নিশীথের সুতনুকা সুতপা
-নাজমুল চৌধুরী
বিমানবন্দর থেকে টেক্সীক্যাবে সোজা কমলাপুর রেলষ্টেশন। ভাড়া মিটিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে টিকেট কাউন্টারের দিকে উৎকন্ঠিত মনে ছুটতে ছুটতে মনে হল টিকেট পাবতো? কি সর্বনাশ, ছ’টা বাজে, সোয়া ছ’টায় সিলেটগামী কালনী একপ্রেস ট্রেনটি এয়ারপোর্ট ষ্টেশন ছাড়ার কথা!
প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমান সিলেট অভিমুখী বেশ কিছু যাত্রীর পদচারণায় আশ্বস্থ হলাম। ক্ষীণ আশা নিয়ে টিকেট কাউন্টারে টিকেট চাইতেই প্রথমশ্রেণীর একটি কামড়ায় সিট পেয়েও গেলাম তবে ষ্টেশনমাষ্টার জানালেন খুলনা হতে আগত মালবাহী ট্রেনের একটি বগি টঙ্গী জংশনের আউটার সিগন্যালের কাছে লাইনচ্যুত হওয়ায় উদ্ধার অভিযান চলছে এবং এজন্য সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ষ্টেশন ছেড়ে যেতে তিনচারঘন্টা বিলম্ব হতে পারে।
অগত্যা বিশ্রামকক্ষে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার মত এক যাত্রীর আর কিইবা করার আছে। যাত্রীদের চোখেমুখে উদ্ধেগ, উৎকন্ঠা আর অপেক্ষার প্রহর গুণা। এরই মধ্যে স্থানীয় যাত্রীদের অনেকে টিকেট ফেরত দিয়ে নিজেদের বাসস্থানে ফিরে গেছে। প্ল্যটফর্মে সীমিত সংখ্যক মানুষের পদচারণা। প্রথমশ্রেণীর ওয়েটিংরুমে লাগেজ দু’টো রেখে বেতের সোফাটিতে গা এলিয়ে দেই। কমপক্ষে চারঘন্টা অপেক্ষা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মায়ের চাহিদানুযায়ী জিনিষগুলো কিনতে গিয়ে নিরীহ এ শরীরটার উপর কি দখলটাই না গেল বিগত কয়েকটি দিন।
চোখ বুজতেই একমাত্র ছোটবোন শান্তার সেই কোমল মুখচ্ছবি ভেসে উঠে মনের পর্দায়। প্রবাসের কর্মমূখর দিনগুলোর ফাঁকে কখন যে সে বেড়ে উঠেছে সেই লাল ফ্রক পরা ছোট্ট বোনটি! আশ্চর্য্য দ্রুত চলে টিকটিক সময়গুলো অথচ এই সেদিনও ওর নরম গালে নাক ডুবিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, প্রথম চাকুরী পেয়ে কি আনতে হবে তাড়াতাড়ি বল্? নাকের অত্যাচারে বিব্রত গোলাপী গালদু’টো মুছতে মুছতে বলতো, ছাড়ো বলছি, কিছুই আনতে হবেনা। জানি মুখ ফুটে বলবেনা কখনো। শেষপর্যন্ত ছোট্ট একটি চিরকুট গুজে দিয়েছিল আমার স্যুটকেসের এক কোণে। মেরুন কালারের থ্রি পিস এবং গলার জন্য সাদা রংয়ের ঝলমলে একটি পাথর সেট।
সেই ছোট্ট বোনটির বিয়ের সানাই অচিরেই বাজবে আর তাইতো ছুটে আসতে হল আগাম ছুটি নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে। ওর জন্য দু’হাত ভরে কিনেছি। শশুরবাড়ির লোকেরা দেখে নিশ্চয়ই ’থ’ বনে যাবে। যাবে না ? মেয়েপক্ষের ক’জন উপযাচক হয়ে এত দামী জিনিষ উপহার দেয়!
আরে নেয়াজভাই যে ? তুমি এখানে কোত্থেকে? চিন্তার বেড়াজাল চিহ্ন করে দেয় সামনে দন্ডায়মান সুন্দরী এক যুবতীর সুরেলা কন্ঠ। হ্যাঁ, আমাকেই উদ্দেশ্য করে বলল মেয়েটি।
তারপর কতকাল পরে বলতো ? কেমন আছ ? ঘনিষ্ট ভঙ্গিতে কাছ ঘেষে দাঁড়ায় তরুণীটি। ছিমছাম গড়ন, অভিজাত চেহারা। একরাশ লাবণ্য সারা অঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। মসৃণ গ্রীবা, উন্নত বক্ষযুগল, ক্ষীণ কটিদেশ আর স্যাম্পু করা আজানুলম্বিত একরাশ কালো চূলের ঝলকানি মিলে তরুণীটি সত্যিই অপরূপা। বিমূঢ় হয়ে মনের আর্শীতে খুঁজতে চেষ্ঠা করি অপরিচিতার মুখ।
একি, একেবারেই ভুলে গেলে ? ডানহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে গুণে গুণে আবারো বিস্ময়মাখানো সুরঃ মাত্র আট বছরের ব্যবধানে মন থেকে উধাও হয়ে গেলাম ?
