়েছে।

নিজেকে নির্বোধ মনে হল। যদিও এ ঘটনাটি সত্য ছিল তবুও এমন এক রোমান্টিক মূহূর্তে এ ঘটনার অবতারণা গিন্নীর কাছে আমার বাড়তি পাওনার সম্ভাবনাকে একেবারেই নস্যাৎ করে দিল।

মাঝে মাঝে আমার যে কি হয়। ঘন্টাদু’য়েক পরে ঘটনাটি বললে কি এমন ক্ষতি হত? গিন্নীতো বলে তোমার সবকিছুই আমার পছন্দ তবে কোন কোন সময় স্বপ্নিল মূহুর্তগুলো হঠাৎ করে বদলে দিতে পার যা অনভিপ্রেত।

সত্যিই আমি মাঝে মাঝে এমন করি কেন তা নিজেই বুঝিনা। মনে পড়ে যে রাতে বিয়ে করে নববধুকে গাড়ীতে করে ফিরছিলাম, খুব কাছাকাছি ওর পাশে বসেছিলাম একটুখানি উষ্ণ সানিধ্য পাওয়ার আশে। হঠাৎ করে আমার উরুতে ভীষণ জোরে এক চিমটি কাটার পরক্ষণেই উচ্চস্বরে বলে উঠেছিলাম, এ্যাই, তুমি আমাকে চিমটি কাটলে কেন? এটা কি হল?

লাল ওড়নার ফাঁকে গিন্নীর রক্তাভো মুখটির ব্যাখ্যা আর নাইবা দিলাম। গাড়ীতে ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী, ছোট্ট ভাতিজী এবং অপরিচিত ড্রাইভার। ড্রাইভার মুখ টিপে হাসলো, ভাবী পরিস্থিতি উপলব্ধি করে বললেন, কে আবার চিমটি কাটবে? বেশ কয়েকটি মশা ঢুকেছে গাড়ীতে। স্বাভাবিক স্বরে বললাম, তাই হবে হয়তো তবে বাংলাদেশের মশা যে চিমটি কাটতে পারে তাতো জানতামনা? ভাবী কিছু না বলে মুখ টিপে হাসলেন। পরক্ষণেই প্রসঙ্গ পালটিয়ে বললেন, ড্রাইভার সাহেব একটু আস্তে চালানতো। আমাদের বাসের বরযাত্রীরা বেশ পেছনে পড়ে গেছে। কি সুন্দর পরিস্থিতিকে সামাল দিলেন, মনে মনে ভাবীর প্রশংসা না করে পারলামনা। মহিলারা সুযোগে অনেক কিছুর উপস্থিত সমাধান দিতে পারে যা পুরুষরা সর্বক্ষেত্রে পারেনা।   

বৌ নিয়ে ঘরে ফেরার পর বাসর ঘরে গিন্নী ক্ষীণকন্ঠে বলেছিল এমন চীৎকার করে চিমটির প্রতিক্রিয়া না জানালে কি হতনা, যদিও চিমটির মাত্রাটা একটু কড়া ছিল? গাড়ীতে ড্রাইভারসহ তিনজন ছিল এ উপলব্ধিটুকু কি থাকা উচিত ছিলনা? তাছাড়া ড্রাইভার ফ্রন্ট মিররে দেখছিল আমরা কিভাবে একজন অপরজনের সাথে লেপটে বসেছি। লজ্জ্বার মাথা খেয়েছিলেন বুঝি?

নিজের অপরাধের মাত্রা একটু লাঘব করার জন্য বললাম আরে ড্রাইভারের কথা ছাড়ো, সেও তো একদিন বিয়ে করেছিল কিন্তু বউয়ের চিমটি কি তার ভাগ্যে জুটেছিল? এদিক দিয়ে সত্যিই আমি ভাগ্যবান। চিমটিতে এত আরাম ছিল যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছিলাম। এ কারণে আমি জেলেও যাবনা, সমাজে নিন্দিতও হবনা, বরং বাড়ীভর্তি মহিলারা ভাবীর মুখে এমন ঘটনা শুনে মনে মনে কল্পনা করবে, হায়রে আমার বরকে এভাবে চিমটি দেওয়ার কথা তখন ভাবিনি কেন, দিলে কতইনা মজা হত। তোমার সুনাম করবে এটা হল্‌ফ করে বলতে পারি।

ছেলেমেয়েদের কেবিনে গিন্নীকে রেখে পুনরায় কেবিনের বাহিরে জাহাজের ডেকে ফিরে এলাম। ঝরে যাওয়া বিবাহিত জীবনের অনেক মধুর স্মৃতি একে একে মনে উঁকিঝুকি দিতে লাগল। আজকের রাতটা দু’জনে মিলে সেই সমস্ত স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু কেন যে ভীমরতি ধরেছিল, এমন সেনসিটিভ ঘটনার অবতারণা না করলে কি হতনা?

পাশের কেবিন থেকে এক ভদ্রলোক ডেকে এসে হাজির। বেচারা হয়তো আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে দেখে রুম হতে বেরোবার প্রয়োজন মনে করেনি। পোষাকে মনে হল সৌদি অথবা আরব-আমিরাতের নাগরিক। চাঁদের কিঞ্চিৎ জ্যোৎস্নায় লোকটিকে সেই ছোট্ট বেলার গল্পের আলীবাবার মত মনে হল। বেশ লম্বা সুঠাম দেহাকৃতির ভদ্রলোক কাছে এসে বিনয়ের সাথে খাঁটি ইংরেজীতে বলল – আপনার কাছে একটু বসতে পারি?

অবশ্যই পারেন, এ সোফাতো শুধু আমাদের জন্য নয় অন্যান্য যাত্রীদেরও অধিকার আছে যদিও বিশাল এ ডেকে কেবিন যাত্রীদের জন্য আরও অনেক সোফা সাজানো রয়েছে। যেহেতু ভদ্রলোকের কেবিন পেরিয়ে আমাদের দু’টো কেবিন।

ভদ্রলোকের ইংরেজী একসেন্ট পশ্চিমাদের মত। নিশ্চয়ই আমেরিকা অথবা ব্রিটেনে পড়াশুনা করেছে। বলল, এতক্ষণ ঘুমাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু ঘুম আসছিলনা চোখে। বুঝলেন -টেনশন এমন একটি জিনিষ যারা এর কবলে পড়েছে তারাই কেবল বুঝতে পারে এর নিদারুণ যন্ত্রণা।

যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে সময় কাটানোর জন্য আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন – বিনয়মিশ্রিত স্বরে বলি।

শেয়ার করতে অসুবিধা হবে কেন? করলে বরং শান্তি পাওয়া যায়। তবে শুরু করার আগে কেবিন থেকে সিগারেট নিয়ে আসতে চাই – ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।

সিগারেট আনতে যেতে হবেনা যদি আমার ব্র্যান্ড পছন্দ করেন তাহলে এই প্যাকেট হতে যতটি ইচ্ছা সাবাড় করতে পারেন। আমার কাছে প্রচুর ষ্টক আছে।

ফ্রান্সের কার্টিয়ার সিগারেট? এ ব্রান্ডের সিগারেট আমার খুব পছন্দ। নিকোটিনলেস। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে ধন্যবাদ দিয়ে একটি সিগারেট নেন।

হ্যাঁ, গত বিশবছর ধরে এ সিগারেট টানছি। যদিও অনেক দামী তবুও ভাল কারণ এ সিগারেটে ক্ষতিকারক নিকোটিন নেই। আর আমার লেখালেখির অভ্যাস আছে। কাজের ফাঁকে লেখালেখিতে সময় কাটাতে ভালবাসি আর এই কার্টিয়ার সিগারেট আমার চিন্তাশক্তিকে সবল করে তুলে। যাক্‌ – যা বলতে চেয়েছিলেন এখন শুরু করতে পারেন যদি আপত্তি না থাকে।

শুরু করার আগে আমাদের পরিচয়পর্বটা সেরে নিতে চাই। আমি আব্দুল্লাহ আল্‌ গামদী। পিতা মরহুম সুলাইমান গামদী, সৌদি নৌ-বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার এডমিরেল এবং নৌ-বাহিনী হতে অবসরে যাওয়ার পর প্রায় পাঁচবছর সরকারের পুলিশ প্রধান ছিলেন। আমরা দু’ভাই এক বোন। বড়ভাই হোসেইন গামদী সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে একজন বিজনেস টাইকন। বড়ভাইকে অনুসরণ করে আলহামদুলিল্লা আমিও বিজনেসম্যান। জেদ্দায় এবং রিয়াদে আমাদের সতেরোটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মিশরের কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, সুয়েজ এবং অন্যান্য কিছুসংখ্যক দেশে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অভারসিজ অফিস ও ফ্যক্টরী রয়েছে। বিজনেস ম্যানেজমেন্টে লেখাপড়া করেছি জেদ্দায় এবং ব্রিটেনে।

সুয়েজ শহরে আমাদের একটি প্রতিষ্ঠানে গতকাল আগুন লেগেছিল, অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, দু’জন শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। অগত্যা এ যাত্রা। বুঝলেন লেবার আনরেষ্ট, জেনারেল ম্যানেজার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ। ক্ষয়ক্ষতির জন্য চিন্তা করছিনা শুধু দু’টো প্রাণ পুড়ে গেল সেটাই দুঃচিন্তার কারণ। এবার বলুন আপনার পরিচয়।

আমার পরিচয় আর কি দেব। জেদ্দায় একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাধারণ একজন বাংলাদেশী কর্মকর্তা। প্রায় দুই যুগ ধরে জেদ্দায় আছি। দৈনন্দিন চাকুরীর অবসরে লেখালেখি করি, বেশ কিছু বইপুস্তক প্রকাশ পেয়েছে। দু’ছেলে ও দু’মেয়ে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে। স্ত্রী বাংলাদেশ দূতাবাস স্কুল ও কলেজের শিক্ষিকা এবং একজন সু-লেখিকাও বটে। তারও বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। লোহিতের তীরের সকল নগর ও জনপদ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সপরিবারে বেরিয়েছি। উদ্দেশ্য শুধু বিনোদনই নয়, এ সমস্ত জনপদের মানুষকে জানা, তাদের সংস্কৃতিকে আমার লেখায় তুলে ধরার এক অদম্য ইচ্ছেও রয়েছে। তাছাড়া সাহিত্যে মিশরের নোবেল বিজয়ী জনাব নাজিব মাহফুজের সাথেও আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্পাদিত বাংলা Óসম্প্রীতিÓ সাহিত্যপত্রিকার জন্য একটি সাক্ষাৎকারের প্রোগ্রামও রয়েছে। কিছুদিন আগে সৌদি সরকারের স্পীকার ডঃ আব্দুল্লাহ ওমর নসীফের সাথেও একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার ছিল যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। ডঃ নাজিব মাহফুজের সাথে সাক্ষাৎকারের অনুমতি পেয়েছি এ কথা জানার পর ডঃ নসীফ আমাকে উৎসাহ জোগালেন এই বলে যে, এই লোকটা সম্মন্ধে উনার বেশ কৌতুহল আছে। লোকটি নাকি একটু পাগলাটে ও নাস্তিক মতবাদে বিশ্বাসী। এটা সত্যি কিনা অর্থাৎ নাজিবের বইপুস্তকে এমন কোন ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায় কিনা তার জন্য তিনি ওনার লিখা কিছু বইপুস্তক পড়ছেন গভীর মনযোগের সাথে। ডঃ নসীফ বলেন ধর্মকর্মে বিশ্বাসী লোকদেরকে নোবেল কমিটি পছন্দ করেনা। এ পর্যন্ত যারা নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে তাদের বেশীরভাগ লোকই নাকি নাস্তিক প্রকৃতির।

ডঃ নসীফ আমার একজন প্রিয় শিক্ষক। জেদ্দার ভার্সিটি জীবনে তাঁর মত গুণী ব্যক্তির সহচর্য্য পেয়েছিলাম। অত্যন্ত অমায়িক ও বিনয়ী ডঃ নসীফ বর্তমানে ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের সভাপতি তা কি জানেন? তিনি জিওগ্রাফীতে ডক্টরেট করেছেন অথচ তার কর্মে তিনি সুপরিচিত ব্যক্তি। বিশ্বমুসলিম ইস্যুতে সোচ্চারের কারণে বিশেষ করে নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রশ্নে ডঃ নসীফ শুরু থেকে সোচ্চার। আব্দুল্লাহ গামদীর ভাষ্যে প্রতিথযশা ডঃ নসীফের গুণকীর্তন ঝরে পড়লো।

হ্যঁ, আমি জানি এবং উনার মত একজন বিনয়ী, সবর্গুণে গুণান্বিত, বিদ্যুষী ব্যক্তি আমাদের সমাজে বিরল – সবিনয়ে বললাম আব্দুল্লাহ গামদীর প্রত্যুত্তরে।

ঠিকই বলেছেন। আমার মরহুম পিতা ডঃ নসীফের নিকটতম বন্ধু ছিলেন। সেই ছোটবেলা থেকে পিতা আমাদেরকে নিরহংকারী ও ডঃ নসীফের মত বিনয়ী হওয়ার পরামর্শ দিতেন। জানেন, আমাদের দু’ভাইয়ের স্কুলের বন্ধে মরহুম পিতা তার অফিসে আমাদেরকে নিয়ে যেতেন। পুলিশ পোষাকধারী টি-বয়কে বলতেন আমাদের মিটিং আছে, ওরা দু‘ভাইকে দিয়ে কনফারেন্স রুমে আমাদের জন্য ছয়কাপ কফি পাঠিয়ে দাও। তার আগে দু’ভাইকে দিয়ে আমার অফিসটি ঝাড়মোছ করিয়ে নাও। পুলিশ প্রধানের আদেশ, কার সাধ্য আছে অমান্য করার। অফিসের পুলিশ কর্মচারীরা নিরবে মরহুম পিতার আদেশ মানতো। আমরা দু’ভাইয়েরও পিতার গুরুগম্ভীর নির্দেশ অমান্য করার সাহস ছিলনা। আমাদের একটি মাত্র বোনকে দিয়ে এঁটো বাসন পরিষ্কার ও ঘর ঝাড়ু দেওয়াতেন। পিতার উপর অনেক রাগ হত। এত লোক থাকতে আমাদেরকে দিয়ে কেন টি-বয় এবং ঝাড়ুদারের কাজ করাবেন?

বড় হওয়ার পর মৃত্যুশয্যায় ডেকে বলেছিলেন তোমাদেরকে ছোটবেলায় এতসব কাজ করিয়েছি কেন জান? যাতে নিরহংকারী হও, নিজের কাজ নিজে করতে জান, পরোমুখাপেক্ষী না হও, মানুষ হিসাবে অন্য মানুষের কষ্ট বুঝতে পার, সর্বোপরি বিনয়ী হতে পার। যদি এতে তোমাদের তাৎক্ষণিক মনোকষ্ট হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে মাফ চাই তবে তোমাদের ভাইবোনের কাছে মাফ চাইবনা কারণ এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট আমাদের নবী এবং খলিফাদের চারিত্রিক গুণাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল। একজন সত্যিকার মানুষ হওয়ার জন্য উত্তম এসব গুণাবলী প্রত্যেক মানুষের জন্য আবশ্যক। সন্তান হিসাবে তোমাদেরকে এধরণের চরিত্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলাম বলেই অনেক সময় নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলাম। আশা করি বাকী জীবনে এ শিক্ষা তোমাদের কাজে লাগাবে।

সত্যি, আপনার মরহুম পিতার মত পিতা আমাদের সমাজে বিরল। স্বীয় সন্তানদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করতে গিয়ে আবেগকে প্রশ্রয় দেননি আর তাইতো আপনার মন মানসিকতায় সেই শিক্ষা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হচ্ছে। বৈষয়িক ক্ষতিকে প্রাধান্য না দিয়ে অগ্নিদগ্ধে মৃত দু’জন কর্মচারীর কথা ভেবে আপনি এত উথলা হচ্ছেন। এমন পিতা আমাদের সমাজের প্রতিটি ঘরে যদি থাকতো তাহলে আজকের সমাজ অন্যধরণের হতো। আপনার পিতার বিরল এ কাহিনী আমার আগামী কোন লেখায় স্থান পাবে। নীরব শ্রদ্ধায় অদেখা প্রয়াত পুলিশ প্রধান সুলাইমান গামদীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করলাম।

আব্দুল্লাহ গামদী নিজ কেবিনে ফিরে গিয়ে আমার জন্য ফ্রান্সের একপ্যাকেট কার্টিয়ার গোল্ড নিয়ে এলেন। বললেন, কথায় ফাঁকে আপনার সিগারেটতো শেষ করে ফেললাম, এ প্যাকেটটি একটু ট্রাই করে দেখুনতো? ভাল লাগবে, এ সিগারেট সম্পূর্ণ টার এবং নিকোটিনমুক্ত, ক্ষতির আশংকা নেই।

অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে এটির কোন প্রয়োজন ছিলনা শুধুমাত্র আপনার সাথে পরিচিত হওয়া এবং কথোপকথনের স্মৃতি ধরে রাখার প্রয়োজনে গ্রহণ করতে বাধ্য হলাম। আমার ব্রান্ডও কার্টিয়ার, নিকোটিন নেই তবে টার কিছুটা আছে আর আপনারটি কার্টিয়ার গোল্ড অর্থাৎ নিকোটিন কিংবা টার-এর কোন ক্ষতিকারক উপাদান নেই। তবে আমরা দু’জনই কার্টিয়ার ভক্ত এ ব্যাপারে কিন্তু বেশ মিল আছে।

কিন্তু একটি ব্যাপারে বোধহয় মিল হবেনা। আমি কিন্তু বিপত্মীক। ব্রিটেনে পড়াশুনার সময় পিতার ইচ্ছাতে অবসর সময়ে লন্ডনস্থ সৌদি দূতাবাসে পার্টটাইম কাজ নিয়েছিলাম। যৌবনের উদ্দাম দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল বেশ আনন্দে। দূতাবাসে পাশাপাশি ডেক্সে কর্মরত খিস্টধর্মে দীক্ষিত ব্রিটিশ নাগরিক হেলেনা ব্রাউনকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। বেশ ভালভাবেই কেটে যাচ্ছিল রোমান্টিক মূহুর্তগুলো। হেলেনা ইসলাম ধর্মে কন্‌ভারট্‌ হয়েছিল বিয়ের পর পর। এদিকে আমার পড়াশুনা প্রায় শেষের পথে। তবে গবেষণার কাজ বেশ কিছু বাকী। হেলেনাকে সন্তান নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানালাম এবং বুঝালাম এই বলে যে, বিয়ে হয়েছে পিতার মতামত না নিয়েই, যদি সন্তান নিয়ে পিতার সামনে হাজির হই তাহলে নাতি বা নাতনীকে তিনি কোলে টনে নিতে বাধ্য হবেন এবং আমাদের বিয়ের স্বীকৃতি দিবেন। হেলেনা আপত্তি জানালো, বলল এত তাড়াহুড়ার কি আছে, কয়েকটা বছর লাইফটাকে এনজয় করি তারপর এ ব্যাপারে চিন্তা করা যাবে।

ভেবে দেখলাম হেলেনার যুক্তিকে উড়িয়ে দেয়া যায়না কারণ আমি এখনো ছাত্র। গবেষণার কাজও এগিয়ে নিতে হবে। পার্টটাইম চাকুরীতে আর কতই বা আসে। এ মূহুর্তে সংসার চালাতে গেলে হেলেনার চাকুরীও জরুরী, তাই ওর যুক্তিকে অগ্রাহ্য করতে পারলাম না।    

পিতার কঠিন তলবের প্রেক্ষিতে আমাকে আকস্মিক একদিন দেশে ফিরতে হল। অনুভব করলাম বিপদ সামনে অপেক্ষা করছে। ভাবলাম আমার প্রগতিশীল পিতা বিয়ের কথা হয়তো জেনে ফেলেছেন এবং আশা করি বুঝিয়ে বললে হয়তো মেনে নিবেন।

ঘরে ফেরার দু’দিন পর পিতা আমাকে অফিসে তলব করলেন। অফিসকক্ষে একটি সোফায় পিতার পাশে বসে জানতে চাইলাম জরুরী তলবের কারণ কি? বললেন, আজ আমরা দু’জন মিলে আধঘন্টার একটি ভিডিও একসাথে দেখব। এতে নিশ্চয়ই শিক্ষনীয় ব্যাপার আছে। ভিডিওটি দেখার পর তোমার মতামত জানাবে।

ভাবনার অতলান্ত গভীরে নিমজ্জিত হয়ে আমার মনে শুধু একটি প্রশ্ন দোল খেতে থাকে, যে পিতাকে কখনো টিভির পর্দায় খবর শুনা ছাড়া অন্য কোন অনুষ্ঠান দেখতে দেখিনি সে পিতা স্বয়ং আমাকে নিয়ে টিভির পর্দায় আধঘন্টার ভিডিও দেখবেন! কি এমন দৃশ্য যা পিতাপুত্রকে একসাথে দেখতে হবে?

গম্ভীর পিতা মনযোগ সহকারে ভিডিওটি দেখতে বললেন। অফিসকক্ষে শুনশান নিরবতা। ছবি শুরু হতেই দেখতে পেলাম আমার স্ত্রী হেলেনা দূতাবাসে কর্মরত অবস্থায় একটি ফাইল গোপনে তার পরণের গাউন অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখতে তৎপর হল। চারিদিকে সতর্ক তার দৃষ্টি। অবশেষে কাজে মনযোগী হল। অফিস শেষে সে দ্রুত বেরিয়ে আসতেই কাল রংয়ের একটি প্রাইভেট কার দূতাবাস গেটে দাঁড়ালো এবং পেছনের দরজা খুলে হেলেনা অতি সন্তর্পনে দ্রুত কারটিতে উঠে পড়তেই ছুটে চলল কারটি অজানা গন্থব্যে।  কিছুক্ষণের মধ্যে কালো রংয়ের কারটি লন্ডনের ডাউনিং স্ট্রিটের প্যালেস হোটেলের পাকিং-এ পৌঁছলো। সামনের সিট হতে নেমে আসা গগলস্‌ পরা লোকটির হাত ধরে হেলেনা হোটেল লবিতে পৌঁছে ফাইলটি হস্তান্তর করে অতি সন্তর্পণে পুনারায় পাকিং-এ ফিরে এসে অন্য একটি সাদা রংয়ের কারে চেপে বসল। পিতা আমার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে বললেন, কিছু বুঝলে?  

নতমস্তকে আমি বুঝেও না বুঝার ভান করলাম। উনি বললেন, তোমার স্ত্রী ইসরাইলী গুপ্তচর, তোমাকে ভালবাসার ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেছে যাতে তার এস্যাইনমেন্ট চালিয়ে যেতে অসুবিধার সৃষ্টি না হয়। মেয়েটির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছ জেনে আমাদের লন্ডনস্থ সৌদি ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর সাহায্য নিয়েছিলাম বলেই না এমন একটি গোপন ভিডিও ওরা পাঠিয়েছে। এ ভিডিওটি না হলে তুমি কি সহজে আমার কথা বিশ্বাস করতে? তোমাকে আর লন্ডন যেতে হবেনা। পারলে অন-লাইনে তোমার গবেষণার কাজ চালিয়ে যাও, আর না পারলেও অসুবিধা নেই। যদি যাও তাহলে ওখানে কর্তব্যরত মোসাদের লোকজন তোমাকে হত্যা করবে। ওরা জানে তুমি সৌদি পুলিশ প্রধানের ছেলে এবং আমরা ইতোমধ্যেই মেয়েটির আসল উদ্দেশ্য যে বুঝতে পেরেছি এটা ওরা জেনে গেছে। এখন তুমি ফিরে যাওয়া মাত্রই তোমাকে হত্যা করার জন্য হয়তো হিথ্র এয়ারপোর্টের আশেপাশেই মোসাদের লোকজন ওৎ পেতে আছে। আর তোমার জানা দরকার মেয়েটি গতকালই সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কর্তৃক চাকুরীচ্যুত হয়েছে।   

নিজেকে অপরাধী মনে হল। এ আমি কি করেছি? একটা বিদেশী গুপ্তচরের সাথে সংসার করেছি। হেরে গেলাম ভালবাসার কাছে। পিতার আদেশ শিরোধার্য। একবার মনে হয়েছিল ফিরে গিয়ে ওর গলা টিপে ধরে বলি, কেন আমার নিঃস্বার্থ ভালবাসাকে এমন করে জলাঞ্জলি দিতে পারলি? তুই একটা মনুষ্যরূপী ডাইনী কিন্তু পারলাম কই? গলা ধরে এল আব্দুল্লাহ গামদীর, হৃদয়ের ক্ষতের গভীরে ভালবাসার অকালমৃত্যু সহ্য করতে যেন কষ্ট হচ্ছে লোকটির।

না পারার জন্য নিজেও বাঁচলেন, দেশকেও বাঁচালেন এটাই বা কম কিসে? আব্দুল্লাহ গামদীকে শান্ত করার চেষ্ঠা করলাম।

আমাদের জাহাজটি সাফাগা বন্দর ছেড়ে আসার পর একটানা পনরো ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে সুয়েজ বন্দরে রাত দু’টায় নোঙ্গর করল। চারিদিকে হৈ-হুল্লাড়, নির্দিষ্ট গন্থব্যে পৌঁছার আনন্দে সবাই মাতোয়ারা।

সুয়েজ বন্দরে আমাদের ইমিগ্রেশন হবে। সপরিবারে জাহাজের বিশাল ওয়েটিংরুমে পাঁচতলার দু’টো কেবিন ছেড়ে নিচে নেমে এলাম। জাহাজের একজন কর্মকর্তা এসে পাসপোর্ট সংগ্রহ করলেন এবং জাহাজের ওয়েটিং রুমে সবাইকে অপেক্ষা করতে বললেন। অসংখ্য লোকের ভিড়ে আমার প্রতিবেশী যাত্রী আব্দুল্লাহ গামদী কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

পনরো মিনিট পর পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে জাহাজ হতে নেমে পড়লাম। গভীর রাতে সুয়েজ বন্দরে পৌঁছে কায়রো যাবার জন্য অধীর আগ্রহে যেকোন ধরণের যানবাহনের অপেক্ষায় ছিলাম। নিঝুম রাতের এ প্রহরে কায়রো যাবার যানবাহন না পেয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বন্দর হতে বন্দর অতিক্রম করে জেদ্দা হতে প্রায় দেড়হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দু’দিন দু’রাত্রি সাগরের উপর ভাসতে ভাসতে সুয়েজ বন্দরে পৌঁছে বেশ ক্লান্তি অনুভব করছিলাম। বিশাল বপুধারী লেবার শ্রেণীর কিছু লোকজন আমাকে সুযোগসুবিধা এবং হোটেলের সন্ধান দিবে বলে এগিয়ে এলো। কে আমার কাছে আগে এসেছে এ নিয়ে দু’পার্টির মধ্যে ইতোমধ্যে বেশ বাকবিতন্ডাও হয়ে গেল।

ঢাকা, করাচী এবং নয়াদিল্লী বিমানবন্দরগুলোর কথা মনে হল। ঢাকা না হয় নিজের দেশ, বিমানবন্দরে আত্মীয়স্বজন এগিয়ে নিতে আসে। না আসলেও আপত্তি নেই। স্বদেশ, মাতৃভূমি – বুকের পাটা শক্ত। গেল বছর নয়াদিল্লী যাওয়ার প্রাক্কালে এক কলিগ বলেছিল – ”দিল্লী কা চাচ্চু, ইয়ে কভি নেহী ভুলো বাচ্চু”। দু’বছর আগে করাচী যাওয়ার প্রাক্কালে পাকিস্তানী এক কলিগ হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছিল –”জরা সমজমে চলো ইয়ার, করাচী মে এয়ারব্যাগ, খালি করো লগালগ”। কথায় আছে সাবধানের মার নেই। হয়তো আমি একটু সাবধানী ছিলাম তাই কোন চাচ্চু বা এয়ারব্যাগ খালি করার মত লোকজন পাত্তা পায়নি।

সুয়েজের অচেনা অপরিচিত পরিবেশে গভীর রাতে নিম্নশ্রেণীর লোকজনদের এরূপ পরোপকারের আশ্বাস মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সবাই মিলে লুটেপুটে নিয়ে আমার পরিবারের সদস্যদেরকে বস্তাবন্দী করে সাগরের অথৈ জলের গভীরে যদি ফেলে দেয় তাহলে হাঙ্গরের ক্ষুধিত পেটে আমাদের স্থান হবে এবং কেউ আমাদের হদিসও পাবেনা। এই ভেবে জড়ো লোকজনের উদ্দেশ্যে বললাম বন্দরের পুলিশ ফাঁড়িতে আমাদেরকে এনট্রি দিতে হবে তাই একটু দেরী হবে। এই বলে বন্দর অফিসে ফিরে এলাম। অফিসে দু-একজন লোক টেবিলে পা রেখে আরামে নিদ্রা যাচ্ছে। চেহারায় একজনকে বিশ্বস্ত বলে মনে হল। ধীর পদক্ষেপে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।

আমাকে ভিনদেশী দেখে লোকটি আধাভাঙ্গা ইংরেজীতে বলল,হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ? কাম টুমরো মর্নিং, নো টিকেট নাও। একটু নড়েচড়ে বসে বিরক্তিভরা মুখে আবার চোখ মুদে লোকটি।

আনা মুশ গাইলাক আসন তসকরা? (আমি আপনার কাছে টিকেটের জন্য আসিনি?)

আরবীতে মিশরীয় উচ্চারণে কথা শুনে লোকটি এবার চোখ মেলে একটু নড়েচড়ে বসে শুধালো - আহ্‌লান ওয়া সাহ্‌লান –ইন্‌তা আইজ এ? মুম্‌কিন আমল্‌লাক্‌ এ? (স্বাগতম, কি চান? কি কাজ করতে পারি আপনার জন্য?) লোকটি জিজ্ঞাসুনেত্রে আমার দিকে চেয়ে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিল।

বললাম -আনা আজনবী, মিন বাংলাদেশ -ওয়া লিচ্ছা গাই দেলোয়াতি, আইজ রুহ্‌ আল কাহেরা, ওয়াল ওয়াক্ত মোতাআখ্‌খের আউয়ি, মাফিস মোয়াচ্ছালাত্‌ দেলোয়াতি, আমল এ ? মুম্‌কিন  ইস্‌তান্না মা’য়াক লগাইত সুবাহ্‌ ? ওয়া হেইয়া দি আল্‌ খেদমা ইল্লি আনা আইজ্‌হা। (আমি বিদেশী, বাংলাদেশী। তাছাড়া এখানে আমি নূতন, কায়রোতে যেতে চাই, রাত বেশ গভীর, কোনরূপ যানবাহন পাচ্ছি না, এখন কি করি? আপনার অফিসে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি? এই খেদমতটুকু আপনার কাছে চাই)

 ব্যাস কিদা ? (শুধু এটুকুই?)

 আইউয়া (হ্যাঁ)

খাল্লিনা সুপ্‌ মুম্‌কিন আমল্‌লাক্‌ এ্যা। তা’য়ালা মা’ইয়া (দেখি, কি করতে পারি আপনার জন্য, আসুন আমার সাথে।)

অন্ধকার রাতের বুক চিরে এগিয়ে চলছে লোকটি। পেছনে নীরবে আমি ওকে অনুসরণ করছি। পরিবারের সদস্যদেরকে অফিসে বসিয়ে রেখে এসেছি। কি করতে চায় লোকটি? কোথায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছে? কোন খারাপ উদ্দেশ্যে নয়তো? লোকটি পোর্টের সরকারী কর্মচারী। অবিশ্বাসের তেমন কোন কারণ নেই। তাছাড়া অফিসে কর্মরত অন্য দু’জনও আমাদেরকে লক্ষ করেছে। ওদেরকে বলে এসেছে ফোনের দিকে ও আমার পরিবারের দিকে খেয়াল রাখতে। কিভাবে লোকটি আমাকে সাহায্য করতে চায় অপেক্ষার বিষয়। অতিআগ্রহ দেখিয়ে প্রশ্ন করলে লোকটি রাগ করতে পারে, অগত্যা চুপ থেকে তাকে অনুসরণ করাই সঙ্গত। প্রায় ছ’ফুট লম্বা, বিশাল বপুধারী লোকটির সাথে তূলনা করলে আমি খেলনা সদৃশ। শরীরের ওজন ওর দেড়শো কেজির নিচে হবেনা। অন্যদিকে আমার উচ্চতার মাফকাঠি পাঁচফিট সাতইঞ্চি ও ওজন মাত্র সত্তর কেজি। মিশরীয় বেশীরভাগ লোকই উঁচু এবং শারীরিক গড়নে মোটা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশীরভাগ লোকই এদের তূলনায় শীর্ণকায়। প্রচুর খেতে পারে এরা। শাকসবজি, ফলমূল সারাদিন ছাগলের মত খায়। আমার কলিগদের অনেককেই দেখেছি আধাকেজি মাংস এরা একবেলা অনায়াসে সাবাড় করে দিতে পারে।

প্রায় আধাকিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লোকটি এবার এক ছোট্ট গলিপথ ধরে এগোতে থাকে। অন্ধকার রাতের শেষ প্রহর। তারার আলোতে পথ দেখে চলেছি। একটি ছোটখাটো কুটিরে পৌঁছে লোকটি হাঁফাতে হাঁফাতে দরজায় ঠোকা মেরে ডাকতে থাকেঃ আলী, ইয়া আলী, ফুক্কুল বাব্‌, উম এস্‌হা (আলী, হে আলী, দরজা খোল্‌,উঠে আয় দেখি?)

দরজা খুলে চোখ রগরাতে রগরাতে আলী নামের লোকটি সামনে এসে বলল -ফি এ্যা উস্তাজ ? (কি চান উস্তাদ?)

খোদ আল্‌ রাগেল্‌ দা ওয়াচ্ছালু লিল্‌ কাহেরা দেলোয়াতি, লিল্‌ মাকান হুয়া আইজ্‌ (এইলোককে নিয়ে এখনই তোকে কায়রো যেতে হবে এবং যে জায়গায় উনি যেতে চান সে জায়গায় সহিসালামতে পৌঁছে দিতে হবে।)

ব্যাস, ইত দুনিয়া লিল্‌ দেলোয়াতি, ওয়া ওয়াক্ত মুতাআখ্‌খের আউয়ি। (কিন্তু এখনতো অনেক রাত, সময়ও সংকীর্ণ)

মত্‌তিস্‌ কাল্লিমস্‌, খালাস। দা ওয়াহেদ্‌ সাহাবী আজিজ আলাইয়া ওয়া আইজ আখদেমুy, ওয়া হুয়া হাইদ্দিক্‌ বকশিস কয়েস (বেশী কথা বাড়াসনে বলছি। উনি আমার পরিচিত বন্ধু মানুষ এবং আমি উনাকে এ খেদমতটুকু করতে চাই, তোকে উনি অবশ্যই বাড়তি বকশিসও দেবেন)

হাদের, আলেসান খত্‌রাক্‌ (ঠিক আছে যাব শুধু আপনার খাতিরে)

এবার আমার দিকে ফিরে ভদ্রলোক বল্লেন – ইজা আবেল্‌তা আই মুসকিলা, কাল্লিম্‌নি আলা রকম দা। খোদ হাগ্গে রকম আত্‌ তেলিফোন (কোনরকম অসুবিধা হলে আমাকে ফোনে জানাতে ভুলবেননা। এই কার্ড রইল)

মুসাক্কের আউয়ি। ইন্‌তা আমেলতুল্লি খেদমা কবীরা, রাব্বানা খাল্লিক্‌ (অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার অনেক বড় উপকারটুকু করলেন। আল্লাহ আপনাকে এর বিনিময় দিবেন)

লা শুকুর আলা ওয়াগেব্‌ (ধন্যবাদ দেবেননা। এটা আমার কর্তব্য)।

আলী গ্যারেজ হতে তার নিজস্ব আশি মডেলের ট্যাক্সি নিয়ে এলে পোর্ট কর্মকর্তা জনাব ইয়াহিয়া মুরশী ও আমি গাড়ীতে চেপে বসে পোর্ট অফিস অভিমুখে রওয়ানা হলাম।

ইয়াহিয়া মুরশীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সপরিবারে এবার কায়রোর পথে রওয়ানা দেই। প্রায় একশো বিশ কিলোমিটার সুয়েজ হতে কায়রোর দুরত্ব। মরুভূমি, উঁচুনীচু পাহাড় আর নীলনদের পাড়ের মিশরীয় সবুজ গ্রাম পেরিয়ে প্রায় আড়াইঘন্টার পথ অতিক্রম করে রাজধানী কায়রোত এসে পৌঁছার পরপরই মসজিদে মসজিদে ফজরের আজানধ্বনির লহরী শুনতে পেলাম। কায়রোবাসী ঘুমুচ্ছে, প্রায় খালি রাস্তায় হেঁটে হেঁটে কেউবা মসজিদে যাচ্ছে।

আমাদের পূর্বনির্ধারিত গন্তব্য আমাদের ’সম্প্রীতি’ সাহিত্য পত্রিকার কায়রো প্রতিনিধি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের বাংলাদেশী ছাত্র জনাব আসলাম উদ্দিনের আল-আব্বাসিয়া রোডের বাসা। আসলাম ও তার বাংলাদেশী সহপাঠি মাহমুদুল হাসান একই বাসায় গত তিনচার বছর ধরে বসবাস করছেন।

ড্রাইভার আলীকে ঠিকানা দিলে কায়রোর বিভিন্ন রাজপথ ও অলিগলি পেরিয়ে আসলামের বাসার দরজায় এলে ড্রাইভার আলী আমাদেরকে গাড়ীতে বসতে বলে নিজে নেমে আসলামের দরজার কড়া নেড়ে নেড়ে ডাকতে থাকে, ইয়া সাইয়েদী, সাইয়েদী, ফুক্কু আল্‌ বাব্‌, ফি ক্বারীব হাগ্গাগ, ফুক্কুল্‌ বাব্‌। (জনাব দরজা খুলুন, আপনার আত্মীয় এসেছেন, দরজা খুলুন)।

উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত মিশর বাংলাদেশ হতে প্রায় চারগুণ বড়। এরিয়া ৩৮৬,৬৬২ বর্গমাইল। দেশটিকে ঘিরে রয়েছে সুদান, লিবিয়া ও ইসরাইল। উত্তরে ভূমধ্যসাগর ও দক্ষিণে লোহিতসাগর। আয়তনে অনেক বড় দেশ হলে কি হবে ? শতকরা নব্বইভাগই ধূসর মরুভূমি। সিনাই, সাহারার একাংশ। লিবিয়া এবং আরবের ধূসর মরুভূমি এবং পাথুরে পার্বত্য অঞ্চল দেশটির শতকরা নব্বই ভাগ জায়গা দখল করে আছে। শতকরা দশভাগ জায়গা জুড়ে নীলনদের পাড় ঘেষে শহর বন্দর আর জনবসতি গড়ে উঠেছে। যদি নীলনদ না থাকতো তাহলে এদেশে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠতো কিনা সন্দেহ।

নীলনদ এঁকেবেঁকে চলেছে দু’পার উর্বর করে, লক্ষ তার উত্তরে ভূমধ্য সাগরের সাথে মিলন। পৃথিবীর দীর্ঘতম নদ এই নীল। উগান্ডার ভিক্টোরিয়া হ্রদ হতে যাত্রা শুরু করে সুদান হয়ে মিশরের মধ্যদিয়ে ৬,৬৬৯ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে মিশেছে ভূমধ্যসাগরে। বয়ে চলা নীলনদ কোথাও প্রশস্থ আবার কোথাও সংকীর্ণ, মৃদৃমন্দ তার গতিপথ। এ নদের পাড়ে দাঁড়ালে মনে পড়ে ফেরাউন বাদশাহদের কথা, মূসা নবী, ইউসুফ নবী এবং অন্যন্য নবী ও সাহাবীদের কথা। কায়রো শহরের বিভিন্ন রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন সাহাবী, নবী পয়গম্বর, সুলতান এবং ফেরাউন বাদশাহদের নামে।

ইতিহাস বিখ্যাত প্রাচীন নগরী কায়রোর জনজীবনে পশ্চিমা ছোঁয়াছ লেগেছে। প্রায় প্রতিটি সরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাক্ষেত্রে, ব্যংকের শাখায় শাখায়, কলকারখানায় মহিলাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত। নীলনদের দু’পাড়ে গড়ে উঠেছে আধূনিক স্থাপত্য, শহর, কৃষিক্ষেত্র ও নূতন নূতন জনবসতি। নীলনদের উর্বর মাটিতে প্রচুর সুস্বাদু ফলমূল ও টাটকা শাকসবজি জন্মে। মিশরের কার্পাস তূলা পৃথিবী বিখ্যাত।