দুঃখিত, আমি আপনাকে ........।
থাক, থাক হয়েছে। এখনো তোমার সেই স্বভাব যায়নি দেখছি। আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দরজায় অপেক্ষমান ভদ্রলোকের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, আসুন, পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হচ্ছেন আমাদের নেয়াজ ভাই। বিদেশে ভাল চাকুরী করছেন। আর নেয়াজভাই, ইনি হচ্ছেন ডাক্তার অমিতাভ, বিখ্যাত আই স্পেশালিষ্ট। নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। আমি উনার সহকারী, একই হাসপাতালে চাকুরী করছি।
একটুকরো গর্বিত হাসি উপহার দিয়ে ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দেন সৌজন্য বিনিময়ে। তরুণীটি মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলল - ট্রেনেরতো অনেক দেরী। তাছাড়া প্রথমশ্রেণীর এই ওয়েটিংরুমে আমরা মাত্র তিনটি প্রাণী। কফি হলে জমবে ভাল, কি বল ?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই একলাফে তরুণীটি বেরিয়ে পড়ল কাছাকাছি ষ্টেশনের কোন এক কফি শপের উদ্দেশ্যে।
ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে বলি, সত্যি বলতে কি আমি আ-স-লে......।
সুতপার সাথে ছাত্রজীবন থেকেই বুঝি পরিচয় ? আমার শুরু করা কথা শেষ না হতেই উত্তরের অপেক্ষায় ডাক্তার অমিতাভ।
কথার খেই যেন হারিয়ে ফেলেছি। আবারো কিছু বলতে গিয়ে হ্যাঁ না-র মাঝামাঝি একটি শব্দ বেরিয়ে আসে যা অস্পষ্ট, আড়ষ্ট।
চিনতে পারছিলেন না বুঝি ? পৌঢ় ডাঃ অমিতাভ ডাক্তারী চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন আমাকে। দৃষ্টির প্রখরতা আমাকে যেন চূলছেড়া বিশ্লেষণ করছে। সুতপা নামক তরুণীটির দুর্বলতার কোন আঁচড় অতীতে আমার মনোজগতকে কখনো প্রভাবিত করতে পেরেছিল কিনা তারই প্রতিফলন হয়তো দেখতে চাচ্ছেন ডাক্তার।
ইচ্ছে হল জানিয়ে দেই পরিচয়ের অজ্ঞতার কথা কিন্তু ততক্ষণে কৌতুহলের ভূত মাথায় চেপেছে । দেখা যাক - জল কতটুকু গড়ায় ? বলে উঠিঃ না, ঠিক সেটা নয়, অনেকদিন পরে দেখাতো, তাছাড়া একটু অন্যমনস্ক হওয়াতে .... বাকীটুকু বিজ্ঞের হাসিতে সমাপ্ত করলাম।
ওহ, আই সি ....।
সুতপা ফিরে আসে। পেছনে ট্রে হাতে বেয়ারা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সুতপা মেলে ধরে তার আর তথাকথিত নেয়াজভাইয়ের অলিখিত ইতিহাসের কিছুটা অধ্যায়।
আড়চোখে পরখ করি ডাঃ অমিতাভের অভিব্যক্তি। না, সেই অলিখিত ইতিহাসে কোন আগ্রহ নেই ভদ্রলোকের। টিসু দিয়ে ঝাপসা চশমার গ্লাস পরিষ্কারে ব্যস্ত তিনি। দৃষ্টি প্ল্যটফর্মের ফেরীওয়ালাদের দিকে নিবদ্ধ।