ছয়কোটি মানুষের মিলিত প্রচেষ্ঠায় মিশর এগিয়ে যাচ্ছে ধাপে ধাপে। লোকজন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং কর্মঠ। মিশরীয় রাজনীতিতে মধ্যে মধ্যে সৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠালাভ করেছে এবং জনগণের সশস্ত্র বিপ্লবে সময় সময় ক্ষমতার পালাবদলও ঘটেছে। উগ্রপন্থীর জন্ম হয়েছে আবার সৈরশাসকরা কঠিন হস্তে দমন করতে গিয়ে অনেকের প্রাণনাশও ঘটেছে। যেমন মুসলিম ব্রাদারহুডের তীব্র আন্দোলনের তাপ সহ্য না করতে পেরে অনেক সৈরশাসক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

মিশরের লোকজন খুব ধর্মপরায়ণ, লোকসংখ্যার সিংহভাগই নিবেদিত মুসলিম। মিশর প্রাচীনকাল হতে শিক্ষায় দীক্ষায় অগ্রসর। প্রাচ্য, প্রতীচ্চ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অগণিত ছাত্রছাত্রী বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় সেই প্রাচীনকাল থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার হিসাবে পরিচিত। ইউরোপ যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল তখন মিশরীয় পন্ডিতরা পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রাচীন মিশরীয়রা ছিল পথপ্রদর্শক।

মিশর প্রাচীনকাল হতে বিভিন্ন রাজা বাদশাহের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে তাই নিম্নবিত্তদের মধ্যে একরকম প্রজাসুলভ আচরণ লক্ষ করা যায়। বকশিস কথাটি আরব বিশ্ব হতেই উৎপত্তি। নিম্নবিত্তদের দ্বারা কোন কাজ করালে নির্ধারিত পাওনার উপর বকশিস দাবী করে এবং বখশিস পেলে শ্রমিকশ্রেণীর লোকদের আচরণে কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে। বকশিসের ব্যাপারটি পাকভারত উপমহাদেশেও বিস্তারলাভ ঘটেছে।

অতিরিক্ত টাকা উপার্জনের লক্ষ নিয়ে মিশরের সরকারী উচ্চপদস্থ অফিসার, পুলিশ অফিসার, আর্মি অফিসার, বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা অবসর সময়ে নিজেদের গাড়ীর খরচ উঠানোর জন্য অবসর সময়ে প্রাইভেট ট্রিপ দিতেও দেখেছি এবং আমি সপরিবারে এধরণের যানবাহনে বিভিন্নসময় সওয়ারও হয়েছি। এতে তারা নিজেদেরকে ছোট ভাবেনা আমাদের দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মত। আমাদের শিক্ষিত ও ধনী লোক কিংবা তাদের সন্তানরা নিজেদের ঘরের ছোট ছোট প্রয়োজনীয় সহজ কাজগুলো নিজে করতে চায়না অথচ প্রবাসে অনেক ধনী ও শিক্ষিত লোকদেরকে প্রয়োজনে লেবার কিংবা টেকনিশিয়ানদের অপেক্ষা না করে ঘরের জরুরী কাজগুলো এমনকি সোয়ারেজ লাইনও স্ব-উদ্যোগে পরিষ্কার করতে দেখেছি। আমাদের ধনী লোকেরা দৈনন্দিন খাবার কিনতে বাজারে চাকরবাকরদেরকে পাঠায়, নিজে যেতে লজ্জ্বাবোধ করে। ওখানে ওসবের বালাই নেই তবে মিশরের সরকারী ও আধাসরকারী অফিসগুলোতে আমাদের দেশের মত ঘুষপ্রথা বিদ্যমান তবে কাউকে বিপদে ফেলে নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের ভেতর থেকে অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য।

মিশরে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পরীক্ষা দেওয়ার পর রেজাল্ট বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ঘরে বসে থাকতে হয়না। সরকারী অফিস আদালতে, বেসরকারী সংস্থায়, পুলিশের সাহায্যকারী হিসাবে, আধা-সামরিক বাহিনীতে, ফায়ার ব্রিগেডে, ব্যংকিংসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে, ট্যুরিস্ট স্পটে কিংবা ট্রাফিক বিভাগে নামমাত্র বেতনে ছাত্রছাত্রীদেরকে তিন থেকে ছ’মাসের জন্য সাময়িক চাকুরী দিতে সরকারী নির্দেশ রয়েছে। এ ব্যবস্থা আরব ও উন্নত বিশ্বের সর্বত্রই বিরাজমান। সরকারই নির্ধারণ করে দেয় কোন্‌ ডিপার্টমেন্টে কতজন ছাত্রছাত্রীকে বছরে সাময়িক নিয়োগ দেয়া হবে। এ কারণে অধ্যায়নরত অবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা দায়িত্বশীল হয়ে উঠে এবং পড়াশুনা শেষ করে দেশের সরকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সংস্থায় নিজেদের অবদান রাখতে পারে। কিছুসংখ্যক আরব দেশে পড়াশনার পালা শেষ করে সামরিক বাহিনীতে ছয়মাসের ট্রেনিং নেয়া বাধ্যতামূলক। কথায় আছে “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের যম” তাই অবসর সময় যদি ছাত্রদেরকে কাজে লাগানো যায় তাহলে সরকারী কাজের গতি ত্বরান্বিত হবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া কাজ পেলে ছাত্রছাত্রীরা অহেতুক হরতাল, অনশন ইত্যাদি ধ্বংসাত্বক কাজ হতে বিরত থাকবে এবং ভুল পথে পরিচালিত হবেনা এটাই সত্য। সুয়েজ হতে কায়রো আসার পথে কিংবা কায়রো পৌঁছে ছাত্রদের সাহায্যকারী ভূমিকা দেখে চমকপ্রদ হয়েছি।    

মিশরীয় আরবী ভাষা আমি ভালভাবে রপ্ত করাতে এদেশের লোকদের সাথে আলাপের মাধ্যমে তাদের সমাজের অনেক তথ্য জানতে পেরেছি। সমাজে অভাবগ্রস্থ লোক বেশী বিধায় তাদের আয় বাড়াতে মনোযোগী সবাই। মিশরের প্রাচীন সভ্যতা দেখতে আসে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লোক তাই সরকার এ সমস্ত আগন্তকদের নিরাপত্তা বিধানে পুলিশের পাশাপাশি কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 
পর্যটন শিল্প হতে মিশর সরকারের বাৎসরিক আয় প্রায় চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার সুতরাং এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার বিদেশী পর্যটকদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে। মিশরের প্রাচীন সভ্যতা পাঁচহাজার বছরেরও অধিক পুরানো। এখানে হাজার হাজার বছরের ঐতিয্যকে মিশরীয়রা গর্বের সাথে স্মরণ করে। ভ্রমণ পিপাসুদের অবিরাম আসাযাওয়া এদেশের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে।

কায়রো মহানগরীর ১০-১২ কিঃ মিঃ দক্ষিণ-পশ্চিমে গিজা জেলা। এখানেই পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যে্যর অনন্য নিদর্শন মিশরের বিখ্যাত পিরামিড। মিশরে মোট আশিটি পিরামিড থাকলেও গিজার পিরামিড তিনটিকেই সপ্ত আশ্চর্য্য বলে গণ্য করা হয়। খিস্টপূর্ব ২৬০০ শতাব্দীতে নির্মিত অমূল্য এ তিনটি রত্ন আজও পৃথিবীর মানুষের কাছে এক অদৃশ্য কৌতুহল সৃষ্টি

করে আসছে। প্রতিদিন পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে আগত তিনচারহাজার পর্যটকদের পদভারে গমগম করতে থাকে গিজা এলাকা। হাজার হাজার বছরের ঐতিয্যবাহী পিরামিডের উপর বয়ে গেছে অনেক ঝড়ঝঞ্জা কিন্তু কালের  আবর্তে ধ্বংস হয়ে যায়নি এর কোনকিছু বরং হাজার হাজার বছর ধরে অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে স্বীয় মহিমায়।

১৯৯৮ এর আগষ্টের ভোরবেলা। মেঘমুক্ত আকাশ। চারিদিকে বয়ে চলা নীলনদের মৃদৃমন্দ বাতাস আর গাছে গাছে হিন্দোলিত ফুলের সমারোহের আড়ালে পাখির কলরবে মেতে উঠেছে কায়রো শহর। প্রশস্থ হাইওয়ে ধরে ক্ষীপ্তগতিতে ছুটে চলেছে আমাদের মাইক্রোবাস গিজার উদ্দেশ্যে। চার ছেলেমেয়ে, আমরা দু’জন আর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের ছাত্র আসলামউদ্দিন আমাদের গাইড হিসাবে ঐতিয্যবাহী কায়রোর অজানা ইতিহাস একে একে বলে যাচ্ছেন। পুরানো এ শহরের বুক চিরে নীলনদ বয়ে চলেছে একেবেঁকে। এদিকে আমাদের মন উথলা হয়ে উঠেছে পিরামিডের কাছে যাওয়ার অদম্য আবেগে।

একসময় পৌঁছে যাই পিরামিডের পাদদেশে। ইতিহাস বিখ্যাত পিরামিড স্বীয় গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে শির উঁচু করে।  

পিরামিড হচ্ছে প্রাচীন মিশরীয় ফেরাউন রাজাদের জন্য নির্মিত সুবিশাল স্মৃতিসৌধ। যার ভিত্তি চতুর্ভূজ এবং দেয়ালগুলো ত্রিভূজ আকারে উপরের দিকে ক্রমশঃ চূড়ায় গিয়ে এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। ভেতরে অনেকগুলো কক্ষ আছে। এর এক একটি কক্ষে পাথরের তৈরী সমাধিতে নির্ধারিত ব্যক্তির মমি সংরক্ষণ করা হত। বহুকক্ষ বিশিষ্ট এক একটি পিরামিডে মৃত ব্যক্তির লাশ সংরক্ষণের  নির্ধারিত কক্ষ ছাড়াও মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনালয়ও রয়েছে। উপরে উঠার জন্য গিরিপথের মত একটিমাত্র সরু রাস্তা। খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০-২৩০০ শতাব্দী জুড়ে নির্মিত গিজার তিনটি পিরামিড প্রসিদ্ধ ও বহুল আলোচিত।

প্রাচীন মিশরীয়রা মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম এবং আত্মার মৃত্যু নেই বলে বিশ্বাস করতো। তারা এও বিশ্বাস করতো আত্মা একসময় তার দীর্ঘ পরিভ্রমন শেষে পুনরায় দেহে প্রবেশ করবে। এ বিশ্বাসই তাদেরকে মৃত ব্যক্তির লাশ পচন হতে মুক্ত রাখার কলাকৌশল আবিষ্কারে এবং পিরামিড তৈরীতে অনুপ্রাণিত করে।    

সুদীর্ঘ চেষ্ঠা এবং গবেষণার পর আবিষ্কিৃত হয় মমিপদ্বতি। প্রথমে তারা মমি সংরক্ষণের জন্য মাটিতে গর্ত করেই লাশ দাফন করতো। প্রত্যহ লাশের জন্য খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র দিয়ে আসতো। আত্মা যাতে তার দেহ চিনতে পারে তারজন্য কাপড়ে পেঁচানো মমির উপর মৃত ব্যক্তির ছবি অংকন করে রাখতো।

এতকিছুর পরও দেখা গেল কালের আবর্তে দাফনকৃত মমিটি নষ্ট হয়ে গেছে। এবার তারা দাফনপদ্বতি পরিবর্তন করে মাটির উপরে প্রস্তরনির্মিত সমাধিপ্রথা চালু করে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাধিগুলোতেও নির্মিত হতে থাকে আলীশান ইমারত কিন্তু তাতেও তারা সন্তুষ্ট নয়।  

খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ শতাব্দীতে এসে তারা আরও উন্নত পদ্বতিতে মৃতদেহ সংরক্ষণের এক অভিনব পন্থা আবিষ্কার করে যা পিরামিডের আকারে রূপ নেয়।

খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮০-২৫৬০ শতাব্দীতে মিশরীয় সভ্যতা উন্নতির শীর্ষচূড়ায় উন্নীত হলে পিরামিড তৈরীর হিড়িক পড়ে যায়।

তৎকালীন বিখ্যাত প্রকৌশলী ‘ইমতুহার’ তার প্রিয় রাজা ‘জুসার’ জন্য সর্বপ্রথম পিরামিডের পরিকল্পনা ও নকশা তৈরী করে। তিনি সাদা রংয়ের আঁঠালো পাথর দ্বারা সাততলা বিশিষ্ট গোলাকৃতি সমাধি নির্মাণ করেন। যার নিচতলায় ছিল চলাচলের পথ ও অনেকগুলো কামরা। একটিতে ছিল রাজার মৃতদেহের জন্য প্রস্তরে খোদাই করা সমাধিস্থান। এটিই ইতিহাসের প্রথম পিরামিড।

রাজা জুসাসের মৃত্যুর পর তার পুত্র “সাখ্‌মাখাত” পিতার আকৃতিতে দ্বিতীয় পিরামিড নির্মাণ শুরু করলেও কাজ শেষ হওয়ার পূর্বেই পরপারে যাত্রা করেন।

চতুর্থ বংশের রাজা “সানফারু” ভিন্ন পদ্বতিতে ৪৮ ফিট উঁচু নূতন পিরামিড তৈরী শুরু করেন যা পূর্বের সাততলা বিশিষ্ট পিরামিডের চেয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কিন্তু এ পিরামিডের নকশা ও ভিত্তিতে ত্রুটি থাকায় অচিরেই তা ধ্বসে পড়ে। খেসারতসরূপ প্রকৌশলীগণের সিদ্ধান্তে এবার “সাফ্‌ফারা” নামক স্থানে চতুর্ভূজ ভিত্তির উপর ৯৯ মিটার উঁচু ও ২২০ মিটার চৌহদ্দি নিয়ে ত্রিভূজ আকারে বিশাল পিরামিড তৈরী হয়। প্রকৃতপক্ষে এটাই প্রথম পূর্ণাঙ্গ পিরামিড।

খ্রিস্টপূর্ব ২৬৩৩-২৬৪৬ শতাব্দীতে রাজা “খুফু” তার কল্পিত সমাধিস্তম্ভে আরো বিশাল পিরামিড নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এরজন্য বেছে নেন নীলনদের পশ্চিম অববাহিকার ধূ ধূ মরুভুমি। একলক্ষ শ্রমিকের বিশবছর পরিশ্রমের পর তৈরী হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ পিরামিড যা পৃথিবীবাসীকে গোঁলকধাঁধায় ফেলে দেয়। তেরো একর ভূমির উপর এ পিরামিড তৈরী করতে তেইশ লক্ষ পাথর লেগেছে। যেগুলোর প্রতিটির ওজন ২.৫ টন করে। এ পিরামিডের উচ্চতা ৪৮১ ফুট, পার্শ্ব ৭৫৬ ফুট লম্বা এবং চৌহদ্দি ২২৩০ মিটার। রাজা “খুফু” তার পিরামিডের পাশে তার তিন রাণীর জন্য ছোট্ট আকারের তিনটি পিরামিডও তৈরী করেন। তার অদুরে তৈরী করেন বিশাল উপাসনালয়।     

রাজা “খুফুর” মৃত্যুর পর তার পুত্র “খাফরা” একই আকৃতিতে পিতার পিরামিডের পেছনে তৈরী করেন পরবর্তী পিরামিড। যার উচ্চতা ১৪৩.৫০ মিটার, চৌহদ্দী ২৫০.৫০ মিটার। খাফরা তার সমাধিস্তম্ভের একটু দুরে মানুষের মুখাকৃতি সিংহ দেহবিশিষ্ট সুবিশাল স্ফিংক্স নির্মাণ করেন। 

খাফরার মৃত্যুর পর তার পুত্র “মানকারা” বাপ দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে একই আকৃতিতে পিতার পিরামিডের পেছনে তৃতীয় পিরামিডটি নির্মাণ করেন। যার উচ্চতা ৬৬.৫০ মিটার ও চৌহদ্দি ১০৮.৫০ মিটার। এ তিন পিরামিডই সর্ববৃহৎ পিরামিড এবং এগুলো পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যে্যর খাতায় স্থান করে নিয়েছে।

মিশরে প্রায় আশিটি পিরামিডের মধ্যে উপরোক্ত তিনটি ছাড়া গিজার ষোল কিলোমিটার দক্ষিণে সাখ্‌খারায় আটটি এবং আল-ফাইয়ূমে বেশ কয়েকটি পিরামিড দেখা যায় যেগুলো অদ্যাবধি অক্ষত আছে।

পিরামিডের চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে এসব প্রচীন কীর্তিগুলো দেখছিলাম। চারিদিকে ধূ ধূ মরুভূমি। গ্রীষ্মের দাবদাহে পিরামিড প্রাঙ্গনে খইফুটা বালুকণা ও পাথরের নূড়ি সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে আর মাঝখানে তিনটি বিশাল আকৃতির পিরামিড সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।

জনপ্রতি বিশ মিশরীয় পাউন্ডের (গিনি) টিকেট কিনে পিরামিড অভ্যন্তরে দেখতে গিয়ে পাথরের সিড়ি বেয়ে প্রায় বিশ মিটার উঁচুতে প্রবেশপথে পৌঁছতেই প্রহরী আমাদের ক্যামেরা এবং হ্যান্ডব্যাগ নিজের জিম্মায় নিয়ে নেয় যাতে আমরা ভেতরে ছবি তুলতে না পারি। ভয়ংকর গিরিপথের মত সরু সুড়ঙ্গপথ যা কঠিন শিলা ভেদ করে উপরে চলে গেছে সোজা ”খুফুর” সমাধিস্থল পর্যন্ত। ভেতরে প্রবেশ করতেই হাজার হাজার বছরের প্রাচীন শিল্পকর্ম দেখে সম্মোহিত হয়ে যাই। প্রথমে দশমিটার পর্যন্ত সমতল। এরপর দু’টো পথ চলে গেছে উপরে ও নিচে প্রায় ১০০ মিটার পর্যন্ত। নিচের সুড়ঙ্গ পথটি নেমে গেছে পিরামিডের ভিত্তিস্থল পর্যন্ত। আলো ও অক্সিজেনের অভাব হওয়ার আশংকায় নিচে নামার পথটি ভিত্তিপ্রস্থরের কয়েক মিটার পূর্বের প্রবেশদ্বার তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে।

উপরে উঠার পথটিই পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। কাঠের রেলিং দেওয়া বিচিত্র এ সুড়ঙ্গপথ। কূঁজোবুড়ির মতই পিঠ বাঁকা করে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। বৈদ্যুতিক বাতিতে সুড়ঙ্গপথ আলোকিত করে রাখা হয়েছে। একেকটা সিড়িতে পা রাখতেই একেকটা প্রশ্নের জট খুলো যাচ্ছিল। কি করে পিরামিডের চূঁড়ায় উঠার এই একশো মিটারের সুড়ঙ্গ পথটি নিখুঁতভাবে প্রাচীন ইঞ্জিনিয়াররা নকশা করতে সমর্থ হয়েছিল তা ভাবতে আশ্চর্য্য লাগে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনে বর্ণিত আছে “তোমরা নিজেদেরকে অধিক শক্তিশালী ভেবোনা, তোমাদের পূর্বে অনেক জাতি গত হয়েছে যারা তোমাদের চেয়ে অধিক শক্তিমালী ও বুদ্ধিমত্তায় প্রবল ক্ষমতাশালী ছিল”।   

তখনতো ছিলনা বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের শক্তিশালী যন্ত্রদানব। শ্রমিকরাই বা কি করে বিশাল বিশাল আড়াইটন ওজনের পাথরখন্ড কেটে কেটে নির্মাণ করতে পেরেছিল এই সুড়ঙ্গপথ রাজা ফুফুর সমাধিস্থল পর্যন্ত। উপরের স্তরে পৌঁছার পর সামনে পড়ে কালো পাথরের তৈরী গেট। বিদ্যুতের আলো কালো পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে তৈরী করেছে ভিন্ন এক সৌন্দর্য্য। জনমানবহীন জগতে এক পাথরের জগত। গেট পেরিয়ে উত্তর পাশের একটি রুম জুড়ে রয়েছে কালোপাথরে খোদাই করা মধ্যমাকারের উঁচু রাজা খুফুর সমাধিস্থল। যুগ যুগ ধরে এখানেই ছিল খুফুর মমিটি। বর্তমানে  মমিটি স্থানান্তরিত করা হয়েছে কায়রো মিউজিয়ামে।

মতান্তরে ধারণা করা হয় ফেরাউন গোত্রের রাজা খুফু কিংবা তোতেনহাম-২ অথবা রামসেস-২ সৈন্যসামন্ত নিয়ে মূসা নবীকে ধাওয়া করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমে লোহিতের অথৈ জলের গভীরে তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে নিমজ্জ্বিত হয়েছিল। ফেরাউন রাজা রামসেস-২ মূসা নবীর পিছু নিয়েছিল বলে বেশীরভাগ ঐতিহাসিকদের মত।

সাম্প্রতিককালে তাদের একজনের মৃতদেহে ফ্রান্সের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে লবণের অস্থিত্ব পাওয়া যায়।ফ্রান্সের গবেষক ডাক্তার মরিস বুকাইলি যিনি ফেরাউন রাজার মমির পরীক্ষাকার্যে্য নিয়োজিত ছিলেন তিনি পবিত্র কু’রআনের বর্ণনামতে মুসা নবীর পিছু নেওয়া ফেরাউন রাজার মমি পরীক্ষা করে সাগরের নোনা জলের অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়ায় পবিত্র কু’রআনে বর্ণিত এ সুরা পড়ার আগ্রহ অনুভব করেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কু’রআন পড়া শুরু করেন এবং ক্রমে কু’রআনকে ভালভাবে বুঝার জন্য আরবী ভাষার উপর দক্ষতা অর্জন করেন।

পবিত্র কু’রআনে বর্ণিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সত্য ক্রমেই তাকে উৎসাহিত করে তুলে। বাইবেল ও কু’রআনের তূলনামূলক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে তিনি স্বীকার করেন পবিত্র কু’রআনই একমাত্র অপরিবর্তিত ধর্মগ্রন্থ যা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মত পরিবর্তিত হয়নি। অবশেষে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ”দ্যা কু’রআন, দ্যা বাইবেল এন্ড দ্যা সাইন্স” রচনা করে বিশ্বাসীর কাছে প্রমাণ করেছেন, পবিত্র কু’রআনই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যাতে কোন ভুল নেই কিংবা এর একটি শব্দও পরিবর্তন করা হয়নি এবং বৈজ্ঞানিকভাবে কু’রআনে বর্ণিত সকল তথ্যই প্রতিষ্ঠিত। এ সত্যটি অনুধাবন করার পর তিনি খ্রিস্ট ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।

পবিত্র কু’রআনে ফেরাউন রাজার পরিণতি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, “ আমি যখন বনি ইসরাইলকে দরিয়া পার করে দিলাম, অতঃপর পশ্চাদ্বাবন করল ফেরাউন ও তার লক্সরবৃন্দ অবাধ্যতা ও প্রতিহিংসাবশতঃ এ পর্যন্ত যে, যখন ফেরাউন ডুবতে লাগল তখন সে বলল, আমি ঈমান এনেছি যে, তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, যার উপর ঈমান এনেছে বনি ইসরাইল- আমিও তাঁর আজ্ঞাবহদের মধ্যে। তখন আল্লাহ ফেরাউনকে বললেন, নিশ্চয়ই তুমি অবাধ্যতা করেছিলে, এর আগে তুমি ফ্যাসাদকারীদের মধ্যে ছিলে। অতএব আজ তোমার জীবনকে নয়, তোমার দেহকে পানিতে নিমজ্জ্বিত হওয়া থেকে রক্ষা করব এই উদ্দেশ্যে যে, যারা তোমার পরে আসবে তাদের জন্য তোমার দেহ যেন শিক্ষনীয় হয়।” (সুরা ইউনুসঃ ৯০-৯১ অনুচ্ছেদ)               

স্ফিংক্স নির্মাণের রহস্যঃ

স্ফিংক্স হল পিরামিডের সামনে বিশাল এবং ভয়ংকর প্রস্তর মূর্তি। যার মুখমন্ডল মানুষের এবং শরীর সিংহের। লম্বা ৫৭ মিঃ, উচ্চতা ২০ মিঃ, চেহারায় দৈর্ঘ্য ৫ মিঃ, প্রস্থ ৫ মিটারেরও কিছু কম, কান দু’টো ১ মিটারের কিছু বড়, মুখটি ২২.১ মিঃ. এবং পরিধি ৯১ ফুট।

প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত এ স্ফিংক্স মূলতঃ তিনটি পিরামিডের প্রকৃত পাহারাদার দেবতা। রাজা খুফুর পিরামিডের জন্য আনা প্রতিটি আড়াই টন ওজনের পাথরের অবশিষ্টাংশ দিয়েই স্ফিংক্স তৈরী হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ শতাব্দীতে রাজা খাফ্‌রা পিতার সমাধির পশ্চাতে যখন নিজের পিরামিড তৈরীর সংকল্প করেন তখন দুই উপাসনালয়ের মাঝখানে পড়ে থাকা এক বিশাল প্রস্তরখন্ডকে অন্য কাজে ব্যবহারের চিন্তা করা হয়। অবশেষে রাজা খাফরার মুখাকৃতিতে এ বিশাল মূর্তি নির্মাণ করা হয়। মিশরীয় প্রাচীন জনগণ রাজাদের প্রতিকৃতিকে মাহকাশের হোরাস দেবতা হিসাবে বিশ্বাস করতো এবং রাজাদের মূর্তিকে ঘিরে পূজা অর্চনা করতো। তারা রাজা খাফরার প্রতিকৃতি এমনভাবে নির্মাণ করেছিল যাতে রাজা শান্ত, দৃঢ়, তীক্ষ ও বিচক্ষণ হিসাবে প্রতিভাত হন। রাজার শৌর্য্যবীর্যের প্রতীক হিসাবে সিংহের দেহের আকৃতিতে পা দু’টো সামনের দিকে প্রসারিত অবস্থায় সাজানো হয়েছে।

মিশরীয় স্ফিংক্স তৈরীর এ অমূলক বিশ্বাস ও পদ্বতি পরবর্তীতে সিরীয় ও গ্রীক সভ্যতা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তবে তারা স্ফিংক্সয়ের আকৃতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটায়। এর বক্ষ ও মাথা নারী আকৃতিতে রূপান্তরিত করে। সে সাথে মহত্ব ও শৌর্যে্যর প্রতীক হিসাবে ঈগলের পাখা এবং শঠতার প্রতীক হিসাবে সাপের মাথা ও লেজ যুক্ত করে। গ্রীক সভ্যতায় স্ফিংক্সকে নারী দৈত্য হিসাবে ধারণা করা হত। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর যত স্ফিংক্স তৈরী হয়েছে তন্মধ্যে পিরামিড সংশ্লিষ্ট স্ফিংক্সটি সর্ববৃহৎ ও রহস্যময়।

তন্ময় দৃষ্টিতে দেখছিলাম রহস্যে ঘেরা পিরামিড অংগন। এরই মধ্যে তিন-চারঘন্টা কখন যে অতিবাহিত হয়ে গেল টেরই পাইনি। হাজার হাজার পর্যটকদের উপস্থিতিতে পিরামিড অঙ্গন মুখরিত। এখনও মিশরীয় প্রাচীন সভ্যতার অনেক কিছুই দেখার বাকী। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সূর্য্যকিরণ পিরামিডের গায়ে লেপটে আছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাদের আস্তানার পথে পা বাড়ালাম। পরদিন শুরু হবে কায়রো মিউজিয়াম পরিদর্শন।

পরদিন আমার পরিবার ও আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের ছাত্র আসলামউদ্দিনসহ আমরা সাতজন একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে কায়রো মিউজিয়াম পরিদর্শনে সকাল দশটার দিকে রওয়ানা হলাম। পৌঁছেই জনপ্রতি মিশরীয় বিশপাউন্ড করে টিকেট কিনে বডি চেকিং শেষে রাজকীয় মমি সংরক্ষণাগারে প্রবেশের অনুমতি পেলাম।

স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস পরিবেষ্ঠিত তৎকালীন ফেরাউন রাজা ও রাণীদের মমি করা লাশগুলো একে একে দেখছিলাম। প্রত্যেক লাশের পাশে তাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নাম লিখা রয়েছে। পবিত্র কু’রআনে বর্ণিত উক্তিটি মনে হল ”তোমার দেহকে পানিতে নিমজ্জ্বিত হওয়া থেকে রক্ষা করব এই উদ্দেশ্যে যে যারা তোমার পর আসবে তাদের জন্য তোমার দেহাবশেষ যাতে শিক্ষনীয় হয়”। এদের মধ্যেই একজন ফেরাউন রাজা রয়েছে যাকে তার সৈন্যসামন্তসহ লোহিতের অথৈ জলে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে সাগরে ভাসমান ফেরাউনের মৃতদেহ এনে পিরামিড অভ্যন্তরে সংরক্ষণ করা হয়। পরে পিরামিডের কবর অভ্যন্তর হতে সরিয়ে মিউজিয়ামে নেয়া হয়।

পবিত্র তৈারাত এবং কু’রআনের বর্ণনা অনুযায়ী তৎকালীন ফেরাউন রাজার রাজপ্রাসাদে মূসা নবী পালিত হয়েছিলেন। গণকের গণনায় তখনকার ফেরাউন রাজাকে হুশিয়ার করে দেয়া হয়েছিল এই বলে যে, মিশরে বসবাসকারী বনি-ইসরাইলীয়দের বংশে জন্ম নেয়া এক ছেলে তৎকালীন ফেরাউন রাজার শত্রু হবে এবং সে বড় হয়ে রাজার পতন ঘটাবে। গণকের ভবিষ্যতবাণী অনুসারে ফেরাউন বাদশাহের আদেশ জারী হল,এখন থেকে বনী ইসরাইল বংশের নবজাতক কোন ছেলেশিশুকে বাঁচিয়ে রাখা যাবেনা।

পিতা ইমরানের ঔরসে এবং বনী ইসরাইল বংশীয় ইবরানী মাতার গর্ভে এক ফুটফুটে শিশুর জন্ম হলে তাকে তিনমাস লুকিয়ে রাখা হল কিন্তু যখন ফেরাউনের লোক লক্সরের তীক্ষ দৃষ্টি থেকে আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা ভেবে তাকে হত্যার আদেশ থেকে বাঁচাতে নলখাগরার তৈরী একটি ঝুড়িতে তেল এবং আলকাতরা মাখিয়ে টুকরিটা নীলনদে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সেই ভেলাটি নীলনদে ভাসতে ভাসতে ফেরাউনের প্রাসাদের পার্শবর্তী ঘাটে এসে ভিড়ে। ছেলেটির কি দশা হয় তা দেখার জন্য ছেলেটির বোন সেখান হতে কিছুদুরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল।

নদীতে স্নান করতে আসা ফেরাউন তনয়া এবং দাসীরা ভেসে আসা এ সুন্দর ছেলেশিশুটিকে নদীপাড়ের নলখাগরার বনে টুকরির মধ্যে কাঁদতে দেখে শাহজাদীর খুব মায়া হল। অদুরে অপেক্ষমান ছেলেটির বোন কাছে এসে শাহজাদীকে বলল, আমি কি আপনার জন্য একজন স্ত্রীলোক ডেকে আনব, যে এ শিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে। শাহজাদী বলল, ঠিক আছে নিয়ে আস।, তখন মেয়েটি তার মা’কে নিয়ে আসল।

শাহজাদী বলল ”এই শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে আমার হয়ে তোমার বুকের দুধ পান করিয়ে লালন-পালন কর। এরজন্য আমি তোমাকে বেতন দেব এবং ছেলেটি একটু বড় হলে আমার কাছে নিয়ে আসবে। শাহজাদীর ইচ্ছা এবং আদেশের কারণে ফেরাউনের লোকজন ছেলেটিকে হত্যা করা হতে বিরত রইল এবং শাহজাদীর নির্দেশে ব্যাপারটি ফেরাউন বাদশাহের কাছে গোপন রাখল।

ছেলেটি একটু বড় হলে তার মাতা নির্দেশনানুযায়ী ছেলেকে ফেরাউনের প্রাসাদে শাহজাদীর কাছে নিয়ে আসলো আর ফেরাউন পত্নী আছিয়া ছেলেটিকে নিজের ছেলে হিসাবে গ্রহণ করলেন এবং শাহজাদী বললেন আমি ওকে নদীর জল হতে তুলে এনেছি সেজন্য এই ছেলেটির নাম দিলাম ”মূসা”।

পিতা ইমরানের ঔরসে মূসার আরেকজন বড় ভাই ছিলেন তার নাম হারুণ। প্রাপ্ত বয়সে তাঁরা উভয় ভ্রাতাই আল্লাহর ইচ্ছায় বনী ইসরাইলীয়দের নবী হিসাবে আবির্ভূত হন এবং তৎকালীন ফেরাউন বাদশাহকে আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে উপদেশ দেন। যেহেতু তৎকালীন ফেরাউন বাদশাহ নিজেকে খোদা বলে দাবী করত এজন্য ক্ষিপ্ত হয়ে মূসা, হারুণ এবং বনী ইসরাইলীয়দের উপর প্রচন্ড জুলুম এবং অমানবিক আচরণ শুরু করে।

জুলুমের এক পর্যায়ে মূসা আল্লাহর নির্দেশে আল্লাহর উপাসনা করার জন্য বনী ইসরাইলীয়দের তথা ইবরানী সম্প্রদায়কে নিয়ে মিশর ত্যাগের আবেদন জানালে ফেরাউন রাজী না হওয়ায় নির্যাতনের মাত্রা আর বৃদ্ধি পায়। ব্যক্ত থাকে যে, মিশরে বসবাস করার কারণে বনী ইসরাইলীয়দেরকে দিয়ে তৎকালীন ফেরাউন বাদশাহ মিশরের কৃষিক্ষেত্র এবং পিরামিড তৈরীসহ যাবতীয় কঠিন কাজগুলো করাতো এবং ক্রীতদাসের মত আচরণ করত, এ কারণে বনি ইসরাইলদেরকে নিয়ে মূসার দেশান্তরী হওয়ার আবেদন ফেরাউন বার বার নাকচ করে।  

তৌরাত ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী মূসা আল্লাহর কাছে ফেরাউনের জুলুম হতে মুক্তি প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাঁর ডাকে সাড়া দেন এবং মিশর এবং ফেরাউন রাজত্বের উপর পর পর দশটি গজব নাজিল করেন, যা হলঃ

 

১-রক্তাক্ত নীলনদঃ

ফেরাউন নদীর ঘাটে একাকী মূসার সাথে দেখা করে বলল, আমার প্রজারা আমাকে খোদা বলে মানে কিন্তু তুমি তাদের বিশ্বাস নষ্ট করছ। মূসা পরিবর্তে আল্লাহর প্রভুত্বকে স্বীকার করতে ফেরাউনকে উপদেশ দেন, ফলে ফেরাউন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ঠিক তখনই অলৌকিক ক্ষমতাবলে প্রাপ্ত হাতের লাঠি দিয়ে মূসা খোদার নির্দেশে নীলনদের জলের উপর আঘাত করেন আর তখনই ফেরাউনের চোখের সামনে নদের জল রক্তাক্ত হয়ে গেল। সকল মাছ ভেসে উঠল এবং পঁচে গলে দূর্গন্ধযুক্ত হয়ে গেল। সমগ্র মিশরের জলের সকল উৎস রক্তাক্ত হয়ে দুষিত হয়ে যাওয়ায় কোথাও বিশুদ্ধ জল পাওয়া গেলনা।ফেরাউন বিপাকে পড়ে মূসা নবীকে গোপনে অনুরোধ করলো এই বলে যে, তোমার রবের কাছে প্রার্থনা কর যাতে আমরা পূর্বের মত বিশুদ্ধ জল পাই। মূসা মানুষের কষ্টের কথা ভেবে রবের কাছে প্রার্থনা করলে এ দূর্গতির অবসান ঘটে।

২-ব্যাঙের উৎপাতঃ

এবার মূসা নবীর উপর আল্লাহর নির্দেশ এলো তুমি ফেরাউনকে বল, সে যাতে তোমাদেরকে আমার এবাদত করার জন্য পূর্বঘোষিত পবিত্র ভূমিতে যেতে দেয় এবং যদি না দেয় তাহলে আমি ব্যাঙের উৎপাত সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। মূসা নবী আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ফেরাউনকে বলার পর ফেরাউন ক্ষিপ্ত হয়ে অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে মিশরের একমাত্র মিষ্টি জলের উৎস নীলনদ ব্যাঙে ভরে গেল এবং কোটি কোটি ব্যাঙ ফেরাউনের প্রাসাদসহ রাজন্যবর্গের লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিছানা এবং খাদ্যের পাত্রসহ সর্বত্রই ব্যাঙের ছড়াছড়ি। বিপাকে পড়ে এবারও গোপনে ফেরাউন মূসাকে অনুরোধ করে তাঁর রবের কাছে প্রার্থনা করতে যাতে এই বিষাক্ত ব্যাঙগুলো সরে যায়। লোকজনের দুঃখকষ্টের কথা ভেবে মূসা আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলে ব্যাঙের উৎপাত হতে সকলে মুক্তি পায়। ব্যাঙগুলোর কিছুঅংশ নীলনদে ফিরে যায় এবং বেশীরভাগই মারা যায়। ব্যাঙের উৎপাত হতে রক্ষা পেলে ফেরাউনের মন পুনরায় শক্ত হল এবং নিজেকে খোদা দাবী করে ব্যাঙের উৎপাত হতে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রজাদের বাহবা এবং শ্রদ্ধা পেল। 

৩-মশার উৎপাতঃ

ফেরাউনের অবাধ্যতার জন্য এবার আল্লাহর কাছ হতে নির্দেশ এলো, হে মূসা তোমার ভাই হারুণকে বল ধূলার উপর তোমার অলৌকিক লাঠি দিয়ে আঘাত করতে। নির্দেশনানুযায়ী হারুণ নবী তাই করলেন তখন ধূলা উড়তে থাকলো এবং ফেরাউনের প্রাসাদসহ সর্বত্রই মশায় ছেয়ে গেল। মশার উপদ্রবে যখন ফেরাউন এবং তার রাজন্যবর্গরা অতীষ্ট হয়ে গেল তখন ফেরাউন দেশের সমস্ত জাদুকরকে আহ্বান জানালো জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে মশা নিধন করতে। জাদুকরেরা অপারগ হওয়াতে পূর্বের মত গোপনে ফেরাউন মূসার কাছে আবেদন জানালে মূসা মিশরীয়বাসীদের কষ্টের কথা ভেবে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলে সকল মশা মরে গিয়ে উৎপাত বন্ধ হল। ফেরাউন নিজেকে খোদা দাবী করে এবারও প্রজাদের প্রশংসা কুঁড়ালো।

৪-পোকার উৎপাতঃ

মূসা ফেরাউনকে বললেন এবার আমার লোকজনকে নিয়ে আল্লাহর এবাদত করার জন্য মিশর ত্যাগের অনুমতি দিন নতুবা ফের আল্লাহর গজবে নিপতিত হবেন কিন্তু ফেরাউন এ অনুরোধে কান না দেওয়াতে এবার এক ধরণের বিষাক্ত পোকার উৎপাত শুরু হল। রাজপ্রাসাদ এবং রাজ্যের কর্মচারীদের সকল অবস্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে বিষাক্ত পোকা ঢুকে গেল এবং তাদের জীবন তছনছ করে দিতে লাগল কিন্তু পার্শবর্তী মরুভূমিতে মূসার লোকেরা নিরাপদ রইল। ফেরাউন এবার গোপনে মূসাকে বলল, হে মূসা তোমার প্রভুকে বল পোকাগুলো সরিয়ে নিতে এর বদলে তোমাদের পশু কুরবানীতে আমি বাঁধা দেবনা এবং তোমার লোকদেরকে নিয়ে মিশর ত্যাগের অনুমতির ব্যাপারে চিন্তা করব। মুসা ফেরাউনের অনুরোধে তার প্রভুর কাছে অনুনয় বিনয় করে দোয়া করলেন এবং খোদার নির্দেশে বিষাক্ত সব পোকাগুলো অপসারিত হল কিন্তু ফেরাউনের মন আবারও শক্ত হল এবং মূসার সাথে পুনরায় চুক্তিভঙ্গ করল।