জানো নেয়াজভাই, তোমরা বদলি হয়ে অন্যত্র যখন চলে গেলে তারপর আমার জীবনের মোড়টা কেমন করে যে ঘুরে গেল। হঠাৎ বাবা মারা গেলেন একরকম বিনা চিকিৎসায়। মা গত হলেন বাবার দু’বছর পূর্বেই। সিদ্ধান্ত নিলাম মানুষের সেবা করে এ দুঃখটাকে ভুলব। ডিগ্রির পাশাপাশি নার্সিং ডিপ্লোমাও নিলাম মনের ক্ষত নিরসনে। মা বাবার অকাল মৃত্যুর স্মৃতি শেষপর্যন্ত হাসপাতালের চাকুরীর দিকে ধাবিত করল। চাকুরীর শুরু হতে ডাঃ অমিতাভের সহকারী হিসাবে আছি। কাল সিলেটে একটি বড়ধরণের চোখ অপারেশন করতে স্যারের সাথে যাচ্ছি। স্যার আমাকে শুধু সহকারী হিসাবে দেখেননা, মেয়ের মতই ভালবাসেন।
সহানুভূতি উপচে ওঠে আমার সমগ্র অন্তর জুড়ে। সত্য উদঘাটন করে আত্মপরিচয় তুলে ধরি সে শক্তিটুকু সুতপার কথার যাদুস্পর্শে কোথায় যেন রহিত হল। কেন বলতে পারছিনা ওকে, তোমার কল্পিত নেয়াজভাই আমি নই, আমি এক ভিন্ন সত্ত্বা।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে সময়ের হাত ধরে। রাতের আকাশে তারার মেলা। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে জ¦লমল তারাগুলো হাসছে আকাশের নীল সামিয়ানায়। নিস্তব্ধ রাতের এই প্রহরে প্রাণোচ্ছ্বাস সুতপা তার ষোলকলা মেলে আমাকে এক অনুরাগের আকর্ষণে বন্দী করেছে।
প্রায় পাঁচঘন্টা পর ট্রেন এল। প্রথমশ্রেণীর একটি কেবিনে ওঠে পড়ে ডাঃ অমিতাভ ও সুতপা। দরজা খুলে সুতপা আমাকে আহ্বান জানায়। উঠে পড় নেয়াজভাই, এটা আমাদের রিজার্ভড্ কামরা। বুঝতেই পারছ আজকাল রাতে ভ্রমণ কতটা ঝুকিপূর্ণ। তাইতো স্যার কেবিনটা রিজার্ভ করে রেখেছিলেন আগেভাগেই। সাথে তোমার দু’টো বিদেশী স্যুটকেস। আমাদের কামড়ায় তুমি অনেকটা নিরাপদ থাকবে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে - তাছাড়া তোমার সাথে অনেক কথা জমে আছে। তোমার কথা ভেবে ভেবে আমার কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে, একসময় ভেবেছি যাকে নিয়ে এতো ভাবনা সেতো নাগালের বাইরে। মা তোমাকে কত ভালবাসতেন তা তুমি জান। মৃত্যুর পূর্বে তোমাকে দেখতে চেয়েছিলেন বারবার কিন্তু সে দেখা তার আর হলনা।
ইতস্ততা কাটিয়ে উঠে পড়লাম যদিও প্রথমশ্রেণীর অন্য একটি কামড়ায় আমার নির্দিষ্ট আসন রয়েছে। সুতপা লাগেজ দু’টো টেনে তুলতে আমাকে সাহায্য করে। কিছুক্ষণের মধ্যে এক্সপ্রেস ট্রেনটি খটাস খটাস শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে ছুটতে শুরু করল। কোথাও ফুটে থাকা হাস্নাহেনার মতমাতানো সৌরভ ট্রেনের সরু জানালাপথে আমাদের কেবিনে প্রবেশ করে পরিবেশকে আরও রোমান্টিক করে দিল।
রাত ক্রমেই গভীর হচ্ছে। তদ্রাচ্ছন্ন ডাঃ অমিতাভ হাই তুলে বললেন আমি আর পারছিনা। আপনারা গল্প করুন এবং কিছু মনে না করলে আমি উপরের সিটে একটু বিশ্রামের আয়োজন করি। অনুমতির অপেক্ষা না করেই তার ফোল্ডিং বিছানা মেলে আমাদের ঠিক উপরে লাগেজের সিটে শোবার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