৫-পশুর মহামারীঃ

ফেরাউনের কাছে খোদার নির্দেশে মূসা তার লোকদেরকে প্রভুর উপাসনা করার জন্য অন্যত্র যাওয়ার অনুমতি চাইলেন কিন্তু ফেরাউন মূসাকে বললেন তোমার লোকেরা আমাকে খোদা মেনে যেন আমার উপাসনা করে এবং আমার নামে কুরবাণী করে। এ কারণে মূসার খোদা মূসাকে বললেন, হে মূসা আমি ফেরাউনের রাজ্যে অচিরেই পশুর মহামারী আনয়ন করব কিন্তু তাতে তোমার লোকজনদের পশুর কোন ক্ষতি হবেনা। খোদার নির্দেশে পরদিন থেকেই ফেরাউন এবং তার রাজন্যবর্গের সকল গরু, ভেড়া, ছাগল এবং গৃহপালিত অন্যান্য পশু-পক্ষীর মধ্যে মহামারী ছড়িয়ে পড়াতে লক্ষ লক্ষ মিশরীয়দের পশু মৃত্যুবরণ করল। ফেরাউনের নামে কুরবাণী দেওয়া কিংবা মাংস খাওয়ার মত কোন পশু খুঁজে পাওয়া গেলনা। অপরদিকে গোশন মরুভূমিতে বসবাসরত মূসার লোকজনদের পশুগুলোর একটিও মারা পড়লনা। ফলে ফেরাউনের মন আরও কঠিন হল এবং ফেরাউন মূসার সাথে সকল শর্ত ভঙ্গ করল। 

৬- বিষফোঁড়াঃ

অবাধ্য ফেরাউন ও তার রাজন্যবর্গদেরকে শাস্তির নিমিত্তে এবার মূসার প্রতি তার প্রভুর নির্দেশ এল, হে মূসা চূলো হতে ছাই নিয়ে তুমি বাতাসে উড়াও, দেখবে এই ছাই ধূলো হয়ে ফেরাউন এবং তার সভাসদদের গায়ে লেগে তাদের শরীরে বিষফোঁড়া হবে। এমনকি তাদের গৃহপালিত পশুও এ ধরণের শাস্তি হতে রক্ষা পাবেনা। মূসা প্রভুর নির্দেশ পালন করা মাত্র ছাই ধূলোর সাথে মিশে ফেরাউনসহ তার প্রজাদের এবং পশুদের গায়ে লেগে ফোঁড়া হতে লাগল। ফোঁড়ার কষ্টে ফেরাউন পুনরায় তার জাদুকরদেরকে ডাকলো কিন্তু এতে লাভ হলনা। ফেরাউন পুনরায় মূসার কাছে নমনীয় হল এবং মূসার প্রার্থনায় একসময় সকলে ফোঁড়া হতে অব্যাহতি পেল।

৭-শিলাবৃষ্টিঃ

মূসার মা’বুদ তাঁকে বললেন, হে মূসা ফেরাউনকে গিয়ে বল, আমার এবাদতের জন্য সে যাতে তোমাদেরকে মিশর ত্যাগের অনুমতি দেয় নতুবা অচিরেই এক ভয়ংকর শিলাবৃষ্টি হবে যা কখনো মিশরের মানুষ দেখেনি। যদি কেউ মাঠে ময়দানে বা চারণক্ষেত্রে পশু নিয়ে যায় তাহলে পশুসহ তারা মারা পড়বে, শস্যক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। মূসা ফেরাউনকে এ কথা জানালে সে ভয় পায় এবং রাষ্ট্রীয় ঘোষণা দেয় যাতে পশুপালনে কিংবা শস্যক্ষেত্রে কেউ না যায়। কয়েকদিনের ব্যবধানে সত্যিই আকাশ কাল মেঘে ঢেকে গেল এবং প্রচুর শিলাবৃষ্টি হতে লাগল। যারা নির্দেশ অমান্য করে বাইরে গিয়েছিল সকলেই পশুসহ মারা পড়ল। ঘরবাড়ীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতে লাগল। যারা আল্লাহর এবাদত গোপনে করতো তারাই কেবল ক্ষয়ক্ষতি হতে রক্ষা পেল। এবার ফেরাউন মূসা এবং হারুণ নবীকে ডেকে এনে গোপনে বলল তোমাদের প্রভুর ক্ষমতা অপরিসীম এবং তোমাদের প্রভুর কাছে দোয়া কর যাতে শিলাবৃষ্টি থামিয়ে দেন এবং বিনিময়ে তোমাদেরকে আমি যেতে দেব এবং তোমাদের ঈশ্বরের এবাদত করতে দিব। অবশেষে মূসার দোয়া আল্লাহ শুনলেন এবং শিলাবৃষ্টি থেমে গেল। কিন্তু ফেরাউন নানা অজুহাতে পরিশেষে মূসা ও হারুণ নবীর সাথে দেওয়া কথার মর্যাদা রাখল না। তার মন কঠোর রয়ে গেল।

৮-পঙ্গপালের উৎপাতঃ

এরপর মা’বুদ মূসাকে বললেন তুমি ফেরাউনের কাছে যাও। আমি তার এবং কর্মচারীদের মনোভাব বুঝে তাদের মনকে শক্ত করেছি। তারা আমাকে মা’বুদ বলে মানবেনা এবং তোমার মাধ্যমে আমি আমার কুদরতীর চিহ্ন দেখিয়ে যাব যাতে পৃথিবীতে তোমাদের বংশধরেরা বলতে পারে মিশরীয় ফেরাউন এবং তার সভাসদরা কিভাবে ধ্বংস হয়েছিল এবং সবাই যাতে বুঝতে পারে আমিই তোমাদের পালনকর্তা এবং আমিই মা’বুদ। যদি আমার এবাদত করার জন্য তোমাকে তোমার লোকজনসহ মিশর ত্যাগ করতে না দেয় তাহলে তাকে বলবে, কালই আমি মিশরের সর্বত্র পঙ্গপাল পাঠিয়ে দেব। যা ইতিপূর্বে কেউ কখনো দেখেনি। শিলাবৃষ্টি হতে যে ফসলগুলো আমার নির্দেশে বেঁচে গিয়েছিল সেগুলোও পঙ্গপাল ভক্ষণ করবে। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।

সভাসদরা ভয় পেয়ে ফেরাউনকে বলল, হুজুর বনী-ইসরাইলীয়দেরকে এবার দেশ ত্যাগের অনুমতি দিন। ওদের জন্য একের পর এক বিপদ লেগেই আছে, এভাবে চলতে থাকলে মিশর ধ্বংসের মুখোমুখি হবে।

রাজন্যবর্গের কথায় ফেরাউন মূসা এবং তদ্বীয় ভ্রাতা হারুণকে ডেকে পাঠালো। বললো, ঠিক আছে তোমরা মিশর ত্যাগ করতে পার তবে তোমাদের সাথে কে কে যাবে? মূসা বললেন, আমরা নরনারী, শিশু-বৃদ্ধ এবং গবাদিপশু সবাইকে নিয়ে মিশর ত্যাগ করতে চাই। ফেরাউন উত্তরে বলল, যদি আমি তোমাদের সবাইকে যেতে দেই তাহলে তোমাদের মা’বুদ যেন তোমাদের সঙ্গে যায়। তোমাদের উদ্দেশ্য ভাল নয়, তোমাদের সকল পুরুষেরা যেতে পার তবে নারী, গবাদি পশু বা অন্য কেউ সাথে যাবেনা।

ফেরাউনের এরূপ উত্তর ও চতুরতার কারণে আল্লাহ মূসাকে বললেন, হে মূসা তোমার লাঠি আকাশের দিকে উত্তোলন কর, আমি শাস্তি হিসাবে ফেরাউনের রাজ্যে পঙ্গপাল পাঠাবো, এরা সব খেয়ে শেষ করে দিবে। তোমার মা’বুদের শক্তি কতটুকু তা ফেরাউন উপলব্ধি করতে পারবে। মূসা আল্লাহর নির্দেশ পালন করা মাত্র পূব-আকাশ কাল মেঘের মত ছেয়ে যেতে লাগল, সূর্যের আলো বিদুরিত হল এবং আকাশ ভরে সর্বগ্রাসী পঙ্গপাল মিশরে নেমে এসে তরুলতা, গাছপালা সব ভক্ষণ করে শেষ করে দিল। ফেরাউন পুনরায় মূসাকে তলব করে বললো, আমি তোমাদের মা’বুদ ও তোমাদের কাছে গুনাহ করেছি।তাই দয়া করে এ শাস্তি তুলে নিতে তোমার মা’বুদকে বল। মূসা ফেরাউনের অনুরোধে আল্লাহর কাছে মিনতি জানালে পঙ্গপালকে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে লোহিত সাগরে নিক্ষেপ করলো। একটাও পঙ্গপাল রইলনা কিন্তু আল্লাহ ফেরাউনের মনকে কঠিন করাতে সে নানা বাহানায় মূসাকে লোকজনসহ যেতে দিলনা।

৯-অন্ধকার গ্রাসঃ

ফেরাউনের অবাধ্যতার কারণে এবার আল্লাহ মূসাকে বললেন তোমার হাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে দাও। আমি মিশরকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করবো। মূসা নির্দেশ পালন করার পরদিন হতে তিনদিন গাঢ় অন্ধকার মিশরে

নেমে আসলো কিন্তু মূসার লোকজন যে গোশান মরুভূমিতে আশ্রয় নিয়েছিল সে জায়গা আলোকিত রয়ে গেল। ফেরাউন মূসাকে তলব করে বললো, ঠিক আছে তোমার লোকজন নিয়ে তুমি মিশর ছেড়ে চলে যাও তবে তোমাদের পশু সাথে নিতে পারবেনা। আর তোমার মা’বুদের কাছে দোয়া কর যাতে এবারের মত অন্ধকার তুলে নেন। লোকজন অন্ধকারে কষ্ট পাচ্ছে দেখে মূসা দোয়া শেষ করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ধকার কেটে গেল।

মূসা বললেন,আমরা আমাদের পশু নিয়ে যেতে চাই কারণ মা’বুদের উদ্দেশ্যে আমরা পশু কোরবানী করে পবিত্র হব। রেগে ফেরাউন বললো, তুমি আমার সামনে থেকে দুর হও, আর কোনদিন সামনে আসবেনা, যদি আস তাহলে তোমাকে মৃত্যুদন্ড দেব। মূসা বললেন, তাই হবে। আমি আমার নিজের ইচ্ছাতে আপনার সামনে আসবনা যদিনা প্রভু নির্দেশ করেন।

১০- প্রথম ছেলের মৃত্যুঃ     

এবার মূসাকে তাঁর মা’বুদ বললেন, আমি ফেরাউন ও মিশর দেশের উপর আরেকটা গজব নাজেল করব। তারপরে সে এখান থেকে তোমাদেরকে যেতে দিবে। তবে সে যখন তোমাদেরকে যেতে দিবে তখন এখান থেকে তোমাদেরকে সে একেবারে তাড়িয়ে বিদেয় করবে। তুমি বনি-ইসরাইলদেরকে বলবে, স্ত্রী-পুরুষ সকলেই যেন তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে গচ্ছিত সকল সোনা ও রূপার জিনিষ চেয়ে নেয়।

মূসা ফেরাউনকে বললেন, মা’বুদ বলেছেন, তিনি মাঝরাতে মিশর দেশের মধ্য দিয়ে যাবেন।তাতে মিশরের সব পরিবারের প্রথম ছেলে মারা যাবে। পশুদের মধ্যেও প্রথম পুরুষ বাচ্চা মারা যাবে। এতে সকল মিশরীয় পরিবারে কান্নার রোল উঠবে এবং আপনার সব লোকজন এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বলবে,আপনি আপনার সব লোকজন নিয়ে মিশর হতে দয়া করে চলে যান।

সেই রাতেই মা’বুদের কথাই রক্ষা পেল। প্রত্যেকটি পরিবারের প্রথম ছেলে এবং পশুর প্রথম পুরুষ বাচ্চা মারা যেতে থাকলো। ভীত সন্ত্রস্থ ফেরাউন মূসা ও হারুণকে ডেকে বললো, তোমাদের লোকজন নারীপুরুষ এবং গবাদিপশুসহ সকলে মিশর ছেড়ে চলে যাও। যেভাবে তোমরা বলেছ সেভাবেই অন্যত্র গিয়ে তোমাদের মা’বুদের এবাদত কর আর আমাকেও দোয়া কর।

মূসা তার সকল অনুসারী ও গবাদি-পশুদেরকে নিয়ে রামিষেষ হতে সুক্কুত নামক স্থানের দিকে রওয়ানা হলেন। মিশর দেশে বনি-ইসরাইলীরা ৪৩০ বৎসর বাস করেছিল।

ফেরাউন তার দলবলসহ মূসাকে অনুসরণ করল যাতে তারা একজনও জীবন্ত ফিরে যেতে না পারে। মূসা খবর পেয়ে মা’বুদের কাছে দোয়া করলেন এবং মা’বুদের নির্দেশে লোকজনদেরকে নিয়ে লোহিতসাগরের পাশে পাহাড়ের উপত্যকায় আশ্রয় নিলেন। ফেরাউন ও তার লোকজন কাছাকাছি আসতেই মূসার প্রতি হুকুম হল তিনি যেন তাঁর অলৌকিক লাঠি দিয়ে সাগরবক্ষে আঘাত করেন। সাগর বক্ষে আঘাত করতেই সাগর দু’ভাগ হয়ে রাস্তা তৈরী হল। সাগর এস্থানে সংকুচিত ছিল এবং শুকনো রাস্তা তৈরী হল। মূসা তাঁর লোকজন নিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার পর পরই ফেরাউন পিছু ধাওয়া করল এবং প্রবল ঢেউ এসে তাদের সকলকে ডুবিয়ে দিল। ফেরাউনসহ তার লোকজনের সবাই মারা পড়ল।

এখনও এ রাস্তার দু’পার পাহাড়বেষ্টিত সাগরের তীর পর্যন্ত প্রসারিত এবং পর্যটকদের জন্য উন্মোক্ত রাখা হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পাহাড়ের গায়ে থেকে উৎসারিত মূসার অলৌকিক লাঠির দ্বারা সৃষ্ট তাঁর অনুসারীদের জন্য ১২টি ঝরণার উৎসস্থল দেখতে যায়। আল্লাহর অলৌকিক নিদর্শন হিসাবে ঝর্ণাগুলো হতে অবিরাম জল এখনো নির্গত হচ্ছে।  

কায়রো মিউজিয়ামের সংরক্ষণাগারে ফেরাউন রাজাদের পাশাপাশি রাণীদের মমিও রয়েছে। অন্যত্র অসংখ্য পুরাকীর্তিসহ প্রায় তিনহাজার বছরের পুরানো বানর, সাপ, কুমীর ও অন্যান্য প্রাণীদেরও মমি রয়েছে। রয়েছে ফেরাউন রাজাদের মমির পার্শে প্রদত্ত ফলমূল এবং শিশু অবস্থায় মৃত রাজপরিবারের অন্যান্য কিছু সদস্যদেরও মমি। একরাশ স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম আস্থানায়।

পরদিন সুলতান সালাহউদ্দিনের দূর্গ, বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, পথে পথে অসংখ্য প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প এবং নবী দৌহিত্র ঈমাম হোসেন মসজিদ পরিদর্শন শেষ করতেই বেলা গড়িয়ে গেল। হোসেন মসজিদেই সমাহিত করা হয়েছে ঈমাম হোসেনের পবিত্র শির মোবারক আর ইরাকের কারবালার অনতিদুরে কুফায় ইমাম হোসেনের পবিত্র দেহ মোবারক।

এ মসজিদ অভ্যন্তরে ঈমাম হোসেন ও কারবালার যুদ্ধে নিহত ইতিহাস বিখ্যাত অনেক সাহাবীদের তরবারী সংরক্ষিত রয়েছে। তাই এই মসজিদটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক গুরুত্ব বহন করে। চৌদ্দশত বছরের অধিক পুরানো বরকতময় এই তরবারীগুলো দেখতে এবং সমবেদনা জানাতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে ছুটে আসে মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারী মানুষের জনস্রোত।

নবী মুহম্মদের (সঃ) স্নেহধন্য দৌহিত্র ঈমাম হোসেন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন ইরাকের কারবালা প্রান্তরে। ইয়াজিদ বাহিনীর লোক যুদ্ধে নিহত ঈমাম হোসেনের শির দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করে ইয়াজিদকে দেখাতে ছিন্ন শিরটি নিয়ে এসেছিল মিশরে এবং এখানেই সেই শির সমাহিত করা হয়। এ করুণ হৃদয়বিদারক কাহিনীর প্রেক্ষিতে এখানে এসে কেউ চোখের অশ্রু সংবরণ করতে পারেনা। নবী হৃদয়ের স্নেহের পরশে যিনি বড় হয়েছেন,নবীর মমতার চুম্বন যার শরীরের প্রতিটি স্থানে অংকিত রয়েছে, সত্যপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে সেই মহামানবের ত্যাগ-তিতীক্ষা কি এমনিতেই ব্যর্থ হবে? এ পৃথিবীতে স্রষ্টার সৃষ্ট প্রিয় মানুষগুলোকে শহীদের মর্য্যাদা দিতে স্রষ্টা ভালবাসেন এবং এটাই ছিল স্রষ্টার ইচ্ছা। নবীদৌহিত্র ঈমাম হোসেনের বড়ভাই ঈমাম হাসানকেও মদিনায় ইহুদি শত্রুদের প্ররোচনায় শহীদ হতে হয়েছিল।

পরিকল্পনানুযায়ী পরদিন সকালে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হল। গ্রীক বীর আলেকজান্দার এবং ভূবনমোহিনী ক্লিয়পেট্রার স্মৃতিবিজরিত ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এই আলেকজান্দ্রিয়া নগরী গ্রীক ও মিশরীয় প্রাচীন সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন। মহাবীর আলেকজান্ডারের নামানুসারে এই নগরী পরিচয় বহন করে আসছে যুগ যুগ ধরে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩১ খ্রিষ্টাব্দে মহাবীর আলেকজান্ডার এই নগরীর গোড়াপত্তন করেন। বন্দর নগরী আলেকজান্দ্রিয়াকে বেছে নেয়া হয়েছে এর সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে। ভূমধ্য সাগরের কোল ঘেষে মেরিওটিস হ্রদ সংলগ্ন এই নগরী অদ্ভূত সৌন্দর্য্যের প্রতীক। ইতিহাসবিখ্যাত এ নগরীর আবহাওয়া এবং তখনকার ফেরাউন রাজা কর্তৃক নির্মিত এ নগরীতে অবস্থিত লাইটহাউস ও দূর্গ পিরামিডের মত পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যে্যর প্রতীক বহন করে।

পর্যটনশিল্পে সমৃদ্ধ এ নগরীতে রয়েছে ”পাখিদের ভিলা” যেখানে রয়েছে গ্লাস এবং মার্বেলনির্মিত ১৩টি ল্যান্ডস্কেপে সজ্জি পাথর এবং গ্লাসে খোদাই করা কবুতর, ময়ূর, টিয়া এবং নাম না জানা অসংখ্য পাখিদের মূর্তিমান মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।

রাস্তা হতে দশমিটার গভীরে ”রোমান ভিলা” প্রায় একশো মিটার এলাকা জুড়ে। ১৪০০ শতাব্দীতে সংঘটিত ভূমিকম্পের কারণে বর্তমানে পানির নিচে, টিকেট কেটে ডুবুরীর ড্রেসে সজ্জ্বিত হয়ে এ প্রত্নতাত্মিক নিদর্শন দেখতে হয়।

ফেরাউন রাজার দূর্গ ও লাইটহাউস যা ১৪০০ শতাব্দীর ভূমিকম্পে প্রায় বিধ্বস্থ ইতিহাসের প্রাচীন কীর্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। 

নৌবাহিনীর একটি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত প্রায় ত্রিশ মিটার তিমির কঙ্কাল দেখলে ইউনুস নবীকে গিলে খাওয়া বিশাল তিমি মাছের পেটের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী যা খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে স্থাপিত হয়েছিল এর সংরক্ষণাগারে শতাব্দীর পর শতাব্দীর ঐতিহাসিক এবং বিজ্ঞানীদের দ্বারা রচিত প্রায় আট মিলিয়ন বইপুস্তক শোভা পাচ্ছে। লাইব্রেরী সংলগ্ন কনফারেন্স রুম এবং মিউজিয়ামে সংরক্ষিত একহাজারেরও উপরে মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন, প্রাচীনকালে প্রথমে কালি-কলম দিয়ে লিখার জন্য ব্যবহৃত পেপিরাস কাগজ দেখতে পাওয়া যায়।

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়ায় নির্মিত কবরস্থান ”কম আল শোখাফা” আবিষ্কৃত হয় ভূগর্ভের ৬০ ফিট গভীরে। ১৯০০ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত কেউ জানতনা ভূগর্ভস্থ এ কবরস্থানের কথা। একটি গাধা এ কবরস্থানের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ ফাটলের গর্তে পড়ে যাওয়ার পর আবিষ্কৃত হয় এ কবরটি।

গাধাকে খুঁজতে গিয়ে ষাট ফিট ভূগর্ভ খনন করে পাওয়া যায় পাথরে নির্মিত একটি কবরস্থান, পাশের রুমে রাখা পাথরের তৈরী ডাইনিং টেবিল, মদের জাগসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র এবং কবরস্থান হতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য একটি রাস্তা। গ্রীক, রোমান এবং মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীন এ নিদর্শন চোখে পড়ার মত।

আলেকজান্দ্রিয়ার পথে পথে প্রাচীন নিদর্শন এবং মুনতাজা নামক স্থানে ফুলফোটানো প্রাকৃতিক পার্ক দেখে বিস্মিত হয়েছি। বিধাতার সৃষ্টিরহস্যের যেন শেষ নেই। প্রাচীন মিশরীয় ও রোমান সভ্যতার কাছে বর্তমান আধূনিক সভ্যতা যেন হার মানে।

আলেকজান্দ্রিয়া হতে ফেরার পথে আমাদের গাইডকে জানালাম আল ফাইয়ুমের ঐতিহাসিক ধনুকুবের কারুণের ধ্বংসাবশেষের নিদর্শনটি দেখার আমাদের প্রবল আগ্রহ রয়েছে। যেখানে নবী মূসার (আঃ) চাচাতো ভাই কৃপণ কারুণের প্রাসাদ এবং তার ধনসম্পদ আল্লাহর নির্দেশে শাস্তিসরূপ মাটির নীচে তলিয়ে গিয়েছিল। নবী মূসার (আঃ) আমলে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত কারুণের ছিল অঢেল সম্পদ এবং তার এই ধনসম্পদের সিন্দুকের চাবি ৪০টি উট বহন করত বলে প্রবাদ রয়েছে। মূসা নবী কারুণকে বলেছিলেন যেহেতু আল্লাহ তাকে সে যুগের ধনদৌলতে পরিপূর্ণ বিত্তশালী করেছেন তাই আল্লাহর নির্দেশে তার এই বিশাল সম্পদের শতকরা আড়াই শতাংশ সে যেন গরীবের মধ্যে যাকাত হিসাবে বিতরণ করে। কারুণ প্রত্যুত্তরে বলেছিল আমার কষ্টার্জিত ধনসম্পদ বিতরণ করব কেন? এটা আমি কোনক্রমেই করব না। মূসা নবী তাকে অনেক বুঝালেন এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে ফিরে আসতে উপদেশ দিলেন কিন্তু নবীর উপদেশ সে অমান্য করল। পরিবর্তে সে পরদিন এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করল এবং মূসা নবীকে আমন্ত্রন জানালো এ অনুষ্ঠানে হাজার হাজার দর্শকের সামনে নবী মূসা তাঁর ধর্মকে প্রচার করার সুযোগ পাবেন, সুতরাং এ আয়োজন মূসা নবী যেন হাতছাড়া না করেন। মূসা নবী এ আমন্ত্রন গ্রহণ করলেন। এদিকে কারুণ রাতের অন্ধকারে সে অঞ্চলের ”সবতা” নামক এক বিখ্যাত যৌনকর্মীকে বিশহাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে রাজী করায় এই বলে যে, নবী মূসা তার ভাষণে যখন ইসলাম ধর্ম প্রচার করবেন তখন সে যেন নবী মূসাকে তার একজন শয্যাসঙ্গী বলে অপবাদ দেয়।

পরদিন অনুষ্ঠানে মূসা নবী আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করার জন্য কারুণের অনুরোধে ষ্টেজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ফিরে আসার জন্য উপস্থিত জনতাকে আহ্বান জানান এবং মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে কাউকে শরীক না করতে উপদেশ দেন। যৌনকর্মী সবতা বিস্ময়ে মূসা নবীর কথা শুনে ভারাক্রান্ত মনে জনতার সামনে কারুণের দুরভীসন্ধির কথা ফাঁস করে দেয় এবং আল্লাহর কাছে অতীতের সকল পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং মূসা নবীর ধর্ম গ্রহণ করে। মূসা নবী সবতার কাছে সকল ঘটনা শুনে কারুণের ধ্বংস কামনা করেন। আল্লাহ সে ডাকে সাড়া দেন এবং কারুণের ধনসম্পদসহ তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলেন। যেখানে কারুণ প্রেথিত হয় সেখানে তার বিশাল ধনভান্ডার এবং সুরক্ষিত ইমারতসমূহ ছিল। আল্লাহর হুকুমে চার কিলোমিটার বিস্তৃত দূর্গন্ধযুক্ত লবণাক্ত একটি হ্রদের সৃষ্টি হয়। হ্রদের পাড়ে এবং মধ্যখানে প্রেথিত বিভিন্ন ইমারতসমূহের চিহ্ন আজও বিদ্যমান। পবিত্র কু’রআনে কৃপণ কারুণ এবং ফেরাউনের পরিণতির কথা বিশদভাবে বলা হয়েছে।

পূর্বপরিকল্পনার জের ধরে কায়রোতে ফিরে ১৯৮৮ সালের সাহিত্যে আরব বিশ্বের সাহিত্যে একমাত্র নোবেল বিজয়ী মিশরীয় লেখক জনাব নাজিব মাহফুজের সাথে সাক্ষাৎকারের জন্য বেরিয়ে পড়তে হয়।

জেদ্দা হতে প্রকাশিত আমাদের ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্রিকা ”সম্প্রীতি”-র জন্য একটি সাক্ষাৎকার প্রদানের নিমিত্তে কায়রো আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের ছাত্র জনাব মাহমুদুল হাসান ও আসলামউদ্দিনের পরিকল্পনায় পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে এ সাক্ষাৎকারের আয়োজন করা হয় নাজিব মাহফুজের কায়রোর অব্বাসিয়ার বাসায় ১৯৯৮ এর আগষ্টে। পরবর্তী পর্যায়ে নাজিব মাহফুজের সাথে বিশেষ এ সাক্ষাৎকারটি আমাদের সাহিত্যপত্রিকা ”সম্প্রীতি”-তে প্রকাশিত হয়।

জনাব নাজিব মাহফুজের জন্ম কায়রোর এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট্ট পদবীর সরকারী ধার্মিক চাকুরে পিতা আদেল আজিজ ইব্রাহিমের ঔরসে এবং মাতা ফাতেমার গর্ভে ১৯১১ সালের ১১ই ডিসেম্বর। পাঁচ ভাই ও দু’বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তিনি তার কর্ম জীবনের বেশীরভাগ সময় মিশরীয় সাহিত্যাঙ্গন ও রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। 

৫০ টিরও অধিক উপন্যাস, ৩৫০ টিরও বেশী ছোটগল্প, ১২ টিরও বেশী সিনেমার কাহিনী এবং বেশ কিছু নাটক লিখেন। তাঁর লেখক জীবনের পেছনে বিখ্যাত মিশরীয় লেখক হাফিজ নাজিব, ত্বাহা হোসেন এবং লেখিকা সালমা মূসার প্রভাব পড়েছিল।

১৯৩০ সালে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নতোকোত্তর ডিগ্রিলাভ করে কয়েকবছর সরকারী চাকুরী করেন কিন্তু ক্রমেই সরকারী চাকুরীতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং সাংবাদিক হিসাবে আল-রিসালা পত্রিকার সাথে জড়িয়ে পড়েন। তখন থেকেই তাঁর লিখা ছোটগল্প কায়রোর প্রভাবশালী পত্রিকা আল-হিলাল এবং আল-আহরামে নিয়মিত প্রকাশ পেতে থাকে। তাঁর কয়েকটি বই ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয় কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এ সমস্ত উপন্যাসকে সাদরে গ্রহণ করে এগুলোর উপর ছবি নির্মাণ করে। ধর্মতত্ত্বের উপর বিভিন্ন প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তার বেশ কয়েকটি উপন্যাসে নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্ঠা করেন ফলশ্রুতিতে তিনি ধর্মভীরুদের আক্রোশে পড়েন।

ব্যাক্তিগত জীবনে নাজিব মাহফুজ ৪৩ বছর বয়সে আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিষ্টান মহিলা আতিয়াল্লাহ ইব্রাহীমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের ঔরসে ফাতেমা এবং উম্মে কুলসুম নামে দু’টো কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে।

তিনি কালমার্কস্-এর সমাজতান্ত্রিক মতবাদে আকৃষ্ট ছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাত ও জামাল নাসেরের সময় রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন।তাই তার লেখনিতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সংযোগ পাওয়া যায়। ১৯৭৮ সালে ইসরাইলের সাথে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দতের ”ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তি”-র ব্যাপারে তিনি তাঁর লেখালেখিতে অত্যন্ত সন্তেুাষ প্রকাশ করেন, যে কারণে পরবর্তী পর্যায়ে তিনি ইসরাইল সরকারের একজন প্রিয়ভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হন।

ব্রিটেনের নাগরিক ভারতীয় বংশদ্ভোত সালমান রুশদিকে তার লিখা ”দ্যা সাতানিক ভার্সাস” বইটিতে ইসলাম এবং এ মহান ধর্মের প্রচারক মুহাম্মদ-কে (সঃ) অবমাননার জন্য বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ যখন ফুঁসে উঠে তখন ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী সালমান রুশদী এবং এ বইটির প্রকাশকের মৃত্যুর ব্যাপারে ফতোয়া জারী করে পুরষ্কার ঘোষণা করেন।

খোমেনীর এ ফতোয়ার বিরুদ্ধে নাজিব মাহফুজ সোচ্চার হন এবং পরোক্ষভাবে তার লেখায় সালমান রুশদির বাক স্বাধীনতার অধিকারকে সমর্থন করে আয়াতুল্লাহ খোমেনীকে একজন সন্ত্রাসী হিসাবে আখ্যায়িত করেন।

”দ্যা সাতানিক ভার্সাস” লিখে সালমান রুশদি পশ্চিমা বিশ্বে ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের সহানুভূতি পান এবং তার লিখা এ বই ”বেষ্ট সেলার বুক” হিসাবে খ্যাতি পায়।

”দ্যা সাতানিক ভার্সাস” অবমাননাকর ইসলাম বিরোধী বইটি লিখে মুসলিম বিরোধী এবং মুসলিম নামধারী এ ব্রিটিশ লেখক (ভারতীয় বংশদ্ভোত) সালমান রুশদী নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বে ”মহানায়ক” হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৮৮ সালে এ বইটি ব্রিটেনের ভাইকিং প্রেস প্রকাশ করে। এ বইটির লেখক সালমান রুশদী ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ইহুদি ও খ্রিস্টান পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া হতে বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয় এবং বইটি ”বুক অব দি ইয়ার” হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে। মুসলিম বিশ্বজুড়ে এ বইটির প্রতিবাদে অসংখ্য মুসলিম শাহাদাত বরণ করেন। ব্রিটেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা বিশ্ব রুশদিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে আগলে রাখে।

একটি স্বপ্ন নিয়ে বইটির অধ্যায় শুরু। একটি হাইজ্যাক করা বিমানের যাত্রী হিসাবে দু’জন ভারতীয় নিজেদের ভাগ্যান্বেষনে ব্রিটেনে পাড়ি জমায়।পথিমধ্যে ইংলিশ চ্যানেলে তাদের বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে। কিন্তু দু’জনই প্রাণে বেঁচে যায়। পুলিশের কাছে বে-আইনীভাবে ব্রিটেনে প্রবেশের জন্য উভয়েই ধরা পড়ে। দু’জনের মধ্যে একজনের নাম জিবরীল, অন্যজন সালাদিন (জিবরিলের চামচা) হিসাবে নিজেদের পরিচয় দেয়। লেখক সালমান রুশদী এ দু’জনের একজনকে জিবরীল ফেরেশতা ও সালাদিনকে ফেরেশতার চামচা শয়তান হিসাবে ব্যাঙ্গাত্মক অর্থে ব্যবহার করেছে।

অন্য একটি অধ্যায়ে ব্যক্ত করা হয় যে, মক্কায় লাত, মানাত ও ওজ্জা দেবদেবীর পূজারীদের মধ্যে বানানো কুরআনের সু’রা পড়ে তাদের পিতৃপুরুষের ধর্মকে বিনষ্ট করার মানসে মুহাম্মদের (সঃ) অবির্ভাব হয়। দু’জন বিধর্মী গুরু এতে প্রতিবাদ জানায়। মুহাম্মদ (সঃ) যখন শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং বিভিন্ন শ্রেণীর লোকেরা এতে সাড়া দেয় তখন ”বাল” নামক প্রতিবাদকারী এক কবি মুসলিম রোষানল থেকে নিজেকে আড়াল করার নিমিত্তে একটি পতিতালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানে সে মুহম্মদ (সঃ) এর কয়েকজন পত্মীকে দেখতে পায়।

এভাবে বিভিন্ন ব্যঙ্গার্থক এবং অবমাননাকর উক্তির মধ্য দিয়ে বইটির শুরু এবং শেষ। ইসলাম ধর্ম এবং এর প্রবর্তক নিয়ে যখনই কুরুচিপূর্ণ কিছু প্রকাশ পায় তখনই খ্রিস্টান এবং ইহুদী মিডিয়াসমূহ অত্যন্ত আগ্রহের সাথে তা লুফে নেয় এবং তাদের পরিচালিত মিডিয়াসমূহ ব্যাপকভাবে প্রচার করে।

এ ধরণের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, লেখালেখির প্রবক্তা অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে মহানায়ক হিসাবে সুখ্যাতি পায় যদিও অনেক পশ্চিমা লেখক ”দ্যা সাতানিক ভার্সাস” বইটির নিরপেক্ষ সমালোচনায় বইটির মধ্যে সাহিত্যরসের তেমন কোন কিছু খুঁজে পাননি। এ বইটি লিখার জন্য হয়তো লেখক সালমান রুশদি কোন একদিন নোবেল পুরষ্কারেও ভূষিত হতে পারে।

বাল্যকাল হতে মিশনারী স্কুল এবং কলেজে পড়ুয়া সালমান রুশদীর জন্ম ১৯৪৭ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে। ২০০০ সালে ব্রিটেনে পাড়ি জমানোর কয়েক বৎসরের মধ্যে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব অর্জন করে। মুসলিম বিদ্বেষী, মুসলিম নামধারী এ লেখক মুসলিম ধর্ম সম্মন্ধে অনভিজ্ঞ এবং মিশনারী স্কুল-কলেজে পড়ার কারণে খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত।

চতুর্থবারের বিবাহিত জীবনে তার জীবন সঙ্গিনী হিসাবে এসেছে ক্লিয়ারিশা লুয়ার্ড, মেরিয়ান উইগিন্স্, এলিজাবেথ ওয়েষ্ট এবং পদ্ম লক্ষী - কিন্তু বিবাহিত জীবনের সকল নারীর সাথেই তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। দুই ছেলের জনক সালমান রুশদী বারবার বিবাহবিচ্ছেদের কারণে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ। শুধুমাত্র মুসলিম ধর্মকে নিয়ে কটুক্তি করার কারণে তার বই ”দ্যা সাতানিক ভার্সাস” ২০০৮ সালের ”বুক অব দি ইয়ার” হিসাবে খ্যাতি পায়।

সম্ভবতঃ এ কারণে হয়তো ইসলামিক বিশ্বের পরম শ্রদ্ধেয় সৌদি পার্লামেন্টের স্পীকার ও বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের সভাপতি ড: আব্দুল্লাহ ওমর নসীফ আমাদের পত্রিকা ”সম্প্রীতি”-র সাথে এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন নোবেল বিজয়ী নাজিব মাহফুজের বইপুস্তকে ইসলামবিরোধী কিছু লিখা আছে এবং আমাকেও এ লেখকের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার পরামর্শ দেন।

আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ফতোয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে মিশরের ”মুসলিম ব্রাদারহুড” এবং অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক পার্টির নেতাকর্মীরা নাজিব মাহফুজকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। মিশর সরকার নাজিব মাহফুজের জীবন রক্ষায় সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করে কিন্তু এত প্রহরার পরও ১৯৯৪ সালে এক অততায়ী বিরাশী বছর বয়ষ্ক নাজিব মাহফুজকে হত্যার উদ্দেশ্যে চড়াও হয়ে তাঁর উরু এবং ঘাড়ে ধারালো চাকুর আঘাত হানতে সমর্থ হয়। নাজিব মাহফুজ প্রাণে বেঁচে গেলেও লেখালেখির জগত হতে তিনি স্থায়ীভাবে অবসরে যান এবং ২০০৬ সালের ৩০ শে আগষ্ট ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৯৮ সালের আগষ্টের চতুর্থ সপ্তাহের মাঝামাঝি। এবার ঘরে ফেরার পালা। গন্তব্য মিশরের সুয়েজ বন্দর হতে জেদ্দা। কায়রো হতে সুয়েজবন্দরের উদ্দেশ্যে  ১২০ মাইল পথ অতিক্রম করে রিটার্ণ টিকেট অনুযায়ী সপরিবারে সুয়েজ বন্দরে এসে পৌঁছলাম। কায়রোতে বিদায় জানালো আসলামউদ্দিন ও মাহমুদুল হাছান। এবার জাহাজের চারতলার সজ্জ্বিত দু’টো কেবিনে আমাদের স্থান হল। বন্দর অফিসে সেই ভদ্রলোক ইয়াহিয়া মুরশী আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। করমর্দন করে কায়রো সফর কেমন হল জানতে চাইলেন। সবিনয়ে কৃতজ্ঞতাবোধ জানালাম, বললাম আপনার সাহায্যের কথা ভুলবনা। যদি কোনদিন জেদ্দায় আসেন তাহলে আগাম দাওয়াত রইল। আমার বাসায় আতিথ্যযেয়তা গ্রহণ করে ধন্য করবেন। উত্তরে বললেন, আবার যদি আসেন তাহলে আমার সাথে অবশ্যই দেখা করবেন। মিশরের অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক কীর্তি অবলোকন করতে সময় নিয়ে আসবেন। কায়রোতে পড়ুয়া আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে মিশরের বুকে যত প্রাগৌতিহাসিক স্থান আছে তার সব’কটি দেখবেন। একসপ্তাহে মিশর দেখা কখনো শেষ হয়না। মিশর এমন একটি দেশ যেখানে প্রতিটি শহরে প্রাচীন ঐতিয্য লুকিয়ে আছে। প্রতিদিন ঘুরলেও একমাসে এ দেখা শেষ হবেনা। কি কি দেখে আসলেন - বলুনতো?