বিনয় মিশিয়ে বলি, না মনে করব কেন ? ধকলতো আর কম গেলনা। আপনি শুয়ে পড়ুন, আমরা গল্পগুজব করে রাতটা কাটিয়ে দেব। মনে মনে বলি, ডাক্তার তুমি ঘুমিয়ে পড়লে আমি কত যে খুশী হই। দেরী করছ কেন, যত্ত পার ঘুমাও, নাক ডাকিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও।
সুতপার দিকে তাকিয়ে ঈশারায় বুঝালাম ভালই হল। মুচকী হাসিতে উদ্ভাসিত সুতপার চোখেমুখে একই অভিব্যক্তি। তারপর দশমিনিটের মত শুনশান নীরবতা। আমরা দু’জন দু’জনার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি, চারচোখের অপলক দৃষ্টি প্রবল অনুরাগের বিকশিত কাননে সুষমা ছড়ায়। বাইরে জ্যোৎস্নার প্লাবন। নীলাকাশ জুড়ে অযুত নক্ষত্রের দীপালী। ট্রেনের সীমিত জানালাপথে ভেসে আসছে ধানী জমিতে খড়পোড়া ধোঁয়ার তীব্র গন্ধ। প্রবাসের কত জ্যোৎস্মামাখা রাতের নিস্তব্ধ প্রহরে একাকী ভালবাসার ডালি সাজিয়ে কল্পনার মানসীকে আহ্বান জানিয়েছি গানে গানে, সে সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে বাতাসের ইথারে কিন্তু আমার মানসকন্যা জ্যোৎস্নার খোলস ভেদ করে আমার কাছে এসে বলেনিঃ এইতো আমি, হাত বাড়িয়ে নাওনা বুকের গভীরে ....।
এবার কতদিনের প্রোগ্রাম নিয়ে দেশে ফিরেছ ? বিয়ের কথা ভাবছ? মৃদু কন্ঠে সুতপা জানতে চায়।
মাস দু’য়েক থাকব। ছোটবোন শান্তার পরইতো আমার সিরিয়াল। তেমন কিছু ঘটলে আরও দু’মাস বাড়িয়ে দিতে পারি। হ্যাঁ, ভাবতেতো হবেই, আর কতকাল সন্যাসব্রত পালন করব বল ?
দু’টো স্যুটকেসে এত কি এনেছ ? সব প্রবাসীদের এই একই বাতিক, দেশে আসতে গেলে দু’তিনটি লাগেজ থাকতেই হবে। কেন, খালি হাতে আসতে পারনা ? বাংলাদেশে কিনা পাওয়া যায় বল ?
একমাত্র ছোটবোন শান্তার আসন্ন বিয়ে উপলক্ষে আসতে হল। ওর জন্য ইচ্ছেমত কিনেছি। ভারী হীরের সেট ছাড়াও অসংখ্য নামীদামী ব্রান্ডের উপহারসামগ্রী। তাছাড়া ওর শশুড়বাড়ির লোক এবং ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজনদের কেউ বোধহয় বাদ যাবেনা। মনের মাধুরী মিশিয়ে দু’হাতে কিনেছি, হিসেব করিনি। যাক্ - শুধু নিজের কেনাকেটার কথাই বলে যাচ্ছি। তুমিতো ফুটে আাছ, বিয়ের ফুল ফুটেনি কেন জানতে পারি?
তোমার মত একজনকে পাইনি বলে ? অপেক্ষার প্রহর গুণেছি। কেন যেন মনে হয়েছিল একদিন না একদিন তোমার দেখা পাব। ছোটবেলায় জ্যোৎস্না রাতে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে দুষ্টামী করে তুমিই প্রস্তাব দিয়েছিলে আমাকে নিয়ে রাজা রাণী খেলতে চাও, কি মনে নেই? তুমি তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী আর আমি তখন সবেমাত্র এইটের ছাত্রী। মেয়েরা যে এইট-নাইনে পড়তেই ইঁচড়েপাঁকা হয়ে যায়। সেদিন থেকে তোমাকে আমার হৃদয়সিংহাসনের সম্রাট বলে ভাবতে শুরু করেছিলাম। লজ্জ্বারাঙ্গা সুতপা মুখায়োববে আবীরের রং ছড়িয়ে বলে, কি - এখনো আমাকে রাণী সাজাতে স্বাধ জাগে?