কায়রো, সুয়েজ এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় যা যা দেখে এসেছি তা সংক্ষেপে বর্ণনা করার পর বললেন, ব্যাস এইটুকুই। বললাম সময় কম ছিল বলে শুধু এইটুকুর দেখা পেয়েছি। ভদ্রলোক বললেন, এখনো আপনার পঁচাত্তর শতাংশ দেখা অপূর্ণ রয়ে গেছে। এই আমি একজন মিশরীয় নাগরিক। বাপদাদারা এদেশেই জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু আমার এই পঞ্চান্নবছর বয়সেও আমি মিশরের চল্লিশ শতাংশ প্রাচীন নিদর্শন এখনো দেখতে পারিনি এবং সম্ভবতঃ কোন মিশরীয়দের পক্ষে সবকিছু দেখা সম্ভব হয়নি।

হাসতে হাসতে বললাম, ফেরাউন বাদশাহদেরকে আপনারা যাই বলে গালি দেন বা আশীর্বাদ করুননা কেন তাদের বদৌলতে আজ মিশর সরকার পর্যটন খাতে বছরে চার বিলিয়ন আমেরিকান ডলার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। অগণিত পর্যটকদের পদভারে আজ  আপনাদের দেশ মুখরিত। উত্তরে ইয়াহিয়া হেসে বললেন এ কারণেইতো আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর এ জালিমদের অত্যাচারের কথা অনেক সময় ভুলে যাই। পৃথিবী বিলয় না হওয়া পর্যন্ত ওদের পাপ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকে চালু রাখবে একথা সত্য  

প্রসঙ্গের অবতারণা করে বললাম আর একথাও সত্য যে, তৌরাত, ইঞ্জিল, কু’রআনে বর্ণিত প্রায় প্রত্যেক নবী রাসুল মিশরে একবার হলেও এসেছিলেন তন্মধ্যে ঈসা, মূসা, হারুণ, ইউনুস, ইয়াকুব, ইসহাক, খিজির, শোয়াইবসহ (আঃ) অসংখ্য নবী রাসুল এদেশের মাটিতে পা রেখে তাদের ধর্মপ্রচার অব্যাহত রেখেছিলেন এবং বিভিন্ন মোজেজা দেখিয়ে আল্লাহর আদেশ পালন করে মানুষের মধ্যে সত্যের আলো প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাছাড়া মহাবীর আলেকজান্দারসহ অসংখ্য গ্রীক বীর এবং সুলতান সালাহদ্দিনের মত অসংখ্য মহান শাসকরা এদেশের মাটিতে তাদের শৌর্য্য-বীর্যের ইতিহাস রচনা করেছিলেন এ কারণে মিশর চিরভাষ্কর এবং সভ্যতার একটি অংশ হিসাবে চিরকাল বিবেচিত হবে।

বুঝেছি, আপনার সাথে আর কথায় পারবনা কারণ আপনার জ্ঞানের পরিধি ইতিহাসের পাতায় পাতায় আর আমার জ্ঞান খাদ্যসামগ্রীতে সীমাবদ্ধ, আর তাইতো দেখুননা পেটটা কিভাবে আগে আগে দৌঁড়াচ্ছে! বুঝলেন, সারাদিন সারারাত যদি খাওয়াটা জারী থাকতো তাহলে আমার মত কেউ এতবেশী খুশী হতনা।অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন ইয়াহিয়া মুরশী। আচ্ছা চলুন, আপনাদেরকে জাহাজের কেবিন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

উর্দিপরা ইয়াহিয়া মুরশী ’সালাম’ জাহাজের রিসিপশনে এসে কারোর দিকে ইঙ্গিত করলেন। সাথে সাথে উর্দিপরা একজন জাহাজ কর্মকর্তা এসে হাজির হল। আমার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে লোকটিকে বললেন – আগুল্লাক্ এ্যা, খাল্লি বেলাক্ সাদিক আলাইয়া। হুয়া মিন বাংলাদেশ ও রইস কবীরা। (শুনুন, আমার এ বন্ধুটির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখবেন। উনি বালাদেশের একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক)।

সাথে সাথে জাহাজের এই কর্তা ব্যক্তিটি আমার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলল, আহলান ওয়া সাহলান। ইজা আই খেদমা তেব্গা, আনা হাদের ইয়া সাইয়েদী। (স্বাগতম, যাত্রপথে যেকোন খেদমত চান, আমি উপস্থিত থাকবো)।

ইয়াহিয়া মুরশীকে বললাম - শোকরান লাক্, রাব্বানা খাল্লিক। (আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আল্লাহ আপনার সহায় হোন)

মিশরের লোকজনের মধ্যে একটি জিনিস প্রত্যক্ষ করেছি যে, ওরা সত্যিকার অর্থে ভোজন রসিক, কৌতুক প্রিয়, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীরা একত্রিত হলে কৌতুক এবং গল্প করে আসর জমিয়ে রাখে। জাহাজের ডেকের যাত্রীদের দিকে লক্ষ করে দেখা যায় ওরা একে অপরের সাথে রসালো গল্পে মেতে আছে। পরিচিত কিংবা অপরিচিত লোকের আসরে যোগ দিয়ে একটা না একটা কৌতুক কিংবা গল্প বলে সহযাত্রীদেরকে হাসাবে। এককথায় ওরা প্রাণোচ্ছ্বল এক জাতি।

মনে পড়ে এক দিনের কথা। অত্যন্ত সুন্দর আলোকজ্জ¦ল লোহিত বধূ জেদ্দার সমুদ্রসৈকতে সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলাম সন্ধ্যার পরপর। বাচচাদের বায়নার কারণে প্রতিদিন বিকেলে ওদের পছন্দের জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতে হত। কখনো পার্কে, সমুদ্রসৈকতে কিংবা হোটেল-রেস্তোরায়। পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার জেদ্দার প্রতিটি রেস্তোরায়। সৌদি ভোক্তা অধিকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয় কাঁচা বাজার, মাংসের দোকান, সুপারমার্কেট, বেকারী এবং রেস্তোরায়। ভেজাল খাদ্য পরিবেশনের কোন সুযোগ এখানে নেই কারণ অনিয়ম পেলেই জেল-জরিমানা হবে এটা সুনিশ্চিত।

লোহিতের ফুরফুরে বাতাসে সৈকতের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এদিক সেদিক নরনারী, শিশু এবং বৃদ্ধরা বিচরণ করছেন। বিনোদনের অবারিত ক্ষেত্র থাকার পরও মানুষজন সেই তূলনায় খুবই নগন্য। সৈকত সংলগ্ন পার্ক, রেস্তোরা হাতের নাগালে। জনজীবনকে সত্যিকার অর্থে আনন্দমুখর রাখতে জেদ্দা সিটি কর্পোরেশনের চেষ্ঠার অন্ত নেই।

এমনি এক ক্ষণে লোহিতের পাড় ঘেষে মার্বেল, মোজাইক ও পাথরের টাইলস্ সমৃদ্ধ প্রসারিত অঙ্গনে খেলা করছিল বাচ্চারা। পাশেই আমরা দু’জন হাঁটছিলাম ফুরফুরে হাওয়ায়। একজন মিসরীয় লোক সস্ত্রীক হেঁটে যাচ্ছিল আমাদের পাশ দিয়ে।

আট নয় বছর বয়সের দশবারটি ছেলেশিশু তাদেরকে ঘিরে ধরে বলতে থাকে, আহ্‌নু বাজুরা, এব্গা এলাব ওয়া আশ্রাব পেপসি। হাত রিয়াল রিয়াল কুল্লুহুম ইয়া সাইয়েদী (জনাব, আমরা শিশুরা এখানে খেলা করছি ও পিপাসায় পেপসি পান করতে চাই। আমাদেরকে একটি করে রিয়াল দিন)।

মিশরীয় পরিবারটির পিছু পিছু ধাওয়া করে ওরা আবদার করেই যাচ্ছিল। লোকটি ওদের আবদারে কোন পাত্তাই দিচ্ছিলনা। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে পেছন ফিরে লোকটি বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, খাল্লিনা সবুর সোয়াইয়া, আনা ওয়াদ্দিক রিয়াল (তোমরা একটু ধৈর্য্য ধর, আমি তোমাদেরকে রিয়াল দিচ্ছি)।

এক মিনিটের মধ্যে লোকটি বাচ্চাদের দিকে পেছনে ফিরে সশব্দে একটি বায়ূ নিঃসরণ করল। শব্দটি এতই প্রবল ছিল যে, হাঁটারত অবস্থায় আমাদের কানে এসে পৌঁছল। বাচ্চারা হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পড়লো। এমন অভিনব ঘটনাপ্রবাহে লোকটির স্ত্রী ও আমরা না হেসে পারলামনা। মিশরীয় মোটা লোকটি এবার বাচ্চাদেরকে বলল, পেয়েছ রিয়াল? খুশীতো? না আরো চাও? এই বলে লোকটি পাছা একটু বাঁকা করতেই বাচ্চারা হাসতে হাসতে দৌঁড়ে পালালো।

আট থেকে দশবছর বয়সের বাচ্চাদের চেহারা দেখে মনে হল ওরা সুদান কিংবা সোমালিয়ান কালো পরিবারের সদস্য। পাশাপাশি কোন লোকালয়ে ওরা থাকে। দলবেঁধে ওরা পার্শবর্তী সমুদ্রসৈকতে এসে খেলা করে। এখানে বেড়াতে আসা বিভিন্ন পরিবারকে সুযোগ বুঝে রিয়াল দেওয়ার বায়না ধরার কারণে পুলিশের ধাওয়াও খেতে হয় তাদেরকে। অনেক সৌদি এবং বিদেশী নাগরিকরা বাচ্চাদেরকে আদর করে এভাবে রিয়াল দিয়ে থাকে। এতে এরা পর্যায়ক্রমে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। ঈদের সময় বাচ্চারা ঘর থেকে বের হলে বা পড়শীর বাড়িতে বেড়াতে গেলে টাকা পাবে এটা এদেশের নিয়ম। এ কারণে কিছুসংখ্যক বাচ্চারা ক্রমেই লোভী হয়ে সমুদ্রসৈকতে বিচরণকারীদের কাছে টাকা খুঁজে বেড়ায়।

যাই হোক,ইয়হিয়া মুরশী বিদায় নিলে টিকেট অনুযায়ী ৫ম তলার স্থলে এবারে জাহাজের ৪র্থ তলায় আমাদেরকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অধিকতর প্রশস্থ ও উন্নত মানের দু’টো কেবিন দেয়া হল। হয়তো জাহাজ কর্মকর্তাকে মিশর সরকারের বন্দর কর্মকর্তা ইয়াহিয়া মুরশীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে এ ব্যবস্থা। তাছাড়া এটা ক্রুইজ শীপ, পরিপাটি করে সাজানো এর অভ্যন্তরভাগ। প্রবাসী এবং পর্যটকদের নিয়ে চলাচল করে। তাই টিকেটের মূল্য সাধারণ জাহাজের দ্বিগুণ। তাই এর ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশনা উন্নতমানের হবে এটাই স্বাভাবিক। 

কায়রো হতে ফিরে আসার দখল সামলাতে পরিবারের সকলই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাথরুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে বাচ্চারা কার পরে কে যাবে তা ঠিক করে দেওয়া হল। সবাই তাদের মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিল।

বাইরে অপেক্ষমান ওয়েটারকে দু’কাপ কফি, স্প্রেড চিজ ও কিছু পাউরুটির অর্ডার দিলাম। লাইট রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা। ঘন্টাদুয়েক পরে লাঞ্চের জন্য জাহাজের ভূফেতে ডাকা হবে।

ওয়েটার অর্ডার সরবরাহ করে চলে গেলে বাচ্চারা স্প্রেড চিজ দিয়ে পাউরুটি খেয়ে তাদের কেবিনে চলে গেল।  

বেলা এগারোটার দিকে জাহাজটি জেদ্দার উদ্দেশ্যে ছাড়লো। মধ্যখানে সাফাগা বন্দরে আধঘন্টার জন্য নোঙ্গর করবে তারপর সরাসরি জেদ্দা। দু’রাত দু’দিন পর প্রায় দেড়হাজার কিলোমিটার সমুদ্রপথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছবে। 

কেবিনের বাইরে ডেকের সোফায় বসে কফি পান করছিলাম আমরা দু’জন। সকালের সোনালী রোদ লোহিতের নীলাভ জলে চিকচিক করছে। এক অভিনব দৃশ্য নূতন করে আবিষ্কার করলাম যা ইতিপূর্বে ততটা খেয়াল করিনি। সাগর বক্ষ হতে জলীয় বাষ্প ধোঁয়ার আকারে আকাশের দিকে উঠছে আর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সাগরস্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। স্কুলে যখন পড়তাম তখন ভূগোল পরীক্ষায় সাগরস্রোত নিয়ে নানাধরণের প্রশ্ন থাকতো। ম্যাপে দেখানো হয় কিভাবে এঁকেবেঁকে সাগর মহাসাগরে স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে এ স্রোতের পরিবর্তন ঘটে, দেশে দেশে এর প্রভাবে আবহাওয়ার তারতম্য ঘটে। তাছাড়া সাগরে চাঁদের প্রভাবে জোয়ার-ভাটাতো সকাল বিকেল লেগেই আছে।

দিনের আলোয় চলার পথে লোহিতের ওপারে ইয়েমেনের পাহাড়-পর্বত ক্ষীণ আলোকরেখার মত দেখা যাচ্ছে। সাদা পাথুরে পাহাড়গুলোয় মেঘের ছায়া এবং সূর্যকিরণ পড়ে অদ্ভূত এক মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করায় আমার ছোট ছেলে ত্বাহা ও বড় মেয়ে নূহাকে এ দৃশ্যগুলো তাদের রং তুলিতে ধারণ করার প্রেরণা  যোগায়। বড় মেয়ে ও ছোট ছেলে স্কুলের আর্ট প্রতিযোগিতায় সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে। তারা উভয়ে জাহাজের ডেকে বসে পড়ল মিশর হতে নিয়ে আসা তাদের রং-তুলি নিয়ে। ছেলেটি সাগরের ঢেউ ও তিমিদের এদিক সেদিক বিচরণের ছবি আর মেয়েটি সাগর আর পাহাড়ের মনোরম দৃশ্যগুলো আঁকছিল তন্ময় হয়ে।

ঘন্টাখানেক পরে জাহাজে সাইরেন বেজে উঠলো অর্থাৎ লাঞ্চের জন্য নিচতলার বিশাল ওপেন ভুফেতে যেতে হবে। দেড়ঘন্টা ফ্রি ভুফে সকল যাত্রীদের জন্য খোলা থাকবে তারপর আর ডিনারের আগে খাবার পাওয়া যাবেনা।

সমগ্র জাহাজ জুড়ে যেন মৃদৃ কম্পন সৃষ্টি হল জুতোর এবং দরজা লাগানোর খটাখট শব্দে। পেটপূজা বলে কথা তাই কার আগে কে নামবে সে প্রতিযোগিতার মাঝে আমরাও সামিল হলাম। নিচে লাউনজে পৌঁছে প্রথমশ্রেণীর যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসে পড়লাম। টিকেট দেখে জাহাজ হতে সরবরাহকৃত টকেন খাবার টেবিলে বসার পূর্বে জমা দিতে হয়। ওয়েটার নির্ধারিত জায়গা দেখিয়ে দেয় সেই অনুযায়ী যাত্রীদেরকে বসানো হয়।

প্লেনের মত প্রথমশ্রেণীর যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার ও বিভিন্ন আইটেম পরিবেশন করা হয় অন্যদিকে সাধারণ যাত্রীদেরকে জন্য প্লেনের মত কয়েকটি খাবার আইটেমের সমন্বয়ে একটি নির্ধারিত প্যাকেট ও পানীয় সরবরাহ করা হয়। এর অতিরিক্ত তাদেরকে দেয়া হয়না।

কেবিন যাত্রীদের জন্য আলাদা করে রাখা টেবিল হতে বাচ্চারা তাদের মনমত খাবার নিয়ে নিজ নিজ টেবিলে বসে খাবার খেতে মনযোগী হল। এদিকে একজন ওয়েটার বিশেষভাবে আমাদের দু’জনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে খাবারের একটি মেনু হাজির করলো যাতে পছন্দ করে খাবার খেতে পারি। মেনু দেখে আমরা শুধু বলবো আর ওয়েটার খাবারগুলো টেবিলে পৌঁছে দিবে। এ বিশেষ আয়োজন সম্ভবতঃ ইয়াহিয়া মুরশীর অনুরোধের ফসল।।ডাইনিং ডেক্সের অদুরেই সাজানো ওপেন ভূফে। কেবিন বা প্রথম শ্রেণীর অন্যান্য যাত্রীরা নিজেরাই পছন্দ করে তাদের উদর পূর্ণ করছে অথচ আমাদের বেলায় দশপনরো হাত দুরে রাখা খাবার আনতে গেলে যেন কষ্ট হবে তার জন্য ওয়েটার নিযুক্ত করা হয়েছে।      

ওয়েটার জানতে চাইলো সুপ এবং সালাদের (এপিটাইজার) পর প্রথমে কি পরিবেশন করবে?  তাজা মাছের মধ্যে মেনু অনুযায়ী মাছগুলোর নাম লিখা রয়েছে আরবীতে সুলেমানী, গারমুট, ছারদিন, শাহুর, হামরা, হামুর, মাকরাল, মাকরুনা, বায়াদী, বাগাহ, নাজিল, শিরউই, বালিলা, হারিদ, গামবুরী, কানাইয়া, সুলতান ইব্রাহীম, হাব্বারা, মুরজান, সাদাফ, আবু মাগাজ, সামাক আল-গারস্‌ ইত্যাদি সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছের নাম। মাংসের মধ্যে উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার মাংস দিয়ে তৈরী করা হয়েছে বিভিন্ন ধরণের কা’বাব, ভূনা ও সবজী, মাংস ইত্যাদি।

ওয়েটারকে বললাম আমাদের দু’জনকে মাছের মধ্যে দু’টো করে সিদ্ধ করা বড় ”গাম্বুরী”(লবষ্টার) ও একটি করে ২৫০ গ্রাম ওজনের ”বায়াদী” এবং দুম্বার শিককাবাব আর গিন্নির জন্য দু’টো আবু-মাগাজ (সামুদ্রিক কাঁকড়া, বাংলায় আবু মাগাজের অর্থ ”মগজের বাপ”, মগজ কম বলে হয়তো কাঁকড়াকে আরবীয়রা এ নাম দিয়েছে) ও কিছু নান রুটি হলেই চলবে। পরিশেষে ট্রপিকানা অরেঞ্জ জুস ও ফ্রেস ওয়াটার দিবে - ব্যাস, এইটুকুই। ”গাম্বুরী (বড় সামুদ্রিক লবষ্টার বা চিংড়ি যার একটির ওজন ২৫০-৫০০ গ্রাম হতে পারে) আর ”বায়াদী” (সামুদ্রিক রুপচাঁদার মত দেখতে তবে একটু বড় মাংসালু শরীরের কোষ, একেকটির ওজন আধাকেজি হতে দশকেজি পর্যন্ত হতে পারে)।

ওয়েটার হাদের (যথাআজ্ঞা) বলে চলে গেল।

গিন্নীর জন্য দু’টো আবু-মাগাজের (কাঁকড়া) অর্ডার দেওয়ার উদ্দেশ্য গিন্নীকে একটু চমকে দেয়া এবং জীবনের এই প্রথম কাঁকড়ার রোষ্ট টেষ্ট করা। একদিন কথাচ্ছলে ওকে বলেছিলাম - জানো, এই সামুদ্রিক লাল রংয়ের কাঁকড়াগুলো আরবীয়দের খুব পছন্দের একটি আইটেম। চিংড়ি এবং কাঁকড়ার মধ্যে তেমন কোন তফাৎ নেই কারণ দু’জনেরই মগজ নেই বললেই চলে এবং এ দু’টোই আরবীয়দের বিশেষ পছন্দের তালিকায়। গিন্নী উত্তরে বলেছিল, তাহলেতো একদিন কাঁকড়া টেষ্ট করতেই হয়। খাবারের নূতন নূতন আইটেমের স্বাদ নেয়া গিন্নীর পছন্দ অন্ততঃ জীবনে একবারের জন্য হলেও তাই প্রতিবারই হোটেল-রেস্তুরায় খেতে বসলে দু’একটি নূতন আইটেম যোগ করতে হয়। 

”ভাতে মাছে বাঙালী” বলে কথা তাই আমি জেদ্দার সামুদ্রিক মাছের আড়তে প্রতি শুক্রবার গিয়ে তাজা মাছ কিনে আনা আমার একধরণের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই সকল মাছের নাম ও দেখতে কেমন তা আমার জানা আছে।

গিন্নী ”আবু মাগাজ” (সামুদ্রিক ছোট আকারের লাল কাঁকড়া) ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ আমরা একত্রে ভ্রমন করেছি এবং বিভিন্ন দেশের নামকরা হোটেলে অবস্থান করেছি এবং স্বাভাবিকভাবেই উপমহাদেশীয় অরিয়েন্টাল খাবার পছন্দের তালিকায় স্থান পেয়েছে।

নিজের কেবিনে ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ক্লান্তি আর অতিরিক্ত ভোজনে চোখের পাতা সুপ্তির ক্রোড়ে ঢলে পড়লো।

একসময় যাত্রীদের কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম সাফাগা বন্দরে জাহাজ নোঙ্গর করেছে। যাত্রীরা উঠানামা করছে। হকার এবং কুলিরা চিৎকার করে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এখানে আধঘন্টা বিরতি। পশ্চিম আকাশের কোল ঘেষে রক্তিম সূর্য্য লাল রং ছড়িয়ে অস্ত যাচ্ছে লোহিতের অথৈ জলের গভীরে।

আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে গিন্নী বাচ্চাদের কেবিনে গল্পগুজবে মত্ত ছিল। আমার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার শব্দ শুনে গিন্নী আমাদের কেবিনে ফিরে এলো। বললাম, তুমি ঘুমাওনি কেন? আমিতো একটানা পাঁচ-ছয়ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটালাম।একটা লম্বা ঘুম দিলে রাতে একসাথে ডেকে বসে গল্পগুজব করতে পারতাম কিন্তু তা হবেনা জানি কারণ তুমি এবং বাচ্চারা ঘুমিয়ে কাটাবে সারারাত আমাকে একা ফেলে?

তোমাকে একা ফেলে রাখব কেন? আমি কুম্ভকর্ণ নই, হয়তো ডিনারের পরে দু’তিনঘন্টা ঘুমাবো তারপরতো সারারাত পড়েই রইলো। বাচ্চাদেরকে জাগিয়ে রেখেছি রাতটা ভাল কাটবে বলে, কি ভাল করিনি? একটি সলাজ দুষ্ট হাসির ঢেউ খেলে গেল গিন্নীর চোখেমুখে।

হয়তো ভালই করেছ। বাচ্চারা ক্লান্ত হয়ে সারারাত ঘুমিয়ে কাটাবে আর সেই সুযোগে অনাবিল আনন্দের ফল্গুধারায় আমরা ভেসে যাব নিভৃত রাতের মৌনতায়। তবে সময়ই বলে দিবে তোমার যুক্তিটা যথার্থ কিনা? এখন কফি পান করাটা আবশ্যিক। কেবিনের বাইরে অপেক্ষমান ওয়েটারকে কফির অর্ডার দিয়ে কেবিনে ফিরে এলাম।

রাত আটটার দিকে ডিনারের আমন্ত্রনে সাইরেন বেজে উঠলো। বাচ্চাদেরকে নিয়ে নেমে পড়লাম নিচের হলরুমের ওপেন ভূফেতে। খাবার টেবিলে বসতেই একজন ওয়েটার মেনু নিয়ে হাজির।

বাচ্চাদের পছন্দের খাবার নির্ধারণ করতেই বেশ সময় নষ্ট হল। এটা খাবনা ওটা খাব, এ নিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে তুমুল তর্কযুদ্ধ শুরু হলে বললাম এখানে মেনুতে প্রত্যেক খাবারের আইটেম লিখা আছে, তর্কাতর্কি না করে যার যার পছন্দমত খাবার অর্ডার দাও তাহলেতো হল। একথা শুনে বাচ্চারা তাদের নিজস্ব পছন্দের খাবার নির্ধারণে মনযোগী হল।

গিন্নী বলল,লাঞ্চে তোমার দেওয়া অর্ডার খেয়েছি।আবু-মাগাজ অর্থাৎ কাঁকড়াও খাইয়েছ। এবার আমি পছন্দ করবো, ঐ যে বললে- সামাক আল্‌গারস্ অন্যান্য খাবার আইটেমের সাথে এটাও দিতে ভুলনা। সত্যি বলতে কি, এ মাছটির নাম শুনেছি বটে তবে বাস্তবে দেখিনি।

গিন্নির কথা রাখতে ওয়েটারকে এ মাছটি খাবারের তালিকায় রাখতে বললাম।

ওয়েটার কিছুক্ষণের মধ্যে অর্ডার মোতাবেক একে একে খাদ্যসম্ভার আনতে লাগল। বাচ্চারা তাদের পছন্দমাফিক খাবার পেয়ে খুশী। বিভিন্নপ্রকার খাবারের মৌ মৌ গন্ধ ছড়াচ্ছে বিস্তৃত এই হলরুমে। সর্বশেষ আইটেম ”সামাক আল-গারস্” নিয়ে যখন ওয়েটার টেবিলে সাজালো তখন গিন্নীর চোখ ছানাবড়া। প্রায় দু’কিলো ওজনের এ মাছটি দেখতে অনেকটা মাংসখেকো পিরানহা মাছের মত। দাঁতগুলো অত্যন্ত ধারালো ও চোখ দু’টি আগুনের মত লাল। যেন মাছটি আমাদের দিকে তার ভৌতিক চেহারা দেখিয়ে হাসছে। গিন্নী ঈশারায় জানালো এ মাছটি তার পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়। ওয়েটারকে বললাম, বাচ্চারা এ মাছটি দেখে ভয় পাচ্ছে সুতরাং এ মাছের পরিবর্তে গাম্বুরী অথবা সুলেমানী মাছ নিয়ে আস।

ওয়েটার হাদের (যথাআজ্ঞা) বলে ফিরিয়ে নিয়ে গেল ”সামাক আল-গারস্” এবং পরিবর্তে কিছুক্ষণের মধ্যে বাচ্চাদের প্রিয় গাম্বুরী (লবষ্টার) ও আমাদের জন্য ফ্রাই করা সুলেমানী মাছ নিয়ে এল। সুলেমানী মাছটি দেখতে আমাদের দেশের মৃগেল মাছের মত সুতরাং গিন্নীর এবার আপত্তির কোন কারণ নেই। দু’জন মিলে গ্রোগ্রাসে ফ্রাই করা সুস্বাদু মাছটি খেয়ে আবারো প্রমাণ করলাম আমরা ভাতে মাছে বাঙালী।

ভোজনপর্ব শেষ করে ঢেকুর তুলতে তুলতে কেবিনে ফিরে এলাম। বাচ্চারা তাদের কেবিনে টিভিতে কার্টুন দেখার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আর এদিকে আমরা বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম খাদ্যগুলো হজম করার তাড়নায়।

সৌদি টিভি স্ক্রীন খুললে যে ভয়ানক খবরটি প্রচারিত হল তা হল ইরিত্রিয়া ও সুদানের মরুভূমি হতে মেঘসদৃশ ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল সৌদিআরবের দিকে ধেয়ে আসছে। সৌদি বিমানবহরের কয়েকটি বিমান ইতোমধ্যে কীটনাশক ঔষধ নিয়ে পঙ্গপাল নিধন ও ঠেকানোর উদ্দেশ্যে আকাশে ওড়াল দিয়েছে এবং কীটনাশক ঔষধ ছড়াচ্ছে। জনসাধারণকে ভীত না হতে এবং ঘরবাড়ির দরজা জানালা লাগিয়ে ঘরের মধ্যে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী দু’দিন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

উৎকন্ঠায় রাত কাটলো। পরদিন সকালে লোহিত বক্ষে কোটি কোটি মৃত পঙ্গপাল ভেসে থাকতে দেখা গেল। বুঝতে পারলাম সৌদি বিমানবহরের কীটনাশক ঔষধ ছিটানোতে সামান্য হলেও কাজ হয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও যথেষ্ট বিপদ আছে। বিমানের ইঞ্জিন কক্ষে যদি পঙ্গপালের দল ঢুকে পড়ে তাহলে বিমান দূর্ঘটনায় আক্রান্ত হতে পারে। তাই বিমানবহর যথাসম্ভব নিচে অবস্থান করে পাহাড়সম পঙ্গপালের দল এড়িয়ে চলে।

আমাদের কেবিনের স্বচ্ছ কাঁচের জানালায় অসংখ্য আহত পঙ্গপালকে বসে থাকতে দেখলাম। যেদিকে তাকাই সেদিকে বড় খয়ারী রংয়ের ঘাসফড়িং সদৃশ পঙ্গপালের উপস্থিতি। আকাশের কোল ঘেষে লক্ষ-কোটি পঙ্গপাল কালো মেঘের মত সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসছে সৌদিআরবের দিকে। কিছু অংশ ইয়েমেনের দিকেও যাচ্ছে। এমন মহাবিপদে টিভির পর্দায় এবং মসজিদে মসজিদে সৃষ্টিকর্তা সমীপে প্রার্থনা চলছে।

জাহাজের সাইরেন বেজে উঠলো। মহাবিপদ সংকেত কারণ পঙ্গপাল যেদিকে যায় সব ধরণের লতাপাতা, ফলফলাদি, ক্ষেতখামার মূহুর্তে খেয়ে নিঃশেষ করে দেয়। গাছপালা পাতাশূন্য হয়ে কঙ্কালসদৃশ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। এমনকি ঘাস পর্যন্ত বাদ যায়না। সুতীক্ষ তাদের দাঁত, মানুষের গায়ে বসলে ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকে সবুজ ঘাসফড়িংয়ের মত। সৌদিআরব পেরিয়ে হাজার হাজার মাইল দুরে তারা বিভিন্ন দেশ প্রদক্ষিণ করবে এবং সাবাড় করবে তৃণলতা, ফসলাদি। ওরা আর কখনো পিছন ফিরবেনা। যেতে যেতে পথে প্রান্তরে মারা পড়বে। জীবিত পঙ্গপালের দল একসময় মাটিতে নেমে আসে। তৃণলতা খেয়ে এমন ভারী হয় যে, দুরপাল্লায় ওড়ার শক্তি ওদের রহিত হয় এবং মানুষের পায়ে পায়ে এবং পশুপাখী খেয়ে ওদেরকে একসময় শেষ করে দেয়।

সন্ধ্যা নামলো। আমরা কেবিন হতে কেউ বের হইনি। বাইরে পঙ্গপালের উৎপাত। অগত্যা টিভি-তে খবরের চ্যানেলে আটকে থাকতে থাকতে একসময় রাত গভীর হল। আধা বাঁকা চাঁদ ও লক্ষ কোটি তারাদের ঝলমল উপস্থিতি আকাশের নীল আঙ্গিনায়। ইচ্ছে হচ্ছে কেবিনের বাইরে ডেকে বসে রাতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করি। কেবিনের কাঁচের জানালায় একটি একটি করে আঁচড়ে পড়ছে উৎসুক পঙ্গপাল আলোর আকর্ষণে। ভিতরের আলো নিবিয়ে দিলাম। বাচ্চাদের কেবিনে আলো জ¦লছে। ওদেরকে চিৎকার করে বললাম জানালার পর্দা টেনে নিতে যাতে আলো বাহিরে যেতে না পারে। কিন্তু এ নির্দেশে ওরা সাড়া দিলনা বরং তাদের কাছে পঙ্গপাল জানালার স্বচ্ছ কাঁচে ধাক্কা খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য অনেক আনন্দের।

মনে পড়ল মিশরে ফেরাউন রাজাদের কথা। সৃষ্টিকর্তা ফেরাউনের রাজত্বে একসময় পঙ্গপাল পাঠিয়ে শাস্তি দিয়েছিলেন। আরও মনে পড়ে ১৫০০ বছর পূর্বে ইয়েমেনের জালীম বাদশাহ আব্রাহার কথা। মক্কায় আল্লাহর পবিত্র ঘর কা’বা ধ্বংস করতে এসেছিল হস্তীবাহিনী নিয়ে কিন্তু মক্কার অদুরে পৌঁছতেই পঙ্গপাল সদৃশ আবাবীল পাখীর ঝাঁক তাদের ছোট্ট ঠোঁটে করে হস্তীবাহিনীর উপর প্রবল ভাবে কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিল যার ফলে খড়খুটোর মত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আব্রাহা বাহিনী। আজও সেখানে হাতীর আকৃতিতে বড় বড় পাথর স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে বিদ্যমান।

ভোরের আকাশে রক্তিম সূর্য্য আলো ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে নূতন দিনের আগমনের সংকেত। সকাল ৮.০০ ঘটিকার মধ্যে আমাদের জাহাজটি জেদ্দা নৌবন্দরে নোঙ্গর করার কথা রয়েছে। লোহিত বক্ষ হতে স্বচ্ছ কাঁচের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসা লোহিত পাড়ের বিশাল বিশাল অট্টালিকার সারি। লোহিত বধূ জেদ্দার অপরূপ দৃশ্য ক্রমেই দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। জাহাজটি ভেপু বাজিয়ে ক্রমেই বন্দরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর সাবধান করে দিচ্ছে সামনে যাতে কেউ ভুলে না এসে পড়ে।

জাহাজটি নোঙ্গর করতেই কেবিন হতে আমরা নিচে নেমে এলাম। জাহাজের পাটাতন পেরিয়ে বন্দর অফিসে ঢুকতেই লাইনে দাঁড়াতে হল। ইমগ্রেশনে পাসপোর্টে সিলমোহর লাগিয়ে কাষ্টমস্ কর্তৃপক্ষের সামনে আমাদের হ্যান্ডব্যাগগুলো রাখতেই কাষ্টমস্ কর্মকর্তা বাংলাদেশী পরিবার জেনে কোন পরীক্ষা ছাড়াই ব্যাগে চক দিয়ে মাকিং করে যেতে বললেন। জাহাজের পাটাতনে এবং পোর্ট বারান্দায় মৃত ও অর্ধমৃত পঙ্গপালের ছড়াছড়ি। জানিনা শহরের গাছপালার কি অবস্থা ?

একটা হলুদ রংয়ের টয়েটা ক্রেসিডা ট্যাক্সিকে ঈশারা করতেই কাছে এসে দাঁড়ালো। জেদ্দা শহরের মেইন রাস্তা জুড়ে অসংখ্য নিমগাছের সারি। দেখলাম, এই নিমগাছগুলো অক্ষত আছে। পঙ্গপালের ধ্বংসযজ্ঞের শিকার অন্যান্য জাতের গাছগুলো কঙ্কালসার দেহ নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় কোনরকম দাঁড়িয়ে আছে। তেতো নিমের পাতা পঙ্গপালের পছন্দ হয়নি তাই এ যাত্রায় নিমগাছগুলো রক্ষা পেল। রাস্তায় লক্ষ লক্ষ পঙ্গপাল মরে আছে গাড়ীর চাকায় পিষ্ট হয়ে।

বাসায় পৌঁছে বেলকনীতে লাগানো আমাদের অনেক সাধের মাধবী লতার গাছটির নিচে এসে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, সৌরভ ছড়াচ্ছে চারিদিকে একই গুচ্ছে গোলাপী ও সাদা ফুলগুলো রংয়ের পসরা সাজিয়ে। বারান্দার নেট জড়ানো থাকায় এ যাত্রায় রক্ষা পেলো আমাদের অতি যত্নের মাধবী লতার গাছটি।

ছেলেমেয়েরা তাদের ব্যাগ হতে মিশর হতে নিয়ে আসা স্মৃতিচিহ্নগুলো নিয়ে মেতে আছে আর আমি মাধবীলতার গাছটি পঙ্গপালের আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়ার খুশীতে একগুচ্ছ ফুল ছিড়ে গিন্নীর খোঁপায় গুজে দিলাম, কাঁধে মাথা রেখে গিন্নী বলল, সারাজীবন এভাবে ভালবাসবেতো ?

শুধুই কি আমি ? আমার অধিকারের প্রশ্নে সবসময় তোমার কার্যকরী ভূমিকা থাকবেতো ?

তুমি কি কোনদিন বুড়ো হবেনা? সবতো উজার করে দিয়েছি,আর কি চাই বল ?

দ্যাখো, প্রমথ চৌধুরীর ”যৌবনে দাও রাজটিকা” প্রবন্ধটি পড়নি? আমাদের বাঙালী নারীরা ক’টা বাচ্চা দিয়েই নিজেকে বুড়ো বলে ভাবতে শুরু করে যদিও তার অঙ্গের তখনকার সুষমা নিজেকে বুড়ো ভাবার বাসনাকে অস্বীকার করে। বুড়ো হয় তনু, মন নয়, বুঝেছ? আর মন যতদিন সজীব থাকবে ততদিন দাম্পত্যজীবনের ভালবাসা নিত্যনূতন পসরা সাজিয়ে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত বিরাজ করবে বিভিন্ন আঙ্গিকে।

আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার থেকে আর বুড়ো কথাটি নিজেদের জীবন থেকে ডিলিট করে দেব।ভাববো আমরা আছি,যৌবনের শেষ প্রান্তে এসেও সুখদুঃখের ভাগিদার হয়ে এ ধরায় বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করবো। হলতো?

হ্যাঁ, এবার যথার্থই বলেছ। কথা দিচ্ছি আগামীতে তোমাকে নিয়ে পশ্চিম ইউরোপ বেড়াতে যাব ’সিনজেন ষ্টেটগুলোর” সব’কটিতেই। ফুল দিয়ে আসব ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর জেনারেল স্যার ওয়াল্টার র‌্যালের বিরহিনী পত্নী এলিজাবেথের কবরে। যে মহিলা তার নিহত স্বামীর ছিন্ন মস্তক দীর্ঘ আটাশ বছর একটি সোনার পাত্রে বরফ মাখিয়ে রেখেছিল। সময়ে অসময়ে সে মস্তক ফ্রিজ হতে বের করে আনতো আর অপলক নয়নে চেয়ে থাকতো। চোখ বেয়ে নেমে আসতো অঝর ধারায় অশ্রুর বন্যা। একটানা ঊনত্রিশ বছর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ নারী তার স্বামীকে এভাবে স্মরণ করেছিল। এলিজাবেথ বুড়ো হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল বটে কিন্তু স্বামীর প্রতি তার নিখাদ ভালবাসার কথা আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা রয়েছে। আমার যদি এমনটি হয় তাহলে কবরপাশে গিয়ে দোয়া করবে যাতে সৃষ্টিকর্তা সকল গোনাহ মাফ করে স্বর্গলোকে আরোহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করেন।

এটা বলছ কেন? তুমি আগে গেলে সুনিশ্চিত আমি পেছনে তোমাকে অনুসরণ করব যাতে স্বর্গালোকে ”স্বর্গ-সহেলী” হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে তোমার নিখাদ ভালবাসা পেতে পারি।

তাহলে কথা দিচ্ছি তোমাকে নিয়ে একটি কাব্যগ্রন্থ অচিরেই রচনা করব যেটির নাম হবে ”স্বর্গ-সহেলী”, বুঝলে গিন্নী।   

আর আমি অবশ্যই একটি উপন্যাসে হাত দেব যার নাম হবে ”এমন একটি ভালবাসা”। আশা করি তোমার কাব্যগ্রন্থ লিখার আগেই আমারটি শেষ হবে।

তাহলে আর দেরী কেন? কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়েই শুরু হবে আমাদের কথা দেয়া-নেয়ার সকল আয়োজন।এবার চল ঘরটা একটু গুছিয়ে নেই।  

                              =============


লেখক পরিচিতিঃ

জন্মঃ নভেম্বর ১৯৪৯ সাল।

পৈতৃক নিবাসঃ বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জে।

শিক্ষাজীবনঃ হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজ ও চট্ট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

চাকুরীজীবনঃ বাংলাদেশে সরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা (১৯৭২-১৯৮০), 

১৯৮০ সালে সৌদিআরবের জেদ্দায় একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা

 হিসাবে যোগদান (১৯৮০-২০০২)

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ

ক)দুঃস্বপ্নের পদচিহ্ন  (ছোটগল্প সংকলন), খ)ইউরোপে সতেরো দিন (ভ্রমন কাহিনী),

 বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ঢাকা বাংলাদেশ।

গ)মুখোশের অন্তরালে (২০১৪ সালের জরিপে শ্রেষ্ট ১০টি গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের মুখোশ

 উন্মোচন), প্রজন্ম পাবলিকেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।

প্রকাশিতব্য গ্রন্থসমূহঃ

ক) অভিশপ্ত নিলয় (উপন্যাস),  খ) জীবন জিজ্ঞাসা (গবেষণামূলক), গ) লোহিতের 

তীরে (ভ্রমণ কাহিনী) ঘ) ফেরারী (উপন্যাস)  ঙ) সিআইএ - মোসাদঃ একই বৃন্তে দু’টো 

ফুল  চ) স্বর্গ-সহেলী (কাব্যগ্রন্থ)

সম্পাদনা, অংশগ্রহণ ও সাক্ষাৎকারঃ

সৌদিআরবের জেদ্দা হতে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ”সম্প্রীতি”সাহিত্য সাময়িকী (১৯৯০-২০০২)

সাক্ষাৎকার ও অংশগ্রহণঃ

ক) বিবিসি রেডিওর বাংলা অনুষ্ঠানে - সাক্ষাৎকার (১৯৯৮ সালের ১৮ই মে),

খ)সৌদিআরবের ইংরেজী জাতীয় দৈনিক ”সৌদি গ্যাজেট, ১৩ জানুয়ারী’ ১৯৯৯

 - সাক্ষাৎকার। 

গ) আসামের শিলচর রেডিও (২১ শে জানুয়ারী, ২০১৭) - সাক্ষাৎকার। 

ঘ) ভারতীয় ঈষাণ বাংলা ও এম সি এন টিভি নেটওয়ার্ক (২৪ শে জানুয়ারী’২০১৭)-সাক্ষাৎকার।

আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণঃ

আসামের ”বরাক উপত্যকা আন্তর্জাতিক বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, ২৭ শে জানুয়ারী, ২০১৭ (বিশেষ অতিথ হিসাবে যোগদান ও স্ব-রচিত কবিতা আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ)।

 

মোবাইল/ওয়াটস্‌ এ্যাপে পেতে হলেঃ ৮৮০-১৭১১-০৭০৩৫৭