উত্তরের ভাষা আমার জানা নেই কারণ সুতপা নামক কোন মেয়ে আমার শৈশবের খেলার সাথী কখনো ছিলনা কিংবা আমি ওর কল্পিত নেয়াজভাইও নই। তাহলে কি সত্যিটা প্রকাশ করে দেব ? না, তা হয়না। সেটা করলে এ মূহুর্তে আমার সকল অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। সুতপা কষ্ট পাবে। তারচেয়ে এই ভাল শান্তার বিয়ের পালা সেরে সুতপাকে টেনে হিঁচড়ে মায়ের কাছে নিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে সত্যটা প্রকাশ করব। সুতপা নিশ্চয়ই আমার মত একজনকে পেলে খুশীই হবে। মেনে নিবে অকাতরে।
গাঢ় ঘুমে ডাঃ অমিতাভের নাক ডাকছে জ্যান্ত ষাড়ের ন্যায়। পাশে উপবিষ্ট সুতপা। শত শাসন উপেক্ষা করে নিজের অজান্তে ওর কোমল মসৃণ হাতটি টেনে নিলাম আমার হাতের মুঠোয়। মুখের কথাগুলো কন্ঠনালীতে আটকা পড়ে আকুলি-বিকুলি করছে। স্পষ্ট শুনতে পারছি ওর বুকের গভীরে হৃৎপিন্ডের স্পন্দন। কাঁপছে তার দেহবল্লরী। কোমল হাতটি ছাড়িয়ে নিতে ওর কোন ইচ্ছা নেই বরং আত্মসমর্পনের উচ্ছ্বাস নিয়ে ক্রমেই সে এলিয়ে পড়ে আমার বাহুডোরে। বাতাসে ওর খুচরো চূলগুলো আমার গলা পেঁচিয়ে আছে। এ মূহুর্তে সুতপা একান্তই আমার আর আমি ওর হারিয়ে যাওয়া নেয়াজভাই, এরচেয়ে বেশীকিছু আমি জানতে চাইনা।
এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানিনা। সুতপার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমার কাঁধে এলিয়ে পড়া ওর কপোলে আলতো একটি চুম্বন এঁকে দিয়ে বলি, চানাচুর খাবে ? শুকনো মুখে আর কত বকবক করব।
না, বড্ড ঘুম পাচ্ছে, রাত চারটা বাজে।
এমন স্বপ্নালু রাতে কি ঘুমিয়ে কাটানো উচিত?
একসময় সুতপা আমার হাতের মুঠো থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসে। ব্যথা পেলাম। ওর যেন কোন অধিকার নেই নিজেকে সরিয়ে নেবার। হাই তুলে পুনরায় বলল, তুমি শুয়ে পড়। আমি তোমার চূলে বিলি কেটে দিচ্ছি।
চূলে বিলি কেটে দেবার প্রবল লোভ আমাকে স্থির থাকতে দিলনা। পরণের জ্যাকেটকে বালিশ বানিয়ে এক মূহুর্ত দেরী না করে শুয়ে পড়লাম ওর সুডৌল উরুতে। ওর মসৃণ আঙুলের সেবা পাওয়ার এক প্রবল নেশা আমার নাদুস নুদুস দেহের কোষে কোষে নূতন করে উন্মাদনা ছড়ায়।
সুতপার কোমল আঙুল আমার চূলের গভীরে। বুদ হয়ে নেশাগ্রস্থের মত পড়ে রইলাম। এ আমার পরম সৌভাগ্য। এত সুখ এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল ? তৃপ্তির মহানন্দে আমি বাকহারা, শিরায় শিরায় শিহরণ জাগানো আবেশের মুগ্ধতায় আমি ধন্য। ওর হ্যান্ডব্যাগ হতে ছোট্ট একটি সেন্টের শিশি বের করে পরম আদরে আমার মুখমন্ডলে মাখিয়ে দেয়। বাতাসে ভেসে আসা ট্রেনের ডিজেল পোড়া প্রকট গন্ধ আমাদের উভয়ের সান্নিধ্যকে যেন ব্যহত করতে না পারে তারজন্য হয়তো এ আয়োজন। আমার নাসারন্দ্রে সেন্টের প্রকট গন্ধে কিছুক্ষণের মধ্যে মগজে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে, ঘুমের আবেশে দু’চোখ মুদে আসে ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানিনা। ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকে যখন ঘুম ভাঙলো তখন একফালি রোদ জানালা ভেদ করে চোখেমুখে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। হকচকিয়ে উঠে বসে নিশীথের সুতনুকা সুতপা এবং ডাক্তার অমিতাভের অস্থিত্ব উপলব্ধির চেষ্ঠা করলাম কিন্তু কামড়াতে আমি ছাড়া কারোর অস্থিত্ব নেই। একপ্রেস ট্রেনটি ততক্ষণে শ্রীমঙ্গল ষ্টেশন ছেড়ে খটাস খটাস শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে এগিয়ে চলছে গন্থব্যের সন্ধানে। মেঝেতে রাখা আমার দু’টো স্যুটকেসের অস্থিত্ব খুঁজে পেলামনা। বালিশ বানিয়ে ঘুমুতে যাওয়া জ্যাকেটে সংরক্ষিত মানিব্যাগটিও যথাস্থানে নেই।
ঘটনার আকস্মিকতায় চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বহমান বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম প্রাণ ভরে, সে নিঃশ্বাসে ছিলনা বৈষয়িক কিছু হারানোর বেদনা, ছিল বিশ্বাসের বেদীমূলে ঠুকরানো একরাশ যাতনা।
**************************